অলকা
উঠে পড়লাম।
বেশ বেলা হয়ে গেছে। ঝি সরস্বতী আজ আসবে কি না বুঝতে পারছি না। এত বেলা তো সে কখনও করে না। আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। এক রিকশাওলার সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার কাছে একশোটা টাকা চেয়েছিল। দেব কোত্থেকে? আমার বাড়তি টাকা যা আছে তা বড় অল্পে অল্পে জমানো। দিই কী করে?
দাঁত মেজে এক কাপ চা করে খেলাম। বিছানা তুলতে ইচ্ছে করছে না। থাকগে, কে-ইবা আসছে দেখতে! সরস্বতী যদি আসে তো তুলবেখুন। সকালের চা করা, বিছানা তোলা এসব ও-ই করে।
আমি খবরের কাগজ রাখি না। ছোট্ট একটুখানি একটা ট্রানজিস্টর রেডিয়ো আছে। সেটাই আমার সঙ্গী। অবশ্য এ ফ্লাটে মস্ত একটা রেডিয়োগ্রাম আছে অসীমদার, কিন্তু সেটার যন্ত্রপাতিতে মরচে, চলে না। আমার ট্রানজিস্টার সেটটারও ব্যাটারি ডাউন। চেরা আওয়াজ আসে। রেডিয়োটা চালিয়ে একটা ফ্যাসফেসে কথিকা হচ্ছে শুনে, বন্ধ করে দিলাম।
আজ ছুটি। কিন্তু ছুটির দিনগুলোই আমার অসহ্য। সময় কাটতে চায় না। শ্রীরামপুরের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু গেলেই অশান্তি। মাসির বাড়িতেও যাওয়া হয় না। রোহিতাশ্ব চৌধুরীর বাড়িতে যেতে কেমন যেন লজ্জা করে আজকাল, ওদের বাড়িতে বেবি সিটারের চাকরি করেছি বলেই বুঝি এক হীনম্মন্যতা কাজ করে।
মুশকিল হল, আমার বাসাতেও কেউ আসেনা। আজ রোববারে কেউ কি আসবে? আসবে না, তার কারণ আমাকে কেউ ভাল চোখে দেখে না। আমার তেমন বন্ধুবান্ধবও নেই। মাঝে মাঝে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে।
এখনও বর্ষা নামেনি এ বছর। গরমকালটা বড় বেশিদিন চলছে। এইসব ভয়ংকর রোদের দিনে ঘরের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছেও হতে চায় না। একা ঘরে সারা দিনটা কাটাবই বা কী করে?
জানালা-দরজা খোলা। আলোয় আলোয় ভেসে যাচ্ছে ঘর। আমি বাথরুমে ঘুরে এসে আয়নার সামনে বসে একটু ফিটফাট করে নিই নিজেকে। চুল আঁচড়াই, মুখে অল্প একটু পাউডার মাখি, কপালের একটা ব্রণ টিপে শাঁস বের করি। বেশ চেহারাটা আমার। লম্বা টান সতেজ শরীর, গায়ে চর্বি খুব সামান্য, মুখখানা লম্বা ধাঁচের, পুরু কিন্তু ভরন্ত ঠোঁট, দীর্ঘ চোখ। নাকটা একটু ছোট কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতি হয়নি। গায়ের রঙে জেল্লা আছে।
অনেককাল নাচি না। আজ একটু ইচ্ছে হল। কোমরে আঁচল জড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অল্প একটু পা কাঁপিয়ে নিলাম। তারপর কয়েকটা সহজ মুদ্রা করে নিয়ে ধীরে ধীরে নাচতে থাকি। কিন্তু বুঝতে পারি শরীর আর আগের মতো হালকা নেই। বেশ কষ্ট হয় শরীর ভাঙতে, দমও টপ করে ফুরিয়ে গেল। হাঁপিয়ে বসে পড়লাম। তাতেও হল না। পাখা চালিয়ে শুয়ে রইলাম মেঝেয়। ঠাণ্ডা মেঝে, বুক জুড়িয়ে গেল। শুয়ে থেকে হঠাৎ মনে হল আজ কেউ আসবে। অনেককাল কেউ আসে না। আজ আসবে। ভাবতে ভাবতে ঝিমধরা মাথায় কখন যে তন্দ্রা এল! সরস্বতী আসেনি, হরিণঘাটা ডিপো থেকে দুধের বোতল আনা হল না। একটু আনাজপাতি, মাছ বা ডিম কিছু আনিয়ে রাখা দরকার ছিল। তাও হল না। সকালের জলখাবার বলতে কিছু খাইনি এখনও, খিদে পেয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেও তন্দ্রা এল। কী আলিস্যি আর অবসাদ যে শরীরটার মধ্যে। বয়স হচ্ছে নাকি! মাগো!
খুব বেশিক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থাকা হল না। পিয়ানোর হালকা শব্দ তুলে কলিং বেল পিং আওয়াজ করল। সদর দরজাটা ভেজানো আছে, সরস্বতী হলে বেল না বাজিয়ে হুডুম দুম করে ঢুকে পড়ত। এ সরস্বতী নয়, অন্য কেউ।
দরজা খুলে একটু খুশিই হই। আমার অফিসের সেই স্মার্ট ও সুপুরুষ যুবক সুকুমার দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। যদিও সুকুমারকে আমি সেই অর্থে ভালবাসি না, তবু ওর সঙ্গ তো খারাপ নয়। জানি না বাপু আমাদের মনের মধ্যে কী পাপ আছে। পাপ একটু-আধটু আছে নিশ্চয়ই। নইলে সুকুমারের ওই দুর্দান্ত বিশাল জোয়ান চেহারা আর হাসির জবাব রঙ্গরসিকতায় ভরা কথাবার্তা আমার এত ভাল লাগে কেন। আমরা পরস্পরকে তুমি করে বলি, সেটাও পাঁচজনের সামনে নয়, দুজনে একা হলে তবেই। তা হলে নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটু পাপ-টাপের গন্ধ পাওয়া যাবে।
বাইরের ঘরে বসে ও তেমনি হাসি মুখে বলল-তোমাকে একটু বিরহী বিরহী দেখাচ্ছে অলি।
ওর হাসিটা যেন একটু কেমন। মানুষ খুব নার্ভাস হয়ে পড়লে মাঝে মাঝে ও রকম হাসি হাসে। ওর মতো চটপটে বুদ্ধিমান ছেলের নার্ভাস হওয়ার কথা নয়।
আমি বললাম-বিরহ নয় বিরাগ। বোসো, আজ আমার ঝি আসেনি; নিজেকেই চা করতে হবে।
ও বিরস মুখ করে বলে–ও, আমি ভেবেছিলাম তোমার বাসায় আজ ভাত খাব দুপুরে। কিন্তু ঝি যখন আসেনি
কথাটা আমার কানে ভাল শোনাল না। ভাত খাবে কেন? এ প্রস্তাবটা কি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না।
আমি বললাম আমি নিজে কতদিন না বেঁধে শুকনো খাবার খেয়ে কাটিয়ে দিই! আজও অরন্ধন।
সুকুমার নড়েচড়ে বসে বলল–এসে তোমার ডিসটার্ব করছি না তো?
-মোটেই নয়। আজ আমার খুব একা লাগছিল।
—আমারও।
–মনে হচ্ছিল কেউ আসবে।
সুকুমারের মুখ হঠাৎ খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ও বলে–কে আসবে বলে ভেবেছিলে? আমি?
না। বিশেষ কারও কথা নয়। যে কেউ।
–আমার কথা তুমি ভাবো না অলি?
পুরুষমানুষদের এই এক দোষ। তারা চায় মেয়েরা সব সময় তাদের কথা ভাবুক। বড় জ্বালা। জয়দেবও বোধহয় তাই চাইত।
আমি একটু হেসে বললাম–ভাবব না কেন? তবে আমার ভাবনা খুব ভাসা ভাসা। গভীর নয়।
সুকুমারের স্মার্টনেস আজ যে কোথায় গেল। সে আজ একদম বেকুব বনে গেছে। মুখের রং অন্যরকম, চোখ অন্যরকম। আমি বাতাসে একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।
আজ সুকুমার খুব ভাল পোশাক পরে এসেছে। সাদা রঙের ওপর নীল রঙের নকশা করা পাতলা টেরিভয়েলের ছাঁদাওয়ালা জামা, খুব সুন্দর ধূসর রঙের প্যান্ট পরা, পায়ে ঝকঝকে মোকাসিন। হাতে এই ছুটির দিনেও একটা পাতলা ভি আই পি স্যুটকেস। রুমালে মুখ মুছে বলল–আমি হঠাৎ এলাম বলে কিছু মনে করো না।
আমি হেসে বললাম তুমি এর আগেও একবার এসেছিলে, তখনও কিছু মনে করার ছিল না। মনে করব কেন?
সুকুমার ভাল করে কথা বলতে পারছে না আজ। আমার দিকে ভাল করে তাকাচ্ছেও না। বলল ভীষণ খারাপ সময় যাচ্ছে আমার।
–কেন, খারাপের কী? সদ্য একটা লিফট পেয়েছ।
সুকুমার ব্যথিত হয়ে বলে–সবসময়ে টাকার পয়েন্টে লোকের ভাল-মন্দ বিচার করা যায় না। সে সব নয়। আমার মনটা ভাল নেই।
-কেন?
–তোমার সেটা বোঝা উচিত।
আমি এ ব্যাপারে খানিকটা নিষ্ঠুর। সুকুমার কী বলতে চায় তা আমার বুঝতে দেরি হয়নি। কিন্তু এসব প্রস্তাবকে গ্রহণ বা গ্রাহ্য করা আমার সম্ভব নয়। বললাম–তোমার প্রবলেম নিয়ে আমি চিন্তা করব কেন? আমার ভাববার মতো নিজস্ব প্রবলেম অনেক আছে।
অলি, তুমি কিন্তু সেলফ সেন্টারড।
সবাই তাই। তুমিও কি নিজের স্বার্থ থেকেই সব বিচার করো না?
সুকুমার সিগারেট খেল কিছুক্ষণ। ওর হাত বশে নেই। বলল–সেটা ঠিকই। কিন্তু তুমি যে হ্যাপি নও এটা নিয়েও আমি ভাবি।
আমি হেসে বললাম-সেটা ভাবতে না, যদি আমার ওপর তোমার লোভ না থাকত।
লোভ। বলে আঁতকে উঠল সুকুমার। বলল–লোভ অলি? লোভ কথাটা কত অশ্লীল তুমি জান? লোভের কথা বললে কেন?
তবে কী বলব, প্রেম? ভালবাসা?
সুকুমার অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলে–আমি তো তাই ভাবতাম।
মাথা নেড়ে বললাম–পুরুষমানুষ আমি কম দেখিনি। লোভ কথাটাই তাদের সম্বন্ধে ঠিক কথা। পুরুষেরা মেয়েদের চায় বটে, কিন্তু সে চাওয়া খিদের খাবার বা নেশার সিগারেটের মতো।
–তুমি বড্ড ঠোঁটকাটা। বলে সুকুমার হাসে একটু। বলে–সে থাকগে। তর্ক করে কি কিছু প্রমাণ করা যায়? বরং যদি আমাকে একটা চানস দিতে অলি, দেখতে মিথ্যে বলিনি।
চা করে আনব?
আনো।
চা খেয়ে সুকুমার নিজের হাতের তেলোর দিকে নতমুখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।
আমার একটু মায়া হল। ও আমাকে ভয় পাচ্ছে। এত বড় চেহারা,এত ভাল দেখতে, তৰুনরম গলায় বললাম কী বলবে বলল।
কী বলব, বলার নেই।
–শুধু বসে থাকবে?
