Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জোজো অদৃশ্য || Sunil Gangopadhyay » Page 5

জোজো অদৃশ্য || Sunil Gangopadhyay

সারারাত ধরে খোঁজাখুঁজি করেও সেই বাঘকে গুলি খাওয়ানো গেল না। বন্দুকধারী পুলিশদের পাহারায় কাকাবাবুদের পৌঁছে দেওয়া হল কাকদ্বীপ ডাকবাংলোতে। সেখানে সুন্দর ব্যবস্থা। মুর্গির মাংসের ঝোল আর ভাতও পাওয়া গেল। শুধু বারান্দায় বসার উপায় নেই, দরজা-জানলা বন্ধ করে থাকতে হল ঘরের মধ্যে।

শুতে যাওয়ার আগে কাকাবাবু অলিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে একটা অন্ধকার ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জোজোকে দেখেছিলে, তারপর আর কিছু দেখেছ?

অলি জোরে-জোরে মাথা নেড়ে বলল, না!

কাকাবাবু বললেন, ভাল করে ঘুমোও। বাঘের কথা আর ভেবো না। বাঘ এখানে আসবে না। হয়তো স্বপ্নের মধ্যে জোজোকে আবার দেখতে পাবে।

অন্য ঘরে পাশাপাশি দুটো খাট, সন্তু আর কাকাবাবুর। প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল দুজনে। সন্তুর ঘুম আসছে না। খালি মনে হচ্ছে, বাংলোর পাশ দিয়ে একটা বড় জন্তু দৌড়ে যাচ্ছে। দূরে অনেক কুকুর ডাকছে একসঙ্গে, এখানে কি বাঘটা আছে?

তারপর সে বাঘের চিন্তা জোর করে মন থেকে মুছে ফেলে বলল, কাকাবাবু, তুমি ঘুমিয়েছ?

কাকাবাবু বললেন, না, কিছু বলবি?

সন্তু বলল, আজ সকাল পর্যন্ত আমার অনেকটাই মনে হচ্ছিল, জোজো ইচ্ছে করেই কোথাও লুকিয়ে আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, জোজো এতটা করবে না। এতক্ষণ থাকবে না।

কাকাবাবু বললেন, জোজোর যা স্বভাব, যদি নিজে লুকোতে চাইত, তা হলে বড়জোর দু-তিন ঘণ্টা আমাদের ধোঁকায় ফেলে রাখত, তারপরই বেরিয়ে আসত হাসতে হাসতে।

সন্তু বলল, বাড়িতে খবর না দিয়ে ও অন্য জায়গায় রাত্তিরে থাকে না।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু কথা হচ্ছে, কে বা কারা জোজোকে ধরে রাখবে? সেইটাই আমি বুঝতে পারছি না। সার্কাসের লোকেরা কেন একটা ছেলেকে ধরে রাখবে? মানুষ অদৃশ্য করার খেলা দেখিয়ে যদি কোনও ছেলেকে ধরে রাখে, তা হলে তো প্রথমেই ওদের ওপর সন্দেহ পড়বে।

সন্তু বলল, জাদুকর মিস্টার এক্স কাল রাত্তিরেই সার্কাস ছেড়ে চলে গেছে। এটা সন্দেহজনক নয়?

কাকাবাবু বললেন, হুঁঃ, ম্যানেজার বলল, মিস্টার এক্স নাকি স্থানীয় লোক। আমি থানার ওসি কৃষ্ণরূপবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জাপানি জাদুকর মিস্টার এক্স কোথায় থাকেন, বলতে পারেন! উনি বললেন, ওই নামে কোনও জাদুকরের কথা উনি শোনেননি। তবে রায় রায়হান নামে এখানে একজন ছোটখাটো ম্যাজিশিয়ান আছে, তাকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। বাঘের ঝামেলা আগে চুকে যাক!

সন্তু বলল, বাঘটা যতক্ষণ ধরা না পড়ে, ততক্ষণ আমরা বাইরেই বেরোতে পারব না!

কাকাবাবু বললেন, আগেকার দিন হলে শিকারিরা এসে বাঘটাকে গুলি করে মেরে ফেলত। এখন পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে, বাঘ শিকার নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। বাঘেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হয়েছে ব্যাঘ্র প্রকল্প। তাতে অনেক টাকা খরচ হয়। মানুষ যে বাঘদের বাঁচাবার জন্য এত কিছু করছে, বাঘেরা কিন্তু তা জানে না। তারা সুযোগ পেলেই মানুষ মারে। সুন্দরবনে প্রতি বছর বেশ কিছু মানুষ বাঘের পেটে যায়।

সন্তু বলল, সন্ধেবেলা থানা থেকে কলকাতায় ফোন করা হল, জোজো তখনও ফেরেনি। রাত্তিরে আর একবার ফোন করলে হত!

