পৌষ-লক্ষ্মী অর্থাৎ পৌষ-পার্বণ
পৌষ-সংক্রান্তির দিন পৌষ-লক্ষ্মী অর্থাৎ পৌষ-পার্বণ। নবান্নের দিন হইতে মাস দেড়েক পর পল্লীবাসীর জীবনে আর একটি সর্বজনীন উৎসব আসিল। যে জীবনে উদয়কাল হইতে অস্তকাল পর্যন্ত বার ঘণ্টা সময়ের অর্ধেকটা চলে হল-আকর্ষণকারী কুজপৃষ্ঠ বলদের অতি-মন্থর পদক্ষেপের পিছনে পিছনে, অথবা ঘরের সমান উঁচু ধান ও খড়-বোঝাই গরুর গাড়ির চাকা ঠেলিয়া অথবা শ্বাস রোগীর মত দুঃসহ কষ্টে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ধানের বোঝা মাথায় করিয়া আনিতে আনিতে কাটিয়া যায় টানিয়া টানিয়া শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলিয়া, সেখানে দেড় মাস সময় পরিমাপে নগর-জীবনের তুলনায় নিশ্চয়ই দীর্ঘ। একটানা একঘেয়ে জীবন।
মধ্যে ইতুলক্ষ্মী গিয়াছে; কিন্তু ইলক্ষ্মীতে নিয়ম আছে, পালন আছে, পার্বণের সমারোহ নাই। পৌষ-পার্বণে ঘরে ঘরে সমারোহ, পিঠা-পরব। অগ্রহায়ণ-সংক্রান্তিতে খামারে লক্ষ্মী পাতিয়া চিঁড়া, মুড়কি, মুড়ি, মুড়ির নাড়ু, কলাই ভাজা ইত্যাদিতে পূজা হইয়াছিল। পৌষসংক্রান্তিতে ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর আসন পাতিয়া ধান-কড়ি সাজাইয়া সিংহাসনের দুইপাশে দুইটি কাঠের পেঁচা রাখিয়া লক্ষ্মীপূজা হইবে। এক অন্ন পঞ্চাশ ব্যঞ্জনে লক্ষ্মীর সঙ্গে নানা দেবতার ভোগ দেওয়া হইবে। রাশিকৃত চাল চেঁকিতে কুটিয়া পুঁড়া প্রস্তুত হইয়াছে—পিঠা তৈয়ারি হইবে হরেক রকমের। রস প্রস্তুত হইয়াছে, রসে সিদ্ধ পিঠা হইবে। তাহা ছাড়া গুড়ে-নারিকেলে, গুড়েতিলে মিষ্টান্ন প্রস্তুত হইয়াছে, পাতলা ক্ষীর হইয়াছে, চাচি বা খোয়া ক্ষীর হইয়াছে—লোকে আকণ্ঠ পুরিয়া প্ৰসাদ পাইবে।
অনিরুদ্ধের এসবের আয়োজন কিছুই হয় নাই। একে পদ্মের দেহ অসুস্থ, তার উপর একটি পয়সাও তাহার হাতে নাই। গোটা পৌষটাই অনিরুদ্ধের কামারশালা একরকম বন্ধ গিয়াছে। বলিলেই হয়। লোহার কাজ এ সময়ে বেশি না হইলেও কিছু হয়; ধান কাটার কাস্তে পাজানো এবং গরুর গাড়ির চাকার খুলিয়া-পড়া লোহার বেড় লাগানো কাজ না করাইয়া চাষীদের উপায় নাই। কিন্তু অবসরের অভাবে অনিরুদ্ধ তাহাও করিতে পারে নাই। অবসর পাইবে কোথায়? পদ্মের অসুখ লইয়াই মাথা খারাপ করিয়া তাহার দিন কাটিয়াছে। আজ এখানে গিয়াছে, কাল ওখানে গিয়াছে। শিবনাথতলা, কোন্ এক মুসলমান ওস্তাদের বাড়ি যাইতে সে বাকি রাখে নাই। সব করিয়াছে ধার করিয়া। খরিদ্দারের টাকা ভাঙিয়া। এদিকে পাঁচ বিঘা বাকুড়ির ধান তাহার গিয়াছে। বাকি জমির ধান ভাগ-জোতদারের সঙ্গে নিজে লাগিয়া কাটিতেছে ও ঘাড়ে করিয়া আনিয়া ঘরে তুলিতেছে।
আবার সরকারের সেটেলমেন্ট আসিয়াছে, নোটিশ হইয়াছে–আপন আপন জমিতে স্বত্ব স্বামিত্বের প্রমাণাদিসহ উপস্থিত থাকিতে হইবে। অন্যথায় সেটেলমেন্ট কার্যবিধি অনুযায়ী দণ্ডনীয় হইবেক।