না, উঠে যাব। এক্ষুনি।
–সে তো যাবেই জানি। কিন্তু মনে হচ্ছিল, আজ তুমি কী একটা বলতে এসেছিলে।
সুকুমার হঠাৎ তার যাবতীয় নার্ভাসনেস ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে মরিয়া হয়ে খাড়া উঠে বসল। আমার দিকে সোজা অকপট চোখে চেয়ে বলল–শোনো অলি, তোমাকে আমি ছাড়তে পারবনা। অনেক চেষ্টা করেছি মনে মনে, পারিনি।
এ সব কথা শুনলে আমার হাই ওঠে। অবাস্তব কথা সব, একবিন্দু বিষয়বুদ্ধি নেই এ সব আবেগের মধ্যে। আমি এঁটো কাপ তুলে নিয়ে চলে আসি। বেসিনে রেখে ট্যাপ খুলে দিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম একা। ভাল লাগে না।
হঠাৎ সুকুমার ঘরের বাইরের থেকে ভিতরে চলে এল, খুব কাছে পিছনের দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দু কাঁধ আলতো হাতে ধরে অল্প কাঁপা গলায় আর গরম শ্বাসের সঙ্গে বলল–অলি, এর চেয়ে সত্যি কথা জীবনে কলিনি কাউকে। গত তিন রাত ঘুমোত পারিনি। কিছুই ভাল লাগছে না, তাই আজ দীঘা যাওয়ার টিকিট কেটে এনেছি।
–যাও ঘুরে এসো। সমুদ্রের হাওয়ায় অনেক রোগ সেরে যায়, এটাও হয়তো যাবে।
–রোগ! কীসের রোগ! আমার কোনও রোগ নেই।
কলের জল পড়ে যাচ্ছে হিলহিল করে। সেই দিকে চেয়ে থেকে বললাম-কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নাও, তোমার হাত ভীষণ গরম।
এ সব সময় যা হয়, তাই হল। অপমানিত পুরুষ যেমন জোর খাটায়, তেমনি সুকুমারও আমাকে জড়িয়ে ধরল হঠাৎ। একটা বিরক্তিকর অবস্থা।
হটাৎ সরস্বতীর ভৌতিক গলা চেঁচিয়ে উঠলউরেব্বাস, এ কী গো!
সুকুমার প্রায় স্ট্রোকের মুরগির মতো অবশ হয়ে টলতে টলতে সরে গেল। সরস্বতী দরজায় দাঁড়িয়ে।
লজ্জায় মরে গিয়ে বললাম–এই হচ্ছে তোমাদের দাদাবাবু। ফেরাতে এসেছে।
জয়দেব আর আমার বিয়ে ভাঙার ব্যাপার সরস্বতী জানে। তাই সে বুঝল সুকুমারই হচ্ছে সেই জয়দেব। খুব হাসিমুখে বলল–তা হলে এত দিনে বাবুর মতি ফিরেছে, ভূত নেমেছে ঘাড় থেকে!
আমি কথাটা চাপা দেওয়ার জন্য বললাম–দেরি করলে যে বড়। সারা সকাল আমি কিছু খাইনি জানো।
কী করব দিদি, টাকার জোগাড় করতে সেই মোমিনপুর গিয়েছিলাম কুসমীর কাকার কাছে। সে পানের দোকান করে। পয়সা আছে। দয়া-ভিক্ষে করতে পাঁচশোটা টাকা দেবে বলেছে।
আমি বললাম- কাজকর্ম তাড়াতাড়ি সায়রা তো। বোকো না।
–দাদাবাবুর জন্য মিষ্টি-টিষ্টি এনে দেব নাকি? দাও তা হলে পয়সা। চায়ের জল চড়িয়ে দোকান থেকে আসি।
কঠিন গলায় বললাম না।
বসবার ঘরের ঠিক মাঝখানটায় সম্পূর্ণ গাড়লের মতো দাঁড়িয়ে ছিল সুকুমার। ভাল পোশাক, চমৎকার চেহারা, তবু কী অসহায় আর বোকা যে দেখাচ্ছে!
