ছন্দ পতন
আজকাল কি যে হয়েছে অনুসুয়ার, কিছুতেই যেন মন লাগে না ! অথচ এই মেয়েটা না মেয়ে বলা ভুল হবে, সে এখন রীতিমত দায়িত্বসম্পন্ন বাড়ির বউ বলে কথা, এই কিছুদিন আগেও অত্যন্ত সাদামাঠা জীবন যাপনেই অপার শান্তি খুঁজে কাটাতো ।
আর নতুন বিয়ে হওয়া অর্ণবের রাগ হবারই কথা, একটু সাজুগুজু করে থাকবে তা নয় ওই যেমন খুশি, একটা থাকলেই হলো আর কি এই ভাবনায় দিন কাটায় ! অবশ্য এটা কোনো ক্যাবলাকান্তি মেয়ের কথা বলছি না, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে এক ঝক ঝকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট আছে মফস্বল শহরের এই মেয়েটির দখলে ! ইংরেজি সাহিত্য, কিটস, শেক্সপিয়র নিয়ে একবার আলোচলা পেরে দেখুন তারিয়ে তারিয়ে সে আলোচনা উপভোগ করবে ঘন্টার পর ঘন্টা ! কিন্তু ওই যে একদম সিম্পল জীবনাচার আর পড়াশোনায় মুখ ডুবিয়ে রাখা এই অভ্যাস বহুদিনের রপ্ত, অর্ণব বললেই কি সহজে যায় সে সব ভোলা না ফেলে দেওয়া সম্ভব!
শ্বশুর বাড়ির মানুষ গুলোর, রূপের গরবে গর্বিত অনেকেই, “বাব্বা নতুন বউ এর একি ছিরি, নতুন লাগছে না মোটেই এমন সব বাঁকা মন্তব্যও উড়ে আসেনি তা নয়! সারল্য মাখা হাসিতে সে সব আলটপকা শব্দ, বাউন্ডারির ওপারে পাঠিয়ে দিয়ে আসে।
ও হ্যাঁ, বলাই তো হয় নি, এই সরল সাদাসিধে জীবন নিয়েই সংসারের চাপ ও বাঙালি মেয়েদের বিয়ের পর সকল কে খুশি করার প্রবল চাপের মাঝেই মাস্টার ডিগ্রিতে দুর্দান্ত একটা রেজাল্ট আর সরকারি স্কুলে সসম্মানে চাকরি দুটোয় করায়ত্ত করে নিয়েছে শ্রীমতি অনূসুয়া।মনের অদম্য বল যে তার অন্যতম ছায়া সঙ্গী সে বিষয়ে অর্ণব কেন অনুসূয়ার ও পূর্ণ আস্থা।
এই তো বেশি দিন আগের কথা নয় যাদবপুরে, পাঠরতা বোনের ক্রমাগত বলে যাওয়া -“ওরে দিদি, তুই সেই তিমিরেই পরে রইলিরে! হাতের মোবাইল সেটটা তো এবার পাল্টা, সেই কোন মান্ধাতা আমলের কি প্যাড সেট নিয়ে পড়ে আছিস! লোকে যখন হোয়াটসএপ, ফেসবুক নিয়ে মেতে আছে তখন তোর কিনা ফেসবুকে নামকা ওয়াস্তে আইডি আছে ! আর অর্ণব দাই আপডেট দিয়ে যায় -কি রে তুইই দিদি! এত্ত সুন্দর সম্মানের জব করিস এই ভাবেই কি কাটিয়ে দিবি!দিদি রে তুই বুড়ি হয়েই গেলি অচিরেই !!”
অকৃত্রিম সেই সুন্দর মুখের হাসি দিয়ে কোনোদিন গায়ে মাখতো না অনুসুয়া বরং বর অর্ণব কে বলত ব্যাক ডেটেড বলো তো বলো, আমি না হয় এমন ই একটা । “সারা দিন এত্ত জর্নী, পরিশ্রম করে আর ওসব ভাল লাগে না গো আর, সাড়ে দশ টা বাজলেই মনে হয় চোখের পাতা যেন জুড়িয়ে এসেছে ।যে টুকু সময় পাই সংসার আর ঘর গুছাতেই কেটে যায়।”এই বলে একটা ম্যাগাজিনের লেখায় মনোনিবেশ করতে না করতেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
অর্ণব ও বলে বলে অনেক পরিবর্তন এনেছে অবশ্য তার সাধের অণুর । সেই বিয়ের পর থেকেই একদম কেয়ার লেস বিউটির তকমায় তার যে সহধর্মিণী কেবল পড়ার বই, গল্পের বইয়ের জগত ছাড়া আর কিছুই চিনত না, তাকেই খেঁচিয়ে খেঁচিয়ে “ওগো একটু তো পরিপাটি থেকো ! একটু না হয় সামান্য পাওডার, অন্তত একটা টিপ “তাতেই যা লাগে না তোমায় ! কি যে করো না তুমি এত্ত উদাসীন নিজের ওপর, ধুর ভাল লাগে না ” এই কমন বাক্য গুলো ঘরের চার দেওয়ালেরও বড্ড পরিচিত হয়ে গেছিল। অর্নব স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে চলে, “আজও বিয়ের এত গুলো বছর পর মনে করাতে হয় ! নিজের মত করেএকটু সাজতেও কি ইচ্ছা করে না গো তোমার? “রাশি রাশি বই এর তাকের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কথা গুলো শোনে আর হাসতো অনু ।
অবশ্য এই ছয় মাস অর্ণব এর অনুরোধ শব্দে কিছু সংযোজন হয়েছে “মোবাইল টা এবার একটু রাখো তুমি ..বাপ রে বাপ -এত্ত নেশা “।
“কে নেশা ধরিয়েছে শুনি !”এই বলে ইদানিং গলার ঝাঁজ টা ও টের পায় অর্ণব তার প্রাণের অণুর ! “রাত বারোটা বাজল কিন্তু “-এই বলে গজরাতে গজরাতে মেয়েকে জড়িয়ে আধো ঘুমে আবার ডুব দেয় কত্তা ! ইন্টারনেট এর নেশা, কত সাইটে মেয়েদের কতো যে হাল ফ্যাশনের রকমারি পোশাক, সাজ গোজ সে সব দেখে নিয়ন আলোয় ঘুম টাই জলাঞ্জলি হয়েছে আজকাল অনুর, সঙ্গে তো নানান পরিচিত হোয়াটসএপ গ্রুপের নোটিফিকেশন ম্যাসেজ ভিড় আসতেই থাকে যা ঘড়ির কাঁটাকে তড়তড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে।