ভোর রাত থেকে বৃষ্টি
ভোর রাত থেকে বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি যে সকালে দেখা গেল পোর্চে পানি উঠে গেছে। গাড়ির মাডগার্ড পানির নিচে। গাড়ির ড্রাইভার সুরুজ মিয়া কিছুতেই গাড়ি স্টার্ট দিতে পারল না। আনন্দে তুষারের চোখে পানি এসে গেল। আজও স্কুলে যেতে হবে না। আজ পাটিগণিতের একটা পরীক্ষা হবার কথা। অন্য রকম পরীক্ষা, স্যার এক জন এক জন করে বোর্ডে ডাকবেন। বোর্ড সব ছাত্রদের সামনে অঙ্ক কষতে হবে। যদি কোথাও ভুল হয় তখন স্যার বলবেন—এই যে বুদ্ধিমান। আমার দিকে তাকাও, চাদমুখটা দেখি। মুখ তো সুন্দর মনে হচ্ছে, শুধু কান দুটি এই সুন্দর মুখের সঙ্গে মানাচ্ছে না। এই যে বুদ্ধিমান, আপনি আসুন আমার সঙ্গে, আপনার কান দুটি আমি খুলে রেখে দিই।
স্কুলে যেতে হবে না–এই আনন্দ তুষার চেপে রাখতে চেষ্টা করছে। মনের ভাবটা প্রকাশ হওয়া উচিত নয়। সে মুখ কালো করে বলল, সত্যি। স্কুলে যেতে পারব না, সুরুজ চাচা?
সুরুজ মিয়া বলল, উহুঁ। অবস্থা দেখতে না? রাস্তায় এক হাঁটু পানি।
তুষার দুঃখী-দুঃখী গলা বের করে বলল, সারা দিন তাহলে করব কী?
কি আর করবা, খেলাধুলা কর। তবে খবরদার পানিতে নামবা না। পানিতে নামলে বেগম সাব খুব রাগ করবেন।
তুষার কাগজের নৌকা বানাতে বসল। রাত্রি বসল গল্পের বই নিয়ে। তুষারের খুব ইচ্ছা করছিল পানিতে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা। একা একা পানিতে যেতে তার সাহসে কুলাচ্ছে না। রাত্রি সঙ্গে থাকলে সে যেত। রাত্রি যাবে না। একবার গল্পের বই নিয়ে বসলে সে বই শেষ না করে ওঠে না। আজ যা মোটা বই হাতে নিয়ে বসেছে। এটা শেষ হতে হতে বৃষ্টি থেমে যাবে। পানি নেমে যাবে। এমন চমৎকার একটা ছুটি অথচ সে তেমন কোনো মজা করতে পারবে না।
তুষার নৌকা বানানর কাগজ নিয়ে বারান্দায় চলে এল। নৌকা বানিয়ে বানিয়ে বারান্দা থেকেই সে ছাড়বে। সাতটা নৌকা বানাবে। সপ্ত ডিঙ্গা মধুকর। দেখা যাবে নৌকাগুলি কত দূর যায়।
প্রথম নৌকা পানিতে ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুষার লক্ষ করল, পানিতে নেমে ছপছপ শব্দ করে বাড়ির পেছনে যাচ্ছে। নিশানাথ স্যারের ঘরের দিকেই যাচ্ছে বোধ হয়।
তুষার ডাকল, এই আলো, এই।
আলো ডাক শুনল না। শুনবার কথাও নয়। সে একা একা কি রকম নির্বিকারভাবে যাচ্ছে। তার হাঁটু পর্যন্ত ড়ুবে গেছে পানিতে।
তুষার মার কাছে চলে গেল।
দীপার মাথা ধরেছে। তিনি শুয়ে আছেন। তাঁর মাইগ্রেনের ব্যথা আছে। মাঝে মাঝে এই ব্যথা তাঁকে কাবু করে ফেলে। আজও করছে। ঘর অন্ধকার করে তিনি শুয়ে আছেন।
তুষার বলল, মা, আলো একা একা বাড়ির পেছনে যাচ্ছে।
দীপা চুপ করে রইলেন।
পানি ভেঙে একা একা যাচ্ছে, মা।
যাক। তোমরা তাকে খেলায় নেবে না, কিছু করবে না, ও বেচারা একা একা কী করবে?
আমি কি ওকে নিয়ে আসব?
নিয়ে আসতে হবে না। ও কিছুক্ষণ খেলুক একা একা।
বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে তো।
ভিজুক। খানিকটা ভিজলে কিছু হয় না।
আমি খানিকটা ভিজে অসব, মা?
না, তোমাকে ভিজতে হবে না।
তুষার বেশ মন খারাপ করল। মার কাণ্ডটা সে বুঝতে পারছে না। একেক জনের জন্যে একেক ব্যবস্থা কেন? আলো যদি পানিতে ভিজতে পারে সে পারবে না কেন? বড়দের এইসব কোন ধরনের যুক্তি? মাকে যুক্তির ভুল ধরিয়ে দেবার সাহসও তার হল না। তার শুধু মনে হল, মা নিজে মেয়ে বলেই মেয়েদের বেশি আদর করেন।
নিশানাথ বাবু একটা আয়না হাতে নিয়ে মুখ কালো করে বসে আছেন। তাঁর নিচের পাটির দাঁত পড়তে শুরু করেছে। আজ সকালে দাঁত মাজার সময় দুটো একসঙ্গে পড়ে গেল। আশ্চর্য কাণ্ড! নিজের মুখটা এখন কী যে কুৎসিত দেখাচ্ছে! কথাবার্তাও কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিছু বললে দাঁতের ট্র্যাক দিয়ে শব্দ বের হয়ে যাচ্ছে। হচ্ছেটা কী? নিশানাথ বাবু জানালা দিয়ে তাকালেন। এখনো বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি একটু কমলে এক জন ডেন্টিস্টের কাছে যাবেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন। তার ধারণা হল, কোনো একটা ভিটামিনের অভাবে এরকম হচ্ছে। সেই ভিটামিনটা এখন খেলে কি বাকি দাঁতগুলি টিকবে?
আমি এসেছি।
নিশানাথ বাবু চমকে উঠলেন। আলো এসেছে, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সে কথা বলছে। মাথার মধ্যে কথা। নিশানাথ বাবু আলোর দিকে ফিরলেন। হাসলেন। যদিও দাঁত নেই মুখে হাসতে তাঁর লজ্জা লাগছে। তিনি আলোর সঙ্গে কথা শুরু করলেন। পুরো কথাবার্তা হল মাথার ভেতরে। কারো ঠোঁট নড়ল না। কেনো রকম শব্দ হল না। বাইরের কেউ দেখলে নিশ্চয় ভাবত–এরা দুজন দু জনের দিকে তাকিয়ে আছে কেন? তাদের কথাবার্তার শুরুটা এমন–
নিশানাথ : কেমন আছ?
আলো : আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
নিশানাথ : আমি ভালো নেই। দেখ নাকী কাণ্ড, আমার সব দাঁত আপনা-আপনি পড়ে যাচ্ছে।
আলে : আপনার কি অসুখ করেছে?
নিশানাথ : বুঝতে পারছি না। হয়তো করেছে। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এস, বস।
(আলো এসে বসল।)
আলো : আপনি আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেন অন্যর সেভাবে বলে না কেন?
নিশানাথ : পুরো ব্যাপারটা আমি কিছুই জানি না। আমার বোধ হয়। কোনো একটা বড়ো অসুখ হয়েছে। সেই অসুখের পর থেকে এই অবস্থা।
আলো : আমি আপনার কাছ থেকে পড়া শিখব।
নিশানাথ : বেশ তো শিখবে। অবশ্যি জানি না পারব কি না। পারতেও পারি। (নিশানাথ বাবু এই পর্যায়ে খুবই উৎসাহিত বোধ করলেন। তুষারের ইংরেজি শেখানোর ব্যাপারটা তাঁর মনে পড়ল।)
নিশানাথ : আলো, তুমি এক কাজ কর। চোখ বন্ধ করে থাক। আমি তোমার মাথার ভেতর চলে যাব। সেখানে থেকে শেখাব।
আলো : মাথার ভেতর কেমন করে যাবেন?
নিশানাথ ; জানি না। তবে আমি যেতে পারি।
আলো চোখ বন্ধ করে বসল। নিশানাথ বাবু মেয়েটির মাথার ভেতর অনায়াসে চলে গেলেন। তাঁর জন্যে বড়ো ধরনের একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। উজ্জ্বল আলোয় এই মেয়ের মাথার গহীন কুয়ো ঝলমল করছে। নিশানাথ বাবু মুগ্ধ হয়ে গেলেন। গহীন কুয়ো দিয়ে নিচে নামতে নামতে তাঁর বারবার মনে হল, এই মেয়ে একটি অসাধারণ মেয়ে। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন এই মেয়ের কল্পনাশক্তি অসাধারণ, বোঝার ক্ষমতাও অসাধারণ।
নিশানাথ বাবুর রোমাঞ্চ বোধ হল। তাঁর ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। আনন্দে মন ভরে যাচ্ছে। তিনি আবার কথা বলা শুরু করলেন।
নিশানাথ : আলো, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
আলো: পারছি।
নিশানাথ : তুমি কি জান সব কিছুর নাম আছে?
আলো : জানি।
নিশানাথ : লেখার সময় নামগুলি লিখি। সেই লেখার জন্যে আমরা কিছু চিহ্ন ব্যবহার করি। যেমন অ, আ, ই, ঈ–।
আলো : আমি এইগুলি বইয়ে দেখেছি।
নিশানাথ : এই চিহ্নগুলি সাজিয়ে সাজিয়ে আমরা মনের ভাব লিখে ফেলি। তুমি চিহ্নগুলি শিখে ফেতাহলে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে। বই পড়তে পারবে।
আলো : আমাকে চিহ্নগুলি শিখিয়ে দিন।
নিশানাথ : এক দিনে পারব না। ধীরে ধীরে শেখাব।
আলো : আমি এক দিনেই সব শিখে ফেলতে চাই।
নিশানাথ : আজ আমি আর শেখাতে পারব না। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
নিশানাথ বাবু আলোর মাথার ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। অসহ্য যন্ত্ৰণা। তিনি ছটফট করতে লাগলেন। এ রকম তীব্র যন্ত্রণা তাঁর এর আগে আর হয় নি। শুধু যে যন্ত্রণা হচ্ছে তাই নয়–মুখ থেকে লালা ঝরছে। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তিনি গোঙানির মতো শব্দ করতে লাগলেন।
দীপা লক্ষ করলেন, আলো ঘরের এক কোণে একটা বই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হয় সে পড়ছে। দীপার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেচারি আলো পড়া-পড়া খেলা খেলছে। আহা বেচারি, আহা!
রাত দশটার দিকে দারোয়ান এসে খবর দিল স্যার যেন কেমন করছে।
দীপা ছুটে গেলেন। নিশানাথ বাবু বিছানায় বসে আছেন। তাঁর চোখ রক্তবর্ণ। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে।
দীপা বললেন, চাচা আপনার কী হয়েছে?
নিশানাথ বাবু বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না, মা। কিছু বুঝতে পারছি না।
দীপা তৎক্ষণাৎ ডাক্তার আনতে পাঠালেন। তিনি মনে মনে ঠিক করে রাখলেন ডাক্তার দেখে যাবার পর নিশানাথ বাবুকে হাসপাতালে কিংবা
কোনো ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেবেন।
চাচা, আপনার অসুবিধা কী হচ্ছে তা বলুন।
আমি নিজেও বুঝতে পারছি না, মা!
মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে?
হ্যাঁ।
পানি খাবেন একটু?
না। আমার তৃষ্ণা হচ্ছে না।
গরম লাগছে কি? ফ্যান ছেড়ে দেব?
না। ঠাণ্ডা লাগছে।
তাহলে গায়ে একটা চাদর দিয়ে শুয়ে থাকুন। ডাক্তার এক্ষুণি চলে আসবে।
নিশানাথ বাবু গায়ে চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে এল।
ডাক্তার এসে দেখেন রুগী ঘুমুচ্ছে। তিনি বললেন, ঘুম ভাঙিয়ে কাজ নেই। আমি সকালে এসে দেখে যাব। ভালো ঘুম হচ্ছে যে কোনো রোগের খুব বড় ওষুধ।
ডাক্তার সাহেবের কথা বোধহয় সত্যি। নিশানাথ বাবুর ঘুম ভাঙল ভোরে। তার মাথাব্যথা নেই। শরীর ঝরঝরে। তিনি অনেকক্ষণ বাগানে হাঁটাহাঁটি করলেন।
চা খেতে খেতে মালীর সঙ্গে অনেক গল্প করলেন। সবই তাঁর ছেলেবেলার গল্প। গল্প শেষ করে নিজের ঘরে এসে চিঠি লিখলেন তাপসীকে। তাপসী তাঁর বড়ো বোনের মেয়ে, কোলকাতায় থাকে। বিএ পড়ে। এই মেয়েটিকে তিনি ছোটবেলায় খুব স্নেহ করতেন। দেশ ছেড়ে সে যখন তার মার সঙ্গে চলে যায় তখন তিনি খুব কেঁদেছিলেন।
তাপসী
মা আমার। ময়না আমার। মা গো, তুমি কেমন আছ। আমার শরীর ভালো নেই মা। কি জানি হয়েছে। বেশি দিন আর বাঁচব না। আমার কি যে হয়েছে নিজেও জানি না। খুব কষ্ট হয়। মাথার যন্ত্রণা। এই কষ্ট তবু সহ্য করা যায় কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কষ্ট আমি মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে যেতে পারি–।
এই পর্যন্ত লিখে নিশানাথ থামলেন। তাপসী এই চিঠি পড়ে কী ভাববে? নিশ্চয়ই ভাববে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তিনি আবোলতাবোল ভাবছেন।
নিশানাথ বাবু চিঠি ছিঁড়ে ফেললেন।