গাড়িটা বাজে
গাড়িটা বাজে—একদম লক্কড়-মাকা। ছক্কর-ছক্কর করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কোন্ চুলোয় যে যাচ্ছে বোঝবার জো নেই। সেই জাঁদরেল অবলাকান্ত প্রায় আমাকে চেপ্টে বসে আছে—ওর নাম যদি অবলাকান্ত হয়, তবে বলেন্দ্রনাথের মানে, স্বয়ং সিন্ধুঘোটকের চেহারা যে কেমন হবে কে জানে! দরজা খোলবার জো নেই—এমন কি, কথাটি কইবার জো নেই। টেনিদা একবার বলতে চেষ্টা করেছিল, ও মশাই, খামকা ভুল লোককে হয়রান করে
ঢ্যাঙা লোকটা খ্যাঁ-খাঁ করে বললে, চোপ!
—যাকে তাকে কম্বলরাম ঠাউরে–
—যাকে তাকে? এমনি খাঁড়ার মতো নাক, এমনি চেহারা-কম্বলরাম ছাড়া আর, কারও হয়? কম্বলরামের কোনও যমজ ভাই নেই, তিনকুলে তার কেউ আছে বলেও আমরা শুনিনি। ইয়ার্কি?
-স্যার, দয়া করে যদি পটলডাঙায় একটা খবর নেন
-শাট আপ ইয়োর পটলডাঙা-আলুডাঙা! আর একটা কথা বলেছ কি, এই পিস্তলের এক গুলিতে–
কাজেই আমরা চুপ করে আছি। যা হওয়ার হয়ে যাক। শুধু থেকে থেকে আমার পেটের ভেতর থেকে কেমন গুড়গুড় করে একটা কান্না উঠে আসছিল। আর কখনও পটলডাঙায় ফিরে যেতে পারব না, আর কোনওদিন পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেতে পাব না। টেনিদার সঙ্গে আড্ডা দিয়েই আমার এই সর্বনাশ হয়ে গেল। মেজদা ঠিকই বলে, ওই টেনিদার চ্যালা হয়েই প্যালা স্রেফ গোল্লায় গেল।
আমি তখন বিশ্বাস করিনি। ভাবলুম, যে যাই বলুক, টেনিদা একজন সত্যিকারের গ্রেটম্যান। দু-একটা চাঁটি-টাঁটি লাগায়, জোর করে খাওয়া-টাওয়াও আদায় করে, কিন্তু আসলে তার মেজাজটা ভীষণ ভালো, বিপদ-টিপদ হলে লিডারের মতো বুক ঠুকে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু সে যে এত মারাত্মক কম্বলরাম হলেও হতে পারে, আর কোথাকার এক বিটকেল সিন্ধুঘোটক তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এ জানলে কে তার ত্রিসীমানায় এগোত।
ওদিকে হঠাৎ অবলকান্ত খ্যাঁ-খাঁ করে হেসে উঠল। বললে, ঘেঁটুদা!
ঘেঁটুদা, ওরফে ঢ্যাঙা লোকটা বললে, কী বলছ হে অবলকান্ত?
—এটা যে কম্বলরাম, তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই।
ঘেঁটুদা বললে, আলবাত!
অবলাকান্ত বললে, তা না হলে এমন ডোম্বলরাম হয়।
ঘেঁটুদা বললে, নির্ঘাত! ডোম্বলরাম বলে ডোম্বলরাম!
