ডোডো
বিল্টুর আজ একদিকে আনন্দ অন্য দিকে খুব দুঃখের দিন। আনন্দ এই জন্য কারণ তার বোনের আজ একবছর বয়সের জন্মদিন। আর, সে আজ প্রথমবার দাদার হাত ধরে এক পা দু পা হেঁটেছে।
আর দুঃখের এইজন্য তার পোষা কুকুর ডোডো আজ সকালে মারা গেছে।
ঘটনাটা একটু খুলেই বলি-
আজথেকে ঠিক একবছর আগে বিল্টুর বোন হয়েছে।সেইদিন বিল্টুদের বাড়ির পেছনে আম গাছের নিচে একটা কুকুর একটা বাচ্চা প্রসব করে মারা যায়। ছোট্ট বাচ্চাটা মৃত মায়ের কোলের কাছে তখনো দুধ খাওয়ার জন্য মা’র পেটের কাছে মুখ ঢুকিয়ে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে। বিল্টুর বাবা এই করুন দৃশ্য দেখে বাচ্চাটাকে নিজের ঘরে তুলে এনে ওকে চামচ করে দুধ খাইয়ে দেন। সেই থেকে ওই সারমেয় ওদের পরিবারের একজন হয়ে ওঠে।
আট বছরের বিল্টুরই এই বিষয় বেশি উৎসাহ।
ও বাচ্চাটার নাম রেখেছিল ডোডো।
বিল্টুর মা ওই সারমেয়টাকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। ডোডো যদি তার মেয়ের ধারে কাছেও আসতো উনি ডোডো কে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতেন। মা’র ডোডোর প্রতি এই ব্যবহার বিল্টুর মোটেই ভালো লাগতো না। কিন্তু ও তো ছোটো, কি বা করতে পারে, তাই চুপ করে থাকতো। সেদিন তো একটা ভীষণ কান্ড ঘটেগেল বাড়িতে। বোনের দুধের বোতল রেখে মা একটু রান্নাঘরে গেছে, বোন দুধের বোতলটা হাতের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
বোতলের মুখটা ভালো করে আটকানো ছিল না। বোতল উল্টে গিয়ে দুধ পড়েগেল। গরম দুধ বোনের দিকে গড়িয়ে আসছে দেখে ডোডো তাড়াতাড়ি বোনের জামা ধরে ওকে সরানোর চেষ্টা করছিল। এর মধ্যে মা ঘরে ঢুকে দেখে দুধ উল্টে পড়ে আছে, আর ডোডো মেয়ের জামা কামড়ে ধরে টানাটানি করছে। এই দৃশ্য দেখে মা’র মাথায় রক্ত উঠে গেলো।মা ভাবলো ডোডোই দুধ ফেলে দিয়েছে আর তার মেয়েকে কামড়ানোর চেষ্টা করছে। মা ওই বোতলদিয়ে ডোডোর মাথায় সজোরে আঘাত করল। ডোডো যন্ত্রনায় কুঁই কুঁই করে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন বিল্টুর খুব রাগ হয়েছিল মা’র উপর। সেদিন সে ও দুপুরে ভাত খায় নি। মা অনেক অনুনয় বিনয় করে আদর করে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিলে তবে খেয়েছিল। বিল্টুর বাবা বাড়ি আসলে বিল্টু সব কথা বাবাকে বলল।
কিন্তু সেদিনের পর থেকে ডোডোও যেন অভিমান করে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করত না। এর কিছুদিনের মধ্যেই বোনের জন্মদিন। বিল্টু আস্তে আস্তে সেদিনের ঘটনা ভুলে গেল। বোনের জন্মদিনে কি কি হবে সেই প্ল্যান করতে বাবা মায়ের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।এদিকে কেউ খেয়াল করল না একটা প্রাণী যে ওদের বাড়িতে পরগাছার মত বেড়ে উঠছিল সে হয়তো আর একটু যত্ন একটু পরিচর্যা পেলে ওই মা মারা প্রাণীটা আর একটু ভালো থাকতো।আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না ওরাও ভালোবাসার কাঙাল।ওদেরও একটু পরিচর্যা দরকার হয়।ওরা খুব বেশি কিছু চায় না সামান্য একটু ভালোবাসা দিলেই ওরা কেনা হয়ে থাকে। নিজের প্রাণটা দিতেও ওরা কার্পণ্য করে না।
ডোডো অভিমান করে ঠিক মতো খেতো না। বিল্টুর মা’র উপর ডোডোর অভিমান হয়েছিলো।হয়তো ও মনে মনে ভেবেছিল বিল্টুর মা তাকে বিল্টুর মতো বিল্টুর বোনের মতো একটু আদর করবে। সেই অভিমানে খাওয়া বন্ধ করে আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
আজকেই সেই দিন। বিল্টুর বোনের জন্মদিন। বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন, অনেক লোকজন।সেই ভিড়ের মধ্যে কেউ খেয়াল করেনি ডোডো বাড়ির পেছনে সেই আম গাছটার তলায় এসে শুয়েছে, যেখানে তার মা তাকে জন্ম দিয়ে তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যায়।
বিল্টু অনেক্ষন ডোডো কে দেখতে পাচ্ছে না। ডোডোর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে পেছনের ওই আম গাছটার কাছে পৌঁছয়। এসে দেখে ডোডোর দুচোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে, আর ওর পেট টা কেমন অস্বাভাবিক ভাবে ওঠা নামা করছে। বিল্টু দৌড়ে গিয়ে ওর বাবাকে ডেকে আনলো।বাবা এসে দেখে বুঝলো ডোডো আর বেশিক্ষন বাঁচবে না। বাবা বিল্টুকে বলল একটু জল আনতে। বিল্টু জল এনে ডোডোর মুখে দিল। ডোডো অনেক কষ্টে চোখ দুটো একটু ফাক করে বিল্টুকে দেখলো কৃতজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে, তার পর চোখ বুঝলো। বিল্টুর বাবা ওকে বলল ডোডো ওর মা’র কাছে চলে গেলো। বিল্টু বাবাকে আঁকড়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো- বাবা আমরা কি ওকে আর একটু ভালোবাসতে পারতাম না বাবা! মা বোনকে এতো ভালোবাসে, আমাকে এতো ভালোবাসে মা কি ডোডোকে একটু ভালোবাসতে পারতো না!
-বিল্টু তুই চুপ কর। আর কাঁদিস না।আজ তোর বোনের জন্মদিন।
-বাবা আমি এখন কি করবো? আমি যে ডোডোকে খুব ভালোবাসতাম।
– ডোডোও সেটা জানতো।তাইতো তুই ওর মুখে জল দিলে ও তোর দিকে ওরকম কৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো ওর তোর জন্য অনন্ত সময় ধরে প্রতীক্ষা করছে।
-তুই চল, এখন ঘরে চল। ডোডোর অন্তষ্টি ক্রিয়া করতে হবে তো। তাহলে ওর আত্মার শান্তি হবে।
– হ্যাঁ বাবা তাই করো।ও বেঁচে থাকতে তো শান্তি পেলো না, মরার পর যেন একটু শান্তি পায়।