দ্বিতীয় অভিযান
এখনও কিছু কাজ বাকি আছে মাধবের, দলপতি হিসাবে তারই দায়িত্ব। আবার ফিরে যেতে হবে জঙ্গলে। মনোরঞ্জনের লাশের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা, তার জন্য খোঁজ করতেই হবে প্রাণপণে। লাশের চিহ্ন যদি পাওয়া যায় তো ভালই, না পেলেও একটা ডাণ্ডা পুঁতে তাতে উড়িয়ে দিতে হবে মনোরঞ্জনের নামে পতাকা। যদি কারুকে বাঘে নেয়, তারপর তার সঙ্গীরা যদি এই শেষ কর্তব্যটুকু পালন না করে, তবে তারা নরকে যায়।
দ্বিতীয় বার যাত্রার জন্য মহাদেবমিস্তিরি নৌকো ভাড়া নেবে না। গ্রামের প্রত্যেক পরিবার থেকে কয়েক মুঠো করে চাল দেবে এই অনুসন্ধান দলটির খোরাকির জন্য। দুর্গাপুজোর ফান্ড থেকে কিছু নগদ টাকাও পাওয়া যাবে পথখরচা হিসেবে। নাজনেখালির পাশেই একটি মাছের ভেড়ি আছে। ভেড়িটির মালিক আগে ছিল বসিরহাটের এক ব্যবসায়ী। পরিমল মাস্টারের পরামর্শে এবং নানা কৌশলে সেই ব্যবসায়ীটির ইজারা নষ্ট করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ভেড়িটির মালিক গ্রামের সবাই, ওই মাছ বিক্রির টাকায় হয়েছে দুর্গাপুজোর ফান্ড। তাছাড়া বছরে এক দিন ওই ভেড়ি থেকে যার যত খুশি মাছ ধরে বিক্রি করতে পারে।
আজকাল নাটক নভেলে, সিনেমা-থিয়েটারে ফরেস্ট অফিসের বড়বাবু কিংবা থানার দারোগাকে ঘুষখোর, বদমাস, অত্যাচারী এমনকী রক্তপায়ী দানব হিসেবে দেখানোই নিয়ম। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে, এখানকার ফরেস্ট অফিসের রেঞ্জারবাবুটি অতি নিরীহ, সাদাসিধে, ভাল মানুষ? জয়নন্দন ঘোষাল মানুষটি সত্যিই তাই। দারোগার কথায় আমরা পরে আসছি।
জয়নন্দন ঘোষালের দোহারা চেহারা, মধ্যবয়স্ক, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, চোখের মণি দুটো বেড়ালের মতো। এই ধরনের মানুষ সচরাচর খুব ধূর্ত হয়ে থাকে, কিন্তু ইনি বরং একটু বেশি সরল, আড়ালে অনারা যাকে বোকা বলে। কণ্ঠস্বর নরম ও শান্ত। জয়নন্দন ঘোষালের এক মামা তাঁকে এই বন বিভাগের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন। এই রকম মানুষের পক্ষে যে-কোনও চাকরিই সমান। বিয়ে করেছিলেন যথাসময়ে। উত্তর বাংলায় যখন পোস্টেড ছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী এক চা-বাগানের ম্যানেজারের সঙ্গে নষ্ট হয়। অতি দুর্ধর্ষ ছিল সেই চা-বাগানের ম্যানেজারটি, গুলি করে মানুষ খুন করে ফেলা তার পক্ষে কিছুই নয়। বউ গৃহত্যাগ করার পর জয়নন্দন সম্পূর্ণ নারীবিমুখ হয়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকেছেন। দু’বেলা পুজো-আচ্চা করেন। সেই জন্য এই নদী-জঙ্গলের মধ্যে নির্জন বাস তাঁর ভালই লাগে। টাকা-পয়সার দিকে তার লোভ নেই, তার নিচের কর্মচারীরা ঘুষ-ঘাস নেয় নিশ্চয়ই, সে-দিকে তিনি নজর দেন না, কারণ দিলেও কোনও লাভ হয় না। সরকারি অফিসে সহকর্মীদের কে কবে দমন করতে পেরেছে।
জয়নন্দন ঘোষাল খবর পাঠালেন যে, তিনি নিজেই সার্চ পার্টি নিয়ে যাবেন তিন নম্বর ব্লকে। মাধব মাঝির দল তাঁর সঙ্গেই চলুক। সজনেখালির ফরেস্ট অফিস বড় অফিস, তাদের লঞ্চ আছে, কিন্তু জয়নন্দন ঘোষের অধীনে কোনও লঞ্চ নেই। তাকে যেতে হবে নৌকোয়।
পাশাপাশি দুটো নৌকো চলল।
মাধবের শরীরে একটা অস্থির অস্থির ভাব। জয়নন্দন ঘোষালের চোখে চোখ রেখে সে কথা বলতে পারে না। মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। অন্তরে একটা চিন্তা পোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে। তিন নম্বর ব্লকে তো হাজার খোঁজাখুঁজি করেও মনোরঞ্জনের লাশ পাওয়া যাবে না! ওইখানে উড়িয়ে দিতে হবে মনোরঞ্জনের নামে পতাকা? সে নিজে গুণিন হয়ে এমন ফেরেববাজি করবে! ফরেস্টবাবুসঙ্গে যেতে চেয়েই তো যত গোলমাল বাধালেন। নইলে সে ঠিক করেছিল, আর কেউ না যাক, সে নিজেই অন্তত আর একবার সাত নম্বরে গিয়ে মনোরঞ্জনের লাশের খোঁজ করবে। চুপি চুপি সেখানে উড়িয়ে দিয়ে আসবে আর একটা পতাকা। কিন্তু ফরেস্টবাবুর নৌকো সঙ্গে থাকলে সে যায় কী করে?
একবার চুপি চুপি সে জিজ্ঞেস করেছিল, ও সাধু, ফরেস্টের বড়বাবুরে খুইলে কবি নাকি সব সইত্যি কথা? এ বাবুভাল লোক।
সাধুচরণ উত্তর দিয়েছিল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে মাধবদা? তাহলে একবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে না? আমরাও বিপদে পড়ব, আর মনোরঞ্জনের বাপ কোনও ক্ষতিপূরণ পাবে?
যা হবার তা তো হইয়েই গিয়েছে… এখন যদি সব বুঝায়ে বলি..ইনি ভাল লোক, নিশ্চয় সব বোঝবেন।
চুপ করো, একদম চেপে যাও মাধবদা। যতই ভাল লোক হোন, তোমার কথায় কি ইনি মিথ্যে রিপোর্ট লিখবেন? সাত নম্বরে লাশ পাওয়া গেলে ইনি লিখবেন তিন নম্বরে? খবরদার একেবারে মুখ খুলো না। দেখোনি, সাহেবের অন্য কর্মচারীরা আমাদের দিকে কেমন টেরিয়ে টেরিয়ে তাকায়।
একথা ঠিক, জয়নন্দন ঘোষালের নিচের লোকেরা কেউই মাধবদের বিশ্বাস করেনি। তিন নম্বর ব্লকে বাঘ, মামদোবাজি, তারা সব জানে! ঘোষালবাবু যদি সঙ্গে না আসতেন, তাহলে তারা এই লোকগুলোকে চুষে নিঙড়ে নিত। ঘোষালবাবু বোকাসোকা লোক বলেই রিপোর্ট নিতে চলেছেন তিন নম্বরে সত্যি বাঘ এসেছে কিনা। যদি বাঘের সন্ধান পাওয়া যায়, ও জায়গাটাকে নোটিফায়েড এরিয়া বলে ঘোষণা করতে হবে, কাঠ কাটার নৌকো আর ও-দিকে যেতে পারবে না। গভর্নমেন্টকেও খবরটা জানাতে হবে।
জয়নন্দন ঘোষালকে খাতির করবার জন্য সাধুচরণ দুপুরবেলা বলল, সার, আমারা পার্শে মাছের তরকারি বেঁধেছি, একটু চেখে দ্যাখবেন নাকি আমাদের রান্না?
জয়নন্দন পাশের নৌকো থেকে বললেন, আমি তো বাবা মাছ-মাংস খাই না। আমি নিরামিষ খাই।
ফরেস্ট অফিসের বড়বাবুনিরামিষ খান শুনে সাধুচরণরা সকলে থহয়ে যায়। শোনা যায়, আগের বড়বাবুর মাংসের লোভ এত বেশি ছিল যে তিনি নিজে হরিণ মারতেন। এত বড় বে-আইনি কাজটা অন্য যে কেউ করলে শাস্তি দেবার ভারও ছিল তারই হাতে।
জয়নন্দন জিজ্ঞেস করলেন, আর কী রেঁধেছ তোমরা?
আর বিশেষ কিছু বলার মতো নয়। ভাত, ডাল, আলু সেদ্ধ মাখা আর পার্শে মাছের ঝাল। আসবার পথে কয়েক খেপ জাল ফেলে কিছু এই ছোট পার্শে পাওয়া গেছে।
আলু সেদ্ধ কি পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে মেখেছ? তবে তাই দাও এক দলা, দেখি কেমন মেখেছ?
ও-নৌকো থেকে বন্দুকধারী ফরেস্ট গার্ড এদের দিকে কটমটিয়ে তাকায়। বড়বাবু মাছ খান না, কিন্তু তারা তো খায়। তাদের একবার অনুরোধ করা হল না পর্যন্ত।
ভাটার সময় দুটো নৌকো পাড়ের কাছে থেমে থাকে পাশাপাশি। কয়েকটা শামুকখোল পাখি উড়ে গেল খুব কাছ দিয়ে। গুলতিটা সঙ্গে আনলেও বার করতে সাহস গেল না নিরাপদর। নিরামিষভোজী বড়বাবুর সামনে পাখি-শিকারও নিশ্চয়ই দোষের হবে।
সময় কাটাতে হবে তো, তাই নিরাপদ একটা গান ধরল আপন মনে।
অগো সুন্দরী
তুমি কার কথায় করেছে মন-ভারী।
অগো সুন্দরী
যেখানে সেখানে থাকি অনুগত তোমারই
অগো সুন্দরী…
হঠাৎ মাঝপথে গান থামিয়ে অপ্রস্তুতের মতো চুপ করে গেল নিরাপদ। তার সঙ্গীরা তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে নিঃশব্দে চেয়ে আছে। ইস, সে এমন ভুল করল?
এই গানটা মনোরঞ্জন গেয়েছিল যাবার দিনে। বোধহয় নদীর বুকে ঠিক এই রকমই জায়গায়। মাঝনদীতে খোলা হাওয়ায় গলা ফাটিয়ে গান গাওয়ার স্বভাব ছিল মনোরঞ্জনের।
গানটা এত ভাল লেগেছিল যে, ওরা সবাই বার বার গাইতে বলেছিল মনোরঞ্জনকে। শুনে শুনে নিরাপদর মুখস্থ হয়ে গেছে, তবু এটা মনোরঞ্জনের গান, এ গান এখন আর অন্য কেউ গাইতে পারে না। নিরাপদ নিতান্ত অন্যমনস্ক ছিল বলেই –।
পাশের নৌকো থেকে জয়নন্দন বললেন, থামলে কেন, গাও না! বেশ তো গলাটি তোমার। ঠাকুর-দেবতার গান জানো না?
নিরাপদকে আবার গাইতে হল। এবার তার গলার আওয়াজ বদলে গেছে, বিষণ্ণ আর গম্ভীর।
হরি হরায়ে নমো কৃষ্ণ যাদবায়ে নমো
যাদবায় মাধবায় কেশবায় নমো
একবার বল রে…
গোপাল গোবিন্দ নাম, একবার বল রে…
বাঃ বেশ! আর একটা?
একবার গলা খাঁকারি দিয়ে নিল নিরাপদ —
দেশ জননী গো তোমার চরণে
এনেছি রক্তের ডালি…
‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ নামে যাত্রার গান, সবটা নিরাপদর মনে নেই। তাছাড়া এমনই করুণ রসের গান যে, গাইতে গাইতে গলা ধরে এল তার। শুধু নিরাপদ নয়, এখন এ নৌকোর সকলেরই খুব মনে পড়ছে মনোরঞ্জনের কথা।
তিন নম্বর ব্লক যখন মাত্র আর দু’বাঁক দূরে, সেই সময় হঠাৎ বৃষ্টি নামল ঝিরি ঝিরি করে।
আনন্দে নেচে উঠতে ইচ্ছে করল মাধব আর তার সঙ্গীদের। বৃষ্টি মানেই আনন্দ। বৃষ্টি মানে চাষের শুরু। বৃষ্টি মানে নতুন ভাবে বাঁচার আশা। অবশ্য, এই বৃষ্টিকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না, এ-দিকটা সমুদ্রের অনেক কাছে, এদিকে ঘন ঘন বৃষ্টি হয়। এখানে বৃষ্টি হলেই যে তাদের গ্রামেও বৃষ্টি হবে, তার কোনও মানে নেই। তবু তো বৃষ্টি। আঃ, কত দিন বৃষ্টি ভেজা হয়নি।
এই বৃষ্টিতে আরও বেশি খুশির কারণ আছে। এরপর আর তিন নম্বর ব্লকে বাঘের পায়ের ছাপের প্রমাণ দেখাবার কোনও দরকার হবে না। বৃষ্টিতে সব ধুয়ে গেছে না? এখন মাধবের মুখের কথাই যথেষ্ট।
সামনের ট্যাঁকেই তিন নম্বর ব্লক। এখানে একেবারে ঝড়-মেশানো তুমুল বৃষ্টি। জয়নন্দন ঘোষালের ছাতা উড়ে যাবার মতো অবস্থা। ঝড়-বৃষ্টির সময় দূরের বনরাজি নীলা বড় সুন্দর দেখায়। কিন্তু তা দেখবার মতো মন এখন কারুর নেই। ওরাও নৌকো ভেড়াল, বৃষ্টিও থামল অমনিই।
এই দ্যাখেন বড়বাবু, এই যে মা বনবিবির থান। এখানে মনোরঞ্জন পূজা দিছিল। সে মানত কইর্যা আইছিল তো!
জয়নন্দন ঘোষাল ভক্তি ভরে গড় করলেন, তাঁর দেখাদেখি অন্য সকলেও। সাধুচরণের মনে একটি অভিমান হল মা বনবিবির প্রতি। মনোরঞ্জন তো সত্যিই পুজো দিয়েছিল, তবু মা তাকে রক্ষে করলেন না।
তারপর এই যে, এই গাছে আমরা পেরথমে কোপ দিছি। অ্যাখোনো দাগটা রইছে।
জয়নন্দন বললেন, তুমি তো বাপু গুণিন। তুমি আগে মন্ত্র পড়ে এই জঙ্গল আটক করো তো! কী জানি বলা যায় না।
যে-বনে বাঘ নেই জানা কথা, সেখানে মন্ত্র পড়ায় গুণিনের আর কী কৃতিত্ব! তবুমন্ত্র পড়তে হয় মাধবকে। শেষের দিকে সে চেঁচাতে শুরু করলে অন্যরাও যোগ দেয় সেই চিৎকারে। বন্দুকধারী গার্ডটি বন্দুকটা বাগিয়ে ধরে। সে জানে, সোঁদরবনের বাঘ বড় টেঁটিয়া, লোকজনের গলায় আওয়াজ শুনলে আরও কাছে আসে। এ তো আর তরাই বনের বাঘ নয় যে, একের বেশি দু’জন মানুষ দেখলেই লেজ গুটিয়ে পালাবে।
তারপর কোন দিকে গিসলে তোমরা?
মাধব এবার সাধুচরণের দিকে তাকায়। ঠিক সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যে বর্ণনাটি দেবার ভার তার ওপর।
সে শুরু করল, এই যে বড়বাবু, এই বাইন গাছটার মাথায় কাঁকটা বসেছিল। নিরাপদ চেষ্টা করে মারতে পারল না। তারপর আমরা সবাই লাইন করে…।
যে-বনে বাঘ নেই, সেবনে এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল বাঘের চিহ্ন! যে-বনে মনোরঞ্জন বাঘের মুখে পড়েনি, সেই বনে খোঁজা হল তার লাশ। মনোরঞ্জন খালি গায়ে নেমেছিল জঙ্গলে, কিন্তু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের এক জন গার্ড একটা ঝোপের মধ্য থেকে আবিষ্কার করল তার গেঞ্জি। তাতে আবার ছিটে ছিটে রক্ত মাখা। মাধবরা সবাই এক বাক্যে সাক্ষী দিল ওই গেঞ্জি মনোরঞ্জনেরই। নিরাপদ ওই গেঞ্জিটা লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু লুঙ্গি আনতে পারেনি প্রাণে ধরে।
জয়নন্দন ঘোষাল তাতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু বাঘ যে আবার তিন নম্বর ছেড়ে চলে গেছে, তা-ও প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। এত হাঁকডাকেও বাঘের কোনও সাড়া নেই। সমুদ্রের মতো এত বড় চওড়ানদী, বাঘ তা-ও সাঁতরে আসে। কুমিরকামটের ভয়ও নেই বাঘের। জানোয়ারের মতো জানোয়ার বটে!
ফেরার পথে দুটো নৌকো আলাদা হয়ে গেল।
মাধব বলল, আইলামই যখন, তখন দুই-এক বোঝা কাঠ কাইট্যা লইয়া যাই, কী কস তোরা?
নিরাপদ সাধুচরণরা একটু কিন্তু কিন্তু করে। মহাদেব মিস্তিরি বিনা পয়সায় এই নৌকো দিয়েছে আসা-যাওয়ার বাঁধা সময়ের করে। দেরি হলে সে ধরে ফেলবে।
মাধব বলল, সবাই মিলে ঝপাঝপ হাত লাগালেই তো চাইর-পাঁচ বোঝা কাঠ হয়। বোঝোস না তোরা, ফিরা গিয়া খামু কী?
কিন্তু কাঠ নিয়ে গেলেই তো ধরে ফেলবে!
সে-চিন্তা নাই। যাওনের পথে ছুটো মোল্লাখালিতে নৌকো ভিড়ায়ে কাঠগুলা দাউদশাখের গুদামে ফেলাইয়া গ্যালেই হবে!
খাঁড়ি দিয়ে খানিকটা ঢুকে ওরা কাঠ কাটতে শুরু করে দেয়। বুদ্ধি করে দু’খানা কুড়াল এনেছে মাধব। বাইন-গরাল-হেঁতাল যা সামনে পায় তাতেই ঝপাঝপ কোপ লাগায়। জ্বালানি কাঠ তো জ্বালানিই সই। যা পাওয়া যায়।
বাঘ নেই, তবুবাঘের ভয়ে গা ছম ছম করে নিরাপদর। সব সময় মনে পড়ছে মনোরঞ্জনের কথা। মনোরঞ্জন ভূত হয়ে কাছাকাছি ঘুরছে না তো? কেন মরতে এসেছিলি মনোরঞ্জন, তোকে তো কেউ ডাকেনি।
পরদিন ওরা গাঁয়ে ফিরল সন্ধেসন্ধি। ছোট মোল্লাখালিতে কাঠনামিয়ে দু-চারটে টাকা যা পেয়েছে, তা নিয়ে অনেক দিন পর ওরা ধুম মাতাল হল। সাঁওতাল পাড়ার দু’টাকায় এক হাঁড়ি হাঁড়িয়া, তাই তিন-চার হাঁড়ি টেনে ওরা গড়াগড়ি দিতে লাগল নিশুতি অন্ধকারের মধ্যে হাটখোলায়।
নিরাপদ ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগল, ওরে মনোরঞ্জন তুই কোথায় গেলি? তুই ছাড়া কে হিরো হবে আমাদের যাত্রায়? ওরে, তোকে আমি একবার ক্যানিং-এর খানকি পাড়ায় নিয়ে গেলাম, কত আনন্দ হল সেবার! ওরে মনা, মনা রে—
.
অরুণাংশুর মনোবদনা
জ্বরের ঘোরে দু’দিন প্রায় বেহুঁশ হয়ে রইল পরিমল মাস্টার।
যেহেতু এ-দিকে গোসাবা ছাড়া কোথাও ডাক্তার নেই, তাই সুলেখা নিজেই হাফ-ডাক্তার। গ্রামের লোকদের টুকিটাকি অসুখে সে নিজেই ওষুধ দেয়, হোমিওপ্যাথিক, অ্যালোপ্যাথিক দুরকমই।
পরিমলের এতখানি অসুখ হওয়ায় সুলেখার জ্বরটা যেন আপনা থেকেই বিনীত ভাবে সরে গেল। প্রথম রাতে স্বামীকে নিজেই ওষুধ দিল। পরদিন বেলাবেলি এলেন ডাক্তার। তাঁর সন্দেহ, পরিমল মাস্টারের টাইফয়েড হয়েছে। অবশ্য রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
অসুখ হয়েছে বলেই যে হুট করে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে, এমন মনে করে না সুলেখা। তার মাথা ঠাণ্ডা, তার বাইরের চাঞ্চল্য কদাচিৎ দেখা যায়। এই যদি সুলেখার এরকম অসুখ হত, তাহলে পরিমল খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ত। ছেলে মেয়ের অসুখ হলে সেই ব্যস্ততা আরও চারগুণ হয়।
মাঝে মাঝে চোখ মেলে পরিমল আচ্ছন্ন ভাবে জিজ্ঞাসা করেন, তারপর কী হল নাজনেখালিতে? ছেলেটার নাম যেন কী? কোন বাড়ির ছেলে?
সুলেখা জানে, এই সময় পুরো কাহিনিটি তার স্বামীকে জানানো বৃথা। জ্বরতপ্ত মাথায় কোনও চিন্তা দানা বাঁধেনা। সে সংক্ষেপে দু-চারটে কথা বলে, তার মধ্যেই আবার ঝিমুনি এসে যায় পরিমলের।
মধ্যরাত্রে হঠাৎ জেগে উঠে পরিমল একবার জিজ্ঞেস করল, অরুণাংশু এসেছে?
সুলেখা বলল, এই সব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে অরুণাংশুবাবুর আসবার দরকার কী?
একটা লঞ্চের শব্দ শুনতে পাচ্ছি যেন?
ওটা পুলিশের লঞ্চ। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা করো তো।
না, দেখো, হয়তো ওই লঞ্চেই অরুণাংশু আসছে। ও সব পারে।
এলে আর কী হবে! থাকবে! তবে তোমার বন্ধু যদি এবার এসে এখানে মদ খায় কিংবা হল্লা করে, তা হলে স্পষ্ট দু’কথা শুনিয়ে দেব।
অ্যাঁ? কী বলছ?
অন্ধকারের মধ্যে স্বামীর মাথায় হাত রেখে সুলেখা নরম গলায় বলল, আর একবার জলপট্টি লাগাব? ঘুম ভেঙে গেল কেন হঠাৎ?
একটু জল দাও, বড্ড তেষ্টা।
খানিকটা বাদে পরিমল আবার বলে উঠল, বুঝলে না, এটা ওদের নেশা…এই নদী ওদের টানে, জঙ্গল টানে…ওরা যাবেই।
কাদের কথা বলছ?
ওই যে ওরা। যতই তুমি নিরাপত্তা দাও, পেটে খাবার দাও, তবু বিপদের ঝুঁকি নেওয়া মানুষের ধর্ম। সেই জন্য ইচ্ছে করে ওরা বাঘের মুখে যায়…।
ঘুমের ওষুধ দেওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে সুলেখা নিঃশব্দে হাত বুলিয়ে যেতে লাগল পরিমলের পাতলা হয়ে আসা চুলের মধ্যে। আপন মনে কিছুক্ষণ কথা বলে থেমে গেল পরিমল।
পরদিনও জ্বর রইল একশো পাঁচ।
প্রলাপ বকার মতো মাঝে মাঝে কথা বলে যেতে লাগল স্ত্রীর সঙ্গে, দু-একবার শোনা গেল অরুণাংশুর নাম। কিন্তু অরুণাংশু আসেওনি। আর কোনও খবরও দেয়নি।
দ্বিতীয় দিনে ডাক্তার জানালেন যে পরিমলের বক্তে টাইফয়েডের জীবাণু পাওয়া যায়নি, জ্বর রেমিশানের জন্য তিনি পালটে দিলেন ওষুধের নাম। সে-ওষুধ অবশ্য গোসাবায় এখন পাওয়া যাচ্ছে না। বনমাতা লঞ্চের সারেংকে অনুরোধ করা হল, ক্যানিং থেকে প্রথম ফেরার লঞ্চের সারেং-এর হাতে যেন ওই ওষুধ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বাসনাকে মহিলা সমিতির হস্টেলে এনে রেখেছে সুলেখা। এই দু’দিন তার প্রতি সে বিশেষ কোনও মনোযোগ দিতে পারেনি। ওখানে অন্য মেয়েরা আছে, তারা দেখবে। তাছাড়া এখন এ মেয়েটির কান্নারই সময়, একা নিজের ঘরে শুয়ে কাঁদুক।
তৃতীয় দিনে শুরু হল অন্য রকম উৎপাত।
মামুদপুর থেকে বাসনার বাবা এবং কাকা এসে হাজির। প্রথমে তারা গিয়েছিল নাজনেখালিতে, সেখানে মেয়ের শাশুড়ির কাছ থেকে গালমন্দ খেয়ে অপমানিত হয়ে তারা দাপাদাপি করতে লাগল জয়মণিপুরে এসে।
মহিলা সমিতির সামনে দাঁড়িয়ে তারা গালাগালির ভাণ্ডার উজার করে দিল। বাসনার বাবার চেয়ে তার কাকারই গলার জোর বেশি। কাকার নাম নিতাইচাঁদ, মুখে মোল্লাদের মতন দাড়ি, লুঙ্গির ওপর নীল ছিটের জামা পরেছে, বাঁ-হাতে একটা রুপোর তাগা বাধা। তার তুলনায় ধুতি ও গেঞ্জি পরা বাসনার বাবা শ্রীনাথ অনেকটা নিরীহ। নিতাইচাঁদ আর শ্রীনাথ কিন্তু পৃথক অন্ন, কিন্তু এই শোকের সময় তারা এক হয়ে গেছে।
তাদের গালাগালির মূল বক্তব্য, তাদের মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে ঠেলে এখানে পাঠানো হয়েছে। তাদের মেয়ে কি অনাথ? এখনও মামুদপুরে নিতাইচাঁদ সাধুকে সবাই এক ডাকে চেনে। কী ভুল করেই না তারা এক হারামজাদার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল মেয়ের।
সেই গালাগালি শোনবার জন্য এখানেও একটা ভিড় জমেছে। শোকের ব্যাপার বলেই অন্য সবাই চুপ করে আছে, নইলে তারাও নানা রকম মন্তব্য করতে ছাড়ত না। শোকে-দুঃখে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তখন কত কী বলে, সে-সব কথা ধরতে নেই।
শুধু বদন দাস একবার বলল, ও দাদারা, একটু আস্তে কথা বলুন। মাস্টারমশাইয়ের খুব অসুখ।
সে কথা ওরা কানেই তুলল না।
ওই চেঁচামেচি অসহ্য লাগছে সুলেখার। স্বামীর শোওয়ার ঘরটায় জানলা-দরজা বন্ধ করে রেখেছে। যাতে তার কানে কিছুনা যায়। তবু পরিমল মাস্টার একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ও কীসের গোলমাল? আজ এখানে গ্রাম-সভা বুঝি?
শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারল না সুলেখা। সে ওদের সামনে এসে বলল, আপনারা এখানে এত চেঁচামেচি করছেন কেন? আপনাদের মেয়েকে কি আমি জোর করে এনেছি? আপনাদের ইচ্ছে হলে তাকে নিয়ে চলে যান।
এর উত্তরে নিতাইচাঁদ আরও জোরে বলল, কোন সাহসে ওরা বলে যে আমাদের মেয়ে অলক্ষ্মী? ভাতারখাগী? ছোটলোকের বাড়ি তো, জানে না আমরা কত বড় বংশ, আমাদের মেয়ে কোনও দিন মুখ তুলে কারোর সঙ্গে কথাটি বলে না…।
সুলেখা ক্লান্ত ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ-সব কথা তার কাছে বলার কী মানে হয়? মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা না থাকলে সে ধীরে সুস্থে বোঝাবার চেষ্টা করত। এখন ভাল লাগছে না। সে ধমক দিয়ে বলল, চেঁচামেচি করতে বারণ করলুম না? আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে চান কি না বলুন।
নিতাইচাঁদ বলল, চোখ রাঙাচ্ছেন কাকে? আমরা আপনার খাই না পরি? না আপনাদের কো-অপের ধার ধারি? আমাদের মামুদপুরেও কো-অপ আছে। এখানে প্রজেক্টের টাকা কীভাবে খরচা হয়, তা সবাই জানে…।
পরিমলমাস্টার থাকলে সে ওদের দুজনের কাঁধে হাত দিয়ে টেনে নিয়ে যেত, রঙ্গ-রসিকতা করত, গাছতলায় বসে ওদের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে টানত। খানিক পরেই ওরা প্রতি কথায় ঘাড় হেলিয়ে বলত, হ্যাঁ মাস্টারমশাই, হ্যাঁ মাস্টারমশাই।
সুলেখা চলে গেল মহিলা সমিতির হস্টেলের ভেতরে। হস্টেল মানে তিনখানা চ্যাঁচার বেড়া দেওয়া ঘর, মেয়েরা চোখ গোল গোল করে শুনছে, তাদের মধ্যে গুম হয়ে বসে আছে বাসনা।
সুলেখা বাসনার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি চলে যেতে চাও, না থাকতে চাও? বাসনা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে আবার কাঁদতে শুরু করল।
সুলেখা কড়া গলায় বলল, এখন কান্না থামাও। কাঁদাকাটা করার অনেক সময় পাবে পরে। এখন থেকে তোমার ভাল-মন্দ নিজেকেই বুঝতে হবে।
বাসনা তবু কোনও কথা বলে না। ফোঁপায় শুধু।
আমার মনে হয়, এখন তোমার বাপের বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল। এই ননী, বিমলা, ওর জিনিসগুলো গুছিয়ে দে।
দুপুর প্রায় একটা। নারী সমিতির মেয়েরা বাসনাকে না খাইয়ে এ-সময় যেতে দেবে না। শ্রীনাথ আর নিতাইচাঁদ একটু দূরে একটা খিরিশ গাছের তলায় বসে গুজুর গুজুর ফুসর ফুসর করতে লাগল। খাওয়া জুটল না ওদের। এ গ্রামে তো হোটেল নেই। আর ও-রকম ঝগড়ুটে দু’জন লোককে কোন গৃহস্থ বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবে?
নদীর বুকে প্রথমে জেগে উঠল ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ, তারপর ভ্যাঁ ভ্যাঁ হর্ন। আড়াইটের লঞ্চ। বাসনাকে সামনে রেখে শ্রীনাথ আর নিতাইচাঁদ এগিয়ে গেল লঞ্চঘাটার দিকে।
পরিমল মাস্টার এসব কিছুই জানলেন না।
সেই মেঘমালা লঞ্চ থেকেই নামল বিখ্যাত লেখক অরুণাংশু সেনগুপ্ত। সেসদ্য বিধবা বাসনাকে লক্ষ করল না। এখানে আট-দশজন যাত্রী ওঠেনামে, কে কার দিকে তাকায়! তাছাড়া এই জয়মণিপুর থেকে ওঠে ঘি-দুধের ড্রাম। বরং অরুণাংশুর দিকেই অনেকে আড়চোখে তাকাল, সে যে বিখ্যাত তা অবশ্য কেউ জানে না, কিন্তু তার মুখের দিকে এক পলক তাকালেই বোঝা যায় সে এখানকার মানুষ নয়। শহরের গন্ধ মাখা প্রাণী।
গাঢ় নীল রঙের ট্রাউজার্স, ফুল ফুল ছাপা খাদির হাওয়াই শার্ট, মাথার চুল কঁচাপাকা, দু’চোখের কোলে অনিদ্রার কালি, মুখে অসংযম ও অত্যাচারের ছাপ। লেখক হিসেবে অরুণাংশু রবি ঠাকুরের বংশধর নন। ইতিমধ্যেই কোনও কোনও ব্যাপারে মাইকেলকে ছাড়িয়ে গেছেন।
অরুণাংশু সাধারণত একা বাইরে যায় না, সঙ্গে দু-একজন বন্ধুবান্ধব থাকে, যে-কোনও জায়গায় যাত্রাপথেই সে মদ্যপান করতে শুরু করে, অল্প অল্প নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় সে জোরে জোরে হাসে। হুকুম করার সুরে কথা বলে, সব জায়গায় তার উপস্থিতি সম্পর্কে সজাগ করে দেয় সকলকে। যাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, তারাই সর্বক্ষণ সরবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করে। অধিকাংশ লেখকই ভোগেন এই রোগে।
আজ কিন্তু অরুণাংশুর একেবারে অন্য রকম রূপ। সে এসেছে একা, দেখে যত দূর সম্ভব মনে হয় নেশা করেনি, মুখে গাঢ় বিমর্ষতা মাখানো। বাঁ-হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ঝুলছে। আগে একবার এখানে এলেও সে দিক ভুলে গেছে, লঞ্চ থেকে নেমে সে এ-দিক ওদিক তাকাতে লাগল। জোয়ারের সময়, তাই পায়ে কাদা লাগেনি।
বদন দাসকেই সে জিজ্ঞেস করল, হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়িটা কোথায়?
বদন দাস বলল, আসেন আমার সঙ্গে।
এই লঞ্চে যারা কলকাতা থেকে আসে, তারা খেয়েই আসে সাধারণত। খবর না দিয়ে এলে আড়াইটে-তিনটের সময় কে ভাত রান্না করে দেবে? অধিকাংশ গ্রামের মানুষই বেলা এগারোটার মধ্যে ভাত-টাত খাওয়া সেরে ফেলে। অরুণাংশু খেয়ে আসেনি, কিন্তু সুলেখার সঙ্গে দেখা হবার পর সে তা বলল না। বন্ধুর অসুখ শুনে সে গিয়ে বসল তার খাটের পাশে।
ওষুধ ও জ্বরের ঘোরে পরিমল মাস্টার অজ্ঞানের মতো ঘুমোচ্ছ।
এই যদি অন্য সময় হত, অরুণাংশুর মাথায় টলটলে নেশা থাকত, তাহলে সে এই রকম কোনও ঘুমন্ত বন্ধুর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বলত, এই শালা, ওঠ। জ্বর-ফর আবার কী রে, লোকের এত জ্বর হয় কেন, আমার তো কোনও দিন হয় না! আজ অরুণাংশু তার বন্ধুর পাশে বসে আলতো করে একটা হাত রাখল কপালে।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সুলেখা, তোমাদের এখানে আমাকে একটা চাকরি দিতে পারবে? আমি এখানেই থেকে যেতে চাই।
এমনকী রসিকতা মনে করেও হাসল না সুলেখা। সঙ্গে সঙ্গে দু’দিকে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, না। তারপর জিজ্ঞেস করল, চা খাবেন তো?
এখন না। আমিও একটু ঘুমোব। কোথায় ঘুমোব বলো তো?
ছেলে আর মেয়ের পড়ার ঘরটা এখন ফাঁকাই পড়ে আছে। খাটও আছে একটা, সেখানেই শোয়ার ব্যবস্থা হল অরুণাংশুর। কিন্তু শুয়েও ঘুমোল না। চিত হয়ে শুয়ে সিগারেট টেনে যেতে লাগল একটার পর একটা। সেই বিমর্ষ ভাবটা মুখে লেখেই রইল।
কদিন ধরে স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই না গেলে বেশ অসুবিধে হয়। তাই বিকেলের দিকে সুলেখা একবার স্কুলে ঘুরে আসতে গেল। কাছেই তো।
সন্ধের পরও অরুণাংশুর ঝোলা থেকে মদের বোতল বেরুল না। পরিমল জেগে ওঠার পর তার খাটের ওপর গিয়ে বসে সে চা খেল।
পরিমল প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, কীসে এসেছিস, পুলিশের লঞ্চে?
না তো!
রাত্তিরে পুলিশের লঞ্চের শব্দ পেলাম।
সময়ের হিসেবটা গুলিয়ে গেছে পরিমলের। দুপুরের লম্বা ঘুমের পর জেগে উঠে যেমন অনেক সময় মনে হয় সকাল।
আর কে কে এসেছে?
কেউ না!
মনোরঞ্জন বলে একটা ছেলের আসবার কথা ছিল না? নাজনেখালির মনোরঞ্জন। সে তোর সঙ্গে আসেনি?
সুলেখা বলল, তুমি কী বলছ? নাজনেখালির মনোরঞ্জনকে উনি চিনবেন কেন? আর সে এখানে আসবেই-বা কী করে? তাকে তো বাঘে নিয়ে গেছে!
এই প্রথম উঠল বাঘের কথা।
পরিমল মাস্টার ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, হ্যাঁ, তারপর কী হল বলো তো? ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই যে তুমি নাজনেখালি গেলে… বিষ্টুপদর ছেলে না মনোরঞ্জন? তাকে সত্যিই বাঘে নিয়ে গেছে?
সুলেখা বলল, হাঁ। তার বউয়ের বয়েস মাত্র উনিশ-কুড়ি। এই তো মোটে ক’মাস আগে বিয়ে হয়েছে।
এরপর সুলেখা অতি সংক্ষেপে বাসনা নাম্নী মেয়েটির এই কয়েক দিনের জীবনকাহিনি শোনাল।
মাথা পরিষ্কার হয়ে গেছে পরিমল মাস্টারের। সে ঠিক বুঝতে পারল ঘটনা পরম্পরা।
সে বললেন, মেয়েটা চলে গেল? তুমি তাকে যেতে দিলে?
বাঃ, তার বাবা-কাকা নিতে এসেছে, আমি তাকে আটকে রাখব নাকি?
দেখোনা এবার কী-রকম মজা হয়।
সে হেসে উঠল হো-হো করে। সুলেখা অবাক। এমন অসুস্থ লোকের মুখে তৃপ্তির হাসি?
তুমি হাসছ?
বললাম তো, দেখোই না এবার কী মজা হবে।
অরুণাংশু আগাগোড়া চুপ। কোনও কিছুতেই তিনি উৎসাহ পাচ্ছে না। সিগারেটের শেষ টুকরোটা ঘরের মেঝেতে ফেলাই তার চরিত্রে ধর্ম, আজ কিন্তু সে মনে করে প্রত্যেকবার জানলার বাইরে ফেলে আসছেন।
প্রসঙ্গ বদলে পরিমল বলল, আমি এমন করে কাবু হয়ে পড়লাম, তোকে নিয়ে কোথাও ঘোরাঘুরি করতে পারবনা।
অরুণাংশু বলল, আমি এখানে কয়েকটা দিন চুপচাপ শুয়ে থাকবার জন্য এসেছি।
কিছু লেখবার জন্য?
না। লেখা-টেখার সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক নেই।
মানে?
আমি লেখা ছেড়ে দেব। দেব মানে কী, ছেড়ে দিয়েছি। কী হবে আর লিখে।
চারদিকে তোর লেখার জয় জয়কার…কাগজ খুললেই তোর বইয়ের বিজ্ঞাপন।
দুর দুর, ও সব বাজে।
তুই দু-চারখানা বই আনিসনি আমাদের জন্য?
নাঃ।
সুলেখা ভাবল, ও অকাল বৈরাগ্য? সেই জন্যই মুখখানা শুকনো শুকনো, উদাস উদাস ভাব? তা ভালই হয়েছে, এই জন্য যদি কয়েক দিন অন্তত মদ খাওয়া বন্ধ থাকে… অন্তত এখানে তো ও-সব কিছু চলবেই না।
পরিমল বলল, না রে, অরুণাংশু তোকে সিরিয়াসলি বলছি, তুই এখানকার মানুষজনদের নিয়ে লেখ না! তোর কলমের জোর আছে, তুই কিছু দিন এখানে থেকে দেখ সব কিছু…।
না, না, না! আমি বুঝে গেছি লিখে এই পৃথিবীর কোনও কিছু বদলানো যায় না। সাহিত্য-টাহিত্য সববিলাসিতা।
পরদিন জ্বর ছেড়ে গেল পরিমলের। শরীর খুব দুর্বল, হাঁটতে গেলে মাথা ঝিমঝিম করে, তবু সে যেন অনুভব করল এবার সুস্থ হয়ে উঠবে। এই জ্বর ঝেঁকে ঝেঁকে আসে। এবার কড়া ওষুধের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে।
অরুণাংশু সত্যিই প্রায় সারা দিন শুয়েই কাটাল। একটা বই পর্যন্ত পড়ে না।
পরিমল বলল, তুই গ্রামের মধ্যে একলা একলাই একটু ঘুরে আয় না। তোকে তো এখানে বিখ্যাত লোক বলে কেউ খাতির করে না, নিজের চোখে এদের অবস্থা দেখবি।
নাঃ, ভাল লাগছে না। গতবারে তো সজনেখালি যাওয়া হল না। এবার যাবি? ব্যবস্থা করে দিতে পারি। এক জন কারুকে সঙ্গে দেব, তোকে নিয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে, ওখানে একটা রাতও কাটিয়ে আসতে পারিস, বাঘের দেখা না পেলেও হরিণ দেখতে পাবি অনেক।
নাঃ, ইচ্ছে করছে না।
গ্রামের মানুষ অরুণাংশুকে না চিনলেও স্কুলের মাস্টারদের মধ্যে তার ভক্ত থাকবেই। শুধু জয়মণিপুরে তিন জন শিক্ষকই নয়, খবর পেয়ে গোসাবার দু’জন শিক্ষক এলেন অরুণাংশুর সঙ্গে দেখা করবার জন্য। লেখকদের সামাজিক দায়িত্ব, সাহিত্যে অশ্লীলতা, বাংলা সাহিত্যে এখন আর গ্রাম নিয়ে তেমন কিছু লেখা হচ্ছে না কেন। এই সব ভাল ভাল বিষয় নিয়ে বিখ্যাত লেখক অরুণাংশু সেনগুপ্তর সঙ্গে মনোজ্ঞ আলোচনা করার বাসনা নিয়ে এসেছিলেন তারা। কিন্তু অরুণাংশু তাদের জিজ্ঞেস করল, ধানের দর কত, চাষির ছেলেরা লেখাপড়া শিখে কী করে হস্টেলে কী রকম খাওয়া দেয়, হ্যামিল্টন সাহেব আসলে বুর্জোয়া জমিদার ছিল কি না এই সব এলোমেলো প্রশ্ন এবং একটু পরেই শিক্ষকদের নিজের ঘরে বসিয়ে রেখে পরিমলের খাটে গিয়ে শুয়ে রইল। আর এলই না।
মাস্টারমশাইরা কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বসে থেকে উঠে গেলেন এক সময়।
সৃষ্টিধব বেবাব মিষ্টিপুকুরের খুব ভাল জিওল মাছ আছে, তার থেকে বেশ বড় বড় গোটা কতক মাগুর সে পাঠিয়ে দিল এ বাড়িতে। জ্বর থেকে উঠে মাস্টারমশাই আজ ঝোল-ভাত পথ্য করবেন সেই জন্য। সৃষ্টিধব ধানের কারবার করে বেশ দু পয়সা আছে, তার এক জন দুর্বল প্রতিবেশীকে জোর করে জমি থেকে উৎখাত করবাব চেষ্টা করছে লোকটিকে পছন্দ করে না পরিমল। গ্রামের অন্য লোকজনদের মধ্যে এটা জনমত সৃষ্টি করেও সে সৃষ্টিধবকে শায়েস্তা করতে পারেনি। অনেকেই আড়ালে গিয়ে সৃষ্টিধবের কাছে হাত পাতে। খোঁজ করলে হয়তো দেখাবে গ্রামের বেশির ভাগ লোকই সৃষ্টিধবের কাছে কোনও না কোনও ভাবে ঋণী।
ও মাছ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল পরিমল। কিন্তু ইলা আগেই কুটে ফেলেছে।
সুলেখা বলল, ঠিক আছে, সৃষ্টিধববাবুকে দাম পাঠিয়ে দিলেই হবে।
তবু মুখখান গোঁজ হয়ে রইল পরিমলের। মাগুর মাছ তার খুবই প্রিয়। এ রকম স্বাস্থ্যবান মাগুর আশেপাশের দশখানা হাট খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তবু আজ এই মাছে কোনও স্বাদ পেল না পরিমল।
পাশাপাশি দুই বন্ধু খেতে বসেছে। মাগুর মাছ বিষয়ে এত সব কথাবার্তার মধ্যে একটিও মন্তব্য করলেন না অরুণাংশু। একেবারে নিঃশব্দ। আহারে রুচি নেই, খেতে হয় তাই খাওয়া।
তুই মুড়োটা খা। তুই তো মাছের মুড়ো ভালোবাসিস।
অকণাংশু থালায় আঁকিবুকি কাটছে। অর্ধেক পাত পড়ে আছে। এমনিতে সে মাছ খেতে খুবই ভালবাসে, অথচ আজ কোনও আগ্রহই নেই।
সুলেখা স্কুলে চলে যাওয়া মাত্র পরিমল বলল, একটা সিগারেট দে।
অরুণাংশু অন্য মনস্কভাবে নীল রঙের ধোঁয়ার নানা রকম প্যাটার্ন পর্যবেক্ষণ করছে।
তোর কী হয়েছে বল তো? গুরুতর ব্যাপার মনে হচ্ছে।
অরুণাংশু বলল, না, সে-রকম কিছু না। এমনিই মনটা ভাল নেই।
ডিপ্রেশান?
তোর এ-রকম হয় না কখনও?
যারা ভাবের কারবার করে, তাদেরই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। আমি এখানে সব সময় একেবারে রূঢ় বাস্তবের মধ্যে থাকি, মানুষের নিছক খাওয়া-পরা জন্ম-মৃত্যু খরা-বন্যা, জমি ধান ঋণ খালকাটা এইসব–এই সব এলিমেন্টাল ব্যাপারের মধ্যে জড়িয়ে থাকলে কখনও কখনও রাগ হয়, ক্ষোভ হয়, অস্থিরতা এমনকী হতাশাও আসতে পারে মাঝে মাঝে। কিন্তু যাকে মন খারাপ বলে, তা হবার কোনও সুযোগ নেই।
পরিমল এমন গুরুত্ব দিয়ে বলল কথাগুলো, কিন্তু অরুণাংশু শোনেনি। শূন্য ভাবে চেয়ে আছে, মন অন্য কোথাও।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
এই জায়গাটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা। পাখিটাখির ডাক ছাড়া কোনও শব্দ নেই। ট্রাম-বাসের আওয়াজ আর মানুষের চেঁচামেচি শুনতে হচ্ছে না, এ এক দারুণ শান্তি।
পরিমল ভুরু কুঁচকে তাকাল বন্ধুর দিকে। লেখার সময়টুকু ছাড়া যে-মানুষ সব সময় হইচই, মানুষের সঙ্গ, ফুর্তি, আত্মম্ভরিতায় সুড়সুড়ি লাগানো কথাবার্তা ছাড়া থাকতে পারে না, তার হঠাৎ এই নৈঃশব্দ্য-প্রীতি?
অরুণাংশু বলল, তোর এখানে আমি যদি বছর খানেক থেকে যাই? জমি চাষ করব, খাল কাটার জন্য কোদাল ধরব, নৌকো নিয়ে চলে যাব জঙ্গলে।
ব্যাপারটা আসলে কী? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া? সান্ত্বনাকে নিয়ে আসবি বলেছিলি যে?
না, ব্যাপারটা মোটেই স্ত্রীঘটিত নয়। অরুণাংশু যে-রকম জীবন যাপন করে, তাতে প্রায়ই যে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হবে সে আর এমন কী অস্বাভাবিক ব্যাপার। সান্ত্বনার সহ্যশক্তি খুবই। দু-তিনবার অবশ্য সেই সহ্যশক্তিরও সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় সান্ত্বনা ডিভোর্সের প্রস্তাব দিয়েছে। একটি অখ্যাত ছোট পত্রিকায় লেখা হয়েছে, এক কালের প্রতিভাবান বিদ্রোহী, আধুনিকতার ও যৌবনের প্রধান প্রবক্তা অরুণাংশু সেনগুপ্ত এখন এস্টাব্লিশমেন্টের কাছে বাঁধা পড়ে গেছেন। পয়সার জন্য লেখেন, জনপ্রিয়তার জন্য দুধে জল মেশাচ্ছেন।
এ-সব সমালোচনা গ্রাহ্য করেনা অরুণাংশু। সাহিত্য-জীবনের প্রায় গোড়াতেই সে ধরে নিয়েছিল যে, অক্ষম লোকেরাই সমালোচনা করে। কোনও এক জন লোক বলে দেবে, তোমার লেখাতে এই এই দোষ, অমুক অমুক ত্রুটি, তাতেই কোনও লোক নিজেকে সংশোধন করে নেবে? এ-রকম কখনও হয়?
নিন্দে সে সহ্য করতে পারে না একেবারে। আর নিন্দে বা কটু সমালোচনা তো হবেই। কেউ সার্থক হলেই একদল লোক তাকে ছোট করবার চেষ্টা করে। বামনদের দেশে দু-এক জন যদি লম্বা হয় অমনি অনেকে তাদের টেনে হিচড়ে নিজেদের সমান করতে চেষ্টা করে। নির্লজ্জ ঈর্ষা নানা রকম রঙিন ভাষার পোশাক পরে সমালোচনার নামে আসরে নামে। আর সব যুগেই থাকে একদল নপুংসক ধরনের লোক, যারা নারী-পুরুষের শারীরিক মিলনের কোনও বর্ণনা দেখলেই সমাজ-সংস্কৃতি সব গেল গেল বলে আর্তনাদ করতে থাকে। অরুণাংশু এ-সব পত্র-পত্রিকা পেলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় একদিন একটি যুবক একটি পত্রিকা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, অরুণদা এটা একটু পড়বেন। অরুণাংশু আগেই জানত সে-পত্রিকায় তার সম্পর্কে কী লেখা হয়েছে। সেঝট করে পত্রিকাটি সেই যুবকটির মুখে চেপে ধরে বলেছিল, নে, খা তোর বমি তুই নিজেই খা।
তবু কোনও এক সময় ভেতরের কোনও একটা জায়গায় হঠাৎ লাগে। কিছু একটা ঝন করে বেজে ওঠে। অক্ষম ব্যর্থদের ঈর্ষার জন্য নয়, এমনিই এক-একসময় নিজের গভীরে গিয়ে নিজেকে দেখতে ইচ্ছে হয়। আপাত-সার্থকতার ওপর পড়ে ব্যর্থতার গোপন গভীর ছায়া। পত্রিকাটা উপলক্ষ মাত্র।
অরুণাংশু উদাসীন ভাবে বলতে লাগল, জীবনটা কী ভেবেছিলাম, কী হয়ে গেল! ভেবেছিলাম জীবনে কোনও বন্ধন থাকবে না, অথচ এই যে লেখালেখি, এ-ও তো বন্ধন, বছরে দুটো-তিনটে উপন্যাস লেখা, ইচ্ছে না থাকলেও অনেক সময় লিখতে হয়। ট্র্যাজেডি কিজানিস, যারা এস্টাব্লিশমেন্টের বাইরে থাকে, তাদের আসলে মনে মনে ইচ্ছে করে ওর মধ্যে ঢুকব, কবে বড় কাগজে সুযোগ পাব, তাদের গালাগালি হচ্ছে কংস রূপে ভজনা, আর যারা এস্টাব্লিশমেন্টের মধ্যে ঢুকে যায় তাদের মধ্যেও একটা অস্থির ছটফটানি থাকে, তারাও ভাবে, বন্দি হয়ে গেলুম? এর থেকে বেরুতে পারব না? ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক, সারা জীবন অনবরত লিখেই যেতে হবে? যে-ভাষার জন্য এত মায়া ছিল, সেই ভাষাও ক্ষয়ে যায়, ঠিক আয়ুর মতো।
এটাই তো স্বাভাবিক।
কী স্বাভাবিক?
যদি আয়ুর টার্মসে ভাবিস!
ঠিক বলে বোঝাতে পারব না, এক ধরনের কষ্ট…মনে হয়, এ পর্যন্ত যা কিছু করেছি সবই ব্যর্থ।
একটু একটু ঘুম এসে যাচ্ছে পরিমলের। কিন্তু সে ঘুমোবে না। জ্বরের পর ভাত-ঘুম ভাল নয়। সে অরুণাংশুর আত্মগ্লানির প্রশ্রয় দিতে লাগল। অরুণাংশুও এ-সব কথা কোনও দিনই মুখে বলে না, আজ বলছে যখন বলুক। মন থেকে বেরিয়ে যাক, সেটাই ভাল হবে।
ছেলে-মেয়েদের পড়বার ঘরে খাটে কাত হয়ে শুয়ে আছে অরুণাংশু, সে বসে আছে চেয়ারে। এর মধ্যে তিনটে সিগারেট খাওয়া হয়েছে খুবই দোনা-মোনা ভাবে। জানলা দিয়ে দেখতে পেল বাগানের গেট খুলে ভেতরে ঢুকছে সাধুচরণ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সাধুচরণ ঠিক চোরের মতো মুখের ভাব করে বলল, নমস্কার মাস্টারমশাই। অন্য চেয়ারটি ঠেলে দিয়ে পরিমল গম্ভীর গলায় বলল, বসো।
বসল না, চেয়ারের পেছন দিকটা ধরে দাঁড়িয়েই রইল সাধুচরণ। কথার মাঝখানে অন্য একটি লোকে এসে পড়ায় অরুণাংশু বিরক্ত হয়েছে।
পরিমল বলল, এর নাম সাধুচরণ পণ্ডা। এর স্বাস্থ্যটি দেখেছিস?
অরুণাংশু বলল, এ-দিককার লোকের স্বাস্থ্য তেমন খারাপ নয়। আমি পুরুলিয়া বাঁকুড়া গিয়ে দেখেছি গ্রামের মানুষ সবারই যেন রোগাটে ক্ষয়টে চেহারা।
সত্যেন দত্ত যে-বাঙালিদের কথা লিখেছেন, এখানকার লোকদের সম্পর্কেই তা বেশি বেশি করে খাটে। এদের সত্যিই বাঘ কুমির আর সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়।
কুমির কোথায় এখন? কুমির আর বিশেষ নেই।
কুমিরের জায়গা নিয়েছে দারিদ্র্য। আগে এ-দিকে এত দারিদ্র ছিল না। এই যে এর এক বন্ধুকেই তো ক’দিন আগে বাঘে নিয়ে গেছে।
সাধুচরণ এক মনে নিজের পায়ের নখ দেখছে।
বসো সাধু। দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
আপনি আমাকে ডেকেছিলেন মাস্টারমশাই?
মনোরঞ্জনকে কী করে বাঘে ধরল, আমাকে বুঝিয়ে দাও তো? সত্যি করে বলো। কোন জঙ্গলে কাঠ কাঠতে গিয়েছিলে তোমরা?
এই জন্যই তো সাধুচরণ আসতে চায় না মাস্টারমশাইয়ের কাছে। সবাই জানে মিথ্যে কথা বলার সময় সাধুচরণের চোখের পাতা কাঁপে না। কিন্তু এই মানুষটির কাছে এলেই তার কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। কিন্তু এই ব্যাপারে চোখের পাতা কাঁপালে কিছুতেই চলবে না। আকবর মণ্ডলের কাছ থেকে পারমিট সে জোগাড় করেছিল নিজের দায়িত্বে। সাত নম্বর ব্লকের কথা জানাজানি হলে আকবর মণ্ডল বিপদের পড়বে, তখন সে সাধুচরণকেও ছাড়বে না।
কথাটা ঘুরিয়ে সে উত্তর দিল, ফরেস্টের বড়বাবুকে সেখানে নিয়ে গিসলাম, তিনি নিজের চোখে দেখে রিপোর্ট দিয়েছেন।
কী হয়েছিল, গোড়া থেকে আমাকে বলো তো!
একটু থেমে থেমে, সাহিত্যিকদের চেয়েও সতর্কভাবে শব্দ নির্বাচন করে সাধুচরণ পুরো ঘটনাটির বিবরণ দিল আবার। তারপর সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কোনও জায়গায় ভুল করেনি।
পরিমলের সঙ্গে অরুণাংশুও আংশিক মনোযোগ দিয়ে ঘটনাটা শুনল। বাঘের গল্পে খানিকটা রোমাঞ্চ থাকেই, শুনতে শুনতে মনের মধ্যেকার শিশুটি জেগে ওঠে।
অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে পরিমল বলল, এর গল্পের কতখানি মিথ্যে বল তো? ঠিক পঞ্চাশ ভাগ!
সাধুচরণ চমকে মুখ তুলতেই পরিমল বলল, তোমরা যে কোর-এরিয়ার মধ্যে গিয়েছিলে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তবে ওই সত্যি কথাটা আর কারুর কাছে বোলো না। আমার কাছে যে-ভাবে মিথ্যে গল্পটি চালালে, অন্যদের কাছেও ঠিক সেইভাবেই বলবে। দলের লোকদেরও বলে রাখবে, যেন ফাঁস করে না দেয়।
এতক্ষণ বাদে সত্যিকারের আশ্বস্ত হল সাধুচরণ।
মনোরঞ্জন খাঁড়া…ছেলেটিকে দেখেছি আমি নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ। মাস্টারমশাই, আপনি অনেকবার দেখেছেন। কো-অপ থেকে জিনিসপত্তর ধার নেবার জন্য ওই তো আপনার কাছে হাঁটাহাঁটি করেছিল।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো। আমি ওকে ভাল রকম চিনি। জ্বরের জন্য মাথাটা গোলমাল হয়ে গেছে, বেশ তেজি ছিল ছেলেটা।
ও এমন ভাবে চলে গেল…এটা ভগবানের অন্যায়..বাড়িতে নতুন বিয়ে করা বউ…।
পরিমল সস্নেহে তার বাহু ছুঁয়ে বলল, এই লোকটি গত বছর ধান কাটার সময় একটি জমিতে লাঠি হাতে নেমেছিল। নিজের জমি নয়, এক গরিব চাষির জমি, ও সাহায্য করতে গিয়েছিল নিঃস্বার্থ ভাবে। সেজন্য জেল গেছে। জেল থেকে ফেরার পর আমি বলেছিলাম ওকে একটা কাজ দেব। আমাদের স্কুলে এক জন দফতরি লাগবে। কিন্তু গভর্নিং কমিটির মিটিং না হলে তো–।
অরুণাংশু বলল, এ-রকম একটা লোক ইস্কুলের দফতরি হবে, দ্যাটস এ পিটি।
তাহলে ওর দ্বারা আর কী করা সম্ভব? ওর নিজস্ব জমিও বিশেষ নেই।
অন্য দেশ হলে এ-রকম ভাল চেহারার মানুষ কুস্তিগির কিংবা বক্সার হত। ট্রেনিং পেলে খেলা থেকেও কত টাকা রোজগার করা যায়।
ও-সব আকাশকুসুম। এই সব ভূমিহীন লোকেরা সারা বছরই থাকে দৈনিক জন খাটার আশায়। বছরে কয়েক মাস কোনও কাজই পায় না। প্রত্যেক দিনের খাদ্য সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হলে তারপর এদের অন্য কাজে লাগানো যায়। সেই জন্যই ভেবেছিলুম ইস্কুলের দফতরির চাকরিটা দিয়ে ওকে কো অপারেটিভের কাজে মাতিয়ে তুলব। কিন্তু আমি জানি, চাকরিটা দিলেও ও রাখতে পারবে না, দু-এক মাস বাদে পালিয়ে যাবে।
না, কাজ ছাড়ব কেন মাস্টারমশাই!
হ্যাঁ ছাড়বে আমি জানি। বুঝলি অরুণাংশু, এটাই ওদের নেশা। এই নদী, এই জঙ্গল এদের টানে, সেই জন্য বার বার এরা বিপদের মুখে যায়। এখন জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাবার কোনও দরকার ছিল না, আর দুমাস অপেক্ষা করলেই ও চাকরি পেত, কিন্তু ও নিজেই অন্য ছেলেগুলোকে তাতিয়ে বাঘের মুখে নিয়ে গেছে। কী সাধু, অস্বীকার করতে পারবে?
সাধুচরণের মুখে একটা অদ্ভুত ফ্যাকাসে ধরনের হাসি ফুটে উঠল। এবার সে মাস্টারমশাইয়ের কাছে সত্যি কথা বলবে। যত গরিবই হোক, তবু প্রত্যেক মানুষের ভেতরে খুব একটা অহঙ্কার আছে। নিজের অভাবের কথা অন্যকে জানাতে চায় না, যখন জানাতে বাধ্য হয়, তখন ওই রকম হাসি লেগে থাকে সেই মানুষের ঠোঁটে।
মাস্টারমশাই, কিছুতেই আমার খিদে মেটে না, রোজ যা খাই সব সময় তবু পেটে খিদে খিদে থাকে! আমি একটু বেশি ভাত খাই, কিন্তু অত ভাত দেবে কে? কার্তিক-অঘ্রাণ মাস থেকেই বুঝলেন মাস্টারমশাই, আপনি তো জানেন, ভাতে টান পড়ে যায়, বউটা তো কম খেয়েই থাকে, ছেলে-মেয়ে দুটো ঘ্যান ঘ্যান করে, তাদের না দিয়ে আমি নিজে খাই কী করে? বর্ষা নামল না। জমির কাজ নেই, আর দুটো মাস বসে থাকা…। তাই ভাবলুম, জঙ্গলে যদি একটা খেপ মেরে আসি।
কথা বলতে বলতে মাঝখানে থেকে সে উদাস হয়ে যায়। ঠিকমতো ভাষা খুঁজে পায় না। হঠাৎ সে পিতা হয়ে গিয়ে নিজের ছেলে মেয়েদের কথা ভাবে।
পরিমল আবিষ্ট ভাবে তাকাল অরুণাংশুর দিকে। ভাবখানা এই, শুনছিস তো। একটু আগে তোর নিজের দুঃখের কথা বলছিলি, এই দেখ, সত্যিকারের দুঃখ কাকে বলে!
মাস্টারমশাই, আমাকে যদি বাঘে ধরত, তাতেও আমার কোনও দুঃখ ছিল না, খিদে সহ্য করার চেয়ে…। কিন্তু মনোরঞ্জন, ওকে আমরা সঙ্গে নিতে চাইনি, নিয়তি ওকে টেনেছে। তবে ওরও ঘরে ভাতের টান পড়েছিল।
যাকগে, মনোরঞ্জন গেছে…। এখন তার বাড়ির কী অবস্থা?
ওই যেমন হয়। আপনাকে তার বেশি কী বলব, আপনি তো সবই জানেন…।
মনোরঞ্জনের স্ত্রী চলে গেল, তাকে তোমরা আটকাতে পারলে না? এখনও শান্তি-স্বস্ত্যয়ন হল না।
সাধুচরণ চমকে উঠে বলল, সে আপনার এখানে নেই?
ছিল তো, তারপর তার বাবা-কাকা এসে নিয়ে গেল জোর করে।
নিয়ে গেল? আপনি যেতে দিলেন?
আমার তো তখন অসুখ…। তা তার বাবা-কাকা নিতে চাইলে আমরা আটকাবার কে? তোমাদের গ্রামের বউ, স্বামী মরতে না মরতেই…।
কী করব, মনার মা যে বড় চেঁচামেচি শুরু করল। এমন করতে লাগল যে বাড়িতে কাক-চিল পর্যন্ত তিষ্ঠোতে পারে না।
ঠিক আছে, আমার পায়ে একটু জোর আসুক, তারপর আমি গিয়ে এমন ওষুধ দেব যে, দেখবে তক্ষুনি মনোরঞ্জনের মায়ের চেঁচানি বন্ধ হয়ে যাবে।
সাধুচরণ এতক্ষণ বাদে খেয়াল করল যে, কয়েক দিনের অসুখেই পরিমল মাস্টার বেশ রোগা হয়ে গেছেন। দাড়িও কামাননি।
ও শুয়োরর বাচ্চারা কী বোঝে?
সাধুচরণ এবং পরিমল দুজনেই চমকে তাকাল অরুণাংশুর দিকে। ওঁদের দুজনের কথার মাঝখানে অরুণাংশুর এই চিৎকার এমনই অপ্রাসঙ্গিক যে ওঁরা বিমূঢ় হয়ে যায়। অরুণাংশু তাকিয়ে আছেন দেয়ালের দিকে। ওঁরা কী করে বুঝবে যে অরুণাংশুর এই হুঙ্কার তার অনুপস্থিত সমালোচকদের উদ্দেশে।
অরুণাংশু উঠে বসে আবার বলল, ওরা কি জানে, এখনও আমি কত কষ্ট করি! এক-একটা লেখার জন্য দিনের পর দিন ছটফট করতে হয়, আমি কাঁদি, আমার মনগড়া চরিত্রগুলোর জন্য আমার যে কী সাংঘাতিক অবস্থা হয়। লোকেরা অন্য কথা বলে, আমার মাথায় কিছু ঢোকেনা। কেউ বুঝবে না, আমার কষ্ট কেউ বুঝবে না।
সাধুচরণ হাঁ করে অরুণাংশুর কথা শুনছে, কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার।
অরুণাংশুর বৈরাগ্য তিন দিন স্থায়ী হল। মাঠে হাল ধরা কিংবা খাল কাটার জন্য কোদাল ধরার সম্পর্কে চিন্তা ত্যাগ করে সে আবার শহরের কাছে আত্মসমর্পণ করবার জন্য ছুটল। ফেরার পথে গোসাবায় এক পরিচিত এসডিপিও-র সঙ্গে দেখা। ইনি পুলিশ হলেও সাহিত্য-রসিক, অরুণাংশুর এক বন্ধুর বন্ধু, সেই সুবাদে অরুণাংশুকে খাতির করে তুলে নিলেন নিজের লঞ্চে।
তারপর চলল খানাপিনা। আবার সারা দিন ধরে নেশা, লোকজনকে ধমক ও গান। আত্মবিস্মৃতির যতগুলি উপায় আছে কোনওটাইঅরুণাংশু বাদ দিল না। ক্যানিং এনা গিয়ে ফের চলে গেল নামখানায়। সেখান থেকে রায়দিঘি। সেখানেও এক পরিচিত সরকারি অফিসার থাকেন, তার কোয়ার্টারে কাটল দুদিন।
কলকাতায় ফিরে, এই কয়েকদিনে যা টাকা-পয়সা খরচ হয়েছে সেটা তোলবার জন্য সে খবরের কাগজের জন্য একটা লেখা তৈরি করে ফেলল চটপট।
খবরের কাগজে একটা যা হোক কিছু লিখলেই তাকে শ’দুয়েক টাকা দেয়। সব সময়ই অরুণাংশুর আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। যত খরচ বাড়ে, ততই বেশি লিখতে হয় রোজগারের জন্য। বেশি লিখতে লিখতে ধরে যায় বিরক্তি। তখন সেই বিরক্তি কাটাবার জন্য বাইরে যাওয়া, তার জন্য আবার খরচ।
কী লিখি, কী লিখি, ভেবে অল্পক্ষণ মাথা চুলকোতেই একটি চমৎকার বিষয়বস্তু মনে পড়ে গেল। বাঘের মুখে নিহত এক ব্যক্তির সদ্য বিধবা পত্নীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। পুরো লেখাটির জন্য রইল সত্য ঘটনার উত্তাপ।
বাসনার সঙ্গে অরুণাংশু একটি কথাও বলেননি। এমনকী চোখের দেখাও হয়নি। তবু এই কাল্পনিক সাক্ষাৎকারটি এমনই মর্মস্পর্শী হল যে পাঠক-পাঠিকার চিঠি এল ষাট-সত্তরটা। কয়েক জন সরকারি অফিসার সেই লেখাটি এক জন মন্ত্রীর নজরে আনলেন। মন্ত্রীর তো পড়বার সময় নেই। বিষয়বস্তুটি জেনে নিলেন এবং নির্দেশ দিলেন একটি ফাইল খোলার জন্য। নাজনেখালির মনোরঞ্জন খাঁড়া মহাকরণের নথিপত্রে অমর হল।