পাইস হোটেলের দরজায়
পাইস হোটেলের দরজায় সুবোধ মিত্রের সঙ্গে দেখা। মিত্র হইহই করে ওঠে, সাড়ে সাতটায় আপনি এখানে! আমি তো মাত্র বিকেলের থার্ড কাপ চা চালিয়ে গেলুম, দশটায় খেতে আসব। চলুন মশাই, বলে মিত্র শ্যামের হাত ধরে, এক্ষুনি রাতের খাওয়া শেষ করলে মাঝরাতে খিদে পাবে। চলুন—
এতক্ষণের শীতভাব কেটে যায় শ্যামের। শরীরের উত্তাপ ফিরে আসে। মনে পড়ে, সারা দিন সে কথা বলেছে খুব কম। হিসেব করে দেখল, সকাল থেকে সে কথা বলেছে মাত্র চারটি লোকের সঙ্গে প্রথম, চায়ের দোকানের বয়, তারপর হোটেলের ছোকরা চাকরকে মাংস আর দই দিতে বলেছিল, পানের দোকানদারের কাছে চেয়েছিল সিগারেট আর পান, কন্ডাক্টরকে বলেছিল খুচরো নেই, আর, আমি নেমে যাচ্ছি।
সে হেসে মিত্রকে বলল, নিয়ে চললেন কোথায়!
কাছেই আমার আস্তানা মশাই। চলুন, দেখে আসবেন।
অনুগতের মতো শ্যাম মিত্রর সঙ্গে হাঁটতে থাকে, কেননা, এখন যে-কোনও সঙ্গই তার কাছে প্রিয় বলে মনে হয়। সে মিত্রর দিকে চেয়ে দেখে, এবং পাশ থেকে মিত্রর প্রোফাইল দেখে তার এমন ধারণা হতে থাকে যে, মিত্রর বয়স খুব বেশি নাও হতে পারে।
যেতে যেতে মিত্র লন্ড্রি থেকে কাপড় নিল, মুদির দোকান থেকে নিল বাতাসা, ফুলের দোকান থেকে গ্যাদাফুল নিল কলাপাতায় মুড়ে। এ-সবের ফাঁকে ফাঁকে একটানা কথা বলে যাচ্ছিল মিত্র, আপনি মশাই ক্রিমিনাল! (শ্যামের শীত করে ওঠে।) আমি ভেবেছিলুম আপনি বেকার। আজ হোটেলের ম্যানেজারের কাছে শুনলুম, বেশ ভাল একটা চাকরি করতেন আপনি অফিসার। ডিরেক্টারের বদমাইসি ধরে দিয়েছিলেন বলে আপনার চাকরি গেছে। হাঃ…হাঃ… সত্যি নাকি! (শ্যাম মৃদু হাসে) তা আপনি মশাই, এখনও বেশ আদর্শ ফাদর্শ মেনে চলেন দেখছি!… তা আমারও ছিল মশাই—ওই আদর্শ যাকে বলে। রাজযোগ আর লাইফ ডিভাইন আমার নিত্যপাঠ্য ছিল, কণ্ঠস্থ ছিল গীতাখানা। কিন্তু মশাই… (মিত্রর সঙ্গে শ্যামও দুঃখিতচিত্তে মাথা নাড়ে–হয় না।) ও হয় না। কী বলব, সাধনমার্গে আমি খানিকটা উঠেও ছিলুম। শেষ দিকে ধ্যানে বসলে গা শিরশির করত, শরীর হালকা বোধ হত, আর জ্যোতি-ফ্যোতিও খানিকটা দেখতে পেতুম। বয়স!… না, তখন আর বয়স এমনকী, কুড়ি-টুড়ি হবে। মেরুদণ্ড শালগাছের মতো সোজা রেখে হাঁটতুম, বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়াতুম বিবেকানন্দের মতো, আপনমনে বিড়বিড় করতুম—মাই ডিয়ার ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স.হাঃ হাঃ…! সেই সময়ে, আমার কুড়ি-একুশ বছর বয়সে, রাস্তা-ঘাটে ঘরে-ছাদে, ক্যালেন্ডারের ছবিতে, সিনেমার পোস্টারে, স্মৃতিতে-স্বপ্নে এত মেয়েছেলে ছিল না মশাই! আর এখন দেখুন, হুড়মুড় করে কোথা থেকে এল এত মেয়েছেলে, ভরে গেল দেশ! বলতে বলতে কেমন ফ্যাকাশে দেখাল মিত্রকে, বিহুল চোখে সে একবার চার দিকে চেয়ে দেখল।
শ্যাম লক্ষ করে, মিত্রর বাঁ বগলে লড্রিতে থোয়ানো কাপড়, বাঁ হাতে বাতাসার ঠোঙা, ডান হাতে কলাপাতায় মোড়া ফুল। এখন যদি হঠাৎ মিত্রর ঘাড় কি নাক চুলকে ওঠে, তা হলে হয়তো মিত্র শ্যামকেই বলবে, দিন তো মশাই আমার ঘাড়টা (কি নাকটা) একটু চুলকে! ভাবতেই শ্যাম খুব বিনয়ের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বলল, আপনার ফুলটা আমার হাতে দিন।
মিত্র ঘাড় নাড়ে, না, না। এ আমার নিত্যকর্ম মশাই, মা কাঠের সিংহাসনে একটা ঠাকুর বসিয়েছিলেন, মরবার সময় মিনমিন করে বললেন, ঠাকুরকে একটু ফুল বাতাসা দিস। আমিও রোজ দিয়ে যাই। চার-ছ’আনায় হয়ে যায় ব্যাপারটা। নইলে মশাই, ঠাকুর-দেবতায় আমার আর তেমন ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। ভগবান-টগবান আছে বলে মনে হয় আপনার? বলে উৎসুক চোখে মিত্র শ্যামের দিকে তাকায়, তারপর নিজেই বলে, আছে বোধহয় কিছু একটা, কিন্তু…
বলতে বলতে গলির শেষে মিত্রর ঘরের সামনে পৌঁছে যায় তারা। মিত্র তালা খুলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালায়, বলে, এই আমার আস্তানা।
দেয়ালে অনেক ঠাকুর-দেবতার ছবি টাঙানো, গোটা তিনেক ক্যালেন্ডার, ইজিচেয়ার, টেবিল আর এখানে-ওখানে তূপীকৃত বইপত্র। জ্যোতিষবিদ্যার দুটো পত্রিকা বিছানায় ওলটানো। টেবিলের রবিঠাকুরের ছবিতে একটা মালা পরানো, সামনে ধূপকাঠির স্ট্যান্ড। বিস্তর ধুলো জমেছে সর্বত্র। ঘরের জানালা মাত্র একটি, ভিতরের দিকে আর-একটা দরজা। মিত্র বাঁ হাতে শার্টের বোম খুলতে খুলতে ডান হাতে দরজাটার ছিটকিনি নামিয়ে বলে, ভিতরটা দেখবেন নাকি!
শ্যাম বলে, থাক।
মিত্র শ্বাস ছাড়ে, কিচেন আছে একটা। ঘুপচি একটা স্টোররুম, ফ্যামিলির কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু সব লক্ষ্মীছাড়া।
মিত্র দ্রুত ধুতি-শার্ট পালটে লুঙ্গি পরে নিল, এক লহমায় ভিতরে গিয়ে চোখে-মুখে, হাতে-পায়ে জল দিয়ে এল, তারপর টেবিলের সামনে একটা আসন পেতে মেঝেতে বসে শ্যামকে হাত দেখিয়ে একটু অপেক্ষা করতে ইঙ্গিত করল। শ্যাম লক্ষ করে, টেবিলের নীচে ঘুপচির ভিতরে একটা কাঠের ছোট্ট পালঙ্ক। সেখানে রয়েছে পিতলের গোপাল, মাটির কালী, রামকৃষ্ণ আর সারদামণির ছবি, এক দিকে আলাদা একটি পিতলের সিংহাসনে চকচক করছে শিবলিঙ্গ। ছোট থালায় গ্লাসে জল আর বাতাসা সাজিয়ে দিল মিত্র, ফুল ভাগ করে দিল সব দেবতাকে, তারপর চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড বসে রইল।
মিত্র উঠে দাঁড়াতেই শ্যাম বলে, কী মন্ত্র বললেন?
বললুম, ঠাকুর খাও। মা ওই মন্ত্রই বলতেন। বলে মিত্র হালকা চালে হাসে, কিছু না মশাই, এ স্রেফ অভ্যাস। অনেক দিন ভুল করে একবার দেওয়া বাতাসা আবার দিয়েছি, জ্বরজারি হলে বিছানায় শুয়ে বলি, ঠাকুর খাও। ঠাকুর তখন কী খায় কে জানে! তবে প্রসাদি বাতাসা আমি জমিয়ে রাখি কৌটোয়। বিকেলে মুড়ির সঙ্গে চলে যায়-হাঃ হাঃ…
মিত্র সত্নে রবিঠাকুরের ছবির সামনে ধূপকাঠি জ্বেলে দিল। শ্যাম লক্ষ করে, ছবির গলায় মালাটা তরতাজা। বোধহয় সকালে কেনা। সে বলে, ও মালাটা কেন?
মিত্র লাজুক একটু হাসে, এটাও অভ্যাস বলতে পারেন। তবে–বলে একটু দ্বিধা করে মিত্র, আপনাকে বলেছিলুম যে, ঠাকুরদেবতায় আমার আর ভক্তিশ্রদ্ধা নেই। কিন্তু কোথাও কোথাও কিছু একটা আছে মশাই… রবিঠাকুর…রবিঠাকুর…বলতে বলতে মিত্র আবার লাজুক একটু হাসে, সে একটা ব্যাপার আছে মশাই, আপনি ঠিক বুঝবেন না।
কেন?
মিত্র চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, আসলে রবিঠাকুরকে আমি খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করি।
সে তো অনেকেই করে। শ্যাম হাসে।
না, ঠিক সেরকম নয়। রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে আমি যাই না কখনও, শান্তিনিকেতন দেখিনি, রবিঠাকুরের কবিতাও আমি খুব একটা পড়িনি, কেবল বাংলা সিলেকশনে যা ছিল তাই, আর দু’-একটা ছুটকোছাটকা। পুরো কবিতা একটাও মুখস্থ নেই, তবে দু-একটা লাইন যদি বলতে বলেন তো বলতে পারি, যেমন–রমণীর মন সহস্র বর্ষেরি সখা সাধনার ধন। কিংবা, ওগো বধূ সুন্দরী…হাঃ হাঃ…না মশাই, ঠিক আপনারা যে-চোখে দেখেন, সে-চোখে নয়। রবিঠাকুর আমার কাছে অন্য রকম একেবারে অন্য রকম। আলাদা।
মিত্র এসে শ্যামের পাশে চৌকিতে বসে, গলা সামান্য নামিয়ে বলে, বিপদে পড়লেই আমি রবিঠাকুরকে ডাকি, মশাই। মিত্রর মুখ-চোখ সামান্য গম্ভীর দেখায়। বলে, ছেলেবেলা থেকেই মশাই, আমার এই অভ্যাস। ভাল মনে পড়ে না, সেই কবে ছেলেবেলায় একবার মাথায় টিকটিকি পড়েছিল বলে ভয়ে আমি দৌড় দিয়েছিলুম, দড়াম করে ধাক্কা খেয়েছিলাম বাবার পড়াশুনোর টেবিলে, কেঁদে উঠতে গিয়ে দেখি টেবিলের ওপর রবিঠাকুরের ওই ছবি–মালা পরানো, সামনে ধূপকাঠি জ্বলছে, আমি কেঁদে বললুম, রবিঠাকুর, আমার মাথায় টিকটিকি…তুমি তাড়িয়ে দাও। আমার ঘন চুলের ভিতর থেকে তক্ষুনি টিকটিকির বাচ্চাটা ছিটকে পড়ল টেবিলে, তারপর দেয়াল বেয়ে উঠে গেল। আমি শিউরে উঠলুম। হাসবেন না মশাই, আমার মনে হয়েছিল, ছবির রবিঠাকুরের চোখে-মুখে একটু হাসি ঝিকমিকিয়ে গেল। ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিল, পালিয়ে গেলুম। তারপর ক্রমে আমি বুঝতে পারলুম, আমি গোপনে একটা আলাদা রবিঠাকুরকে পেয়ে গেছি। সে আমার গোপন কথার মতো, মায়ের কাছে গায়ের জ্বর লুকিয়ে রাখার মতো করে আমি সকলের কাছ থেকে রবিঠাকুরকে আলাদা করে নিলুম, রাত্তিরে একা অন্ধকার ঘর পেরোতে পারছি না, ডাকলুম–রবিঠাকুর, আমি অন্ধকার পেরোতে পারছি না, পার করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে মনে হত খুব আপনজনের মতো কেউ আমার হাত ধরল, আমি গটমট করে পেরিয়ে যেতুম ঘর। ঘুড়ি ধরা নিয়ে একবার খালাসিপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারপিট লাগলে আমি মার খেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলুম–ঠাকুর, রবিঠাকুর, আমাকে এরা মারছে, তুমি আমাকে নিয়ে যাও। শুনে থমকে গিয়ে ছেলেগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ল—রবিঠাকুর নিয়ে যাবে কী রে, ছেলেটা। তাদের হাসির ফাঁকে গলে গিয়ে আমি টেনে দৌড় মেরেছিলুম। আমি কতবার আমাদের ফুলবাগানে ঘুরে বেড়িয়েছি রবিঠাকুরের সঙ্গে, চলে গেছি বহু দূরের নীলকুঠিতে ফল খেতে, রেল ব্রিজ হেঁটে পার হয়ে চলে গেছি শম্ভুগঞ্জের মেলায়, মাঝিদের ফাঁকি দিয়ে পাট-বোঝাই দু’দাঁড়া নৌকোর গাঁটরির ফঁাকে বসে চলে গেছি অচেনা গঞ্জে। লোকে ভাবত, একা একা গেছে সুবোধ। কিন্তু তা নয়, আমার সঙ্গে সবসময়েই থাকত রবিঠাকুর—ওই অত লম্বা, মাথায় কালো ঠোঙার মতো টুপি, গায়ে জোব্বা আর দুধ-সাদা দাড়িওলা রবিঠাকুর সবসময়ে থাকত আমার সঙ্গে, একটু কুঁজো হয়ে নরম একখানা প্রকাণ্ড হাতে ধরে থাকত আমার হাত। আমি নিশ্চিন্তে চলে যেতুম যেখানে সেখানে, পথ-হারানোর ভয় থাকত না, জানতুম রবিঠাকুর ঠিক পৌঁছে দেবে, ঝড়ে-জলে জোব্বার আড়ালে ঘিরে রাখবে আমাকে, ঘুমের আগে শুনিয়ে দেবে রূপকথার গল্প। মা, দিদি বা ঠাকুরমার কাছে কতবার শুনেছি, ভূতের ভয় পেলে বুকে রামনাম লিখিস। সন্ধেবেলা চার তারা না দেখে ঘরে ঢুকিস না। রাত্রে সাপের নাম করলে তিনবার আস্তিক মুনির নাম নিস। আমি সে-সব মানতুম না। আমি গোপনে রবিঠাকুরকে বলতুম, এরা তো জানে না যে, আমার তুমি আছ! তারপর খুব হাসতুম দু’জনে। আমাদের দু’জনের ছিল বাদবাকি সকলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। না, সবসময়ে নয়, সবকিছু চাইলেই যে পাওয়া যেত তা নয়। একবার একটা ছেলে আমাদের পোষা দাড়ের তোতা পাখিকে ঢিল মেরেছিল বলে আমি চেঁচিয়ে বলেছিলুম, রবিঠাকুর, ওর চোখ দুটো কানা করে দাও। তার ফলে দু’দিন বাদে আমার চোখ উঠল। আর-একবার আমি আমার ছোট বোনের কাছে আঁক করে বলেছিলুম যে, আমি রাত দশটার সময় একা একা ছাদে বেড়িয়ে আসতে পারি। সে বলল, ইল্লি! সঙ্গে সঙ্গে আমি বললুম, বাজি। সে তার জমানো পয়সা বাজি ধরলে। একদিন রাত দশটায় আমি হাসতে হাসতে ছাদে চলে গেলুম। কিন্তু নামবার সময় আমাদের পোষ বেড়ালের গায়ে পা পড়তে বেড়ালটা আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দিল। সে রাতে রবিঠাকুর আর কথা বলেনি আমার সঙ্গে; কেননা কেন আমি জেনেশুনে বাজি ধরেছিলুম! কেন আমি ঠকিয়ে নিতে চেয়েছিলুম আমার ছোট বোনটার টিফিন-না-খাওয়া, পুঁতির-মালা-না-কেনা কষ্টে জমানো পয়সা! হ্যাঁ মশাই, যতক্ষণ আমি পবিত্র ও শুদ্ধ থাকতুম, ততক্ষণই রবিঠাকুর থাকত আমার সঙ্গে। ঝড়ে-জলে, আলোয়-অন্ধকারে, ঘরে কিংবা দূরে— সবসময়ে ওই অত লম্বা, মাথায় কালো টুপি, জোব্বা পরা দাড়িওলা লোকটা সব কাজ ফেলে আমার সঙ্গে থাকত।
ক্রমে মিত্রর চোখে চিকচিক করে ওঠে জল, না মশাই, আপনাদের রক্তমাংসের রবিঠাকুরকে আমি চোখে দেখিনি। আপনার কি মনে হয় আমার রবিঠাকুরের সঙ্গে আপনাদের রবিঠাকুরের কোনও মিল আছে?
শ্যাম মাথা নাড়ে, না।
আঃ! ঠিক তাই। আসলে আমিই ঠিক আসল রবিঠাকুরকে পেয়েছিলুম মশাই। কিন্তু রাখতে পারলুম না। ক্রমে বয়স বাড়তে লাগল, গালে এল ব্রণ, ঘুমে এল অবৈধ স্বপ্ন, চলায় ফেরায় এল সতর্কতা। আমার ভিতরে মশাই পাপ ঢুকে যেতে লাগল। তখন রবিঠাকুরের কবিতা পড়ি স্কুলে, মানে বই থেকে অর্থ দেখে নিই। কিন্তু কেবলই মনে হয় আমি যাকে চিনতুম এ সে নয়। একদিন আমি আমাদের বাগানের কোণে শিমুলগাছতলায় বসে ঘাসের ডাঁটি দাঁতে কামড়ে আস্তে ডাকলুম, রবিঠাকুর! কোনও সাড়া এল না। আবার ডাকলুম। সাড়া এল না। এল না তো এলই না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ডাকলুম। সকালে উঠে ডাকলুম, ছাদে গিয়ে মাঠে গিয়ে নৌকোয় চড়ে ডাকলুম। আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকলুম, নদীর জলের দিকে চেয়ে ডাকলুম…তারপর বসলুম আমার গোপন কান্না কাঁদতে। গেল আমার রবিঠাকুর, গেল আমার সাহস, শুদ্ধতা, গেল আমার শৈশব; বুকের শব্দে বিসর্জনের বাজনা শুনলুম।
মিত্রর চোখ বেয়ে, গাল বেয়ে নেমে এল জল, ঘুমের মধ্যে মায়ের কোল থেকে যেভাবে সরে যায় বাচ্চা ছেলে! তারপর থেকেই আমার জীবন একটা ট্র্যাজেডি মশাই…
বলতে বলতে আস্তে ফুপিয়ে ওঠে মিত্র, হাঁটু মুড়ে মুখ গুঁজে দেয়, কাঁদতে থাকে। একটা ঘোরের মধ্যে শ্যাম এগিয়ে গিয়ে মিত্রর কাছ ঘেঁষে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, এলোমেলোভাবে বলতে চেষ্টা করে, আমি বুঝতে পেরেছি, আমি বুঝতে পেরেছি…
শ্যাম মিত্রর অস্ফুট কথা শুনতে পাচ্ছিল, রবিঠাকুর ছাড়া আর আমার কিছু নেই—নেই। এখন আমাকে কে আবার দেবে সেই রবিঠাকুর? কে দেবে?
গভীর দুঃখে শ্যাম মাথা নাড়ে, ঠিক।
মুখ না তুলেই মিত্র বলে, সবচেয়ে বড় কথা কী জানেন!
কী?
আমার আর ভালবাসা নেই।
ভালবাসা নেই? শ্যাম অবুঝের মতো প্রশ্ন করে।
নেই। আমি আর কোনও দিনই কোনও কিছুকেই তেমন করে ভালবাসতে পারলুম না। বলেই মিত্র গভীরতর কান্নায় ড়ুবে যেতে লাগল।
মিত্রকে কাঁদতে দিয়ে শ্যাম ধীর, নিঃশব্দ পায়ে উঠে এল। বেরিয়ে এল রাস্তায়। অন্যমনস্কভাবে সিগারেটের প্যাকেট হাতড়ে বের করল পকেট থেকে। দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে খস শব্দে হঠাৎ মনে পড়ে যে, আজ একত্রিশের জন্মদিন পার হয়ে গেল। মিত্রকে খাওয়ানোর কথা ছিল আজ। হল না। সামান্য একটু হেসে শ্যাম হটতে থাকে।
গলির মুখে নির্জন রাস্তায় হঠাৎ একটা খুব লম্বা লোক শ্যামের উলটো দিক থেকে হেঁটে আসে। চমকে যায় শ্যাম–মিনু না! না, মিনু না, অন্য লোক, অনেকটা মিনুর মতো দেখতে।
দোতলার সিঁড়িতে সাদা একটা বেড়াল বলের মতো গোল হয়ে শুয়ে ছিল। শ্যাম অন্য মনে লাথি ছুড়ল, ‘ফ্যাঁস’ করে লাফিয়ে ওঠে বেড়ালটা, নিঃশব্দে বিদ্যুৎগতিতে দৌড়ে উঠে যায় সিঁড়ির মাথায়, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শ্যামের দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্যাম দাঁড়িয়ে থাকে, বেড়ালটার দিকে চেয়ে দেখে ভয়ংকর ঘেন্নায় রাগে বেড়ালটার দু’চোখ জ্বলছে। শ্যাম টের পায়, তার সামনের বাতাস বিদ্বেষে বিষিয়ে আছে। সিঁড়ি ভাঙতে পা তোলে শ্যাম, কিন্তু এগোতে পারে না। বেড়ালটা স্থির চোখে তাকে দেখে। হঠাৎ সে শুনতে পায়, তাকে ফেলে রেখে তারই পায়ের শব্দ সামনের সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাচ্ছে। আর্তনাদ করে উঠতে গিয়ে আস্তে হেসে ফেলে শ্যাম। না, সব ঠিক আছে। সে নিজেই উঠছে সিঁড়ি ভেঙে! শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্য সে নিজের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
অনেক রাতেও শ্যাম তার ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে ঘন কুয়াশা, গাছপালা স্থির। একটা ল্যাম্পপোস্টের একটু পাথুরে আলোর ভিতর দিয়ে ল্যাঙ ল্যাঙ করে একটা ঘেয়ো কুকুর চলে যায়। দূরে পুলিশের বুটের শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে শূন্য রাস্তায়।
শ্যাম তার সকালে কেনা প্যাকেটের শেষ সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরে।
দেশলাই জ্বালবার খস শব্দে ভীষণ চমকে ওঠে সে। তার মাথার ভিতরে টলমল করে ওঠে ঘোলা জল। শূন্য চোখে কুয়াশার দিকে চেয়ে হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়—মাই গু-উ-ডনেস! টু-ডে কিলড এ ম্যান!