অবলাকান্ত বললে, হ্যাঁ, ভোম্বলরামও বলা যায়।
বলেই দুজনে খ্যাঁ-খ্যাঁ করে হেসে উঠল।
আমরা নিজের জ্বালায় মরছি, কিন্তু ওদের যে কেন এত হাসি পেল, সে আমি বুঝতে পারলুম না। জুলজুল করে আমি একবার টেনিদার দিকে চেয়ে দেখলুম। গাড়ির ভেতরে ওকে ভালো দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না, কিন্তু যেটুকু দেখলুম তাতে মনে হল রাগে ওর দাঁত কিড়মিড় করছে। নিতান্তই দু-দুটো পিস্তল না থাকলে এতক্ষণে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।
গাড়িটা চলছে তো চলছেই। মাঝে-মাঝে গাড়োয়ান এক-একবার জিভে-টাকায় এক-একটা কটকট আওয়াজ করছে, আর সাঁই সাঁই করে চাবুক হাঁকড়াচ্ছে। গাড়িটার থামবার নামই নেই। একসময় মনে হল, পিচের রাস্তা ছেড়ে খোয়াওঠা পথ ধরল আর থেকে-থেকে এক-একটা বেয়াড়া ঝাঁকুনিতে পিলেসুন্ধু নড়ে যেতে লাগল।
এতক্ষণ পথের পাশে গাড়ি-টাড়ির আওয়াজ পাচ্ছিলুম, ট্রামের ঘণ্টি কানে আসছিল, লোকের গলা পাওয়া যাচ্ছিল, কানে আসছিল রেডিয়ো-টেডিয়োর শব্দ। এখন মনে হল, হঠাৎ যেন সব নিঝুম মেরে গেছে, কোথায় যেন ঝিঝি-টিঝি ডাকছে, থেকে থেকে পেঁকো গন্ধ বন্ধ গাড়ির ভেতরেও এসে ঢুকছে। তার মানে উদ্ধারের শেষ আশাটুকুও গেল। এখন আমরা চলেছি একেবারে সিন্ধুঘোটকের খপ্পরে—কোন্ পোড়াবাড়ির পাতালে নিয়ে আমাদের দুম করে গুম করে ফেলবে—কে জানে!
হঠাৎ ক্যাবলার কথা মনে পড়ে আমার ভারি রাগ হতে লাগল। ক্যাবলা বলে ওসব গোয়েন্দা-গল্প স্রেফ গাঁজা বানিয়ে বানিয়ে লেখে, আমি এক বর্ণও বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজ রাতে সিন্ধুঘোটকের পাল্লায়–
খ্যাড়—খ্যাড়-খ্যাড়াৎ–
গাড়িটা কাত হয়ে উল্টে পড়তে-পড়তে সামলে নিলে মনে হল, কোনও নালাফালায় নেমে যাচ্ছিল। আমি একেবারে অবলাকান্তের ঘাড়ে গিয়ে পড়লুম—সে বললে, উঁহু-উঁহু, নাকটা গেল মশাই। ওদিকে ঘেঁটুদার গলা থেকে আওয়াজ বেরুল : ক্যাঁক—গেলুম!
আর তক্ষুনি টেনিদা বললে, ঘেঁটুচন্দর—এবার! তোমার পিস্তল তো কেড়ে নিয়েছি আগে তোমার দফা নিকেশ করে ছাড়ব!
আমি চমকে উঠলাম। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারলুম, গাড়িটা কাত হওয়ার ঝাঁকুনিতে টেনিদা সুযোগ পেয়ে ফস করে ঘেঁটুর পিস্তলটা ছিনিয়ে নিয়েছে! একেই বলে লিডার। কিন্তু অবলাকান্তের হাতে তো পিস্তলটা এখনও রয়েছে। টেনিদা না হয় ঘেঁটুকে ম্যানেজ করল, কিন্তু অবলাকান্ত যে এক্ষুনি আমায় সাবাড় করে দেবে।
টেনিদা বললে, ওয়ান-টু-থ্রি। শিগগির গাড়ির দরজা খোলো, নইলে–
আমি তো কাঠ হয়ে বসে আছি—খালি মনে হচ্ছে, এখুনি আমি গেলুম। এইবারে দু-দুটো পিস্তলের আওয়াজ—ঘেঁটুচন্দর চিত, আমারও বাতচিত চিরতরে ফিনিশ! তারপর রইল টেনিদা আর অবলাকান্ত কিন্তু মহাযুদ্ধের সেই শেষ অংশটা আমি আর দেখতে পাব না, কারণ আমি ততক্ষণে দুনিয়া থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছি।
গোয়েন্দা-উপন্যাসে এসব জায়গায় একটা দারুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পড়তে-পড়তে লোকের মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। অথচ ঘেঁটু আর অবলাকান্ত হঠাৎ খাঁ খাঁ করে অট্টহাসি হাসল।
টেনিদা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অবলাকান্ত বললে, শাবাশ কম্বলরাম, তুমি বীর বটে। তোমার বীরত্ব দেখে আমার চন্দ্রগুপ্ত নাটকের পার্ট বলতে ইচ্ছে করছে। আলেকজান্ডারের মতো—যাও বীর, মুক্ত তুমি। কিন্তু সে আর হওয়ার জো নেই, কারণ। আমরা সিন্ধুঘোটকের আস্তানায় ঢুকে পড়েছি।
আর তক্ষুনি চট করে গাড়িটা থেমে গেল। কোচোয়ান ঘরঘর করে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললে, নামো।
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : সাবধান, আমি এখুনি গুলি ছুঁড়ব বলে দিচ্ছি—আমার হাতে পিস্তল–
বলতে বলতে গাড়ির ওধারটা খুলে অবলাকান্ত টপ করে নেমে গেল। আর ঘেঁটুদা বললে– থাম ছোকরা, বেশি বকিসনি। পিস্তল-ফিস্তল ছুড়ে আর দরকার নেই, নেবে আয়–
আর এদিক থেকে অবলাকান্ত এক হ্যাঁচকায় আমাকে নামিয়ে ফেলল, ওদিক থেকে টেনিদা আর ঘেঁটুদা জড়াজড়ি করতে করতে একসঙ্গে কুমড়োর মতো গড়িয়ে পড়ল গাড়ি থেকে।
আমি দেখলুম, সামনে একটা ভুতুড়ে চেহারার পোডোমতো পুরনো বাড়ি। তার ভাঙা সিঁড়ির সামনে গাড়ি এসে থেমেছে, চারজন লোক দুটো লুণ্ঠন হাতে করে এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে।
একজন হেঁড়ে গলায় বললে, কী ব্যাপার কুস্তি লড়ছে কারা?
টেনিদা ততক্ষণে ধাঁ করে একটা ল্যাং কষিয়ে ঘেঁটুকে উল্টে ফেলে দিয়েছিল। ঘেঁটু গ্যাঙাতে-গ্যাঙাতে উঠে দাঁড়াল। বললে, তোমরা তো বেশ লোক, হে! দিব্যি বুঝিয়ে দিলে, কম্বলরামটা এক নম্বরের ভিতু, একটু ভয় দেখালেই ভিরমি খেয়ে পড়বে। এ তো দেখছি। সমানে লড়ে যাচ্ছে, আবার একটা প্যাঁচ কষিয়ে আমায় চিত করে ফেললে। ইঃ—একগাদা গোবর-টোবর না কীসের মধ্যে যেন ফেলে দিয়েছে হেকী গন্ধ। ওয়াক।
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : হুঁশিয়ার, আমার হাতে তৈরি পিস্তল।
লোক চারটে থমকে দাঁড়িয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে। শেষে একজন বললে, পিস্তল! পিস্তল আবার কোত্থেকে এল হে।
অবলাকান্ত বললে, দুত্তোর পিস্তল। সেই যে কম্বলরামকে ভয় দেখাব বলে ফিরিওলার কাছ থেকে আড়াই টাকা দিয়ে দুটো কিনেছিলুম, তারই একটা কেড়ে নিয়েছে আর তখন। থেকে শাসাচ্ছে আমাদের। বলেই আমার হাতে নিজের পিস্তলটা জোর করে গুঁজে দিয়ে বললে, ওহে কম্বলরামের দোস্ত কাঁথারাম, তোমারও গুলি ছোঁড়বার সাধ হয়েছে নাকি। তা হলে এটা তোমায় প্রেজেন্ট করলুম, চার আনার ক্যাপ কিনে নিয়ো—আর সারাদিন দুমফটাক করে বাড়ির কাক-টাক তাড়িয়ে।
বলে, অবলাকান্ত তো খ্যাঁ-খাঁ করে হাসলই, সেই সঙ্গে গোবরমাখা ঘেঁটুচন্দর, গাড়ির কোচোয়ান আর দুটো লণ্ঠন হাতে চারটে লোক সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। আর সেই হাসির আওয়াজে পাশের একটা ঝুপসি-মতন আমগাছ থেকে গোটা দু-তিন বাদুড় ঝটপট করে উড়ে পালাল।
ঘেঁটু বললে, কই হে কম্বলরাম, গুলি ছুঁড়লে না?
টেনিদা কিছুক্ষণ ঘুগনিদানার মতো মুখ করে চেয়ে রইল, তারপর খেলনা পিস্তলটা তার হাত থেকে টপ করে পড়ে গেল। ইস ইস—আমরা কী গাড়ল। দুটো লোক আমাদের স্রেফ বোকা বানিয়ে গড়ের মাঠ থেকে ভর সন্ধেবেলায় এমন করে ধরে আনল। আগে জানলে–
কিন্তু পিস্তল-ফিস্তল চুলোয় যাক—এখন আর কিছুই করবার নেই। আমরা দুজন—কোচোয়ান সুষ্ঠু ওরা সাতজন। টেনিদার কুস্তির প্যাঁচ-ট্যাঁচ কোনও কাজে লাগবে
—সোজা চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবে। সেই হেঁড়ে গলার লোকটা বললে, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কতক্ষণ ভ্যারেণ্ডা ভাজবে, হে। রাত তো প্রায় আটটা বাজল। চলোচলো শিগগির। সিন্ধুঘোটক তখন থেকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে।
টেনিদা একবার আমার দিকে তাকাল, আমি টেনিদার দিকে তাকালুম। তারপর কী আর করা যায়—দুজনে সুড়সুড় করে এগিয়ে চললুম লোকগুলোর সঙ্গে সঙ্গে।
কোন আদ্যিকালের একটা রদ্দিমাকা বাড়ি—মানুষজন বিশেষ থাকে-টাকে বলে মনে হল না। ভাঙাচোরা সব ঘর—কোথাও একটা তেপায়া কিংবা খাটিয়া, কোথাও বা দু-একখানা ধুলোবালি-মাথা টেবিল-চেয়ার। দুটো লণ্ঠনের আলোয় ঘরগুলোকে যেমন বিচ্ছিরি, তেমনি ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল। থেকে থেকে মাথার ওপর দিয়ে চামচিকে উঠে যাচ্ছিল, তাই দেখে আমি শক্ত করে নিজের কান দুটোকে হাত চাপা দিলুম। চামচিকেকে আমার ভীষণ সন্দেহজনক মনে হয়—কেন যে হঠাৎ লোকের ঘরে ঢুকে ফরফর করে উড়তে থাকে তার কোনও মানেই বোঝা যায় না। ছোড়দি বলে, ওরা নাকি লোকের কান ধরে ঝুলে পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। আমার লম্বা লম্বা কান দুটো তাই আগে থেকেই সামলে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ বলেই মনে হল আমার।
এ-ঘর থেকে ও-ঘর, ও-ঘর থেকে সে-ঘর। তারপরেই ঘরটাই বোধহয় শ্রীঘর। ভেবেই আমার মনে হল, শ্রীঘর তো থানার হাজতকে বলে। সিন্ধুঘোটক নিশ্চয় পুলিশ নয় যে আমাদের দুম করে হাজতে পুরে দেবে।
এদিকে একটা সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে উঠছি। খুব বাজে মাকা সিঁড়ি, রেলিং ভাঙা, ধাপগুলো দাঁত বের করে রয়েছে। ঠিক এমনকি একটা বাড়িতেই যত রকম ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়—দসর্দার চিং চুং বেপরোয়া গোয়েন্দা দিগ্বিজয় রায়কে গুম করে ফেলে, কিংবা কাঞ্চীগড়ের রাজরানী মৃদুলাসুন্দরীর হীরের নেকলেস নিয়ে গুণ্ডা তিলালের সঙ্গে ওস্তাদ কলিমুদ্দির গজকচ্ছপের যুদ্ধ বেধে যায়। আমার প্রিয় লেখক কুণ্ডু মশাইয়েরও যত সব দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর কাহিনী একে-একে আমার মনে পড়ে যেতে লাগল।
কিন্তু খালি একটা খটকা লাগছে। সেসব গল্পে খেলনা পিস্তলের কথা কোনও দিন পড়িনি!
আবার এসব দারুণ দারুণ ভাবনায় হঠাৎ বাধা পড়ে গেল। সিঁড়ি পেরিয়েই সামনে মস্ত একটা ঘর। তার দরজাটা ভেজানো, কিন্তু ভেতর থেকে একটা জোরালো আলো বাইরে এসে পড়েছে। আমরা সেইখানে থেমে দাঁড়ালাম।
অবলাকান্ত বেশ মিহি গলায় ডাকল : স্যার!
ভেতর থেকে ব্যাঙের ডাকের মতো আওয়াজ এল : কে?
—আমরা সবাই। মানে কম্বলরাম সুদ্ধ এসে গেছে।
—এসে গেছে? অলরাইট! ভেতরে চলে এসো।
অবলাকান্ত দরজাটা খুলে ফেলল। আর পেছন থেকে লোকগুলো আমাকে আর টেনিদাকে ধাক্কা দিয়ে বললে, যাও–যাও, এবার স্যারের সঙ্গে মোকাবেলা করো।
সবাই আমরা ঘরে পা দিলুম।
বাড়িটা নীচে থেকেই যতই খারাপ মনে হোক—এ-ঘরটা একেবারে আলাদা। টিমটিমে লণ্ঠন নয়—মেঝেতে সোঁ-সোঁ করে একটা পেট্রোম্যাক্স বাতি জ্বলছে। মস্ত ফরাসের ওপর ধপধপে শাদা চাদর বিছানো, সেখানে তিন-চারটে তাকিয়া, আর একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে—গড়গড়ার নল মুখে পুরে–
কে?
কে আর হতে পারে—সিন্ধুঘোটক ছাড়া?
চেহারা বটে একখানা! হঠাৎ দেখলে মনে হয় বোধহয় স্বপ্ন দেখছি, নিজের কানে চিমটি কেটে পরখ করতে ইচ্ছে করে। একটা লোক যে এমন মোটা হতে পারে, এক পিপে আলকাতরায় ড়ুব দিয়ে উঠে আসার মতো তার যে গায়ের রঙ হতে পারে, মন চারেক শরীরের ওপর এত ছোট যে একটা মাথা থাকতে পারে, আর ছোট মাথায় যে আরও ছোট এমন দুটো কুঁতকুঁতে চোখ থাকতে পারে—এ না দেখলে তবুও বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু দেখলে আর কিছুতেই বিশ্বাস করবার জো নেই।
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম, ডি-লা-গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস—কিন্তু সামলে নিলুম আর সিন্ধুঘোটক ব্যাঙের গলায় গ্যাং-গ্যাং করে বললে, বোসো সব, সিট ডাউন।
এমন কায়দা করে বললে– যে, আমরা যেন সব স্কুলের ছাত্র আর হেডমাস্টার আমাদের বসতে হুকুম দিচ্ছেন।
ঘেঁটুদা কাঁউমাউ করে বললে, আমি বসতে পারব না স্যার—এই কম্বলরামটা আমাকে গোবরের ভেতরে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। গায়ে দারুণ গন্ধ।
সিন্ধুঘোটক বললে, তুমি একটা থার্ডক্লাস! আমার ফরাসে গোবর লাগিয়ো না—আগে চান করে এসো। যাও—গেট আউট।
ঘেঁটুদা তখুনি সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল।
আমরা সবাই তখন ফরাসে বসে পড়েছি, সিন্ধুঘোটক তাকিয়া ছেড়ে পিঠ খাড়া করে উঠে বসল। জিজ্ঞেস করলে, কে কম্বলরাম?
অবলাকান্ত টেনিদাকে একটা খোঁচা দিয়ে বললে, এইটে।
সিন্ধুঘোটক আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, আর রোগা চিমটে খাড়া খাড়া কানওলা ওটা কে?
অবলাকান্ত বললে, নাম জানিনে স্যার। কম্বলরামের দোস্ত–কাঁথারাম বোধ হয়।
হেঁড়ে গলায় লোকটা বললে, শতরঞ্চিরাম হতেও বাধা নেই।
বাকি সবাই একসঙ্গে বললে, হ্যাঁ, শতরঞ্চিরামও হওয়া সম্ভব।
সিন্ধুঘোটক বললে, অর্ডার- অর্ডার বলেই আবার গড়গড়ার নলটা মুখে তুলে নিলে। আর এইবার আমি লক্ষ করে দেখলুম, গড়গড়ায় কলকে-টলকে কিছু নেই, শুধু-শুধু একটা নল মুখে পুরে সিন্ধুঘোটক বসে আছে।
–তারপর কম্বলরাম–
এতক্ষণ টেনিদা আলু-চচ্চড়ির মতো মুখ করে বসে ছিল, এবার গাঁ-গাঁ করে উঠল।
—দেখুন স্যার, এরা গোড়া থেকেই ভুল করেছে। আমি তো কম্বলরাম নই-ই, আমাদের সাতপুরুষের মধ্যে কেউ কম্বলরাম নেই। আমি হচ্ছি টেনি শর্মা-ওরফে ভজহরি মুখুজ্যে, আর এ হল প্যালারাম—ওর ভালো নাম স্বর্ণেন্দু ব্যানার্জি। আমরা পটলডাঙায় থাকি। গরমের জ্বালায় অস্থির হয়ে আমরা গঙ্গার স্নিগ্ধ সমীর সেবন করছিলুম, আপনার ঘেঁটুচন্দর আর অবলাকান্ত গিয়ে আমাদের জোর করে ধরে এনেছে।
শুনে, সিন্ধুঘোটকের মুখ থেকে টপ করে নলটা পড়ে গেল। তিনটে কোলা ব্যাঙের ডাক একসঙ্গে গলায় মিশিয়ে সিন্ধুঘোটক প্রায় হাহাকার করে উঠল : ওহে অবলাকান্ত, এরা কী বলে?
অবলাকান্ত ব্যস্ত হয়ে বললে, বাজে কথা বলছে, স্যার। এই কম্বলরামটা দারুণ খলিফা—তখন থেকে আমাদের সমানে ভোগাচ্ছে। আপনিই ভালো করে দেখুন না, স্যার। কম্বলরাম ছাড়া এমন চেহারা কারও হয়? এমন লম্বা তাগড়াই চেহারা, এমন একখানা মৈনাকের মতো খাড়া নাক, এমনি তোবড়ানো চোয়াল–
দাঁড়াও—দাঁড়াও!—সিন্ধুঘোটক হঠাৎ তার ছোট্ট মাথা আর কুঁতকুঁতে চোখ দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলে : কিন্তু কম্বলরামের নাকের পাশে যে একটা কালো জড়ল ছিল, সেটা কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে বাকি লোকগুলো সবাই ঝুঁকে পড়ল টেনিদার মুখের ওপর : তাই তো, জড়লটা কোথায়?
টেনিদা খ্যাঁচম্যাচ করে বললে, আমি কি কম্বলরাম যে জড়ল থাকবে? এইবার আপনারাই বলুন তো মশাই, এই দারুণ গ্রীষ্মের সন্ধেবেলায় খামকা দুটো ভদ্র সন্তানকে হয়রান করে আপনাদের কী লাভ হল?
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর সিন্ধুঘোটক ডাকল : অবলাকান্ত!
-বলুন স্যার!
—এটা কী হল?
—আজ্ঞে, অন্ধকার স্যার ভালো করে ঠাওর পাইনি। মাথা চুলকোতেকুলকোতে অবলাকান্ত বললে, কিন্তু আমার মনে হয় স্যার, এটাই কম্বলরাম। চালাকি করে জড়লটাও কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।
-শাট আপ। জড়ল কি একটা মার্বেল যে ফস করে লুকিয়ে ফেলা যায়?
—যদি অপারেশন করায়?
—হুঁ। সে একটা কথা বটে—সিন্ধুঘোটক আবার নলটা তুলে নিলে : কিন্তু অপারেশনের দাগ তো থাকবে।
–নাও থাকতে পারে স্যার। আজকাল ডাক্তারদের অসাধ্য কাজ নেই।
টেনিদা কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দোরগোড়া থেকে কোচোয়ান বললে, হুজুর, আমার একটা নিবেদন আছে।
–বলে ফেলো পাঁচকড়ি। আউট উইথ ইট।
–কম্বলরামকে আমি চিনি, স্যার। রোজ বিকেলে মনুমেন্টের নীচে আমরা খইনি খাই। সে কলকাতায় নেই, আজ দুপুরবেলায় রেলে চেপে তার মামাবাড়ি বাঁকুড়া চলে গেছে।
শুনে, অবলাকান্ত তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। পাঁচকড়িকে এই মারে তো সেই মারে।
—তবে এতক্ষণ বলিসনি কেন হতভাগা বুদ্ধ কোথাকার? খামকা আমাদের খাটিয়ে মারলি?
–বলে কী হবে? আমার কথা তো কেউ বিশ্বাস করে না বলে, ভারি নিশ্চিন্ত মনে পাঁচকড়ি হাতের মুঠোয় খইনি ডলতে লাগল আর গুনগুনিয়ে গান ধরল : বনে চলে সিয়ারাম, পিছে লছমন ভাই
সিন্ধুঘোটক বললে, অর্ডার, অর্ডার! পাঁচকড়ি, নো সিংগিং নাউ। কিন্তু এ-পরিস্থিতিতে কী করা যায়?
অবলাকান্ত প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে রইল। আর বাকি সবাই একসঙ্গে বললে, তাই তো, কী করা যায়!
টেনিদা বললে, কিছুই করবার দরকার নেই স্যার। বেশ রাত হয়েছে, আমাদের তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন, নইলে বাড়িতে গিয়ে বকুনি খেতে হবে।
সিন্ধুঘোটক কিছুক্ষণ খালি খালি গড়গড়া টানতে লাগল। কলকে-টলকে কিছু নেই, শুধু গড়গড়ার ভেতর থেকে উঠতে লাগল জলের গুড়গুড় আওয়াজ।
তারপর সিন্ধুঘোটক বললে, হয়েছে।
অবলাকান্ত ছাড়া বাকি সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, কী হয়েছে!
—প্ল্যান। কম্বলরাম যখন নেই, তখন একে দিয়েই কাজ চালাতে হবে। নাকের নীচে একটা জড়ল বসিয়ে দিলেই ব্যস—কেউ আর চিনতে পারবে না।
অবলাকান্ত ভারি খুশি হয়ে হাত কচলাতে লাগল : আমিও তো স্যার সেই কথাই বলছিলুম।
হায়–হায়, ঘাটে এসে শেষে নৌকো ড়ুবল! এতক্ষণ বেশ আরাম বোধ করছিলাম, কিন্তু সিন্ধুঘোটকের কথায় একেবারে ধুক করে নিবে গেল বুকভরা আশা। টেনিদার দিকে চেয়ে দেখলুম, ওর মুখখানা যেন ফজলি আমের মতো লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে।
টেনিদা শেষ চেষ্টা করল : স্যার, আমাদের আর মিথ্যে হ্যারাস করবেন না। ভুল যখন বুঝেইছেন—
সিন্ধুঘোটক এবার কুঁতকুঁতে চোখ মেলে টেনিদার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকটা। কী ভেবে মিনিট খানেক খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসল, তারপর বললে, আচ্ছা ছোরারা, তোমরা আমাদের কী ভেবেছ বলো দেখি? রাক্ষস? খপ করে খেয়ে ফেলব?
ভাবলে অন্যায় হয় না—অন্তত সিন্ধুঘোটকের চেহারা দেখলে সেই রকমই সন্দেহ হয়। এতক্ষণে আমি বললুম, আমরা কিছুই ভাবছি না স্যার, কিন্তু বাড়ি ফিরতে আর দেরি হলে বড়দা আমার কান ধরে–
–হ্যাং ইয়োর বড়দা!–বিরক্ত হয়ে বললে, তোমার কান দুটো এমনিতেই বেশ বড় রয়েছে, একটু ছাঁটাই করে দিলে নেহাত মন্দ হবে না। ওসব বাজে কথা রাখো। তোমাদের দিয়ে আজ রাতে আমরা একটা মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চাই। যদি সফল হইতোমাদের খুশি করে রিওয়ার্ড দেব!
—মহৎ উদ্দেশ্য।–টেনিদা চিড়বিড় করে উঠল : এইভাবে ভদ্দর লোকদের পথ থেকে পাকড়াও করে এনে কোন্ মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে স্যার?
সিন্ধঘোটক চটে বললে, চোপরাও! এই বাড়ির পেছনে একটা পচা ডোবা আছে, তাতে কিলবিল করছে জোঁক। বেশি চালাকি করো তো, দুজনকে আধঘণ্টা তার মধ্যে চুবিয়ে রাখব!
শুনে আমার প্রাণ শুকিয়ে গেল। জোঁক আমি কখনও দেখিনি, কিন্তু তারা কী করে কুটুস করে মানুষকে কামড়ে ধরে আর নিঃশব্দে রক্ত শুষে খায়, তার ভয়াবহ বিবরণ অনেক শুনেছি। তা থেকে জানি, আর যাই হোক, জোঁকের সঙ্গে কখনও জোক চলে না।
টেনিদা হাঁউমাউ করে বললে, না স্যার, জোঁক নয়, জোঁক নয়! ওরা খুব বাজে জিনিস।
—তা হলে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও।
–কী করতে হবে, স্যার?
—বেশি কিছু নয়। শুধু একজনের পকেট থেকে একটা কৌটো তুলে আনতে হবে। আর সেকাজ কম্বলরাম ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না।
–কীসের কৌটো স্যার?
—জারমান সিলভারের।
–কী আছে তাতে?—টেনিদা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল : হীরে-মুক্তা-মানিক? কোহিনুর? নাকি আরও, আরও দামী, আরও দুর্মূল্য কোনও দুর্লভ রত্ন?
সিন্ধুঘোটক গড়গড়ার নলটা মুখ থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণ প্যাট-প্যাট করে চেয়ে রইল। তারপর বিষম বিরক্ত হয়ে বললে, ধেৎ, হীরে-মুক্তো কোত্থেকে আসবে? অত সস্তা নাকি?
–তবে কী আছে স্যার? কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গোপন ফরমুলা?
–নাঃ ও-সব কিছু নয়!—চিরতা-খাওয়ার মতো তেতো মুখ করে সিন্ধুঘোটক বললে, কৌটোয় কী আছে, জানো? নস্যি, এক নম্বরের কড়া নস্যি। তার দাম দু-পয়সা কিংবা চার পয়সা!
—অ্যাঃ! সেই কৌটোর জন্যে—
সিন্ধুঘোট বললে, শাট আপ! এর বেশি আর জানতে চেয়ো না এখন। ওহে অবলাকান্ত, এই নকল কম্বলরামকে এবার নিয়ে যাও-কাঁথারামকেও ছেড়ো না। মেক-আপ করে দশ মিনিটের মধ্যে রেডি করে ফেলল।
আর একবার মনে হল, জেগে আছি, না স্বপ্ন দেখছি? তক্ষুনি নিজের গায়ে চিমটি কেটে আমি চমকে উঠলুম, আর কে যেন আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললে, চলো ব্রাদার—আর দেরি নয়।