খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো লালা স্বরাজের। আজ বৃহস্পতিবার। আর কঘণ্টা পরেই দশটা। এত ভোরে কোনদিন ওঠেনি সে। ঘরেই তো ফেরে রোজ রাত তিনটের আগে নয়। কাল রজনীর কথামত ছুটিতে কেটেছে। ঘুমিয়েছিল বারোটার মধ্যে। জেগে উঠে বুকের মধ্যে রিমঝিম করতে থাকল তার। স্বর্গে থাকেন বিধাতা পুরুষ। মর্তের মানুষের সঙ্গে একেক সময় তার পরিহাস করতে ইচ্ছে হয়, এরকম কথা শোনা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল কোলামবাসের এই ননম্বর কামরায় যা ঘটলো তাকে হয়ত দশটা মানুষ মিলে সেই পরিহাসই বলবে। কিন্তু লালা স্বরাজের কাছে তার ব্যাখ্যা অন্য রকম। ব্যাখ্যা থাক, যা ঘটলো তা এই।
গোসল করে এসে চা খেতে খেতে সকালের কাগজ পড়ছিল সে। আজ তার মন বসছিল না। কোন সংবাদে। চঞ্চল চোখ এ পাতা ও পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছিল, একই লেখা সতেরোবার দেখছিল। এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল ছোট্ট একটি সংবাদ। সে সংবাদে লেখা, গতকাল বিকেলে করাচিতে আসছিল হায়দ্রাবাদ থেকে লোকাল। তার পাদানি থেকে ফসকে পড়ে দশরথ নামে আনুমানিক পয়ষট্টি বৎসরের এক দরিদ্র বৃদ্ধ হরিজন গুরুতর রূপে আহত হয়েছে। তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে আশঙ্কাজনক অবস্থায়।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল স্বরাজ। দশরথ? দশরথ যে তার বাবার নাম
যে বাবাকে ফেলে সে ছোটবেলায় পালিয়ে গিয়েছিল, যে বাবাকে সে গত পাঁচ বছর ধরে করাচির বস্তিতে বস্তিতে খুঁজে বেরিয়েছে। তার বাবা বেঁচে থাকলে তো আজ পঁয়ষট্টি বছর বয়সের হতেন। তিনিই কি আসছিলেন হায়দ্রাবাদ থেকে? উত্তেজনায় সারা শরীর কেঁপে উঠলো লালা স্বরাজের। কিন্তু কিছুতেই বিচলিত হওয়া স্বভাব নয় তার। এ বৃদ্ধ তার বাবা নাও হতে পারেন। দশরথ নামে রামায়ণের যুগ থেকে আজ অবধি কোটি কোটি মানুষ জন্ম নিয়েছে।
তবু দুর্ঘটনার কথা শুনে তার মনের মধ্যে কেমন করে উঠলো। কী জানি হয়ত হাতের কাছে এসে হারিয়ে যাবে। তবু তো নামের মিল রয়েছে, এ মিলটুকুও সে গত পাঁচ বছরে খুঁজে পায়নি।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাতটা বাজে। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসা যাবে। হয়ত রজনী এখনো ঘুম থেকেই ওঠেনি।
পোশাক পরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল সে হোটেল থেকে। বুড়ো পাঠান পোর্টারের সঙ্গে দেখা হলো সিঁড়ির মুখে। তাকে বলল, মেম সাহেব আমার কথা জিগ্যেস করলে বোলো আমি এক্ষুণি আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেল না স্কুটার, ট্যাকসি। একটা টাঙ্গা যাচ্ছিল। সেটাকে থামিয়ে উঠলো। স্বরাজ। কিছু দূরে গিয়ে একটা খালি ট্যাসি চোখে পড়তেই চিৎকার করে সেটা থামাল। বসলো তাতে। ট্যাসি ছুটে চলল রেলওয়ে হাসপাতালের দিকে।
হাসপাতালে এ সময় ভিজিটর আসা নিষেধ। তার সাংবাদিক কার্ড দেখিয়ে মুক্তি পাওয়া গেল। খোঁজ পেতে পেতে লাগল মিনিট পনেরো। অবশেষে তেতলার এক চার–বেড। কামরায় তাকে নিয়ে এলো ওয়ার্ডেন।
দরোজায় পা দিয়েই লালা স্বরাজ দেখল বেড খালি। আসলে তিনটে বেড খালি ছিল, সেই তিনটেই আগে চোখে পড়েছে তার। আবার যখন ভালো করে তাকাল, দেখল, ডান দিকের বেডে ফিরে শোয়া একটি দেহ। সমস্ত দেহ কম্বলে ঢাকা। মুখের যতটুকু প্রকাশিত কেবল। শাদা চুল দেখা যাচ্ছে। তার শরীর এমন শান্তিতে ডুবে আছে যে এ কেবল অধিক মর্ফিয়াতেই সম্ভব।
ডাক্তার জানাল, একটা পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচুর।
লালা স্বরাজ ধীরে ধীরে বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়ে চেষ্টা করল তার মুখ দেখতে। ভালো করে দেখা গেল না। তখন সে ঘুরে তার ফেরানো মুখের সমুখে। এসে দাঁড়াল।
একটা পলক। কিসসু দেখতে পেল না স্বরাজ। কিংবা দেখল পথে ঘাটে দেখা হাজার হাজার ধাঙড় ঝাড়ুদার ভিখিরিদের একটা মুখ। হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেল তার। পরক্ষণে একপাল ঘোড়ার পদক্ষেপে বিচূর্ণ হতে থাকল তার সমস্ত অনুভূতি। সেই মুখ, চিবুকের নিচে সেই গভীর কাটা দাগ, গলায় সেই রূপোর মাদুলি! তার বাবা। তার ঝাড়ুদার বাবা, যে বাবাকে সে খুঁজে বেরিয়েছে পাঁচটি বছর। তিনি শুয়ে আছেন মর্ফিয়ার আচ্ছন্ন করা ঘুমে। কালো ত্বক বয়সের ভারে আরো কালো হয়েছে, কুঞ্চনে ভরে গেছে মুখ, চিবুকের হাড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আরো। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলো পিতার দিকে সন্তান। যেন পঁচিশ বছরের অদর্শনের বিরাট ফাঁক কয়েক মুহূর্তের হাহাকার ভরা দৃষ্টিতে ভরে তুলেছে স্বরাজ। সে একবার হাত রাখতে গেল জ্ঞানহীন দশরথের শরীরে, ফিরিয়ে আনল, বিমূঢ়ের মতো তাকাল চারদিকে। কোনো রকমে ডাক্তারকে বলতে পারল, বাঁচবেন?
এখনো বলা যাচ্ছে না। কে লোকটা? ডাক্তার স্বরাজকে দেখে নিয়ে আবার শুধালো, আপনার বাড়িতে কাজটাজ করত নাকি?
শুনে তার ভীষণ ক্রোধ হলো। চমকে উঠলো সারাটা অন্তর। নিজেকে সংযত করে চোয়ালের হাড় দৃঢ় করে সে উচ্চারণ করল, আমার বাবা।
ও মাই গড। অস্কুট বিস্ময়–ধ্বনি বেরুলো ডাক্তারের কণ্ঠ থেকে। অবাক হয়ে সে একবার পিতার দিকে দেখল, একবার পুত্রের দিকে।
আধঘন্টার মধ্যে হোটেলে ফিরতে চেয়েছিল স্বরাজ। কিন্তু হোটেলের কথা তার আর মনে রইলো না। মনে পড়ল না রজনীর কথা। আজ দশটার সময় তার বিয়ে, রজনী তার জন্যে। তৈরি হয়ে বসে থাকবে—- এসব কিছুই যেন তার জীবনে ঘটবার কথা ছিল না। সে নিষ্পলক বসে রইলো দশরথের পাশে। ডাক্তার আসছে, যাচ্ছে, নার্স সেবা করছে, ওষুধ দিচ্ছে, ইনজেকশান হচ্ছে ছবির মতো সব ঘটে যাচ্ছে তার চোখের সমুখে। একটা শব্দ তার। কানে যাচ্ছে না। ওদের একটা কথার মানে সে বুঝতে পারছে না।
সারাটা দিন বসে রইলো সেখানে। নাওয়া–খাওয়া কিছুই হলো না। কেবল মনে হলো, সে উঠে গেলেই ফাঁকি দিয়ে তার বাবা স্বর্গে যাত্রা করবেন। যেন সে বসে আছে বলেই এখনো তার মৃত্যু সম্ভব হচ্ছে না।
বিকেলের দিকে একটু জ্ঞান হলো দশরথের। যেন একবার চোখ মেলল। উদগ্রীব হয়ে স্বরাজ ডাকল, বাবা। চোখ বন্ধ করল দশরথ। সে শুনতেও পেল না। আবার সে ডাকল, বাবা।
রাত নটার সময় পরিপূর্ণ চোখ মেলল দশরথ। দেখল, একটি অপরিচিত মুখ। কোমরের নিচ থেকে সব শূন্য লাগছে, কোথায় যেন যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝতে পারা যাচ্ছে না, মাথার মধ্যে চোখে দেখা সব কিছু টলছে, স্থির হয়ে আবার টলছে।
সে বলল, বাবা, আমি স্বরাজ।
কে?
দশরথের কাছে দূর থেকে চেনা মনে হলো নামটা। যেন বহুঁকাল আগে ভিড়ের মধ্যে কোথাও শুনেছিল। অজান্তে তার হাতটা উঠে এলো, কাঁপতে কাঁপতে স্পর্শ করল স্বরাজের চোখের কোল।
স্বরাজের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে অশ্রু দশরথের শিথিল আঙুলের ডগা সিক্ত করে দিল। আলোর প্রতিফলনে একখন্ড দীপ্তি হয়ে উঠলো সে অংশটুকু। হাতটা পড়ে গেল। বিছানার পরে। লালা স্বরাজ সে হাত তার আকুল মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, বাবা, বাবা, তুমি শুনছ, তুমি চিনতে পারছ না? বাবা, আমি স্বরাজ। আমি স্বরাজ। আমি রাগ করে চলে গিয়েছিলাম। বাবা, আমি স্বরাজ।
দশরথ তার কণ্ঠ শুনল কিনা বোঝা গেল না। কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার মুখে। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করবাব ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। আধ ঘণ্টা পরে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হলো।
তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন কামরায়। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো স্বরাজ। অস্থির পদচারণা করতে করতে সে জেসাসের ছবি মনে করবার চেষ্টা করল। পাগলের মতো প্রার্থনা করতে লাগল। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঈশ্বরের সিংহাসন টলিয়ে দশরথের জীবন ভিক্ষা সে চাইলো। মুহুর্মুহ উত্তর্ণ হয়ে উঠলো। আবার সে প্রার্থনা করল।
আবার তাকে নিয়ে আসা হলো বেডে। দশরথ যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাক্তারের দিকে চোখ তুলে স্বরাজ তাকাতেই সে বলল, এখনো বেঁচে আছেন। আমরা চেষ্টা করছি।
আশান্বিত হয়ে সারারাত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জেগে রইলো স্বরাজ। আশা, কখন চোখ মেলে সে ছেলেকে চিনতে পারবে।
রাত চারটে ছাপ্পান্ন মিনিটে ঘুমের মধ্যে মারা গেল দশরথ। যন্ত্রের মতো বুকে ক্রশ করলো লালা স্বরাজ। তবু বিশ্বাস হলো না। তবু যেন আশা ফুরাতে চায় না। নার্স দেহটাকে যখন কম্বলে ঢেকে দিল তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলো।
আমার পিতাকে তুমি স্বর্গে নিও, যেমন তুমি সবাইকে তোমার অসীম ক্ষমার মধ্য দিয়ে স্বর্গে নেবে। আমরা যারা জীবিত, আমাদের যেন অহংকার না হয়। একমাত্র তোমার নিকটেই সান্ত্বনা। তোমারই এ রাজ্য, সর্বক্ষমতা, সর্বগৌরব। আমেন।
.
আর রজনী? সারাটা দিন সে প্রতীক্ষা করল স্বরাজের জন্যে। দশটা বেজে গেল তবু সে এলো না, তখন তার প্রসাধনে প্রস্তুত দেহ, অনুভবে সম্পন্ন হৃদয়, আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। ভাবলো এই হয়ত সে এসে যাবে, রাজার মতো এসে দাঁড়াবে স্বরাজ তার দুয়ারে। লজ্জা করল, নিজে গিয়ে খবর নিতে। সে যে আজ বিয়ের কনে।
এগারোটা পেরিয়ে গেল তবু যখন স্বরাজ আসেনি, তখন সে কম্পিত চরণে নিচে নেমে দেখে ননম্বর কামরা বন্ধ। বুকের মধ্যে আগুনের মোহর পড়লো যেন তার। স্বরাজ যে কাগজে কাজ করে সেখানে টেলিফোন করে সন্ধান পাওয়া গেল না। তাড়াতাড়ি ওপরে এসে নিজের ঘরে বসে বুকের পরে হাত রেখে আত্মস্থ হবার চেষ্টা করল রজনী। স্বরাজ কি শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পালটে পালিয়ে গেল মহসিনের মতো? নিজের পোড়া কপালটার কথা মনে করে পাগলের মতো হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো তার। ইচ্ছেটা এত তীব্র, হৃদপিণ্ড ফেটে পড়বে যেন।
বুড়ো পাঠান এসে জানিয়ে গেল, সাহেব বাইরে গেছেন, বলে গেছেন একটু পরেই ফিরবেন। তার কথা কানেও গেল না রজনীর। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো সে। মলিন হতে লাগল তার মুখের রং। খসে পড়ল কপালের কুঙ্কুম। পাণ্ডুর হলো কবরীর মোতিয়া–মালা। বেলা গেল, তবু স্বরাজ এলো না।
কিসসু ভাবতে পারল না মেয়েটা। ভাবনার উৎস যেন তার বিকল হয়ে গেছে। ইন্দ্রিয় হয়েছে পাথব। যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইলো। না অতীত, না বর্তমান, না ভবিষ্যৎ কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারল না।
সন্ধ্যের ঠিক আগে যখন সমস্ত ঘরটা একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারে, আর রজনীর মনে হচ্ছিল তার মৃত্যু হচ্ছে, ঠিক তখন দরোজায় টোকা পড়ল।
হৃদয় লাফিয়ে উঠলো দুরাশায়। দরোজা খুলে দেখল, মহসিন।
মহসিন। দুয়ার খুলে চেনা এই লোকটার মুখ একেবারে রজনীর চোখে দুর্বার তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়লো যেন।
এক মুহূর্তে কী হলো তার মনের মধ্যে, মহসিনের বুকের পরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বেষ্টন করে তাকে দুহাতে আঘাত করতে করতে অশ্রু জড়ানো বিকৃত কণ্ঠে সে বলতে লাগল, তুমি আমার শত্রু। আমাকে কেন ভালবাসলে? কেন চলে গেলে?
বিহ্বল হয়ে গেল মহসিন। রিক্ত, সর্বস্বান্ত, বিপন্ন অস্তিত্ত্ব এই লোকটা কিসসু বুঝতে পারল না। রজনীর খোলা এলো চুল, বিস্ফারিত চোখ দেখে সে ভয় পেলো, অপরাধী বোধ করল নিজেকে। আজো সে টাকা নিতে এসেছিল রজনীর কাছ থেকে। রজনীর ওপর দিয়েই দুঃখের দিনগুলো পার হবে ভেবেছিল। কিন্তু তা তলিয়ে গেল কোথায়। সেদিন যে বিশ্রী কথাগুলো রজনীকে বলেছিল, সেটা তো ছিল তার পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথম আবির্ভাবের সংকোচ আর অপরাধের বিরুদ্ধে একটা বর্ম। আজ সে বর্ম ভেঙ্গে গেল খানখান হয়ে। সে খোলা দরোজার মুখে রজনীকে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে উচ্চারণ করল, রজনী, আমি বাসা করেছি, আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমি আর কোথাও যাবো না, রজনী।
বাসার কথাটা অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে মহসিনের। তার বাসা কোথায়? তার বাসা তো পথ। কিন্তু রজনীকে বুকের মধ্যে নিয়ে, তার কান্নার জন্যে মিথ্যে ছাড়া আর কিছুতে সান্ত্বনা দেয়ার কথা সে ভাবতে পারল না।
নিজেকে মুক্ত করে রজনী বলল, চলো, আমাকে এখুনি নিয়ে যাও।
মহসিন হাত ধরলো তার। দৃপ্ত ভঙ্গিতে রজনী সিঁড়ির দিকে এগুলো। খোলা দরোজা পড়ে রইল খোলা। মহসিন তাকে নিরস্ত করবার মতো সাহস পেল না খুঁজে। কেবল বলল, তাই চলো।
.
তখন যদি ওরা একবার পেছনে ফিরে তাকাতো, দেখতে পেতো, একেবারে দক্ষিণে বাতি নেভানো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ একটা মানুষ তাদের দেখছিল। সে লোকটা দেখেছে রজনী মহসিনের আলিঙ্গনে বাঁধা। দৃশ্যটা চোখে পড়তেই তার হৃদয়ে তীরবিদ্ধ হবার যন্ত্রণা হয়েছিল। মুমূর্ষ মানুষের মতো সে তাকিয়ে দেখেছে ওদের। তাকিয়ে দেখেছে রজনীকে। দেখেছে মহসিনের সঙ্গে তাকে চলে যেতে।
যেন তার জীবন থেকে অপসারিত হলো সূর্য।
রজনী চলে গেলে পীরজাদা তার ঘরে এসে দাঁড়াল। মাথা নত করে কী ভাবলো অনেকক্ষণ ধরে। এ কসপ্তাহ রজনীকে সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, আজ রজনী যখন নিজেই চলে গেল তখন হৃদয় ধাবিত হলো তারই দিকে। কিছুতেই ফেরানো যাচ্ছে না। অথচ রজনীকে অবাধে যেতে দিতে হয়েছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে মৃত একটা মানুষের মতো নিশ্চলতা নিয়ে সে দেখেছে তাদের দুজনকে।
দ্রুত একটা চিঠি লিখল পীরজাদা। সেটা লালা স্বরাজের ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্যে বেয়ারার হাতে দিল। তারপর দরোজা বন্ধ করে আলমিরা খুলে দেখল চার বোতল হুইস্কি এখনো আছে। নামিয়ে আনলো বোতল চারটে। টেবিলের ওপর পাশাপাশি রেখে খুললো সব কটার মুখ। নিভিয়ে দিল বাতি। তখন বাইরের অস্পষ্ট আলো ঘরের মধ্যে বেলে জ্যোছনার মতো ছড়িয়ে পড়ল লাফিয়ে। তখন উন্মত্তের মতো মাথা পেছনে ঠেলে হাঁ করে একটার পর একটা বোতল থেকে পান করতে লাগল ঢকঢক করে।
.
শবদাহ করে সকাল নটার সময় হোটেলে ফিরল লালা স্বরাজ। এসে সোজা গেল রজনীর ঘরে। দরোজা ঠেলে দেখল, তালা বন্ধ। নিচে নেমে এসে শুনলো, কাল সন্ধ্যের সময় সে চলে গেছে।
কোথায়?
বলতে পারল না কেউ। ম্যানেজারেব কাছে জিগ্যেস করেও কোনো লাভ হলো না। কেবল এইটুকু শোনা গেল, মহসিনের সঙ্গে গেছে রজনী। নিজেকে তখন ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হলো তার। পৃথিবীতে এই একটা বন্ধন ছিল—- তার বাবা। তাকে দাহ করে এসে নিঃসঙ্গতা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট নেই।
নিজের ঘরে এসে দেখল, মেঝেয় একটা চিঠি। হয়ত রজনীর চিঠি। হাতে নিয়ে পীরজাদার হাতের লেখা চোখে পড়ল তার।
স্বরাজ, বন্ধুত্বের অনেক ঋণে তুমি আমাকে আবদ্ধ করেছ। আজ একটা অনুরোধ করব। আমি হয়ত মরতে যাচ্ছি, আমার দেহ তুমি গুজরানওয়ালায় পাঠিয়ে দাও। তোমার কল্যাণ হোক।
বোকার মতো চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলো স্বরাজ। দৌড়ে তেতলায় এসে পীরজাদার দরোজা ঠেলে দেখে ভেতর থেকে বন্ধ। উন্মত্তের মতো আঘাত করতে লাগল সে দরোজায়। ভেতর থেকে খুলে দিল না কেউ। আবার সে আঘাত করল, আবার, আবারও।
ম্যানেজারকে ডেকে এনে দরোজা খুলে লাশ বার করা হলো পীরজাদার। মেঝের পরে শূন্য চারটে বোতল। প্রাণহীন নিস্পন্দ দেহ লুটিয়ে ছিলো পা সোফায়, মাথা মেঝেয়, চোখ বিস্ফারিত, মুখে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের একত্রিত এক অর্থহীন অসীম বিরক্তি। আর কিছু না। লালা স্বরাজ একদিনে দেখল দুটি মৃত্যু, আর একটি মানুষের হারিয়ে যাওয়া। বুকের পরে ক্রশ করতে ভুলে গেল সে এবার।
সেদিন রাতে সে অফিসে বসে সংবাদ লিখল তার টাইপরাইটারে—-কাল রাতে ঘুমের মধ্যে হার্টফেল করে মারা গেছে পীরজাদা।
যে লোকটার জীবন ছিল বিড়ম্বিত, যে লোকটা ছিল তার বন্ধুদের অসীম করুণার পাত্র, সে আত্মহত্যা করেছে এ সংবাদ ছেপে তাকে আরো করুণার পাত্র করতে পারলো না লালা। স্বরাজ। টাইপ শেষ করতে করতে দেখল, ভালো করে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আচমকা চোখে হাত দিয়ে দেখল, চোখ পানিতে ভরে আছে। সম্ভবত লালা স্বরাজ ছিল পীরজাদার একমাত্র বন্ধু।