এক টুকরা জমির জন্য কানুনগো ও আমিন বাবুদের সঙ্গে সেই ভোর হইতে বেলা তিন প্রহর কাটিয়া যায়, পাকা ধানের উপর দিয়া শিকল টানিতে টানিতে সেই জমিটুকুতে আসিতে চার-পাঁচ দিন সময় লাগে। সে টুকরাটা হইয়া গেলে দুই-তিন দিন কি চার-পাঁচ দিন নিশ্চিত, তাহার পর হয়ত আবার এক টুকরা। শুধু অনিরুদ্ধ নয়, সমস্ত গ্রামের লোকেরই এইভাবে লাঞ্ছনা-দুর্বিপাকের আর শেষ নাই! পৌষ সংক্রান্তিতে ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর সিংহাসন স্থাপনের উদ্যোগ হইতেছে; কিন্তু এবার লক্ষ্মী এখনও মাঠে! গোটা গায়ের মধ্যে একটি গৃহস্থেরও দান আসে নাই। ওই আবার একটা হাঙ্গামা রহিয়া গেল। ধান তোলার শেষ দিনে দাওন আসিবে–অনিরুদ্ধের নিজেকেই শেষ ধানগুচ্ছটি কাটিতে হইবেকাটা ধানের গোড়ায় জল দিয়া ধানগুচ্ছটি লইয়া আসিতে হইবে মাথায় করিয়া। অনিরুদ্ধের কৃষাণ নাই, ভাগ-জোতদারকে পায়েস রাঁধিয়া খাওয়াইতে হইবে। অন্যান্যবার এই লক্ষ্মীর সঙ্গেই ও পর্বটি সারা হইয়া যায়–এবার সেটেলমেন্টের দায়ে বাকি পড়িয়া রহিল।
ভাতের হাঁড়িটা নামাইয়া পদ্ম ফেন গালিয়া ফেলিল। খুঁজিয়া বাছিয়া ভাতের ভিতর হইতে একটা ছোট পুঁটলি টানিয়া বাহির করিল, পুঁটলিটার মধ্যে আছে খানিকটা মসুর কলাই, গোটাচারেক বড় আলু এবং একটুকরা কুমড়ার ফালি। এগুলা মাখিয়া ফেলিয়া আবার মাছ দেখিতে হইবে; মাছ নহিলে অনিরুদ্ধের ভাত উঠিবে না। এইজন্য খিড়কির ডোবার জলের কিনারায় কতকগুলা আপা অর্থাৎ গর্ত করা আছে—পকাল মাছগুলা তাহার মধ্যে ঢুকিয়া থাকে; সতর্ক ও ক্ষিপ্রভাবে হাতে চালাইয়া দিলেই ধরা যায়। পদ্ম অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বাহিরের দরজার দিকে চাহিল। এ কাজটুকুও তো সে করিলে পারিত! কোথায় গেলেন নবাব? সেই একবার বাহির-দরজায় সাড়া শোনা গিয়াছিল–চণ্ডীমণ্ডপ না ঘটিবার সঙ্কল্পের আস্ফালন হইতেছিল, তারপর আর সাড়া নাই। চণ্ডীমণ্ডপ ছাঁটিব না। তবে তো মাকালী ও বাবা-শিবের বেগুনক্ষেত জলপ্লাবিত হইয়া গাছগুলা পচিয়া নিদারুণ ক্ষতি হইয়া গেল! ওইরূপ মতি না হইলে এই দুৰ্গতি হইবে কেন?
–কম্মকার রইছ নাকি হে? কষ্মকার! অকম্মকার! কৰ্ম্মকার হে!
কে লোকটা? উত্তর না পাইয়াও একনাগাড়ে ডাকিয়াই চলিয়াছে।
–অ কম্মকার! এই তোমার দুগ্গা বললে বাড়ি গেল কম্মকার, আর সাড়া দিচ্ছ না। ওহে। ও কৰ্ম্মকার।
অনিরুদ্ধ তাহা হইলে দুর্গার বাড়ি গিয়াছিল। রূপ আছে বলিয়াই ওই মুচিনীর বাড়ি। ছি-ছিছি!…লক্ষ্মী? ওই লোকের বাড়িতে লক্ষ্মী থাকে? না এই লোকের বংশ থাকে: পদ্ম যেন: পাগল হইয়া উঠিল—সে উনান হইতে জ্বলন্ত কাঠ একখানা টানিয়া বাহির করিল। আগুন ধরাইয়া দিবে ঘর-সংসারে সে আগুন ধরাইয়া দিবে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাড়ির ভিতর আসিয়া প্রবেশ করিল ভূপাল চৌকিদার।
—বলি, কম্মকার, তুমি কি রকম মানুষ হে? ডেকে ডেকে গলা আমার ফেটে গেল! কই ককার কই?
বাড়ির মধ্যে অনিরুদ্ধকে না পাইয়া ভূপাল খানিকটা অপ্রতিভ হইয়া গেল, অবশেষে পদ্মকেই উদ্দেশ করিয়া বলিল তুমি বাপু কম্মকারকে বোলো—আমি এসেছিলাম। আমার হয়েছে এক মরণ! ডাকলে নোকে যাবে না, আর গোমস্তা বলবে—শালা, বসে বসে ভাত খাবার জন্য তোকে মাইনে দিই!
—কে রে! কে কি বলবে কষ্মকারকে? কষ্মকার কার কি ধার ধারে? বাহির দরজা হইতেই কথা বলিতে বলিতে অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকিল।
এই যে কষ্মকার! ভূপাল হাফ ছাড়িয়া বাঁচিল।তুমি বাপু একবার চল, গোমস্তা তো আমার মুণ্ডপাত করছে।
অনিরুদ্ধ খপ করিয়া তাহার হাতখানা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল—এই। বাড়ির ভেতর ঢুকলি ক্যানে তুই?
তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ভূপাল এবার রুষ্টস্বরে বলিল হাত ছাড় কৰ্ম্মকার!
বাড়ি ঢুকলি ক্যানে তুই? খাজনার তাগাদা আছে, বাড়ির বাইরে থেকে করবি। জমিদারের নন্দী-বেটা ছুঁচোর গোলাম চামচিকে!
হাতটা মোচড় দিয়া ছাড়াইয়া লইয়া ভূপাল এবার হুঙ্কার দিয়া উঠিল—এ্যাঁও! মুখ সামলে, কম্মকার, মুখ সামলে বল। দু বছর খাজনা বাকি, খাজনা দাও নাই ক্যানে? আলবৎ বাড়ি ঢুকব। ইউনান বোর্ডের ট্যাক্স—তাও আজ পর্যন্ত দাও নাই!… ভূপালও বান্দীর ছেলে, সেও এবার বুক ফুলাইয়া দাঁড়াইল।
খাজনা, ইউনিয়ন বোর্ডের ট্যাক্স! অনিরুদ্ধ অস্থির হইয়া উঠিল। কিন্তু সে আর অধিক দূর অগ্রসর হইতে সাহস করিল না। ওসব কথা আমলে না আনিয়া সে তাহার নিজের অভিযোগটাই তুবার জাহির করিল—আমি যদি বাড়িতে থাকতাম, তা হলে নয় ঢুকতিস ঢুকতিস। বাড়িতে বেটাছেলে নাই—আমার বাড়ি ঢুকবি ক্যানে তুই?
ভূপাল বলিল—চল তুমি, গোমস্তা ডাকছে!
-–যা যা, বল গে, কারুর ডাকে আমি যাই না।
–খাজনার কি বলছ বল?
–যা বল গে, খাজনা আমি দেব না।
—বেশ। ভূপাল বাহির হইয়া চলিয়া গেল। অনিরুদ্ধও সাফ জবাব দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া আস্ফালন আরম্ভ করিয়া দিল—আদালত আছে, উকিল আছে, আইন আছে, নালিশ কর গিয়ে। বাড়ির ভেতর ঢুকবে, বাড়ির ভেতর! ওঃ আস্পদ্ধা দেখ!
অকস্মাৎ সে কাঁদো-কাঁদো সুরে আবার বলিল–গরিব বলে আমাদের যেন মান-ইজ্জত নাই! আমরা মানুষ নই!
পদ্ম একটি কথাও বলে নাই, নীরবেই সিদ্ধ সামগ্রীগুলি নুন-তেল দিয়া মাখিতেছিল। এতক্ষণে বলিল–হ্যাঁগা, মাছের কি হবে?
–মাছ? মাছ চাই না। কিছু খাব না, যা। পিণ্ডিতে আমার অরুচি ধরেছে।
পদ্ম আর কোনো কথা না বলিয়া ভাত বাড়িতে আরম্ভ করিল।
অনিরুদ্ধ অকস্মাৎ চিৎকার করিয়া উঠিল—তুই আমার লক্ষ্মী ছাড়ালি!
–আমি?
–হাঁ, তুই। রোগ হয়ে দিনরাত পড়ে আছিস, ঘরে সন্ধ্যে নাই, ধূপ নাই। এ ঘরে লক্ষ্মী থাকে? বলি কাল যে লক্ষ্মীপুজোতার কি কুটোগাছটা ভেঙে আয়োজন করেছিস? অনিরুদ্ধ রাগে ক্ষোভে অধীর হইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।
পদ্ম চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার অন্তরের ক্ষোভের উন্মত্ততা ইতিমধ্যে অদ্ভুতভাবে প্রশান্ত উদাসীনতায় পরিণত হইয়া আসিয়াছে। অনিরুদ্ধের এই অপমানে ক্ষোভে তাহার তৃপ্তি হইয়াছিল কি না কে জানে, কিন্তু তাহার নিজের ক্ষোভের উন্মত্ততা—যে উন্মত্ততাবশে কিছুক্ষণ পূর্বে সে ঘরে আগুন ধরাইয়া দিতে চাহিয়াছিল—সে উন্মত্ততা বিচিত্রভাবে শান্ত হইয়া গিয়াছে। আঁচল বিছাইয়া সেইখানেই সে শুইয়া পড়িল। তাহার বুকের ভিতর যেন একরাশ কান্না উথলাইয়া পড়িতেছে।
পদ্ম নীরবে দিতেছিল; দরদরধারে তাহার চোখ হইতে জল গড়াইয়া গাল ভিজাইয়া মাটির উপর ঝরিয়া পড়িতেছিল। কাঁদলে তাহার বুকের ভিতরে গভীর যন্ত্রণাদায়ক আবেগটা কমিয়া যায়। কাঁদিতে কাঁদিতে সে কিছুক্ষণ পর তৃপ্তি অনুভব করে, তাহার পর একটা আনন্দ পায়।
—কই হে, কামার-বউ কই হে?
কে ডাকিতেছে? পদ্ম নিঃশব্দে চোখের জল অ্যাঁচলে মুছিয়া ফেলিল। মুছিয়া ফেলিয়াও কিন্তু সাড়া দিল না, সাড়া দিতে ইচ্ছা হইল না।
–কামার-বউ! ওমা এই বিকেলবেলা উনোনের মুখে শুয়ে ক্যানে হে?
তাহাকে দেখিয়া পদ্মের সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। যে ডাকিতেছিল সে ঘরে আসিয়া ঢুকিয়াছে। সে দুর্গা।
কি আস্পর্ধা মুচিনীর! ডাকিবার ধরন দেখ না। অত্যন্ত অপ্রসন্ন কণ্ঠেই সে বলিল—কানে? কি দরকার?
হাসিয়া দুর্গা বলিল—একটা কথা আছে ভাই তোমার সঙ্গে।
—আমার সঙ্গে? কি কথা? কিসের কথা শুনি?
–বলব, তা উঠেই বস।
–আমার শরীরটা ভাল নাই।
দুর্গা শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল—অসুখ করেছে? দাওয়ার উপর উঠব?
তড়িৎস্পৃষ্টের মত পদ্ম উঠিয়া বসিল, বলিল–না।
দুর্গা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল-ওমা, কাঁদছিলে বুঝি? কি হল? কর্মকারের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?
সে হি-হি করিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল।
—সে খবরে তোমার দরকার কি? কি বলছ বল না? খোঁজ দেখ না! যেন আমার কত আপনার জন!
–আপনার জন তো বটে, ভাই। লই কিনা—তুমিই বল!
–তুই আমার আপনার জন? পদ্ম ক্ৰোধে এবার তুই বলিয়া সম্বোধন করিল।
দুর্গা কিন্তু তাহাতেও রাগ করিল না, হাসিল। হাসিয়া বুলিলা হে হ্যাঁ। যদি বলি আমি তোমার সতীন! তোমার কৰ্তা তো আমাকে ভালবাসে হে!
পদ্ম এবার ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। দুরন্ত ক্ৰোধে রান্নাশালার ঝাটাগাছটা কুড়াইয়া লইল। দুর্গা হাসিয়া খানিকটা সরিয়া গিয়া বলিল ছোঁয়া পড়লে অবেলায় চান করতে হবে। আমার কথাটাই আগে শোন ভাই, তারপর না-হয় ঝাঁটাটা ছুড়েই মেরো! পদ্ম অবাক হইয়া গেল।
দুর্গা বলিল–দাঁড়াও ভাই, বারদরজাটা আগে বন্ধ করে দি। কে কখন এসে পড়বে।
পদ্ম তখনও শান্ত হয় নাই, সে কঁজালো সুরে বলিল—দরজা দিয়ে কি হবে? গণ্ডায় গণ্ডায় আমার তো নাগর নাই।
দুর্গা আবার হাসিয়া উঠিল, বলিল—আমার তো আছে ভাই। তারা যদি গন্ধে গন্ধে এসে পড়ে!
—আমার বাড়ি এলে ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেব না?
দুর্গা ততক্ষণে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছে। ফিরিয়া সে সংস্পৰ্শ বাঁচাইয়া খানিকটা দূর হইতে বলিল—পরকে না হয় পার, কিন্তু তোমার আপন কত্তাটিকে? সেও যে আমার তুমি যা বললে—তাই! যাক শোন ভাই, ঠাট্টা লয়, এইগুলো ঘরে তুলে রাখ দেখি। সে ততক্ষণে কাখাল হইতে কাপড়-ঢাকা একটা চুপড়ি নামাইল। তাহার মধ্য হইতে নামাইয়া দিল—এক ঘটি দুধ, এক ভাঁড় গুড়, গোটাদুয়েক ছাড়ানো নারিকেল, সেরখানেক তিল, একটা পাত্রে আধসেটাক তেল—আরও কতকগুলি মসলাপত্র। বলিল—যাও, লক্ষ্মীপুজোর উয্যুগ করে ফেল। আতপ চাল তো আমার নাই, আর আমাদের চালগুঁড়োতে তো হবে না। আমি শুনলাম তোমার কর্তার কাছে।
পদ্মর সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল, ইচ্ছা হইল লাথি মারিয়া জিনিসগুলোকে ছড়াইয়া ফেলিয়া দেয়। তাই সে দিত। কিন্তু ঠিক তখনই বাহির দরজায় ধাক্কা দিল। হয়ত অনিরুদ্ধ। ভাল, সে-ই আসুক-তারপর সামনেই সে লাথি মারিয়া ফেলিয়া দিবে।
দ্রুতপদে সে নিজেই গিয়া খুলিয়া দিল। কিন্তু সে অনিরুদ্ধ নয়—বুড়ি রাঙাদিদি। পদ্ম শান্তভাবে সম্ভাষণ করিলকে, রাঙাদিদি?
হ্যাঁ। তা হ্যাঁ লো নাতবউ!—বলিতে বলিতে বৃদ্ধার দৃষ্টি পড়িল দুর্গার উপর। ওমা, ও কে বসে? ওটা কে?
—আমি। কণ্ঠস্বর উচ্চ করিয়া দুর্গা বলিল রাঙাদিদি, আমি দুগ্গা, বায়েনদের দুগ্গা!
দুগ্গা! তোর কি আ-ছাটা মিত্তিকে নাই লা? এই হেথা, এই হোথা, একেবারে হুই মুলুকে! কঙ্কণা, জংশন কোথায় বা না যাস! তা হেথা কি করছিস লা? ওগুলো কি বটে।
—এই, কামার-বউ টাকা দিয়েছিল জংশন থেকে জিনিস কিনতে; তাই এনে দিলাম, রাঙাদিদি।
—তা আমাকে বলতে নাই? গাঁয়ে বসে চার আনার বাজার করলাম আজ, চাল বেচলাম এক টাকার। জংশনে চার আনার বাজারেও একটা পয়সা বাচত, চালের দরেও দুটো পয়সা বেশি পেতাম। আমার তো শক্তলোমথ সোয়ামী নাই, আবাগী আমি আমার উবৃগার করবি ক্যানে ব?
হাসিয়া দুর্গা বলিল—এইবার একদিন দিও দিদি, এনে দোব।
—তা দিস। তুই মানুষ তো ভাল, তবে বড় নচ্ছার। তা তুই যা করবি করগে, আমার কি?
দুর্গা সশব্দে হাসিয়া উঠিল—তা বৈকি, দিদির তো আর বুড়ো নাই। ভয়-ভাবনা কিসের? তা বাজার তোমার করে দোব দিদি।
বৃদ্ধা বলিল—মরণ। তার আবার হাসি কিসের লা?
—বেশ, আর হাসব না। এখন কি বলছ বল?
—মর, তোকে কে বলছে? বলছি নাতবউকে। হা লা নাতবউ, এবার যে বড় আমার বাড়িতে চাল কুটতে গেলি না?
রাঙাদিদির বাড়িতে চেঁকি আছে, পদ্ম বরাবরই রাঙাদিদির পেঁকিতে পিঠার চাল কুটিয়া আনে। এবার যায় নাই, তাই বৃদ্ধা আসিয়াছে।
—বলি হালা, তোকে আমি কখনও কিছু বলেছি নাকি? বল্ কিছু বলেছি কি না? মনে তো পড়ছে না ভাই!
কাহাকে কখন যে বুড়ি কি বলে সে আর পরে তাহার মনে থাকে না।
ম্লান হাসি হাসিয়া পদ্ম বলিলতার জন্য নয়; এবার চাল কোটাই হয় নাই রাঙাদিদি।
–চাল কোটাই হয় নাই? বলিস্ কি?
–না।
–আমরণ! তা আর কবে চাল কুটবি? রাত লোহালেই তো লক্ষ্মী–
পদ্ম চুপ করিয়া রহিল। দুর্গা মাঝখান হইতে বলিলনাতবউয়ের অসুখ তো জান, রাঙাদিদি। অসুখ শরীরে কি করবে বল?
—তবে? লক্ষ্মী হবে কি করে? তোর সেই হাদামুষল মিন্সে কোথা? সেই অনিরুদ্ধ? সে পারে না?
দুর্গাই বলিল হবে কোনো রকম করে। কম্মকার আসুক, দোকান থেকে কিনে আনবে।
-–কিনে আনবে? না না। কলে কোটা গঁড়োয় কি লক্ষ্মী হয়? ও নাতবউ, এক কাজ কর, আমার ঘর থেকে নিয়ে আয় চাট্টি খুঁড়ো। তা দু সের-আড়াই সের দিতে পারব। আচ্ছা, আমিই না হয় দিয়ে যাব। ওমা! তা বলতে হয়। আমি এক্ষুনি দিয়ে যাচ্ছি।
যাইতে যাইতে দরজার গোড়ায় দাঁড়াইয়া বৃদ্ধা বলিলইছু শেখ পাইকারের করণটা দেখ দেখি দুগ্গা, বুড়ো গাইটার দাম বলছে চার টাকা। শেষমেশ বলে, পাঁচ টাকা। তোদের পাড়ায় আর কেউ পাইকার এলে পাঠিয়ে দি তো বুন্।
দুৰ্গাও ঝুড়িটা লইয়া উঠিল, বলিল–বাটি-ঘটি কাল এসে নিয়ে যাব ভাই। আজ চললাম।
—এইখানে কাল খাবে।
–বেশ। দুর্গা হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল।
অকস্মাৎ কোথা দিয়া কি হইয়া গেল। রাঙাদিদির সঙ্গে কথা বলিতে বলিতে কেমন করিয়া তাহার অন্তরের ক্ষোভ যেন জুড়াইয়া গেল। আবার সব ভাল লাগিতেছে। দুর্গার জিনিসগুলা সে প্রত্যাখ্যান করিল না, লাথি মারিয়া ফেলিয়া দিল না। দুর্গার ওই মিথ্যা কথাটা তাহার বড় ভাল। লাগিয়াছে; রাঙাদিদিকে সে বলিল—কামার-বউ তাহাকে জংশন শহর হইতে বাজার করিয়া আনিতে টাকা দিয়াছিল—এ সেই জিনিস।
সে রাঙাদিদির চালগুঁড়োর প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। বাড়িতে আতপ চাল নাই। চাল গুঁড়াইয়া একবার বাটিয়া লইয়া আপনার গোলা তৈয়ারি করিতে হইবে। আপনা অ্যাঁকিতে হইবে বাহির দরজা হইতে ঘরের ভিতর পর্যন্ত খামারে, মরাইয়ের নিচে গোয়াল ঘরে পর্যন্ত। চণ্ডীমণ্ডপে আবার পৌষ আগলানোর আলপনা আছে। মনে পড়িল, আউরী-বাউরী চাই। কার্তিক সংক্রান্তি মুঠ লক্ষ্মীর ধানের খড় পাকাইয়া সেই দড়িতে বাঁধিতে হইবে বাড়ির প্রতিটি জিনিস। ঘরের বাক্স-পেটরা তৈজসপত্র সবেতেই পড়িবে মা-লক্ষ্মীর বন্ধন। ঘরের চালে পর্যন্ত আউরী-বাউরীর বন্ধন পড়িবে। তাহা হইলেই বৈশাখের ঝড়ে আর চাল উড়িবে না।
সেই পুরাকালে ছিল এক রাখাল ছেলে। বনের ধারে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে সে আপনার গরুগুলিকে লইয়া চরাইয়া ফিরিত। গ্রীষ্মের রৌদ্র, বর্ষার বৃষ্টি, শীতের বাতাস তাহার মাথার। উপর দিয়া বহিয়া যাইত। মধ্যে মধ্যে দুঃখ-কষ্ট হইলে সে চোখের জল ফেলিত, আর ঊর্ধ্বমুখে দেবতাকে ডাকিত-ভগবান, আর পারি না, এ কষ্ট তুমি দূর কর, আমাকে বাঁচাও।
একদিন লক্ষ্মী-নারায়ণ চলিয়াছিলেন আকাশ-পথে। রাখালের কাতর কান্না আসিয়া পৌঁছিল। তাহাদের কানে। মা-লক্ষ্মীর কোমল হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। দূর কর ঠাকুর, রাখালের দুঃখ। দূর কর!
নারায়ণ হাসিলেন। বলিলেন—এ দুঃখ দূর করিবার শক্তি তো আমার নাই লক্ষ্মী, সে শক্তি তোমার!
লক্ষ্মী বলিলেন—তুমি অনুমতি দাও।
নারায়ণের অনুমতি পাইয়া লক্ষ্মী আসিলেন মর্ত্যে। চারিদিক হাসিয়া উঠিল—সোনার বর্ণচ্ছটায়, বাতাস ভরিয়া উঠিল দেবীর দিব্যাঙ্গের অপরূপ সৌরভে। রাখাল অবাক হইয়া গেল। দেবী রাখালের কাছে আসিয়া বলিলেন দুঃখ তোমার দূর হইবে, তুমি আমার কথামত কাজ কর। এই লও ধানের বীজ; বর্ষার সময় মাঠে এইগুলি ছড়াইয়া দাও, বীজ হইতে গাছ হইবে। সেই গাছের বর্ণ যখন হইবে আমার দেহবর্ণের মত, আমার গাত্রগন্ধের মত, গন্ধে যখন ভরিয়া উঠিবে তাহার সর্বাঙ্গ, তখন সেগুলি কাটিয়া ঘরে তুলিবে।
রাখাল লক্ষ্মীকে প্রণাম করিল। বর্ষায় প্রান্তরের বুকে ছড়াইয়া দিল ধানের বীজ; দেখিতে দেখিতে সমস্ত মাঠ ভরিয়া গেল সবুজ ধানের গাছে। ক্ৰমে ক্ৰমে বর্ষা গেল—সবুজ ধানের ডগায় দেখা দিল শিষ। রাখাল নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিল, কিন্তু এখনও সেই ঠাকরুনের মত বর্ণ হয় না, সে গন্ধও উঠিতেছে না। রাখাল অপেক্ষা করিয়া রহিল। হেমন্তের শেষ অগ্রহায়ণে একদিন রাত্রে ঘরে শুইয়াই রাখাল পাইল সে গন্ধ। সকালে উঠিয়াই সে ছুটিয়া গেল মাঠে। অবাক হইয়া গেল। সোনার বর্ণে গোটা মাঠটা আলো হইয়া উঠিয়াছে, দিব্যগন্ধে আকাশ বাতাস আমোদিত। সোনার বর্ণে, দিব্যগন্ধে আকৃষ্ট হইয়া আকাশে নানাবিধ কীট-পতঙ্গ-পাখি উড়িতেছে-পশুরা, আসিয়া জুটিয়াছে চারিপাশে, সেই ঠাকরুন যেন তাহার দুঃখে বিগলিত হইয়া মাঠ জুড়িয়া অঙ্গ এলাইয়া বসিয়া আছেন। রাখাল ধান কাটিয়া ভারে ভারে ঘরে তুলিল।
দেশের রাজা সংবাদ পাইয়া আসিয়া সোনা দিয়া কিনিতে চাহিলেন সমস্ত ধান। রাজার ভাণ্ডারের সোনা ফুরাইয়া গেল কিন্তু রাখালের ধান অফুরন্ত। রাজার বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। তখন রাজা আপনার কন্যাকে আনিয়া দান করিলেন রাখালের হাতে। সম্মুখেই পৌষসংক্রান্তিতে রাখাল লক্ষ্মীদেবীকে পূজা করিল। ওই ধানকেই স্থাপিত করিল সিংহাসনে, সিন্দুর কজ্জলে বসনে-ভূষণে তাহাকে বিচিত্র শোভায় সাজাইল, সম্মুখেই স্থাপন করিল জলপূৰ্ণ ঘট, ঘটের মাথায় দিল ডাব-আমের পল্লব। রাজকন্যা ঐ ধান ভানিয়া চাল করিলেন, চাল হইতে প্রস্তুত হইল সেই নানাবিধ সুখাদ্য, ঘৃতে-অন্নে ঘৃতান্ন, দুধে-অন্নে মিষ্টান্ন-পায়সান্ন-পরমান্ন, হরেক রকমের পিঠা সরুচাকলি, তাহার সঙ্গে পঞ্চপুষ্পে ধূপে-দীপে-চন্দনে-গন্ধে দেবীর পূজা করিয়া রাখাল ও রাজকন্যা দেবীর ভোগ দিয়া সর্বাগ্রে দিলেন কৃষাণকে, রাখালকে নিজের স্বামীকে, ঘরের জনকে তাহার পর বিলাইলেন পাড়া-প্রতিবেশীকে, হেলে বলদ, গাই-গুরু, ছাগল-ভেড়া—এমনকি বাড়ির উচ্ছিষ্টভভাজী কুকুরটা পর্যন্ত প্রসাদ পাইল।
লক্ষ্মীদেবী মূর্তিমতী হইয়া দেখা দিলেন, আপন পরিচয় দিলেন, বর দিলেন, তোমার মত এই পৌষ সংক্রান্তিতে যে আমার পূজার্চনা করিবে তাহার ঘরে আমি অচলা হইয়া বাস। করিব। পৃথিবীতে তাহার কোনো অভাব বা কোনো দুঃখ থাকিবে না। পরলোকে সে করিবে বৈকুণ্ঠে বাস।
ব্ৰত-কথাটি মনে মনে স্মরণ করিতে করিতে আশা-আকাঙ্ক্ষায় বুক বাঁধিয়া পরিতুষ্ট মনেই পদ্ম লক্ষ্মীর আয়োজন আরম্ভ করিল। ঘর-দুয়ার, খামার হইতে গোয়াল পর্যন্ত আলপনা অ্যাঁকিয়া এবার সে যেন একটু বেশি বিচিত্রিত করিয়া তুলিল। দুয়ার হইতে আঙিনার মধ্যস্থল পর্যন্ত আলপনায় অ্যাঁকিল চরণ-চিহ্ন। ওই চরণ-চিহ্ন। ওই চরণ-চিহ্নে পা ফেলিয়া লক্ষ্মী ঘরে আসিবেন। ঘরের মধ্যস্থলে সিংহাসনের সম্মুখে অ্যাঁকিল প্রকাও এক পদ্ম। অপরূপ তাহার কারুকার্য। মা আসিয়া বিশ্রাম করিবেন। শখ ধুইল, ধূপ বাহির করিল, প্রদীপ মার্জনা করিল, সিন্দুর রাখিল, কাজল পাড়িল। এদিকের আয়োজন শেষ করিয়া গুড়ে-নারিকেলে, গুড়ে-তিলে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিবে, দুধ জ্বাল দিয়া ক্ষীর হইবে। কত কাজ, কত কাজ! কাজের কি অন্ত আছে! আজ যদি তাহার একটা ছোট মেয়ে থাকি, তবে সে-ই জিনিসপত্রগুলি হাতে হাতে আগাইয়া দিতে পারিত। সহসা তাহার মনে পড়িয়া গেল—আলপনার কাজে তাহার একটা ভুল হইয়া গিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপে পৌষ-আগলানোর আলপনা চাই সেটা দেওয়া হয় নাই।
এক মুহূর্তে সে দাঁড়াইয়া ভাবিয়া লইল। মনে পড়িল অনিরুদ্ধ তখন বলিতেছিল, চণ্ডীমণ্ডপে তাহার কেহ যাইবে না, তাহার পৌষ-আগলানো পর্ব হইবে তাহার বাড়ির দুয়ারে!
না, সে হইবে না। পদ্ম তাহা করিবে না, করিতে দিবে না। মাকালী, বাবা বুড়োশিবের চরণতল ওই চণ্ডীমণ্ডপ ছাড়িয়া,না, সে হইবে না। পদ্ম আলপনা গোলার বাটি হাতে চণ্ডীমণ্ডপ অভিমুখেই বাহির হইয়া গেল।
চণ্ডীমণ্ডপের সামনে দাঁড়াইয়া পদ্মের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। এ কি সেই চণ্ডীমণ্ডপ? কোন্ জাদুকরের মায়াদণ্ডের স্পর্শে তাহার আমূল পরিবর্তিত হইয়া গিয়া এমন অপরূপ শোভায় হাসিতেছে! এ যে সব পাকা হইয়া গিয়াছে। পথ হইতে চণ্ডীমণ্ডপে উঠিবার পাকা সিঁড়ির দুই পাশে দুইটি হাতির গঁড় সিঁড়িগুলিকে বেষ্টন করিয়া যেন ধরিয়া রাখিয়াছে ষষ্ঠীতলার বকুল গাছটির চারিপাশ পাকা গোল বেদি করিয়া বাঁধানো। চণ্ডীমণ্ডপের মেঝে পাকা হইয়াছে, মসৃণ সিমেন্টের পালিশ ঝকমক করিতেছে। থামগুলিতে পলেস্তারা কবা হইয়াছে। তাহাতে দুধবরন কলি-চুন দেওয়া হইয়াছে। ওপাশে নূতন একটা কুয়া। পদ্মের মনে পড়িয়া গেল—এসব শ্রীহরি ঘোষের কীর্তি। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া আলপনা অ্যাঁকিতে বসিল। পৌষ পৌষ পৌষ, বড় ঘরের মেঝেয় এসে বস–একটা ঘর অ্যাঁকিতে হইবে। মরাই অ্যাঁকিতে হইবে। এস পৌষ বস তুমি, না যেয়ো ছাড়িয়া। পৌষ মাস তো শ্ৰীহরির, তাহাদের আবার পৌষ মাস কিসের?
—কে গা? কে তুমি, একরাশ আলপনা যেন দিয়ে না, বাছা। মুঠো মুঠো খরচ করে একজন বাধিয়ে দিলে—আর তোমরা তো আপনার কল্যাণ করে চাল গোলা ঢালছ। এরপর ধোবে মুছবে কে?
পদ্ম মুখ ফিরাইয়া দেখিল, শ্ৰীহরির মা পথের উপর হইতে চিৎকার করিতেছে। পদ্ম প্রতিবাদ করতে পারিল না। শ্ৰীহরির মায়ের এ-কথা বলিবার অধিকার আছে বৈকি। সে কোনোমতে আলপনা শেষ করিয়া চলিয়া আসিল।
বাড়ি ঢুকিতে গিয়াই দেখিল, দেবু তাহাদেরই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিতেছে। ঘোমটা টানিয়া সে একপাশে সরিয়া দাঁড়াইল। দেবুর পিছনে বাড়ির দরজায় দাঁড়াইয়াছিল অনিরুদ্ধ। দেবু হাসিয়া পদ্মকেই বলিল—কাল তা হলে পণ্ডিতগিন্নির কাছে লক্ষ্মীর কথা শুনতে যেয়ো মিতেনী। সে বলে দিয়েছে।
পদ্ম অবগুণ্ঠিত মস্তকে সায় দিয়া ইঙ্গিতে জানাইল, সে যাইবে।
দেবু চলিয়া গেল।
অনিরুদ্ধ বলিল পণ্ডিত এসেছিল; কার কাছে শুনেছে, লক্ষ্মীর উ্যুগ হয় নাই আমার, তাই দুটো টাকা দিয়ে গেল। এমন মানুষ আর হয় না! কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে আবার বলিল, কিন্তু সংসারে বাড়-বাড়ন্ত তো ওর হবে না, হবে ছিরের।
পদ্ম চুপ করিয়া রহিল। সে-ও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
অনিরুদ্ধ আবার প্রশ্ন করিল, আর কিছু আনতে হয় তো বল?
–না।
–তবে নে, কাজগুলো সেরে নে। আগে একবার তামুক সেজে দে দেখি।
অনিরুদ্ধকে তামাক সাজিয়া দিয়া সে উনানে কড়া চড়াইয়া আরম্ভ করিল গুড়-নারিকেলের পাক। তাহার অন্তর আবার দুঃখের আক্ষেপের আবেগে ভরিয়া উঠিয়াছে। দেবু পণ্ডিতের কথা ছাড়িয়াই দিতে হইবে পণ্ডিত সত্যই দেবতার মত মানুষ! কিন্তু ওই দুর্গা, তাহারও দয়াধৰ্ম আছে, ভালবাসা আছে, রাঙাদিদির মত কৃপণ, সেও পুণ্যকর্ম করে। শ্ৰীহরি ঘোষের কীর্তি তাহার মহত্ত্ব দেখিয়া সে তো অবাক হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহাদের জীবনে কি হইল!
দুঃখ তাহার নিজের জন্য, কিন্তু আজ সে হিংসা কাহাকেও করিল না। বরং সকলকেই সে শ্রদ্ধা নিবেদন করিল। আর বার বার কামনা করিল, মাগো! দুঃখ আমার দূর কর। সন্তানেসম্পদে আমার ঘর ভরিয়া দাও, আমি ষোড়শোপচারে তোমার পূজা দিব, আব্দুল কাটিয়া প্রদীপের সলিতা করিব, চুল কাটিয়া চামর বাঁধিয়া সে চামরে তোমায় বাতাস করিব, বুক চিরিয়া রক্ত দিয়া সেই রক্তে তোমার পায়ে আলতা পরাইব। তোমার পূজায় পঞ্চ-শব্দের বাজনা করিব, পট্টবস্ত্রের চাদোয়া টানাইবা রুপার সিংহাসনে সোনার ছাতার তলায় তোমাকে বসাইব; আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শী, দীন-দুঃখী, পশু-পক্ষীকে বিতরণ করিব তোমার প্রসাদ–একঅন্ন, পঞ্চাশ-ব্যঞ্জন!.
অনিরুদ্ধ বাড়ির বাহির হইতেই ব্যস্তসমস্ত হইয়া ব্যর্থ কণ্ঠে ডাকিল পদ্ম! ও পদ্ম!
পদ্ম চমকিয়া উঠিল। কি হইল আবার?
অনিরুদ্ধ ঘরের ভিতর ঢুকিয়া বলিল—কড়াইটা নামিয়ে রেখে আমার সঙ্গে আয় দেখি।
—কেন?
–পণ্ডিতকে ধরে নিয়ে গেল। পণ্ডিতের বাড়ি যাব।
–ধরে নিয়ে গেল? কে?
–সেটেলমেন্টের হাকিম পরোয়ানা বার করেছিল; থানা থেকে লোক এসে ধরে নিয়ে গেল।
সেটেলমেন্ট! সেটেলমেন্ট! উঃ—কোথা হইতে ইহারা আসিয়া গ্রামখানার অঁটি ধরিয়া ঝাকি দিয়া সর্ব অঙ্গ-স্নায়ুতন্ত্ৰী-মন এমন করিয়া অস্থির অবশ করিয়া দিল। নিত্য নূতন নোটিশ, নূতন হুকুম! ত-অ্যাঁটা পিয়নগুলোর যাওয়া আসার বিরাম নাই। পথে-ঘাটে সাইকেলের পর সাইকেল চলিয়াছে। কিন্তু হায় হায় এ কি কাণ্ড! দেবু পণ্ডিতের মত লোককে তাহারা ধরিয়া লইয়া গেল!