কাকাবাবু বললেন, অসীম একটা ব্যবস্থা করেছে। জোজোদের বাড়ির কাছে যে থানা, সেখানে বলে দেওয়া হয়েছে, জোজোদের বাড়ির ওপর নজর রাখতে। জোজো ফিরে আসার খবর পেলেই আমাদের জানিয়ে দেবে! শুধু চিন্তা করে কী হবে, এখন ঘুমো!

বাঘটার সন্ধান পাওয়া গেল পরদিন সকাল নটায়। এর মধ্যে সে একজন চাষিকে আক্রমণ করেছিল, মারতে পারেনি, শুধু কাঁধে একটা থাবা দিয়েছে। তারপর সে একটা গোরুকে মেরে একটা ঝোপের মধ্যে বসে খাচ্ছিল। কয়েকজন তোক দেখতে পেয়ে ফরেস্ট অফিসারদের খবর দিয়েছে। তাঁরা যখন গিয়ে পৌঁছলেন, তখনও সে কড়মড় করে হাড় চিবিয়ে খাচ্ছিল। সার্কাসে ভাল করে খেতে দেয় না, আফিম-গোলা জল খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, তাই। অনেকদিন পর বাঘটা মনের সুখে খাচ্ছিল সেই মাংস। বন্দুকধারীদের দেখেও সে পালায়নি, গরগর আওয়াজ করে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিল। তারপর দুটো গুলি বেঁধার পর সে ঘুমিয়ে পড়েছে, হাত-পা বেঁধে তাকে তোলা হয়েছে লঞ্চে।

হাজার-হাজার লোক দেখতে গেছে সেই ঘুমন্ত বাঘকে।

কলকাতা থেকে জোজোর কোনও খবর আসেনি, কিন্তু অসীম দত্তর জরুরি ফোন এসেছে। আজ দুপুরেই তাঁকে পুলিশমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

সার্কাসের জিনিসপত্র নিয়ে ট্রাকগুলো সরে পড়েছে এর মধ্যে। ম্যানেজার জহুরুল আলমের কোনও পাত্তা নেই।

অসীম দত্ত বললেন, পালাবে কোথায়? বজবজে ওকে ধরা হবে। ওখানকার পুলিশকে জানিয়ে দিচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, অসীম তুমি তা হলে কলকাতায় ফিরে যাও। আমি এখানেই থেকে দেখি জাদুকর মিস্টার এক্স-এর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় কি না। তুমি এই সার্কাসের ম্যানেজার আর যে-লোকটি বাঘের খেলা দেখায়, এই দুজনকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করো। আমি এখানে যদি কিছু না পাই, ফিরে গিয়ে ওদের জেরা করব।

অসীম দত্ত মেয়েকে বললেন, অলি, তা হলে জুতো পরে নে। আমরা এক্ষুনি বেরোব!

অলি মুখ গোঁজ করে বলল, আমি যাব না। আমি কাকাবাবুর সঙ্গে থাকব।

অসীম দত্ত বললেন, আর থেকে কী করবি? তোর গানের পরীক্ষা আছে।

অলি বলল, এবারে পরীক্ষা দেব না। আবার তিন মাস পরে হবে!

এর পর অসীম দত্ত মেয়েকে অনেকভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, অলি কিছুতেই ফিরতে রাজি নয়। তার দু চোখে টলটল করছে জল।

কাকাবাবু বললেন, অসীম, মেয়েটার যখন এতই ইচ্ছে, তখন থাক না আমার কাছে। তোমার কোনও ভয় নেই, আমি বেঁচে থাকতে অলির কোনও ক্ষতি হবে না।

হাল ছেড়ে দিয়ে অসীম দত্ত বললেন, তোমার কাছে থাকবে, তাতে আবার ভয় কী! ওর মা চিন্তা করবে! ঠিক আছে, তাকে বুঝিয়ে বলব!

অসীম দত্ত চলে যেতেই কাকাবাবু থানার ওসি কৃষ্ণরূপ রায়কে বললেন, আপনি এখানকার একজন ম্যাজিশিয়ানের কথা বলেছিলেন না, রায় রায়হান না কী নাম, চলুন, তার সঙ্গে দেখা করব।

থানার জিপটা এখন ঠিক হয়ে গেছে। সেই জিপে উঠে পড়ল সবাই। যেতে-যেতে কাকাবাবু ওসি-কে জিজ্ঞেস করলেন, এই সার্কাসে দশদিন ধরে মানুষ অদৃশ্য করার খেলা দেখানো হয়েছে। সবাই নিশ্চয়ই পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়নি। আপনার কাছে এখানকার লোক হারিয়ে যাওয়ার কোনও রিপোর্ট এসেছে?

