ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 03
আনসারিং মেশিনে তিনটে মেসেজ পেল অদিতি। একটা অবধারিতভাবে রাজর্ষির। মাকে যোগাযোগে পাচ্ছে না, ই-মেল করেছে তাকে, তারও কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। তাই সরাসরি ফোন। মায়ের খবর কী? ব্যবস্থা হল? বাবার মৃত্যুদিবস আগামী ঊনিশে, সে কি মনে করে একটা ইনসার্শন দেবে কাগজে! দিলে স্মরণকারীদের নামের মধ্যে যেন অদিতির নামটাও থাকে। অদিতিকে বাবা ভালবাসতেন।
মজা মন্দ নয়, হঠাৎ কেমন রাগ চড়ে গেল মাথায়। অদিতিকে বাবা ভালবাসতেন! হুঁ! যদিও তাঁর ছেলে বাসে না। ইনসার্শনটাও তাকে দিতে হবে কেননা বাবা তাকে ভালবাসতেন। মায়ের অসুখ করলেই ছোটো বিষ্ণুপুর, নিয়ে এসে ভরতি করো নার্সিংহোমে। রোজ ফলমিষ্টি নিয়ে দেখা করতে যাও। তারপরে আবার তিনি নিজেকে সুস্থ মনে করলে বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে দিয়ে এসো। কেন? না তাঁকে দেখবার কেউ নেই, এবং ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও অদিতি মানবিক মানুষ। তার মানবিকতাটাকে সমানে এক্সপ্লয়েট করে চলেছে লোকটা। চিরকাল।
পরের মেসেজটা নাছোড়বান্দা মনীষা দেবীর। তিনি ই-মেলটা পেয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী মেলের উত্তর পাচ্ছেন না। কী গণ্ডগোল আবার হল রে কম্প্যুটারটার? মনীষা দেবী কৃতজ্ঞ চিরদিনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু অদিতির সুপরামর্শে। তিনি অর্থাৎ মনীষা দেবী মাঝে মাঝেই অমন অস্থির হয়ে যান। তখন তাঁকে স্টেডি করতে কাউকে দরকার। যতদিন না তিনি যোগ্য বান্ধব পাচ্ছেন, ততদিন অন্তত অদিতি যেন এমনি করে তাঁকে সাহায্য করে।
যাক। বাঁচা গেল। মনীষা আসছে না। মনীষাকে ঠেকাতে অদিতি সবকিছু করতে পারে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি ও দেশেই একটা বর/বান্ধব জুটিয়ে দিতে পারে। রাজর্ষিকে অনুরোধ করবে নাকি? এত কথা সে রাখছে লোকটার, তার একটা অনুরোধ কি আর ওর রাখা উচিত নয়? আবার মনীষা তো ওরই ক্লাস-মেট। তবে ভরতের আত্মীয় যত, সকলই ভরতের মতো। রাজর্ষির সাঙ্গোপাঙ্গরাই বা কী হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য হবে? মনীষাও খুব সুবিধের ব্যাপার নয়! সে যেমন মনীষাকে ভয় পায়, বহু লোকেরই তেমন ভয় পাওয়া সম্ভব। ওর সুবিধে হচ্ছে ও বড্ড সুন্দর। বান্ধব পেতে ওর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিউটি অ্যান্ড ব্রেন দুটোই এই মাত্রায় থাকলে বান্ধব যেমন তেমন, বিবাহিত বরই কি বেশিদিন সহ্য করবে? বিশেষত এত অ্যাডভান্টেজ থাকার যত মন্দ ফল সবই মনীষাতে বর্তেছে। অভিমান যা অহংকারেরই ও পিঠ তা পুরোপুরি বর্তমান। কোনও শারীরিক পরিশ্রম সে একেবারে যোলোআনা বাধ্য না হলে করবে না। হাউসকিপিং, হোম-মেকিং ওসব ফুঃ ফুঃ। সে সেবা পেতে ভালবাসে। আদায় করে নেবার জন্যে যত খুশি নীচে নামতে পারে।
তৃতীয় মেসেজটা অনোহিতার মায়ের। মিসেস সাহা রায়। অদিতি সোজা হয়ে বসল। থ্যাংকস জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি অদিতির সঙ্গে কথা বলতে চান, মুখোমুখি, না বাড়িতে নয়, কোনও রেস্তোরাঁয় হতে পারে। অদিতি যেন রিং ব্যাক করে।
কিন্তু আসল লোকটির কোনও খবর নেই। অর্থাৎ তনিকা ওরফে অনোহিতা। একটা খবর। চলে যাচ্ছে, অদিতি ঘুমোচ্ছে। তাই জাগাচ্ছে না ইত্যাদি, একটা শুকনো ধন্যবাদ পর্যন্ত না। অথচ অদিতি ওকে নিজের বাথরোব ব্যবহার করতে দিয়েছে। না দিতেই পারত। কাউকে সে দেয় না। নিজের হাতে রান্না করে খিচুড়ি-ডিমভাজা খাওয়াল। খিচুড়িতে প্যাকেটের মটরশুঁটি যতটা ছিল সবটাই সে দেয়। তদুপরি ডিম ফেটাবার পরে কর্নফ্লেক্স গুঁড়িয়ে দেবার একটা কায়দা সে নিজে আবিষ্কার করেছে। খুব ফোলে। বড়ও হয়। সেইভাবে তৈরি ডবল ডিমের ডিমভাজা সে নিজে ভেজে গরম গরম ওকে খাইয়েছে।
ভাবতে গেলে এটাই অবশ্য ওর চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায়। নদী হতে চায়। বৃষ্টিতে উপুরচুপুর ভেজে। অচেনা মহিলার বাড়ি যেচে অতিথি হয়, অথচ তাকে নাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না। দিদি বলে ডাকা তো দূরের কথা। গুজগুজেমতো অথচ হঠাৎ হঠাৎ হেসে ওঠে। মেজাজ খারাপ বা গোপনীয়তার চিহ্নমাত্র নেই সে হাসিতে। দিব্যি কায়দা করে ড্রিংকটা চেয়ে নিল! প্রবলেম গার্ল। স্বভাবতই তার মা অদিতির সঙ্গে আড়ালে কথা বলতে চেয়েছেন।
—ও কী শীলাদি। তুমি দাঁড়িয়ে আছ এখনও! বাকসটা রাখো! শীলাবতী দাম পুরনো চামড়ার সুটকেস হাতে বিস্ময়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ি! বাঁকুড়ার মতো ছড়ানো বাগানঅলা দোতলা এ নয়। একশো বছরের পুরনো জীর্ণ ভাঙাচোরা বাড়ি। অত বড় মানুষের ছেলের বউ। অত বড় মানুষের বিয়ে করা শাস্তরের মন্তর-পড়া বউ! এর এই দশা? সে যতদূর শুনেছিল বউমাও মা-বাপের একমাত্র সন্তান। সম্পত্তি পেয়েছে। নিজেও কাজকর্ম করে ভাল! এ-ই?
উঁচু চৌকাঠ পার হয়ে হাঁ করে কাঁচা উঠোন। তাতে বেড়ালের ঝগড়া, ছন্নছাড়া দুটো গাছ, শ্যাওলা, জায়গায় জায়গায় ব্লিচিং পাউডারের ছাপকা! কোলাপসিবলের তালা খুলে দরজা খুলে যখন ভেতরে ঢুকল, বসবার ঘরে নিয়ে গেল, তখন অবশ্য সে একটু সোয়াস্তির নিশ্বাস ফেলে। না ভেতরটা ভালই। তাদের ‘মাধুরী-প্রকাশ’ বাড়ির মেঝে চকচকে লাল সিমেন্টের। কিন্তু মাঝে মাঝে ফাটল ধরেছে। বউমার বাড়ি একেবারে রাজবাড়ির মতো রুইতন রুইতন সাদা-কালো মার্বেল দিয়ে মোড়া, দু’-দুটো বসার জায়গা আর দেওয়ালময় ছবি ছবি ছবি। ছবির সামনে থেকে আলো।
—চলো তোমাকে ঘর দেখিয়ে দিই।
আগে নিজের শোবার ঘরে ঢুকল অদিতি।—তোমার বাকসটা হাত থেকে নামাও! ঘরটা কালো একটু ঝেড়েঝুড়ে দিতে গেছে। বসো শীলাদি, ওই চেয়ারটাতে বসো।
শীলাবতীর চোখে জল টলটল করছে। দেরাজের ওপর বউমা আর খোকার ছবি— বিয়ের আগের, বিয়ের সময়ের, বিয়ের পরেকার। একটাই ফ্রেমে বাঁধানো। চমৎকার ফ্রেমটা, বিলিতি বোধহয়। দেখে মনে হচ্ছে না সময় গেছে, অন্যায় অবিচার প্রেমহীনতা বিচ্ছেদ জীবন সব, সব বয়ে চলে গেছে সময় বেয়ে।
একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। শীলাদি এগিয়ে গিয়ে ছবিটা তুলে নিয়ে নিজের আঁচল দিয়ে মুছল যত্ন করে।
—বউমা! তার রুদ্ধ গলা।
—শুধু শুধু কান্না খরচ করছ কেন শীলাদি! অদিতি নরম সুরে বলল।
—এ রকম হয়। কত হয়। না বনলে এ রকম আলাদাই ভাল, বোঝবার চেষ্টা করো।
—তা হলে এটা? ছবিটা বাড়িয়ে ধরল শীলাদি।
—এবার? এবার কী করে বোঝাবে সে? এ যে অতি জটিল মনস্তত্ত্ব! এর গিঁট খুলতে সে অপারগ। চেষ্টাও করে না। ছবিগুলো যখন তোলা হয়েছিল তখনকার আনন্দটা তো এখনও সময়ের পুটে কোথাও-না-কোথাও ধরা আছে! ধরা আছে তার অন্দরেও। ওই রাজ এক আলাদা মানুষ, তাকে অদিতি চেনে। গাঢ় আবেগে বন্ধুতায় আপ্লুত হয়ে ভালবাসে। এখনও তাকে স্বপ্নে দেখে সে। কখনও উৎকণ্ঠা, কখনও রোমান্টিক, কখনও একেবারে সরাসরি যৌন স্বপ্ন। আর্দ্র হয়ে যায়। ঘুম ভাঙলে বাস্তবে ফিরতে সময় লাগে। দারুণ বিপদের সময়ে তার কাঁধে মাথা রেখেছে। সে-ই ভুলিয়েছে। পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গেছে। এখনকার রাজর্ষি গুপ্তর সঙ্গে ওগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই। সত্যিই নেই। এ রাজর্ষি জাস্ট পরিচিত মানুষ। তার বেশি কিছু নয়। এত কথা শীলাদিকে বোঝানো সম্ভব নয়। দরকারই বা কী! প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার জগৎ আছে। স্বতঃস্ফূর্ত। তার কোনও ঠিক বেঠিক নেই।
সে হেসে বলল— রয়ে গেছে!
ডক্টর রায়চৌধুরী বললেন— শুনুন মিস সরকার, সিচুয়েশন খুব ভাল নয়, আপনাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই। —হার্ট ডাইলেটেড হয়ে গেলেই তার কাজটা মন্থর, কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। তার ওপর কোলেস্টেরেল হাই। আর্টারিগুলো থিক হয়ে গেছে। ব্লাডপ্রেশার হাই। সমস্ত অর্গ্যানগুলোর কাজগুলোই ক্রমশ ধীর হয়ে যাচ্ছে। আপনি সাবধানে রাখতে পারেন। নিয়ম করে মাপা খাওয়াদাওয়া, ওষুধ যা দেওয়া হল খাওয়া। হালকা চলাফেরা। প্রথম ক’দিন এখান থেকে গিয়ে বেড রেস্টে রাখবেন। কিন্তু ওই…যে-কোনও সময়ে…।
কোনও উপায় নেই। পালাবার পথ নেই। স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, কর্তব্যবোধের কথা ছেড়েই দাও…একবার মানবিকতার জালে পড়েছ তো তুমি পঞ্চতন্ত্রের জালবদ্ধ মৃগ। কিছুতেই ছাড়া পাবে না। স্টিয়ারিংয়ে হাত, মনে অসীম বিরক্তি, সেই সঙ্গে নিরুপায় করুণা, —একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে যায় অদিতি। আঁদ্রের সঙ্গে যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল! এই রকম, এই রকম একটা অনুভূতি হয়েছিল। অবিকল নয়, কিন্তু কাছাকাছি। অদিতিকে না ছাড়লে সে পিতৃসম্পত্তি পাবে না, অনেক সে সম্পদ। ওর বাবা ওকে মার্কেট ইকনমি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে ঘুরঘুর করত গ্যালারিতে গ্যালারিতে। ল্যুভ-এর ক্লাসে। আর্টিস্ট পাড়ায়। হয়ে গেল ডাকসাইটে শিল্পবোদ্ধা। দু’ হাতে ছবি কেনে, ক্রমশ নিজস্ব গ্যালারি বা সাঁল করে ফেলল। যখন আর্টিস্ট পাড়ায় নীলচোখ-সোনালি চুল আর শ্যাম রং-কালো চোখের দেখা হত, নিছক উৎসাহে, উভয়ের আবেগের জিনিস শিল্পের সম্পর্কে কথা বলতে বলতে হঠাৎ হঠাৎ আঁদ্রের চোখ স্থির হয়ে যেত কালো চোখের ওপর। যেন প্রসঙ্গ ভুলে গেছে, —কী হল? কী যেন বলছিলে?
—ও হ্যাঁ, না… অপ্রস্তুত নীরবতা।
তারপর একদিন বলেই ফেলল— চলো আজ রাতটা আমরা একসঙ্গে কাটাই।
অদিতি ততদিনে নীল চোখে সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। কিন্তু ক্ষীণ, অতিক্ষীণ একটা সংস্কারের স্বর তার ভেতরে কথা বলছিল। বলে যাচ্ছিল। প্রেম নিবেদন নয়, দুটো রোমাঞ্চের কথা নয়, প্রথম পদক্ষেপেই যখন আঁদ্রে রাত কাটাতে চাইল, সে এত ক্ষুব্ধ, এত অপমানিত বোধ করেছিল যে ভাষায় তা প্রকাশ করা চলে না। সে কাঁপা কাঁপা হাতে তার ব্যাগটা তুলে নিয়ে, ছাইমাখা মুখে উঠে গিয়েছিল। আঁদ্রে পিছু ডেকেছিল, উঠে এসেছিল, সে শুধু একবার পিছু ফিরে বলেছিল— সিন ক্রিয়েট কোরো না।
অন্তত সপ্তাহখানেক সে নেহাত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোয়নি। একোলে বা মঁমার্তে যাওয়া তো দূরস্থান। সেই সময়টা অনেক ভাবনা-চিন্তা তাকে পেয়ে বসেছিল। ভেবে দেখতে গেলে আঁদ্রে কোনও অন্যায় করেনি, তাকে সস্তা মেয়েটেয়ে ভেবে কোনও অপমানও সম্ভবত না। এখানে এসব জলভাত। যখন-তখন যে-যার সঙ্গে ইচ্ছে থাকতে চলে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন কেউ কারও সঙ্গে ধারাবাহিক থেকে গেলেও কোনও অধিকার জন্মায় না। আর তার দিক থেকে তো কোনও ভুল নেই-ই। সে ভারতীয়। আর্টিস্ট পাড়া সোজাসুজি এমন প্রস্তাব না দিলেও আকারে ইঙ্গিতে তো বহু দিয়েছেও। ল্যুভ-এ পিকাসো মিউজিয়ামে সব ক্ল্যাসিক স্টাডি করছে তারই মধ্যে। তার কঠিন মুখ, কিংবা প্রসঙ্গ পালটানোর ধরন দেখে ঘাবড়ে গেছে। আর এই ছেলেটা যে যখন-তখন তার চোখে হারিয়ে যায়, গালে এনে দেয় লাল, এই ছেলেটা, নিঃশেষে যার কাছে আত্মসমর্পণের জন্য সে প্রস্তুত, সে কিনা একবার হাতটা ধরল না, একবার ভালবাসার কথা বলল না, একটা চুম্বনের জন্যও কোনও আর্তি দেখাল না, যখন তাদের চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় চুম্বনের স্রোত বয়ে চলেছে, মঁমার্তে, পোঁ দ্য লা কঁকর্দে, প্লাস দ্য ফ্রুস্তাবের ছোট্ট রেস্তোরাঁয়, একেবারে শয্যায় নিয়ে তোলবার কথা তুলে ফেলল! ইন টার্মস অব বেড! হ্যাঁ নিশ্চয়ই, ভারতীয় মনে ভালবাসার সঙ্গে আগে মিশে থাকে মন, তখন শরীর-মন আলাদা করে চেনা যায় না। পরে, সামান্য পরে শরীরী প্রেম শুরু। কিন্তু ইউরোপীয় মনে হয় দুটো আসে একসঙ্গে, নয় শরীর আগে মন পরে আসে আবার আসেও না। এরা দরকারও মনে করে না। মুহূর্তে বাঁচে, মুহূর্তে লয় পায়। প্রেমের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু এতটুকু পূর্বরাগ ভাষায় ও ভঙ্গিতে ও প্রকাশ করতে পারল না? ধিক, ধিক তোমাকে আঁদ্রে, ধিক আমাকে।
এমন করেই সে ভাবছিল, যখন ঝোড়ো কাকের মতো আঁদ্রের উদয় হল। দরজা খুলেই সে সাত হাত পিছিয়ে গেল আগে, কেননা ওর দেহভাষায় এমন এক প্রবল বেগ, প্রবলতর সংরাগ যেন সব বাধা ভেঙে দেবে এমন একটা ঝড় বইছে।
—ভাল দার্জিলিং চা আছে, খাবে?
হকচকিয়ে গেল আঁদ্রে। একেবারে। সে অন্য কিছু ভেবেছিল। অদিতিও ভাবেনি সে এই কথা বলবে। সে চলে প্রধানত ইনস্টিংটের বশে, কখনও বা ইনটুইশন। এই ইনস্টিংটের ভেতরে এত গভীর মনস্তত্ত্ব জ্ঞান লুকিয়ে থাকে যে তা বিশ্লেষণ করলে বোধহয় অধ্যায়ের পর অধ্যায় লিখে ফেলা যাবে। সে নিজেই লিখে ফেলতে পারবে।
আসলে ওই সহজ সুরে গতানুগতিক অন্তিথি ভাষা— আগুনের ওপর আছড়ে পড়া জল। পুরো পরিস্থিতির আগ্নেয়তা এক ঝাপটায় শেষ। আগের প্রসঙ্গ তোলা নয়, কোনও ক্ষমাপ্রার্থনার জায়গা ছেড়ে দেওয়া নয়, মান-অভিমান, ক্রোধ-অভিযোগ এসবের যে-কোনওটা ঘটাতে পারত অগ্নৎপাত। তাই তার বিধির ভেতর থেকে অমন সহজ বোধের সংকেত— ভাল দার্জিলিং-চা আছে, খাবে?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আঁদ্রে ভেতরে ঢুকে এল।
এই চা মা পাঠিয়েছে এবার। শ্রেষ্ঠ চা। দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। সুগন্ধে ম’ ম’ করছে চারদিক। এই চা-য়ের সঙ্গে সত্যি কথা বলতে কি কিছু চলে না। বিস্কিট, কুকিজ, কিচ্ছু না— রসভঙ্গ হয়। কেননা প্রত্যেক খাবারের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, সেটা দার্জিলিং চায়ের সুরভির মধ্যে ছন্দপতনের মতো ঢুকে পড়ে। তবু চায়ের সঙ্গে কিছু দেশি ডালমুট পরিবেশন করল অদিতি। এইটা আঁদ্রে খুব ভালবাসে। শুধু আঁদ্রে কেন, অনেককেই সে ডালমুট ধরিয়েছে।
একটু ডালমুট মুখে পুরে আঁদ্রে বলল— তা হলে তুমি মনে রেখেছ!
—কী! একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল অদিতি।
—এই… ডালমুট আমি ভালবাসি।
—শুধু তুমি কেন, আমার সব ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালীয় বন্ধুরাই এটা ভালবাসে।
আঁদ্রের মুখে ছায়া নামল।
—কিন্তু আমি তোমাকে পরামর্শ দেব, আগে দু’-এক চুমুক চা খাও।
—তাই?
অদিতি নিজের কাপটা মুখের কাছে তুলল। সাদা ধবধবে টিউলিপ ফুলের মতো দেখতে কাপ। সাদা ছাড়া বস্তুত এই চায়ের হালকা রংটা খোলে না। এখন টিউলিপের গা দিয়ে আভা বেরোচ্ছে।
—দারুণ। আশ্চর্য! —আঁদ্রে বলল- মের্সি,
—কথা বোলো না, শুধু উপভোগ করো।
খুব নীরবে চা-পান সমাপ্ত হল। আঁদ্রে খুব কোমল নম্র গলায় জিজ্ঞাসা করল —জাপানিদের চা-পান অনুষ্ঠানের কথা পড়েছি। ভারতীয়দেরও আছে তা জানতাম না।
ভেতরে ভেতরে অদিতির মজা লাগছিল। খুব সিরিয়াসলি বলছে। সত্যিই ভেবেছে এটা একটা রিচুয়্যাল।
—কত জিনিসই তো আমরা জানি না, জানতে চাই না। যাক, কিছু নাকি পিকাসো এসেছে অকশনে। সত্যি!
—হ্যাঁ গোড়ার দিকের আঁকিবুকি। কত তো এঁকে এখানে-সেখানে ফেলে দিত।
—কিনছ নাকি?
—নাঃ।
—কেন? ভাল ইনভেস্টমেন্ট হত!
—তুমি ভুলে যাচ্ছ অদিতি, আমি আর্টকে বিজনেস প্রপোজিশন বলে দেখি না।
অদিতি চুপ করে রইল।
একটু পরে আঁদ্রে বলল—তুমি কি ভুলে যেতে চাইছ, মনে রাখতে চাইছ না?
এইবারে অদিতির মস্তিষ্কের মধ্যে কড়কড় করে বাজ ডেকে উঠল। সেই অশনিসংকেত বেরিয়ে এল গলা দিয়ে— ভুলে যাব! সম্ভব? জীবনে কোনওদিন ভুলে যাব না, একজন সহমর্মী বন্ধু যুবক আমাকে খুব সহজে, হেলায়ফেলায় কু-প্রস্তাব দিয়েছিল।
—তোমরা প্রাচ্যদেশীয়রা খুব রক্ষণশীল আমি জানি, আঁদ্রের চোখে মিনতি।
—তোমরা পশ্চিমারা খুব উচ্ছৃঙ্খল আমিও জানি, অদিতির উত্তর সঙ্গে সঙ্গে।
—আমরা এভাবেই বড় হয়েছি। নিশ্চয় সেটা দোষ নয়।
—আমরাও এভাবেই বড় হয়েছি। সেটাও নিশ্চয় দোষ নয়!
—আমি … আমি তোমার জন্য কামনায় চুরমার, চুরমার হয়ে ভেঙে যাচ্ছি।
—আমি … আমি তোমার প্রতি বিতৃষ্ণায় চুরমার হয়ে যাচ্ছি।
—আমার এই ক্ষুধা…ক্ষুধাটাকে তুমি বুঝতে পারছ না। অদিতি তুমি না আমার বন্ধু?
—ক্ষুধা মেটাতে তোমাদের এই পারী শহরে অনেক বন্ধু আছে, তাদের কাছে যাও না আঁদ্রে।
বজ্রাহতের মতো বসে রইল আঁদ্রে। কাপ-প্লেটগুলো ট্রে-তে গুছিয়ে তুলে পেছন ফিরে রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল অদিতি। সে অনুভব করছিল একটা হতাশা, একটা সংরক্ত বিষাদ তাকে পেছন থেকে বিঁধছে।
আঁদ্রে বলতে লাগল।
—আমি … আমি স্বীকার করছি আমি ভার্জিন নই। শুধুমাত্র সেক্স হলে সেটা আমি মিটিয়ে নিতেই পারতাম। কিন্তু আমি যে প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গেছি ওদিৎ। আমার কী উপায় হবে, ভাবো … ভাবো একবার! আমি, আমি কি যথেষ্ট পুরুষ নই!
কোথায় আঁদ্রের লেগেছে এবার ভাল করে বুঝতে পারল অদিতি। ঠিক কোন জায়গাটায়। তার দয়া হল না। বিতৃষ্ণা বেড়ে গেল। সে বাসনগুলো ধুয়ে মুছে অর্থাৎ বেশ সময় ব্যয় করে তবে আবার এসে লাউঞ্জে আঁদ্রের মুখোমুখি হল। ও তেমনই বসে আছে। কিছুক্ষণ পর বলল— আমার কথার জবাব দিলে না? আমি জানি প্রবল পুরুষ না হলে ভারতীয় নারীদের আকৃষ্ট করা শক্ত। আমার মতো এ রকম…মানে নরম…চেহারার একজন যুবক …
এ ছেলেটাকে ভারতীয় নারী সম্পর্কে এত জ্ঞানগম্যি কে দিয়েছে? ভাবল অদিতি। সে যাই হোক, কী ভাবে এগোলে সে সাড়া দিতে পারবে সে সম্বন্ধে এ একেবারে অজ্ঞ। কোনও চৈতন্যই নেই। সে কি সোজাসুজি বলবে, লাভ-মেকিং বলে তোমাদের যে কনসেপ্টটা আছে, আমাদের কাছে সেটার মানে কিন্তু কূজন। অনেক শব্দ-স্পর্শ-দর্শন-শ্রবণের ফোর-প্লে পার হয়ে প্রেম, অনেক প্রেম পার হয়ে তবে তোমাদের লাভ-মেকিং। অন্ততপক্ষে প্রথম প্রথম, পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে কী হয় না হয় প্রত্যক্ষভাবে তার জানার কথা নয়। কিন্তু অনুমানে তো জানেই। চারদিকে যা দেখছে তার থেকেই জানে। সেসব ভবিষ্যতের কথা। ভেবে লাভ নেই। কিন্তু ওর ওই স্বীকারোক্তি! ভার্জিন নই! জানে তবু সে সেভাবে জানে না। পাশ্চাত্য সভ্যতায় তরুণ হওয়ামাত্র সদ্য-জাগা শারীরিক কামপ্রবৃত্তিকে তুষ্ট করতেই হবে। অন্তত কোনও বাধা নেই। যে সে কাজ করে না সেই বরং অপাংক্তেয় হয়ে যায় বন্ধুদের কাছে। এ এদের বহুদিনের ঐতিহ্য। রাশিয়ানরা মস্কোয় বা প্যারিসে পড়তে এসে রীতিমতো রক্ষিতা রাখত। না রাখলে তাদের আভিজাত্য প্রমাণ হত না। অনেকটা হুতোম প্যাঁচাদের কালের বঙ্গ যুবকদের মতো। এদের এখন আর রক্ষিতা রাখতে হয় না। তরুণী মেয়েদের মধ্যেও এখন ক্ষুধা-প্রকাশের একই তরিকা। সুতরাং কাম পেলেই শুয়ে পড়ো, কিংবা লিভ-টুগেদার করো। প্রকৃতপক্ষে সেই সনাতন প্রস্তাবই তাকে দিচ্ছে ছেলেটি।
—তোমার আর কিছু বলবার আছে?
—এত, এত, যে কী ভাবে শুরু করব, কোনখান থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না।
—বোঝার কাজটা শুরু করে ফেলো, যখন গুছিয়ে উঠতে পারবে তখন এসো। এখন তুমি গেলেই আমি স্বস্তি বোধ করব।
তার পরেও আঁদ্রে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বেশির ভাগটাই মাটির দিকে, কিংবা দেওয়ালময় নানান ক্ল্যাসিকের প্রিন্টের দিকে চেয়ে। পোস্টারের দিকে। অদিতিরই করা। তারপরে মিয়োনো গলায় বলল— যাই তা হলে!
—হ্যাঁ এবার যাও।
এত বোকা লোকটা, এরপর তার কাছে বিয়ের সম্মানজনক প্রস্তাব নিয়ে এল। মানে বিছানায় তোলার অধিকার।
অদিতি বলল— তুমি কি ভেবেছ আমি তোমাকে লাইসেন্স বার করতে বলেছি?
—আমি জানি ভারতীয় মেয়েরা বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের কৌমার্য রক্ষা করে।
—এক কাজ করো আঁদ্রে তুমি বরং একটা বই লিখে ফেলো।
—হঠাৎ?
—এই সাবজেক্টটার ওপরে। ভারতীয় মেয়ে। তারা কী চায় না চায়, কী রক্ষা করে না করে।
—তুমি কি আমাকে ভালবাসো না? আমার ধারণা ছিল— বাসো।
—আমারও তো তাই ধারণা ছিল।
—ছিল? মানে এখন নেই?
—আমি তোমাকে, তোমার ধরনধারণকে পছন্দ করতে পারছি না আঁদ্রে।
এতদিনে, এই এতদিনে বোধহয় আঁদ্রের সহজাত বোধে কিছু ধরা দিল। বন্ধুভাবে মেলামেশা করতে লাগল, বাড়িতে আসতে লাগল, এই বাসন ধুয়ে দিচ্ছে, এই দেওয়ালের ছবিগুলো ঠিক করে সাজিয়ে দিচ্ছে। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা আলোচনা চলছে দু’জনের — কবিতা, উপন্যাস, বালজাক, জোলা, আঁদ্রে জিদ, বদলেয়র, পিসারো, সেজান। ছবি আঁকছে অদিতি সে ধৈর্য ধরে ঠায় পাশে বসে। মোড়কে করে খাবার আনছে, যাতে অদিতিকে রান্না করতে না হয়। অনেক রাত। ফেরবার সময়ে আরক্ত মুখে একবার চায়, তারপর অদিতির হাতে চুমো রাখে, চলে যায়। কোনওদিন গালে বিদায়ী চুম্বন। একেক সময়ে তার বুকটা টনটন করে। নিকট হলেই ঘিরে ধরে একটা মোহ, মুগ্ধতা, ইচ্ছে করে ওর কাঁধে মাথা রাখে। আঁদ্রে খুব বেশি লম্বা নয়, অদিতি বেশ লম্বা। দু’জনের দৈর্ঘ্যের অনুপাতটা যেন আশ্লেষের জন্যই তৈরি। তবু তবু …