দুপুরের মধ্যেই ভিসা আর টিকিট
দুপুরের মধ্যেই ভিসা আর টিকিট হয়ে গেল, সন্ধেবেলা প্লেন। মোটে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে কলকাতা থেকে চিটাগাং যেতে। ছোট্ট এয়ারপোর্ট, সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছেন সিরাজুল চৌধুরী। বেশ বড়সড় চেহারা, নাকের নীচে মোটা গোঁফ, দেখলেই জবরদস্ত পুলিশ অফিসার বলে মনে হয়।
তিনি কাকাবাবুর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, আসুন, আসুন রায়চৌধুরী সাহেব। এই প্রথম চিটাগাং এলেন, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম!
কাকাবাবু বললেন, আগেও এসেছি, কেউ জানতে পারেনি। এবারেও কাউকে জানাবেন না। এই আমার ভাইপো সন্তু!
সিরাজুল সাহেব বললেন, আমি বই-টই বিশেষ পড়ি না। তবে আমার ছেলেমেয়েরা আপনাদের কথা জানে। তারা এই সন্তুর খুব ভক্ত। তারা ঢাকায় আছে, একদিন আমাদের বাড়িতে যেতে হবে।
গাড়িতে ওঠার পর তিনি আবার বললেন, নিপুর কোনও খোঁজ পেলেন? আমার দৃঢ় ধারণা, তাকে কলকাতাতেই নিয়ে গেছে। বম্বেতেও চালান করে দিতে পারে। ও, আপনারা তো এখন বম্বেকে মুম্বই বলেন তাই না?
কাকাবাবু বললেন, অসীম দত্ত সেসব ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। কক্সেসবাজার যাব, সেখানে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে?
সিরাজুল চৌধুরী বললেন, অনেক জায়গা আছে। সুন্দর ব্যবস্থা। গিয়ে দেখবেন, সে-শহরের কত বদল হয়ে গেছে। এখানেও আপনাদের জন্য গেস্ট হাউসের ব্যবস্থা করেছি। অসীম যদি নিপুকে উদ্ধার করে ফেরত পাঠাতে পারে, তবে বড়ই কৃতজ্ঞ হব। এখানে আপনারা যা সাহায্য চান, পাবেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, যে ম্যাজিশিয়ানের খেলা দেখতে গিয়ে নিপু নামের ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গেছে, তার মুখে কি মুখোশ ছিল?
সিরাজুল সাহেব চমকে উঠে বললেন, আপনি জানলেন কী করে? হ্যাঁ, সে একটা মুখোশ পরে ছিল, অনেকটা কমিকসের ফ্যান্টমের মতন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তার একজন সহকারী ছিল কি, যার মাথায় একটাও চুল নেই, ভুরুও নেই!
সিরাজুল সাহেব বললেন, সেরকম কিছু রিপোর্ট পাইনি। সহকারীর কথা কেউ বলেনি।
কাকাবাবু বললেন, এখান থেকে আর কোনও ছেলে হারাবার খবর পাওয়া গেছে কি?
সিরাজুল সাহেব বললেন, দেশে এত মানুষ, কিছু কিছু হারিয়ে যায়, সন্ধান পাওয়া যায় না। অনেকে পুলিশে খবরও দেয় না।
কাকাবাবু বললেন, তবে ম্যাজিক দেখিয়ে সতেরো-আঠারো বছরের ছেলেদের উধাও করার মধ্যে বেশ নতুনত্ব আছে, তাই না?
সিরাজুল সাহেব বললেন, চোরেরা এই কায়দাটা কেন নিয়েছে জানেন? রাস্তাঘাট থেকে ছেলে-মেয়ে চুরি করতে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর ধরা পড়লেই লোকের হাতে মার খেতে-খেতে প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। ম্যাজিক দেখিয়ে অদৃশ্য করলে সে ভয় নেই। লোকে ভাববে ম্যাজিকের খেলা, একটু পরে ফিরে আসবে। কিংবা ছেলেটা ইচ্ছে করে লুকিয়ে আছে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছেন। এইজন্যই বাচ্চাদের বদলে বড় বয়েসের ছেলেদের নিচ্ছে, যারা ইচ্ছে করে লুকিয়ে থাকতে পারে। যাদের নিয়ে কেউ প্রথমেই বেশি চিন্তা করে না।
কথা বলতে বলতে গাড়িটা পৌঁছে গেল গেস্ট হাউসে। বড় বড় গাছপালায় ঘেরা সেই বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখাই যায় না। কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার পর সামনে চওড়া বারান্দা, পাশাপাশি অনেক ঘর।
সিরাজুল চৌধুরী লোকজনদের ডেকে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। কাকাবাবুকে বললেন, আপনাদের এখানে কোনও অসুবিধে হবে না, যা দরকার হয় চাইবেন। রায়চৌধুরী সাহেব, আপনার সঙ্গে কয়েকদিন থাকতে পারলে আমার ভাল লাগত খুব। কিন্তু তার উপায় নেই, আমায় কালই ঢাকায় যেতে হবে বিশেষ কাজে। আমার দুজন অফিসার আপনাদের দেখাশুনো করবে।
কাকাবাবু বললেন, না, না, আপনি ব্যস্ত মানুষ আমি জানি। আমাদের দেখাশুনো করবার দরকার নেই। শুধু কক্সেসবাজারে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিলেই হবে। আমি মহেশখালির পুরনো মন্দিরটা একবার দেখতে যাব।
সিরাজুল চৌধুরী বললেন, কাল সকালেই আপনাদের জন্য একটা গাড়ি আসবে। সে-গাড়িটা যতদিন খুশি সঙ্গে রাখবেন। সব জায়গায় নিয়ে যাবে।
সিরাজুল সাহেব চলে যাওয়ার পরই গেস্ট হাউসের ম্যানেজার দুটি বড় বড় প্লেটে ভর্তি নানারকম খাবার নিয়ে এলেন। তাতে কচুরি-শিঙাড়া থেকে শুরু করে অনেকরকম কেক-পেস্ট্রি সাজানো রয়েছে।
সন্তু বলল, এত খাবার কী করে খাব?
কাকাবাবু বললেন, বাংলাদেশের মানুষরা খুব খাওয়াতে ভালবাসে। কাল থেকে দেখবি, যার সঙ্গে আলাপ হবে, সেই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে চাইবে। কারও বাড়িতে নেমন্তন্ন মানেই পাঁচ-ছরকমের মাছ আর তিন-চাররকমের মাংস থাকবেই।
সন্তু শুধু একটা শিঙাড়া তুলে নিয়ে কামড় দিল। তার মনে হল, জোজো খেতে ভালবাসে, সে এখানে থাকলে খুশি হত! জোজোকে এদিকে কোথাও ধরে রেখেছে, না আরব দেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে? কিংবা সে আছে হিমালয়ে?
হঠাৎ সন্তুর চোখদুটো জ্বালা করে উঠল। জোজো কি চিরকালের মতন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে?
রাত্তিরবেলা ডিনারের সময়ও প্রচুর খাবার দেওয়া হল। কাকাবাবু বা সন্তু কেউই বেশি খেতে পারে না। জোজোর কথা বেশি করে মনে পড়ায় সন্তুর আজ কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।
গেস্ট হাউসটাতে অনেক ঘর, কিন্তু আর কোনও ঘরে লোক নেই। কর্মীরা থাকে পেছনের দিকে। রাস্তায় কোনও গাড়িঘোড়ার শব্দও শোনা যায় না। দশটার মধ্যে চতুর্দিক একেবারে সুনসান।
কাকাবাবু বারান্দাটা একবার ঘুরে দেখে নিয়ে ঘরে এসে ভাল করে দরজা বন্ধ করলেন। রিভলভারটা বালিশের নীচে রেখে বললেন, রাতটা একটু সাবধানে থাকিস সন্তু। রাত্তিরে কিছুতেই ঘরের বাইরে যাবি না।
আলো নিভিয়ে দেওয়ার পর সন্তুই ঘুমিয়ে পড়ল আগে।
সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল কিছু একটা ঠাণ্ডা জিনিসের ছোঁয়ায়। তার কপালে কেউ যেন এক চাঙড় বরফ রেখেছে। সে সেখানে হাত দিতেই টের পেল, বরফ নয়, কারও হাত। অসম্ভব ঠাণ্ডা, মানুষের হাত এত ঠাণ্ডা হতে পারে না। তারপরই একটা ঘরর ঘরর শব্দ পেল। তার শিয়রের কাছে একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখদুটো ঠিক টর্চের আলোর মতন জ্বলছে। ঘরের দরজা বন্ধ, তবু এই লোকটা কী করে ঢুকল? মানুষ নয়, ভূত? ধুত! সন্তু ভূত বিশ্বাস করে না। ভূত বলে কিছু নেই। তবে কি অন্য গ্রহের প্রাণী? তাই-ই হবে নিশ্চয়ই, মানুষের চোখ ওইরকম ভাবে জ্বলে না।
এইবার সেই প্রাণীটা সন্তুর হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল। তার হাতে অসম্ভব জোর। সন্তু ছাড়িয়ে নিতে পারল না নিজেকে। কাকাবাবুকে সে ডাকতেও পারছে না, গলা শুকিয়ে গেছে।
সেই প্রাণীটা তাকে দরজার কাছে নিয়ে যেতেই দরজাটা খুলে গেল আপনা থেকে। বাইরে এসে সন্তু দেখল, বারান্দার নীচে বাগানে বনবন করে ঘুরছে একটা আলোর মালা। তার নীচে একটা পালকির মতন জিনিস, ভেতরে বসার জায়গা, তা-ও অনেক রঙের আলো দিয়ে সাজানো। এটা কি একটা ছোট্ট হেলিকপ্টার, না মহাকাশযান?
এবার সেটার পেছন থেকে বেরিয়ে এল সেই টাকমাথা লোকটা। সারা গায়ে চকচকে কোনও ধাতুর পোশাক, মুখটা শুধু বেরিয়ে আছে। এরও চোখ জ্বলজ্বল করছে। ও, এ-লোকটাও তা হলে মহাকাশের প্রাণী?
সে হাতছানি দিয়ে সন্তুকে ডাকল।
সন্তু এবার চেঁচিয়ে উঠল, না, যাব না! আমি যাব না!
অন্য প্রাণীটা সন্তুকে টানতে লাগল, সন্তু নিজেকে ছাড়াতে পারছে না, ছটফট করছে…
এই সময় তার স্বপ্নটা ভেঙে গেল। তবু বুঝতে সময় লাগল কিছুটা। সত্যি স্বপ্ন? হ্যাঁ, সে বিছানাতেই শুয়ে আছে, ঘরের দরজা বন্ধ। অন্ধকার কিছুটা পাতলা হয়ে গেছে, ঘরের মধ্যে কেউ নেই।
এরকম একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখার কোনও মানে হয়? সন্তু বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল, এখনও তার বুক ধকধক করছে।
ভয় পাওয়ার জন্য এখন তার লজ্জা হল। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলেও আর তার ঘুম এল না। টাকমাথা লোকটাকে সে অন্য গ্রহের প্রাণী বলে দেখল কেন স্বপ্নে? সেরকম কেউ এলে মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নাকি? তবে লোকটার হাবভাব বেশ অস্বাভাবিক ঠিকই। বোবা সেজে ছিল। কিন্তু সে বাংলা লিখতে পারে, যতই ভুলভাল বানান হোক!
ক্রমে ভোর হয়ে এল, পাখি ডাকতে লাগল। এখানে অনেক পাখি। জানলা দিয়ে ভোরের আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়ায় সন্তু দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। সকালটা কী সুন্দর। এখনও আর কেউ জাগেনি। কাল সন্ধের পর এখানে এসেছে বলে বোঝা যায়নি। এখন দেখা গেল বাগান-ভর্তি নানা জাতের ফুল। অনেক ফুল সন্তু চেনেই না। দুটো হলুদ পাখি এক গাছ থেকে আর-এক গাছে উড়ে গেল।
এইসব সুন্দর দৃশ্য দেখতে-দেখতে রাত্তিরের দুঃস্বপ্নটা আস্তে-আস্তে মুছে গেল সন্তুর মন থেকে। কাকাবাবু জেগে ওঠার পর তাঁকে কিছুই বলল না।
ব্রেকফাস্ট খাওয়ার টেবিলে বসতেই একটা গাড়ি এসে থামল। তার থেকে নেমে এল দুজন তরুণ অফিসার। কাছে এসে একজন বলল, আসসালামু আলাইকুম। আর-একজন বলল, নমস্কার। একজনের নাম মুস্তাফা কামাল, আর-একজনের নাম তথাগত বড়য়া।
তথাগত বলল, সার, আপনারা কোথায় যেতে চান বলুন। আমি আপনাদের নিয়ে যাব। এখানে আশপাশে অনেক দেখবার জায়গা আছে।
কাকাবাবু বললেন, আমি আপাতত কক্সেসবাজার যেতে চাই। ফেরার পথে চট্টগ্রাম ঘুরে দেখব।
তথাগত বলল, তা হলে কামাল আপনার সঙ্গে যাবে। ওটা ওর এলাকা। কাল রওনা হবেন, আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে দুটি ডাল-ভাত খেতে হবে।
কামাল বলল, দুপুরে আমার বাড়িতে। আমার স্ত্রী বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছেন আপনাদের।
কাকাবাবু বললেন, ওসব খাওয়াদাওয়া পরে হবে, আগে বরং কক্সেসবাজার ঘুরে আসি। এখনই বেরিয়ে পড়তে চাই।
আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে কাকাবাবু ও সন্তু গাড়িতে চড়ে বসল। চট্টগ্রাম শহরটি বড় মনোহর। ছোট-ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কর্ণফুলী নদী, কাছেই সমুদ্র। সেসব কিছুই দেখা হল না, গাড়িটা একটু পরেই শহর ছাড়িয়ে পড়ল ফাঁকা রাস্তায়।
সন্তু কাকাবাবুর এত ব্যস্ততার কারণ বুঝতে পারল না। কক্সেসবাজার যাওয়া হচ্ছে তো অনেকটা আন্দাজে। টাকমাথা লোকটা লিখেছিল, মহিষ কালী, সেটা যদি কালী মহিষানি হয়, তা হলে যাওয়া উচিত ছিল হিমালয়ে। কিংবা ওই লোকটা কাকাবাবুকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য হিজিবিজি কিছু একটা লিখে দিয়েছে।
রাস্তা বেশ মসৃণ, গাড়িটাও বিদেশি। যাওয়া হচ্ছে আরামে। কাকাবাবু কামালকে জিজ্ঞেস করছিলেন তার বাড়ি কোথায়, কতদিন হল সে চাকরিতে ঢুকেছে, এইসব। এক সময় বললেন, আচ্ছা কামাল, আমি শুনেছিলাম চিটাগাং-এর লোক এমন ভাষায় কথা বলে, যা বাইরের লোক প্রায় কিছুই বুঝতে পারে না। এমনকী ঢাকার লোকেরাও বুঝতে পারে না। কিন্তু তোমার কথা তো সব ঠিকঠাক বুঝতে পারছি।
কামাল হেসে বলল, আমরা বাইরের লোকের সঙ্গে আজকাল সে-ভাষায় কথা বলি না। নিজেদের মধ্যে বলি। সে-ভাষা শুনলে সত্যিই আপনারা বুঝতে পারবেন না।
কাকাবাবু বললেন, একটুখানি শোনাও তো।
কামাল ফরফর করে কী খানিকটা বলল, তার একবর্ণও বোঝা গেল না! কাকাবাবু বললেন, শুনে তো মনে হল বার্মিজ!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কক্সেসবাজার জায়গাটাকে এখানকার লোক কী বলে?
কামাল বলল, কেউ বলে ককস্যাসবাজার, কেউ বলে, কশোবাজার।
সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, আর মহেশখালিকে কী বলে?
কামাল বলল, আমরা মহেশখালিই বলি। ড্রাইভারসাহেব কী বলেন দেখা যাক। ও ড্রাইভারসাহেব, আপনি মহেশখালি গেছেন?
ড্রাইভার মুখ ফিরিয়ে বললেন, কী কইলেন সার? মইশকালি? হ, গেছি। লঞ্চে যাইতে হয়।
সন্তু কাকাবাবুর দিকে আড়চোখে তাকাল। কাকাবাবু বললেন, চট্টগ্রাম শহরটার নামও কত বদলে গেছে। কেউ বলে চাটগাঁ, সেটা তবু বোঝা যায়। কিন্তু চিটাগাং শুনলে মনে হয় অন্য নাম। হয়তো আগে চিটাগাং-ই নাম ছিল, তার থেকে শুদ্ধ করে চট্টগ্রাম বানানো হয়েছিল।
কামাল বলল, এই রাস্তাটা ধরে সোজা গেলে বার্মা পৌঁছোনা যায়।
টেকনাফ বলে আমাদের একটা জায়গা আছে, তার পরেই বার্মার বর্ডার।
কাকাবাবু বললেন, এখন আর বার্মা বলা যাবে না। নতুন নাম হয়ে গেছে। মায়ানমার। কত নামই যে বদলে যাচ্ছে! ভাগ্যিস কলকাতার নামটা বদলায়নি।
রাস্তার দুধারে মাঝে-মাঝে ঘন জঙ্গল। কখনও যেতে হচ্ছে দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে। মধ্যে-মধ্যে ছোট-ছোট গ্রাম। রাস্তা দিয়ে যেসব মানুষজন যাচ্ছে, তাদের অনেকের চেহারা বার্মিজদের মতন।
কক্সবাজার পৌঁছবার মুখে এক জায়গায় কামাল বলল, ওই দেখুন সমুদ্র! রাস্তাটা সেখানে বেশ উঁচু, সেখান থেকে নীল সমুদ্র দেখা যায়। তারপর রাস্তাটা নিচু হয়ে শহরে ঢুকে গেছে। কাকাবাবু বললেন, এ-শহরটা যে চেনাই যায় না! আমি দশ বারো বছর আগে এসেছিলাম, তখন ছিল নিরিবিলি ছিমছাম শহর। এখন কত বড় বড় বাড়ি।
কামাল বলল, হ্যাঁ, লোক অনেক বেড়ে গেছে। অনেক টুরিস্ট আসে তাই প্রচুর হোটেল হয়েছে, আরও বানানো হচ্ছে।
গাড়ি এসে থামল একটা টুরিস্ট লজে। অনেকখানি জায়গা নিয়ে তৈরি, দুপাশে বাগান, কাছাকাছি আর কোনও বাড়ি নেই। ঘরের জানলা দিয়ে সমুদ্র চোখে পড়ে। বেলাভূমিতে অনেক লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
জিনিসপত্র ঘরে রেখে দেওয়ার পর কামাল বলল, কাকাবাবু, আপনি মহেশখালির মন্দির দেখতে যাবেন বলেছিলেন। আপনাদের জন্য স্পিড বোট রেডি আছে। কখন যেতে চান বলুন?
কাকাবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, এখন সওয়া দশটা। দুপুরটা কী করব? এখনই ঘুরে আসা যাক না!
কামাল বলল, অনেকটা সময় লাগবে কিন্তু। দুপুরে খেতে বেশ দেরি হয়ে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, একদিন না হয় দেরিতেই খাব। না খেলেই বা ক্ষতি কী! কী বলিস সন্তু?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, এক্ষুনি যাব।
কাকাবাবু কামালের কাঁধ চাপড়ে বললেন, তোমাকেও আজ না খাইয়ে রাখব।
কামাল হেসে বলল, আমার অভ্যাস আছে।
আবার বেরিয়ে পড়া হল। যাওয়ার পথে একটা দোকানে বেশ পুরুষ্টু চেহারার সোনালি রঙের মর্তমান কলা দেখে কাকাবাবুর খুব পছন্দ হয়ে গেল, কিনে নিলেন এক ডজন।
পাকা জেটি এখনও তৈরি হয়নি, একটা সরু লম্বা কাঠের পুলের দুধারে অনেক নৌকো, স্পিড বোট, ছোটখাটো লঞ্চ বাঁধা রয়েছে। কোনও-কোনওটা কাদার ওপর। ভাটার সময় বলে জল নেমে গেছে। জায়গাটায় খুব মাছ-মাছ গন্ধ।
পুলটার একেবারে শেষপ্রান্তে একটা স্পিড বোটে চাপল ওরা। চালকটি ঘুমোচ্ছিল, ধড়মড় করে উঠে বসে সেলাম দিয়ে বলল, সার, আমার নাম আলি।
লোকটির চেহারাটি ছোট্টখাট্টো হলেও বেশ একটা চটপটে ভাব আছে। মুখোনা হাসি মাখা। তাকে পছন্দ হয়ে গেল কাকাবাবুর। চালক পছন্দ না হলে কোনও গাড়িতে চেপেই সুখ নেই।
ভটভট শব্দ করে স্পিড বোটটা চলতে শুরু করল। প্রথম থেকেই বেশ জোরে। সাঁ-সাঁ করে জল কেটে ছুটছে, মাঝে-মাঝে বড় ঢেউ এলে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে।
কাকাবাবু বললেন, কী রে সন্তু, আগে কখনও স্পিড বোটে চেপেছিস? সন্তু প্রথমে বলল, না। তারপর বলল, ও হ্যাঁ, একবার সুন্দরবনে।
কাকাবাবু বললেন, সে তো নদীতে। সেখানে এরকম বড়বড় ঢেউ তো নেই। আমি কখনও সমুদ্রে স্পিড বোটে ঘুরিনি।
সন্তু বলল, সিনেমায় দেখেছি।
কাকাবাবু কামালকে জিজ্ঞেস করলেন, এই বোট কি কখনও উলটে যেতে পারে?
কামাল বলল, সহজে ওলটায় না।
কখনও কঠিন অবস্থায় পড়লে উলটে যায়?
তা যায়। ঝড়-বাদলের সময় বেশি ভয় থাকে।
উলটে গেলে কী হয়? যাত্রীরা প্রাণে বাঁচে?
দেখুন, খানিকটা তো রিস্ক থাকেই। তবে, এই বোট উলটে গেলেও ড়ুবে যায় না। আবার সোজা করে নেওয়া যায়। ততক্ষণ সাঁতার কেটে থাকতে হয়।
যদি কেউ সাঁতার না জানে?
তা হলে তো খুব বিপদ। আমাদের এদিকে সব লোকই সাঁতার জানে। আপনি জানেন না?
সাঁতার তো জানি। কিন্তু সমুদ্রে সাঁতার কাটা কি সহজ কথা? খোঁড়া পায়ে কতক্ষণই বা পারব?
তা হলে কি ফিরে যাব? পরে প্যাসেঞ্জার লঞ্চে আসা যেতে পারে। সেগুলো অনেক বড়, খুব ঝড় বাদল না হলে ভয় থাকে না।
না, না, ফিরে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমার বেশ ভালই লাগছে। কী রে, সন্তু, ভয় পাচ্ছিস না তো?
সন্তু জোরে-জোরে দুদিকে মাথা নাড়ল। জেটি ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে আসার পর বোটটা এমনিতে ঠিকভাবেই চলছে, হঠাৎ-হঠাৎ কোথা থেকে ঢেউ আসছে, অমনই লাফিয়ে ওঠে, তখন বুকটা কেঁপে ওঠে ঠিকই। সন্তু দুহাতে শক্ত করে ধরে আছে পাটাতন।
কাকাবাবু বোটের চালককে বললেন, আলিভাই, সাবধানে চালাবেন। আপনার ওপর আমাদের জীবন নির্ভর করছে।
আলি কাকাবাবুর ক্রাচদুটো একবার দেখে নিয়ে বলল, আপনার মতন কোনও প্যাসেঞ্জার এই বোটে ওঠে নাই।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো অনেকদিন চালাচ্ছেন। এর মধ্যে একবারও বোেট উলটেছে?
আলি বলল, তা ধরেন পাঁচ-ছয়বার তো হবেই।
কাকাবাবু বললেন, পাঁচ-ছবার? সবাই ঠিকঠাক ছিল, নাকি কেউ-কেউ…
আলি বলল, এই তো গত মাসেই, লস্কর সাহেবের পোলাডা, কী যে হইল, আর পাওয়াই গেল না।
কামাল বলল, পোলাডা মানে বুঝলেন? ছেলেটা।
কাকাবাবু বললেন, থাক, ওসব কথা থাক। আচ্ছা কামাল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এখানে তো বেশ কয়েকটা দ্বীপ আছে, তাই না? যদি কেউ বলে, একটা দ্বীপে কেউ একটা মস্ত বড় চারতলা সাদা বাড়ি বানিয়ে রেখেছে, তা হলে সে কথাটা গাঁজাখুরি মনে হবে, তাই না?
কামাল বলল, মোটেই না। এরকম বাড়ি তো আছে। একটা না, অনেক।
কাকাবাবুই এবার অবাক হয়ে বললেন, সে কী? দ্বীপগুলোতে তো গরিব লোকেরা থাকে। তাদের ছোট-ছোট মাটি-খড়ের বাড়ি, বড়জোর টালির বাড়ি। সেখানে হঠাৎ মস্ত বড় তিন-চারতলা পাকা বাড়ি কে বানাবে? আমি আগেরবার এসে তো এরকম কিছু শুনিনি!
কামাল বলল, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামেই বহু জায়গায় এরকম বাড়ি ছড়িয়ে আছে। এগুলোকে বলে সাইক্লোন শেলটার। প্রায় প্রত্যেক বছরই এদিকে সাঙ্ঘাতিক সাইক্লোন হয়, বহু লোক মারা যায়—
সন্তু খুব আগ্রহ নিয়ে এই কথাবার্তা শুনছিল, এবার সে বলে উঠল, খুব ঝড় হলেই খবরের কাগজে কক্সবাজারের নাম দেখি। এখানেই বেশি ঝড় হয় কেন?
কামাল বলল, এটাকে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা বলতে পারো। বঙ্গোপসাগরের এক জায়গায় ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, তারপর সেটা এইদিকে ধেয়ে আসে। পশ্চিমবাংলার পাশ দিয়েই আসে, কিন্তু আশ্চর্য, সেখানে এই ঝড়ের ঝাপটা লাগে না। আপনাদের ডায়মন্ড হারবার কিংবা কলকাতা প্রত্যেকবার বেঁচে যায়, ঝড়ের যত তেজ সব এসে আছড়ে পড়ে চিটাগাং কক্সবাজারে। এখানে কত বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়, কত বাড়ির চাল, গাছপালা উড়ে যায় আকাশে, হাজার-হাজার গোরু-ছাগল মারা পড়ে। সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়।
সন্তু বলল, একবার আমাদের অন্ধ্রপ্রদেশেও এরকম সাইক্লোনের ধাক্কা লেগেছিল।
কামাল বলল, ঠিক। সেবারেও খুব জোর ঝড় হয়েছিল, এদিকে না এসে ওদিকে বেঁকে গিয়েছিল। তোমাদের ওড়িশাতেও কোনও-কোনওবার হয়। খালি পশ্চিমবাংলারই ভাগ্য ভাল।
কাকাবাবু বললেন, বেশিবার এদিকেই আসে, প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। কয়েক বছর আগেই তো কক্সবাজারের এদিকে লাখখানেক লোক মারা গিয়েছিল না?
কামাল বলল, তার বেশি। এদিকের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। সেইজন্যই মাঝে-মাঝে ওইরকম পাকা বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঝড়ে যখন গরিব মানুষের বাড়িঘর উড়ে যায়, তখন মানুষ ছুটে গিয়ে ওই বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তবু প্রাণে বাঁচে।
কাকাবাবু বললেন, বুঝলাম। বাড়িগুলো কে বানিয়ে দিয়েছে?
কামাল বলল, আমাদের সরকার। মানে সবগুলো নয়। বাংলাদেশ সরকারের অত টাকা নেই। অন্য অনেক দেশও বানিয়ে দিয়েছে, জাপান, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আপনাদের ইন্ডিয়াও বানিয়ে দিয়েছে, আরও অনেক দেশ সাহায্য করেছে। চলুন না, আপনাকে সেরকম দু-একটা বাড়ি দেখিয়ে দেব।
আলি বলল, ওই তো, ডাইন দিকে দ্যাখেন। ওই তো একখান ছাইকোন ছেল্টার!
কাকাবাবু ও সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। স্পিড বোটটার একপাশে তীর দেখা যায়, আর-একপাশে অথৈ জল। তীরের দিকে ফাঁকা জায়গায় একটি চৌকো সাদা রঙের বাড়ি দেখা যায় অনেক দূর থেকে। ওখানে আর কিছু ছোট-ছোট মাটির বাড়ি রয়েছে, সেগুলো গ্রামের লোকদের, ওই বাড়িটা একেবারে অন্যরকম। অনেক উঁচু তো বটেই, একেবারে চৌকো এবং ধপধপে সাদা। দেখলেই বোঝা যায় নতুন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সব বাড়িই সাদা?
কামাল বলল, বিদেশিরা যে-সব বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে, সেগুলি একই রকম দেখতে। সামনে গেলে আরও দেখতে পাবেন।
কাকাবাবু বললেন, এর পর আর-একটা প্রশ্ন আছে। গ্রামের মানুষদের জন্যই তো এই বাড়িগুলো বানানো হয়েছে। এমনও দ্বীপ আছে, যে-দ্বীপে কোনও মানুষ নেই। সেই দ্বীপেও কি এরকম বাড়ি থাকতে পারে?
কামাল বলল, হ্যাঁ পারে। আলি বলল, একখান আছে।
কাকাবাবু বললেন, মানুষের জন্যই তো সাইক্লোন শেল্টার। যে-দ্বীপে মানুষ নেই, সে-দ্বীপে শুধু-শুধু অত বড় বাড়ি বানিয়ে রাখবে কেন?
কামাল বলল, জেলেদের জন্য। জেলেরা নৌকো নিয়ে অনেক দূরে-দূরে মাছ ধরতে যায়। হঠাৎ ঝড় উঠলে তারা কী করবে? আগে কত নৌকো ড়ুবে গেছে, কত জেলে মারা পড়েছে। এখন তারা ঝড়ের আভাস পেলেই কাছাকাছি দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ফাঁকা থাকলেও বাঁচবে না, তাই তাদের জন্যও বাড়ি রয়েছে।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকালেন।
আলি বলল, সেই দ্বীপটা আমি দূর থেকে দেখছি একবার! দ্বীপটা ভাল। সেখানে ভূত আছে।
কাকাবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, তাই নাকি, ভূত আছে?
আলি বলল, এইজ্ঞে সার। যে মানুষগুলা আগে মরে গেছে, তারা বাড়িটায় ভূত হয়ে আছে।
কাকাবাবু বললেন, তবে তো সেখানে যেতেই হয়। আমি কখনও ভূত দেখিনি।
আলি বলল, কিন্তু সে তো উলটা দিকে। দূর আছে।
কামাল বলল, আপনি যে মহেশখালি যাবেন বলেছিলেন। ওই যে দেখুন পাহাড়ের ওপর মন্দির দেখা যাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, মন্দির তো পালিয়ে যাচ্ছে না। ওখানেই থাকবে। আগে চলো, ভূত দেখে আসি। সেটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। কামাল, তোমার কি ভূতের ভয় আছে নাকি?
কামাল হা-হা করে হেসে বলল, কী যে বলেন! ভূত-ফুত কিছু আছে নাকি? যেসব গ্রামে এখনও ইলেকট্রিসিটি পৌঁছয়নি, শুধু সেইসব জায়গায় মানুষ এখনও ভূতে বিশ্বাস করে।
কাকাবাবু আলিকে জিজ্ঞেস করলেন, সেই দ্বীপে যে ভূত আছে তা তুমি কী করে জানলে? অন্যরা বলেছে, না নিজের চোখে দেখেছ?
আলি বলল, নিজে দেখিছি।
কাকাবাবু বললেন, বটে, বটে! কী দেখেছ বলো তো?
আলি বলল, সে-দ্বীপে মানুষজন নাই। তবু রাত্তিরবেলা দপদপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। আলেয়া না, চড়া আগুন। আর মাঝে-মাঝে একটা শব্দ হয়, কী বিকট সেই শব্দ, যেন মনে হয়, একখান দৈত্য পেটের ব্যথায় চিখরাচ্ছে!
এবার সবাই হেসে উঠল।
কাকাবাবু বললেন, দৈত্যদের পেটব্যথা হলে কীরকম চিৎকার করে তাও কখনও শুনিনি। তা হলে তুমি বলছ, শুধু ভূত নয়, দৈত্যও আছে সেখানে? নাও, সবাই কলা খাও, কলা খেয়ে গায়ের জোর করে নাও!
সেই দ্বীপটার কাছে পৌঁছতে আরও ঘণ্টাদেড়েক লাগবে। এখন গনগনে দুপুর। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে সূর্য। এখন একটুও শীত নেই, কাকাবাবু কোট খুলে ফেলেছেন, সন্তুও খুলে ফেলেছে সোয়েটার। এরকম দিনের আলোয় কি ভূত দেখা যায়? আলিও বলল যে, আগুন-টাগুন দেখা যায় সন্ধের পর। তা হলে এত তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে কী হবে?
কামাল বলল, তা হলে এক কাজ করা যাক। কাছাকাছি চাঁদপাড়া নামে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামে সাগরের নোনা জল ঢুকে যায় বলে এখন বাঁধ বাঁধার কাজ চলছে। সরকারি লোকেরা ক্যাম্প করে আছে সেখানে। একজন এঞ্জিনিয়ার আমার খুব চেনা। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই আমরা। তারপর বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়লেই হবে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, চলো সেখানেই যাই। কিন্তু আমরা কোন দ্বীপে যাব, সেসব কিছু তাদের বলবার দরকার নেই। বলবে, আমরা এমনই বেড়াচ্ছি। বাঁধের কাজ দেখতে এসেছি।
কামাল বলল, আলি, চলো চাঁদপাড়ায়।
চাঁদপাড়ায় প্রায় তিনশো লোক মাটি কেটে বাঁধ দিচ্ছে। আগের বছর সাইক্লোনের সময় সমুদ্রের ঢেউ পাহাড়ের মতন উঁচু হয়ে উঠে পুরো গ্রামটা ভাসিয়ে দিয়েছিল। একটাও ঘরবাড়ি আস্ত নেই। তবে যেখানে-যেখানে সমুদ্রের জল জমে ছিল, এখন সেখানে সেই জল শুকিয়ে নুন বানানো হচ্ছে। গভর্নমেন্ট বাঁধ বানিয়ে দিচ্ছে, মজদুররা কাজের ফাঁকে-ফাঁকে মাছ ধরছে অল্প জলে। একজনের ঝুড়িতে লাফাচ্ছে বড়বড় চিংড়ি।
কামালের চেনা লোকটি জোর করে ওদের ভাত-মাছের ঝোল খাইয়ে দিল। গরম-গরম ভাত আর টাটকা চিংড়িমাছের ঝোল, অপূর্ব স্বাদ।
কাকাবাবু বললেন, দ্যাখো, ভেবেছিলাম শুধু কলা খেয়ে দিনটা কাটাতে হবে। কেমন সুখাদ্য জুটে গেল। কোনও হোটেলে এত টাটকা চিংড়িমাছ পাবে?
কামাল বলল, এতদূর পর্যন্ত তো আসবার কথা ছিল না। আমিও আগে ভাবিনি।
মাটি কাটা শ্রমিকরা কাকাবাবুকে ভেবেছে কোনও অফিসার। খোঁড়া পা নিয়ে এত দূরে এসেছেন বাঁধের কাজ দেখার জন্য, তা হলে নিশ্চয়ই খুব বড় অফিসার হবেন। সবাই বেশি-বেশি কাজ করতে লাগল।
বিকেলের একটু আগে বেরিয়ে পড়া হল সেখান থেকে। খানিক বাদেই সন্তু মুখ ঘুরিয়ে দেখল, এখন চারদিকেই সমুদ্র, কোনওদিকেই আর তীর দেখা যায় না। শীতকালের আকাশে মেঘ নেই। আকাশ নীল, জলও নীল। এখানে আবার ঢেউ বেশি, ছলাত ছলাত শব্দ হচ্ছে আর স্পিড বোটটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে।
কাকাবাবু কামালকে জিজ্ঞেস করলেন, এত দূরেও জেলেরা মাছ ধরতে আসে?
কামাল বলল, জি, আসে। এখন তো শীতকাল, এই সময় মাছ ওঠে কম। গরমকালে এলে দেখবেন, নৌকোয়-নৌকোয় জায়গাটা ভরে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, গরমকালেই ঝড় ওঠে। শীতকালে তো তেমন ঝড় হয় না। শীতের সময় এই সাদা বাড়িগুলো খালি পড়ে থাকে?
কামাল বলল, অন্য সময় কাউকে আসতে দেওয়া হয় না। না হলে তো বাড়িগুলো জবরদখল হয়ে যাবে।
সন্তু বলল, দূরে-দূরে দু-একটা নৌকো দেখা যাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, এখনকার নৌকোয় তো বৈঠা বাইতে হয় না। মোটর লাগানো থাকে, তাই অনেকদূর যেতে পারে। নৌকো কথাটাই উঠে যাচ্ছে, এখন বলে ভটভটি।
কামাল বলল, আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য এই জেলেরাও পাচ্ছে। এত দূর বৈঠা বেয়ে আসতে হলে কত পরিশ্রম হত ভাবুন! সময়ও লাগত অনেক।
কাকাবাবু বললেন, ছোটবেলায় দেখেছি, পালতোলা নৌকো, বাতাসে টেনে নিয়ে যেত, একজন মাঝি হাল ধরে বসে থাকত, ভারী সুন্দর দেখাত।
এইরকম কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় চলে গেল। তারপর এক সময় সেই কূলকিনারাহীন সমুদ্রের বুকে জেগে উঠল একটা দ্বীপ। প্রায় গোল আকৃতি, মাঝারি উচ্চতার গাছপালার রেখা দিয়ে ঘেরা, আর-একটাও বাড়িঘর নেই, শুধু সাদা রঙের বিশাল এক চৌকো বাড়ি মাথা উঁচু করে আছে। সমুদ্রের নীল, গাছপালার সবুজ আর বাড়িটির সাদা রং মানিয়েছে চমৎকার!
সন্তু অস্ফুটভাবে বলল, তা হলে সত্যিই এরকম দ্বীপ আছে। তাতে সাদা বাড়িও রয়েছে। কী করে বলতে পারল মেয়েটা?
কাকাবাবু বললেন, তোরা তো বিশ্বাস করিসনি। কেউ-কেউ পারে। এখন আলির কথার বাকিটা মিললেই হয়।
কামাল বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন?
কাকাবাবু বললেন, আমাদের কলকাতার একটি মেয়ে, সে কখনও এদিকে আসেনি, অথচ সে বলে দিয়েছিল, এরকম দ্বীপের মধ্যে একটা সাদা বাড়ি আছে।
কামাল বলল, হয়তো কোনও পত্রিকায় পড়েছে। বাংলাদেশের সাইক্লোন নিয়ে অনেক বিদেশি কাগজেই লেখালেখি হয়।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এমন সুন্দর একটা দ্বীপ, এখানে মানুষ থাকে না। কেন?
কামাল বলল, খাবার পানি পাবে কোথায়? চারদিকে সমুদ্র, তার পানি এত লোনা যে, মুখে দেওয়া যায় না। সেই যে ইংরেজি কবিতা আছে না, ওয়াটার ওয়াটার এভরি হোয়ার, নট এ ড্রপ টু ড্রিংক!
আলি বলল, এই পর্যন্ত! এইখান থিকা দ্যাখেন।
কাকাবাবু মুগ্ধভাবে দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এমন সুন্দর একটা দ্বীপ, ঠিক যেন স্বর্গের বাগান, এটা ভূতেরা দখল করে থাকবে, সেটা তো ঠিক নয়! জেলেদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাড়িটা তৈরি হয়েছে, সেটা ভূতেরা নিয়ে নেবে? এ ভারী অন্যায়। এখান থেকে ভূত তাড়াবার কেউ চেষ্টা করেনি?
কামাল বলল, আসল ব্যাপার কী জানেন, সাইক্লোন বা জোর ঝড়বাদল হলেই এইদিকটা সম্পর্কে সরকারের টনক নড়ে। অন্য সময় এদিকে তো কেউ আসে না। এই ভূতের ব্যাপারটা তো আমি প্রথম শুনছি!
স্পিড বোটটা থেমে যেতে দেখে কাকাবাবু বললেন, এ কী আলিভাই, এঞ্জিন বন্ধ করলে কেন?
আলি বলল, আমি আর যাব না!