মাসাইদের পুরো গ্রাম
মাসাইদের পুরো গ্রামটাই গোল করে উঁচু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যে ছোট-ছোট আলাদা কুঁড়ে ঘর। একটি মাত্র ছোট দরজা দিয়ে সেই গ্রামে ঢোকা যায়। লম্বা মাচার ওপরে পালা করে পুরুষেরা পাহারা দেয় সারা রাত। রাতের অন্ধকারে কোনও হিংস্ৰ জন্তু-জানোয়ারের এখানে ঢুকে পড়ার উপায় নেই।
গ্রামের মধ্যে একটা বড় চালাঘরে রয়েছে অনেকগুলো গোরু আর মোষ আর ভেড়া। পশুপালনই এখন এদের জীবিকা। প্রত্যেকটি মাসাই-পুরুষই ছফুটের কাছাকাছি লম্বা, শরীর যেন ইস্পাত দিয়ে গড়া, হাতে সবসময় থাকে বশ। মাসাই মেয়েরাও কম লম্বা নয়, তারাও যুদ্ধ করতে জানে। মাসাইরা আফ্রিকার অন্য সব জাতের তুলনায় আলাদা।
এক দল মাসাইপুরুষ সন্ধেবেলা গ্রামে ফিরছিল। আস্তে-আস্তে দৌড়বার সময় ওরা মাথা নিচু করে নাচের ভঙ্গিতে এগোয় আর গলা দিয়ে নানারকম পশু-পাখির ডাকের অনুকরণ করে। সন্তু আর কাকাবাবুকে দেখতে পেয়ে ওরা তাদের কাঁধে করে তুলে এনে গ্রামের ঠিক মাঝখানে ফেলল, দুজনে ওদের বুকে পা দিয়ে চেপে ধরে বর্শা তুলে রাখল। কয়েকজন গেল সর্দারকে ডাকতে।
সেখানেই দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে একটা পাথর-ঘেরা জায়গায়। সেই আগুনের চার পাশে গোল হয়ে বসে আছে গ্রামের সব নারী-পুরুষ। একটা ভেড়া ঝলসানো হচ্ছে আগুনে।
সর্দার এসে বসল। একটা কাঠের গুড়িতে, ঠিক রাজাদের মতন একটা পা সামনের দিকে বাড়িয়ে, একটু বুকে। তার বয়স খুব বেশি নয়, বড়জোর বছর চল্লিশ। নাকটা বেশ টিকোলো, গায়ের রং কালো হলেও খসখসে ধরনের নয়, চকচকে, তার মাথার চুল নানা রঙের পুতির মালা দিয়ে বাঁধা, তার গলাতেও অনেকগুলো পাথরের মালা।
সন্তু আর কাকাবাবুর দিকে এক পলক মাত্র দেখল সে, মনোযোগ দিল না। যে-লোকগুলো ওদের নিয়ে এসেছে, তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে সর্দার কী যেন চাইল। সেই লোকগুলো সবাই একসঙ্গে কী যেন উত্তর দিল।
সর্দার আবার কী জিজ্ঞেস করল, লোকগুলো উত্তর দিল একই রকম। এইভাবে কয়েক মিনিট উত্তর-প্রত্যুত্তর চলল। তারপর সর্দার যেন খুব অবাক হল। কাঠের গুড়ির আসন থেকে উঠে এসে সে কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টি।
কাকাবাবু ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ইংরেজি বোঝে? তা হলে আমাকে উঠে বসতে দাও। আমি সব কথা খুলে বলছি।
সর্দার কাকাবাবুর কথা একবৰ্ণও বুঝল না। সে এবার কী যেন জিজ্ঞেস করল নিজের ভাষায়, কাকাবাবুও তা বুঝলেন না একটুও।
যে লোক দুটি সন্তু ও কাকাবাবুর বুকের ওপর পা চেপে রেখেছিল, সদারের হুকুমে সরে গেল তারা। তারপর সর্দার হাততালি দিয়ে অন্যদের কী যেন একটা হুকুম করল।
কাকাবাবুর মাথার কাছে যদিও এখনও একজন বর্শা তুলে আছে, তবু সেটা অগ্ৰাহ্য করে কাকাবাবু বললেন, ওয়াটার। জল না খেলে আমরা মরে যাব। একটু জল দাও!
