Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চেইন রিয়্যাকশন || Anish Deb

চেইন রিয়্যাকশন || Anish Deb

ইয়োর বুকস কোম্পানিতে আমি লাস্ট এপ্রিলে জয়েন করেছি–ওদের এডিটোরিয়াল গ্রুপে, অ্যাসোসিয়েট এডিটর হিসেবে। সেখানেই রঙ্গিলা শর্মার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।

লম্বা, ছিপছিপে, ঝকঝকে মেয়ে রঙ্গিলা। ওর উজ্জ্বল চোখে ক্ষুরধার দৃষ্টি। সে-চোখে নজর পড়লেই মনে হয়, ও সব গোপন কথা জানে। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিল।

রঙ্গিলার এমনই টান যে, ওকে দেখলেই সবাই বন্ধুত্ব পাতাতে চায়। কিন্তু অনেকেই ওর দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। কারণ, ওর ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধি।

পাবলিশিং ওয়ার্ল্ডে রঙ্গিলা শর্মার নাম সবাই জানে। ও এক অদ্ভুত জাদু জানে–অঙ্কের জাদু। আড়ালে অনেকে বলে, ও সুপারন্যাচারাল ম্যাথমেটিক্যাল জিনিয়াস। তবে ম্যাথ বলতে আমরা যা বুঝি তা নয়। রঙ্গিলার ব্যাপারটা সুপারম্যাথ। এই অঙ্কই বই বিক্রির জাদু ওর হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সিম্পলি ওর জন্যেই ইয়োর বুকস অন্য সব পাবলিশিং কোম্পানিকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। পাবলিশিং-এর দুনিয়ায় রঙ্গিলা শর্মা এককথায় এক ইউনিক আইকন।

ইয়োর বুকস-এ চাকরির সুযোগ পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। অন্তত আমার কাছে। এর আগে ছোটামোটা ফিলিম ম্যাগাজিনে সাব-এডিটরের কাজ করেছি। একটা ক্রাইম ম্যাগে সহ-সম্পাদকও ছিলাম। হঠাৎ করে কী খেয়ালে ইয়োর বুকস-এর ইন্টারভিউটা দিয়েছিলাম–লাক ফ্যাক্টর চাকরিটা গেঁথে গেল। স্বপ্নের চাকরি। কারণ, কোম্পানিটা মাপে বাড়ছে–ওপরে ওঠার স্কোপ অনেক।

ইয়োর বুকস লাস্ট দশবছরে যেকটা পেপার-ব্যাক সিরিজ বের করেছে তার সবকটাই সুপারহিট। কোনওটা ক্লাসিক, কোনওটা ছোটদের, কোনওটা ক্রাইম থ্রিলার, কোনওটা আবার সায়েন্স ফিকশন অ্যাডভেঞ্চার। এই সবকটা সিরিজ সাকসেসফুল হওয়ার মূলে রঙ্গিলা–আর ওর সুপারম্যাথ। আর তার রেজাল্ট ইয়োর বুকস-এর টার্নওভার অন্যান্য পাবলিশিং হাউসকে ঈর্ষায় নীল করে দেয়–গাঢ় নীল।

ইয়োর বুকস-এ জয়েন করার পর তৃতীয় দিনেই রঙ্গিলার মুখোমুখি হলাম।

মাঝারি একটা কাচের ঘরে ওর অফিস। টেবিলে তিনটে টেলিফোন, একটা ল্যাপটপ, হাফডজন নানা রঙের পেন, আর দু-থাক ফাইল।

একতাড়া কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটের ওপরে ঝুঁকে ছিল ও। ওপরের হেডিং দেখে বুঝলাম, ওগুলো সেক্স ফিগার। পরে জেনেছি, সেক্স ফিগারেই রঙ্গিলার একমাত্র ইন্টারেস্ট। কারণ, সেক্স ফিগারই ওর সুপারম্যাথ অ্যাপ্লিকেশানের র ডেটা।

আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেছেন বিক্রম ভট্টাচার্য, কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমাদের দেখেই ও মুখ তুলে তাকাল। ছোট-ছোট লেন্সের শৌখিন চশমাটা চোখ থেকে নামাল। তারপর উঠে দাঁড়াল।

আমাদের প্রোডাকশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশান ম্যানেজার রঙ্গিলা শর্মা। বিক্রম আলাপ করিয়ে দিলেন মিস শর্মা, আমাদের নতুন অ্যাসোসিয়েট এডিটর প্রীতম চৌধুরী।

চট করে ও হাত বাড়িয়ে দিল। আমরা হাত আঁকালাম। আমি বললাম, আপনার নাম অনেক শুনেছি….।

তাই? ও হাসল–ছোট্ট চাপা হাসি। অনেকটা পিঠ চাপড়ানো গোছের।

আমি ওকে দেখছিলাম। চাউনি, শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর ঢং, গলার স্বর–সবকিছু থেকেই ক্ষমতার অদৃশ্য তরঙ্গ ঠিকরে বেরোচ্ছে। এই তিরিশ বছর বয়েসেই ইয়োর বুকস-এর প্রোডাকশন অ্যান্ড ড্রিস্ট্রিবিউশান ম্যানেজার! হয়তো আর কয়েক বছরের মধ্যেই ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হয়ে ভিপি-তে পৌঁছে যাবে।

বিক্রম তখন মুখে পেশাদার হাসি ফুটিয়ে বলে চলেছেন, রঙ্গিলা আমাদের কোম্পানির সুপারব্রেন। ওর ম্যাজিকে আমাদের সেক্স ফিগার এক্সপোনেশিয়ালি বেড়ে চলেছে…।

কেন জানি না, বারবার সেক্স ফিগার কথাটা শুনতে-শুনতে আমার রঙ্গিলার ফিগারের দিকে নজর গেল। সবুজ ছককাটা চুড়িদারে ওকে সুন্দর মানিয়েছে। গাঢ় সবুজ ওড়নাটা যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই–অনেকটা পাশে সরে গেছে। তাই বোঝা গেল, ওর কাঠামো ছিপছিপে হলেও ও বেশ ফলন্ত গাছ। তবে ওর আকর্ষণের মধ্যে কোথায় যেন একটা সাবধানী শাসন রয়েছে।

সবমিলিয়ে যেটা বুঝলাম, রঙ্গিলা শর্মা আর-পাঁচটা মেয়ের মতো নয়।

আমার ধারণা যে কতটা সত্যি সেটা বুঝলাম আরও মাস-দেড়েক পর। কারণ, এর মধ্যে রঙ্গিলার সঙ্গে আমার অল্পবিস্তর বন্ধুত্ব হয়েছে। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই আমি ওর ঘরে গিয়ে হাজির হই। নতুন-নতুন বইয়ের পাবলিকেশান প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করি। ও চাবুকের মতো সব পরামর্শ দেয়, নানান বুদ্ধি দেয়, ইউনিক সব স্কিমের কথা বলে। তিরিশ বছরের একটা মেয়ের মুখ থেকে এসব শুনে আর কোনও সন্দেহ থাকে না যে, ও এক অদ্ভুত টাইপের জিনিয়াস।

ওর এই রহস্য আমাকে টানতে থাকে। কিন্তু ওর ব্যবহার দেখে সেরকম কোনও টান আমি টের পেতাম না।

রঙ্গিলা কোম্পানির প্রোডাকশন আর ডিস্ট্রিবিউশান ছাড়াও সেক্স-এর অনেকটাই দেখাশোনা করে। কোন বই কত প্রিন্ট রান দেওয়া হবে, কোন-কোন বই দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এইসব মেজর সিটির কোথায় কোথায় কত কপি করে পাঠাতে হবে, কোন টাইটেল-এর আনসোল্ড কপি রিটার্ন নেওয়া হবে–কোনটার হবে না সবই রঙ্গিলা শর্মা ঠিক করে দেয়। বলতে গেলে কোম্পানিতে রঙ্গিলাই যেন শেষ কথা।

কানাঘুষোয় শুনলাম, এ নিয়ে বিক্রম ভট্টাচার্যের বেশ ক্ষোভ আছে। কিন্তু ভদ্রলোক কাজপাগল পেশাদার মানুষ। কোম্পানির জন্যে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন। কোম্পানিকে বড় করে তোলার পেছনে ওঁর অনেক অবদান আছে। পনেরো বছর ইয়োর বুকস-এ আছেন। সেখানে রঙ্গিলা শর্মা মাত্র চারবছর।

কিন্তু মামুলি মেধার মানুষ আর জিনিয়াসের মধ্যে এটাই তো ফারাক!

রঙ্গিলা সারাটা দিন ওর কাচের দেওয়াল ঘেরা অফিসে বসে অঙ্ক কষে, ল্যাপটপে ঠকাঠক করে বোতাম টেপে, চোখের চশমাটাকে বারবার ঠেলে নাকের গোড়ায় তোলে। তারপর…সারাদিনের পরিশ্রমের পর হাসিমুখে ঘরের বাইরে বেরোয়। সারকুলেশান ম্যানেজার আশুতোষ শিভালকরের কাছে গিয়ে বলে, হান্ড্রেড অ্যান্ড ওয়ান গোস্ট স্টোরিজ টাইটেলটা মুম্বাই আউটলেটে দু-হাজার কপি পাঠান। আর কবিতা ভার্গবের ফেমাস পিল্ল, ফেমাস ড্রিমস হায়দ্রাবাদে যত আনসোল্ড কপি আছে–আপনি বলছিলেন বারোশো মতন–ওটা ইমিডিয়েটলি বেঙ্গালুরুতে পাঠিয়ে দিন। ও. কে.?

ও. কে.। শিভালকরের মুখ দেখে বোঝা যায় যে, তিনি খুশি হননি। কিন্তু ইয়োর বুকস এ এসব ব্যাপারে রঙ্গিলা শৰ্মাই শেষ কথা।

আর আমি এটাও জানি, শেষ পর্যন্ত রঙ্গিলাই জিতবে। খুব কম সময়ের মধ্যেই মুম্বই আর বেঙ্গালুরুর পাঠকরা ওই বই দুটোকে শুষে নেবে।

একদিন আমি শিভালকরের ঘরে ছিলাম। আমাদের নতুন তিনটে টাইটেল কেমন বাজার পাচ্ছে সে-সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। কথা শেষ করে উঠতে যাব হঠাৎই রঙ্গিলা ঘরে এসে ওর চমকে দেওয়া তিনটে সিদ্ধান্ত জানিয়ে গেল।

শিভালকর ব্যাজার মুখে থ্যাংক য়ু বলল।

রঙ্গিলা ঘরের বাইরে বেরোতেই আমিও বেরিয়ে এলাম। অফিসের করিডরে ওর পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে বললাম, আপনি কি ম্যাজিক জানেন?

ছোট্ট হেসে একঝলক তাকাল আমার দিকে ও ম্যাজিক নয়। ম্যাথমেটিক্স। ম্যাথমেটিক্স অফ ইভেন্ট স্পেকুলেশান।

ইভেন্ট স্পেকুলেশান?

হ্যাঁ। টাইম অ্যান্ড স্পেসে দুটো ইভেন্টকে একই কো-অর্ডিনেটে রাখতে পারলে আপনি যা চান তাই হবে। মানে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ের দেখা হতে পারে। দুটো গাড়ির অ্যাসিডেন্ট হতে পারে। একজন পাঠক একটা বই কিনে ফেলতে পারে..ব্যস…সিম্পল।

এর নাম সিম্পল?

কথা বলতে বলতে আমরা রঙ্গিলার চেম্বারে চলে এলাম।

ও চেয়ারে বসল। আমাকেও বসতে বলল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে সরাসরি তাকাল আমার দিকে : দেখুন, ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সিল্প নয়, তবে আমাকে লাস্ট পাঁচবছরে অনেক কমপ্লেক্স ক্যালকুলেশান করতে হয়েছে–তারপর ব্যাপারটা আমার কাছে সিল্ল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা অন্য কাউকে এক্সপ্লেইন করে বোঝানো বেশ কঠিন। তবে এর এসেন্স হল, ওই যে বললাম, ম্যাথমেটিক্স অফ ইভেন্ট স্পেকুলেশান…।

এসব তো সায়েন্স ফিকশানের মতো শোনাচ্ছে।

মতো কেন? এটা সত্যি সত্যিই সায়েন্স ফিকশান। ও মুচকি হেসে বলল।

বুঝলাম, এর বেশি ও খুলে বলবে না। আর বলবেই বা কেন? এটা তো ওর স্পেশাল সিক্রেট।

কিন্তু আমার কৌতূহল বেড়েই চলল। রঙ্গিলার মন্ত্রগুপ্তিটা কী? এমন নয় যে, সেটা জেনে আমি আমার প্রোমোশানের কাজে লাগাব। তবে কৌতূহলটা সবসময় আমাকে খোঁচাতে লাগল।

কিছুদিন পর আবার একটা ঘটনা ঘটল। রঙ্গিলার সেই সুপারম্যাথের ম্যাজিক। ঠিক জায়গায় ঠিক বইটা ঠিক সময়ে পাঠানো। আমরা প্রায় চারহাজার কপির বোনাস সেল পেলাম। ইয়োর বুকস এর সি অ্যান্ড এম-ডি আমেরিকা থেকে রঙ্গিলাকে স্পেশাল কনগ্রাচুলেশা নোট পাঠালেন। আমরাও ওকে অভিনন্দন জানালাম। ওর ছোট্ট হাসি দেখে বুঝলাম, এসব সাবাশি নেওয়া ওর অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে।

আমাদের অফিস বিল্ডিং-এর একতলায় একটা কফি শপ আছে। কাজের ফাঁকে কিছুটা বাড়তি সময় হাতে পেলে আমি ওখানে গিয়ে বসি। সেদিন রঙ্গিলাকে কফি খাওয়াব বলে কফি শপে নিয়ে গেলাম।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে একথা সে কথা বলতে বলতে আমি সেই চারহাজার কপির বোনাস সেলের প্রসঙ্গে গেলাম।

রঙ্গিলা তেরছা চোখে আমার দিকে তাকাল, ঠোঁটে একটুকরো হাসি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিছুই না–সিম্পলি ম্যাথমেটিক্স। আমি জানতাম ওখানে সাতদিনের একটা ন্যাশনাল স্পোর্টস ইভেন্ট আছে। সেটা দেখতে প্রচুর লোক জড়ো হবে তারা বিন্দাস মুডে থাকবে। যদি সেই সাতটা দিন স্টেডিয়ামের নিয়ারেস্ট বুকশপগুলোতে আমাদের স্পোর্টস টাইটেলগুলো রাখতে পারি তা হলে একটা স্ট্যাগারিং সেল পাওয়া যেতে পারে। তো তাই করলাম। সিম্পল।

এরপর আরও কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে গল্প করলাম বটে কিন্তু আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না। ওর সুপারম্যাথ আরও কী কী করতে পারে ভেবে আমার অবাক লাগছিল।

কয়েকমাসের মধ্যেই অন্যান্যদের মতো রঙ্গিলার ম্যাজিক আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। আমি ওর সঙ্গে গল্প-টল্প করলেও এ-নিয়ে আর কোনও কথা জিগ্যেস করতাম না। বরং মন দিয়ে নিজের কাজটা করতাম। কোন বই ছাপতে হবে, কোন বই রিপ্রিন্টে পাঠাতে হবে, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ইয়োর বুকস দিনকেদিন আরও ফুলে-ফেঁপে উঠতে লাগল।

চাকরিটা আমার ভালোই চলতে লাগল–শুধু বিক্ৰম ভট্টাচার্যের খবরদারি ছাড়া। আমাদের কোম্পানির মালিক বলবিন্দার নারুলা সারাটা বছর বলতে গেলে আমেরিকাতেই থাকেন। লোকটা যে ঠিক কত টাকার মালিক তা ও নিজেও জানে না। ওর অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে ইয়োর বুকস এর তুলনা করলে হাতির পাশে মাছিকে রাখতে হবে। তো এই মাছির খবরদারি করার দায়িত্বে রয়েছেন বিগ বস বিক্রম ভট্টাচার্য।

আমাদের অফিসটা পার্ক স্ট্রিটের একটা পুরোনো বিল্ডিং-এর ফোর্থ ফ্লোরে। প্রায় পাঁচহাজার স্কোয়ার ফুট জায়গা নিয়ে মোটামুটিভাবে সাজানো। রিসেপশানের এনক্লেভটা বড়, আমাদের পাবলিকেশানের নানান বইয়ের কভার দিয়ে সাজানো। তারপর রয়েছে অ্যাকাউন্ট্র ডিপার্টমেন্ট, ডিস্ট্রিবিউশান সেল, এডিটোরিয়াল গ্রুপ, স্টোর এইসব। এ ছাড়া কোম্পানির কয়েকজন হোমরাচোমরা –যেমন, এডিটর মনোজ বর্মন, সারকুলেশান ম্যানেজার আশুতোষ শিভালকর, রঙ্গিলা শর্মা, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কৃপাল সিং আর ভি পি বিক্রম ভট্টাচার্য–যার-যার ঘরে বসেন।

বিক্রম ভট্টাচার্য লোকটা কেমন যেন। চেহারায় বেঁটেখাটো। ময়লা রং। কপালে সবসময় ভাঁজ পড়েই আছে। সুট-টাই পরে অফিসে আসেন। কিন্তু কেন জানি না, আমার মনে হয় সুট টাই ওঁকে একদম মানায় না।

বিক্রমের সঙ্গে কারও তেমন সদ্ভাব নেই। কিন্তু তিনি সবসময় গা-জোয়ারি ব্যক্তিত্ব ফলাতে চেষ্টা করেন। লোকে ভয়ে বা ভক্তিতে ওঁর কথা শোনে। রঙ্গিলার সঙ্গে বিক্রমের প্রায়ই খটাখটি লাগে। কিন্তু রঙ্গিলা কোম্পানির কাছে যতই ইমপরট্যান্ট হোক বিক্রম ভট্টাচার্য বলবিন্দারের ব্লু আইড বয়। কারণ, কোম্পানির ছোট অবস্থা থেকে অনেক কান্না-ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে বিক্রম ইয়োর বুকস-কে ন্যাশনাল ম্যাপে এস্টাবলিশ করেছেন। অ্যানুয়াল অ্যাড্রেসে মিস্টার নারুলা সবসময় বিক্রমের স্যাক্রিফাইসের কথা বলেন। বলেন যে, মিস্টার ভট্টাচার্য ছাড়া ইয়োর বুকসক্‌স কে ভাবা যায় না। হি ইজ দ্য ক্যাপ্টেন অফ দিস ফ্লোটিং ভেসেল মাই ডিয়ারেস্ট ভেসেল ফর দ্যাট ম্যাটার।

এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কৃপাল সিং-এর বয়েস প্রায় সাতষট্টি। প্রায়ই ওঁর অসুখবিসুখ লেগে আছে। মাঝে-মাঝেই ওঁর রিটায়ারমেন্টের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সবাই জানে, কৃপাল সিং-এর জায়গায় রঙ্গিলা যখন-তখন যেতে পারে। তারপরই আর বাকি থাকবে মাত্র একটা ধাপ। বিক্রম ভট্টাচার্যের ভিপি-র চেয়ার। সেই চেয়ারের জন্যে রঙ্গিলার যে আকাঙ্ক্ষা আছে সেটা ওর কথায় মাঝে-মাঝে টের পেতাম। আর বিক্রম ভট্টাচার্য যে বুক পাবলিশিং-এর ব্যাপারটা ভালো বোঝেন না সেটা নিয়েও ও কমেন্ট করত। বলত, মিস্টার ভট্টাচার্য হলেন এসটিডি এমপ্লয়ি।

তার মানে?

মানে হল, সার্ভিস টিল ডেথ। হেসে বলত রঙ্গিলা, কবে কে কোম্পানির জন্যে কী স্যাক্রিফাইস করেছে সেটা ভাঙিয়ে দশ-পনেরো বছর চালিয়ে যাওয়াটা বড় বাড়াবাড়ি।

আমি তখন রঙ্গিলাকে লক্ষ করতাম। ওর চোখ ছোট হয়ে এসেছে। দু-ভুরুর মাঝে দু-একটা সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে। ঠোঁটের কোণে অপছন্দের ছাপ।

দু-সপ্তাহ পরপরই বিক্রম স্ট্র্যাটেজি মিটিং ডাকতেন। তখন আমরা সবাই ওঁর চেম্বারে গিয়ে হাজির হতাম। ভিজিটরদের জন্যে সাজানো চারটে চেয়ারে মনোজ বর্মন, আশুতোষ শিভালকর, কৃপাল সিং আর রঙ্গিলা বসে। আর আমরা স্মল ফ্রাইরা ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকি।

বিক্রম ওঁর মতো করে পাবলিশিং প্ল্যান, কোম্পানি পলিসি, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি এসব নিয়ে কথা বলেন। আমরা বাধ্য ছাত্রের মতো শুনি। তারই মধ্যে খেয়াল করি, রঙ্গিলা ওর চেয়ারে বসে উশখুশ করছে, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কখনও-বা হাই তুলছে।

বিক্রম ভট্টাচার্য কথা বলতে বলতে এই সিমটমগুলো লক্ষ করতেন। বুঝতেন, রঙ্গিলা ওঁর গুরুগম্ভীর কথাবার্তাগুলোকে একফোঁটাও আমল দিচ্ছে না। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে রাগ হলেও বিক্রম সে-রাগ চেপে রাখতেন। কারণ, তিনি জানেন, তিনি কোম্পানির যতই ব্লু আইড বয় হোন না কেন, রঙ্গিলার চোখের মণিও কম নীল নয়। রঙ্গিলাকে তাড়ানোর ক্ষমতা বিক্রমের নেই। কারণ, কোম্পানিতে রঙ্গিলার যে-কোনও কথাই বেদবাক্য। ওর কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা কারও নেই।

আমরা সবাই জানতাম, বিক্রম রঙ্গিলার কোনও একটা ভুলের জন্যে তক্কেতক্কে আছেন। ছোট বা বড়–যে-কোনও একটা ভুল। তা হলেই বিক্রম ওকে ছেটে ফেলতে পারবেন। কিন্তু ওঁর কপাল খারাপ। কোম্পানির সেলস ফিগার দিন দিন বেড়েই চলেছে আর রঙ্গিলাও কাগজ-পেন নিয়ে ল্যাপটপে খটাখট বোতাম টিপে ওর ম্যাথমেটিক্স অফ ইভেন্ট স্পেকুলেশান-এর ম্যাজিক দেখিয়ে চলেছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, আমাদের কোনও টাইটেল দশহাজার কপি বিক্রি হওয়ার মানে হল আমাদের চোখে সেটা অ্যাভারেজ সেল।

রঙ্গিলা আচমকা তিনটে কি চারটে হার্ড কভার বই সিলেক্ট করে কৃপাল সিং আর বিক্রম ভট্টাচার্যকে বলত সেই বইগুলোর পেপারব্যাক এডিশান বের করতে। আমরা এডিটোরিয়াল গ্রুপ থেকে স্টাডি করে দেখতাম যে, বইগুলোর তেমন পোটেনশিয়াল নেই। কিন্তু রঙ্গিলা সেগুলো ছাপার জন্যে ঝুলোঝুলি করত। বিক্রম ভট্টাচার্য যখন ওকে বোঝাতেন যে, বইগুলো হার্ড কভারে খুব কম বিক্রি হয়েছে তখন রঙ্গিলা বলত, তার মানেই তো, স্যার, বইগুলো বেশি লোক পড়েনি। পেপারব্যাক এডিশান বেরোলে পড়বে। এগুলোর পেপারব্যাক এডিশান রাইট আমাদের ইমিডিয়েটলি কেনা উচিত। আই হোপ নাউ য়ু এগ্রি, স্যার…।

আমরা পেপারব্যাক এডিশান বের করার পর বইগুলো মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হত। অর্থাৎ, শেষ পর্যন্ত রঙ্গিলার সুপারম্যাথই জিতত।

চাকরির স্তরবিচারে আমার আর রঙ্গিলার মধ্যে দূরত্ব থাকলেও আমরা একবছরের মধ্যেই ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। আর কৃপাল সিং-ও বয়েস আর অসুখের চাপে রিটায়ার করলেন। আমরা সবাই ভাবলাম, এইবার রঙ্গিলা শর্মাকে নিশ্চয়ই এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর করা হবে। কিন্তু আমাদের হিসেব মিলল না। কৃপাল সিং-এর স্লটটা বলবিন্দার নারুলা খালিই রেখে দিলেন। তখন নতুন একটা কানাঘুষো শুরু হল। নিজেদের মধ্যে অনেকে বলাবলি করতে লাগল যে, বিক্রম ভট্টাচার্যের চেয়ারটা খালি হলেই রঙ্গিলা এ-কোম্পানির ভিপি হয়ে বসবে। কিন্তু বিক্রম ভট্টাচার্যের চেয়ারটা কীভাবে খালি হবে সেটা কেউ বলতে পারল না।

একদিন সন্ধের পর একতলার কফি শপে বসে আমি আর রঙ্গিলা স্যান্ডউইচ আর কফি খাচ্ছিলাম। কথায় কথায় আবার ওর সুপারম্যাথের কথা উঠল।

এখন রঙ্গিলার সঙ্গে আমার রিলেশানটা এমনই যে, আপনি-আপনি-র বদলে আমরা তুমি তুমি করে কথা বলি। তা ছাড়া ইয়োর বুকস-এ আমার চাকরিও বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। তাই পুরোনো কৌতূহলটা আবার মাথাচাড়া দিল। ফস্ করে বলে ফেললাম, রঙ্গিলা, একটা সত্যি কথা বলব?

কী, বলো? কফির কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে ও চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে।

তোমার সিক্রেটটা আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে।

ও হাসল। বলল, প্রীতম, এতদিনে তুমি নিশ্চয়ই বুঝে গেছে, আমাদের অফিসে শকুন বেশি, মুনিয়া কম। য়ু আর ডিফরেন্ট–তাই আজ তোমাকে বলছি। বাট য়ু শুড কিপ ইট আ সিক্রেট।

প্রমিস।

ওয়েল, অঙ্কটা হচ্ছে নানান ইভেন্টের পারসেন্টেজের খেলা। লাস্ট পাঁচবছর ধরে এই অঙ্কটা নিয়েই আমি লড়ে গেছি। স্রেফ অঙ্ক কষে দুটো জিনিসকে এক জায়গায় মিট করানো যায়। মানে, একটা পারটিকুলার টাইমে একটা পারটিকুলার জায়গায় দুটো অবজেক্ট এসে মিট করবে। এটা করতে হলে সেই অবজেক্ট দুটো সম্পর্কে প্রচুর ডেটা থাকতে হবে–আর যে-কোনও একটার ওপর তোমার ইনাফ কন্ট্রোল থাকতে হবে। আই মিন, টু সাম এক্সটেন্ট তুমি তার মুভমেন্ট, অ্যাক্টিভিটি–এসব কন্ট্রোল করতে পারবে। অঙ্ক কষে আমি যেটা করি, ইভেন্ট স্পেকুলেশান। দুটো সিকোয়েন্স অফ ইভেন্ট্রকে দুটো অ্যাঙ্গেল থেকে স্টাডি করে একই জায়গায় নিয়ে এসে স্রেফ মিট করিয়ে দেওয়া। ব্যস–।

ব্যাপারটা আমার ম্যাজিকের চেয়েও বেশি কিছু বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু ওকে কিছু বললাম না।

ও বলে চলল, আর বই বিক্রির ব্যাপারে আমি যেটা করি সেটা হল, সাপ্লাই আর ডিমান্ডকে মিট করিয়ে দেওয়া। ঠিক যে-জায়গায় ডিমান্ড ডেভেলাপ করেছে আমি ঠিক সেই স্পটে বই পাঠিয়ে দিই। ব্যস–লোকে বই কেনে। ইট দ্যাট সি ।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ধুস, আরও গুলিয়ে গেল। তারপর শব্দ করে কফির কাপে চুমুক দিলাম। স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসালাম।

রঙ্গিলা আমাকে হাত নেড়ে বোঝাতে লাগল ও লুক, সাপোজ মুম্বইতে আমাদের হরার সিরিজের তিনটে টাইটেল নেক্সট থার্সডেতে তিনশোজন পাঠক কিনতে চাইবে। তখন আমি সেই বইটা মঙ্গলবারের মধ্যে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। তখন সাপ্লাই আর ডিমান্ড মিট করে যায়। আমার ইকুয়েশানগুলো সম্ভ করেই সব উত্তর আমি পেয়ে যাই। যখন কোনও খদ্দেরের একটা বই কেনার ইচ্ছে চাগিয়ে ওঠে ঠিক তখনই সেই পারটিকুলার বইটা আমি তার হাতের নাগালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।

স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে ও কফি শপের কাচের জানলার দিকে তাকাল। একটু আনমনা গলায় বলল, শুধু বই কেন, যে-কোনও দুটো অবজেক্ট নিয়ে আমি এরকম করতে পারি–অবশ্য, তাদের প্রচুর ডেটা আমার হাতে থাকা দরকার।

তো তুমি হঠাৎ বইয়ের লাইনে এলে কেন? পাবলিশিং ইজ নট দ্যাট অ্যাট্রাকটিভ।

টু মি, ইট ইজ ভেরি মাচ অ্যাট্রাকটিভ। হেসে বলল রঙ্গিলা, আমি পাবলিশিং ট্রেডকে ইনডাস্ট্রিতে কনভার্ট করতে চাই। এটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। পাবলিশিং বিজনেসের মেইন ড্রব্যাকটা কোথায় জানো? যখন একজন পাঠকের একটা বই কেনার ঝোঁক চাপছে তখন সেই বইটা সে হাতের কাছে পায় না। পরে যখন বইটা সে হাতের নাগালে পাচ্ছে তখন কিন্তু বইটা কেনার বেঁক কমে গেছে। অ্যাজ আ রেজাল্ট বইটা সে আর কিনছে না। সো য়ু গেট নো সেল। কিন্তু…। আমার দিকে তাকিয়ে কয়েকসেকেন্ড সময় নিল রঙ্গিলা। কফিতে ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর বলল, কিন্তু যদি সেই পাঠকের বই কিনতে চাওয়ার ইমপালসের মোমেন্টে তুমি বইটা তার হাতের কাছে পৌঁছে দিতে পারো তো কেল্লা ফতেয়ু গেট আ সেল।

আমি ভীষণ অবাক হচ্ছিলাম। রঙ্গিলা এসব বলছে কী! আজ ও খুব ক্যান্ডিড মুডে আছে। ওর সিক্রেট রুমের দরজা খুলে দিচ্ছে ধীরে-ধীরে। আর আমিও অন্ধকার ঘরটার ভেতরে উঁকি ঝুঁকি মারার চেষ্টা করছি।

বই ছাড়াও অন্য ইভেন্ট নিয়ে এরকম অঙ্ক তুমি করতে পারো?

কফি শেষ করে কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখল ও। তারপর নীচু গলায় বলল, অন্য ইভেন্ট নিয়ে এরকম করতে পারি কিনা? হ্যাঁ, পারি। কখনও ভেবে দেখেছ, যখন কোনও লোক গাড়িতে ধাক্কা খায় তখন একই জায়গায় ঠিক একই সময়ে দুটো অবজেক্ট এসে মিট করে? এই অবজেক্ট দুটো কিন্তু নানান চেইন অফ ইভে-এর মধ্যে দিয়ে এসে ওই পারটিকুলার মোমেন্টে মিট করেছে– যাকে আমরা বলি অ্যাক্সিডেন্ট। তা হলে ভেবে দ্যাখো, লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি ঘটনা–যাদের একটার সঙ্গে আর-একটার কোনও কানেকশান নেই কীভাবে এসে মিট করে! একটা ইভেন্ট চেইন কীভাবে আর-একটা ইভেন্ট চেইনকে ইন্টারসেক্ট করে!

এরকম কোনও ইভেন্ট চেইনকে তুমি কি সত্যিই কন্ট্রোল করতে পারো?

কিছু কিছু পারি। ঠোঁট টিপে হাসল রঙ্গিলা : আমি ক্যালকুলেট করতে পারি। ইভেন্ট স্পেকুলেশানের ম্যাথ অ্যাপ্লাই করতে পারি। সেসব করে ইভেন্ট চেইনের কয়েকটা টুকরোকে ম্যানিপুলেট করতে পারি। একজন পাঠক আর একটা বইকে একজায়গায় নিয়ে আসতে পারি। একটা গাড়ি আর একজন রাস্তা-পার-হওয়া মানুষকে ধাক্কা লাগাতে পারি। ইয়েস আই ক্যান।

ওর মুখের সিরিয়াস ভাব দেখে আমি হেসে ফেললাম : রঙ্গিলা, এবার ব্যাপারটা সায়েন্স ফিকশানকে ছাপিয়ে যাচ্ছে কিন্তু! তার মানে, তুমি বলছ বহু ঘটনার ফাইনাল ডেস্টিনেশান তোমার হাতে?

ডেস্টিনেশান মানে? রঙ্গিলা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল।

ডেসটিনি। আই মিন, য়ু থিংক য়ু ক্যান কন্ট্রোল ডেটিনি?

আমার প্রশ্নটায় ব্যঙ্গের ছোঁয়া থাকলেও রঙ্গিলা সেটাকে আমল দিল না। ও সিরিয়াস মুখে বলল, হ্যাঁ, প্রীতম, ডেসটিনি আমি কন্ট্রোল করতে পারি–খানিকটা অন্তত পারি।

এ নিয়ে কথাবার্তা সেখানেই শেষ হয়েছিল। তারপর কাজের চাপে ব্যাপারটা মন থেকে সরে গেল। নতুন একটা অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ লঞ্চ করার প্ল্যানিং নিয়ে আমাদের এডিটোরিয়াল গ্রুপ মেতে উঠল। আমি আর মনোজ বর্মন ঘনঘন মিটিং করতে লাগলাম। কলকাতা বুক ফেয়ার কাছাকাছি এসে গেল। প্রতি বছরের মতো ইয়োর বুকস-এ সাজ-সাজ রব পড়ে গেল।

সেইসময় একদিন বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ রঙ্গিলা আর বিক্রম ভট্টাচার্যের তুমুল খটাখটি লাগল। রঙ্গিলা চারটে আউট অফ প্রিন্ট পেপারব্যাক রিপ্রিন্টের জন্যে প্রোডাকশনের পাইপলাইনে দিয়েছিল, কিন্তু বিক্রম সেগুলো নাকচ করে দিয়েছেন।

রঙ্গিলা বেশ জোরালো গলায় বলল, আমার সিক্সথ সেন্স বলছে বুক ফেয়ারে এই বইগুলোর এক-একটা দুহাজার করে বিক্রি হবে। সেইজন্যেই আমি পাইপলাইনে ওগুলো দিয়েছি।

সরি, রঙ্গিলা। দিস টাইম আই উড গো বাই মাই সিক্সথ সেন্স। বইমেলায় নতুন টাইটেল হল টপ প্রায়োরিটি। অন্তত আমার কাছে। সো–।

এই চারটে টাইটেল হল হাই পোটেনশিয়াল মেটিরিয়াল–নতুন টাইটেলের চেয়ে কিছু কম নয়।

সো য়ু থিঙ্ক। বিক্রম ভট্টাচার্যের গলা সামান্য উঁচু হল।

ওঁর ঘরের বাইরে তখন আমাদের কয়েকজনের ভিড়। আমরা ভাবছি, জল কোনদিকে গড়ায়।

আমি তা হলে সি অ্যান্ড এম-ডি-কে ব্যাপারটা জানাচ্ছি। থমথমে গলায় বলল রঙ্গিলা।

অফ কোর্স জানান। আই উড লাভ দ্যাট। অ্যাজ পার দ্য রুস্ অফ দ্য কোম্পানি এক্সক্লডিং সি অ্যান্ড এম-ডি দ্য ভিপি অলওয়েজ হ্যাজ দ্য ফাইনাল সে। এক্সক্লডিং সি অ্যান্ড এম-ডি অ্যান্ড আই অ্যাম স্টিল দ্য ভিপি হিয়ার। য়ু হ্যাভন্ট গট মাই জব ইয়েট। আমি আটমোস্ট ট্রাই করব যাতে এই কোম্পানিতে আপনি সবসময় ভিপি-র চেয়ারের নীচেই থাকেন। ও. কে., নাউ য়ু ক্যান। বেগ ইয়োর লিভ, ম্যাম। এই কথা বলে বিক্রম ওঁর চেম্বারের কাচের দরজা খুলে ধরলেন।

গলা ধাক্কা দেওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত।

রঙ্গিলা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর মুখে এক অদ্ভূত নির্লিপ্ত ভাব। দেখে বোঝাই যায় না, একটু আগেই বিক্রম ভট্টাচার্য ওর ইগোতে হিংস্র কামড় বসিয়েছেন।

আমি ভাবলাম, এইবার বোধহয় কোম্পানিতে উথালপাতাল শুরু হবে, কলকাতা বইমেলার আগে একটা বোম-টোম কিছু ফাটবে।

কিন্তু কিছুই হল না।

এতে আমি যেমন অবাক হলাম, অফিসের আরও অনেকে অবাক হল। রঙ্গিলার বন্ধু হওয়ায় অনেকে আমার কাছে গোপন খবর শুনতে চাইল। কিন্তু আমি ছাই কিছু জানলে তো বলব।

বিক্রম ভট্টাচার্যের সঙ্গে ক্ল্যাশের দশ-বারোদিন পর একদিন অফিসের কাজে রঙ্গিলার চেম্বারে ঢুকেছি, দেখি ও ঘরের খোলা জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের রাস্তার দিকে মগ্ন হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ওর হাতে একটা ছোট নোটবই আর পেন। মাঝে-মাঝে কীসব লিখছে।

কী করছ? আমি জিগ্যেস করলাম।

রঙ্গিলা ওর কাজে এতই বিভোর যে, কোনও উত্তর দিল না।

কিন্তু ততক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি, ও কী করছে।

রঙ্গিলা পার্ক স্ট্রিট আর মিলটন স্ট্রিটের ক্রসিং-এর ট্র্যাফিক খুঁটিয়ে দেখছে। কটা গাড়ি যাতায়াত করছে তার হিসেব টুকে নিচ্ছে।

এরপর আরও কয়েকদিন ওকে একই অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। জানলা দিয়ে পার্ক স্ট্রিটের গাড়ি চলাচল দেখছে, নোট নিচ্ছে, আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে। তারপর সেই নোটবই থেকে প্রচুর ডেটা নিয়ে ল্যাপটপে যে বোতাম টিপে ঢোকাচ্ছে সেটাও লক্ষ করলাম।

বিক্রমের ওপরেও রঙ্গিলা নজর রাখতে লাগল। কখন তিনি অফিসে আসেন, কখন বেরোন, কখন লাঞ্চ সারেন, সবই খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

বিক্রম ভট্টাচার্য এমনিতে খুব ডিসিপ্লিন্ড আর পাংচুয়াল মানুষ। রোজ ঠিক পাঁচটায় তিনি অফিস থেকে বেরোন। এলিভেটরের জন্য লাইনে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যান। তারপর অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রিট ক্রস করেন। তারপর মিডলটন স্ট্রিটে বাঁক নিয়ে নিজের লাল রঙের ইন্ডিকা গাড়িতে ওঠেন। গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ি যান।

আমার মাথার মধ্যে ম্যাথমেটিক্স অফ ইভেন্ট স্পেকুলেশান-এর গল্প ঘোরাফেরা করতে লাগল। আমি জোর করে ওইসব আজগুবি রাবিশকে মাথা থেকে তাড়ালাম। ধুস, যতসব ফালতু ব্যাপার!

একদিন–সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার–পাঁচটা বাজতে পাঁচমিনিট নাগাদ বিক্রম যখন ওঁর চেম্বার থেকে বেরিয়ে চটপটে পা ফেলে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন রঙ্গিলা ওঁকে ডাকল।

স্যার।

বিক্রম থমকে দাঁড়ালেন। চোখে প্রশ্ন।

রঙ্গিলা তড়িঘড়ি ওঁর কাছে এগিয়ে গেল। তারপর নর্থ ইন্ডিয়া রিজিয়ানে আমাদের হোলসেল বিজনেস নিয়ে এলোমেলো কথা বলতে লাগল।

বিক্রম ভুরু কুঁচকে একবার নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকালেন। তারপর শুধুমাত্র রঙ্গিলা শর্মা বলেই ওর কথা শুনতে লাগলেন।

আমি অফিসের ওয়াল ক্লকের দিকে নজর দিলাম। ওঁরা তখনও কথা বলছে। লক্ষ করলাম, রঙ্গিলাও আড়চোখে ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে।

ঠিক পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড পার হওয়ামাত্রই রঙ্গিলা হঠাৎ করে থ্যাংক য়ু, স্যার বলে কথাবার্তায় আচমকা ইতি টানল। তারপর অনেকটা অশোভনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের চেম্বারের দিকে রওনা দিল।

বিক্রম ভট্টাচার্যও তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

আমি কী ভেবে রাস্তার দিকের একটা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

নীচে ব্যস্ত পার্ক স্ট্রিট।

একটা ঠান্ডা চোরা স্রোত আমার শরীরের ভেতরে বইতে শুরু করল। ভাবলাম, বিক্রমকে ডেকে সাবধান করি। কিন্তু কীসের জন্যে সাবধান করব? আমাকে পালটা ওঁর ধমক খেতে হবে।

দেখলাম, বিক্রম ভট্টাচার্য অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ফুটপাথের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর প্রথম সুযোগেই রাস্তা পার হতে শুরু করলেন।

রাস্তার মাঝবরাবর আসতেই একটা ট্যাক্সি পাগলের মতো ছুটে এসে বিক্রমকে ধাক্কা মারল। ওঁর শরীরটা শূন্যে ছিটকে গেল। তারপর…।

এরপর একমাস কেটে গেলেও আমার মন থেকে চোরা অস্বস্তিটা গেল না। বিক্রম অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর রঙ্গিলা শর্মা এখন আমাদের কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভিপির চেয়ারে গেলেও আমার সঙ্গে ও তুমি-তুমি-র বন্ধুত্বই বজায় রেখেছে। ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা দেখে অনেক সহকর্মীই আমাকে এখন পিঠ চাপড়ায়, আওয়াজ দেয়। আমিও বুঝতে পারি, রঙ্গিলার সঙ্গে আমার রিলেশানটা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। এরপর যদি একদিন আমাদের বিয়ে হয়, তারপর…।

তারপর আমাকে এই ভেবে সারাটা জীবন কাটাতে হবে যে, কবে ও আমাকে মাঝপথে দাঁড় করিয়ে আমার সঙ্গে ঠিক পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড কথা বলবে, দেরি করিয়ে দেবে। তারপর…।

ওই পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ডের ভয়েই আমি ইয়োর বুকস-এর চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress