সুলতান সুজার নৌবহর
সুলতান সুজার নৌবহর গঙ্গার স্রোত বাহিয়া আসিয়াছিল; তাঁহার স্থলসৈন্য—পিয়াদা ও সওয়ার গঙ্গার তীর ধরিয়া অগ্রসর হইতেছিল। নৌকায় স্বয়ং সুজা ছিলেন, তাঁহার অগণিত নারীপূর্ণ হারেম ছিল, আর ছিল বড় বড় কামান গোলা বারুদ। যে কয়জন আমীর এখনও তাঁহার সংসর্গ ত্যাগ করেন নাই তাঁহারাও নৌকায় ছিলেন।
মুঙ্গেরে অবতীর্ণ হইয়া সুজা কেল্লার মধ্যে ফৌজদারের বাসভবনে অধিষ্ঠিত হইলেন। দুর্গের পশ্চিমভাগে উচ্চভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত দুইটি বড় বড় মহল; একটিতে সুজার হারেম রহিল, অপরটি তাঁহার দরবার ও মন্ত্রণাগৃহে পরিণত হইল। সুজার প্রধান উজির আলিবর্দি খাঁর জন্যও উৎকৃষ্ট বাসভবন নির্দিষ্ট হইল। আলিবর্দি খাঁ সুজার অতিশয় প্রিয়পাত্র ছিলেন, সুজা আদর করিয়া তাঁহাকে খান্ ভাই বলিয়া ডাকিতেন! তিনি করণ-চূড়া নামক কেল্লার উত্তরভাগের একটি সুন্দর শৈলগৃহ অধিকার করিলেন। সৈন্যদল মাঠে ময়দানে তাম্বু ফেলিল; কতক নৌকায় রহিল।
মুঙ্গেরে পৌঁছিয়া সুলতান সুজা একদণ্ডও বৃথা কালক্ষয় করিলেন না, প্রবল উৎসাহে দুর্গসংস্কার আরম্ভ করিয়া দিলেন। পাটনা হইতে আসিবার পথে তিনি স্থির করিয়াছিলেন, মুঙ্গেরের দুর্ধর্ষ দুর্গেই তাঁহার শক্তির কেন্দ্র রচনা করিবেন। যদিও রাজমহল তাঁহার রাজধানী, তবু রাজমহল আগ্রা হইতে অনেক দূর; মুঙ্গের অপেক্ষাকৃত নিকট। যাঁহার দৃষ্টি ময়ূর সিংহাসনের উপর নিবদ্ধ তাঁহার পক্ষে রাজমহল বা ঢাকা অপেক্ষা মুঙ্গেরে ঘাঁটি তৈয়ার করিবার ইচ্ছাই স্বাভাবিক। সুজার আদেশে ও তত্ত্বাবধানে কেল্লার প্রাকার মেরামত হইতে লাগিল, পরিখা আরও গভীরভাবে খনন করিয়া গঙ্গার ধারার সহিত তাহার নিত্যসংযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা হইল। দুর্গপ্রাকারের বুরুজের উপর বড় বড় কামান বসিল। সুজা অশ্বপৃষ্ঠে চারিদিকের বিপুল কর্মতৎপরতা তদারক করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। সুজার সঙ্গী-সাথীরা তাঁহার এই অপ্রত্যাশিত কমোৎসাহ দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। যাঁহারা বুদ্ধিমান তাঁহাদের সন্দেহ দূর হইল, সুজা কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঔরংজেবকে অনুকরণ করিবার চেষ্টা করিতেছেন।
একচল্লিশ বছর বয়সে সুজার চরিত্র সংশোধনের আর উপায় ছিল না। তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমান ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘকালব্যাপী ব্যসনাসক্তি তাঁহার বুদ্ধি ও দেহের উপর জড়তার প্রলেপ মাখাইয়া দিয়াছিল। তৈমুরবংশের রক্তে তিনটি প্রধান উপাদান—বিবেকহীন উচ্চাশা, অদম্য ভোগলিঙ্গা এবং কুটিল নৃশংসতা। সকল মোগল সম্রাটের মধ্যেই এই প্রবৃত্তিগুলি অম্লাধিক অনুপাতে বিদ্যমান ছিল। সুজার জীবনে ভোগলিপ্সাই প্রধান হইয়া উঠিয়াছিল।
কিন্তু তাই বলিয়া উচ্চাশাও তাঁহার কম ছিল না। মাঝে মাঝে তাহা খড়ের আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিত; তীব্র সর্পিল বুদ্ধি জড়ত্বের খোলস ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিত। কিন্তু তাহা ক্ষণিক। ঔরংজেবের ন্যায় লৌহদৃঢ় চিত্তবল তাঁহার ছিল না। আবার তিনি আলস্যে বিলাসে গা ভাসাইয়া দিতেন।
কিন্তু মুঙ্গেরে পৌঁছিয়া তিনি এমন বিপুল উদ্যমে কাজ আরম্ভ করিয়া দিলেন যে সাতদিনের মধ্যে জীর্ণ দুর্গের সংস্কার শেষ হইল। কেবল দুর্গ মেরামত করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হইলেন না, শত্রু যাহাতে দুর্গের কাছে না আসিতে পারে তাহার ব্যবস্থাও করিলেন। জলপথে অবশ্য সুজার কোনও ভয় ছিল না, কারণ সে-সময় বাংলার অধীশ্বর সুজা ভিন্ন আর কাহারও নৌবহর ছিল না। স্থলপথে মুঙ্গের আক্রমণের পথ পূর্ব ও দক্ষিণ হইতে; তাহাও গিরিশ্রেণীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। কিন্তু গিরিশ্রেণীর ফাঁকে ফাঁকে সৈন্য চালনার উপযোগী রন্ধ্র আছে। সুজা এই রন্ধ্রগুলি বড় বড় বাঁধ তুলিয়া বন্ধ করিয়া দিবার বন্দোবস্ত করিলেন। সুজা সত্যই রণপণ্ডিত ছিলেন, সুতরাং মুঙ্গের কেল্লা ও পারিপার্শ্বিক ভূমি সংরক্ষণের কোনই ত্রুটি রহিল না।
হাজার হাজার মজুর লাগিয়া গেল। পাহাড়ের ব্যবধানস্থলে উচ্চ জাঙ্গাল খাড়া হইল, তাহার মাথার উপর কামান বসিল। সুজা ঘোড়ার পিঠে সমস্ত পরিদর্শন করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। বন্ধু এবং উজির খান ভাই আলিবর্দি খাঁ সর্বদা তাঁহার সঙ্গে রহিলেন।
সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যার সময় সুজার মহলে দরবার বসিত। দরবার অবশ্য পাকা দরবার নয়, আদব কায়দার কড়াকড়ি ছিল না; অনেকটা মজলিসের মতো আসর বসিত, আলিবর্দি খাঁ, মিজা জান বেগ প্রমুখ কয়েকজন অন্তরঙ্গ পারিষদ আসিয়া বসিতেন। মখমল বিছানো বৃহৎ কক্ষে বহু তৈলদীপের আলোতে শিরাজি চলিত, হাস্য পরিহাস চলিত, কচিৎ মন্ত্রণা পরামর্শও হইত। রাত্রি যত গভীর হইত সুজা ততই মাতাল হইয়া পড়িতেন, কিন্তু পরদিন প্রাতঃকালে আবার তিনি অশ্বপৃষ্ঠে বাহির হইতেন। পারিষদেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিয়া ভাবিতেন, এভাবে আর কতদিন চলিবে।
এইভাবে একপক্ষ কাটিল।
একদিন সন্ধ্যার পর মজলিস বসিয়াছিল। সুজার হাতে শিরাজির পাত্র ছিল, তিনি ফৌজদারের পানে চাহিয়া বলিলেন, পীর পাহাড়ের দিকে কাজ কেমন চলছে?
ওদিকের কার্য-তত্ত্বাবধানের ভার ফৌজদার মহাশয়ের উপর ছিল, তিনি বলিলেন, ভালই চলছে জাঁহাপনা, ঘাঁটি প্রায় তৈরি হয়ে গেছে।
সুজা বলিলেন, বেশ, কাল ওদিকে তদারক করতে যাব।
স্ফটিকের পানপাত্র নিঃশেষ করিয়া তিনি বাঁদীর হাতে ফেরৎ দিলেন। কয়েকজন যুবতী বাঁদী শরাবের পাত্র, তাম্বুলের পেটি ও গোলাপজল ভরা গুলাবপাশ লইয়া মজলিসের পরিচর্যা করিতেছিল। সুজার ইঙ্গিতে একটি বাঁদী ফৌজদারের সম্মুখে পানের বাটা ধরিল। সম্মানিত ফৌজদার তসলিম করিয়া একটি তব-মোড়া পান তুলিয়া লইলেন।
শরাবের আর একটি পাত্র হাতে লইয়া সুজা বলিলেন, আমার শরাবের পুঁজি তো প্রায় ফুরিয়ে এল। ফৌজদার সাহেব, আপনাদের দেশে মদ পাওয়া যায় না?
ঈষৎ হাসিয়া ফৌজদার বলিলেন, পাওয়া যায় হজরৎ—তাড়ি।
সুজা প্রশ্ন করিলেন, তাড়ি? সে কি রকম জিনিস?
ফৌজদার বলিলেন, মন্দ জিনিস নয়। গ্রীষ্মকালে এদেশের ইতর-ভদ্র সকলেই খায়। স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ ভাল। কিন্তু বড় দুর্গন্ধ।
সুজা হাসিয়া বলিলেন, আন্দাজ হচ্ছে ফৌজদার সাহেব তাড়ি চেখে দেখেছেন।
ফৌজদার কহিলেন, জী। পুদিনার আরক একটু মিশিয়ে দিলে গন্ধ চাপা পড়ে—তখন মন্দ লাগে না।
ক্রমে রাত্রি হইল। সুজা কিংখাপের তাকিয়ার উপর এলাইয়া পড়িলেন, তাহার কথা জড়াইয়া আসিতে লাগিল। বাঁদীরা তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিল।
আলিবর্দি খাঁ বুঝিলেন, আজ রাত্রে সুজা হারেমে ফিরিবেন না। তিনি অন্য পারিষদবর্গকে চোখের ইশারা করিলেন, সকলে কুরনিশ করিয়া বিদায় হইলেন।
দরবারকক্ষের পদা-ঢাকা দ্বারের বাহিরে হাসী খোজারা লাঙ্গা তলোয়ার লইয়া পাহারা দিতেছে। তাহারা আমীরগণকে এত শীঘ্র বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়া নিঃশব্দে দাঁত বাহির করিয়া হাসিল। তাহারা পুরাতন ভৃত্য, প্রভুর স্বভাব-চরিত্র ভাল করিয়াই জানে।