Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কালোপায়রা দিঘির ওপারের ছাতিমবন নিবিড় হয়েছে, তার ছায়ায় ছায়ায় উত্তর দেউলের যাবার পথে বাদুরনখী গাছের জঙ্গল তেমনি ঘন, যেমন শরৎ চিরকাল দেখে এসেছে, তবে এখনো গাছ শুকিয়ে যায় নি— সবে বেগুন রঙের ফুল ধরেছে বড় বড় সবুজ পাতার আড়ালে৷ শরৎ আগে আগে প্রদীপ হাতে রাজলক্ষ্মী পেছনে৷ কত পরিচিত পুরনো পথ, সারা জীবনই যেন অতীব শান্ত ও নিরুপদ্রব আরামে ওই বাদুড়নখী গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে সে, তার পিতৃগৃহের পুণ্য আবেষ্টনী তার জীবনের পাথেয় যুগিয়ে এসেছে— যে জীবনের না আছে রাত্রি, না আছে অরুণোদয়—শুধু এমনি চাপা গোধূলি, হৈচৈহীন কর্মকোলাহলহীন!

প্রদীপ দিয়ে ওরা আবার ফিরল৷ পথের দুপাশে পুষ্পশ্রীর লীলায়িত চেতনা ওর আগমনে যেন আনন্দিত৷ কতকাল পরে রাজকন্যা বাড়ি ফিরেছে!

রাজলক্ষ্মী বলে, এঃ দিদি, এ ঘরে বসে রাঁধবে কি করে? জল পড়ে মেজে যে একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে!

—পিঁড়ি পেতে নেব এখন৷ তুই আমার বাপের ভিটের নিন্দে করিস নি বলে দিচ্ছি—

রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, সেই ছেলেমানুষি স্বভাব এখনও যায় নি শরৎদি—

—চা খাবি?

—তা খাচ্ছি—এখন বলো এতকাল কোথায় ছিলে তোমরা?

—রাজারাজড়ার কাণ্ড, একটু হিল্লিদিল্লি বেড়িয়ে আসা গেল!

—সে তো বুঝতেই পারছি৷

—আজ রাত্তিরে এখানে খাবি রাজলক্ষ্মী৷ কিন্তু কিছু নেই বলছি, শুধু ধুঁধুলভাতে, ধুঁধুলভাজা৷ ভাঙা ঘরে এই দুই তরুণীতে বসে বহুকাল পরে আবার আসর জমালে—ওদিকে দুই বৃদ্ধ উঠোনে দুই কাঁঠালকাঠের পিঁড়ি পেতে বসে অনেক রকম রাজা-উজির বধের গল্প করছিলেন৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে ইতিমধ্যে চলে গিয়েছেন৷

—ভাই, জ্যাঠামশায় আর বাবাকে চাটুকু দিয়ে আয় তো—

রাজলক্ষ্মী চা দিতে গেলে কেদার বললেন, আরে আমার মা-লক্ষ্মী যে! আয় আয়—কতকাল পরে দেখলাম, ভালো ছিলি?

গোপেশ্বর চাটুজ্জেও বললেন, হ্যাঁ, এ খুকিকে তো দেখেছি বটে এখানে—কি নাম যেন তোমার মা?

রাজলক্ষ্মী দুজনের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে রান্নাঘরে চলে গেল৷

কেদার বললেন, দাদা, এবার এখানে কিছুদিন থেকে যাও৷ একসঙ্গে দিনকতক কাটানো যাক—

—শরৎ-মা বলছিল—তীর্থভ্রমণে একবার চলুন, বেরুনো যাক রাজামশাই—

কেদার নিশ্চিন্ত আরামে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বললেন, আর কোথাও বেরুতে ইচ্ছে করে না দাদা৷ বিদেশে বড় গোলমাল—শুনলে তো সবই! আমাদের এই জায়গাটাই ভালো—বাইরে নানারকম ভয়৷ কেন এখানে ওখানে বেরুনো—আমার হাতে এখনো যা টাকা আছে, এ বছরটা হেসে খেলে চলে যাবে৷ খাজনাপত্তর কেউ দেয় নি দুটি বছর—কাল থেকে আবার তাগাদা শুরু করি৷

শরৎ নিজে তামাক সেজে আনতেই গোপেশ্বর চাটুজ্জে হাঁ হাঁ করে উঠলেন৷ —তুমি কেন মা—তুমি কেন? আমাকে বললেই তো হত—এসব আমি পছন্দ করি নে, মেয়েদের দিয়ে তামাক সাজানো! রাজামশায়ের তামাক আমি সাজব৷

কেদার বললেন, তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় দাদা৷ আর যে উপকার তুমি করেছ, তার ঋণ আমি বা আমার মেয়ে কেউ শুধতে পারব না৷ আমার এ বাড়িতে যতদিন ইচ্ছে থাকো, তোমার বাড়ি তোমার ঘর-দোর৷ আমার মেয়ে তোমার আমার তামাক সাজবে এ আর বেশি কথা কি দাদা?

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, আচ্ছা রাজামশাই, এই কালোপায়রা দিঘি৷ ওপারের বন কেটে বেশ আলু হয়—কিছু বীজ এনে—

—না দাদা, ওসব আমাদের বংশে নেই৷ চাষকাজ করে চাষা লোকেরা৷ আমার দরকার হয় গড়ের জঙ্গল থেকে মেটে আলু তুলে আনব৷ সোজা মেটে আলুটা হয় গড়ের জঙ্গলে৷ সে বছর উত্তর দেউলের গায়ের বন থেকে আলু তুলেছিলাম এক একটা আধমণ ত্রিশ সের৷ আলুর অভাব কি আমার?

হঠাৎ জগন্নাথ চাটুজ্জেকে পুনরায় আসতে দেখে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ও শরৎ, জগন্নাথ খুড়ো আসছেন—আর একটু চা পাঠিয়ে—

জগন্নাথ চাটুজ্জে আসতে আসতে বললেন, তুমি বাড়ি এসেছ শুনে অনেকে দেখা করতে আসছে কেদার রাজা৷ আমি গিয়ে সাতকড়ির চণ্ডীমণ্ডপে খবরটা দিয়ে এলাম—সেই জন্যেই গিয়েছিলাম৷ ওঃ, একটু তেল আনতে বলো তো শরৎকে! বিছুটি যা লেগেছে গায়ে—বড্ড বিছুটির জঙ্গল বেড়েছে গড়ের খালের পথটাতে৷ ছিলে না অনেকদিন, চারিধারে বনজঙ্গল হয়ে—

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, কাল আমি সব কেটে সাফ করে দেব—দেবেন তো দেখিয়ে জায়গাটা!

জগন্নাথ চাটুজ্জে এসেছেন এদের সব খবর সংগ্রহ করতে৷ একটু পরেই তিনি বড় বেশি আগ্রহ দেখাতে লাগলেন, একা এতদিন কোথায় ছিলেন, কি ভাবে কাটল সে-সব খবর জানতে৷ জগন্নাথ বললেন, তুমি কি বরাবর হিংনাড়ায় ছিলে এই দেড় বছর—না আর কোথাও—

—না, আমি—গিয়ে হিংনাড়াতেই—

—কাদের আড়তে বললে—

—ঘোষেদের আড়তে৷ বিপিন ঘোষ বিনোদ ঘোষ দুই ভাই—ওদেরই—

—মাটসের বিনোদ ঘোষ?

—মাটসে তো ওদের বাড়ি নয়, শত্রুঘ্নপুর—

—সে আবার কোন দিকে? নাম তো শুনি নি—

—শত্রুঘ্নপুর বাজিতপুর—রামনগর থানা৷

কেদার ক্রমশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন জগন্নাথ চাটুজ্জের জেরায়৷ এত খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করবার কি দরকার তিনি বুঝতে পারলেন না৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে পরের ছিদ্র অনুসন্ধান করে জীবন কাটিয়ে দিলেন কিনা, তাই ভয় হয়৷

গোপেশ্বরকে দেখিয়ে জগন্নাথ বললেন, ইনি সেই একবার তোমার এখানে এসেছিলেন না? চমৎকার হাত তবলার৷ একদিন শুনতে হবে আবার৷

—হ্যাঁ৷

—শরৎ বুঝি এঁর পরিবারের সঙ্গে তীর্থ করে এল?

—হ্যাঁ৷

—বেশ বেশ৷

জগন্নাথ চাটুজ্জে হঠাৎ বললেন, ভালো কথা কেদার ভায়া, শুনেছ বোধ হয়, প্রভাসের বাবা হারান বিশ্বেস মারা গিয়েছে আজ বছরখানেক হল৷ প্রভাসদের কলকাতার বাড়িতে তোমরা তো প্রথম যাও—না?

কেদারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ জগন্নাথ চাটুজ্জে কতটা জানে বা না জানে আন্দাজ করা শক্ত৷ কি ভেবে ও কি কথা বলছে, তাই বা কে জানে? হঠাৎ প্রভাসের কথা তোলার মানে কি?

তবুও সত্য কথার মার নেই ভেবে তিনি বললেন, প্রভাসদের বাড়িতে তো ছিলাম না আমরা৷ একটা বাগানবাড়িতে আমাদের থাকবার জায়গা করে দিয়েছিল৷

—কতদিন সেখানে ছিলে তোমরা?

—বেশি দিন নয়—দিন পনেরো৷

—তার পর কোথায় গেলে?

এইবার জবাব দিলেন গোপেশ্বর চাটুজ্জে৷ বললেন, তার পর একদিন আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা৷ আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করলাম বাগানবাড়িতে গিয়ে তার পরদিন সকালে৷ আমার বাড়ির সকলে তীর্থ করতে বেরিয়েছিল—সেই সঙ্গে শরৎকে নিয়ে গেলাম৷ রাজামশাই দেশে চলে আসছেন, হিংনাড়ার বাজারে ঘোষেদের আড়তের একজন কর্মচারীর সঙ্গে ওঁর চেনা ছিল—সে নিয়ে গিয়ে চাকরি জুটিয়ে দিলে৷ এই হল মোট ব্যাপার৷ কেমন, এই তো রাজামশাই?

—হ্যাঁ, ওই বৈকি৷

দুপুরবেলা৷ কেউ কোথায় নেই৷ গোপেশ্বর কালোপায়রার দিঘিতে মাছের চার করতে গিয়েছেন, আহারাদির পর কেদারকে নিয়ে মাছ ধরতে যাবেন৷

শরৎ বাবাকে একা পেয়ে বললে, আচ্ছা বাবা, আমার খোঁজ করলে না কেন?

কেদার এ কথার কি উত্তর দেবেন? এ সব ব্যাপারকে তিনি এড়িয়ে চলতে চান—জীবনের সব চেয়ে বড় ধাক্কাকে তিনি ভুলে যেতে চেষ্টা করে আসছেন—তাঁর সব চেয়ে ভয় মেয়ে পাছে আবার ওইসব কথা তোলে৷

আমতা আমতা করে বললেন, তা—খোঁজ করি কোথায়? আমার—

—তোমাকে ওরা বলেছিল আমি ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে দেখা করি নি—না? বলো বাবা, তা যদি বিশ্বাস করে থাকো আমি তোমার সামনেই দিঘির জলে ডুবে মরব৷

এবার কেদার যেন একটু বিচলিত হলেন, তাঁর অনড় আত্মস্বাচ্ছন্দ্য-বোধ এইবার একটু ধাক্কা খেলে৷ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে তিরস্কারের সুরে বললেন, তাই তুই বিশ্বাস করিস যে আমি ওসব ভাবতে পারি? দে—একটু তেল দে মাখবার— দেখি আবার গোপেশ্বর ভায়া মাছের চারের কতদূর কি করলে! তোর রান্না হল?

—বেশ বাবা, কি নিশ্চিন্দিই থাকতে পার তুমি, তাই শুধু আমি ভাবি৷ ঘরে আগুন লাগলেও বোধ হয় তোমার সাড়া জাগে না—মানুষে যে কি করে তোমার মতো—আচ্ছা আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি—উত্তর দেবে?

কেদার বিষণ্ণ মুখে বললেন, কি?

—প্রভাসের নামে তোমাকে কেউ কিছু বলেছিল তো? সেই মুখপোড়া গিরীনই বলে থাকবে৷ তুমি পুলিসে খবর দিলে না কেন?

—তারাই বললে পুলিসে খবর দেবে তোর নামে৷ তাতেই তো আমি পালিয়ে এলাম৷

পুলিসের কাছে নালিশে কে আসামী কে ফরিয়াদি হয় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই শরতের—ওসব বড় গোলমেলে ব্যাপার৷ সে চুপ করে রইল৷

কেদার বললেন, কষ্ট পেয়েছিস না মা?

—যাও, তোমাকে আর—

—না মা, ছিঃ, রাগ করতে নেই৷ কি রাঁধছিস? বেগুন এনে দেব এখন ওবেলা৷ গেঁয়োহাটি যাব তাগাদা করতে, ব্যাটারা আজ দু-বছর খাজনার নামটি করে নি৷

—করবে কি? তুমি ছিলে এ চুলোয়? মেয়েকে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেও ভেসে পড়েছিলে৷ কি নির্বিকার পুরুষমানুষ তুমি তাই শুধু ভাবি বাবা৷

শরতের এ মেজাজকে কেদারের চিনতে বাকি নেই৷ এ সময় ওর সামনে থাকতে যাওয়া মানে বিপদ টেনে আনা৷ কেদার তেল মেখে সরে পড়লেন৷ বাবাকে যতক্ষণ দেখা গেল শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে, তারপর তিনি কালোপায়রা দিঘির পাড়ের বন-ধুঁধুলের লতাজালের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলে শরৎ দুই হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল৷ তার বাবা, তাদের বনজঙ্গলে ঘেরা এত বড় গড়বাড়ি, কত পুরনো ভাঙা মন্দির, উত্তর দেউল, বারাহী দেবীর ভগ্ন পাষাণমূর্তি, ওই ছায়ানিবিড় ছাতিমবন—এসব ফেলে তাকে কোথায় চলে যেতে হয়েছিল ভাগ্যের বিপাকে! আর যদি সে না ফিরত, আর যদি বাবাকে না দেখতো, গড়বাড়ির মাটির পুণ্যস্পর্শলাভের সৌভাগ্য যদি আর না ঘটত তার?

কার পায়ের শব্দে সে মুখ তুলে দেখলে রাজলক্ষ্মী একটা বাটি হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠছে৷ এই আর একটি মানুষ—যাকে দেখে শরৎ এত আনন্দ পায়! দেড় বছরের মধ্যে কত জায়গা সে বেড়াল, কত নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল—কিন্তু এমন কি একটা দিনও গিয়েছে যেদিন সে এই গরিব ঘরের মেয়েটার কথা ভাবে নি৷

—কি রে ওতে?

—তোমাদের জন্যে একটু সুত্তু�নি—মা বললেন জ্যাঠামশায়কে দিয়ে আয়—

—খাওয়া হয়েছে?

—পাগল! এখুনি খাওয়া হবে? তোমাদের এখান থেকে গিয়ে নাইব—তার পর—

—আর বাড়ি যায় না, এখানেই খা—

—না, না শরৎদি—

—খেতেই হবে৷ আচ্ছা, কেন অমন করিস বল তো? কতকাল দুই বোনে বসে একসঙ্গে খাই নি তা তোর মনে পড়ে? মোটে কাল আর আজ যদি হয়—সত্যি ভাই, বিশ্বাস এখনও যেন হচ্ছে না যে, আমি আবার গড়শিবপুরের ভিটেতে বসে আছি৷ একযুগ পরে আবার এ মাটিতে—

রাজলক্ষ্মীকে শরৎ এখনও সব কথা খুলে বলে নি৷ রাজলক্ষ্মীও ওকে খুঁটিনাটি কিছুই জিজ্ঞেস করে নি প্রথম আনন্দের উত্তেজনায়৷ শরৎ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে রাজলক্ষ্মীকে সে অবসর সময়ে সব খুলে বলবে৷ বন্ধুত্বের মধ্যে দেওয়াল তুলে রাখা তার পছন্দ হয় না৷

শরৎ বললে, এই দেড় বছরের গাঁয়ের খবর বল—কিছুই তো জানি নে৷

—চিন্তে বুড়ি মরে গিয়েছে, জানো?

—আহা, তাই নাকি? কবে মোলো?

—ফাল্গুন মাসে৷ গুরুপদ জেলের সেই হাবা ছেলেটা মরে গিয়েছে আষাঢ় মাসে৷ ম্যালেরিয়া জ্বরে৷

—আহা!

—পাঁচী গয়লানীর বাড়ি চোর ঢুকে সব বাসন নিয়ে গিয়েছিল৷ থানার দারোগা এল, এর নাম লিখলে, ওর নাম লিখলে—কিছুই হল না শেষটা৷

—ভালো কথা, ওপাড়ার সেজখুড়িমার ছেলেপিলে হবে দেখে গিয়েছিলাম—

—একটা ছেলে হয়েছে—বেশ ছেলেটি৷ দেখতে যাবে কাল?

—বেশ তো, চল না৷ সাতকড়ি চৌধুরীর মেয়ের বিয়ে হয়েছে?

—কেন হবে না? হাতে পয়সা আছে—মেয়ের বিয়ে বাকি থাকে?

শরৎ হেসে বললে, কেন রে, তোর বুঝি বড় দুঃখু বিয়ে না হওয়ায়?

—কার না হয় শরৎদি, যদি সত্যি কথা বলা যায়! যেমনি মা হিম হয়ে বসে আছে, তেমনি মেজখুড়িমা হিম হয়ে বসে আছে—আমার এদিকে আঠারো পেরুলো, লোকের কাছে বলে বেড়ান পনেরোতে নাকি পা দিইছি৷ এমন রাগ ধরে!

শরৎ হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি৷

—ওমা, তুই হাসালি রাজলক্ষ্মী৷ আজকালকার মেয়ে সব হল কি? সত্যি রে, তোর মনে কষ্ট হয়?

—ওই যে বললাম দিদি, সত্যি কথা বললে হাসবে সবাই৷ তুমি বললে, তাই বললাম৷

—আমি দেখব রে তোর সম্বন্ধ?

—না, হাসি না শরৎদি৷ এতদিন তুমি ছিলে না—আমার মন পাগল-পাগল হয়ে উঠত৷ এই গাঁয়ে একঘেয়ে থাকলে মানুষ পাগল হয়ে যায় না তুমিই বলো? তার চেয়ে মনে হয়—যা হয় একটা দেখে-শুনে দে, একঘেয়েমির হাত থেকে নিস্তার পাই৷ জন্মালাম গড়শিবপুর, তো রয়েই গেলাম সেই গড়শিবপুরে৷ এই যে তুমি কত দেশ বেড়িয়ে এলে শরৎদি, কেন বেড়িয়ে এলে? নতুন জিনিস দেখবার জন্যে তো?

শরৎ গম্ভীর সুরে বললে, আমার কপাল দেখে হিংসে করিস নে ভাই৷ তোকে সব খুলে বলব সময় পেলে৷

রাজলক্ষ্মী বিস্ময়ের সুরে বলল, কেন শরৎদি?

—সে কথা এখন না ভাই—বাবা আসছেন, সরে আয়—

কেদার গামছায় মাথা মুছতে মুছতে বললেন, কে ও? রাজলক্ষ্মী? বেশ মা বেশ৷ হ্যাঁ ভালো কথা শরৎ—মনে পড়ল নাইতে নাইতে—তোর মায়ের সেই কড়িগুলো কোথায় আছে মা?

শরৎ হেসে বললে, কোনো ভয় নেই বাবা, লক্ষ্মীর হাঁড়িতেই আছে৷ প্রথম দিন এসেই আমি আগে দেখে নিয়েছি৷ ঠিক আছে৷

—ও, তা বেশ৷ আর—ইয়ে—তোর মার সেই ভাঙা চিরুনিখানা?

—ওই গোল তোরঙ্গের মধ্যে রেখে গিয়েছিলাম, সেইখানেই আছে, সেও দেখে নিয়েছি সেদিন৷

—ইয়ে, ডাকি তবে গোপেশ্বর দাদাকে? রান্না হয়েছে তো?

কেদার আবার গেলেন পুকুরপাড়ে গোপেশ্বর চাটুজ্জেকে ডাকতে৷ শরৎ মৃদু হেসে রাজলক্ষ্মীকে বললে, দুটি নিষ্কর্মা আর নিশ্চিন্দি লোক এক জায়গায় জুটেছে, জ্যাঠামশায় আর বাবা—দুই-ই সমান৷ দুটিতে জুড়ি মিলেছে ভালো৷

কেদার বলতে বলতে আসছিলেন, বেহালা বাজাই নি আজ দেড় বছর দাদা৷ তারগুলো সব ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ আজ ওবেলা ছিবাসের ওখানে আসর করা যাক গিয়ে৷ তোমার তবলাও অনেক দিন শোনা হয় নি৷

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress