চুয়াচন্দন – পর্ব ৭
সন্ধ্যার প্রাক্কালে দুই জন বাহির হইলেন। ব্রাহ্মণপল্লী হইতে অনেকটা উত্তরে গঙ্গাতীরে নৌ-কর সুত্রধরদের বাস। সেখানে উপস্থিত হইয়া দুই জনে দেখিলেন, রাশি রাশি স্তূপীকৃত শাল, পিয়াল, সেগুন, জারুল কাষ্ঠের প্রাকারের মধ্যে ছোট বড় নানাবিধ নৌকা তৈয়ার হইতেছে। কোনটির কংকালমাত্র গঠিত হইয়াছে, কোনটি পাটাতনে শোভিত হইয়া পূর্ণাঙ্গ হইয়া উঠিতেছে। বড় বড় বজরা—পঞ্চাশ দাঁড়ের নৌকা—কাহারও হাঙ্গর-মুখ, কেহ বা ময়ূরপঙ্খী, কেহ বা হংসমুখী। আবার ক্ষুদ্রকায় ডিঙ্গি, সংকীর্ণ-দেহ ছিপও আছে। কোনটি সম্পূর্ন হইয়াছে, কোনটি এখনও অসম্পূর্ণ।
দুই জনে অনেক নৌকা দেখিয়া শেষে একটি ডিঙ্গি পছন্দ করিলেন। ডিঙ্গির সুন্দর গঠন, আড়াই হাত চওড়া, আট হাত লম্বা—শোলার মত হালকা। মাত্র চারি জন লোক তাহাতে বসিতে পারে।
নিমাই পণ্ডিত ছুতারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাম কত?”
ছুতার কিন্তু ডিঙ্গি বেচিতে রাজী হইল না, বলিল, “ফরমাশী ডিঙ্গি।”
চন্দনদাস জিজ্ঞাসা করিল, “এ ডিঙ্গির জন্য কত দাম পাবে?”
ছুতার একটু বাড়াইয়া বলিল, “তিন তঙ্কা।”
চন্দনদাস নিঃশব্দে তাহার হাতে এক মোহর দিল। ছুতার স্বপ্নেও এত মূল্য কল্পনা করে নাই, সে কিছুক্ষণ হতবাক্ থাকিয়া মহানন্দে ডিঙ্গির মালিকত্ব চন্দনদাসকে সমর্পন করিল।
ডিঙ্গি তৎক্ষণাৎ গঙ্গার জলে ভাসানো হইল। নিমাই পণ্ডিত ও চন্দনদাস তাহাতে আরোহন করিয়া দুই জোড়া দাঁড় হাতে লইলেন। দাঁড়ের আঘাতে ডিঙ্গি জ্যা-মুক্ত তীরের মতো জলের উপর ছুটিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ গঙ্গাবক্ষে দাঁড় টানিয়া উভয়ে দেখিলেন, ডিঙ্গি নির্দোষ ও অতি সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। দুই জনে সন্তুষ্ট হইয়া তীরে ফিরিলেন। তারপর নৌকা ছুতারের তত্ত্বাবধানে রাখিয়া নিমাই পণ্ডিত বলিলেন, “কাল বৈকালে আমি এসে ডিঙ্গি নিয়ে যাব।”
ছুতার সাহ্লাদে এক দিনের জন্য নৌকা রাখিতে সম্মত হইল।
অতঃপর নিমাই পণ্ডিত গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। চন্দনদাসের তখনও কাজ শেষ হয় নাই, সে গঙ্গার ধার দিয়া ঘাটের দিকে চলিল।
যে ঘাটে দ্বিপ্রহরে নৌকা বাঁধিয়াছিল, সেই ঘাটে যখন উপস্থিত হইল, তখন সন্ধ্যার ছায়া ঘনীভূত হইয়া আসিতেছে। ঘাটে কয়েকটি ক্ষুদ্র ডিঙ্গি বাঁধা ছিল; চন্দনদাস কয়েকজন মাঝিকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাপু, তোমরা জেলে তো?”
“আজ্ঞে, কর্তা।”
“তোমাদের মোড়ল কে?”
একজন বৃদ্ধ-গোছের জেলে বলিল, “আজ্ঞে কর্তা, আমি মোড়ল। আমার নাম শিবদাস।”
“বেশ। তোমার সঙ্গে আমি কিছু কারবার করতে চাই। এখানে যত জেলে আছে, সবাই তোমার অধীন তো?”
“আজ্ঞে।”
“কত জেলে-ডিঙ্গি তোমাদের আছে?”
“তা—ত্রিশ-চল্লিশখানা হবে।”
“বেশ। শোনো; তোমাদের যত জেলে-ডিঙ্গি আছে, সব আমি ভাড়া করলাম। তোমরা জেলে-মাঝির দল কাল বেলা তিন পহরের সময় বেরুবে; বেরিয়ে সটান স্রোতের মুখে দক্ষিণে গিয়ে শান্তিপুরের ঘাটে নৌকো বাঁধবে। তারপর সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। সন্ধ্যে পর্যন্ত আমি যদি না যাই, আহলে আবার ফিরে আসবে।—বুঝলে?”
“বুঝলাম কর্তা। কিন্তু কাজটা কি, তা তো এখনও জানতে পারিনি।”
“কাজের কথা শান্তিপুরের ঘাটে জানতে পারবে। কেমন, রাজী আছ?”
“আজ্ঞে, গররাজী নই। কিন্তু ধরুন, শান্তিপুরের ঘাটে যদি আপনার দেখা না পাই?”
“বলেছি তো, তাহলে ফিরে আসবে।”
“কিন্তু আমাদের যাওয়া-আসা যে তাহলে না-হক হয়রানি হয়, কর্তা। আপনাকে তখন পাব কোথায়? আপনাকে তো চিনি না।”
চন্দনদাস হাসিয়া বলিল, “তা হলেও তোমাদের লোকসান হবে না। তোমাদের অর্ধেক ভাড়া আমি আগাম দিয়ে যাব। সব নৌকো শান্তিপুরে যাওয়া-আসার জন্য কত ভাড়া লাগবে?”
শিবদাস মোড়ল বিবেচনা করিয়া বলিল, “আজ্ঞে, দশটি তঙ্কার কমে হবে না।”
চন্দনদাস একটু ব্যবসাদারি করিল। কারণ, এক কথায় রাজী হইয়া গেলে জেলেরা কিছু সন্দেহ করিতে পারে। কিছুক্ষণ কষা-মাজার পর নয় তঙ্কা ভাড়া ধার্য হইল। চন্দনদাস পাঁচ তঙ্কা শিবদাস মোড়লের হাতে দিয়া বলিল, “এই নাও। কিন্তু কথার নড়চড় যেন না হয়।”
“আজ্ঞে”—শিবদাস মুদ্রা গণিয়া লইল, “আপনি নিশ্চিন্দি থাকুন কর্তা, ঠিক সময়ে আমরা শান্তিপুরের ঘাটে হাজির থাকব—“
“সব ডিঙ্গি নিয়ে যাবে, একখানাও বাদ না পড়ে।”
“আজ্ঞে, একখানাও বাদ পড়বে না।”
এইরূপে নবদ্বীপ হইতে সমস্ত ডিঙ্গি তফাৎ করিবার বন্দোবস্ত করিয়া চন্দনদাস কতকটা নিশ্চিন্তমনে নিমাই পণ্ডিতের গৃহে ফিরিল। সেইখানেই তাহার রাত্রিতে থাকিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল।