চুয়াচন্দন – পর্ব ৫
ওদিকে চন্দনদাস তীরবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া দিয়াছিল। দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে, পথে লোকজন কম। চন্দনদাস ধাবমান ঘোড়ার পিঠে বসিয়া চিন্তা করিতেছিল—এখন কর্তব্য কি? প্রথমত, চুয়াকে রক্ষা করিতে হইবে। মাধবের নাকে কিল মারার ফলে তাহার ক্রোধ কোন্ পথে লইবে, অনুমান করা কঠিন; মাধব চুয়ার কথা ভুলিয়া তাহার প্রতি ধাবমান হইতে পারে; তাহাতে চুয়া কিছুক্ষণের জন্য রক্ষা পাইবে। দ্বিতীয়ত, তাহার নৌকা বাঁচাইতে হবে। ক্রোধান্ধ মাধব প্রথমে তাহাকেই ধরিতে আসিবে; তখন তাহার অমূল্য পণ্য ও সোনাদানায় বোঝাই নৌকা লুণ্ঠিত হইবে। মাধব রেয়াৎ করিবে না।
ঘাটে পৌঁছিবার পূর্বেই চন্দনদাস কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিল। অশ্বত্থ-শাখায় ঘোড়া বাঁধিয়া সে দ্রুতপদে নৌকায় গিয়া উঠিল; দেখিল, মাঝি-মাল্লারা আহার করিতে বসিয়াছে। চন্দনদাস সর্দার-মাঝিকে ডাকিয়া পাঠাইয়া বলিল, “এখনি নৌকো খুলতে হবে।”
হতবুদ্ধি মাঝি বলিল, “এখনি? কিন্তু—“
“শোনো, তর্ক করবার সময় নেই। এই দণ্ডে নৌকো খোলো—পাল আর দাঁড় দুই লাগাও। আজ সন্ধ্যে পর্যন্ত যতদূর সম্ভব উজান বেয়ে যাবে, তারপর গাঙের মাঝখানে নোঙর ফেলবে। আমি যতদিন না ফিরি সেইখানে অপেক্ষা করবে। বুঝলে?
“আপনি সঙ্গে যাবেন না?”
“না। এখন যাও, আর দেরি করো না। যতদিন আমি না ফিরি সাবধানে নৌকো পাহারা দিও।”
“যে আজ্ঞা”—বলিয়া প্রাচীন মাঝি চলিয়া গেল। মুহূর্ত পরে দুই নৌকার মাঝি-মাল্লার হাঁকডাক ও পাল তোলার হুড়াহুড়ি আরম্ভ হইল। এই অবকাশে চন্দনদাস নৌকার পশ্চাতে মাণিকভাণ্ডারে গিয়া কিছু জিনিস সংগ্রহ করিয়া লইল। প্রথমে সিন্দুক হইতে মোহর-ভরা একটা সর্পাকৃতি লম্বা থলি বাহির করিয়া কোমরে জড়াইয়া লইল। যে-কার্যে যাইতেছে, তাহাতে কত অর্থের প্রয়োজন কিছুই স্থিরতা নাই; অথচ বোঝা বাড়াইলে চলিবে না। চন্দনদাস ভাবিয়া চিন্তিয়া একছড়া মহামূল্য সিংহলী মুক্তার হার গলায় পরিয়া লইলা। যদি মোহরে না কুলায়, হার বিক্রয় করিলে যথেষ্ট অর্থ পাওয়া যাইবে।
এ ছাড়া আরও দুইটি জিনিস চন্দনদাস সঙ্গে লইল। একটি ইস্পাতের উপর সোনার কাজ করা ছোট ছোরা; এটি সে কোচিনে এক আরব বণিকের নিকট কিনিয়াছিল। দ্বিতীয়, এক কাফ্রির উপহার একটি লোহার কাঁটা। কৃষ্ণবর্ণ দ্বিভুজ লোহার কাঁটা, সেকালে শৌখীন স্ত্রী-পুরুষ এইরূপ কাঁটা চুলে পরিত। এই কাঁটার বিশেষত্ব এই যে, ইহার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ শরীরের কোনও অংশে ফুটিলে তিনবার নিশ্বাস ফেলিতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হইবে। চন্দনদাস কাঁটার সূক্ষ্ণাগ্র সোনার খাপে ঢাকিয়া সাবধানে নিজের চুলের মধ্যে গুঁজিয়া লইল।
নৌকা হইতে নামিয়া চন্দনদাস নগরের ভিতর দিয়া আবার হাঁটিয়া চলিল। ঝাঁ-ঝাঁ দ্বিপ্রহর, আশেপাশে দোকানের মধ্যে দোকানী নিদ্রালু; মধ্যাকাশ হইতে সূর্যদেব প্রখর রৌদ্র ঢালিয়া দিতেছেন। গাছ-পালা পর্যন্ত নিঝুম হইয়া পড়িয়াছে; মানুষ গৃহতলের ছায়ায় আশ্রয় লইয়াছে।
কিছুদূর যাইবার পর একটা মোড়ের মাথায় পৌঁছিয়া চন্দনদাস এবার কোন্ পথে যাইবে ভাবিতেছে, এমন সময় তাহার চোখে পড়িল, একটা নয়-দশ বছরের কটিবাসপরিহিত শীর্ণকায় বালক প্রচণ্ড মার্তণ্ড-ময়ূখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া পথের মধ্যে একাকী ডাণ্ডাগুলি খেলিতেছে। চন্দনদাস হাতছানি দিয়া তাহাকে ডাকিল। বালক ক্রীড়ায় বিরাম না দিয়া, যষ্টির আঘাতে ক্ষুদ্র কাষ্ঠখণ্ডটিকে চন্দনদাসের দিকে তাড়িত করিতে করিতে তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তারপর প্রবীণের মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চন্দনদাসের বেশভূষা নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, “সওদাগর! সমুদ্দুর থেকে আসছ—ন্যাঃ?”
বালকের ভাষা ও বাক্প্রণালী অতি অদ্ভুত—আমরা তাহা সরল ও সহজবোধ্য করিয়া দিলাম।
চন্দনদাস বলিল, “হ্যাঁ। নিমাই পণ্ডিতের বাড়ি কোথায় জানিস?”
বালক বলিল, “হিঃ—জানি।”
“আমাকে সেখানে নিয়ে চল্।”
বালকের ধূর্ত মুখে একটু খানি হাসি দেখা দিল, সে এক চক্ষু মুদিত করিয়া বলিল, “ডাংগুলি খেলছি যে।”
“পয়দা দেব।”
আকর্ণ দণ্ডবিকাশ করিয়া বালক হাত পাতিল, “আগে দাও।”
চন্দনদাস তাহাকে একটা কপর্দক দিল, তখন দে আবার ডাংগুলি খেলিতে খেলিতে পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল।
বেশি দূর যাইতে হইল না’ নিম্ববৃক্ষচিহ্নিত একটা আবড়ি যষ্টি-নির্দেশে দেখাইয়া দিয়া বালক প্রস্থান করিতেছিল, চন্দনদাস তাহাকে ফিরিয়া ডাকিয়া বলিল, “তুই যদি আর একটা কাজ করিতে পারিস, তোকে চারটে পয়সা দেব।”
“কি?”
“কাঞ্চন বেনের বাড়ি জানিস?”
বালকের চক্ষু উজ্জ্বল হইল, “চুয়া? মাধায়ের কইমাছ? জানি।—হি হি!”
চন্দনদাসের ইচ্ছা হইলে, অকালপক্ক ছোঁড়ার গালে একটা চপেটাঘাত করে; কিন্তু সে কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করিয়া বলিল, “হ্যাঁ, চুয়া। শোন্, তার বাড়ির সামনে দিয়া যাবি, কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করবি না, কেবল দেখে আসবি, সেখানে কি হচ্ছে। পারবি?”
বালক বলিল, “হিঃ—পয়দা দাও।”
চন্দনদাস মাথা নাড়িয়া বলিল, “না, আগে খবর নিয়ে আসবি, তবে পয়সা পাবি। আমি এখানেই থাকব।”
বালক ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া মনে মনে গবেষণা করিল, চন্দনদাসকে বিশ্বাস করা যাইতে পারে কি না? শেষে ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইয়া পূর্ববৎ ডাংগুলি খেলিতে খেলিতে প্রস্থান করিল।
চন্দনদাস তখন নিমাই পণ্ডিতের গৃহে প্রবেশ করিল। সম্মুখেই টোলের আটচালা; ছাত্ররা কেহ নাই, নিমাই পণ্ডিত একাকী বসিয়া আছেন। তাঁহার কোলে তুলতের একখানি নূতন পুঁথি; পাশে লেখনী ও মসীপাত্র। চন্দনদাসের পদশব্দে নিমাই পণ্ডিত মুখ তুলিলেন; প্রশান্ত বিশাল চক্ষু হইতে শাস্ত্র-চিন্তাজনিত স্বপ্নাচ্ছন্নতা দূর করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাকে চান?”
চন্দনদাস বলিল, “নিমাই পণ্ডিতকে।”
“আমিই নিমাই পণ্ডিত।”
পাদুকা খুলিয়া চন্দনদাস গিয়া নিমাই পণ্ডিতকে প্রণাম করিল। নিমাই পণ্ডিত বয়সে তাহার অপেক্ষা ছোট হইলেও ব্রাহ্মণ। তুলসীপাতার ছোট বড় নাই।
নিমাই পণ্ডিত প্রণাম গ্রহণ করিয়া বলিলেন, “দেখেছি বলে মনে হচ্ছে—আপনিই কি আজ দুখানি নৌকা নিয়ে সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরেছেন?”
চন্দনদাস বিনীতভাবে বলিল, “আজ্ঞা হাঁ, আমিই।”
নিমাই পণ্ডিত হাসিয়া বলিলেন, “আজ আপনার নৌকার ঢেউয়ে নবদ্বীপের একটি অমূল্য রত্ন ভেসে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে রক্ষা করা গিয়েছে। যা হোক, আপনি—?“
চন্দনদাস নিজের পরিচয় দিয়া শেষে করজোড়ে বলিল, “আপনি ব্রাহ্মণ এবং মহাপণ্ডিত, আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলে আমার অপরাধ হয়।”
নিমাই পণ্ডিত বলিলেন, “বেশ, কি ব্যাপার বলো তো?”
চন্দনদাস বলিল, “একটা কাজে আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি। নবদ্বীপে কাউকে আমি চিনি না, কেবল আপনার নাম শুনেছি। শুনেছি, আপনি শুধু অপরাজেয় পণ্ডিত নন, সৎকার্য করবার সাহসও আপনার অদ্বিতীয়। আমাকে সাহায্য করবেন কি?”
নিমাই পণ্ডিত বুঝিলেন, বণিকতনয় আজ গুরুতর কোনও কাজ আদায় করিতে আসিয়াছে, মৃদুহাস্যে বলিলেন, “তোমার নম্রতা আর বিনয় দেখে ভয় হচ্ছে। যা হোক্, প্রস্তাবটা কি শুনি?”
চন্দনদাসও হাসিল; বুঝিল, নিমাই পণ্ডিতকে মিষ্ট চাটুকথায় বিগলিত করা চলিবে না, তাঁহার সহিত অকপট ব্যবহার করাই শ্রেয়ঃ। সে ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল, “আপনি কাঞ্চন বেনের মেয়ে চুয়াকে জানেন?”
নিমাই পণ্ডিত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চন্দনদাসের মুখের পানে চাহিলেন। তাঁহার মুখ ঈষৎ গম্ভীর হইল, বলিলেন, “জানি। চুয়ার কথা নবদ্বীপের সকলেই জানে।”
চন্দনদাস বলিয়া উঠিল, “তবু তাকে উদ্ধারের চেষ্টা কেউ করে না?”
নিমাই পণ্ডিত স্থির হইয়া রহিলেন, কোনও উত্তর দিলেন না।
চন্দনদাস তখন বলিল, “আমি চুয়াকে বিয়ে করতে চাই। আপনি সহায় হবেন কি?”
নিমাই পণ্ডিত বিস্মিত হইলেন। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া কোল হইতে পুঁথি নামাইয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “কিন্তু চুয়া সম্বন্ধে সব কথা তুমি জানো কি?”
“যা জানি, আপনাকে বলছি।”—এই বলিয়া আজ নৌকা হইতে নামিবার পর এ পর্যন্ত যাহা যাহা ঘটিয়াছিল সমস্ত সবিস্তারে বর্ণনা করিল; শেষে কহিল, “এই নির্বান্ধব পুরীতে চুয়া যেমন একা, আমিও তেমনি একা। এখন আপনি যদি সাহায্য করেন, তবেই কিছু করিতে পারি। নচেৎ একটি বালিকার সর্বনাশ হয়।”
নিমাই পণ্ডিত ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া চিন্তামগ্ন হইলেন।
এই সময় সেই বালক ডাংগুলি হস্তে ফিরিয়া আসিল। চন্দনদাস সাগ্রহে তাহাকে কাছে ডাকিতেই সে বলিল, “চুয়ার বাড়ির সামনে দুটো পাক্ বসে আছে; যে যাচ্ছে তারে হুমকি দিচ্ছে।”
“আর কি দেখলি?”
“চুয়া আর তার ঠান্দি ঘরে আছে। চাঁপা নাপতিনী বুড়ির সাথে কোঁদল করছে।”
“আর কিছু?”
“আর মাধাই চন্নন বেনের ডিঙ্গি লুঠ করতে গেছে। পয়সা দাও।”
খুশি হইয়া চন্দনদাস বালককে চার পয়সার স্থলে দু’গণ্ডা দিল। হৃষ্ট বালক তীক্ষ্ণস্বরে একবার “উ—“ বলিয়া উল্লাস জ্ঞাপনপূর্বক ডাংগুলি খেলিতে খেলিতে প্রস্থান করিল।
বালককে বিদায় করিয়া চন্দনদাস নিমাই পণ্ডিতের দিকে ফিরিতেই তিনি উদ্দীপ্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “আমি তোমাকে সাহায্য করব। তোমার উদ্যম প্রশংসনীয়; আমরা গাঁয়ের লোক যা করিনি, তুমি বিদেশী তাই করতে চাও। তোমার স্বার্থ আছে জানি, কিন্তু তাতে তোমার মহত্ত্বের কিছু মাত্র হানি হয় না; আমি কি করতে পারি বলো।”
চন্দনদাস বলিল “তা আমি জানি না। আপাতত পরামর্শ দিতে পারেন।”
“বেশ, এসো, পরামর্শ করা যাক। মাধব যে রকম দুর্ধর্ষ পাষণ্ড, তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে কোনও ফল হবে না। আমার মনে হয়—“
চন্দনদাস বলিল, “একটি নিবেদন আছে। আমার বড় তৃষ্ণা পেয়েছে; ব্রাহ্মণবাড়ি একটু পাদোদক পেতে পারি?”
নিমাই সচকিত হইয়া বলিলেন, “তুমি এখনও আহার করোনি?”
চন্দনদাস হাসিয়া বলিল, “না, কেবল চুয়ার দেওয়া একখানি বাতাসা খেয়েছি।”
“কি আশ্চর্য! এতক্ষণ বলোনি কন? দাঁড়াও, আমি দেখি।”—বলিয়া খড়ম পরিয়া ত্বরিতে অন্দরে প্রবেশ করিলেন।
বেলা তখন তৃতীয় প্রহর। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী ভৃত্য-পরিজন সকলকে খাওয়াইয়া নিজে আহারে বসিতে যাইতেছিলেন, নিমাই গিয়া বলিলেন, “একজন অতিথি এসেছে। খেতে দিতে পারবে?”
বিষ্ণুপ্রিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “পারব।” তারপর ক্ষিপ্রহস্তে দালানে জল-ছড়া দিয়া পিঁড়ি পাতিয়া নিজের অন্নব্যঞ্জন অতিথির জন্য ধরিয়া দিয়া স্বামীর মুখের পানে চাহিলেন।
নিমাই দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলেন, স্মিতমুখে চন্দনদাসকে ডাকিতে গেলেন। এই নীরব কর্মপরায়ণা অনাদৃতা বধূটি ক্ষণকালের জন্য নিমাই পণ্ডিতের মন হইতে লক্ষ্মীদেবীর স্মৃতি মুছিয়া দিল।
অতঃপর চন্দনদাস পরিতোষপূর্বক ব্রাহ্মণগৃহে প্রসাদ পাইল।