Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঝোট্টন ও লোট্টন || Pramatha Chaudhuri

ঝোট্টন ও লোট্টন || Pramatha Chaudhuri

যে কালের কথা বলছি, তখন আমি বাংলাদেশের কোনো একটি শহরে বাস করতুম—কলকাতায় নয়।

পাড়াগেঁয়ে শহরে নানা অভাব থাকতে পারে, কিন্তু একটা জিনিসের অভাব নেই—অর্থাৎ জমির। শহরের ভিতরে না হোক বাইরে দেদার জমি পড়ে আছে—জঙ্গল নয়, ধানের খেত। আর সেই-সব ধান-খেতকে কেউ কেউ প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা বাড়িতে পরিণত করেছেন। আমি যে বাড়িতে বাস করতুম সেটা ছিল সেই জাতের বাড়ি।

সে বাড়িতে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি-গোছ একটা মস্ত আস্তাবল ছিল—বসতবাড়ির গা ঘেঁষে নয়, দু-তিন রশি তফাতে বড়ো রাস্তার ধারে। সে আস্তাবলে ছিল মস্ত একটা গাড়িখানা, তার দু-পাশে দুটি ঘোড়ার থান, আর তার ওপাশে সইস- কোচম্যানদের সপরিবারে থাকবার ঘর। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন সেখানে গাড়িও ছিল না, ঘোড়াও ছিল না, মানুষও থাকত না। ছিল শুধু ইঁদুর ও ছুঁচো, টিকটিকি ও আরসোলা; আর সেখানে যাতায়াত করত গো-সাপ ঢোড়া-সাপ আর গিরগিটি, যাদের দেখবামাত্র আমাদের নীরব ও নিরীহ বিলেতি শিকারী কুকুরটা তনুহূর্তে বধ করত; অথচ তাদের মাংস খেত না। সে ছিল ইংরেজরা যাকে বলে real sportsman I ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’–এ উপদেশ তাকে দেওয়া ছিল নিষ্প্রয়োজন; কারণ ফলনিরপেক্ষ হত্যাই ছিল তার স্বধর্ম।

একদিন সকালে আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় শুনতে পেলুম সেই পোড়ো আস্তাবলে সে মহা চিৎকার করছে। কানে এল আমাদের মালী চিনিবাসের গলার আওয়াজ। সে তারস্বরে “নিকালো নিকালো” বলে চেঁচাচ্ছে। বুঝলুম, যার প্রতি এ আদেশ হচ্ছে, সে পশু নয়— মানুষ।

এই গোলমাল শুনে আমি ও আমার এক আত্মীয়, উপেনদা দুজনে সেখানে ছুটে গেলুম। গিয়ে দেখি আস্তাবলে গাড়িখানার মেঝেয় দুটি লোক বসে আছে। দুজনেই সমান অস্থিচর্মসার, আর দুজনেই মুমূর্ষু। রোগের হোক, উপবাসেই হোক, তারা শুকিয়ে-মুকিয়ে আমচুর হয়ে গেছে। তারা যে চিনিবাসের কথা অমান্য করছে, তার কারণ তাদের নড়বার চড়বার শক্তি নেই। এমন কঙ্কালসার মানুষ জীবনে আর কখনো দেখি নি। তারা যে এখানে চলে এল কি করে, তা বুঝতে পারলুম না। বোধ হয় আকাশ থেকে পড়েছিল।

উপেনদা এদের দেখবামাত্র চিনিবাসের সঙ্গে যোগ দিয়ে “বেরিয়ে যাও” বলে চীৎকার করতে লাগলেন। আমি ও-দুজনকেই থামালুম। আমি মনিব, সুতরাং আমি এক ধমক দিতেই চিনিবাস চুপ করলে আর যদিও আমি তখন ফোর্থ ক্লাসে পড়ি, আর উপেনদা বি. এ. পড়েন, তবু তিনি জানতেন যে মা আমার কথা শোনেন, তাঁর কথা উপেক্ষা করেন। তিনি ভাবতেন তার কারণ অন্ধ মাতৃস্নেহ, কিন্তু আসলে তা নয়। তার যথার্থ কারণ, মা ও আমি উভয়েই এক প্রকৃতির লোক ছিলুম। অপর পক্ষে উপেনদার মতে, নিজের তিলমাত্র অসুবিধে করে অপরের জন্য কিছু করা অশিক্ষিত নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ।

সে যাই হোক, আগন্তুক দুটিকে জিজ্ঞাসা করে বুঝলুম যে তারা দুজনে ‘দেশ্ কা’ ভাই। কিন্তু কোন্ দেশ যে তাদের দেশ, তা তারা বলতে পারে না; কারণ তাদের নাকি “কুছ্ ইয়াদ নেই।” তাদের আছে শুধু পেটে ক্ষিধে, আর মনে বেঁচে থাকবার ইচ্ছে। তারা আসছে বহুদূর থেকে, আর দুদিন আমাদের এখানে থাকতে চায়; আর তাদের নাম ঝোট্টন ও লোটন। যদি সব দেখে শুনে বললুম, “আচ্ছা, তুমলোক হিঁয়া রহেনে সতা।” তার পর মার কাছে গিয়ে তাঁর অনুমতি নিলুম। উপেনদা মাকে ভয় দেখালেন যে ও-দুজন ডাকাত, আর এসেছে আমাদের বাড়ি লুটে নিয়ে যেতে। মা হেসে বললেন, “যেরকম শুনছি তাতে ওরা ভূত হতে পারে, কিন্তু ডাকাত কিছুতেই নয়।”

ফলে ঝোট্টন ও লোট্টন আমাদের আস্তাবলেই থেকে গেল। মা ওদের দুবেলা খাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন ও দুদিন পরে ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন এদের চিকিৎসা করতে অনেক দিন লাগবে, তাই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া ভালো। চিনিবাস পরদিনই তাদের দুজনের হাত ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কিন্তু হাসপাতাল তখন ভর্তি, তাই সেখানে তাদের স্থান হল না। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু চিনিবাসকে বললেন— রোজ সকালে একবার করে এদের নিয়ে এসো, নিত্য পরীক্ষা করে ওষুধ দেব। ঝোট্টন রোজ যেতে রাজি হল, কিন্তু লোউন বললে সে রোজ অত দূর হাঁটতে পারবে না। চিনিবাস তখন প্রস্তাব করলে যে, সে লোট্রনকে পিঠে করে রোজ হাসপাতালে নিয়ে যাবে ও ফিরিয়ে আনবে। আর বাস্তবিকই দিন-পনেরো ধরে সে তাই করলে। লোট্টন দু-পা দিয়ে চিনিবাসের কোমর জড়িয়ে ধরত, আর দু-হাত দিয়ে তার গলা। চিনিবাসের এই কার্য দেখে সকলেই অবাক হলুম। মা বলতেন—চিনিবাস মানুষ নয় দেবতা।

এত করেও কিছু হল না। লোট্টন একদিন রাত্রে শুয়ে সকালে আর উঠল না। চিনিবাসই তার সৎকারের সব ব্যবস্থা করলে। লোটনকে মাদুরে জড়িয়ে একটা বাঁশে ঝুলিয়ে, সে পোড়াতে নিয়ে গেল; একা নয়, আর জন-তিনেক জাতভাই জুটিয়ে। মা তার খরচ দিলেন এবং চিনিবাসকে ভালো করে বকশিশ দেবেন স্থির করলেন। কিন্তু এ বিষয়েও উপেনদা তাঁর আপত্তি জানালেন। তাঁর কথা এই যে, লোউনের সব খাবার চিনিবাস খেত, আর লোট্টন না খেতে পেয়ে মরে গিয়েছে। মা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চিনিবাসকে লোউনের খাবার খেতে দেখেছ?” তিনি বললেন, “না, লোট্রনের মুখে শুনেছি।” মা আর কিছু বললেন না।

তার পর সন্ধেবেলায় চিনিবাস লোটনের মুখাগ্নি করে ফিরে এল; এসে ঝোট্টনের সঙ্গে মহা ঝগড়া বাধিয়ে দিলে। চিনিবাসের চীৎকার শুনে আমি আর উপেনদা আস্তাবলে গেলুম। গিয়ে দেখি চিনিবাস এক-একবার তেড়ে তেড়ে ঝোট্টনকে মারতে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। তারা চেহারা ও রকম-সকম দেখে মনে হল, চিনিবাস শ্মশান থেকে ফেরবার পথে তাড়ি খেয়ে এসেছে। শেষটায় বুঝলুম যে ব্যাপার তা নয়। লোট্রনের ত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে হবে, তাই নিয়ে হচ্ছে ঝগড়া। ঝোট্টন বলছে যে, সে যখন লোউনের ভাই, তখন সেই ওয়ারিশ। আর চিনিবাস বলছে যে, লোট্টন মরবার আগে তাকে বলে গিয়েছিল যে—আমার যা-কিছু আছে তা তোমাকে দিয়ে গেলুম

লোট্রনের থাকবার ভিতর ছিল একখানি কম্বল, আর একটি লোটা। ঝোট্টন কম্বল দিতে রাজি ছিল, কিন্তু লোটাটি কিছুতেই দেবে না বললে। কম্বলটি বেজায় ছেঁড়াখোঁড়া, তবে লোটাটা ছিল ভালো। আমি ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গেলুম। তবে এ মামলার বিচারটা একদিকের জন্য মুলতবি রাখলুম।

তার পরদিন সকালে চিনিবাস এসে বললে যে, কাল রাত্তিরে ঝোট্টন লোটাটা নিভে ভেগেছে, আর ফেলে গিয়েছে সেই ছেঁড়া কম্বলখানা। চিনিবাস রাগের মাথায় আরো বললেন, “ও শালা চোর হ্যায়, উসকো রাস্তামে পকড়কে মারকে ও-লোটা হাম লে লেগা।”

এ কথায় উপেনদাও রেগে তাঁর হিন্দিতে জবাব দিলেন—”তুমি চোরের উপর বাটপাড়ি করতে গিয়া থা, না পেরে এখন ঝোট্রনকে খুন করতে চাতা হ্যায়। ঐ লোটার লিয়ে তুমি লোটনকো পিঠে করে হাসপাতাল যাতা আতা থা। আর তার মরবার পরও লোউনের জাত-বিচার নেই করকে তার মড়া কাঁধে করেছ। তোমি মানুষ নেহি হ্যায়—পশু হ্যায়।”

চিনিবাস জিজ্ঞেস করলে, “মুর্দা কোন্ জাত হ্যায় বাবুজি?”

এরপর চিনিবাস ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল—উপেনদার কটু কথা শুনে নয়, হারানো ধন লোটার দুঃখে।

ইতিমধ্যে মা এসে জিজ্ঞেস করলেন—এত দুঃখ কিসের?

চিনিবাস বললে, “হামারা জরুকো বোল্‌কে আয়া যো একটো আচ্ছা লোটা লা দেগা। বেগর লোটা ঘর যানেসে উস্কা সাথ লড়াই হোগা। ও ভি হামকো মারেগা, হাম ভি উস্‌কো মারেগা। ওঠো ছোটা জাতকে ঔরৎ হ্যায়, উস্‌কো মারনেসে ও ভাগেগা। তব্‌ হামারা ভাত কোন্ পাকায়গা? হাম ভুক্‌সে মরেগা।”

এ বিপদের কথা শুনে মা বললেন, “আমি তোমাকে একটা নতুন ঘটি কিনে দেব।”

এ আশা পেয়ে চিনিবাস শান্ত হল।

সমস্যা


এ অকিঞ্চিৎকর ঘটনার গল্প আপনাদের কাছে বলবার উদ্দেশ্য এই যে—মা বলেছিলেন চিনিবাস মানুষ নয়, দেবতা। আর উপেনদা বলেছিলেন সে মানুষ নয়, পশু। আমি বহুকাল বুঝতে পারি নি, এঁদের কার কথা সত্য। এখন আমার মনে হয় যে, চিনিবাস দেবতাও নয় পশুও নয়—শুধু মানুষ; যে অর্থে ঝোটন-লোটনও মানুষ, তুমি-আমিও মানুষ।

আপনারা কি বলেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *