দ্বিতীয় খণ্ড – চতুর্থ পর্ব : ৪.৭
এই সময় রাজাবাহাদুরের সাড়া পেলেন ও-ঘরে। রাজাবাহাদুর ফিরেছেন। আলবোলার নলটি টেবিলের উপর রেখে তিনি এঘরে ফিরে এলেন। রাজাবাহাদুর এসে বসেছেন তাঁর আসনে, তাঁর সামনে একটি মূল্যবান ট্রের উপর প্রকাণ্ড আকারের একখানা বই। রাজাবাহাদুর বললেন—বসুন। এবার দুটো ঘরের কথা বলি! বাবা তো সোমেশ্বর রায়মশায়ের একমাত্র পুত্র, শুনেছি অনেক ক্রিয়াকাণ্ডের পর আপনার জন্ম। আপনার ভগ্নীপতির পিতা ছিলেন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী, তিনিই নাকি ক্রিয়াকর্ম করেন, তারপর এক কন্যা এক পুত্র হয়ে বাঁচে
—আজ্ঞে হ্যাঁ। শুনেছি তাই।
—ভগ্নীটি নাই। গত হয়েছেন।
—হ্যাঁ। কিন্তু—
—বলুন!
—এত কথা আপনি জানলেন কি করে?
—আমার বাবা ওটা বোধ হয় একটা স্বভাব। তা ছাড়া আপনার ভগ্নীপতি বিমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে আমি জানি। তিনি পত্নীর মৃত্যুর পর কলকাতায় এসে কিছুকাল ছিলেন। পুত্রটিকেও দেখেছি। সুন্দর সুকুমার। তবে নরাণাং মাতুলক্রম তো, বাপের মত এত সহনশীল শান্ত নয়, তেজস্বী। উগ্ররকমের তেজস্বী।
মাথার মধ্যে রক্ত যেন চন চন করে উঠল বীরেশ্বরের। বিমলাকান্তকে কতটুকু জানেন রাজাবাহাদুর? সাপ। তাও গোখুরা নয়, তেজের সঙ্গে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে গর্জন করে সাড়া দিয়ে আক্রমণ করে না। চিতি সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে নির্জীবের মত; মনে হয় ছেঁড়া দড়ির একটা তাল কি ছেঁড়া লতার খানিকটা; অসতর্ক পদক্ষেপে মুখটা ছুঁড়ে দিয়ে আক্রমণ করে দাঁত ফুটিয়ে বিষ ঢেলে দেয়। গোখুরার বিষে ত্বরিত মৃত্যু, অল্পক্ষণেই যন্ত্রণার শেষ হয় আর এ–এই চিতি সাপের বিষক্রিয়া ধীরে ধীরে দীর্ঘক্ষণ ধরে। অনন্ত যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মৃত্যু। রাজাবাহাদুরকে কি বলে গেছে তিনি জানেন না। হয় বলে গেছে—বীরেশ্বর নাস্তিক অধার্মিক মদ্যপ অত্যাচারী হিংস্র অমানুষ—
রাজাবাহাদুর বললেন—আপনাদের উপর বিমলাকান্তের কৃতজ্ঞতা-স্নেহের শেষ নেই। বলতেন—একটু তেজস্বী, আধুনিক ইংরাজীপন্থী কিন্তু হৃদয়টা বড় ভাল। তবে বড় ভুল করে বসে। এবং ভুলকে কখনও বিচার করে দেখে না। নইলে বীরেশ্বর আমার কনিষ্ঠ সহোদরের মত। আমার জীবনের যা কিছু সে তো ওঁদেরই জন্য। সামান্য যজমানসেবী ব্রাহ্মণের দৌহিত্র, বাপ ছিলেন ঘরজামাই, আমার জন্মের পরই চলে গিয়েছিলেন সন্ন্যাসী হয়ে; তারপর ফিরেছিলেন ওই রায়মশায়দের বাড়ীতে। তারপর কংসাবতীর বন্যায় ডুবে মারা যান। তাঁর ক্রিয়ার ফলে সন্তান হয়েছিল বলে নিজের কন্যার সঙ্গে আমার মত ভিক্ষুকের বিবাহ দিয়ে ঘরে রেখেছিলেন, পড়িয়েছেন। কলকাতায় কলেজে দিয়েছিলেন, তারপর ঘরে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, মৌলবী, ইংরেজ পাদ্রী রেখে সংস্কৃত পার্সী ইংরিজী শিখিয়েছিলেন। ওঁদের কাছে আমার অনেক ঋণ। হেসে বলতেন—হয়তো জন্মজন্মান্তর শোধ করতে হবে।
বীরেশ্বর রায় বিস্ময়ে যেন অভিভূত হচ্ছিলেন এবার! মনের বিস্ময়ের সঙ্গে প্রাণপণে যুদ্ধ করছিলেন। বার বার ভাবতে চাচ্ছিলেন—এও তার ওই সাপের প্রকৃতির খলতা ছলনা চতুরতা। আসল সত্যটিকে চাপা দিয়ে নিজের সততাকেই জাহির করবার জন্য এই কথা সে বলে গিয়েছে। মনে পড়ছিল কমলাকান্তকে। মনে পড়েছিল ভবানীকে। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন অন্তরে অন্তরে! আবার মন বলছিল-না-না! এ মহত্ত্ব তার স্বীকার করতে হবে যে, সে রায়বংশের মুখে কালি মাখিয়ে দিয়ে যায় নি। রাজাবাহাদুরের কথা শেষ হলে এতক্ষণে প্রশ্ন করলেন—তিনি ওখান থেকে কেন চলে এলেন তার কারণ কিছু বলেন নি?
—হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করেছিলাম বৈকি। কারণ কীর্তিহাটের রায়বংশের জামাই। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের ডান হাত আপনার পিতামহ রায়ভট্টাচার্য মশাই তো খ্যাতিমান লোক। আপনার পিতাও এখানে সর্বজনপরিচিত ছিলেন। সতীদাহ নিবারণের দরখাস্তের সময় স্বর্গীয় দ্বারকানাথ ঠাকুর মশায়ের সঙ্গে বিশেষ পরিচয় সত্ত্বেও তিনি তাতে সই করেন নি। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল। আপনাদের অর্থের কথা বিষয়ের কথা বিষয়ীরা সকলেই জানেন। সেই বিষয়ের একাংশের মালিক, দেবোত্তরেরও সেবায়েৎ-তিনি এলেন আমার কাছে শব্দকল্পদ্রুমের কর্ম করতে। বললেন—জীবিকা এবার নিজেকেই অর্জন করতে হবে। যা আছে তা তো আমার নয়, এই কমলাকান্তের। তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম- এর কারণ কি? আমার মনে হয়েছিল আপনার সঙ্গে বিবাদ হয়ে থাকবে। তা বার বার বললেন—না-না-না। বিবাদ কলহ এ আমার সঙ্গে হ’তে পারে না বীরেশ্বরের। সে সম্পর্কই নয়। তার একমাত্র দোষ সে নাস্তিকভাবাপন্ন। তা নইলে গুণী মানুষ। উত্তমরূপে ইংরাজী শিক্ষা করেছে। গানে বাজনায় গুণীলোক। দুর্দান্ত সাহসী; বাঘ কুমীর শিকার করে। উঁচু নজর। তাছাড়া ভেবে দেখুন, নিজে পছন্দ করে এক দরিদ্র শিক্ষকের কন্যাকে বিবাহ করেছিল। কন্যাটি সাক্ষাৎ দেবী। খানিকটা দেব-অংশ তাতে আছে এ বিষয়ে সন্দেহই নেই। বিবাহের সময় কন্যার পিতা বলেছিলেন—দেখুন বাবা, মদ্যপান যারা করে বা যারা উন্মার্গগামী এমন পাত্রের হাতে বিবাহ দিতে গুরুর নিষেধ আছে আমার। তা আপনি কি তা করেন? বীরেশ্বর বলেছিলেন—তা করি। মিথ্যা আমি বলি না। তবে যদি আমাকে ওই কন্যা দান করেন তবে মদ্যপান ত্যাগ করব আমি। এবং তাই করেছিলেন তিনি। তারপর দুর্ঘটনা ঘটেছে। কি যে হল ভগবান জানেন। বলতে পারব না কারণ আমি চলে আসার পর সংঘটিত হয়েছে, বধূটি কংসাবতীর ঘাটের দহে ভেসে গেছে। তারপর বীরেশ্বর এই আঘাতে মদ্যপান অবশ্য আরম্ভ করেছেন, কিন্তু বিবাহ আর করেন নি। এ যুগে, যেখানে দুটো তিনটে চারটে, কুলীন সন্তানেরা শতাধিক বিবাহ করেন সে যুগে এই স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিবাহ না করা একটা বিশেষ লক্ষণ তার চরিত্রের। সে ঝগড়াঝাঁটি করবে কেন? আমি চলে এলাম অন্য কারণে, সেটা ধরুন, সম্পত্তি তো কমলাকান্তের। ওখান থেকে জীবনযাপন করার অর্থ কমলাকান্তের অর্থে জীবনযাপন করা। সেটা আমার ভাল লাগল না। শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, বিষয়কর্মও বুঝি কিন্তু শাস্ত্রকর্ম অর্থাৎ ব্রাহ্মণের কর্ম করেই জীবিকা অর্জনের অভিপ্রায়ে চলে এসেছি। সেইটাই সংকল্প। এবং সেইজন্যই রাজাবাহাদুরের কাছে আসা।…তা তিনি ‘শব্দকল্পদ্রুমের যে অংশটি করেছেন তা অতি উত্তম হয়েছে। আমার ইচ্ছা ছিল ওঁকে অন্য কর্ম দিয়ে এখানে রাখি কিন্তু কি অভিপ্রায় হল তাঁর হঠাৎ বললেন-আর এখানে থাকব না, বারাণসী যাব। এখানে কলকাতার ইংরিজীয়ানার মধ্য থেকে ছেলেকে তিনি রক্ষা করতে চান। কাশীতে সংস্কৃত শিক্ষা দেবেন, ইংরাজী শিক্ষারও ব্যবস্থা করবেন। তা ছাড়া তাঁর এক ভগ্নী এসে পড়ল ঘাড়ে। সন্ন্যাসিনীর মত। তারও কাশীধামে বসবাসের একান্ত ইচ্ছা। এইজন্যে চলে গেলেন।
চমকে উঠলেন বীরেশ্বর। ভগ্নী? বিমলাকান্তের ভগ্নী? তিনি তো শোনেন নি! পূর্ববঙ্গে শ্যামাকান্তের ক’টি বিবাহ ছিল। তাদের মধ্যে কারুর কন্যা?
মন বললে—না-না-না। এ সেই সেই। দহে দেহ মেলে নি। এ সেই!
চঞ্চল হয়ে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বীরেশ্বর হাতজোড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—এবার আমাকে অনুমতি করুন রাজাবাহাদুর, আমি উঠি!
—উঠবেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রেখেছি। ভাল লাগছিল, আপনার সঙ্গে বাক্যালাপে আনন্দ পাচ্ছিলাম। তা আমার বাড়ীতে ব্রাহ্মণ আপনি পদার্পণ করেছেন, তার কিঞ্চিৎ সম্মানী দক্ষিণা না দিলে তা সার্থক হয় না। এই আমার শব্দকল্পদ্রুম গ্রন্থ।
বীরেশ্বর সৌজন্যে অভিভূত হয়ে গ্রহণ করলেন। বললেন—এ তো মহামুল্য বস্তু। মাথায় রাখতে হয়। তাই রাখব।
—না-না, শুধু মাথায় রাখলে হবে না। একটু-আধটু পড়তে হবে। সবটা দেখলে খুব সন্তুষ্ট হব। খুশী হব।
—দেখব, পড়বার চেষ্টা করব।
—সাধু সংকল্প। সাধু-সাধু। তারপর হেসে বললেন—দেখুন পড়ে, পড়া শেষ হলে দেখবেন সংস্কৃত বেশ হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে। এবং কি মনোরম ভাষা, দেবভাষা যে বলে তা মিথ্যা নয়—তা বুঝবেন।
চাকরকে বললেন—যা, গাড়ীতে তুলে দিয়ে আয়। তারপর হঠাৎ বললেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনলাম বাবা নাকি একজোড়া খুব তেজস্বী আরবী ঘোড়া কিনেছেন? ক’জনই বলেছিলেন আমাকে। হেসে বীরেশ্বর বললেন—হ্যাঁ, ঘোড়া জোড়াটা ভাল। কিন্তু রাজাবাহাদুরের আস্তাবলে যে সব ওয়েলার আরবী ঘোড়া আছে তার সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না।
রাজাবাহাদুর বললেন—না বাবা, পত্নীসম্পদের মত কতকগুলি বস্তুর জন্য ভাগ্য প্রয়োজন। সবার হয় না। তার মধ্যে ঘোড়া একটি বস্তু। যার ও ভাগ্য নাই সে মূল্য অনেক দিয়ে কিনেও ঠকে যায়। যদি বা জুটল তো মরে গেল। আর ভাগ্য—ধরুন মহারাণা প্রতাপ—তাঁর তো আকবর শাহের হাতে অনেক নিগ্রহ, কিন্তু ঘোড়ার ভাগ্যে তিনি চৈতককে পেয়েছিলেন! তা সেই জুড়িতে এসেছেন নাকি?
—না, এ অন্য জুড়ি।
—আচ্ছা অন্য কোনদিন যদি আসেন সেই জুড়িতে আসবেন। দেখব। আমি ঘোড়া চিনি, লক্ষণ জানি। বলে দেব কেমন ঘোড়া।
এরই মধ্যে বীরেশ্বর রায়ের মনে অন্য একটি প্রশ্ন ঘুরছিল। যেন তিনি হঠাৎ বললেন—একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হচ্ছে। আপনি কলকাতার সংবাদ দেখছি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাখেন।
—কি বলুন।
—চৌরিঙ্গীর মাঠে ওইসব জলাজঙ্গল যে-দিকে সেদিকে এক পাগল সন্ন্যাসী থাকেন! সায়েব-সুবোরাও যায় তাঁর কাছে—
—ও যিনি গন্ধ এনে দেন, ধুলোকে গুড় করে দেন? মধ্যে মধ্যে নিজেকে দংশন করেন। চীৎকার ক’রে কাঁদেন?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই। সেই
একটু চুপ করে থেকে রাধাকান্ত দেব বললেন—হ্যাঁ, আশ্চর্য সন্ন্যাসী বটে। তবে বাবা, সাধনা থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গেছেন উনি। শুনেছি কামাখ্যা পাহাড়ে তাঁর আসন থেকে তাঁকে তুলে একেবারে খাদে নিক্ষেপ করেছিল!
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, সেদিনের এই সুদীর্ঘ বিবরণটি বীরেশ্বর রায় ফিরে এসেই লিখেছিলেন খাতায়। শেষকালে লিখেছেন—আজ আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছি। এই বিরাট ধনীটির মধ্যে এক বিরাট জ্ঞানীকে দেখে এলাম। এ দেশে যাঁরা ধনী এবং জ্ঞানী ও গুণী তাঁরা প্রত্যেকেই নবযুগের মানুষ। হিন্দু সংসারে জন্মগ্রহণ করেও তাঁরা হিন্দু সমাজের সকলপ্রকার আচার ও বিশ্বাস থেকে মুক্ত। ইংরাজের চরিত্র, ইংরাজী দর্শন, এ থেকেই তাঁরা প্রবুদ্ধ। কিন্তু এই মানুষটি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। ইনি খাঁটি হিন্দু। আচারবিচারগুলিকে এমন সুন্দর সংস্কার ক’রে বজায় রেখেছেন যে কেউ তাঁর আচার আচরণকে অজ্ঞতার অন্ধকারপ্রসূত বলতে পারবে না। একটা ভুল হয়ে গেছে, তাঁর বিরাট গ্রন্থ শব্দকল্পদ্রুমের জন্য ডেনমার্ক দেশের অধীশ্বর যে সুবর্ণচক্র পাঠিয়ে সম্মানিত করেছেন, তা দেখা হয়নি। ইউরোপের পণ্ডিতেরা রাজাবাহাদুরের এই কর্মের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমারও এসব সাধ ইচ্ছা ছিল। কিন্তু—। আমি ঈশ্বর মানি না। ওই পাগল সাধুকে দেখেও মানি না- আজ রাজাবাহাদুরকে দেখে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে তার কোন পরিবর্তন ঘটে নি। তবু এই যে ইচ্ছা আমার পূর্ণ হল না, এর কারণ কি বলব? অদৃষ্ট ছাড়া কোন সংজ্ঞা আছে? রাজাবাহাদুর বললেন—সে নাকি দেব-অংশজাতা ছিল। তা হোক বা না হোক, সে তো সত্যই দেবীচরিত্রের ছিল। তার সেই বাসরঘরের গান—গৌরী লউট যায়ে—রোয়ে রোয়ে—গান গাওয়া মূর্তি মনে পড়ছে।
সে তো সত্যসত্যই ধ্যান। তার সেই মূর্তি মনে পড়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছিল সেই অল্প কয়েক বৎসর কি গভীর আনন্দের মধ্যে তাঁরা বাস করেছিলেন, কত কল্পনা করেছিলেন। ভবানী নিত্য পূজা করত, লালপেড়ে গরদের শাড়ী প’রে কালীমন্দিরে যেত—তিনি কাছারিতে বসে দেখতেন। সে রূপ দেখে চোখ যেন জুড়িয়ে যেত। ঈশ্বরদেবতায় বিশ্বাস তিনি করতে পারতেন না। কিছুতেই না। কোন শাস্ত্র তাঁকে সে বিশ্বাস দিতে পারেনি, কোন পণ্ডিত কোন সন্ন্যাসী তাঁর সংশয় খণ্ডন করতে পারে নি। কিন্তু ভবানীর বিশ্বাস দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হত।
ভবানী কখনও নিজের জন্য কিছু চায় নি—কখনও তাঁর অবিশ্বাস নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেনি। একটি আশ্চর্য সরল সহজ মানুষ, আশ্চর্য হৃদয়, আবার তেমনি নির্ভীকতা, সাহস। ভয় তার ছিল না।
ক’টি ঘটনা বীরেশ্বর রায়ের মনে অক্ষয় হয়ে আছে। শেষ-আশ্বিন, ঠিক পূজোর আগে ঝড়বাদল হয়েছিল-সাইক্লোন। প্রচণ্ড প্রলয়ঙ্কর ঝড়। গোটা গ্রামখানার বাড়ীর খড়ের চাল উড়ে গিয়েছিল, মাটির বাড়ীর দেওয়াল ঝড়ের বেগে বৃষ্টির মুখে ছুরি দিয়ে যেন কেটে দুখানা করে দিচ্ছিল। বড় বড় মাটির ঘর ভেঙে পড়ছিল হুড়মুড় করে। নদীর ওপারে ও সিদ্ধপীঠের ঘন জঙ্গলটায় গাছগুলো ভাঙছিল কাঠির টুকরোর মত। রায়দের বাড়ীর সব জানালা ঝনঝন শব্দ করে কাঁপছিল। পূর্ব-উত্তর কোণের বারান্দাটার কাঠের ঝিলিমিলিগুলো ঝড়ের টানে ছেড়ে কোথায় উড়ে গিয়েছিল কাটা ঘুড়ির মত। ঝড়ের গোঙানি ভীষণ ভয়ঙ্কর। বীরেশ্বরের দিদি পাগল বিমলা এক বছরের কমলাকান্তকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে চীৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল। চিন্তা সকলেরই হয়েছিল। চিন্তা কেন ভয়ই হয়েছিল। এ ঝড় আর বাড়লে এ পাকা বাড়ীটাও হয়তো ধ্বসে যাবে। অন্ততঃ দোতলার কিছুটা বা সবটাই হয়তো যাবে। উপর ছেড়ে সকলে এসে নীচে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মৃত্যুভয়ে বিমলার কান্না সব থেকে বেশী বিব্রত করে তুলেছিল সকলকে। ঠিক সন্ধ্যার সময় তখন। রায়বাড়ীর কালীমন্দিরে সেদিন আরতি হয় নি। নাটমন্দিরে টাঙানো ঝাড়লণ্ঠন- গুলো ছিঁড়ে গিয়ে থামে লেগে বা দেওয়ালে লেগে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে ভাবছিল ভবানী। হঠাৎ ঝড়ের একটা দমকা ঝটকায় ভেঙে পড়েছিল ওই বারান্দার আরও কতকগুলো ঝিলিমিলি এবং একটা থাম ভেঙে পড়েছিল প্রচণ্ড শব্দ করে। সে শব্দে চমকে উঠেছিল সকলেই কিন্তু বিমলা এবার শিশু কমলাকান্তকে কোল থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বুকে হাত রেখে আর্তচিৎকার করে উঠেছিল—মরে যাব, মরে যাব বলে। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে পালাতে যাচ্ছিল বেরিয়ে। ভবানী ছুটে গিয়ে দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ভয় কি? ভয় কি? কমলাকান্তকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন বীরেশ্বর।
বিমলা চিৎকার করে উঠেছিল—না-না-না। বাড়ি ভেঙে চাপা পড়বে সব, ছেড়ে দাও।
ভবানী বলেছিল—মাকে ডাক দিদি। ভয় কি? যে বাড়িতে মা রয়েছেন, সেখানে ভয় কি?
—না না, পারব না।
—আমি ডাকছি, তুমি শোন। বলেই সে তার সেই আনন্দিত কণ্ঠের সুরে স্তোত্র পাঠ করতে শুরু করেছিল।
বীরেশ্বর খাতায় লিখেছেন—সংস্কৃত আমি চর্চা করিনি। বলতে গেলে জানি না বলতে হয়। তবু এদেশের মানুষ হিন্দুর ঘরে জন্ম বলে বুঝতে সেদিন কষ্ট হয় নি। কিন্তু স্তোত্রটি স্মরণ করতে পারছি না। শুধু মনে পড়ছে, আজও কানে বাজছে ভবানীর মধুর কণ্ঠে অন্তরের বিশ্বাস এবং আবেগ-মেশানো কয়েকটি শব্দের একটি কলি। “গতিস্ত্বং গতিস্ত্বং ত্বমেকা ভবানী।” বার বার ফিরে-ফিরে প্রতি স্তবকের শেষে ওই কথা “গতিস্ত্বং গতিস্ত্বং ত্বমেকা ভবানী।”
সারা ঘরখানা ভরে উঠেছিল শুধু তার কণ্ঠমাধুর্যে নয় স্তোত্রের শব্দ-ঝঙ্কারেই নয়, ভরে উঠেছিল একটি আশ্চর্য আশ্বাসে। ভবানীর বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিই যেন সেই আশ্বাস। সব কটি লোক হাতজোড় করে নিশ্চল হয়ে বসে ছিল। বিমলাও হাতজোড় করে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় সেই সময়টাই ছিল ঝড়ের চরমতম বেগের সময়। ঘণ্টাখানেক পর ধীরে ধীরে কম পড়তে শুরু করেছিল। শেষ রাত্রে অনেক শান্ত। প্রাতঃকালে তখনও বাতাস বইলেও আকাশে ঘন কালো মেঘের রাশি দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে ছুটলেও ঝড়ের বিপদ তখন কেটেছে। কিন্তু ওদিকে সারা কীর্তিহাটকে বেড় দিয়ে কাঁসাই হয়েছে দুকূল পাথার। সকালে ভবানীকে দেখেছিলাম ওই ভাঙা বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুকুল পাথার কাঁসাইয়ের লালচে জলের বিপুল বিস্তারের দিকে। দুর-দুরান্তর পর্যন্ত রক্তাভ জলরাশির মধ্যে জেগে আছে গাছের মাথা ঘরের চাল। চোখ দিয়ে তার জল গড়াচ্ছিল।
বীরেশ্বর বলেছিলেন—কাঁদছ?
মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হেসে ভবানী বলেছিল—কত প্রাণ নষ্ট হল? এখনও হচ্ছে। কত দুঃখ বল তো!
—এতে তো মানুষের হাত নেই।
—না। ঈশ্বর এক এক সময় এমন নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন! একটু চুপ করে থেকে বলেছিল—কাল থেকে ভাবছি। কাল।
—চুপ করলে কেন? কাল কি—
—আচ্ছা, দিদি এত ভয় পাচ্ছিলেন কেন?
—ও তো পাগল। ছেলেমানুষের মত। ঘর চাপা পড়বে বলে ভয়।
—জান!
–কি?
—কাল যেন ভয়ঙ্কর কিছু দেখছিলাম।
–সে তো ভয়ঙ্করই ছিল কালকের রাত্রি।
—না। ওসব ছাড়াও।
—সেটা আবার কি?
—ঠিক তো বলতে পারব না। বোঝাতেও পারব না। কিন্তু ভয়ঙ্কর ছিল। আমার মনে হয় দিদিও দেখেছিলেন।
বীরেশ্বর হেসে বলেছিলেন, তুমি তো জান আমি ওসবে বিশ্বাস করি না।
চুপ করে গিয়েছিল ভবানী।
তারপর সে এক সেবাপর্ব। কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্যের দেবোত্তরের দলিলে ছিল, গ্রামের বিপদে গ্রামবাসীকে সাহায্যের ব্যবস্থা। কতকগুলি শর্ত ছিল। বিপদ-আপদ ঘটলে যে বাড়ীতে ঘটত, সে বাড়ীর লোকে ঠাকুরবাড়ীতে খেতে পেত। এবার গোটা গ্রামের বিপদ। গ্রামে জল ঢুকে ঘরবাড়ীই শুধু ভাঙে নি। ধানের গোলা ডুবেছে বন্যায়। অনেক জায়গায় ধ্বসে গিয়ে ধান ভেসে গেছে। মানুষ মরেছে, ভেসে গেছে। গরু ছাগল মরেছে। সে দারুণ দুর্দিন।
রায়বাড়ীর সাহায্য-ব্যবস্থা ভবানীর জন্যই সেবার দানছত্র হয়ে উঠেছিল। সে এসে তার সমস্ত গহনা খুলে দিয়ে বলেছিল, এগুলো বিক্রী করে খয়রাতের কাজে লাগিয়ে দাও।
বীরেশ্বর তখন বিমলাকান্তের সঙ্গে বসে এই সাহায্যের ব্যবস্থাই করছিলেন।
বিমলাকান্ত বলেছিলেন, গহনা তুমি রাখ, রায়বাড়ীর সিন্দুকে এখনও টাকার অভাব হয়নি।
লজ্জিত হয়ে ভবানী বলেছিল, আমি কি তাই বলেছি। রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনে কাঠ-বেড়ালীরা বালি মাটি মেখে এসে সেতুর উপর গা-ঝেড়ে সাহায্য করতে চেয়েছিল।
বিমলাকান্ত বলেছিলেন, তা নিচ্ছি, একখানা কিছু। বাকী তুমি নিয়ে যাও। তবে আজ থেকে তোমার নাম হল কাঠবেড়ালী। কি বল?
বীরেশ্বর হাসছিলেন, এবার বলেছিলেন—তা মন্দ হবে না জামাইদা, ‘স্কুইরিল’ বেশ মিষ্টি শোনাবে। ‘প্রেটি স্কুইরিল।’
সেবার এই সাহায্য দানসত্র করে তুলেছিলেন বীরেশ্বর রায়, ভবানীর জন্যে।
আর একটা ঘটনা মনে পড়েছিল রায়ের। এটা পূর্বের ঘটনার আগের ঘটনা। বিমলা এবং ভবানীর একসঙ্গে সন্তান হয়েছিল, একদিন আগে, একদিন পরে। কালীপূজার পর দুজনকে নিয়েই আসছিলেন কলকাতায়।
তখনও পর্যন্ত বীরেশ্বর ভবানীকে নিয়ে কলকাতায় জানবাজারের বাড়ীতেই বাস করতেন। মধ্যে মধ্যে বজরায় করে আসতেন কীর্তিহাটে। বছরে দু-তিনবার। তার মধ্যে পুজার আগে এসে কালীপূজা পর্যন্ত থেকে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় বিমলার হাতের ফোঁটা নিয়ে যমদ্বিতীয়া পার করে কলকাতায় ফিরতেন। সেবার বিমলা সন্তান-সম্ভবা শুনে তাকেও নিয়ে যাচ্ছিলেন কলকাতায়। মৃতবৎসা ব্যাধিগ্রস্তা বিমলাকে প্রতি প্রসবের সময়ই কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এবার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই নিয়ে যাচ্ছিলেন। কাঁসাই হয়ে রূপনারায়ণ ধরে ভাগীরথীতে পড়ে উজানে আসতে হত। তখনকার কাল। তখন নদীতে ডাকাতের ভয় ছিল। বিশেষ করে রূপনারায়ণ থেকে ভাগীরথী পর্যন্ত এবং ভাগীরথীর কতকটা পর্যন্ত একদল গোয়ান ডাকাতি করে বেড়াত। এ অঞ্চলে এককালে হিজলীর নবাব, মহিষাদলের রাজারা বর্গীদের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গোয়া থেকে হারমাদী রক্তওয়ালা গোয়ান গোলন্দাজ এনে এখানে বাস করিয়েছিলেন। ইংরেজ অধিকারের পর সে পর্যন্ত প্রায় আশী-নব্বুই বৎসরে দেশে মোটামুটি শান্তি রয়েছে। বর্গীরা আজ নিজেদের দেশেই বিপন্ন, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে শক্তিহীন হতমান হয়েছে। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে বার বার হেরে সন্ধি করেছে। সন্ধি নামেই সন্ধি, আসলে ইংরেজের প্রভুত্ব মানতে হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে রাজা, জমিদারদের তোপগুলোকে ইংরেজ কতক কেড়ে নিয়ে গেছে, দু-চারটে ছোট তোপ বাড়ীর ফটকে সাজিয়ে রাখতে দিয়েছে বটে, কিন্তু অকেজো করে তবে দিয়েছে। সুতরাং গোয়ান গোলন্দাজদের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। তারা আজ শাক্ত কৃষিজীবীতে পরিণত। রাজা, নবাব তাদের জমিজেরাত দিয়ে স্থায়ীভাবেই বাস করিয়েছিলেন এখানে।
আগে যখন গোলন্দাজী করত তারা, তখন মেজাজ ছিল আলাদা। মিলিটারী মেজাজ। সে মেজাজে তারা চাষ করত না। ভাগে চাষ করত এখানকার হরিজন চাষীরা। যা তারা দিত, তাই নিত। না কুলোলে চাষীর ভাগ কেড়ে নিত। কিন্তু গোলন্দাজী গিয়ে তারা কর্মহীন বেকার হয়ে পরিণত হয়েছে চাষী গৃহস্থে। বুলি হয়ে গেছে বাংলা। পোশাকও হয়ে গেছে বাঙালী পোশাক। মধ্যবিত্ত ভদ্রজনের মতই তারা থাকে। চার্চ আছে। নিজেদের পাদরী পুরুত আছে। এদেশের চাষী গৃহস্থদের মত সন্ধ্যেবেলা খোল বাজিয়ে যীশুর নাম কীর্তন করে। নিজেরাই গান বেঁধে নেয়। এমন কি—“বলরে ভাই মধুর স্বরে-যীশুর নাম বিনে আর কি ধন আছে সংসারে? যীশুর নামে গহন বনে মৃত তরু মঞ্জরে।” গানও গায়। ওদের মধ্যে লেখাপড়া আছে, পাদরী পুরুতও বটে, পাঠশালার পণ্ডিতও বটে। সাজগোজের সময় পাতলুন, কোট পরে।
কিন্তু একটা দল, অল্প কিছু লোক, এরা রাজার এলাকার লোক নয়, এরা হিজলীর নবাবের আনা দলের একটা অংশ, এরা শান্ত হয়নি, চাষ ভাল লাগেনি, এরা সেই পুর্বপুরুষের হারমাদি রক্তের নেশায় আজও বুঁদ হয়ে আছে। এক সময় নবাবদের আমীরীর উল্লাস এবং ধারাধরনও এদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দু-চারটে মেয়ে নবাবী হারেমে ঢুকেছে। মুসলমান আমল শেষ হওয়ার পর এরাও সাধারণ মুসলমানদের দু-দশটা মেয়েকে শাদী করে নিয়ে এসেছে। উর্দু-বাংলা মিশিয়ে কথা বলে। বাঁকা-বাঁকা কথা। এদেরই দু-তিনটে দল আজও নদীতে ডাকাতি করে—নিজেরা ডাকাতি বলে না। বলে হারমাদি। এবং গোঁফে তা দেয়। দুপাশের গালে গালপাট্টা, পাকানো গোঁফ, লম্বা ঝাঁকড়া চুল। সে চুলে মেহেদী মাখিয়ে লাল করে যথাসাধ্য হারমাদ হতে চেষ্টা করে। জলে এরা দুর্ধর্ষ। রঙ এদের কটাসেই বটে।
রায়বাড়ীর বজরার সঙ্গে ছিপ আর ডিঙ্গি নৌকোতে অবশ্য চারখানা ছিল। তাতে লাঠিয়াল সড়কীওলা ছিল বিশ-পঁচিশজন। তাদের সর্দার ছিল কীর্তিহাটের ফুলচাঁদ বাগ্দী, আর কাঁথির ফড়িং মালো। ফড়িং মালো এককালে নাকি সাগর দ্বীপের মুখে জঙ্গলে আড্ডা করে জাঁহাবাজী করেছে। বাঘ মেরেছে, হরিণ মেরেছে। মধ্যে মাঝে লুটতরাজও করেছে। এখন বীরেশ্বর রায়ের মত মনিব পেয়ে তার কাছে চাকরী নিয়েছে। আর ফুলচাঁদ বাগ্দী—এ বাড়ীর দু পুরুষের চাকর। বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে শিকারে যায়। বন্দুকে বারুদ গেদে যুগিয়ে দেয় হাতে।
পথে রূপনারাণে পড়ে কিছু আসতে আসতেই খানিকটা ঝড়ো হাওয়া উঠেছিল। বাতাসের উল্টো মুখে চলছিল নৌকো। পথে যেখানে নৌকো বাঁধবার কথা সেখানে পৌঁছুতে দেরী হয়ে গিয়েছিল, ওদিকে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে বাতাসের মুখে একখানা ছিপ আসছিল তীর-বেগে! সাড়া পড়ে গিয়েছিল ডিঙ্গিতে ডিঙ্গিতে। ছিপখানা ছিল সবের সামনে। তার উপরে তৈরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল সড়কিওলারা।
ওদিকের ছিপখানা কাছে আসতেই সকলে গুঞ্জন করেছিল, হিজলীর হারমাদি হারামীরা। হুঁসিয়ার।
বীরেশ্বর বন্দুক বের করে হাতে নিয়ে বজরার দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। খানিকটা ঠোকাঠুকি হয়েছিল, তারপরই ওরা পালিয়েছিল, দলবলের জোর দেখে, বন্দুক দেখে। বন্দুক তিনটে ছিল, বীরেশ্বর বারবারই আওয়াজ করেছিলেন। ফুলচাঁদ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল বজরার সামনে সড়কি আর ঢাল নিয়ে, সেদিন বন্দুক গেদে তৈরী করে যুগিয়েছিল ভবানী। বিমলার বিচিত্র স্বভাব ছিল, নৌকার দোলায় সে গাঢ় ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ত। সে ঘুমুচ্ছিল।
রায়ের মনে পড়েছিল প্রতিটি ঘটনা। প্রথম তিনি তিনটে বন্দুক গেদে নিয়ে পাশাপাশি রেখে পরের-পর ফায়ার করেছিলেন। তারপর আবার বন্দুকে বারুদ ঠাসবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন, ভবানী বারুদ ঠাসছে বন্দুকে।
বলেছিলেন—দাও, দাও আমাকে দাও। তুমি পারবে না।
ভবানী বলেছিল—দেখ না পেরেছি কি না? দেখ।
বীরেশ্বর তবু নিজে ঠাসাই আরও শক্ত করবার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝেছিলেন ঠাসাই ঠিক হয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্যাপ পরিয়ে ঠিক করে দিয়েছে সব। ছররার সঙ্গে এদেশী জালের কামার কাঠি তাও দিয়েছে। নিজেই বললে ভবানী—কাঠি দিয়েছি, ছররাও দিয়েছি। বন্দুকটা হাতে নিয়ে সাবধানে ফায়ার করেছিলেন রায়। ভেবেছিলেন হয়তো ধাক্কা বেশী দেবে। নয়তো গুলি ছররা বেশী দুর যাবে না। কিন্তু তা কিছুই হয় নি। ফায়ার করে বন্দুকটা নামাতে নামাতে সে আর একটা বন্দুক হাতে তুলে দিয়েছিল। এই সময়ে বিমলার ঘুম ভেঙে সে চিৎকার শুরু করেছিল ভয়ে।
ডাকাতেরা পালিয়েছিল, ওদের একজন বোধ হয় মরেছিল। জলে পড়ে ভেসে গিয়েছিল। একজন জখম হয়েছিল। এ পক্ষের ক্ষতি কিছু হয় নি। বন্দুকের গুলির ভয়েই তারা কাছে ঘেঁষে নি, দূরত্ব রেখে বাতাসের মুখে চলে গিয়েছিল উল্টো মুখে
ভবানীর শুধু এইটুকুই সব নয়। সে মাস্টার বাপের কাছে ইংরিজী কিছুটা শিখেছিল, বাংলা ভাল জানত, সংস্কৃত যাকে জানা বলে তা জানত না, তবে শ্লোকস্তোত্র তার কণ্ঠস্থ ছিল। পূজা-পদ্ধতি জানত। সোমেশ্বর রায়ের মৃত্যুর পর বীরেশ্বর রায় যখন কীর্তিহাটে এসেছিলেন তখন কিছুদিন সে কালীমায়ের পুরোহিত রায়বংশের প্রথম পুরুষ কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্যের গুরুবংশের জ্ঞাতিসন্তান রামব্রহ্ম ন্যায়রত্নের কাছে দীক্ষা নিয়ে কিছুদিন শাস্ত্র পড়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতও কিছু শিখেছিল। সেই সময় বর্ধমানের মহারাজা বাহাদুরের রামায়ণ, মহাভারত এসেছিল তাঁদের বাড়ী। মহারাজার মেদিনীপুরের অনেক জমিদারী। বাগড়ী পরগনা তাঁদের অধীনে অনেকটা পত্তনী নিয়েছিলেন সোমেশ্বর রায়। সেই সূত্রে মহারাজার প্রীতিভাজন ছিলেন রায়েরা। এই রামায়ণ, মহাভারত পড়ে ভবানী বলেছিল, তুমি এমনি কীর্তি কিছু কর না! তোমার তো অনেক আছে।
বীরেশ্বর বলেছিলেন—তুমি বলছ?
—হ্যাঁ বলছি। এইভাবে লেখা থাকবে তোমার নাম।
মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস কি
মহর্ষি মহাকবি বাল্মীকি বিরচিত
মহাগ্রন্থ বীরেশ্বর দেবশর্মা কর্তৃক মূল
সংস্কৃত হইতে বঙ্গভাষায় অনুবাদিত।
উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন বীরেশ্বর। তিনি বলেছিলেন—নিশ্চয় করব। জান ভবানী, আগে অন্য রকম ছিলাম। এদেশের এইসব ধর্মকর্ম আচার-বিচার কিছু ভাল লাগত না আমার। রেভারেন্ড হিল আমাকে পড়াতেন, ইংরিজী শিখিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এ সবকিছুকে ঘেন্না করতে শিখিয়েছিলেন। দেবতা পুজার্চনা কত মিথ্যে এ-সব বলতেন। তাতে শুধু হিন্দুর দেবতা পুজো আচার-বিচারই মিথ্যে হয়ে যায়নি, ঈশ্বরও মিথ্যে হয়ে গিয়েছে আমার কাছে। তোমাকে পেয়ে আজ একটু একটু করে বুঝতে পারছি, এসবের মধ্যেও মহিমা আছে, সত্য আছে। মত আজও আমার ঠিক পাল্টায় নি। তবে বুঝছি আছে, কিছু আছে। ওদের বাইবেলে যে সব সেন্টের কথা আছে, আমাদের সাধু-সন্ন্যাসীর মধ্যে তেমন সেন্ট অনেক আছে। ওদের যীশু আছেন, আমাদের কৃষ্ণকে না মানি, রামকে না মানি, বুদ্ধ আছেন। পাপ ওদের অনেক, আমাদের থেকে অনেক বেশী। এদেশে রবিনসন যা করছে তা দেখছি। আমার ঠাকুরদাদা লোকে বলে ঘুষ নিতেন। ওরা বেশী বলে। কিন্তু ক্লাইভ হেস্টিংস যে টাকা ঘুষ নিয়েছে তার তুলনায় তা কি? আগে এগুলো জেনেও যেন জানতাম না। ভাবতাম না। তোমাকে পেয়ে ভাবছি। ঈশ্বর না মানতে পারি, ধর্ম না মানি, সদাচার মেনে মনে আনন্দ পাচ্ছি। ভাল লাগছে। কীর্তি করব। করব বইকি। এ সব সগ্রন্থ। অনুবাদ করাব। ইস্কুল দেবার ইচ্ছে আছে। আরও অনেক কীর্তি।
বীরেশ্বর রায় লিখেছেন খাতায়—অনেক রাত্রির দীর্ঘক্ষণ এই কীর্তির একটা ফিরিস্তি করতাম দুজনে। বিবি মহলে দোতলার উপর গোল ছত্রির তলায় বসে কথা হত। নিচে কাঁসাইয়ের স্রোতের একটা একটানা শব্দ উঠত। ওপারে সিদ্ধপীঠের জঙ্গলে ঝিঁঝির ডাক উঠত। এক-একদিন ফেউ ডেকে উঠত। আমি বীরেশ্বর রায় ফেউয়ের ডাকে উৎকর্ণ হয়ে উঠে চঞ্চল হতাম। সে হেসে বলত, অমনি রক্ত গরম হয়ে উঠল তো? না।
সে বুঝত, আমার প্রিয় বন্দুক মনে পড়েছে। আমার চোখের দৃষ্টি কাঁসাইয়ের ওপারে জঙ্গলের অন্ধকারে চলে গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুঁজছে রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে আগুনের আঙরার মতো জ্বলন্ত দুটো গোল চোখ
—পাখী নয়, হরিণ নয়। এ বাঘ। বাঘ মারব না?
সে বলত-বাঘ যখন মানুষ মারবে, গরু মারবে তখন মানুষ বাধ্য হয়ে মারবে বাঘকে। তখন দোষ হবে না। কেউ যতক্ষণ ক্ষতি না করে ততক্ষণ কেন মারবে বল? এ পৃথিবী যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই মানুষও তৈরী করেছেন, বাঘও তৈরী করেছেন। বাঘ বনে থাকে থাকুক। মানুষের ঘর চড়াও যতক্ষণ না হয়, ততক্ষণ তুমি চড়াও হয়ে মারবে কেন?
যুক্তিগুলো দুর্বল, অন্যে কেউ বললে ব্যঙ্গ করতাম, হয়তো বা ধমক দিতাম, মুর্খ বলতাম। কিন্তু তার মুখে এমন মানাত কথাগুলি এবং এমন সরল সহজভাবে সে বলত যে আমারও মনে হত, তাই তো। কথা তো ঠিক!
নারীপ্রণয়মুগ্ধ পুরুষেরা কামান্ধ হয়ে বোকা হয়ে যায়। কিন্তু এ তা নয়, আমি বোকা হতাম না।
জল-জল। কিন্তু আকাশ থেকে যে জল ঝরে সে জল নির্মল, তুমি খুঁটি পুঁতে চাদর টাঙিয়ে সে জল পাত্রে ধর, সে জল ফিল্টার করা জল থেকেও নির্মল। সেই জল মাটিতে পড়ে পঙ্কিল। একই কথা। ভবানীর মুখে সে ওই আকাশের ঝরা জল। ওই কথা পণ্ডিত রামব্রহ্ম ন্যায়রত্নের মুখে ফিল্টার-করা জল। রেভারেণ্ড হিলের মুখেও তাই। সাধারণের মুখে ওই কথাই, বোকার কথা, নির্বুদ্ধিতার এবং অদৃষ্টবাদিতার পঙ্ক মেশানো কথা। তারা যখন বলে কপালে ছিল বলে বাঘে ধরেছে, তখন তাদের পিঠে চাবুক মেরে বলতে ইচ্ছে করে, এও তোর কপালে ছিল।
ভবানী, আশ্চর্য ভবানী! কিন্তু সেই ভবানী —। এ কি করে হল। কেমন করে হল?
রায়ের খাতায় আছে, শব্দকল্পদ্রুম উল্টে দেখছি সারাদিন, আর ভাবছি।