হাতের ইঙ্গিতে তিনি জল খাওয়া বোঝালেন।
সর্দার দুদিকে হাত নেড়ে বোঝাল, না, এখন জল দেওয়া হবে না। কাকাবাবু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের মধ্যে কি কেউ একটুও ইংরেজি জানো না?
দুজন লোক হাত ধরে-ধরে একজন বৃদ্ধকে নিয়ে এল সেখানে। বৃদ্ধটির গায়ে একটা টকটকে লাল রঙের চাদর। মাথার চুল বেশ পাকা। চোখ দুটি দেখলে মনে হয়, লোকটি খুব অসুস্থ। কিন্তু তার মুখে বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে।
সেই বৃদ্ধটি কাকাবাবুর পাশে এসে বসতেই সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল। সদার হাত তুলে অন্যদের থামিয়ে নিজে কিছু বলল।
বৃদ্ধটি কাকাবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টি। প্রায় দু-তিন মিনিট। তারপর আস্তে আস্তে, পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, এরা জানতে চাইছে, তোমাদের সঙ্গের অস্ত্রশস্ত্র কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
কাকাবাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি ইংরেজি জানো! হে মাননীয় বৃদ্ধ, আমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। বন্দুক-পিস্তল তো দূরের কথা, সামান্য একটা ছুরিও ছিল না।
বৃদ্ধ বলল, আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করি না। তোমার সঙ্গে এই একটা বাচ্চা ছেলে রয়েছে, আর বাকি লোকজনরা কোথায়?
কাকাবাবু বললেন, আমাদের সঙ্গে আর কেউ ছিল না। আমরা দুজন এই মাঠে-জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছি। তোমাদের লোকজন ঠিক সময়ে না গিয়ে পড়লে আমরা মরেই যেতম।
বৃদ্ধ বলল, আমরা তোমাদের কথা বিশ্বাস করি না। তোমরা, সভ্য লোকরা, নানারকম মিথ্যে কথা বলতে পারো।
কাকাবাবু বললেন, মাননীয় বৃদ্ধ, দয়া করে একটু জল দিতে বলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জল না পেলে কোনও কথা বলতে পারছি না। আমার কথা বিশ্বাস করো। আমরা তোমাদের শত্ৰু নই, বিপদে পড়ে তোমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছি।
বৃদ্ধ অন্যদিকে ফিরে বলল আগুনটা বাড়িয়ে দিতে। দু-তিনজন লোক আধপোড়া কাঠগুলো ঠেলে দিতে আগুনটা আবার জোর হয়ে গেল।
বৃদ্ধ বুকে পড়ে কাকাবাবুর মুখের একেবারে কাছে নিজের মুখটা নিয়ে এল, চোখের একটাও পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। চাদরের তলা থেকে একটা হাত বার করে জ্বর দেখার মতন কাকাবাবুর কপালে হাত রাখল, তোমাদের শাস্তি হল মৃত্যু!
কাকাবাবুও চোখের পলক না ফেলে বললেন, মাসাইরা বীরের জাতি বলে খ্যাতি শুনেছিলাম। আমাদের মতন দুজন নিরস্ত্ৰ মানুষকে মেরে যদি তোমাদের খ্যাতি আরও বাড়ে, তা হলে মারো! তোমার লোকজন প্ৰথমে আমাদের দেখতে পায়নি আমরাই আগুন জ্বালিয়ে ওদের ডেকেছি। কেউ আশ্রয় চাইলেও বুঝি তোমরা তাদের মেরে ফ্যালো?
বৃদ্ধটি খুব জোরে হেসে উঠল। তারপর পাশের একজন লোককে কী যেন একটা হুকুম করল। সদরের দিকে ফিরে অনেক কিছু বলল। সর্দারের মুখেও হাসি দেখা দিল এবার।
বৃদ্ধটি আবার কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, শোনো হে অতিথি, মাসাই কখনও নরহত্যা করে না। মাসাই কখনও নিরস্ত্ৰ লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করে না। মাসাই কখনও আশ্রিতকে অবিশ্বাস করে না। মাসাই কখনও কারও কাছে জলপান করতে চেয়ে তারপর তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। কিন্তু তোমরা যারা লেখাপড়া শেখো, যারা সভ্যতার বড়াই করো, তারা এর প্রত্যেকটা জিনিস করো! তোমরা যখন-তখন মানুষ মারো, তোমরা নিরস্ত্ৰ লোককেও আক্রমণ করো, কাউকে আশ্রয় দিয়েও তাকে ঠকাও…ঠিক কি না?
কাকাবাবু একটু থতমত খেয়ে গেলেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ, এর অনেকটা সত্যি। কিন্তু সব সভ্য মানুষই সমান নয়! লেখাপড়া শিখলেও অনেকে সৎ থাকতে পারে।
একজন লোক একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে খানিকটা কী যেন তরল পদার্থ নিয়ে এল। সেটার রং লাল। দুধের মতন ঘন।
বৃদ্ধ বলল, এটা খেয়ে নাও আগে, তারপর তোমার সব কথা শুনব।
কাকাবাবু বাটিটা সন্তুর দিকে এগিয়ে দিলেন।
বৃদ্ধ বলল, তোমরা দুজনেই খাও।
কাকাবাবু তরল পদার্থটিতে একটু চুমুক দিয়েই মুখটা তুলে বললেন, আমরা শুধু একটু জল চেয়েছিলাম।
বৃদ্ধটি হুকুমের সুরে বলল, আগে ওটা খেয়ে নাও এক চুমুকে। তাতে শরীরে জোর পাবে।
কাকাবাবু সন্তুকে ফিসফিস করে বললেন, এরা দুধের মধ্যে কোনও না কোনও পশুর রক্ত মিশিয়ে খায়। তোর একটু খেতে খারাপ লাগলেও এক চুমুকে যতটা পারিস খেয়ে নে, নইলে এরা অপমানিত বোধ করবে।
সন্তু বিশেষ আপত্তি করল না। তেষ্টায় তার গলা ফেটে যাচ্ছে যেন। চোঁচো করে সে অনেকখানি রক্ত-মেশানো দুধ খেয়ে ফেলল। কাকাবাবু বাকিটা শেষ করে দিয়ে বললেন, এবারে কি আমরা খানিকটা জল পেতে পারি?
বৃদ্ধটি বলল, পাবে। তার আগে তোমার কাহিনীটা শুনি। তোমরা কে? কোথা থেকে এসেছ? তোমাদের মতন দুজন সভ্য মানুষকে এ-রকম নিরস্ত্ৰ অবস্থায় এই দিকে কোনওদিন ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়নি, তাই আমাদের লোকজন খুব অবাক হয়েছে।
কাকাবাবু সংক্ষেপে তাঁদের ঘটনোটা বললেন।
বৃদ্ধটি আবার পেছন ফিরে ওদের ভাষায় সবাইকে সেই কাহিনী শোনাল। সবাই দারুণ কৌতূহল নিয়ে শুনল। তারপর সর্দার উঠে দাঁড়িয়ে কী একটা হুকুম করতেই দুজন লোক এসে কাকাবাবুর দুহাত চেপে ধরে দাঁড় করাল। সদার এগিয়ে এসে কাকাবাবুর খোঁড়া পাটা তুলে হাত ঝুলিয়ে দেখল।
তারপর সর্দার প্রথমে অন্যদের দিকে ফিরে একটা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে কী একটা দুবোধ চিৎকার করল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই সে আবার ফিরে নিজের কপালটা ঠুকে দিল কাকাবাবুর কপালে।
এর পর যেন একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। দুজন নিয়ে এল দুবাটি জল। দুটি মেয়ে দিল দুবাটি ছাতুর মতন খাবার। একজন ঝলসানো ভেড়ার মাংস থেকে অনেকটা কেটে এনে রাখল। কাকাবাবুর পায়ের কাছে। একজন কাকাবাবুর গলায় পরিয়ে দিল একটা পাথরের মালা।
বৃদ্ধটি হেসে বলল, তুমি খোঁড়া পায়ে এত বিপদের মধ্যেও এতখানি পথ পার হয়ে এসেছ শুনে এরা তোমাকে বীর হিসেবে স্বীকার করছে। মাসাইরা বীরের সম্মান দিতে জানে।
কাকাবাবু অভিভূত হয়ে গিয়ে হাত জোড় করে বললেন, আমাকে এরকম সম্মান আগে কখনও কেউ জানায়নি। আজ আমি ধন্য হয়ে গেছি। আপনাদের সবাইকে নমস্কার জানাচ্ছি।
সর্দার বৃদ্ধকে আবার কিছু একটা কথা মনে করিয়ে দিতেই বৃদ্ধটি কাকাবাবুকে বলল, তোমরা আগে একটু খাবার খেয়ে নাও, তারপর তোমাদের কয়েকটা জিনিস দেখাব?
কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, একটু একটু খেয়ে নে। আজ সারাদিন যা ধকল গেছে, হঠাৎ বেশি খাবার খেলে বমি এসে যাবে।
সন্তু বলল, আমার আর খেতে ইচ্ছে করছে না। ওই দুধ খেয়েই খিদে চলে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, তবু একটু করে সবই মুখে দে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আমরা এখান থেকে ফিরব কী করে? এ জায়গাটা কোথায়? আমাদের হোটেল থেকে কতদূর?
দাঁড়া, সব জানা যাবে। আস্তে আস্তে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বৃদ্ধ লোকটি খুবই বুদ্ধিমান। সন্তুর কথা সে এক বিন্দু বুঝতে না পারলেও বোধহয় আন্দাজ করে নিল, সন্তু কী বলতে চায়। খানিকটা মজা করবার জন্যই যেন সে এবার সন্তুকে বলল, তোমরা যখন আমাদের মধ্যে এসে পড়েছই, এখন এখানেই থেকে যেতে হবে। সারাজীবন। থাকতে পারবে না? আমাদের খাবার তোমার পছন্দ হয়নি?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, এখানে থাকতে আমাদের ভালই লাগবে। কিন্তু তার আগে হোটেলের ম্যানেজার ফিলিপকে শান্তি দিতে চাই। সেইজন্য একবার অন্তত ফিরে যেতে হবে।
বৃদ্ধটি বলল, বাঃ, তোমারও তো বেশ তেজ আছে দেখছি। তা তুমি ওই ম্যানেজারকে কী শাস্তি দেবে ঠিক করে রেখেছ?
ওর ফাঁসি হওয়া উচিত!
ফাঁসির চেয়েও ভাল শাস্তি আছে। ধরো, যদি ওকে দিয়ে একেবারে সারাজীবন গোরুর গোবর পরিষ্কার করার কাজে লাগানো যায়, তা হলে কেমন হয়। আমরা হলে তাই করতাম!
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আপনি কোথায় কী দেখাবেন বলছিলেন?
বৃদ্ধটিও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি নিজে হাঁটতে পারি না, আমাকে ধরে নিয়ে যেতে হয়। আমি খুব অসুস্থ, বেশিদিন বাঁচব না। এই দেখুন!
বৃদ্ধটি গা থেকে লাল রঙের কাপড়টা খুলতেই দেখা গেল, তার বুকের ডান দিকে একটা মস্ত বড় ঘা। দগদগ করছে।
আবার কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে দুদিকে দুহাত ছড়াতেই দুজন লোক তাকে ধরে-ধরে নিয়ে চলল। আর একজন সঙ্গে নিয়ে চলল। একটা মশাল।
প্রথমে ঢোকা হল একটা কুঁড়েঘরে। মশালের আলোয় দেখা গেল, সেখানে বেশ কয়েকটা বড় বড় হাতির দাঁত ও অনেক রকম জন্তুর চামড়া পড়ে আছে। আর-এক পাশে রয়েছে তিনটে রাইফেল, দুটো রিভলভার ও দুটো লাইট মেশিনগান। কয়েকটা বেল্ট ভর্তি টোটা।
বৃদ্ধ বলল, এইসব জন্তুগুলো আমরা মারিনি। মেরেছে। শহরের লোকেরা। আমরা আজকাল পশুপালন করি, পশুহত্যা করি না। তবু আমাদের নামে দোষ পড়ে। সরকারের লোক আমাদের ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। যে-সব অস্ত্ৰ দিয়ে ওদের মারা হয়েছে সেগুলোও দ্যাখো।
কাকাবাবু অবাকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা ওই অস্ত্রগুলো পেলেন
কোথা থেকে?
সভ্য লোকদের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমরা ব্যবহার করি না। তা বলে ভেবো না যে, আমরা ব্যবহার করতে জানি না। আমি নিজে মাউমাউ
বৃদ্ধ একটা এল. এম. জি. তুলে নিয়ে বাগিয়ে ধরল, ট্রিগার টিপল, গুলি ভরা নেই, তাই শুধু খট্-খট্ শব্দ হল কয়েকবার। বৃদ্ধ সেটি অবহেলার সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দিল আবার!
এরপর আসা হল বড় চালাঘরটিতে। সেটি আসলে একটি বৃহৎ গোয়ালঘর। সেখানে রয়েছে গোটা-পঞ্চাশেক গোরু, শখানেক ভেড়া ও গোটা-চারেক জেব্ৰা।
বৃদ্ধ বলল, এইসব পশু আমাদের নিজস্ব। এগুলোর ওপর নির্ভর করেই আমরা বেঁচে আছি। এক জায়গার ঘাস ফুরিয়ে গেলে আমরা সেখান থেকে গ্রাম তুলে নিয়ে আবার যেখানে ঘাস আছে সেখানে চলে যাই।
গোরুগুলোর স্বাস্থ্য চমৎকার। আমাদের হরিয়ানার গোরুকেও হার মানায়।
এইসব গোরুরই দুধ আর রক্ত একসঙ্গে আমরা খাই। তাতে গায়ে জোর হয়। এসো হে বিদেশি, তোমাদের আর দুটি বিচিত্র পশু দেখাই!
গোয়ালঘরের খানিকটা ভেতরে ঢুকে এক জায়গায় মশালের আলো ফেলতেই কাকাবাবু আর সন্তু দারুণ চমকে উঠল। দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, এ কী!
দুটো খুঁটির সঙ্গে হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা দুজন মানুষ। তাদের পরনে শুধু নেংটি, খালি গা, সম্পূর্ণ কাদামাটি মাখা, চুল জট-পাকানো, তবু বোঝা যায় ওরা দুজন শ্বেতাঙ্গ সাহেব।
সন্তু অস্ফুট স্বরে বলল, সেই দুজন জার্মান টুরিস্ট!
কাকাবাবু বললেন, টুরিস্ট নয়, মার্সিনারি। ভাড়াটে সৈনিক। টাকার বিনিময়ে মানুষ মারত।
বৃদ্ধ বলল, এদের দুজনকে তোমাদের ওই লিট্ল ভাইসরয় হোটেল থেকে ভাড়া করা হয়েছিল গোপনে এখানে জন্তু-জানোয়ার মারার জন্য। এল. এম. জি. দিয়ে হাতি-গণ্ডার-হরিণ-লেপার্ড কিছুই মারতে বাকি রাখত না। দাঁত, শিং, চামড়ার জন্য। দোষ হত আমাদের। সেইজন্যই ওদের এখানে ধরে রেখেছি।
বুলি এদের খোঁজ পানি পুলিশ তো এদের অনেক খোঁজাখুঁজ করেছে।
না। কোনও পুলিশ বা সরকারি লোক, গত ছমাসের মধ্যে আমাদের এখানে আসেনি। আমরা ওদের দিয়ে এই গোয়ালঘর পরিষ্কার করাই রোজ। এর মধ্যে তিনবার ওরা পালাবার চেষ্টা করেছিল, তিনবারই ধরা পড়েছে। আমাদের জোয়ান ছেলেদের চোখ এড়ানো খুব শক্ত!
একটু থেমে, একটু হেসে বৃদ্ধ আবার বলল, সাহেব জাতি আমাদের এখান থেকে লক্ষ লক্ষ লোক ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস বানিয়েছে। তাই না? এখন আমরা যদি দুচারটে সাহেবকে ক্রীতদাস করে রাখি, সেটা কি অন্যায়, বলো?
না, মোটেই না!
মাসের পর মাস এই জার্মান দুটি বোধহয় সন্ধের পর আলো দ্যাখেনি। মশালের আলো দেখে গোরুগুলো যেমন ছটফট করতে লাগল, সেইরকম। ওই মানুষ দুজনও চোখ পিটপিট করতে লাগল। একজন কাকাবাবুর দিকে কোনওরকমে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল, হেলপ! ইউ প্লিজ হেলপ আসি
কাকাবাবু কঠোরভাবে বললেন, দুঃখিত, আমি তোমাদের কোনও সাহায্য করতে পারব না। তোমরা এই সহৃদয় বৃদ্ধটির কাছে ক্ষমা চাইতে পারো। দয়া চাইতে পারো।
মাসাই বৃদ্ধটি বলল, তা হলে শোনো! এই দুজন শ্বেতাঙ্গ যখন এখানে বহু পশু হত্যা করছিল, তখন আমি ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে থামাতে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল আমার বড় ছেলে, সে তখন মাসাই দলটির সর্দার। আমরা দুজন এদের সঙ্গে কথা বলতে যেতেই এরা আমাদের ওপর গুলি চালাল। মানুষ বলে আমাদের গ্রাহ্য করল না। ওদের চোখে আফ্রিকার কালো মানুষ আর পশু যেন সমান। আমার বড় ছেলে সঙ্গে-সঙ্গে মারা যায়, আমি তখন মরিনি, কিন্তু আমার বুকের মধ্যে গুলি রয়ে গেছে, সেই ক্ষততেই আমি মরব। তার পরেও দ্যাখো, এদের দুজনকে বন্দী করার পর আমরা সঙ্গে-সঙ্গে খুন করিনি। তারপরেও কি তোমরা বলবে, মাসাইরা নিষ্ঠুর?
বৃদ্ধের কথা শুনে জার্মান দুজন চোখ বুজে পাশ ফিরেছে। কাকাবাবু সেই বৃদ্ধের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনিই প্রকৃত দয়ালু। এতটা ক্ষমাশীল আমরা কেউ হতে পারতাম না!
সন্তু বলল, আমি কি বাইরে যেতে পারি? আমি আর ওদের দেখতে চাই क्रा!
আপনি জানেন নিশ্চয়ই, নির্বিচারে পশুহত্যা এখনও চলেছে। আপনি দুজন খুনিকে বন্দী করেছেন, ওরা আরও এরকম লোক ভাড়া করবে। এই সব বন্ধ করার জন্য আমাদের একবার ফিরে যাওয়া দরকার।
বৃদ্ধ হেসে বলল, অফ কোর্স। তোমরা কি ভেবেছ, তোমাদের এখানে আটকে রাখব। আমরা! যখন ইচ্ছে যেতে পারো।
কিন্তু আজ সারাদিন এক পায়ে লাফিয়ে আমার হাঁটু ফুলে গেছে।
কাল-পরশুর মধ্যে আমি এই হাঁটুতে আর লাফাতে পারব না। একটা গাড়ি ডাকা দরকার। আচ্ছা, মাসাইমারা এয়ারস্ট্রিপ থেকে এই জায়গাটা কত দূরে?
বেশি দূর নয়।
তবু? কুড়ি মাইল? তিরিশ বা চল্লিশ মাইল?
অত না। তোমরা সারাদিন হাঁটলেও খানিকটা অর্ধ বৃত্তাকারে ঘুরেছ। এখান থেকে মাসাইমারা এয়ারস্ট্রিপ মাত্র দশ মাইল আর লিটল ভাইসরয় হোটেল হবে তেরো মাইল। আমরা অবশ্য ওদিকে কক্ষনো যাই না।
আমি একটা চিঠি লিখে দিলে তোমাদের কোনও মাসাই-ছেলে ওই এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছে প্লেনের পাইলটের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিতে পারবে না?
কোন পারবে না। এ আর এমন শক্ত কী ব্যাপার। কিন্তু সে-সব কাল ভোরের আগে তো কিছু হবে না। এখন চলো, নাচ দেখবে। আমরা মাসাইরা প্রত্যেক রাত্তিরে খানিকটা নাচ-গান না করে ঘুমোতে যাই না?
এর পর সেই আগুনের জায়গাটা ঘিরে শুরু হল নাচ-গান। কিন্তু সন্তু আর বেশিক্ষণ চোখ মেলে থাকতে পারল না। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল মাটিতে। কাকাবাবু আগুনের আলোয় একটা চিঠি লিখলেন। তারপর একটু বাদে বৃদ্ধের অনুমতি নিয়ে তিনিও শরীর এলিয়ে দিলেন।
পরদিন দুপুরের আগেই একটি গাড়ি নিয়ে হাজির হল তিনজন। একজন কৃষ্ণাঙ্গ, একজন শ্বেতাঙ্গ, একজন ভারতীয়। মাসাইদের গ্রামের একটু দূরে গাড়ি থামিয়ে মাথার ওপর হাত তুলে তারা এগিয়ে এল আস্তে আস্তে।
ভারতীয়টি পি. আর. লোহিয়া, শ্বেতাঙ্গটি প্লেনের পাইলট আর কৃষ্ণাঙ্গ লোকটি ওদের অচেনা।
কৃষ্ণাঙ্গ লোকটিই আগে এগিয়ে এসে মাসাই সদার এবং বৃদ্ধ লোকটিকে অভিনন্দন জানোল। তারপর কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তোমাদের কোনও অনিষ্ট হয়নি।
লোহিয়া তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ইনি মিঃ জোসেফ এনবোয়া। ইনি কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রাইভেট সেক্রেটারি। ইনি আজ সকালের প্লেনেই পৌঁছেছেন। হোটেলের ম্যানেজার ফিলিপ যখন কাল তোমাদের বাদ দিয়ে একলা ফিরে এল, তখনই আমি নাইরোবিতে একে ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছি।
জোসেফ এনবোয়া মাসাই-বৃদ্ধটিকে বললেন, তোমার লোকজনকে বলে দাও, মাসাইদের সঙ্গে সরকারের কোনও ঝগড়া নেই। এই অঞ্চলে যে বে-আইনিভাবে বহু পশু হত্যা করা হয়, তার জন্য মাসাইরা দায়ী নয়, কয়েকজন ব্যবসায়ীর দুষ্টচক্র এই কাজ করছে, আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। প্রেসিডেন্টের একজন আত্মীয় প্রেসিডেন্টকে কিছু না জানিয়ে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে এই কারবার চালাচ্ছিল, তাকে আর তার সঙ্গী-সাখী আরও চারজনকে কাল বন্দী করা হয়েছে। তোমরা মাসাইরা এখানকার ঘাস-জমিতে যেমন পশু চরাতে, এখনও সেই অধিকার পাবে। কেউ তোমাদের বাধা দেবে না।
বৃদ্ধটি মাসাইদের ভাষায় সেই কথাগুলো অনুবাদ করে দিতে সবাই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।
বৃদ্ধটি এবার জোসেফ এনবোয়া আর পাইলটটিকে নিয়ে গেল গোয়ালঘর দেখাতে।
লোহিয়া কাকাবাবুর হাত ধরে বলল, আবার আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিঃ রায়চৌধুরী, প্লেনে আপনাকে দেখতে পাওয়ার পরেই আমি বিবেকের দংশনে ভুগছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম, আপনি কোনও রহস্যের গন্ধ পেলে সহজে ছাড়বেন না। আর আপনি বেশি কিছু জেনে ফেললে এরাও আপনাকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে।
কাকাবাবু হাসিমুখে বলেন, আপনিই নাইরোবির হোটেলে টেলিফোনে আমাদের সাবধান করতে চেয়েছিলেন?
লোহিয়া বলল, প্ৰথম টেলিফোনটা করেছিল নিনজানে। আমারই অফিসে বসে।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্তু, তুই তা হলে ঠিকই ধরেছিলি।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমাদের গাড়িাচাপা দিতে এসেছিল কে?
এটাও নিনজানের কীর্তি। ভাড়াটে গুণ্ডা পাঠিয়েছিল আপনাদের ভয় দেখাতে। লোকটা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনই গোঁয়ার। অশোক দেশাইয়ের বুদ্ধি আছে, কিন্তু লোকটার প্রচণ্ড টাকার লোভ।
হ্যারি ওটাংগো-কে ওরাই খুন করিয়েছে, তাই না?
সেটা আমি মাত্র কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছি। আপনি নাইরোবি শহরে আরও দুচারদিন থাকলে আমি আস্তে-আস্তে আপনাকে সব কিছু জানতাম। কিন্তু আপনি সে সুযোগ দিলেন না। আমি চিঠি লিখে আপনাকে বারণ করলাম, তবু আপনি মাসাইমারায় চলে এলেন।
হোটেল-ম্যানেজার ফিলিপ কাল ফিরে গিয়ে আপনাদের কী বলল
আমাদের সম্পর্কে?
সে এক উদ্ভট গল্প। আপনারা নাকি কোথায় হিরে খুঁজে পেয়েছিলেন। তারপর রিভলভার দেখিয়ে ওকে বাধ্য করেছেন গাড়িটা তানজানিয়ার দিকে নিয়ে যেতে। সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আপনারা পালিয়ে গেছেন! এ-গল্প আমি এক বিন্দু বিশ্বাস করিনি। আমি তো আপনাকে চিনি।
সে আপনাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেনি? সে বলেছিল, এই এলাকায় সে কারুকে পরোয়া করে না?
সে আমাকে শাসিয়েছিল। সে তখনও জানত না, আমি তার মালিকদের উকিল। আমি প্ৰথমে এসে পরিচয় দিইনি। তারপর যখন আমার আসল পরিচয় জানল, তখন চুপসে গেল। এ-দেশের লোক উকিলদের খুব ভয় পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কী জানেন, ওই ফিলিপকে ধরা গেল না। আজ ভোরবেলা সে পালিয়েছে।
সন্তু চমকে উঠে বলল, লোকটা পালিয়েছে? কী করে পালাল?
ও তো এদিককার সব জায়গা চেনে। কোথায় লুকিয়ে বসে আছে কে জানে। আমরা হোটেলটা সিল করে দিয়েছি। আপাতত এক মাস বন্ধ থাকবে। গার্ডদের বলে দেওয়া হয়েছে, ফিলিপকে দেখলেই যেন বন্দী করে।
গোয়ালঘর থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে বাইরে। জার্মান বন্দী দুজনকেও হাত বেঁধে নিয়ে আসা হয়েছে। মাসাইরা রাজি হয়েছে জোসেফ এনবোয়ার হাতে ওদের তুলে দিতে। নাইরোবিতে ওদের বিচার হবে।
সন্তু সেই বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বলল, জানেন, ম্যানেজার ফিলিপ পালিয়ে গেছে! ওকে শাস্তি দেওয়া গেল না?
বৃদ্ধ শান্তভাবে বলল, শাস্তি ও পাবেই। ও যদি মাসাইমারায় যে-কোনও জায়গায় লুকিয়ে থাকে, মাসাইরা ওকে ঠিক খুঁজে বার করবে। এক পালিয়ে ও বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। ওকে খিদে শাস্তি দেবে, ওকে রোদ্দুর শাস্তি দেবে, বৃষ্টি শাস্তি দেবে, আকাশ শাস্তি দেবে। যে পশুদের ও মেরে মেরে শেষ করতে চেয়েছিল, সেই পশুরাও ওকে শাস্তি দেবে।
সন্তু বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে শহরে চলুন না। হাসপাতালে চিকিৎসা করলে আপনি সেরে উঠবেন।
বৃদ্ধ সন্তুর কাঁধে হাত রেখে হাসল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, মাসাইরা জানে, কখন তাদের মৃত্য আসবে। মাসাইরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। আমার বুকের মধ্যে যে গুলিটা ঢুকে বসে আছে, সেটা আসলে সভ্যতার বিষ। আমি জানি, আমি আর বাঁচব না। তোমরা যাও, তোমরা শান্তিতে থেকো।
সন্তুর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। কান্না লুকোবার জন্য সে মুখটা ফিরিয়ে নিল অন্য দিকে।