Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গজাননের কৌটো || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 6

গজাননের কৌটো || Shirshendu Mukhopadhyay

মধ্যরাত্রে ছয়টি হনুমান

মধ্যরাত্রে ছয়টি হনুমান রায়বাড়ির বাগানের পাঁচিলে পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসে আছে। খুবই চুপচাপ।

হঠাৎ সামনের অন্ধকার কুঁড়ে কালো পোশাক-পরা একটা বিশাল চেহারার লোক এসে লোহার ফটকের সামনে দাঁড়াল। পেছনে আরও জনাসাতেক ষণ্ডামার্কা মানুষ। প্রত্যেকের মুখেই রাক্ষসের মুখোশ। দু’জনের হাতে বন্দুক, দু’জনের হাতে বল্লম, তিনজনের হাতে লোহার রড। বিশালদেহী লোকটার হাতে তলোয়ার।

একজন নিঃশব্দে ফটকের তালাটা লোহার রডের চাড় দিয়ে ভেঙে ফেলল। কারও মুখে কোনও কথা নেই। দুটো কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠল। কিন্তু তেড়ে এসেও ভয় পেয়ে কেঁউ কেঁউ করে পালিয়ে গেল।

আটজন তোক দ্রুতপায়ে বাগানটা পেরিয়ে বাড়ির সামনের বারান্দায় উঠে সদর দরজাটা ঠেলে দেখল। বন্ধ।

ছ’টা হনুমান হঠাৎ হুপ-হুঁপ করে ডাক ছাড়তে-ছাড়তে গাছের ডাল বেয়ে দ্রুত বাড়ির পেছনদিকে চলে যাচ্ছিল।

হনুমানের শব্দে বিশালদেহী লোকটা চকিতে একবার ঘুরে বাগানটা দেখে নিল। রাত্রিবেলা হনুমানের এরকম আচরণ স্বাভাবিক নয়।

একজন বন্দুকধারী বলল, “গুলি চালাব?”

“না। দরজা ভাঙো।” পুরনো আমলের নিরেট কাঠের মজবুত দরজা। কিন্তু বিশাল মুশকো চেহারার দু-দুটো লোকের জোড়া-জোড়া লাথি পড়তে লাগল দরজায়। দুমদুম শব্দে বাড়ি কেঁপে উঠল। বাড়ির লোকজন ঘুম ভেঙে “কে? কে?” করে চেঁচাতে লাগল।

হরিকৃষ্ণ রায় জানলা দিয়ে বন্দুকের নল গলিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “এই কে রে? কার এত সাহস? গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব কিন্তু!”

কেউ কোনও জবাব দিল না। দরজাটা লাথির চোটে নড়বড় করতে লাগল। বাড়ির ভেতরে চেঁচামেচি বাড়ছে। পুরুষদের সঙ্গে বাড়ির মেয়েরা আর বাচ্চারাও চেঁচাচ্ছে, “ডাকাত! ডাকাত! মেরে ফেললে!”

দরজাটা দড়াম করে খুলে হাঁ হয়ে গেল।

খোলা তলোয়ার হাতে প্রথমে বিশালদেহী লোকটা এবং তার পিছু পিছু সাতজন সশস্ত্র লোক গটগট করে ভেতরে ঢুকল।

টর্চ ফেলে সিঁড়িটা দেখে নিয়ে সর্দার লোকটা বলল, “ওপরে চলো।”

ওপরে সিঁড়ির মুখেই হরিকৃষ্ণ বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। “কে? কে তোমরা? খবর্দার আর এগিয়ো না বলছি..”

তাঁর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই সর্দার নোকটা কোমর থেকে একটা ছোরা টেনে এনে ফলাটা দু’আঙুলে ধরে বিদ্যুদ্বেগে ছুঁড়ে মারল।

“বাপ রে!” বলে বন্দুক ফেলে বসে পড়লেন হরিকৃষ্ণ। ছোরাটা তাঁর বাহুমূলে বিধে গেছে।

“বাবা! বাবা!” বলে অঘোরকৃষ্ণ, হরিকৃষ্ণ, নীলকৃষ্ণ, গন্ধর্বরা সব ছুটে এসে ধরল তাঁকে।

লোকটা বজ্রগম্ভীর স্বরে বলল, “কেউ বাধা দিও না, মরবে।” গন্ধর্ব বলল, “কী চান আপনারা?” ৬৮

“এ বাড়ির পুরনো জিনিসপত্র কোথায় থাকে?” গন্ধর্ব ভয়-খাওয়া গলায় বলে, “ভাঙা আসবাবপত্র নীচের তলায়।”

“ওসব নয়। আমরা একটা কৌটো খুঁজছি। সোনার কৌটো। কোথায় থাকে পুরনো জিনিস?”

অঘোরকৃষ্ণ বললেন, “পুরনো জিনিস কিছু নেই।”

সদার লোকটা চোখের পলকে অঘোরকৃষ্ণের মুখে একটা ঘুসি মারল। অঘোরকৃষ্ণ ঘুসি খেয়ে দড়াম করে পড়ে গেলেন।

হরিকৃষ্ণ ক্ষতস্থান চেপে ধরে মুখ বিকৃত করে বললেন, “খামোখা মারধর করছ কেন বাপু? আমাদের সিন্দুকে কিছু পুরনো জিনিস আছে, দাঁড়াও, বের করে দেওয়া হচ্ছে। গন্ধর্ব, যাও তো আমার বিছানা শিয়রের লোশকের তলায় চাবি আছে, নিয়ে এসো।”

গন্ধর্ব দৌড়ে গিয়ে চাবি নিয়ে এল।

“কোথায় সিন্দুক আছে নিয়ে চলো। চালাকি করলে মেরে ফেলব।”

গন্ধর্ব তাদের পুরনো দলিল-দস্তাবেজের সুরক্ষিত ঘরটা খুলে দিয়ে বলল, “ওই যে সিন্দুক।”

বজ্রগম্ভীর স্বরে লোকটা বলল, “খোলো!”

গন্ধর্ব সিন্দুক খুলে পুরনো ভারী পাল্লাটা টেনে তুলল। ভেতরে মূল্যবান বাসন-কোসন, গয়নার বাক্স, রুপোর জিনিস, মোহর, রুপোর বাঁট লাগানো ছোরা থরেথরে সাজানো। লোকটা একটা-একটা করে জিনিস তুলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল ঘরের মেঝেয়। ছড়িয়ে গেল মোহর, রুপোর টাকা, গয়না, আরও কত জিনিস।

লোকটা হিংস্র গলায় বলল, “কৌটোটা কোথায়?” গন্ধর্ব মাথা নেড়ে বলে, “জানি না। যা আছে এখানেই আছে।”

গন্ধর্বের গালে একটা বিরাশি সিক্কার চড় কষিয়ে লোকটা বলল, “চালাকি হচ্ছে?”

গন্ধর্ব চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল।

লোকটা ফিরে সকলের দিকে পর্যায়ক্রমে চেয়ে বলল, “কৌটোটা এবাড়িতেই আছে। তোমরা লুকিয়ে রেখেছ। পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে যদি কৌটো বের করে না দাও তা হলে এক-এক করে সবাইকে কেটে ফেলব।”

বাড়ির সবাই হাঁ। মেয়েরা ডুকরে কাঁদছে। বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হরিকৃষ্ণ ছোরাটা বাহুমূল থেকে বের করেছেন। তাঁর ক্ষতস্থানে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিল তাঁর মেজো ছেলে হরিৎকৃষ্ণ। হরিকৃষ্ণ ব্যথায় মুখ বিকৃত করে বললেন, “বাপু হে, কৌটোটা কেমন দেখতে তা বললে না হয় হদিস দিতে পারি।”

“ছোট একটা সোনার কৌটো। কারুকাজ করা। বের করো, পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেই।”

হরিকৃষ্ণের জামাকাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। তবু তিনিই সবচেয়ে কম ঘাবড়েছেন। বললেন, “ওঃ, তা হলে বোধ হয় গজাননের কৌটোটার কথাই বলছ বাপু।”

লোকটা একটা বাজখাঁই ধমক দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, সেটাই। এক্ষুনি বের করো।”

হরিকৃষ্ণ বললেন, “ওটাও সিন্দুকেই ছিল। ভাল করে দ্যাখো, একটা লাল শালুতে মোড়া কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে।”

“না, নেই। তোমরা কৌটোটা লুকিয়ে রেখেছ।” হরিৎকৃষ্ণ বললেন, “আমার বাবা মিথ্যে কথা বলেন না।”

“চোপরও!” বলে লোকটা হঠাৎ একটা লাথি মেরে হরিকৃষ্ণকে সাত হাত দূরে ছিটকে ফেলে দিল।

সবাই আঁতকে চেঁচিয়ে উঠতেই লোকটা ধমক দিয়ে বলল, “খবর্দার। টু শব্দ নয়। চার মিনিট হয়ে গেছে। আর এক মিনিট মাত্র সময় আছে তোমাদের হাতে।”

দেখতে-দেখতে এক মিনিটও কেটে গেল।

সর্দার তার তলোয়ারটা তুলে তার একজন সঙ্গীকে বলল, “ওই বুড়ো লোকটার মুণ্ডুটা নামিয়ে ধরো। প্রথমে ওকে দিয়েই শুরু করা যাক।”

মুগুরের মতো হাতওয়ালা একটা লোক এগিয়ে এসে হরিকৃষ্ণের মাথাটা ধরে নামিয়ে রাখল। সর্দার তলোয়ারটা তুলতেই একটা কচি গলা শোনা গেল, “তোমরা এই কৌটোটা খুঁজছ?”

সর্দার তলোয়ার সংবরণ করে ফিরে চাইল।

পুতুল এগিয়ে এসে তার কচি দুটো হাতে-ধরা সোনার কৌটোটা তুলে দেখাল।

সর্দার ছোঁ মেরে তার হাত থেকে কৌটোটা নিয়ে টর্চের আলো ফেলে দেখল, “হ্যাঁ, এই তো সেই কৌটো! কোথায় পেলে?”

“এটা আমার পুতুলের বাক্সে ছিল।”

সর্দার কৌটোটার ডালা খুলে দেখল। তার মুখোশ-ঢাকা মুখে হাসি ফুটল কি না বোঝা গেল না। তবে সে যেন একটু খুশির গলায় বলল, “হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।”

পুতুল অবাক চোখে বিশাল চেহারার মানুষটাকে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দেখছিল। বলল, “এই কৌটোয় কী আছে?”

“তুমি খুলে দ্যাখোনি তো?”

“না। ডালাটা খুব শক্ত করে আটা ছিল। আমি খুলতেই পারিনি।”

“ভাল করেছ। এতে একটা বিষ আছে।”

“তোমরা আমাদের আর মারবে না তো!”

“না। শুধু একটা কথা!”

“কী কথা?”

“গজানন নামে কাউকে তোমরা দেখেছ?”

“কীরকম দেখতে?”

“গোঁফদাড়ি আছে। লোকটা বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। দেখেছ?”

“না তো!”

“সে কখনও যদি এই কৌটোর খোঁজে আসে, তা হলে তাকে বোলো কৌটোটা আমি নিয়ে গেছি।”

“তুমি কে, তা তো জানি না।”

“আমার নাম মাণ্ডুক।”

“তোমার মুখে মুখোশ কেন?”

“আমাকে দেখলে সবাই ভয় পায়, তাই মুখোশ পরে থাকি।”

ডাকাতরা আর দাঁড়াল না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল।

ওদিকে নীচের তলায় গজাননের জানলার বাইরে ছ’জন হনুমান জড়ো হয়েছে। তারা বিচিত্র সব শব্দে কথা বলছিল।

গজানন জানলার কাছে বসে নিবিষ্ট হয়ে তাদের কথা শুনছিল। তারপর সেও কয়েকটা বিচিত্র শব্দ করল। হনুমানেরা ধীরে ধীরে চুলে গেল।

মাঝরাতে শাসন একটা শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসল। রাতের কিছু চেনা শব্দ আছে। কুকুর বা শেয়ালের ডাক, বাদুড়-প্যাঁচার শব্দ, ইঁদুরের শব্দ, আরশোলার ফরফর, জীবজন্তুদের দৌড়োদৌড়ি, গাছে বাতাসের শব্দ, দূরের পেটা ঘড়ির আওয়াজ। কিন্তু এটা সেইসব চেনা শব্দ নয়। এত সূক্ষ্ম একটা খসখসে আওয়াজ যে, শুনতে পাওয়ার কথাই নয়!

শাসন উঠে বসে শব্দটা ফের শোনার চেষ্টা করছিল। ইন্দ্রিয়গুলি সজাগ। গায়ে হঠাৎ কেন যেন কাঁটা দিচ্ছিল তার। সেদিন কে যেন তার মাথা লক্ষ্য করে একটা কামানের গোলা ছুঁড়ে মেরেছিল। সে-ই আবার এল না তো কাজটা সমাধা করতে? সে গরিব মানুষ। নিতান্তই দীনদরিদ্র একটা টালির চাল আর বাঁশের বেড়ার ঘরে থাকে। দরজা জানলা মোটেই মজবুত নয়। একটা লাথি মারলেই ভেঙে পড়বে। এ ঘরে নিরাপত্তা বলে কিছু নেই।

শাসন তার চৌকি থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, বাইরে কোনও সন্দেহজনক শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না। কিছু শুনতে না পেয়ে সে দরজার তক্তার ফাঁকে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করল। ভাগ্য ভাল, বাইরে একটু জ্যোৎস্নার আলো আছে। সামান্য ফাঁক দিয়ে সে বারান্দা আর উঠোনের একচিলতে অংশ আবছা দেখতে পাচ্ছিল। সেখানে কেউ নেই। তবু সে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে এসে তার উঠোনে দাঁড়াল। বিশাল চেহারা, গায়ে কালো পোশাক, মুখে মুখোশ। একটা ক্ষীণ শিসের শব্দ হল। আরও কয়েকজন উঠোনে এসে ঢুকল।

প্রত্যেকেরই চেহারা খুব শক্তপোক্ত। প্রত্যেকের মুখেই মুখোশ।

শাসনের পালানোর কোনও রাস্তা নেই। এরা যে ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি তাও সে বুঝতে পারছে। কিন্তু আত্মরক্ষার কোনও উপায় আপাতত সে দেখতে পাচ্ছে না। তবে কিনা দীর্ঘকাল বিপদ-আপদের সঙ্গে বসবাস করার ফলে সে চট করে বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে না। কৌশল ছাড়া এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যে শক্ত, তা বুঝতে হঠাৎ সে এক দুঃসাহসী কাজ করে ফেলল।

হুড়কো খুলে দরজার কপাট সরিয়ে সে দাওয়ায় বেরিয়ে এসে হাত জোড় করে অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল, “মহারাজের জয় হউক।

এই দীনের কুটিরে পদার্পণ করিয়াছেন। আমি ধন্য।”

বলেই শাসন একটা আভূমি অভিবাদন করে ফেলল।

তার এরকম আচরণে লোকগুলো একটু থমকে গেছে।

সামনের বিশাল পুরুষটি বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “তুই কে?”

“শ্রীমন্মহারাজাধিরাজ, আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। পূজার্চনাদি করিয়া উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকি।”

“আমি কে, তা তুই জানিস?”

শাসন জানে না। কিন্তু তার মন বলছিল, এই লোকটা বিষাণ দত্তের সেই মেঘনাদবাবু হলেও হতে পারে। নিতান্তই অনুমান। তবে বিদ্যুৎ-চমকের মতো হঠাৎ তার মাথায় একটা নাম খেলে গেল।

সে হাঁটু গেড়ে বসে অতি বিনীতভাবে বলল, “ধর্মনগরের অধিপতি মহারাজ মঙ্গলকে আমার আনুগত্য জানাইতেছি।”

লোকটা হঠাৎ এগিয়ে এসে বজ্রমুষ্টিতে তার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কে বলেছে যে, আমি রাজা মঙ্গল?”

প্রবল সেই ঝাঁকুনিতে শাসনের মনে হল তার মুণ্ডুটা বোধ হয় ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে।

শাসন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “ক্ষমা করুন মহারাজ, আমার ভ্রম হইয়াছে।”

লোকটা অবশ্য তাকে ছাড়ল না। আর-একটা ঝাঁকুনিতে তার ঘাড়ের হাড় প্রায় আলগা করে দিয়ে বলল, “সব ব্যাপারে নাক গলাতে তোকে কে বলেছে?”

ব্যথায় শাসনের চোখে জল এল। সে বলল, “আর এইরূপ হইবে মহাশয়, বাক্য প্রদান করিতেছি।”

লোকটা তাকে হাতের ঝটকায় দাওয়ার ওপর ফেলে দিল। তারপর একজন সঙ্গীকে বলল, “আমার খঙ্গটি দাও।”

লোকটা একটা ঝকমকে খাঁড়া এগিয়ে দিল। লোকটা খাঁড়ার ধারটা একটু পরীক্ষা করে নিয়ে এগিয়ে এল।

শাসনের একটি গুণ আছে। সে হরিণের মতো দৌড়তে পারে। সে পড়ে গিয়েই ভেবে নিয়েছিল, যদি সে উঠে ছুট লাগায় তবে এইসব ভারী চেহারার লোকেরা তার নাগাল পাবে না। কিন্তু উঠে দৌড় লাগানোর জন্যও একটু সময় দরকার। সেই সময়টুকু পাওয়া যাবে কি?

লোকটা খাঁড়া হাতে দাঁড়িয়ে একজনকে বলল, “ওর মাথাটা ধরো।”

একটা লোক এগিয়ে এল। একটু সুযোগ। ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা আর মাথার ভেতরে একটা ডোম্বল ভাব সত্ত্বেও নিতান্ত জৈব প্রাণরক্ষার তাগিদে সে প্রায় অন্ধের মতো হঠাৎ শরীরটা গড়িয়ে এক ঝটকায় উঠোনে পড়ে গেল। পড়েই সে এগিয়ে-আসা লোকটার একটা ঠ্যাং ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই লোকটাও বিশাল একটা গাছের মতো দড়াম করে পড়ল উঠোনে। একটা ‘রে রে’ শব্দ করে উঠল সবাই। শাসন একটা লাফ দিয়ে খানিকটা তফাতে গিয়েই উঠোনের বেড়াটা ডিঙিয়ে নক্ষত্ৰবেগে ছুটতে লাগল। টের পেল পেছনে পেছনে লোকগুলো ভারী পা ফেলে দ্রুত ছুটে আসছে।

দিগ্বিদিক খেয়াল না করেই শাসন ছুটতে ছুটতে ডানধারে অন্ধকার আমবাগানটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমবাগানে চট করে লুকিয়ে পড়া যায়। সহজে ধরতে পারবে না।

সে অন্ধকার বাগানটায় ঢুকতেই কয়েকটি হনুমান হুপ-হুঁপ করে যেন উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। এ-সময়ে ওদের চেঁচামেচি করার কথা নয়। শাসন তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে আড়ালে খানিক দৌড়ে, খানিক হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল। যতখানি সম্ভব ওদের কাছ থেকে দূরে যাওয়া দরকার। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে বটে, কিন্তু বিপদ এখনও কাটেনি।

পেছন থেকে মাঝে-মাঝে জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ছে এদিক-সেদিকে। ওরা টের পেয়েছে যে, সে আমবাগানে ঢুকেছে। এবার ওরা চারধারে ছড়িয়ে পড়ে তাকে খুঁজবে। খুব সহজে রেহাই পাবে না শাসন। প্রাণভয়ে সে ফের ছোটার চেষ্টা করল। দু’বার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। কিন্তু দমে গেল না। এগোতে লাগল।

হঠাৎ ‘বাপ রে’ বলে একটা চিৎকার শোনা গেল পেছন থেকে। আর-একজন চেঁচিয়ে বলল, “গাছ থেকে কে যেন ঢিল মারছে হুজুর।”

গম্ভীর গলাটা বলল, “গাছে তাক করে গুলি চালাও।” দুম করে একটা গুলির শব্দ হল। সেইসঙ্গে হনুমানদের হুপ-হুঁপ শব্দ আসতে লাগল।

এই সুযোগে অনেকটাই এগিয়ে গেল শাসন। কে ঢিল মারল তা বুঝতে পারছে না। হনুমানগুলোই কি? এরকম তো হওয়ার কথা নয়!

হাঁটতে হাঁটতে আর দৌড়তে দৌড়তে সে যখন আমবাগানটা পেরিয়ে খোলা জায়গায় পা ফেলল, তখন ভোর হয়ে আসছে। এবং সে ধর্মনগর শিবাইতলার গঞ্জে পৌঁছে গেছে। সামনেই গন্ধর্বদের বাড়ি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress