Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য || Sankar Brahma

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য || Sankar Brahma

চন্দ্রগুপ্তের ছোটবেলা সম্পর্কে খুব বেশি খবর জানা যায় না। সংস্কৃত, গ্রিক ও লাতিন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক রচনা থেকে কিছু খবর জানা সম্ভব হয়েছে। চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর ৭০০ বছর পরে রচিত সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষসে তাকে নন্দের বংশধর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নন্দরাজ্যের রাণীর এক দাসী ছিল, যার নাম ছিল মুরা। একদা নন্দরাজ দাসী মুরার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। তার গর্ভসঞ্চার হয়। লোকলজ্জার ভয়ে নন্দরাজ মুরা ও তার সন্তানের কথা গোপন রাখেন।
বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশে চন্দ্রগুপ্তকে মোরিয় নামক একটি ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপরিনিব্বাণ সুত্ত অনুসারে, মোরিয়রা উত্তর ভারতের পিপ্পলিবনের ক্ষত্রিয় গোষ্ঠী ছিলেন। মহাবংশটীকা অনুসারে, তাকে শাক্য-বংশের ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম হয়। কথিত আছে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর, তিনি তাঁর মায়ের সাথে পাটালিপুত্রে আসেন। শৈশবে তাঁর মা তাঁর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন এক গো-পালককে। কিন্তু এই গো-পালক চন্দ্রগুপ্তকে এক শিকারীর কাছে বিক্রয় করে দেন। এই শিকারীটিও তাঁকে গো-চারণে নিযুক্ত করেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাখাল বালকদের নেতা হয়ে উঠেন। এই সময় তক্ষশীলাবাসী চাণক্য (কৌটিল্য), চন্দ্রগুপ্তের দেহে রাজ-চিহ্ন দেখে শিকারীর কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্তকে কিনে নেন। তারপর চাণক্য তাঁকে তক্ষশীলায় নিয়ে আসেন। এরপর চাণক্য তাঁকে রাষ্ট্রবিদ্যা এবং সমরবিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলেন। পরে চাণক্য উচ্চাশিক্ষার জন্য তাঁকে পাটালিপুত্রে পাঠান। এই সময় পাটালিপুত্রের রাজা ছিলেন নন্দরাজ ধননন্দ।


নন্দরাজ অত্যন্ত অত্যাচারী রাজা ছিলেন। এই কারণে পাটালিপুত্রের অধিবাসীরা ধননন্দের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। এই সময় আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। মূলত খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আলেকজান্ডার ভারতের দিকে অভিযান শুরু করেন। আর খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় এসে উপস্থিত হন। চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে উৎখাত করার লক্ষ্যে গ্রিকদের সাহায্য পাওয়ার জন্য আলেকজান্ডারের শিবিরে যান। আলেকজান্ডার প্রথমে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের উদ্ধত ব্যবহারের জন্য, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যু দণ্ডাদেশ দেন। চন্দ্রগুপ্ত কৌশলে গ্রিক সৈন্যদের হাত থেকে পালিয়ে বিন্ধ্যাপর্বতের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এই সময় নন্দরাজ কর্তৃক অপমানিত হয়ে চাণক্য এই বনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই বনে উভয়ের দেখা হওয়ার পর, উভয়ই নন্দরাজের পতনের লক্ষ্যে একমত হন। প্রাথমিকভাবে সৈন্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে সাহায্য করেন।
চাণক্য নামক তক্ষশিলার এক কূটনৈতিক ব্রাহ্মণের নিকট শিক্ষালাভ করেন ও দুইজনে মিলে নন্দ সম্রাট ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নাটকে ও জৈন গ্রন্থ পরিশিষ্টপার্বণ গ্রন্থে হিমালয়ের একটি পার্বত্য রাজ্যের রাজা পর্বতেশ্বর বা পর্বতকের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের মিত্রতার কথা উল্লিখিত রয়েছে। এই রাজা এবং পুরুষোত্তম একই ব্যক্তি বলে অনেক ঐতিহাসিক মত দিয়েছেন।
এরপর চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথম দু’টি যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত পরাজিত হয়ে অরণ্যে আশ্রয় নেন। তৃতীয় বারের যুদ্ধে তিনি নন্দরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। অনেকে মতে আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের পর, যে গ্রিক সৈন্যরা ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল শাসন করছিলেন, তাঁরা চন্দ্রগুপ্তকে এই যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন। কথিত আছে এই যুদ্ধে দশ হাজার হাতি, এক লক্ষ অশ্বারোহী এবং পাঁচ হাজার রথচালক নিহত হয়েছিল। আনুমানিক ৩২৪-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে পরাজিত করে রাজত্ব লাভ করেন। মহাবংশ-টীকা গ্রন্থ মতে নন্দরাজ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। অন্যমতে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে সামান্য কিছু আসবাবপত্র দিয়ে, তাঁর পরিবার পরিজন সহ নন্দরাজকে পাটালিপুত্র থেকে বিতারিত করেছিলেন।

তাঁর সিংহাসন লাভের সময় নিয়ে মতভেদ আছে। মতগুলো হলো ―

খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৩ অব্দ (কারপেন্টার)
খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৮ অব্দ (সেইন্ট)
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০ অব্দ (ফ্লিট)
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দ (স্মিথ)
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দ (রাধাকমল মুখার্জি)
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫ অব্দ (কানিংহাম, জয়স্বাল)

ইরফান হাবিবএবং বিবেকনন্দ ঝায়ের মতে চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল – ৩২২-২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। উপন্দর সিংয়ের মতে- ৩২৪ বা ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ক্রিস্টিলির মতে – ৩২০ থেকে ২৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। বৌদ্ধ গ্রন্থ মতে, চন্দ্রগুপ্ত ২৪ বছর রাজত্ব করেন।

নন্দরাজকে পরাজিত করে তিনি পাঞ্জাব ও গঙ্গা-যমুনা উপত্যাকার অধিকার লাভ করেন। এরপর তিনি উত্তরভারতের গ্রিক সৈন্যদের তাড়াবার উদ্যোগ নেন। তিনি গ্রিকদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ করে গ্রিক সেনাপতি সেলিউকসকে পরাজিত করেন এবং আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের ব্যকট্রিয় থেকে সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁর অধিকারে আনেন। আলেকজান্ডার চন্দ্রগুপ্তের কাছে অ্যারাকোসিয়া (কান্দাহার), গেড্রোসিয়া (মায়ান) এবং পারপোনিসাদাই (পারপোমিসাডে, কাবুল) ছেড়ে দেন।
এরপর তিনি প্রায় ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে পশ্চিম ভারতের মালব ও সৌরাষ্ট্র দখল করেন। তারপর তিনি দক্ষিণ ভারতে অভিযান চালান। ঠিক কতদূর পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ ভারতকে তাঁর রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এ নিয়ে মতভেদ আছে।
তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে গ্রিক সেনাপতি সেলিউকস আবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৫ অব্দের দিকে গ্রিকরা এই আক্রমণ করেছিল। এসময় বড় ধরনের কোনও যুদ্ধ হয়েছিল কিনা তা ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে জানা যায় না। তবে ছোটোখাটো একটা যুদ্ধ যে হয়েছিল, তা জানা যায় গ্রিক ঐতিহাসিক স্ট্রাবোর বিবরণ থেকে। এই বিবরণে যুদ্ধের বিবরণ নেই, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের সাথে সেলিউকস-এর মৈত্রী চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল সেটা জানা যায়। এই মৈত্রীচুক্তির সময় সেলিউকস তাঁর কন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময় সেলিয়াকাস-এর রাষ্ট্রদূত হিসেবে মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের দরবারে স্থান পেয়েছিলেন।
সেলিউকসের সাথে বিবাদ মিটে যাওয়ার পরে, চন্দ্রগুপ্ত একে একে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্য দখল করতে সক্ষম হন। তিনি পারস্য সীমান্ত থেকে দক্ষিণ ভারতের মহীশূর এবং সৌরাষ্ট্র থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
সিন্ধু নদীর পশ্চিমে সেলুকাসের প্রদেশগুলিকে সংযুক্ত করার পর, চন্দ্রগুপ্তের একটি বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে ছিল উত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে বঙ্গোপসাগর থেকে আরব সাগর পর্যন্ত । চন্দ্রগুপ্ত তার সাম্রাজ্য বিন্ধ্য রেঞ্জের বাইরে এবং দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়ে ছিলেন ।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ক্ষমতায় আসার পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ বেশ কয়েকটি মহাজনপদে বিভক্ত ছিল এবং সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতলভূমি নন্দ রাজবংশ দ্বারা শাসিত হত। চন্দ্রগুপ্ত তার রাজত্বের শেষ পর্যন্ত তামিল ও কলিঙ্গ ছাড়া ভারতের অধিকাংশ স্থান দখল করেছিলেন।
পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি পর্যন্ত, ভারতের ইতিহাসে কখনও এর চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য নির্মিত হয়নি।
মেগাস্থেনিসের মতে, চন্দ্রগুপ্তের শাসন তিনটি সমান্তরাল প্রশাসনিক কাঠামো দ্বারা চিহ্নিত ছিল। একজন গ্রামের বিষয়গুলি পরিচালনা করেন, সেচ নিশ্চিত করা, জমির মালিকানা রেকর্ড করা, সরঞ্জাম সরবরাহ পর্যবেক্ষণ করা, শিকার করা, কাঠের পণ্য এবং বন-সম্পর্কিত আইন প্রয়োগ করা এবং বিরোধ নিষ্পত্তি করা। আরেকটি প্রশাসনিক কাঠামো শহরের বিষয়গুলি পরিচালনা করে, যার মধ্যে ব্যবসা, বণিক কার্যকলাপ, বিদেশীদের সফর, পোতাশ্রয়, রাস্তা, মন্দির, বাজার এবং শিল্প সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা কর সংগ্রহ করত এবং মানসম্মত ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিত করত। তৃতীয় প্রশাসনিক সংস্থা সামরিক বাহিনী, তার প্রশিক্ষণ, তার অস্ত্র সরবরাহ এবং সৈন্যদের চাহিদাকে উপেক্ষা করেছিল।
চন্দ্রগুপ্ত ও তার প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করেছিলেন। চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে তোলেন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের রৌপ্য পাঞ্চ মার্ক মুদ্রা , চাকা এবং হাতির প্রতীক (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী)
সেচ, মন্দির, খনি এবং রাস্তার মতো শক্ত অবকাঠামো থেকে সাম্রাজ্য একটি শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরি করেছিল। প্রাচীন উপাখ্যানের প্রমাণ থেকে জানা যায়, চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্যের পরামর্শে, বেসামরিক জনগোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে অনেকগুলি সেচের জলাধার এবং নেটওয়ার্কগুলি শুরু এবং সম্পূর্ণ করেছিলেন, একটি অনুশীলন তার বংশীয় উত্তরসূরিদের দ্বারা অব্যাহত ছিল। কৃষিতে আঞ্চলিক সমৃদ্ধি ছিল তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের অন্যতম কর্তব্য।
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতির সাথে সাথে এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ফলস্বরূপ একটি শক্রিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুসারে, চন্দ্রগুপ্তের মৌর্যের বিশাল সেনাবাহিনীতে চার লক্ষ সৈন্য ছিল।
মেগাস্থেনিসের মতে মৌর্য সাম্রায়্যের নগর সংগঠনটি ছিল নিম্নরূপ –
কমিটি- ফাংশন
১. প্রথম দল শিল্প ও কারশিল্প পরিদর্শন
২. দ্বিতীয় কমিটি বিদেশীদের তত্ত্বাবধান
৩. তৃতীয় গ্রুপ আদমশুমারি
৪. অন্য গ্রুপ ব্যবসা-বাণিজ্যের সংস্থা
৫. পঞ্চম কমিটি পরিদর্শন ব্যবস্থা
৬. সংঘ কর এবং রাজস্ব সংগ্রহ

কৌশিক রায়ের রায়, মৌর্য রাজবংশের শাসক ছিলেন “মহান মহানগর নির্মাতা”। গ্রীক রাষ্ট্রের সদস্য মেগাস্থিনিস এই ঐতিহ্যের কৃতিত্ব চন্দ্রগুপ্তকে দেন। যেখানে তিনি অধ্যয়নস্থল তিনি বিহারের যেখানে চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী।পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশীলার সাথে সংযোগকারী হাজার মাইল দীর্ঘ হাইওয়ের কাজ শেষ করেছিলেন।
চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে এবং তার রাজবংশের সময়ে, ভারতে অনেক ধর্মের উন্নতি হয়েছিল, বৌদ্ধ ধর্ম , জৈন ধর্ম এবং আজিবিকা অন্যান্য লোক ঐতিহ্যের সাথে প্রাধান্য লাভ করে।
প্লুতার্কের বর্ণনানুসারে, বিতস্তা নদীর যুদ্ধের সময়, নন্দ সাম্রাজ্যের ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ রথারোহী এবং ৬,০০০ যুদ্ধহস্তী ছিল। এই বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর কথা শুনে মহান আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ভারতে অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
চন্দ্রগুপ্তকথা নামক গ্রন্থানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের সেনাবাহিনী প্রথমদিকে নন্দ সাম্রাজ্যের কর্তৃক পরাজিত হয়। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত এরপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ধননন্দ ও তার সেনাপতি ভদ্রশালাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করে ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন।
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে চন্দ্রগুপ্ত তার সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ম্যাসিডনীয় সত্রপ রাজ্যগুলির দিকে নজর দেন। তিনি পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু নদ উপত্যকা অঞ্চলের শাসক ইউদেমোস ও পাইথনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন বলে মনে করা হয়। রোমান ঐতিহাসিক মার্কাস জুনিয়ানিয়াস জাস্টিনাস তার বর্ণনায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ম্যাসিডনীয় সত্রপগুলি অধিকার করার ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ব্যাক্ট্রিয়া ও সিন্ধু নদ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ সেনাপতি প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরের অধিকারে আসে। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষের সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না, কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর তাকে আরাখোশিয়া, গেদ্রোসিয়া ও পারোপামিসাদাই ইত্যাদি সিন্ধু নদের পশ্চিমদিকের বিশাল অঞ্চল অঞ্চল সমর্পণ করতে এবং নিজ কন্যাকে তার সাথে বিবাহ দিতে বাধ্য হন। দাম্পত্য সঙ্গী – হেলেনা (প্রথম সেলেউকাস নিকাতোর এর কন্যা), দ্বিতীয় – দুর্ধরা এবং তৃতীয় পত্নী – নন্দীনী (মহাপদ্মা নন্দ এর কন্যা)। তাঁর দুই পুত্র – বিন্দুসার ও প্রাসাদ।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির পর প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর পশ্চিমদিকে প্রথম আন্তিগোনোস মোনোফথালমোসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। চন্দ্রগুপ্ত প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরকে ৫০০টি যুদ্ধ-হস্তী দিয়ে সহায়তা করেন। যা ইপসাসের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে জয়লাভে সহায়তা করে।
এরপর চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তিনি বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে দাক্ষিণাত্য মালভূমির সিংহভাগ দখল করতে সক্ষম হন। এর ফলে কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্যের অল্পকিছু অংশ বাদে সমগ্র ভারত মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়।
চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বাংলা থেকে মধ্য আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল যা বর্তমানে তামিলনাড়ু , কেরালা এবং ওড়িশা ব্যতীত ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে ছিল।
চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং হত্যার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করার জন্য বিস্তৃত কৌশল তৈরি করেছিলেন। বিভিন্ন সূত্র জানায়, ষড়যন্ত্রকারীদের বিভ্রান্ত করতে চন্দ্রগুপ্ত ঘন ঘন শয়নকক্ষ পরিবর্তন করতেন। তিনি কেবলমাত্র কিছু কাজের জন্য তার প্রাসাদ ত্যাগ করেছিলেন: সামরিক অভিযানে যেতে, ন্যায়বিচারের জন্য তার দরবারে যেতে, বলিদানের জন্য, উদযাপনের জন্য এবং শিকারের জন্য। উদযাপনের সময়, তিনি ভালভাবে রক্ষিত ছিলেন, এবং শিকারের সময়, তিনি মহিলা রক্ষীদের দ্বারা বেষ্টিত ছিলেন যারা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা কম বলে মনে করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী রাজাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসা নন্দ রাজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে এই কৌশলগুলি হতে পারে।

তিনি পরিণত বয়সে জৈন ধর্মগ্রহণ করেন। এই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে তিনি তাঁর পুত্র বিন্দুসারকে রাজ্য সমর্পণ করে, জৈন সন্ন্যাসী ভদ্রবাহুর সাথে দাক্ষিণাত্য যাত্রা করেন।
দিগম্বর ঐতিহ্য অনুসারে, যে পাহাড়ে চন্দ্রগুপ্ত তপস্যা করেছিলেন বলে জানা যায় সেটি এখন চন্দ্রগিরি পাহাড় নামে পরিচিত এবং দিগম্বররা বিশ্বাস করেন যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একটি প্রাচীন মন্দির তৈরি করেছিলেন যা এখন চন্দ্রগুপ্ত বাসদী নামে টিকে আছে। সেখানে তিনি একজন তপস্বী হিসেবে বসবাস করেছিলেন। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮-২৯৫ অব্দের দিকে বর্তমানে‌ কর্ণাটকের শ্রাবণবেলগোলায় স্বেচ্ছায় উপবাসে দেহত্যাগ করেন। কিছু দিগম্বর কিংবদন্তিতে দুই চন্দ্রগুপ্তকে একই বলে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পরবর্তী যুগে – চতুর্থ বা অষ্টম শতাব্দীতে বিশাখদত্ত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থানকে বিষয় করে মুদ্রারাক্ষস নামক একটি সংস্কৃত নাটক রচনা করেন।

সঙ্গম সাহিত্যের বিখ্যাত তামিল কবি মমুলনার মৌর্য সেনাবাহিনী দ্বারা দাক্ষিণাত্য আক্রমণের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় চন্দ্রগুপ্ত নামক একটি বাংলা নাটক রচনা করেন। নাটকের গল্প পুরাণ এবং গ্রীক ইতিহাস থেকে নেওয়া হয়েছে।

১৯৩৪ সালে আবদুর রশিদ কারদারের চন্দ্রগুপ্ত হলো একটি ধারাবাহিক ভিডিও ।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত জয়ন্ত দেশাইয়ের ১৯৪৫ সালে প্রথম ঐতিহাসিক ছবি।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বাবুভাই মিস্ত্রির প্রথম একটি কেন্দ্রীয় ঐতিহাসিক কল্পকাহিনী চলচ্চিত্র যা ১৯৪৫ সালে, ভিডিওর রিমেক। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ভারত ভূষণ।

চাণক্য এবং চন্দ্রগুপ্তের গল্প নিয়ে ১৯৭৭ সালে তেলেগু ভাষায় চাণক্য চন্দ্রগুপ্তএকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল।

নোবুনাগা দ্য ফুল, একটি জাপানি মঞ্চ নাটক এবং অ্যানিমে, সম্রাটের উপর ভিত্তি করে চন্দ্রগুপ্ত গ্রাম একটি চরিত্রের উদাহরণ হয়েছে।

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত নামক একটি তেলুগু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যেখানে নন্দমুরি তারক রামা রাও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত চাণক্য নামক একটি টেলিভিশন ধারাবাহিকে দীনেশ শকুল ও অভিষেক দ্বিবেদী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় ডাক বিভাগ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সম্মানে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেন।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত অশোকা নামক হিন্দি চলচ্চিত্র উমেশ মেহরা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের চরিত্রে অভিনয় করেন।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নামক একটি টেলিভিশন ধারাবাহিকে আশীষ শর্মা ও ঋষিরাজ পাওয়ার চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত চন্দ্রনন্দিনী নামক একটি ভারতীয় টেলিভিশন ধারাবাহিক প্রচারিত হচ্ছে, যা পরিচালনা করছে বালাজী টেলিফিল্ম। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ভূমিকায় অভিনয় করছেন রজত তকাস।

—————————————————————
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া –
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়। ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress