প্লেনটা বেশ ছোট
প্লেনটা বেশ ছোট। ফকার ফ্রেন্ডশিপ, কুড়ি-বাইশজন যাত্রীর বসবার ব্যবস্থা। এখন যাত্রী মাত্র পাঁচজন। সন্তু আর কাকাবাবু ছাড়া একজোড়া শ্বেতাঙ্গ দম্পতি, আর একজন বুড়োমতন সাহেব একেবারে সামনের দিকে বসে আছে। পাইলটের ঘরেও একজন মাত্র সঙ্গী, সেই লোকটিই একবার বেরিয়ে এসে সবাইকে একটা করে কোকাকোলার বোতল দিয়ে গেল।
প্লেনটা উড়ছে খুব নিচু দিয়ে, তলার সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। দেখবার অবশ্য বিশেষ কিছু নেই। নাইরোবি ছাড়বার পর প্রথম-প্রথম কিছু-কিছু ক্ষেত-জমি আর ছোট-ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছিল, তারপর থেকে শুধু পাথুরে ডাঙা। মাঝে-মাঝে ছোট-ছেট টিলা।
প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর প্লেনটা নামছে মনে হল। সন্তু ভাবল, ওরা বুঝি পৌঁছে গেছে। তা অবশ্য নয়, এটা একটা ছোট্ট শহর, এর নাম বাতিটাবু। এয়ারপোর্ট বলতে কিছু নেই, মাঠের মাঝখানে রানওয়ে আর একখানা মাত্র श।
এখানে একগাদা মুরগি, আলুর বস্তা, কয়েকটা তরমুজ, আনারস—এইসব তোলা হল প্লেনে।
কাকাবাবু বললেন, হোটেলের জন্য খাবার যাচ্ছে। জঙ্গলে তো কিছুই পাওয়া যাবে না, রোজারোজ তা হলে এরকম প্লেনে করে খাবার নিয়ে যেতে হয়।
সন্তু বলল, নিশ্চয়ই এই হোটেলে থাকার অনেক খরচ!
তোর আর আমার তো সেই চিন্তা নেই। আমরা মালিকের অতিথি।
আমরা যে যাচ্ছি তা কি ওখানকার হোটেলের লোকরা জানে?
নিশ্চয়ই ওয়্যারলেসে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা আছে।
কাকাবাবু, কাল, রাত্তিরে ওই চিঠিটা কে পাঠাতে পারে?
আপাতত সে-চিন্তা আমি করছি না। যে-ই পাঠক, তার আসল উদ্দেশ্যটা কী সেটা আগে জানা দরকার।
এবার প্লেনটা আকাশে ওড়বার খানিক বাদে মাঝে-মাঝে একটু-একটু জঙ্গল দেখা যেতে লাগল। খুব ঘন নয়, দু-চারটে বড় গাছ, আর ঝোপঝাড়। একটা নদীর ধারে একগাদা জন্তু দেখা গেল, কী জন্তু তা চেনা যাচ্ছে না। তার খানিকটা পরেই গোটা-পাঁচেক হাতি।
সন্তু কাকাবাবুকে ডেকে দেখাল।
কাকাবাবু বললেন, একজন সাহেব আমাকে একবার বলেছিল, ভারতবর্ষে যেমন সব জায়গায় পিলপিল করছে মানুষ, আফ্রিকায় সেইরকম জন্তু-জানোয়ার। এখানে মানুষের চেয়ে বন্যপ্ৰাণী অনেক বেশি।
নীচে বুনো হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সন্তু প্লেনের জানলা দিয়ে তা-ই দেখছে, এতে তার খুব মজা লাগল।
এর থেকেও বেশি মজা পাওয়া গেল একটু পরে।
মাসাইমারার লিটল ভাইসরয় হোটেলের নিজস্ব রানওয়ের ওপরে পৌঁছেও প্লেনটা নামতে পারল না, গোল হয়ে চক্কর দিতে লাগল। রানওয়ের ওপর ছড়িয়ে আছে একগাদা জেব্রা, আর ঠিক মাঝখানে গভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুটো প্ৰকাণ্ড দাঁতাল হাতি। ওগুলো থাকলে প্লেন নামবে কী করে।
জানলা দিয়ে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, শ্বেতাঙ্গ দম্পতিটি খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, এটা দেখে আমার আর-একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। একবার রাঁচি শহর থেকে আমার কলকাতায় প্লেনে ফেরার কথা ছিল, বুঝলি! এয়ারপোর্টে এসে বসে আছি, পাটনা থেকে প্লেনটা এল, কিন্তু নামতে পারল না। এয়ারপোর্টের পাঁচিল ভাঙা, সেখান দিয়ে গোটা পঞ্চাশেক গোরু রানওয়েতে ঢুকে পড়েছে, কয়েকটা ছেলে সেখানে আবার সাইকেল চালাচ্ছে। সেই সাইকেলওয়ালাদের সরানো গেলেও গোরুগুলোকে কিছুতেই তাড়ানো গেল না, তাদের একদিকে তাড়া করলে অন্যদিকে চলে আসে। শেষ পর্যন্ত প্লেনটা নামলেই না, বিরক্ত হয়ে চলে গেল!
সন্তু বলল, এখানে হাতি-জেব্রা কে সরাবে?
ককপিটের দরজা খুলে কো-পাইলট বেরিয়ে এসে বলল, আপনারা চিন্তা করবেন না, এক্ষুনি একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনাদের ভাগ্য ভাল, দু-চারটে সিংহ এসে বসে নেই, সিংহদের সরানো খুব শক্ত। আমাদের তেল বেশি নেই, বেশিক্ষণ ওপরে চক্কর দেওয়া যাবে না।
এবারে দেখা গেল, গোটা তিনেক স্টেশান ওয়াগন আসছে একটু দূর থেকে ধুলো উড়িয়ে। সেই গাড়িগুলো জেব্রাগুলোকে তেড়ে গেল। রাঁচি এয়ারপোর্টের গোরুদের মতন জেব্রাগুলোও একবার এদিকে আর একবার ওদিকে করতে লাগল, তারপর শেষ পর্যন্ত পালাল।
হাতি দুটো কিন্তু সহজে নড়েচড়ে না। তখন ফটফট করে ধোঁয়ার পটকা ফাটানো হল তাদের সামনে। তাতে তারা সামান্য একটু সরে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল ঘাড় ফিরিয়ে।
প্লেনটা আর ওপরে থাকতে পারছে না, ওই অবস্থাতেই নেমে পড়ল ঝুঁকি নিয়ে।
সন্তু দেখল, তাদের জানলা থেকে মাত্ৰ চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত দূরে হাতি দুটো দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু কলকাতার চিড়িয়াখানায় হাতি দেখেছে, আসামের জঙ্গলে বুনো হাতিও দেখেছে, কিন্তু এই হাতিদের আকার যেন তাদের দ্বিগুণ। যেমন প্ৰকাণ্ড মাথা, তেমনই বড়-বড় দাঁত।
সন্তু বলল, আমরা নামতে গেলে যদি হাতি তেড়ে আসে?
কাকাবাবু বললেন, আমিও তো সেই কথাই ভাবছি। বেশ রিস্কি ব্যাপার!
প্লেনটা থামাবার পর পাইলট আর কো-পাইলট বেরিয়ে এল দুটো রাইফেল হাতে নিয়ে। গম্ভীরভাবে গটগট করে পেছন দিকে গিয়ে দরজা ধুলে তারা দমাস-দমাস করে গুলি ছুঁড়তে লাগল।
মেমসাহেবটি দু কানে হাত চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল উ-ও-ও করে।
হাতি দুটোকে অবশ্য মেরে ফেলার জন্য গুলি চালানো হয়নি। মোট সাতটা গুলি ওপরের দিকে ছুঁড়ে খরচ করার পর তারা গজেন্দ্রগমনে পেছন ফিরে চলে গেল।
সন্তু ভাবল, বাপস, এইভাবে লোকে এদিকে বেড়াতে আসে।
কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে পাইলটদের সঙ্গে আলাপ করলেন; ওরা একজন শ্বেতাঙ্গ, অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গ। দুজনেই বেশ আমুদে। প্লেনটি ওদের নিজস্ব কোম্পানির। প্রত্যেকদিনই এদিকে আসে, বিভিন্ন হোটেলের প্যাসেঞ্জার আনার জন্য ভাড়া খাটে।
কাকাবাবুর বগলে ক্ৰাচ দেখে শ্বেতাঙ্গটি বলল, তুমি কিন্তু এদিকে কখনও একলা—একলা বেরিও না। যখন-তখন সিংহের সামনে পড়ে যেতে পারে, তখন পালাতে পারবে না।
কাকাবাবু হাসতে-হাসতে বলল, তুমি কি জাতে ব্রিটিশ? জানো না, ব্রিটিশ সিংহের সঙ্গে লড়াই করে আমরা ভারতের স্বাধীনতা পেয়েছি।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার সঙ্গে কাকাবাবুর এমন ভাব হয়ে গেল যে, সে কাকাবাবুকে বিয়ার খাওয়াবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। কিন্তু হোটেলের লোকরা যাবার জন্য তাড়া দিচ্ছে।
শ্বেতাঙ্গ দম্পতিটি আর সন্তু-কাকাবাবুকে তোলা হল একটা গাড়িতে। বুড়ো সাহেবটি অন্য একটি গাড়িতে রইলেন একা। এই গাড়িগুলো আলাদাভাবে তৈরি, মাটি থেকে অনেক উঁচু, দু পাশে বড়-বড় কাচের জানলা থাকলেও তার বাইরে লোহার রড দেওয়া, গাড়ির ছাদ ইচ্ছে করলে খুলে ফেলা যায়।
অল্প-বয়েসি সাহেব-মেম দুটি নিজেদের মধ্যে গল্প করছে আর অনবরত হাসছে। ধুধু করা মাঠের মধ্য দিয়ে এবড়োখেবড়ো রাস্তা, মাঝে-মাঝে বড়-বড় ঘাস, একদল হরিণ রাস্তার এক পাশ থেকে অন্য পাশে ছুটে চলে গেল। এক জায়গায় একটা বেশ লম্বা। আর ডালপালা-ছড়ানো গাছ দেখে কাকাবাবু বললেন, ওই দ্যাখ, ওটা বাওবাব গাছ।
সন্তুর মনে পড়ে গেল, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়-এ সে এই গাছটার কথা পড়েছিল। সে গাছটাকে ভাল করে দেখতে যাচ্ছে, এমন সময় মেমসাহেবটি তার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, হেই! লুক! লুক!
বাওবাব গাছের ছায়ায় বসে আছেন এক পশুরাজ। কেশর-ভরা মস্ত বড় মাথা, দুটি পা সামনের দিকে ছড়ানো, এই গাড়ির দিকে ঘুম-ঘুম চোখে একবার তাকালেন।
প্রথম দেখায় একবার বুকটা কেঁপে উঠল সন্তুর। এত কাছে একটা সিংহ। তারপর দেখল, একটা নয়, অনেকগুলো। পশুরাজ একলা বসে আছেন, খানিক দূরে এক দঙ্গল। তার মধ্যে দুটি সিংহী, পাঁচটা নানা বয়েসের বাচ্চা। বাচ্চাগুলো ঠিক বেড়ালছানার মতন এ-ওকে কামড়ে খেলা করছে!
সাহেব-মেম দুটি চেঁচিয়ে ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থামাতে!
ড্রাইভার মুখ ফিরিয়ে বলল, আমি গাড়ি স্লো করছি, আপনারা দেখুন, তবে অনুগ্রহ করে বেশি জোরে কথা বলবেন না।
গাড়ি থামল কি না-থামল তা গ্ৰাহও করল না সিংহের দলটা। যেমন ছিল, তেমনিই রইল। ঠিক যেন মনে হয়, ওরা সপরিবারে বসে রোদ পোহাচ্ছে আর খেলা করছে, শুধু বাড়ির কতা একটু দূরে বসে আছেন।
মিনিট কুড়ি গাড়ি চলবার পর থামল একটা গাছপালা-ঘেরা জায়গায়। ড্রাইভার নেমে পড়ে বলল, এবারে আপনাদের হেঁটে যেতে হবে। মালপত্ৰ সব থাক, পরে অন্য লোক এসে নিয়ে যাবে, সেজন্য চিন্তা করবেন না। আসুন আমার সঙ্গে।
গাছপালার মধ্য দিয়ে একটা সরু রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে। খানিকটা যেতেই একটা নদী চোখে পড়ল। বেশি চওড়া নয়। নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত একটা নাইলনের দড়ি টাঙানো, এপারে বাঁধা রয়েছে একটা খেয়া-নৌকো। এই নৌকো বাইতে হয় না, দড়ি ধরে-ধরেই ওপারে চলে যাওয়া যায়!
নদীর জল বেশ পরিষ্কার, স্রোত আছে। ড্রাইভারটি বলল, আপনারা এই নদীতে কেউ কখনও নামবার চেষ্টা করবেন না, এতে যথেষ্ট কুমির আছে। এই নৌকোতেও কক্ষনো একা পার হবার চেষ্টা করবেন না।
নদীর ওপারে আর-একটা খাড়াই সরু পথ। তারপর খানিকটা ঘন জঙ্গল। বোঝা গেল, নদীর ওই দিকটা পর্যন্ত গাড়ি চলে। এপারে দুজন লম্বা আফ্রিকান ছেলে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, বোধহয় গাড়ির আওয়াজ শুনে এসেছে। দুজনের হাতেই রাইফেল। তাদের মধ্যে একজন ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বলল, প্লিজ ডোনট অ্যালোন গো টু ফরেস্ট। ভেরি ডেঞ্জার! গ্রুপ কাম, গ্রুপ গো। ফলে মি!
কয়েক পা যেতেই ছেলেটি থমকে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ্শ্শ্শ্!
মাত্র কুড়ি-পঁচিশ হাত দূর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে দুটি দাঁতাল শুয়োর। রাস্তার ধারে একটা বড় গাছের ডাল ধরে ঝুলছে কয়েকটা বেবুন।
কাকাবাবু ফিসফিস করে সন্তুকে বললেন, হোটেলে পৌঁছবার আগেই তো অনেক রকম জানোয়ার দেখা হয়ে গেল রে!
কালো ছেলে দুটি হাতের রাইফেল তুলল না, কিছুই করল না, শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মিনিট। তাতেই রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। তখন একজন বলল, কাম স্লো, নো রান!
জঙ্গল একটু পাতলা হতেই সন্তু ভাবল, এইবার হোটেল-বিল্ডিংটা দেখা যাবে। কিন্তু কোথায় বিল্ডিং। আর একটুখানি যেতে চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড, হোটেল লিটল ভাইসরয়। তার ওপাশে খানিকটা ব্যবধানে দুটো তাঁবু, একটা বেশ বড়, আর-একটা মাঝারি, সেটার গায়ে লেখা আছে অফিস। এই নাকি হোটেল? এ কী হোটেলের ছিরি! তবে যে অশোক দেশাই বলেছিলেন বিরাট হোটেল?
ওরা সেই অফিস-তাঁবুর কাছে আসতেই একজন বেশ স্মার্ট চেহারার কালো যুবক বেরিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, ওয়েলকাম! ওয়েলকাম! আজকের দিনটা খুব সুন্দর, তাই না? দেখুন বৃষ্টি নেই, ঝকঝকে রোদ উঠেছে, আপনারা সুন্দরভাবে বেড়াতে পারবেন। আগে খাতায় আপনাদের সবার নাম-ঠিকানা লিখুন, তারপর আমি আপনাদের থাকার জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি!
কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে এসে যুবকটি বলল, আশা করি আপনিই মিঃ রায়চৌড্রি? কাল রাত্তিরেই আপনাদের আসার খবর পেয়েছি। আমি চব্বিশ ঘণ্টাই এখানে থাকি। আপনার যখন যা দরকার হয়, আমাকে বলবেন।
খাতায় নাম-টাম লেখা হয়ে যাবার পর সেই ম্যানেজার সবাইকে নিয়ে সামনের দিকে এগোল। দেখা গেল, ওই বড় তাঁবুটা হল খাবার ঘর। তারপর ডান পাশে একটা জলাভূমি, বা দিকে জঙ্গল, সেই জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে খানিকটা দূরে দূরে ছড়ানো আরও অনেক তাঁবু, অন্তত গোটা চল্লিশোক তো হবেই।
এই তাঁবুগুলোই হোটেল-ঘর। সবুজ তাঁবুগুলো জঙ্গলের মধ্যে মিশে আছে, তাই জঙ্গলের সৌন্দর্য নষ্ট হয়নি। এখানে একটা সিমেন্ট-কংক্রিটের মস্ত বড় বাড়ি থাকলে বিচ্ছিরি দেখাত।
ডান পাশের জলাভূমিতে জল বেশি নেই, মাঝে-মাঝে ঘাস গজিয়েছে, সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে কতকগুলো মোষ। মাঝখানে একটা দ্বীপের মতন জায়গায় একঝাঁক বেবুন ও বুনো শুয়োর, বেশ খানিকটা দূরে আবছা-আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা হাতি।
ম্যানেজারটি বলল, আপনারা কেউ এই জলাভূমিতে নামবেন না। যে-কোনও জন্তু যখন-তখন এখানে এসে পড়তে পারে, তাতে ভয় পাবার কিছু নেই। সব জন্তুরই নিজস্ব খাদ্য এখানে প্রচুর আছে, সেইজন্য মানুষ ওদের ক্ষতি না করলে ওরাও মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। তবে, একটা ব্যাপারে খুব সাবধান, ওই যে মোষগুলো দেখছেন, আপাতত নিরীহ মনে হলেও ওরাই আফ্রিকার সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক প্ৰাণী। ওদের কাছাকাছি খবরদার যাবেন না। ওরা অত্যন্ত বদরাগী, একমাত্র ওরাই বিনা কারণে মানুষ সামনে দেখলে টুসিয়ে পেট ফুটো করে দেয়। ওরা দল বেঁধে থাকলে সিংহ কাছে ঘেঁষে না।
সন্তু শুনে অবাক হল। মোষগুলোকে তো আমাদের দেশের মোষের মতনই দেখতে প্ৰায়। তবে, এদের পায়ের কাছে একটু সাদা ছোপ, মনে হয় যেন সাদা মোজা পরা। জলাভূমি ছেড়ে এই মোষগুলো যদি তাঁবুর কাছে চলে আসে?
অধিকাংশ তাঁবুই খালি। একটি-দুটি লোককে মাত্র দেখা গেল। সন্তুদের দেওয়া হল ৩৪ নম্বর তাঁবু, তার পেছন দিকটায় বাঁশবন, ডান পাশে, বাঁ পাশেও এমন ঝোপঝাড় যে, সেখান থেকে অন্য কোনও তাঁবু দেখতে পাওয়া যায় না।
ম্যানেজার বলল, আপনারা একটু বিশ্রাম নিন, আপনাদের মালপত্র এক্ষুনি পৌঁছে যাচ্ছে। সাড়ে বারোটার সময় লাঞ্চ দেওয়া হবে, প্রথম যে বড় তাঁবুটা দেখেছিলেন, সেখানে চলে আসবেন।
এই তাঁবু সাধারণ তাঁবু নয়, স্পেশালভাবে তৈরি। নাইলনের তৈরি এমন পুরু বনাত যে ছুরি দিয়েও কাটা যাবে না। ব্যবস্থা দেখে কাকাবাবু পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বললেন, বাঃ! এরকম আশাই করিনি।
তাঁবুর সামনেটায় একটা ছোট বারান্দায় বসবার জায়গা, সেখানে রয়েছে তিন-চারটে চেয়ার আর একটা নিচু টেবিল। তারপর ভেতরে ঢোকার দরজা। মাঝখানের একটা জিপার টেনে খুললেই দরজার দুটো পাল্লা হয়ে যায়। ভেতরে দু পাশে দুটি খাট পাতা, তাতে ধপধপে সাদা বিছানা। ঠিক যেন কোনও ভাল হোটেলের ডাবল-বেড রুম। শিয়রের কাছে ছোট টেবিল, তার ওপরে বাইবেল ও কয়েকটা পত্রপত্রিকা, এমনকী দেওয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিও টাঙানো আছে। দুদিকে দুটি দুটি জানলা, তাতে তারের জাল। পেছন দিকে আবার জিাপার টেনে দরজা খুললে একটুখানি ফাঁকা জায়গা, তারপর আর-একটা ছোট তাঁবু। সেটা বাথরুম। সেই বাথরুমের ব্যবস্থা দেখলে হকচাকিয়ে যেতে হয়। তাতে কমোড আছে, শাওয়ার আছে, বেসিন আছে। সেই বেসিনের দুটো কল, সন্তু খুলে দেখল, একটা দিয়ে ঠাণ্ডা আর-একটা দিয়ে গরম জল বেরোচ্ছে! সবা-কিছু একেবারে নিখুঁত আর ঝকঝকে পরিষ্কার!
ওরা দুজনে সামনের বারান্দায় চেয়ার টেনে বসল। যদিও ঝকঝকে রোদ উঠেছে, তবু গরম নেই। প্রথম দশ-পনেরো মিনিট ওরা চুপ করে বসে রইল। সামনের দৃশ্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। জলাভূমিতে নানা রকম প্রাণী আসছে, চলে যাচ্ছে, একদল হরিণ খেলছে। আপনমনে, কিছু মানুষ যে ওদের দেখছে সেদিকে ওদের হুঁশই নেই। এই প্ৰথম সন্তু জিরাফ দেখতে পেল। এক জোড়া জিরাফ নাচের ভঙ্গিতে আস্তে-আস্তে ছুটে এসে আবার জলাভূমির ডান পাশের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। কাছাকাছি কী যেন একটা পাখি শিস দিচ্ছে, পাখিটাকে দেখা যাচ্ছে না।
কাকাবাবু এক সময় বললেন, এখানে বসে-বসেই তো সারাটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় রে
সন্তু বলল, এখনও আমার চোখকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না!
কাকাবাবু বললেন, এখানে যারা বেড়াতে আসে, তাদের পয়সা খরচ সার্থক হয়ে যায়। কিন্তু হোটেলটা তো সত্যি চলছে না দেখছি। এতগুলো তাঁবু। খালি! এত বড় হোটেল যখন বানিয়েছে, তখন এক সময় নিশ্চয়ই প্রচুর লোক আসত।
হঠাৎ ফ-র-র ফ-র-র শব্দ শুনে সন্তু চমকে উঠল। তাঁবুর খুব কাছেই একটা জেব্রা এসে নিশ্বাস ফেলছে। এই জেব্ৰাট পেছনের বাঁশবনের দিক থেকে এসেছে। দৌড়ে এসে থমকে দাঁড়িয়ে অবাক চোখ মেলে সে এই মানুষ দুটিকে দেখছে।
এত কাছ থেকে সন্তু কখনও জেব্রা দ্যাখেনি। তার গায়ের চামড়া কী মসৃণ, ঠিক সিস্কের মতন। সাদা শরীরে কালো ডোরাগুলো যেন কোনও শিল্পীর আকা। মুখখানা কচি বাচ্চাদের মতন সরল।
সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাকাবাবু, ওর গায়ে একটু হাত ঝুলিয়ে দেব?
কাকাবাবু বললেন, জেব্রাগুলো তো এমনিতে খুব শান্ত হয় শুনেছি। তবে লাথি-টাথি ছেড়ে কি না তা জানি না। চেষ্টা করে দ্যাখ।
সন্তু বারান্দা থেকে নামতেই জেব্রাটা বিদ্যুৎ-গতিতে পেছন ফিরে পৌঁপোঁ করে ছুট লাগাল।
এই সময় একটি আফ্রিকান ছেলে এল ওদের সুটকেস দুটো বয়ে নিয়ে। সে-দুটো বারান্দায় নামিয়ে রেখে সে জিজ্ঞেস করল, ইউ নিড এনিথিং স্যার? টি, কফি, বিয়ার, ফুটস? নে? কোকাকোলা, সেভেন আপ? নোঃ? স্যান্ডউইচ, হ্যাম, সসেজ, পেস্ট্রি?
কাকাবাবু বললেন, নো, থ্যাংক ইউ। সাড়ে বারোটা বাজতে আর আধঘণ্টা দেরি আছে, তখন আমরা লাঞ্চ খেতে যাব।
লোকটি নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।
কাকাবাবু বললেন, এই মরুভূমি আর জঙ্গলের মধ্যেও কত রকম জিনিস পাওয়া যায় দেখলি? আপ্যায়নের কোনও ক্রুটি নেই। একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, নদীর ধার থেকে যে-ছেলে দুটি বন্দুক হাতে নিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল, তাদের সঙ্গে এই লোকটার চেহারার অনেক তফাত। এই লোকটা বেঁটে, ওরা দুজন খুব লম্বা। এখানে তো অনেক উপজাতি আছে, তাদের ভাষা আলাদা, চেহারাও আলাদা, গায়ের রংও দেখবি সবার সমান কালো নয়। ওই লম্বা ছেলে দুটো খুব সম্ভবত মোসই। এই মাসাইরা খুব সাহসী যোদ্ধা হয়। আর খুব আত্মসম্মান জ্ঞান আছে।
সন্তু বলল, ও, তা হলে এই উপজাতিদের নামেই জায়গাটির নাম মাসাইমারা? মারা মানে কী?
তা আমি জানি না। তবে মারা নামে এদিকে একটা নদী আছে।
এই সময় একজন প্রৌঢ় শ্বেতাঙ্গ আস্তে-আস্তে হেঁটে এসে এই তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, গুড মর্নিং! তোমরা বুঝি আজকেই এলে?
কাকাবাবু বললেন, গুড মর্নিং। হ্যাঁ, আমরা নতুন এসেছি। আপনি কতদিন আছেন?
লোকটি একটু কাছে এসে বলল, আমি এসেছি.প্রায় দু সপ্তাহ হয়ে গেল, আরও কিছুদিন থাকব।
কাকাবাবু লোকটির সঙ্গে আলাপ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে তাঁকে বসবার জন্য অনুরোধ করলেন। লোকটির নাম গুনার ওলেন, জাতে সুইডিশ। তিনি একজন নাট্যকার। নিরিবিলিতে এখানে একটি নতুন নাটক লিখতে এসেছেন। দু বছর আগে তিনি এখানে আর-একবার এসেছিলেন, সেবার যে নাটকটি লিখেছিলেন, সেটি সুইডেনে খুব জনপ্রিয় হয়েছে, ইংরেজিতেও অনুবাদ বেরিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, আপনাদের দেশের ইংগামার বার্গম্যানের অনেকগুলো ফিল্ম আমি দেখেছি, আমার খুব ভাল লেগেছে।
গুনার ওলেন হেসে বললেন, আমার সঙ্গে কোনও বিদেশির দেখা হলে ওই নামটাই সবাই বলে। হ্যাঁ, ইংগামার এখন আমাদের দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি। আপনারা কি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন?
হ্যাঁ।
বেড়াতে!
হ্যাঁ, বেড়াতেই। আমি আপনার মতন লেখক নই। আপনি তো দুবছর আগে এখানে এসেছিলেন বললেন। তখনকার থেকে এখন কোনও তফাত দেখছেন?
জায়গাটা একই রকম আছে। তবে দুবছর আগে এই হোটেলটা ভর্তি দেখেছি। লোকজনে জমজমাট ছিল। এবার তো প্ৰায় ফাঁকা। গতকাল পর্যন্ত সাতজন ছিল মাত্র, তার মধ্যে পাঁচজন চলে গেল। আজ। আপনারা কজন এলেন? কম লোক এলে হোটেলের ক্ষতি হয় বটে, কিন্তু আমার পক্ষে ভাল। আমি নির্জনতা পছন্দ করি।
আচ্ছা, মিঃ ওলেন, আমরা তো নতুন এসেছি, আপনার কাছ থেকে কয়েকটা কথা জেনে নিই। এখানে কোনও ভয়-টয় নেই তো? এই যে এত জন্তু-জানোয়ার কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে কোনও হিংস্ৰ প্ৰাণী আক্রমণ করতে পারে না?
একটা কথা মনে রাখবেন, মিঃ রায়চৌধুরী। প্রকৃতির জগতে আপনি যদি কারও ক্ষতি না করেন, তা হলে অন্য কেউ সহজে আপনার ক্ষতি করতে চাইবে না! এক রাত্তিরে আমি একটা হাতির মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। আমি জানি, মানুষ তো হাতির খাদ্য নয়। সে শুধু শুধু আমাকে মারবে কেন? আমি হাতিটাকে নমস্কার করলুম, সে অন্যদিকে চলে গেল!
বাঃ, এ যে প্ৰায় গল্পের মতন।
গল্প নয়। সত্যি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা।
নাইরোবিতে থাকার সময় আমরা একটা গুজব শুনেছিলাম, দুজন বিদেশি টুরিস্ট নাকি এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেটা বোধহয় গুজবই, তাই না?
এই কথাটা আমিও শুনেছি। আমি বিশ্বাসও করিনি, অবিশ্বাসও করিনি। দুজন জার্মান যদি অদৃশ্য হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তারা নিশ্চয়ই নিজেরা ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেছে। এক-এক সময় আমারই তো ইচ্ছে করে, হাঁটতে-হাঁটতে দিগন্তে মিলিয়ে যাই।
এই হোটেলে হঠাৎ টুরিস্ট কম আসছে কেন বলুন তো? আপনার কী মনে হয়?
আমার কিছু মনে হয় না। যত কম লোক আসে, ততই ভাল! বেশি লোক এসে জঙ্গলের মধ্যে হইচই করে, সেটা আমার মোটেই পছন্দ নয়।
তা অবশ্য আপনি ঠিকই বলেছেন, মিঃ ওলেন!
আপনার নাম কী যেন বললেন? মিঃ রোয়া, রোয়া, চুডরি?
রায়চৌধুরী। তবে শুধু রায় বা রোয় বললেও ক্ষতি নেই।
গুনার ওলেন সন্তুর দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক পলক। তারপর কাকাবাবুকে বললেন, মিঃ রোয়চৌডারি, আপনি যে জঙ্গল দেখবেন, তা এই কিশোরটির চোখ দিয়ে দেখুন। এই বয়েসটাই সবকিছু দুচোখ ভরে দেখতে জানে। আমি জন্মেছি সুইডেনের একটা দ্বীপে। সেখানে প্রচুর জঙ্গল ছিল। এখন আমি পৃথিবীর যে-কোনও জঙ্গলে বেড়াতে গেলেই আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।
এই সময় ঝুনঝুন করে একটা বেল বেজে উঠল। বেশ খানিকটা দূরে। খুব সম্ভবত অফিস-তাঁবুর কাছ থেকে।
কাকাবাবু বললেন, ওই বোধহয় খাবার ঘণ্টা বাজছে।
গুনার ওলেন হেসে বললেন, না, এটা সে-ঘণ্টা নয়। এটা হাতি আসার ঘণ্টা। কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোনও হাতির পাল এসে পড়েছে। তখন ঘণ্টা বাজিয়ে এরা আমাদের তাঁবুর বাইরে যেতে নিষেধ করে।
কাকাবাবু বললেন, সে কী, এই সব তাঁবুর কাছেও হাতি আসে নাকি?
গুনার ওলেন বললেন, এরা যখন খুশি আসবে, সেইটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? আমরাই ওদের জায়গা দখল করে আছি। তবে, চিন্তার কিছু নেই। আফ্রিকার হাতি মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ দেখলে তারাই অবজ্ঞার সঙ্গে দূরে সরে যায়।
তারপর তিনি সন্তুর দিকে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বুঝি হাতিগুলোকে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে? চলো না, এগিয়ে দেখা যাক।
গুনার ওলেন সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে জলাভূমির কাছে চলে গেলেন। কাকাবাবু কোটের পকেটে হাত দিয়ে খুঁজতে লাগলেন। কী যেন। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি চুরুট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু এখনও উত্তেজনার মুহূর্তে চুরুটের জন্য তাঁর হাত নিশপিশ করে।
চুরুট না খেলেও কাকাবাবু পকেটে সবসময় একটা লাইটার রাখেন। অনেক সময় ওটা অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগে। সেই লাইটারটা বার করে তিনি আপনমনে জ্বালাতে লাগলেন।
সত্ত্বরা অবশ্য হাতির পালটা দেখতে পেল না। দুরের জঙ্গলে হোটেলের কর্মীরা পটকা ফাটাচ্ছে, সেই ধোঁয়া উড়ছে।
একটু বাদে অল ক্লিয়ার ঘণ্টা বাজল। ওরা এবার খেতে গেল বড় তাঁবুটার দিকে।
সুন্দর রোদ-ঝিকিমিকি দিন বলে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে বাইরে। অনেকগুলো টেবিল এনে পাতা হয়েছে। ওপেন এয়ারে বুফো লাঞ্চ। অনেক রকমের খাবার, যে যত খুশি খেতে পারে। সন্তু গুনে দেখল, খেতে বসেছে ওরা মাত্র আটজন। আর হোটেলের এগারোজন কর্মচারী ওদের দেখাশোনা করছে। কী করুণ অবস্থা এই হোটেলের।
যে সাহেব-মেম দম্পতিটি ওদের সঙ্গে একই প্লেসে এসেছিল, তাদের সঙ্গে আলাপ হল। ওরা আমেরিকান, বিয়ে করার পর বেড়াতে এসেছে। কিছুদিন আগে যে এই হোটেল থেকে দুজন টুরিস্ট অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে-কথা ওরা জানে না।
আর একটা প্রৌঢ় দম্পতি এখানে রয়েছেন, দিন-পাঁচেক ধরে। কাকাবাবু তাঁদের সঙ্গেও যেচে আলাপ করলেন। সেই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলারাও এই হোটেল সম্পর্কে কোনও অভিযোগ নেই। এঁরা জাতিতে পর্তুগিজ, স্বামী আর স্ত্রী দুজনেই চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর সারা পৃথিবীতে অ্যাডভেঞ্চার খুঁজতে বেরিয়েছেন। দুজনেই বেশ মজার কথা বলেন।
সন্তুদের সঙ্গে একই প্লেনে আর একজন যে বুড়ো সাহেব এসেছিলেন, তিনি খেতে বসলেন একা একটি টেবিলে। অন্য কারও দিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি উঠে উঠে নিজের খাবারও নিতে যাচ্ছেন না, হোটেলের কর্মচারীরা তাঁর খাবার এনে দিচ্ছে। ইনি একটু করে খাচ্ছেন আর অনেকক্ষণ উদাসভাবে তাকিয়ে থাকছেন জলাভূমির দিকে।
হোটেলের ম্যানেজারটি এসে ঘোষণা করল, খাওয়া-দাওয়া শেষ করার আধঘণ্টা পরেই সবাইকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হবে। নদীর ওপারে গাড়ি তৈরি আছে।
খাওয়া শেষ করে কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে আস্তে-আস্তে হেঁটে গিয়ে সেই বুড়ো সাহেবের টেবিলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেন। সন্তু একটা বায়নোকুলার এনেছে, সেটা দিয়ে সে জলাভূমির দূরের জানোয়ারগুলোকে ভাল করে দেখবার চেষ্টা করছে। একটা জিনিস সে লক্ষ করেছে। এখানে কোনও কুকুর নেই। খোলা জায়গায় খেতে বসলে দু-একটা কুকুর এসে সামনে ঘুরঘুর করবে, এটাই যেন স্বাভাবিক মনে হয়। গুনার ওলেন। অবশ্য সন্তুকে বলেছিলেন যে, এখানে ঝাঁকে-ঝাঁকে ওয়াইল্ড ডগস আছে, তারা এমনই হিংস্ৰ যে, মোষ কিংবা সিংহরাও তাদের ভয় পায়।
বুড়ো সাহেবটি একবার চোখ তুলতেই কাকাবাবু বললেন, শুভ দ্বিপ্রহর। এখানে রোদ বেশ চড়া, কিন্তু হাওয়াটা ঠাণ্ডা, এটা বেশ চমৎকার, তাই না?
লোকটি গম্ভীরভাবে বলল, হুঁ!
কাকাবাবু আবার বললেন, আপনার তো দেখছি এখনও কফি খাওয়া হয়নি, আমি আপনার টেবিলে বসে আর-এক কাপ কফি পান করতে পারি কি?
লোকটি বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
সন্তুর চোখে যদিও দূরবীন তবু সে কান খাড়া করে সব কথা শুনছে। সে আগে কখনও কাকাবাবুকে এরকম সোধে-সেধে অন্যদের সঙ্গে আলাপ করতে দ্যাখেনি।
সেই বৃদ্ধটির টেবিলে বসে কাকাবাবু বললেন, অতি সুন্দর জায়গা। ইচ্ছে করে এখানে অনেকদিন থেকে যেতে।
বৃদ্ধটি শুকনো গলায় বললেন, আপনার ভাল লাগছে। এ-জায়গাটা? শুনে সুখী হলাম।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কেন, আপনার এ জায়গাটা ভাল লাগছে না?
বৃদ্ধটি বললেন, ভাল লাগালাগির তো প্রশ্ন নয়। আমি প্রত্যেক বছর অন্তত ছমাস করে এখানে থাকি।
কাকাবাবু ভুরু তুলে বললেন, আপনি প্রতি বছরে ছ। মাস…তার মানে কত বছর ধরে এখানে আসছেন?
তা প্ৰায় পনেরো বছর হবে? পনেরো বছর? অর্থাৎ এই জায়গাটি আপনি এত ভালবাসেন যে, প্ৰতি বছর আপনাকে আসতেই হয়?
এই জায়গাটা যে আমার খুব ভাল লাগে, তা আমি বলতে পারব না। মাঝে-মাঝে বেশ খারাপ লাগে, একঘেয়ে লাগে, তবু আমাকে আসতেই হয়।
খারাপ লাগে, একঘেয়ে লাগে, তবু আসতে হয়? ঠিক বুঝলাম না। তার মানে কি এই যে, মাসাইমারা আপনাকে চুম্বকের মতন টানে? আপনি না এসে পারেন না?
বৃদ্ধটি কাকাবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, চুম্বকের টানের ব্যাপার নয়। আমাকে আসতে হয় সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আমার নাম পিয়ের লাফাৰ্গ। আমি এই হোটেলটার মালিক?