আমি হেসেই বললাম–মাথা ঠাণ্ডা রেখো, বুঝলে? আমারও তো কিছু নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে।
–সে জানি।
–ছাই জানো। আমার স্বামী লোকটা খুব খারাপ নয়। অন্তত লোকে তাকে খারাপ বলে না। তবু তাকে আমার পছন্দ হয়নি বলেই তার সঙ্গে থাকিনি। তুমি কি ভাবো আমি একা থাকি বলে খুব সহজে বশ করে নেওয়া যাবে আমাকে?
তুমি কখনওই আমাকে বুঝলে না অলি। বোধহয় ভালবাসা তুমি বুঝতেই পারো না। থাকগে, যা হয়েছে তার জন্য ক্ষমা করে দিয়ো।
সুকুমার চলে যাচ্ছিল। আমি বললাম–এখন কি সোজা দীঘায় যাবে।
সুকুমার হতাশ গলায় বলল–দীঘায় একা যাওয়ার প্রোগ্রাম তো ছিল না।
-তা হলে?
–ইচ্ছে ছিল তোমাকেও নিয়ে যাব। দুটো কটেজ বুক করে রেখেছি, সরকারি বাসে দুটো টিকিট কেটে রেখেছি। কিন্তু সে সব ক্যানসেল করতে হবে।
ওর দুঃসাহস দেখে আমি হতবাক। বলে কী! আমাকে নিয়ে দীঘা যেতে চেয়েছিল?
কিন্তু এ বিস্ময়টা আমার বেশিক্ষণ থাকল না। ওরকম পাগলামির অবস্থায় মানুষ অনেক বেহিসেবি কাজ করে। বললাম আমাকে দীঘায় নিয়ে কী করতে তুমি?
সুকুমার মনোরুগির মতো হাসল একটু। বলল–আমাকে বিশ্বাস কোরো না অলি। আমার মাথার ঠিক নেই। কত কী ভেবে রেখেছি, কত কী করতে পারি এখনও।
আমি মাথা নেড়ে বললাম–এ সব ভাল নয়। তুমি আমার ক্ষতি ছাড়া কিছু করতে পারো না আর।
-বোধহয় তুমি ঠিকই বলছ। আমি নিজেকেও আর বিশ্বাস করি না।
আমি বললাম–দাঁড়াও, এক্ষুনি চলে যেয়ো না।
-কেন?
-মনে হচ্ছে, তুমি একটা বিপদ করবে। বসে একটু বিশ্রাম করো। আর বরং দুপুরে এখানেই খেয়ে যাও।
সুকুমার বসল।
সুকুমার প্রায়ই এর ওর হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে। আসলে ও হাত দেখার কিছুই জানে না, কেবল ব্লাফ মারে। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বানায় বেশ চমৎকার। নতুন ধরনের কথা বলে। কাউকে হয়তো বলে, শীতকালটায় আপনি খুব বিষণ্ণ থাকেন। আমাদের অফিসের বড়কর্তাকে একবার বলেছিল সামনের মাসে আপনাকে চশমার পাওয়ার পালটাতে হবে, এটা দাঁত তোলাবেন ফেব্রুয়ারি মাসে। এই রকম সব। অফিসের মেয়েদের হাত দেখে এমন সব কথা বলে যে মেয়েরা পালাতে পারলে বাঁচে। একবার আমার হাত দেখে সুকুমার বলেছিল-শুনুন মহিলা, আপনার একটা মুশকিল হল আপনি সকলের সঙ্গে বেশ সহৃদয় ব্যবহার করতে ভালবাসেন। স্নেহ-মায়া আপনার কিছু বেশি। কিন্তু তার। ফলে লোকের সব সময়ে মনে হয় যে আপনি তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন বা প্রেমে পড়েছেন। একটু রূঢ় ব্যবহার করতে শিখুন, ভাল থাকবেন।
কী ভীষণ মিথ্যে কথা, আবার কী ভীষণ সত্যিও! সুকুমারের ওই ভুয়ো ভবিষ্যদ্বাণী তার নিজের সম্পর্কে কেমন খেটে গেল।
স্নেহবশে মায়ায় ওকে আমি দুপুরে খেয়ে যেতে বললাম। আসলে ওই ছুতোয় ওকে একটুক্ষণ আটকে রাখার জন্য। নইলে ওর যেরকম মনের অবস্থা দেখছি, হয়তো রাস্তায় গিয়ে গাড়ি চাপা পড়বে। আর সেই আটকে রাখাটাই বুঝি ভুল হল। সুকুমার ভাবল, আমার মানসিক প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে, আমি ওকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছি।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে সুকুমার বাইরের ঘরে বসে সিগারেট ধরাল। সরস্বতী চলে গেছে, কাল সকালে ফের আসবে। যাওয়ার আগে সে সুকুমারের সঙ্গে কিছু তরল রসিকতাও করে গেল আমাকে নিয়ে।
আমি মনে মনে চাইছিলাম সুকুমার এখন চলে যাক। সুকুমার গেল না। সারা বেলা আমাদের খুব একটা কথা হয়নি। আমি রান্নাঘরে বেঁধেছি, সুকুমার বাইরের ঘরে বসে বইপত্র পড়েছে।
দুপুরে রোদ আর গরমের ঝাঁঝ আসে বলে দরজা-জানালা সরস্বতী যাওয়ার আগেই বন্ধ করে দিয়ে যায়। বেশ অন্ধকার আবছায়ায় সুকুমারের সিগারেট জ্বলছে। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। ছুটির দিনে আত্মীয়স্বজন কেউ যদি হুট করে চলে আসে, তো আমার কোনও সাফাই কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু সুকুমারকে কী করে চলে যেতে বলি?
মুখোমুখি বসেছিলাম। বললাম তুমি কি বিশ্রাম করবে, না যাবে এক্ষুনি?
সুকুমার আয়েসের স্বরে বলল–এই গরমে বের করে দেবে নাকি?
–তা বলিনি বলে অস্বস্তিতে চুপ করে থাকি। ভেবে-চিন্তে বললাম তা হলে এ ঘরে বিশ্রাম নাও। আমি ও ঘরে যাই।
শোওয়ার ঘরে এসে কাঁটা হয়ে একটু শুতেনা-শুতেই আবছা একটা মূর্তি এসে হঠাৎ জাপটে ধরল আমাকে। সুকুমার। আমি প্রতিমুহূর্তে এই ভয় পাচ্ছিলাম। ওর খাস গরম, গা গরম, উন্মাদের মতো আশ্লেষ। ও খুনে গলায় বলল–তোমাকে মেরে ফেলব অলি, যদি রাজি না হও আমাকে বিয়ে করতে।
আমার কোনও কথাই ও শুনতে পাচ্ছে না। গ্রাহ্য করছে না আমার কিল, ঘুষি, আঁচড়,কামড়।
হঠাৎ বহুকাল নিস্তব্ধতার পর বিপদসঙ্কেতের মতো টেলিফোনটা বেজে উঠল। সেই শব্দে চমকে সুকুমার একটু থমকাল। আমি নিজেকে সামলে গিয়ে টেলিফোন তুলে বললাম–হ্যালো।
একটা গম্ভীর গলা বলল–আপনার ঘরে কে রয়েছে?
এত ভয় পেয়েছিলাম যে রিসিভার হাত থেকে খসে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম–আপনি কে বলছেন?
উত্তর এল–ওই লোকটাকে ঘর থেকে বের করে দিন। টেলিফোনটা কেটে গেল আচমকা!