ওসি বললেন, না সার। ওই ম্যাজিকের খেলা আমিও দেখেছি। ও তো ম্যাজিকই। মানুষ তো সত্যি-সত্যি অদৃশ্য হয় না। আমি যেদিন সার্কাসে যাই, সেদিন সতীশ নামে একজন লোককে অদৃশ্য করা হয়েছিল। সেই সতীশ তো এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে! পরশুও দেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, ওই সতীশকেও আমার দরকার। জাদুকর তাকে অদৃশ্য করার পর তার কী হয়েছিল, নিশ্চয়ই বলতে পারবে।

ওসি বললেন, আমি সতীশকে সেকথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমার কৌতূহল হয়েছিল, সতীশ ঠিক বলতে পারে না। সে শুধু বলল, তার মাথা ঝিমঝিম করেছিল, চক্ষে অন্ধকার দেখেছিল, তারপর কী হল তার মনে নেই। খানিক বাদে সে দেখল যে পরদার পেছনে বসে আছে। তাকে শিঙ্গাড়া আর রসগোল্লা খেতে দেওয়া হয়েছে।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এখানে মানুষজন হারিয়ে যাওয়ার কোনও রিপোর্ট নেই?

ওসি বললেন, উঁহুঃ! তবে দিন দশেক আগে একটা ষোলো সতেরো বছরের ছেলে তোরবেলা নদীতে স্নান করতে গিয়ে ড়ুবে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার ডেডবডিটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ-কেউ বলছে, ছেলেটা ইচ্ছে করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। ছেলেটা এখানকার স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিল, এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে।

জিপটা থামল একটা দর্জির দোকানের সামনে। কিছু লোক এখনও সেখানে জটলা করে বাঘের গল্প বলছে। অনেকের ধারণা আর একটা বাঘ এখনও রয়ে গেছে এখানে। পুলিশের জিপ দেখে সবাই চুপ করে গেল।

দর্জির দোকানের মালিকের নাম পরেশ জানা। সে বই পড়ে নিজে নিজেই কিছু ম্যাজিক শিখেছে। রথের মেলায়, দুর্গাপুজোর সময় ম্যাজিক দেখায়।

দোকানের পেছনদিকের একটা ঘর আছে। সেই ঘরে বসে কাকাবাবু পরেশ জানাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ম্যাজিশিয়ান মিস্টার এক্স-কে চেনেন?

পরেশ দুদিকে জোরে-জোরে মাথা নেড়ে বলল, নাঃ! কক্ষনও নামও শুনিনি!

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু সে এখানকারই লোক শুনলাম যে!

পরেশ বলল, এখানকার কেউ ম্যাজিক শিখলে আমি জানতাম না? এ কোনও বাইরের উটকো লোক! মুখে সবসময় মুখোশ পরে থাকে, ওর আসল মুখও তো কেউ দেখেনি!

কাকাবাবু বললেন, সবসময় মুখোশ পরে থাকে?

পরেশ বলল, তাই তো শুনেছি। সার্কাসের বাইরে রাস্তাঘাটে তাকে দেখা যায়নি। তবে, কিছুদিন আগে গঙ্গাসাগরের মেলা হয়ে গেল, সেখানেও নাকি ওই মিস্টার এক্স জাদুর খেলা দেখিয়েছে। দুটি ছেলেকে অদৃশ্য করে দিয়েছে, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কাকাবাবু ও সি-র দিকে ফিরে বললেন, গঙ্গাসাগর মেলায় দুটি ছেলে হারিয়ে গেছে, সে-রিপোর্ট আপনারা পাননি?

ওসি বললেন, দেখুন, গঙ্গাসাগর মেলায় দূর-দূর থেকে কত মানুষ আসে, প্রতি বছরই কয়েকজন হারিয়ে যায়, আবার বোধ হয় তাদের পাওয়াও যায়। মোট কথা, আমাদের থানায় ডায়েরি করেনি কেউ!

পরেশ বলল, সার, আমাদের দেশে কত মানুষ, চতুর্দিকে মানুষ গিসগিস করছে, তার মধ্যে দু-চারটে কখন কোথায় হারিয়ে গেল, তা নিয়ে কি পুলিশের মাথা ঘামাবার সময় আছে?

ওসি পরেশকে জিজ্ঞেস করলেন, গঙ্গাসাগর মেলায় ম্যাজিক দেখাবার সময়ই যে দুটি ছেলে হারিয়ে গেছে, তা তুমি জানলে কী করে?

পরেশ বলল, আমার ভাইপো ওই মেলায় গিয়েছিল। তার কাছে। শুনেছি। সে ওই ম্যাজিক দেখেছে। তারপর বিহারের এক ভদ্রলাক তার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে খুব চ্যাঁচামেচি করেছিল। আর একটা ছেলের সঙ্গে ছিল তার মা আর মাসি। সেই মহিলা দুজন খুব কান্নাকাটি করছিল, কিন্তু ছেলেটাকে পাওয়া যায়নি!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেই ম্যাজিশিয়ানের কাছে লোকে জবাবদিহি চায়নি কেন?

পরেশ বলল, মুখোশ-পরা ম্যাজিশিয়ান। মুখোশটা খুলে সে যদি ভিড়ে মিশে যায়, তা হলে তাকে কে চিনবে? আমি সার অনেক ম্যাজিক দেখেছি, কলকাতাতেও দেখেছি, কিন্তু কোনও মুখোশপরা ম্যাজিশিয়ানের কথা বাপের জন্মে শুনিনি!

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা পরেশবাবু, আপনি তো অনেক ম্যাজিক জানেন। বেশ ভাল ম্যাজিক দেখান শুনেছি। আপনি মানুষ অদৃশ্য করার খেলা দেখাতে পারেন?

পরেশ অবজ্ঞার সঙ্গে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, আমি ওসব আজেবাজে খেলা দেখাই না। ও তো ভেলকিবাজি। যন্ত্রপাতি আর আলোর খেলা। আমি দেখাই শুধু হাতের খেলা। দেখবেন, দেখুন!

পরেশ পকেট থেকে একটা এক টাকার মুদ্রা দেখাল। সেটা ডান হাতে নিয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছেন তো, ভাল করে দেখুন, এটা একটা টাকা। এই যে ওপরে ছুড়ে দিচ্ছি। এই যে লুফে নিলুম। দেখলেন তো? আবার ছুড়ে দিচ্ছি! কই গেল?

টাকাটা নেই। পরেশ দুটো হাত উলটেপালটে দেখাল। কোনও হাতেই টাকাটা নেই।

পরেশ হাসতে-হাসতে বলল, দেখতে পেলেন না? ভাল করে দেখেননি। এই তো!

পরেশ আবার ডান হাতটা ওলটাতেই দেখা গেল সেখানে রয়েছে টাকাটা।

পরেশ বলল, এই হচ্ছে হাতের খেলা। এ শিখতে এলেম লাগে। কাকাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার!

সন্তু আর অলি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, এবার অলি বলল, আর-একটা, আর-একটা দেখান!

পরেশ অলির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখবে? তোমার হাত দুটো বাড়িয়ে দাও!

পরেশ অলির হাত দুটো ধরে একটুক্ষণ মুঠো করে রাখল। তারপর আবার খুলে আবার মুঠো করে দিল।

অন্যদের দিকে ফিরে বলল, এই মেয়েটির একটা হাতে আমি সেই টাকাটা রেখে দিয়েছি। বলুন তো, কোন হাতে সেই টাকাটা আছে? সন্তুর দিকে ফিরে বলল, তুমিই বলো, কোন হাতে? সন্তু অলির ডান হাতটা ছুঁয়ে দিল। মুঠো খুলতে দেখা গেল, টাকাটা রয়েছে সেই হাতে।

পরেশ বলল, বাঃ, তুমি ঠিক ধরেছ তো। এক চান্সেই বলে দিলে? আচ্ছা, এবার বাঁ হাতটা খুলে দেখাও তো খুকুমণি!

বাঁ হাতের মুঠো খুলতে দেখা গেল, সে-হাতেও রয়েছে এক টাকা। একটা মুদ্রা দুটো হয়ে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, দারুণ তো!

পরেশ সগর্বে বলল, আমার যন্ত্রপাতি লাগে না। শুধু হাতে খেলা দেখাই!

কাকাবাবু বললেন, বেশ। আপনাকে ধন্যবাদ। এবার আমাদের উঠতে হয়। তা হলে, মিস্টার এক্স এই অঞ্চলে কোথায় থাকে, আপনি বলতে পারবেন?

পরেশ বলল, আমার ধারণা, সে এখানকার লোক নয়। বিদেশি। গঙ্গাসাগর মেলার সময় সে একটা লঞ্চে করে এসেছিল। আমার ভাইপো তাকে একবার একটা লঞ্চ থেকে নেমে আসতে দেখেছে। আপনারা তাকে খুঁজছেন। তো। একবার গঙ্গাসাগরে গিয়ে দেখুন, সেখানে পাওয়া যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, মেলা শেষ হয়ে গেলে তো সেখানে আর কেউ থাকে না।

ওসি বললেন, এখন সারা বছরই কিছু লোক যায়। কয়েকটা হোটেল আর গেস্ট হাউস হয়েছে। কপিল মুনির আশ্রমের কাছে কয়েকজন সাধুও থাকে।

পরেশ বলল, কেউ লুকিয়ে থাকতে চাইলে ওটা খুব ভাল জায়গা। মেলার সময় ছাড়া সারা বছর ওখানে পুলিশ যায় না।

কাকাবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠতেই ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল একজন বেশ সুদর্শন যুবক। সাদা প্যান্ট ও নীল হাওয়াই শার্ট পরা। সে হাতজোড় করে বলল, নমস্কার। আপনি রাজা রায়চৌধুরী, দেখেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু আপনাকে আমি মিস্টার রায়চৌধুরী বলতে পারব না, আপনাকে আমি কাকাবাবু বলে ডাকব, আমি আপনার ভক্ত। আমি এই মহকুমার পুলিশ অফিসার। আমার নাম অর্ক মজুমদার।

কাকাবাবু বললেন, অসীমের কাছে আপনার কথা শুনেছি।

অর্ক বলল, আপনি নয়, আপনি নয়, আমাকে তুমি বলবেন। আমি একটা খবর দিতে এসেছি। জুয়েল সাকার্স পার্টির নামে অনেক অভিযোগ এসেছে। বাঘের খাঁচার দরজা খুলে যাওয়ায় চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তাই আমি চতুর্দিকে ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে ওই সার্কাসের যে-কোনও লোককে দেখলেই অ্যারেস্ট করার অর্ডার দিয়েছি। ওরা বলেছে, বজবজের দিকে যাবে, এই ঘটনার পর অন্যদিকে পালাবার চেষ্টা করাই তো ওদের পক্ষে স্বাভাবিক। তাই না?

কাকাবাবু বললেন, ওদের সঙ্গে বাঘ আছে, হাতি আছে, আরও কত জিনিসপত্র, এতসব নিয়ে ওরা পালাবে কী করে?

অর্ক বলল, বনে-জঙ্গলে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে। ধরা পড়বে ঠিকই, কিন্তু দেরি হতে পারে। এর মধ্যেই একজন ধরা পড়েছে। আমি তাকে জেরা করার জন্য নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই যাব! যে ধরা পড়েছে, সে সার্কাসে কী করত?

অর্ক বলল, তা বলতে পারছি না। একজন কনস্টেবল তাকে এই সার্কাসে দেখেছে। সে লোকটি হারউড পয়েন্ট থেকে লঞ্চে উঠতে যাচ্ছিল।

কাকাবাবু বিস্মিতভাবে বললেন, হারউড পয়েন্ট? সেখানে কি সারা বছর লঞ্চ চলে?

অর্ক বলল, হ্যাঁ, এখন চলে। দেখলেন, এটা বজবজের একেবারে উলটো দিকে।

পরেশ দর্জি বলল, ওখান দিয়েই তো গঙ্গাসাগর যায়। দেখলেন, আমি ঠিক বলেছিলাম কি না।

কাকাবাবু বললেন, তাই তো দেখছি।

অর্ক এনেছে একটা স্টেশন ওয়াগন। কাকদ্বীপ থানার ওসি-কে ছেড়ে দিয়ে কাকাবাবু সদলবলে অর্কর গাড়িতে উঠলেন।

গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার পর অর্ক বলল, কাকাবাবু, কাল রাত্রে ওই ব্যাঘ্ৰকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর খবর পেয়ে কলকাতা থেকে অনেক সাংবাদিক চলে এসেছে। এমন রোমাঞ্চকর ব্যাপার তো বিশেষ হয় না। সাংবাদিকরা আপনাকে চিনতে পারলে কিন্তু বিরক্ত করে মারবে। আপনার চোখের সামনেই তো বাঘটা বেরিয়েছিল!

কাকাবাবু বললেন, চোখের সামনে মানে? আমাদের গাড়ির মাথায় বাঘটা চেপে বসে ছিল।

অর্ক বলল, এই গল্প শুনলে কি আর সাংবাদিকরা আপনাকে ছাড়বে? আপনি মাথাটা নিচু করে থাকুন, যাতে কেউ দেখতে না পায়! কলকাতাতেও খবর নিয়েছি, আপনাদের সেই জোজো এখনও ফেরেনি।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, তুমি তো বেশ কাজের ছেলে! তোমাকে দেখলে পুলিশ অফিসার মনে হয় না। মনে হয় যেন কলেজের ছাত্র!

অর্ক বলল, পরীক্ষা দিয়ে দুবছর আগে চাকরি পেয়েছি। তার আগে তো ছাত্ৰই ছিলাম। কী হে সন্তু, তুমি কিছু কথা বলছ না যে!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, যে-লোকটা ধরা পড়েছে, তাকে কেন কাকদ্বীপে নিয়ে আসা হল না? আপনাকে যেতে হচ্ছে কেন?

অর্ক বলল, ওখানে কোনও গাড়ি নেই। ধরা পড়ার পরেও লোকটা পালাবার চেষ্টা করেছিল। আমাদের কনস্টেবল, আরও দু-তিনজন মিলে তাকে জাপটে ধরে বেঁধে রেখেছে। ওর কাছে কয়েকটা বড়বড় আলোর বা পাওয়া গেছে। চুরি করেছে কি না কে জানে, নইলে পালাবার চেষ্টা করবে কেন?

কাকদ্বীপ থেকে হারউড পয়েন্ট বেশি দূর নয়। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, ফেরিঘাটের পাশে এক জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। কাকাবাবু ক্রাচ নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন। সন্তু আগে-আগে দৌড়ে গেল।

সেই ভিড় ঠেলে মাঝখানের হাত-পা বাঁধা মানুষটাকে দেখে সন্তু খুশিতে শিস দিয়ে উঠল।

মাথায় একটাও চুল নেই, চকচকে টাক, ভুরুও দেখা যায় না, এ তো সেই ম্যাজিশিয়ানের অ্যাসিস্ট্যান্ট। সন্তুর গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল।

কাকাবাবু আসতেই সন্তু উত্তেজিতভাবে বলল, কাকাবাবু, এর সঙ্গে নিশ্চয়ই ম্যাজিশিয়ান এক্স-ও ছিল। মুখোশ খোলা থাকলে তো তাকে কেউ চিনতে পারবে না। এ ধরা পড়ার পর ম্যাজিশিয়ান পালিয়েছে।

কাকাবাবু চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, এই ভিড়ের মধ্যে মিশে সে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারে!

লোকটি শুয়ে ছিল মাটিতে। তার জামা-প্যান্ট ভেজা। পালাবার জন্য সে ঝাঁপ দিয়েছিল নদীতে। সেখান থেকে তাকে টেনে তোলা হয়েছে।

অর্ক কাছে গিয়ে লোকটিকে দাঁড় করাল। তারপর তার জামার বুকের কাছটা মুঠো করে ধরে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, কী রে, পালাতে চাইছিলি কেন? কী দোষ করেছিস?

লোকটি কোনও উত্তর দিল না।

অর্ক আবার জিজ্ঞেস করল, তোর নাম কী? সার্কাসে তুই কী কাজ করিস?

লোকটি এবারেও চুপ।

অর্ক প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, কথা বলছিস না কেন? যা জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দে!

লোকটি মুখ না খুলে সোজা চেয়ে রইল অর্কর দিকে।

কনস্টেবলটি এবার লাঠি তুলে মারার ভঙ্গি করে বলল, এই, সাহেব যা জানতে চাইছেন, জবাব দে, নইলে মাথা ফাটিয়ে দেব!

কাকাবাবু হাত তুলে বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও, মারবার দরকার নেই। একে আমরা চিনি। ম্যাজিশিয়ান মিস্টার এক্স-এর সহকারী। সেই ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে কথা বলা আমার খুব দরকার। ম্যাজিশিয়ান কোথায় গেছে, এ নিশ্চয়ই বলতে পারবে। কিন্তু এখানে এত লোকের মধ্যে জেরা করে লাভ নেই। কোথাও গিয়ে বসতে হবে।

অর্ক বলল, তা হলে কাকদ্বীপের থানায় যাওয়া যাক।

কাকাবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, কাকদ্বীপে না। এই লোকটা এখান থেকে লঞ্চ ধরে গঙ্গাসাগরের দিকে যেতে চাইছিল, কেন? চলো, আমরাও সেখানেই যাই। গাড়িটা এখানে থাকবে?

অর্ক বলল, গাড়িসুদ্ধই যাওয়া যেতে পারে। সে ব্যবস্থা আছে। শুধু এখন জোয়ার না ভাটা তা দেখতে হবে।

ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন চেঁচিয়ে বলল, জোয়ার, জোয়ার। ওই তো ফেরির লঞ্চ আসছে।

এখানে দুরকম লঞ্চ চলে। একরকম লঞ্চে শুধু যাত্রী পারাপার করে। আর-একরকম লঞ্চে গাড়ি, বাস, ট্রাক সব উঠে যায়। তাতেও যাত্রীরা যায় কিছু-কিছু।

গাড়ির সামনের সিটে কনস্টেবলটি ন্যাড়ামাথা লোকটিকে ধরে বসে রইল। পেছনের সিটে আর সবাই।

গঙ্গা এখানে বিশাল চওড়া। বড় বড় ঢেউ। হুহু করছে হাওয়া। অনেক মাছধরার নৌকো ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলছে।

অলি জিজ্ঞেস করল, আমরা কি সমুদ্রে যাচ্ছি?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, সমুদ্রের দিকেই যাচ্ছি। তবে এখনই নয়। দেখছ তো, এই লঞ্চটা কোনাকুনি গঙ্গা পার হচ্ছে। ওদিকে একটা দ্বীপ আছে। খুব বড় দ্বীপ, সেখানে মানুষজন থাকে। সেই দ্বীপের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে অনেকটা গেলে, একেবারে শেষে গঙ্গার মোহনা। মোহনা কাকে বলে জানো?

অলি বলল, হ্যাঁ, নদী যেখানে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।

কাকাবাবু বললেন, সেই মোহনার নাম গঙ্গাসাগর। অনেকের ধারণা, সেখানে স্নান করলে খুব পুণ্য হয়, তাই বছরে একবার বহু দূর দূর থেকে মানুষ এসে গঙ্গাসাগরে ড়ুব দেয়।

অলি বলল, আমিও ড়ুব দেব। কিন্তু আমি সাঁতার জানি না।

কাকাবাবু বললেন, সাঁতার না জানলেও ড়ুব দিতে পারবে। ভয় নেই। সন্তু তোমার পাশে থাকবে।

অলি জিজ্ঞেস করল, সন্তুদা বুঝি ভাল সাঁতার জানে?

কাকাবাবু হেসে বললেন, সন্তুকে যদি এই গঙ্গায় ঠেলে ফেলে দাও, ও ঠিক সাঁতরে ওপারে চলে যাবে।

অর্ক বলল, তাই নাকি! সন্তু তোমার সঙ্গে একদিন সাঁতারের কম্পিটিশন দিতে হবে। আমি সাঁতার প্রতিযোগিতায় দু-তিনটে প্রাইজ পেয়েছি।

সন্তু লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, আমি তেমন কিছু ভাল পারি না।

কাকাবাবু অর্ককে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জুয়েল সার্কাসের শো দেখেছ?

অর্ক বলল, হ্যাঁ, দেখে গেছি একবার। বেশির ভাগ খেলাই অতি সাধারণ। গ্রামের মানুষদের ভাল লাগবে, আমরা ধরে ফেলি।

কাকাবাবু বললেন, মানুষ অদৃশ্য করার খেলাটা?

অর্ক বলল, ওটা তো খুব সোজা! ওই যে উঁচু করে স্টেজটা বানিয়েছিল, ওর মাঝখানে কিছুটা জায়গা কাটা। তার ওপর একটা আলগা তক্তা পাতা থাকে। একজন লোককে সেখানে দাঁড় করায়, তারপর অনেক আলো জ্বলতে নিভতে থাকে, ম্যাজিশিয়ান লোকটাকে একটা কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়, পা দিয়ে একটা শব্দ করে তক্ষুনি স্টেজের নীচ থেকে ওর সহকারী তক্তাটা সরিয়ে লোকটাকে নীচে টেনে নেয়।

অর্ক সামনে ঝুঁকে ন্যাড়ামাথা লোকটার কাঁধ ছুঁয়ে বলল, কী রে, তাই নয়?

সে ফিরে তাকাল না, কোনও উত্তর দিল না।

কাকাবাবু বললেন, তা ছাড়া আর কী হবে! কিন্তু ব্যাপারটা প্রায় চোখের নিমেষে ঘটে যায়।

অর্ক বলল, সেটাই তো প্র্যাকটিস। তা ছাড়া আলোর খেলায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

সন্তু বলল, যাদের অদৃশ্য করা হচ্ছে, তারা তো ফিরে এসে কায়দাটা বলে দিতে পারে।

অর্ক বলল, তা তো পারেই। বললেই বা ক্ষতি কী? আগে থেকে কায়দাটা জানলেও যে-সময় ওরা খেলাটা দেখায়, সেসময় একটুও ধরা যায় না। মনে হয়, সত্যি-সত্যি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, অদৃশ্য হওয়ার খেলার পর আমাদের জোজোকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই একই ম্যাজিশিয়ান গঙ্গাসাগর মেলাতেও ওই খেলা দেখিয়েছে। দর্জি ভদ্রলোক বললেন, তখনও নাকি দুটি ছেলে হারিয়ে গেছে।

অর্ক বলল, মেলাতে অত ভিড়ের মধ্যে প্রতি বছরই… কাকাবাবু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেটা জানি। কিন্তু আমি একটা অন্য কথা ভাবছি। আমাদের জোজোর বয়েস সতেরো। মেলায় যে দুটি ছেলে হারিয়ে গেছে, তাদের বয়েসও যোলো-সতেরো। কাকদ্বীপের ওসি বললেন, কয়েকদিন আগে একটি ছেলে তোরবেলা নদীতে স্নান করতে গিয়েছিল, তার বয়েসও সতেরো, তাকে আর কেউ দেখেনি, তার ডেডবডিও পাওয়া যায়নি। হঠাৎ ঠিক ওই এক বয়েসের ছেলেরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, এটা খুব পিকিউলিয়ার না?

অর্ক বলল, এটা কাকতালীয় হতে পারে। তা ছাড়া এই বয়সের ছেলেরাই বাড়ি থেকে পালায়।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের জোজো বাড়ি থেকে পালাবার ছেলে নয়। তাকে কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে রেখেছে।

অর্ক অবাক হয়ে বলল, সে কী! এর মধ্যেই সেটা ধরে নিচ্ছেন কী করে?

কাকাবাবু অলির মাথায় হাত রেখে হেসে বললেন, ধরে নিইনি, সেটা আমাদের এই অলি দিদিমণি জানে।

অর্ক বলল, ও কী করে জানবে? ও কি দেখেছে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, সেটা তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব, এই যে আমরা এসে গেছি!

ফেরি লঞ্চটা ভা ভা করে করে ভেঁপু বাজিয়ে জেটিতে এসে ভিড়ল। গাড়িটা উঠে এল উঁচু রাস্তায়।

অর্ক বলল, আমরা পি ডব্লু ডির বাংলোয় থাকব, সেখানে রান্নাবান্না করে দেবে। খুব ভাল ব্যবস্থা আছে।

কাকাবাবু বললেন, এইসব জায়গায় বেড়াতে এসে ভালই লাগে। কিন্তু মাথার মধ্যে জোজোর চিন্তা ঘুরছে। জোজোকে যতক্ষণ না খুঁজে পাচ্ছি, ততক্ষণ কিছুই ভাল লাগছে না।

অর্ক বলল, যারা ছেলেধরা, তারা সাধারণত বাচ্চা ছেলেমেয়েদের চুরি করে। পাঁচ বছর, সাত বছর, বড়জোর আট-নবছর। কিন্তু একটা যোলো-সতেরো বছরের জোয়ান ছেলেকে চুরি করাটা খুবই অস্বাভাবিক। এরকম শোনা যায় না।

কাকাবাবু বললেন, অস্বাভাবিক তো বটেই? ম্যাজিক দেখাবার ছল করে একটা ছেলেকে সত্যি-সত্যি অদৃশ্য করে দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়?

অর্ক বলল, ওই ম্যাজিশিয়ানই যে জোজোকে চুরি করেছে, তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। হয়তো এটা সার্কাসের ম্যানেজারের কারসাজি।

কাকাবাবু বললেন, কে সত্যি দায়ী, তা এই লোকটাকে জেরা করে জানা যেতে পারে।

দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি, সকলেরই খিদে পেয়ে গেছে বেশ। বাংলোতে পৌঁছতে অনেক বেলা হয়ে গেল। এখন রান্না করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

কাকাবাবু অনেক বছর আগে এসেছিলেন গঙ্গাসাগরে, তখন এখানে বাড়িঘর প্রায় কিছুই ছিল না। এখন অনেক বাংলো, গেস্ট হাউস, ইয়ুথ হস্টেল হয়ে গেছে। কয়েকটা ছোটখাটো হোটেল আর চায়ের দোকানও আছে। একটা হোটেল থেকে রুটি আর আলুর দম কিনে আনা হল।

খেতে-খেতে অর্ক বলল, কাকাবাবু, আপনি প্রথমে এই টাকলু লোকটাকে জেরা করে কিছু কথা বার করতে পারেন কি না দেখুন। মনে হচ্ছে, এব্যাটা গভীর জলের মাছ। সহজে মুখ খুলবে না। যদি আপনি না পারেন তা হলে আমি চেষ্টা করব। থার্ড ডিগ্রি দিলেই ওর পেটের কথা হুড়হুড় করে বেরিয়ে যাবে।

অলি জিজ্ঞেস করল, থার্ড ডিগ্রি কী?

অর্ক বলল, সেটা ছোটদের জানতে নেই। যখন আমি থার্ড ডিগ্রি দেব, তখন তুমি আর সন্তু সেখানে থাকতে পারবে না।

সন্তু বলল, পা বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া?

কাকাবাবু বললেন, অত সব লাগবে না।

অর্ক বলল, আমি ঘুরেফিরে চারদিকটা দেখে আসি। মুখোশ-পরা ম্যাজিশিয়ান সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারে কিনা খোঁজ নিই। আপনারা কিন্তু সাবধানে থাকবেন। দেখবেন, ও ব্যাটা না পালায়।

কাকাবাবু বললেন, না, পালাবে কী করে? হাত-পা বাঁধা আছে। ওকে এখন কিছু খেতেও দেওয়া হবে না। খাবার সামনে রেখে লোভ দেখাতে হবে। আপাতত ওকে একটা ঘরে আটকে রাখা হোক। এর মধ্যে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। কাল রাত্তিরে একে তো বাঘের উপদ্রব, তার ওপর জোজোর চিন্তায় আমার ভাল করে ঘুম হয়নি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress