Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » খট্টাঙ্গ ও পলান্ন || Narayan Gangopadhyay

খট্টাঙ্গ ও পলান্ন || Narayan Gangopadhyay

ওপরের নামটা যে একটু বিদঘুটে তাতে আর সন্দেহ কী! খট্টাঙ্গ শুনলেই দস্তুরমতো খটকা লাগে, আর পলান্ন মানে জিজ্ঞেস করলেই বিপন্ন হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়।

অবশ্য যারা গোমড়ামুখো ভালো ছেলে, পটাপট পরীক্ষায় পাশ করে যায়, তারা হয়তো চট করে বলে বসবে, ইঃ—এর আর শক্তটা কী! খট্টাঙ্গ মানে হচ্ছে খাট আর পলান্ন মানে হচ্ছে। পোলাও। এ না জানে কে!

অনেকেই যে জানে না তার প্রমাণ আমি আর আমার মতো সেই সব ছাত্র, যারা কমসে কম তিন-তিনবার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু ওই শক্ত কথা দুটোর মানে আমাকে জানতে হয়েছিল, আমাদের পটলডাঙার টেনিদার পাল্লায় পড়ে। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।

আচ্ছা গল্পটা তা হলে বলি।

খাটের সঙ্গে পোলাওয়ের সম্পর্ক কী? কিছুই না। টেনিদা খাট কিনল আর আমি পোলাও খেলাম। আহা সে কী পোলাও! এই যুদ্ধের বাজারে তোমরা যারা র‍্যাশনের চাল খাচ্ছ আর কড়মড় করে কাঁকর চিবুচ্ছ, তারা সে-পোলাওয়ের কল্পনাও করতে পারবে না। জয়নগরের খাসা গোপালভোগ চাল, পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ–

কিন্তু বর্ণনা এই পর্যন্ত থাক। তোমরা দৃষ্টি দিলে অমন রাজভোগ আমার পেটে সইবে। তার চাইতে গল্পটাই বলা যাক।

টেনিদাকে তোমরা চেনো না। ছহাত লম্বা, খাড়া নাক, চওড়া চোয়াল। বেশ দশাসই জোয়ান, হঠাৎ দেখলে মনে হয় ভদ্রলোকের গালে একটা গালপাট্টা থাকলে আরও বেশি মানাত। জাঁদরেল খেলোয়াড়—গড়ের মাঠে তিন-তিনটে গোরার হাঁটু ভেঙে দিয়ে রেকর্ড করেছেন। গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে।

এমন একটা ভয়ানক লোক যে আরও ভয়ানক বদরাগী হবে, এ তো জানা কথা।

আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে–বছরে ছমাস ম্যালেরিয়ায় ভুগি আর বাটি বাটি সাবু খাই। দুপা দৌড়াতে গেলে পেটের পিলে খটখট করে। সুতরাং টেনিদাকে দস্তুরমতো ভয় করে চলি শতহস্ত দূরে তো রাখিই। ওই বোম্বাই হাতের একখানা জুতসই চাঁটি পেলেই তো খাটিয়া চড়ে নিমতলায় যাত্রা করতে হবে।

কিন্তু অদৃষ্টের লিখন খণ্ডাবে কে?

সবে দ্বারিকের দোকান থেকে গোটা কয়েক লেডিকেনি খেয়ে রাস্তায় নেমেছি হঠাৎ পেছন থেকে বাজখাঁই গলা : ওরে প্যালা!

সে কী গলা! আমার পিলে-টিলে একসঙ্গে আঁতকে উঠল। পেটের ভেতরে লেডিকেনিগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। তাকিয়ে দেখি—আর কে? মূর্তিমান স্বয়ং।

—কী করছিস এখানে?

সত্যি কথা বলতে সাহস হল না বললেই খেতে চাইবে। আর যদি খাওয়াতে চাই তা হলে ওই রাক্ষুসে পেট কি আমার পাঁচ-পাঁচটা টাকা না খসিয়েই ছেড়ে দেবে! আর খাওয়াতে চাইলে—ওরে বাবা!

কাঁচুমাচু করে বলে ফেলোম, এই কেত্তন শুনছিলাম।

—কেত্তন শুনছিলে? ইয়ার্কি পেয়েছ? এই বেলা তিনটের সময় শেয়ালদার মোড়ে দাঁড়িয়ে কী কেত্তন শুনছিলে? আমি দেখিনি চাঁদ, এক্ষুনি দ্বারিকের দোকান থেকে মুখ চাটতে চাটতে বেরিয়ে এলে?

এই সর্বনাশ–ধরে ফেলেছে তো। গেছি এবারে। দুগানাম জপতে শুরু করে দিয়েছি ততক্ষণে, কিন্তু কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম কে জানে, ফাঁড়াটা কেটে গেল! না চটে টেনিদা গোটা ত্রিশেক দাঁতের ঝলক দেখিয়ে দিলে আমাকে। মানে, হাসল।

–ভয় নেই—আমাকে খাওয়াতে হবে না। শ্যামলালের ঘাড় ভেঙে দেলখোসে আজ বেশ মেরে দিয়েছি। পেটে আর জায়গা নেই।

আহা বেচারা শ্যামলাল! আমার সহানুভূতি হল। কিন্তু আমাকে বাঁচিয়েছে আজকে। দধীচির মতো আত্মদান করে আমার প্রাণ, মানে, পকেট বাঁচিয়েছে।

টেনিদা বললে, এখন আমার সঙ্গে চল দেখি!

সভয়ে বললাম, কোথায়?

—চোরাবাজারে। খাট কিনব একখানা—শুনেছি শস্তায় পাওয়া যায়।

–কিন্তু আমার যে কাজ—

—রেখে দে তোর কাজ। আমার খাট কেনা হচ্ছে না, তোর আবার কাজ কিসের রে? ভারি যে কাজের লোক হয়ে উঠেছিস—অ্যাাঁ?–কথাটার সঙ্গে সঙ্গে ছোটখাটো একটি রদ্দা আমার পিঠে এসে পড়ল।

বাঃ–কী চমৎকার যুক্তি! টেনিদার খাট কেনা না হলে আমার কোনও আর কাজ থাকতে নেই। কিন্তু প্রতিবাদ করবে কে? সূচনাতেই যে রদ্দা পিঠে পড়েছে, তাতেই হাড়-পাঁজরাগুলো ঝনঝন করে উঠেছে আমার। আর একটি কথা বললেই সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি অসম্ভব নয়।

–চল চল।

না চলে উপায় কী। প্রাণের চেয়ে দামি জিনিস সংসারে আর কী আছে?

চলতে চলতে টেনিদা বললে, তোকে একদিন পোলাও খাওয়াতে হবে। আমাদের জয়নগরের খাসা গোপালভোগ চাল—একবার খেলে জীবনে আর ভুলতে পারবি না।

কথাটা আজ পাঁচ বছর ধরে শুনে আসছি। কাজ আদায় করে নেবার মতলব থাকলেই টেনিদা প্রতিশ্রুতি দেয়, আমাকে গোপালভোগ চালের পোলাও খাওয়াবে। কিন্তু কাজটা মিটে গেলেই কথাটা আর টেনিদার মনে থাকে না। গোপালভোগ চালের পোলাও এ-পর্যন্ত স্বপ্নেই দেখে আসছি বসনায় তার রস পাবার সুযোগ ঘটল না।

বললাম, সে তো আজ পাঁচশো বার খাওয়ালে টেনিদা!

টেনিদা লজ্জা পেলে বোধহয়। বললে, না, না—এবারে দেখিস। মুশকিল কী জানিস-কয়লা পাওয়া যায় না—এ পাওয়া যায় না—সে পাওয়া যায় না।

পোলাও রাঁধতে কয়লা পাওয়া যায় না! গোপালভোগ চাল কী ব্যাপার জানি না, তা সেদ্ধ করতে কমন কয়লা লাগে তাও জানি না। কিন্তু কয়লার অভাবে পোলাও রান্না বন্ধ আছে। এমন কথা কে কবে শুনেছে? আমাদের বাসাতেও তো পোলাও মাঝে মাঝে হয়, কই র‍্যাশনের কয়লার জন্য তাতে তো অসুবিধে হয় না! হাইকোর্ট দেখানো আর কাকে বলে! ওর চাইতে সোজা বলে দাও না বাপু-খাওয়াব না। এমনভাবে মিথ্যে মিথ্যে আশা দিয়ে রাখবার দরকার কী?

টেনিদা বললে, ভালো একটা খাট যদি কিনে দিতে পারিস তা হলে তোর কপালে পলান্ন নাচছে, এ বলে দিলাম।

—পলান্ন!

-হ্যাঁ—মানে পোলাও! তোদের বুকড়ি চালের পোলাওকে কি আর পলান্ন বলে নাকি। হয় গোপালভোগ চাল, তবে না!

হায় গোপালভোগ! আমি নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

তারপরে খাট কেনার পর্ব।

টেনিদা বললে, এমন একটা খাট চাই যা দেখে পাড়ার লোক স্তম্ভিত হয়ে যাবে! বলবে, হ্যাঁ—একটা জিনিস বটে! বাংলা নড়বড়ে খাট নয়—একেবারে খাঁটি সংস্কৃত খট্টাঙ্গ। শুনলেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চমকে উঠবে!

কিন্তু এমন একটা খট্টাঙ্গ কিনতে গিয়েই বিপত্তি!

একেবারে বাঁশবনে ডোমকানা। গায়ে গায়ে অজস্র ফার্নিচারের দোকান। টেবিল, চেয়ার, সোফা, আলনা, আয়না, পালঙ্কের একেবারে সমারোহ। কোন দোকানে যাই?

চারদিক থেকে সে কী সংবর্ধনার ঘটা! যেন এরা এতক্ষণ ধরে আমাদেরই প্রতীক্ষায় দস্তুরমতো তীর্থের কাকের মতো হাঁ করে বসে ছিল।

—এই যে স্যার—আসুন—আসুন—

–কী লইবেন স্যার, লইবেন কী? আয়েন, আয়েন, একবার দেইখ্যাই যান—

—একবার দেখুন না স্যার—যা চান, চেয়ার, টেবিল, সোফা, খাট, বাক্স, ডেক্সো, টিপয়, আলনা, আয়না, র‍্যাক, ওয়েস্ট-পেপার বাসকেট, লেটার বক্স–

লোকটা যেভাবে মুখে ফেনা তুলে বলে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল একেবারে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত বলে তবে থামবে।

টেনিদা বললে, দুত্তোর—এ যে মহা জ্বালাতনে পড়লাম।

উপদেশ দিয়ে বললাম, চটপট যেখানে হয় ঢুকে পড়ো, নইলে এর পরে হাত-পা ধরে টানতে শুরু করে দেবে।

তার বড় বাকিও ছিল না। অতএব দুজনে একেবারে সোজা দমদম বুলেটের মতো সেঁধিয়ে গেলাম—সামনে যে-দোকানটা ছিল, তারই ভেতরে।

–কী চান দাদা, কী চাই?

–একখানা ভালো খাট।

—মানে পালং? দেখুন না, এই তো কত রয়েছে। যেটা পছন্দ হয়! ওরে ন্যাপলা, বাবুদের জন্যে চা আন, সিগারেট নিয়ে আয়–

—মাপ করবেন, চা-সিগারেট দরকার নেই। এক পেয়ালা চা খাওয়ালে খাটের দরে তার পাঁচ গুণ আদায় করে নেবেন তো। আমরা পটলডাঙার ছেলে মশাই, ওসব চালাকি বুঝতে পারি। বাঙাল পাননি–হুঁ!

দোকানদার বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর সামলে নিয়ে বললে, না খান তো না খাবেন মশাই ব্যবসার বদনাম করবেন না।

–না করবে না! ভারি ব্যবসা—চোরাবাজার মানেই তো চুরির আখড়া। চা-সিগারেট খাইয়ে আরও ভালো করে পকেট মারবার মতলব!

মিশকালো দোকানদার চটে বেগুনী হয়ে গেল : ইঃ, ভারি আমার ব্রাহ্মণ-ভোজনের বামুন রে! ওঁকে চা না খাওয়ালে আমার আর একাদশীর পারণ হবে না! যান যান মশাই অমন খদ্দের ঢের দেখেছি।

—আমিও তোমার মতো ঢের দোকানদার দেখেছি যাও–যাও—

এই রে-মারামারি বাধায় বুঝি! প্রাণ উড়ে গেল আমার। টেনিদাকে টেনে দোকান থেকে বার করে নিয়ে এলাম।

টেনিদা বাইরে বেরিয়ে বললে, ব্যাটা চোর।

বললাম, নিঃসন্দেহ। কিন্তু এখানে আর দাঁড়িয়ো না, চলো, অন্য দোকান দেখি।

অনেক অভ্যর্থনা এড়িয়ে আর অনেকটা এগিয়ে আর একখানা দোকানে ঢোকা গেল। দোকানদার একগাল হেসে বললে, আসুন—আসুন—পায়ের ধুলো দিয়ে ধন্য করান! এ তো আপনাদেরই দোকান।

—আমাদের দোকান হলে কি আর আপনি এখানে বসে থাকতেন মশাই? কোন কালে বার করে দিতাম, তারপর যা পছন্দ হয় বিনি পয়সায় বাড়িতে নিয়ে যেতাম।

এ-দোকানদারের মেজাজ ভালো—চটল না। একমুখ পান নিয়ে বাধিত হাসি হাসবার চেষ্টা করলে : হেঁঃ—হেঁঃ—হেঁঃ। মশাই রসিক লোক। তা নেবেন কী?

–একখানা ভালো খাট।

—এই দেখুন না। এ-খানা প্লেন, এ-খানাতে কাজ করা। এটা বোম্বাই প্যাটার্ন, এটা লন্ডন প্যাটার্ন, এটা ডি-লুক্স প্যাটার্ন, এটা মানে-না-মানা প্যাটার্ন–

–থামুন, থামুন। থাকি মশাই পটলডাঙা স্ট্রিটে—অত দিল্লি-বোম্বাই কামসকাটকা প্যাটার্ন দিয়ে আমার কী হবে! এই এ-খানার দাম কত?

—ও-খানা? তা ওর দাম খুবই সস্তা। মাত্র সাড়ে তিনশো।

–সা–ড়ে তিনশো?—টেনিদার চোখ কপালে উঠল।

—হ্যাঁ–সাড়ে তিনশো। এক ভদ্দরলোক পাঁচশো টাকা নিয়ে ঝুলোঝুলি পরশু তাঁকে দিইনি।

-কেন দেননি?

–আমার এসব রয়্যাল খাট মশাই-যাকে-তাকে বিক্রি করব? তাতে খাটের অমর্যাদা হয় যে। আপনাকে দেখেই চিনেছি বনিয়াদী লোক। তাই মাত্র সাড়ে তিনশোয় ছেড়ে দিচ্ছি—আপনি খাটের যত্ন-আত্তি করবেন।

আহা-লোকটার কী অন্তদৃষ্টি। ঠিক খদ্দের চিনেছে তো। আমার শ্রদ্ধাবোধ হল। কিন্তু টেনিদা বশীভূত হবার পাত্র নয়।

—যান—যান মশাই, এই খাটের দাম সাড়ে তিনশো টাকা হয় কখনও? চালাকি পেয়েছেন? কী ঘোড়ার ডিম কাঠ আছে এতে?

বলতে বলতেই খাটের পায়া ধরে এক টান—আর সঙ্গে সঙ্গেই মড়মড়মড়াৎ। মানে, খাটের পঞ্চত্ব-প্রাপ্তি।

–হায়—হায়—হায়—

দোকানদার হাহাকার করে উঠল : আমার পাঁচশো টাকা দামের জিনিস মশাই, দিলেন সাবাড় করে? টাকা ফেলুন এখন।

–টাকা। টাকা একেবারে গাছ থেকে পাকা আমের মতো টুপটুপ করে পড়ে, তাই না? খাট তো নয়—দেশলাইয়ের বাক্স, তার আবার দাম!

দোকানদার এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। খপ করে টেনিদার ঘাড় চেপে ধরেছে : টাকা ফেলুন—নইলে পুলিশ ডাকব।

বেচারা দোকানদার—টেনিদাকে চেনে না। সঙ্গে সঙ্গে জুজুৎসুর এক প্যাঁচে তিন হাত দূরে ছিটকে চলে গেল। পড়ল একটা টেবিলের ওপর সেখান থেকে নীচের একরাশ ফুলদানির গায়ে। ঝনঝন করে দু-তিনটে ফুলদানির সঙ্গে সঙ্গে গয়াপ্রাপ্তি হয়ে গেল—খণ্ড-প্রলয় দস্তুরমতো।

দোকানদারের আর্তনাদ—হইহই হট্টগোল। মুহূর্তে টেনিদা পাঁজাকোলা করে তুলে ফেলেছে আমাকে, তারপর বিদ্যুৎবেগে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বৌবাজার স্ট্রিটে। আর বেমালুম ঘুষি চালিয়ে ফ্ল্যাট করে ফেলেছে গোটা তিনেক লোককে। তারপরেই তেমনি ব্লিৎক্রি করে সোজা লাফিয়ে উঠে পড়েছে একখানা হাওড়ার ট্রামে। যেন ম্যাজিক।

পিছনের গণ্ডগোল যখন বৌবাজার স্ট্রিটে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে আমরা ওয়েলিংটন স্ট্রিট পেরিয়ে গেছি।

আমি তখনও নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি না। উঃ—একটু হলেই গিয়েছিলাম আর কী। অতগুলো লোক একবার কায়দামতো পাকড়াও করতে পারলেই হয়ে গিয়েছিল, পিটিয়ে একেবারে পরোটা বানিয়ে দিত।

টেনিদা বললে, যত সব জোচ্চোর। দিয়েছি ঠাণ্ডা করে ব্যাটাদের।

আমি আর বলব কী। হাঁ করে কাতলা মাছের মতো দম নিচ্ছি তখনও। বহু ভাগ্যি যে পৈতৃক প্রাণটা রক্ষা পেল আজকে।

ট্রাম চীনেবাজারের মোড়ে আসতেই টেনিদা বললে, নাম—নাম।

—এখানে আবার কী?

—আয় না তুই।…এক ঝটকায় উড়ে পড়েছি ফুটপাথে।

টেনিদা বললে, চীনেদের কাছে সস্তায় ভালো জিনিস মিলতে পারে। আয় দেখি। বাঙালীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি, আবার চীনেম্যানের পাল্লায়। নাঃ, প্রাণটা নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারব মনে হচ্ছে না। প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে নিতান্তই পটল তুলল আজকে। কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম হায় হায়!

সভয়ে বললাম, আজ না হয়—

চল চল ঘাড়ে আবার একটি ছোট রদ্দা।

ক্যাঁক করে উঠলাম। বলতে হল, চলো।

চীনেম্যান বললে, কাম কাম, বাবু। হোয়াত্ ওয়ান্ত? (What want?)

টেনিদার ইংরেজী বিদ্যেও চীনেম্যানের মতোই। বললে, কট ওয়ান্ট্‌।

–কত্? ভেরি নাইস্‌ কত্। দেয়ার আর মেনি। হুইচ তেক? (Cot? Very nice cot. There are many. Which take?)

—দি।…একটা দেখিয়ে দিয়ে টেনিদা বললে, কত দাম?

—তু হান্দ্রে লুপিজ (Two hundred rupees)।

—অ্যাঁ—দুশো টাকা! ব্যাটা বলে কী! পাগল না: পেট খারাপ? কী বলিস্ প্যালা এর দাম দুশো হয় কখনও?

চুপ করে থাকাই ভালো। যা দেখছি তা আশাপ্রদ নয়। পুরনো খাট রং-চং করে একটু চেহারা ফিরাবার চেষ্টা হয়েছে। খাট দেখে একটুও পছন্দ হল না। কিন্তু টেনিদা যখন পছন্দ করেছে, তখন প্রতিবাদ করে মার খাই আর কি! না হয় ম্যালেরিয়াতেই ভুগছি, তাই বলে কি এতই বোকা?

বললাম, হুঁ, বড্ড বেশি বলছে।

টেনিদা বললে, সব ব্যাটা চোর। ওয়েল মিস্টার চীনেম্যান, পনেরো টাকায় দেবে?

—হো-হোয়াত? ফিতিন লুপিজ? দোস্ত জোক বাবু। গিভ এইতি লুপিজ। (What? Fifteen rupees? Dont joke, Babu! Give eighty rupees.)

–নাও–নাও চাঁদ—আর পাঁচ টাকা দিচ্ছি–

—দেন গিভ ফিপতি—

শেষ পর্যন্ত পঁচিশ টাকায় রফা হল।

খাট কিনে মহা উল্লাসে টেনিদা কুলির মাথায় চাপালে। আমাকে বললে, প্যালা, এবারে তুই বাড়ি যা—

পোলাও খাওয়ানোর কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল কিন্তু লাভ কী। দোকানদার ঠেঙিয়ে সেই থেকে অগ্নিমূর্তি হয়ে আছে—পোলাওয়ের কথা বলে বিপদে পড়ব নাকি। মানে মানে বাড়ি পালানোই প্রশস্ত!

কিন্তু পোলাও ভোজন কপালে আছেই—ঠেকাবে কে?

পরের গল্পটুকু সংক্ষেপেই বলি। রাত্রে বাড়ি ফিরে খাটে শুয়েই টেনিদার লাফ। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ছারপোকা কাঁকড়াবিছে, পিশু কী নেই সেই চৈনিক খাটে? শোবার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বালাময়ী অনুভূতি।

খানিকক্ষণ জ্বলন্ত চোখে টেনিদা তাকিয়ে রইল খাটের দিকে। বটে, চালাকি। তিনটে গোরা আর চোরাবাজারের দোকানদার ঠ্যাঙানো রক্ত নেচে উঠেছে মগজের মধ্যে। তারপরেই একলাফে উঠনে অবতরণ, কুড়ল আনয়ন–এবং–

অতগুলো বাড়তি কাঠ দিয়ে আর কী হবে। দিন কয়েক কয়লার অভাব তো মিটল। আর ঘরে আছে গোপালভোগ চাল—অতএব–

অতএব পোলাও।

খট্টাঙ্গের জয় হোক। আহা-হা কী পোলাও খেলাম! পোলাও নয়—পলান্ন। তার বর্ণনা আর করব না, পাছে দৃষ্টি দাও তোমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress