মতিলাল তার বিছানায়
মতিলাল তার বিছানায় শুয়েছিল। আজকের বিকেলের ঘটনার পর থেকে ওর কেবলই মনে হচ্ছিল বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই। স্বামী হয়ে স্ত্রীকে কন্ট্রোল করতে পারেনি সেটা এক জিনিস, অনেকেই পারে না। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় অনেকের। কিন্তু চোখের সামনে অন্য পুরুষের হাতে মার খেয়ে সুভদ্রা যেভাবে কেঁচো হয়ে গেল তা দেখার পর বেঁচে থেকে কী লাভ। মার খাওয়ার পর সুভদ্রা যদি চিৎকার করে তার সাহায্য চাইত তা হলে সে ছুটে যেত। তা না করে ও ওই লোকটার সঙ্গে ভেতরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করল–এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। সামনের মাস থেকে একটা পয়সাও দেবে না সুভদ্রাকে। সুভদ্রা যদি এখানে এসে ঝগড়া করে তা হলে সে হাত চালাবে। জীবনে কখনও মেয়েমানুষের শরীরে হাত তোলেনি সে, এবার তুলবে। ওই মেয়েকে বাঁচাবার জন্যে সে আগবাড়িয়ে গিয়েছিল বলে এখন আফসোস হচ্ছিল। এই সময় দরজায় শব্দ হল।
দরজা খুলতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু দ্বিতীয়বারের শব্দের সময় চাপা নারীকণ্ঠ কানে এল। অতএব উঠতে হল মতিলালকে। দরজা খুলতে ছিটকে ভেতরে চলে এল সুজাতা। মতিলাল দেখে পুলকিত হল। ওর কাঁধে সেই তিব্বতি ব্যাগ। ঘরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে সুজাতা বলল, এম্মা! কী করে রেখেছ তুমি? ঘরটা যে নরক হয়ে উঠেছে।
মতিলাল বলল, তাতে কার কী?
সুজাতা তার শরীর থেকে চাদরটা খুলে টেবিলের ওপর রাখল। ব্যাগটা চাদরের ওপর। মতিলাল দেখল মেয়েটা একটা আঁটো ব্লাউজ ছাড়া কিছু পরেনি।
তোমার ঠান্ডা লাগে না?
সুজাতা নিজের শরীরের দিকে তাকাল, ওমা! তোমার এসব নজরে পড়ে নাকি! শোনো, দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে আমাকে জব্দ করতে যাকে ডেকে এনেছিলি তার কাছে যা। আমি বললাম, যাওয়ার হলে যাব। শুনে বলল, গিয়ে দ্যাখ না। একটা কাঠের পুতুল ছাড়া কিছু না। মেয়েমানুষ আর পাশবালিশের কোনও তফাত বোঝে না। তাই নাকি?
মতিলাল জবাব দিল না। কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র সুভদ্রা সম্পর্কে তার বিদ্বেষ বাড়ছিল। সে নিজের ঘরে চলে গেল। তার খুব আফসোস হচ্ছিল। আজ দুপুরেও যদি সে সুভদ্রাকে প্রহার করত তা হলে সন্ধেবেলায় ওই দৃশ্য দেখতে হতো না।
সুজাতা চলে এল তার শোওয়ার ঘরের দরজায়, কী হল, বাক্যি নেই কেন?
ব্যাগটা এখানে আনো।
ব্যাগে কী ছিল?
সেটা আমি বুঝব।
চিনি, চা আর–!
মতিলাল তাকাল। নিশ্চয়ই দেখেছে সুজাতা। আর দেখেছে বলে আপনির বদলে তুমি তুমি করে কথা বলছে। সে নিশ্বাস চেপে বলল, আর?
পিস্তল। গুলিভরা পিস্তল। দিদি তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল, না?
হ্যাঁ।
তোমার কাছে পিস্তল কেন? দিদিকে মারবে বলে?
সেটা পারলে খুশি হতাম।
তুমি খুব হিংসেয় স্কুলছ। তার মানে তুমি দিদিকে ভালোবাস।
পিস্তলটা কোথায়?
সুজাতা চলে গেল ওঘরে। ফিরে এল পিস্তল হাতে, কিন্তু দিল না। না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে তোমার খারাপ লাগে?
আমি জানি না।
এখন থেকে আমি এখানে থাকব।
কেন?
আমার ইচ্ছে তাই। তুমি খেয়েছ?
হ্যাঁ। মিথ্যে কথা বলল।
পিস্তলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে চোখের আড়াল হল সুজাতা। চট করে ওটাকে তুলে নিয়ে চোখের সামনে আনল মতিলাল। না। মানুষ খুন করতে পারবে না সে। কিন্তু বদলা নিতে হবে। কীভাবে বদলা নেওয়া যায়? পিস্তলটাকে একটা খালি জুতোর বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল সে। এবং তখনই ভুটানি মদের বোতল হাতে সুজাতা ফিরে এল, এই হুইস্কি তুমি খাও?
না।
তা হলে রেখেছ কেন?
একজন দিয়েছিল তাই এনেছিলাম।
গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে কাঁচা খেল সুজাতা, বড্ড কড়া!
জল ছাড়া খাচ্ছ!
তুমি খাও।
না।
আমার দিব্যি, একটু খাও।
সুজাতার মুখের দিকে তাকিয়ে মতিলালের হঠাৎ যেন অন্যরকম লাগল। সে সুজাতার বাড়ানো গ্লাসটা নিয়ে মুখে ঢালল। সঙ্গে-সঙ্গে কান গরম, গলা জ্বলতে লাগল। প্রথম ধাক্কা কমে গেলে শরীরে যেন আগুন ছড়াল। সুজাতা দ্বিতীয়বার গ্লাসে ঢেলে নিজের গলায় ঢালল। ঢেলে আর-এক পেগ এগিয়ে দিল। মতিলাল বলল, না। আর না।
কেন?
আমার অভ্যেস নেই।
কী হবে খেলে? বাড়িতেই তো আছ। আমি আছি।
অতএব দ্বিতীয় গ্লাস মুখে ঢালল মতিলাল। তার শরীরে এখন গরম বাতাস পাক খাচ্ছে। গ্লাস-বোতল একপাশে সরিয়ে রেখে সুজাতা জামার বোতামে হাত দিল। একটু বাদে মতিলালের মনে হল এমন পেলব নারী-শরীর সে কখনও দেখেনি। দু-হাতে সুজাতাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল সে। সুজাতা বলল, আঃ আস্তে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সমস্ত শরীরে ঝড়। বিছানায় দুটো শরীর যখন পরস্পরকে জানতে-জানতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখন সুজাতা বলল, দিদি মিথ্যে কথা বলেছে।
ও মিথ্যুক।
তুমি আমাকে বিয়ে করবে? দু-হাতে মতিলালকে আঁকড়ে ধরেছিল সুজাতা।
আমি বদলা নেব।
কীসের বদলা?
উত্তর দিতে পারল না মতিলাল। উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাড়িটাকে চমকে দিয়ে বাইরের দরজার বেলের বোতাম টিপল কেউ। শব্দটা মতিলালের নার্ভে আঘাত করতেই সমস্ত উত্তেজনা উধাও। সুজাতা নিচুস্বরে বলল, বাজাক। মনে হচ্ছে দিদি এসেছে।
ও না।
কী করে বুঝলে?
ও এভাবে বেল বাজায় না।
বাব্বা! বেল বাজানোর আওয়াজেও মানুষ চিনতে পারো নাকি তুমি। যাও, দ্যাখো। সুজাতা বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ওর উন্মুক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না মতিলালের। অনেক-অনেক দিনের পর সে যেন এক নতুন স্বাদ পাচ্ছিল একটু আগে। যে স্বাদ সুভদ্রা তাকে এক মুহূর্তের জন্যে কখনও দেয়নি।
নিজেকে ভদ্রস্থ করে দরজা খুলতেই দুটো লোককে দেখতে পেল মতিলাল। সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে বেশ হ্যান্ডসাম, সিনেমার নায়কের মতো দেখতে। পিছনের লোকটা বেঁটে কিন্তু বোঝা যায় শক্তিশালী। বাড়ির সামনে একটা মোটরবাইক দাঁড়িয়ে আছে।
মতিলাল জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?
আপনার নাম মতিলাল? সামনের লোকটি জিজ্ঞাসা করল।
জি হ্যাঁ।
ভেতরে আসতে পারি?
কিন্তু আমি যে এখন খুব ব্যস্ত।
এদিকে আমার যে সময় নেই। আমাকে এখনই গ্যাংটকে যেতে হবে।
গ্যাংটকে? এত রাত্রে?
সেটা আমার সমস্যা।
ও। আসুন। তাড়াতাড়ি বলবেন যা বলার।
প্রদীপ এবং লিটন ঘরে ঢুকল। চারপাশে তাকিয়ে প্রদীপ একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। মতিলাল বুঝতে পারছিল না এদের মতলব। তার মন পড়ে আছে পাশের ঘরে। সেখানে শুয়ে থাকা সুজাতা নিশ্চয় কথাবার্তা শুনে পোশাক পরে নিয়েছে। লোকদুটো আর সময় পেল না এখানে আসার।
হ্যাঁ, বলুন! মতিলাল বিরক্ত প্রকাশ করল।
মতিলালজী। আজ সকালে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি খুবই দুঃখিত। সেই সময় আপনাকে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলাম যার ফলে আপনার এবং আমার, দুজনের হাত থেকে কিছু জিনিস পড়ে যায়। এখন অনুগ্রহ করে যদি আমার জিনিসটা আমাকে ফেরত দিয়ে দেন তা হলে চলে যাই। প্রদীপ শান্ত গলায় বলল।
কী জিনিস পড়ে গিয়েছিল? মতিলালের বুকে ড্রাম বাজতে লাগল। তার চেহারাটা মনে পড়ল। ওপর থেকে দ্রুত নেমে আসা যুবকটি যে তার সামনে বসে আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রদীপ উঠল। হাঁটতে হাঁটতে ঘরটা দেখল। মতিলালের চোখ তার ওপর ঘুরছিল।
প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, আমি আপনার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে চাই। পিস্তলটা কোথায়?
অস্বীকার করতে গিয়েও পারল না মতিলাল পিস্তলটা যে আপনার তার প্রমাণ কী?
এই সময় লিটন বলে উঠল, এতো আজব চিড়িয়া। তোমাকে এখনও চেনেনি গুরু।
প্রদীপ হাসল, প্রমাণ লোকে কোর্টে দেয়। শুনুন। আপনি একজন সাধারণ মানুষ। খবর পেলাম আপানর বউ পালিয়ে অন্যের সঙ্গে প্রেম করছে। পিস্তল নিয়ে আপনি কী করতে পারবেন? তার চেয়ে আমার জিনিস আমাকে দিয়ে দিন।
ওটা আমার কাছে আছে তা আপনাকে কে বলল?
শানবাহাদুর। এখন সে মাতাল হয়ে পড়ে আছে।
ঠিক তখনই শোয়ার ঘরের দরজায় এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সুজাতা। যতটা পোশাক সংক্ষিপ্তভাবে পরে নেওয়া সম্ভব তাই পরেছে সে। প্রদীপ দেখল মেয়েটাকে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তেমন নয় কিন্তু মেয়েটার শরীর আছে আর সেটাকে ব্যবহার করতে জানে।
আমার এই বাড়িতে পুলিশ সার্চ করে গেছে, কিছু পায়নি।
পুলিশ যাতে না পায় সেই ব্যবস্থা আপনি করেছিলেন। ওটা যে পুলিশের হাতে পৌঁছয়নি। সেইজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। তার জন্যে কত টাকা দিতে হবে?
লিটন চাপা গলায় বলল, বস, সময় নষ্ট করছ।
পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে টেবিলে রাখল প্রদীপ, দিন।
মতিলাল আর পারল না। সেখান থেকেই চিৎকার করে বলল, সুজাতা, ভেতরের ঘরে খাটের নিচে জুতোর বাক্স থেকে পিস্তলটা বের করে ওকে দিয়ে দাও। ঝমেলা চুকে যাক।
সুজাতা ঘরে ঢুকে যাওয়া মাত্র বাইরে গাড়ির শব্দ এবং হেডলাইটের আলো দেখা গেল। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগে থাপা কয়েকজন সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। প্রদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে?
থাপা দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, আমি তোমাকে এত বোকা বলে ভাবিনি প্রদীপ। পিস্তলটার খোঁজে এখানে আসার আগে তোমার চিন্তা করার দরকার ছিল। আমার হাতে এতদিন কোনও প্রমাণ না থাকায় তোমাকে ছুঁতে পারিনি। আজ তুমি ফেঁসে গেলে।
আপনি আজ কী প্রমাণ পেয়েছেন?
ওকে সার্চ করো। থাপা হুকুম দিতেই সেপাইরা এসে প্রদীপের শরীর হাতড়ে দেখল। লিটনকেও বাদ দিল না তারা। ওরা কিছু না পেতে থাপা মতিলালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আজ তোর হাড় ভাঙব আমি। যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব ঠিকঠাক দিবি। ও পিস্তলের খোঁজে এখানে এসেছে, তাই তো?
মতিলালকে এখন হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিল। কোনওরকমে মাথা নাড়ল সে, হ্যাঁ। থাপার মুখে হাসি ফুটল, গুড। পিস্তলটা দিয়েছ ওকে? চুপ করে রইল মতিলাল। থাপা চিৎকার করল, কথা বল!
না। দিইনি। মতিলাল শোওয়ার ঘরের দরজার দিকে তাকাল।
সেখানে কেউ নেই।
কোথায় রেখেছ ওটাকে?
আমি রাখিনি।
কে রেখেছে? বাঁচতে চাও তো সত্যি কথা বলো।
আমি জানি না। কিছু জানি না।
থাপার নজরে পড়ল কিছু টাকা সামনে পড়ে আছে। নোটগুলো তুলে সে গুনল, দুশো। এইসময় প্রদীপ বলল, আপনি মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন স্যার।
সেটা আমি বুঝব। তোমাদের এই জুড়িকে যদি হাজতে ঢোকাতে পারি–! এই টাকা কি তুমি দিয়েছ ওকে?
আপনি তো পিস্তল খুঁজতে এসেছেন। টাকার খোঁজ নিয়ে আপনি কী করবেন?
কিছু বলতে গিয়ে থাপা চুপ করে গেল। তার চোখ মতিলালের ওপর। মতিলাল যেন অনেকক্ষণ থেকে বিপরীত দরজায় দিকে তাকিয়ে কিছু লক্ষ করার চেষ্টা করছে। থাপা চটপট শোওয়ার ঘরের দরজায় পৌঁছে গেল। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে উঠল, এই জানলা দিয়ে পালিয়েছে। কে ছিল এই ঘরে?
খ্যাপা মোষের মতো বেরিয়ে এল থাপা, এই ঘরে মেয়েছেলে ছিল। মেয়েদের পোশাক পড়ে আছে বিছানার ওপর। কে ছিল?
আমার–আমার–। মতিলাল ঢোঁক গিলল।
তোমার বউ? থাপা ধমকে উঠল।
না স্যার। বউ না। বউ-এর বোন!
ও বাব্বা। শালির সঙ্গে লীলা করছিলে নাকি? অনেক গুণ আছে দেখছি। কিন্তু জানলা দিয়ে শালি পালাল কেন? পিস্তলটা ওই নিয়ে গেছে?
আমি জানি না স্যার, কিছু জানি না।
থাপাকে এখন কিংবর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছে। প্রদীপ এগিয়ে গেল, স্যার, আপনি যে কাজটা পাইয়ে দিয়েছেন সেটা করতে হলে আমাকে এখনই গ্যাংটকে রওনা হতে হয়। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি পিস্তলটা পাইনি।
কথাগুলো কানে গেল না যেন থাপার। মতিলালের দিকে তাকিয়ে সে বলল, তোমার শালিকে আমি আজ রাত্রেই তুলে আনছি। তারপর তোমাদের মজা দেখাব।
প্রায় ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল থাপা তার দলবল নিয়ে। লিটন এতক্ষণ একপাশে সিঁটিয়ে ছিল, এবার বলল, চলো গুরু, কেটে পড়ি।
প্ৰদীপ মতিলালের দিকে তাকাল। মতিলাল এখন দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। ওর শরীর কাঁপছে। প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, এটা কী হল?
আমি বুঝতে পারছি না। ও কেন পালাল?
পালিয়ে দার্জিলিং-এর কোথাও থাপার হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। প্রদীপ ঘুরে দাঁড়াল, টাকাটা রইল। যদি পিস্তলটা আপনার হাতে আসে তাহলে ফিরে এসে ওটা নেব আমি।
বাইরে বেরিয়ে এল সে, পিছনে লিটন।
এখন বেশ ঠান্ডা। আকাশ পরিষ্কার। অন্ধকার রাস্তায় মানুষজন নেই। লিটন বলল, শালা বহুৎ হারামি। আমি বদলা নেব।
কার কথা বলছিস?
শানবাহাদুর। ভাবলাম নেশার ঘোরে কথা বলছে, আউট হয়ে গেল। পয়সা দিলাম তবু আমরা চলে আসার পরেই পুলিশকে খবরটা দিয়েছে।
ছুঁচো মেরে এখন লাভ নেই। গ্যাংটকে পিস্তলটা সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। মোটরবাইকে উঠে পড়ল সে, কাল সকালের ফার্স্ট বাস ধরে গ্যাংটকে চলে আসবি, হোটেল ড্রিমল্যান্ডে গিয়ে খবর নিবি। ইঞ্জিন চালু করল প্রদীপ।
তুমি একা এতটা রাস্তা যাবে? আমি পেছনে বসি না।
না। একা যেতে আমার সুবিধে হবে।মোটরবাইক চালু করল প্রদীপ। লিটন হাঁটতে শুরু করল বিপরীত দিকে। মোড় ঘুরতেই হেডলাইটের আলোয় একটা মূর্তিকে দৌড়ে মাঝখানে চলে আসতে দেখল প্রদীপ। আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে যে মূর্তিটা হাত নাড়ছে সে স্ত্রীলোক।
কাছাকাছি আসতেই চিনতে পারল প্রদীপ। সে বাইকটাকে থামাতেই সুজাতা ছুটে এল কাছে, আমাকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি, আপনি আমাকে বাঁচান।
আমি কীভাবে বাঁচাব?
আপনি তো গ্যাংটকে যাচ্ছেন।
তোমাকে কে বলল?
আমি শুনেছি। বাড়িতে ঢোকার সময় আপনি জামাইবাবুকে বলেছিলেন। আপনি আমাকে গ্যাংটকে নিয়ে চলুন। ওখানে আমার এক পিসি থাকে। ওখানে গেলে এখানকার পুলিশ আমাকে কিছু করতে পারবে না।
কাল সকালের বাস ধরে চলে যেও।
তার সুযোগই পুলিশ আমাকে দেবে না। আপনার পিস্তলটাকে বাঁচাতে গিয়ে এ আমি কী বিপদ ডেকে আনলাম। কেঁদে ফেলল সুজাতা।
পিস্তলটা বাঁচাতে গেলে কেন?
মনে হয়েছিল ওটা পেলে পুলিশ আপনাকে ছাড়বে না।
আমাকে তুমি চেনো না। আমাকে পুলিশ ধরলে তোমার কী?
আমি আপনাকে চিনি।
সে কি? কোথায় দেখেছ?
দেখেছি। দার্জিলিং-এই।
তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তোমার জামাইবাবুকে বাঁচাতে চেয়েছিলে তুমি।
তা হলে পালাতাম না। জানলা দিয়ে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলতাম বাইরে।
ওটা তোমার কাছে আছে?
হ্যাঁ।
আমাকে দাও।
না। আগে আপনি আমাকে গ্যাংটক নিয়ে যান, তারপর।
তোমাকে কীভাবে নিয়ে যাব? আমি তো এখনই বাইকে রওনা হচ্ছি।
বাইকের পিছনে বসে আমি যেতে পারব।
তোমার ঠান্ডা লাগবে। গায়ে তো বেশি জামা কাপড় নেই।
লাগুক। তবু এখান থেকে যেতেই হবে।
ঠিক আছে। তুমি স্টেশনের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। সাবধান, পুলিশ যেন তোমাকে দেখতে না পায়।
আপনি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছেন না তো?
প্রদীপ হাসল, তোমাকে ফেলে আমি চলে যেতে পারি, কিন্তু আমার পিস্তলটাকে নিয়ে যাওয়াটা খুব জরুরি।
.
পনেরো মিনিট বাদে প্রদীপ যখন স্টেশনের পাশের রাস্তায় বাইক দাঁড় করাল তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। এতটা পথ মোটরবাইকে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। এপাশ ওপাশে তাকাতেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল সুজাতা। তার দুই হাত বুকের ওপর। শীতে কাঁপছে সে। প্রদীপ ব্যাকসিটে রাখা ওভারকোট এগিয়ে দিল, এটা পরে নাও। টুপি, মাফলার আছে ওখানে। চটপট।
কৃতার্থ হয়ে আদেশ মান্য করল সুজাতা। তারপর বাইকের পিছনে উঠে বসল। দার্জিলিং ছাড়িয়ে বাইক এগিয়ে যাওয়া মাত্র সুজাতা ফিসফিস করে বলল, পিস্তলটা নেবেন না?
গ্যাংটকে পৌঁছবার পর নেওয়ার কথা।
সুজাতা হাসল। তারপর বলল, আপনি খুব ভালো।
প্রদীপ জবাব দিল না। এ রকম তৈল মর্দন মানুষ কোনও বিপাকে পড়ে করে, সেটা তার জানা আছে।
দার্জিলিং থেকে তিস্তাবাজার হয়ে কালিম্পংকে ডানদিকে রেখে মধ্যরাত্রে গ্যাংটকের দিকে ছুটে যাওয়াটা মোটেই আরামদায়ক নয়। কিন্তু প্রদীপ যাবতীয় প্রাকৃতিক প্রতিরোধকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় ছিল। লিটনকে সঙ্গে না নিয়ে রওনা হওয়া ভুল হচ্ছিল সেটা কিছুটা দূর আসার পরই টের পেয়েছিল। এখন লিটনের বদলে সুজাতা পিছনে থাকায়, কোনও কথা না বলা সত্ত্বেও, তার মনে হচ্ছিল এই কষ্টকর যাত্রায় সে একা নেই। আর একটি মানুষের তপ্ত উপস্থিতি তাকে যথেষ্ট স্বস্তি দিচ্ছিল।
পাহাড়ি রাস্তায় সন্ধে ঘন হয়ে গেলে কেউ গাড়ি চালায় না। নিতান্ত বাধ্য না হলে কোনও গাড়িকে রাতদুপুরে এইসব পথে দেখা যায় না। একটানা যেতে-যেতে বাইক গরম হয়ে উঠেছে বেশ। প্রদীপ রাস্তার পাশে একটা সমান জায়গা পেয়ে বাইক দাঁড় করাল। নিচে পা দিতে গিয়ে বুঝতে পারল পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।
বাইক থেকে নেমে সুজাতা প্রথম কথা বলল, এখানে কেন?
ইনি বিশ্রাম চাইছেন। প্রদীপ পায়ে সাড় আনার চেষ্টা করছিল, উঃ কী ঠান্ডা!
পায়ে কী হয়েছে?
বাঁ পা অবশ-অবশ লাগছে। এক নাগাড়ে। ঠিক আছে।
প্রদীপ সোজা হল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমার ঠান্ডা লাগছে না?
লাগছে। সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।
এইভাবে এককথায় দার্জিলিং ছেড়ে চলে এলে, ওখানে কেউ চিন্তা করবে না?
আমার জন্যে কেউ চিন্তা করে না।
জামাইবাবু? দিদি?
দিদি তো মুক্তি পাবে। জামাইবাবু, হাসল সুজাতা, আজকের আগে আমার দিকে ভালো করে কখনও তাকাননি। আজ যে আমার মাথায় কী ঢুকল!
নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলে!
ঠিক বলেছেন।
আমরা গ্যাংটকে পৌঁছে যাব ভোরের মধ্যে। ওইসময় পিসির বাড়িতে গেলে তিনি অবাক হবেন না? জানতে চাইবেন না কীভাবে এলে?
সেটাই তো স্বাভাবিক। একটা কিছু উত্তর দিতে হবে।
তুমি বিবাহিতা?
একসময় ছিলাম। এখন নই।
প্রদীপ আর কথা বাড়াল না।
ওরা গ্যাংটকে ঢুকল যখন তখন শহর ঘুমন্ত। ইতিমধ্যে আকাশের চেহারা বদল হয়েছে। সিকিমের আকাশে এখন গুঁড়ি-গুড়ি মেঘ। সূর্যদেবের ওঠার কোনও আয়োজনই নেই। রাস্তার আলোগুলো বুড়ি ডাইনির চোখ হয়ে জ্বলছে। প্রদীপ গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় নামবে?
আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন? গলা তুলতে হল সুজাতাকেও।
হোটেল ড্রিমল্যান্ড। বাড়ির কাছাকাছি না নামলে তোমার এখন একা হাঁটা ঠিক হবে না। তুমি আমার সঙ্গে চলো। আলো ফুটলে পিসির বাড়িতে চলে যেও।
আপনার কোনও অসুবিধে হবে না তো?
প্রদীপ জবাব দিল না।
হোটেল ড্রিমল্যান্ড কুলীন নয়। এর আগে দুবার গ্যাংটক এসে এখানেই উঠেছিল প্রদীপ। এই সময়ে কাউন্টারে লোক থাকার কথা নয় কিন্তু কয়েকজন ট্যুরিস্ট সাইট সিয়িং-এ যাচ্ছে বলে হোটেলের কর্মচারী জেগেছিল। ওদের দেখে লোকটা অবাক, আপনারা বাইকে করে এতটা রাস্তা এসেছেন? এই রাত্রে!
প্রদীপ হেসে বলল, ঘর হবে?
সিওর। ডাবল বেড?
লিটন আসবে দুপুরের আগেই। ওর জন্যে ব্যবস্থা রাখা দরকার।
প্রদীপ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
লোকটি চাবি নিয়ে দোতলায় উঠে ঘর খুলে দিয়ে বলল, পরে একসময় খাতাপত্তরের কাজ করে নেব। চা খাবেন?
সিওর। সেইসঙ্গে কিছু স্ন্যাকস।
লোকটা চলে গেলে সুজাতা জিজ্ঞাসা করল, আপনি ডাবল বেড নিলেন কেন?
এবার খেয়াল হল প্রদীপের। সুজাতা কি তাকে সন্দেহ করছে?
সে হাসল, নিলাম।
আপনি কী করে ভাবলেন এখানে আমি থাকব?
সারারাত ধরে আমার বাইকের পিছনে বসে আসবে এটাও তো কখনও ভাবিনি।
আমি যাচ্ছি।
বসো। আমার এক বন্ধু আসবে সকালের বাসে, যে আমার সঙ্গে তোমার জামাইবাবুর বাড়িতে গিয়েছিল। ব্যবস্থাটা তার জন্যে। প্রদীপ বাথরুমে চলে গেল। গরমজলের কল খুলে মুখে দিল খানিকটা। আঃ, আরাম। বাইকের সাইড ক্যারিয়ারে যে অ্যাটাচিটা রয়েছে সেটা আনিয়ে নিতে হবে। দুদিন চলে যাবে এমন সব কিছু তাতে ঠাসা আছে।
বাইরে বেরিয়ে এসে সে বলল, তুমি তো এক বস্ত্রে এসেছ। এই মুহূর্তে আমিও তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। তবু মুখটা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।
এগিয়ে যাওয়ার সময় নিচু গলায় সুজাতা বলে গেল, সরি।
দুঃখিত হওয়াটা সন্দেহ প্রকাশের কারণে এটা বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করল প্রদীপ। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। চা এল। চা আর বিস্কুট। তাড়াতাড়ি সেগুলো শেষ করে একটা বিছানায় লম্বা হল প্রদীপ। আমি আটটা পর্যন্ত ঘুমাব। ততক্ষণ কথা না বললে উপকার করা হবে।
তা হলে এটা রাখুন। পিস্তলটা বের করে বিছানার ওপর রেখে সুজাতা বাথরুম চলে গেল।
সোওয়া আটটা নাগাদ ঘুম ভাঙল প্রদীপের। বিছানায় শুয়েই বুঝতে পারল সুজাতা ঘরে নেই। ও চোখ বন্ধ করল। মেয়েদের সম্পর্কে তার কোনও উন্নাসিকতা নেই। ঠিকঠাক প্রেমে পড়ার মতো কোনও মেয়ের দর্শন সে এখনও পর্যন্ত পায়নি। মেয়েরা এসেছে জীবনে কিন্তু তারা মেয়ে বলেই প্রেমে পড়তে হবে এমনটা কখনও মনে হয়নি। কেউ-কেউ এসে শরীরের স্বাদ দিয়ে চলে গেছে এবং এই কারণে তার কোনও পাপবোধ নেই। সেইসব মেয়েরা এসেছিল স্বেচ্ছায়, চলে যাওয়ার ব্যবস্থা রেখে। আজ দার্জিলিং থেকে গ্যাংটকের দীর্ঘপথটা যে মেয়ে পাড়ি দিয়ে এল তার পেছনে বসে, এই হোটেলের বন্ধ ঘরে শুয়ে রইল পাশের বিছানায় সে নিশ্চয়ই তাকে এখন সাধু-সন্ন্যাসী ভাবছে।
প্রদীপ উঠল। এবং তখনই চোখে পড়ল পাশের বিছানার ওপর তার এনে দেওয়া ওভারকোট মাফলার এবং টুপি পড়ে আছে। সে বাথরুমের দরজা খুলে দেখল সেখানেও সুজাতা নেই। সে ওকে শহরে ঢোকার সময় বলেছিল আলো ফুটলে চলে যেতে। সেইমতো কাজ করেছে মেয়েটা। শুধু যাওয়ার সময় বলে যেতে পারত। প্রদীপ হাসল, সে নিজেই তো বিরক্ত করতে নিষেধ করেছিল।
সাড়ে আটটা নাগাদ প্রদীপ পথে নামল। বাইক নিয়ে সোজা চলে এল বাজারের কাছে যেখানে পরপর ট্যুরিস্ট অফিসগুলো রয়েছে। বেশিরভাগ বাস ইতিমধ্যে ট্যুরিস্টদের দ্রষ্টব্য জায়গা দেখাতে চলে গিয়েছে। কিছু বাস তৈরি হচ্ছে।
ঘণ্টাখানেক ধরে একের পর এক অফিসে ঘুরে প্রদীপ দেখল কোনও কাজের কাজ হচ্ছে না। কোনও অফিসই বলতে পারছে না কাল সিকিম-তিব্বত বর্ডারে কোন বাস গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল রেজিস্টার্ড ট্যুরিস্ট কোম্পানি ছাড়াও বেশ কিছু সংস্থা মিনিবাসে ট্যুরিস্টদের নিয়ে ওদিকে বেড়াতে যায়। নবম অফিস থেকে হতাশ হয়ে বেরিয়ে প্রদীপ যখন ভাবছে কী করা যায় তখন তার মনে পড়ে গেল। যে বাসটা গতকাল ওদিকে গিয়েছিল তার যাত্রীরা ব্ল্যাক লেপার্ডদের মেটিং দেখেছে। তিনজন ট্যুরিস্ট তার ছবি তুলেছে। এমন বিচিত্র ঘটনার কথা শহরে ফিরে এসে কেউ আলোচনা করবে না এমন হতেই পারে না।
সামনে দাঁড়ানো একটা বাসের দিকে তাকাল সে। কয়েকজন যাত্রী উঠেছে। ড্রাইভার নিচে দাঁড়িয়ে। সে এগিয়ে গেল, আচ্ছা, ব্ল্যাক লেপার্ড দেখা যায় বলে শুনেছি। কোন বাসে গেলে দেখার সুযোগ পাব বলতে পারেন?
লোকটা অবাক চোখে তাকাল, ব্ল্যাক লেপার্ড?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমি তো এ জীবনে দেখিনি। দেখা যায় কে বলল আপনাকে?
কালই একটা ট্যুরিস্টবাসের সবাই দেখেছে। টিবেটিয়ান বর্ডারের কাছাকাছি।
আমি তো শুনিনি। আপনাকে কি কমলাপ্রসাদ বলেছে এই গল্পটা?
না। কমলাপ্রসাদ কে?
ড্রাইভার। হিমালয়ান ট্যুরিজমের বাস চালায়। ওর কথায় কান দেবেন না। দিনকে রাত করার মতো মিথ্যে কথা ওর জিভে। একদিন তো এসে বলেছিল ইয়েতির বাচ্চাকে দেখেছিল। বেচারা নাকি পথ হারিয়ে কাঁদছিল। হাঃ হাঃ হাঃ।
গল্পটা গল্পই হতে পারে। কিন্তু ড্রাইভার কাছাকাছি পুলিশ স্টেশনে খবর দিয়ে গিয়েছিল। সেই পুলিশ স্টেশনের খাতায় নিশ্চয়ই ড্রাইভারের পরিচয় পাওয়া যাবে। আর মিথ্যে হলে লোকটা পুলিশকে কি ভাওঁতা দেবার মতো সাহস পাবে?
হিমালয়ান ট্যুরিজমের অফিসে ঢুকে পড়ল প্রদীপ। টেবিলের ওপাশে একটি মাঝবয়সি সুন্দরী সিকিমিজ মহিলা কাগজপত্র দেখছিলেন, মুখ তুলে হাসলেন, গুডমর্নিং।
গুডমর্নিং। বসতে পারি?
সিওর। বলুন, আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?
ভদ্রমহিলা এখন একা অথচ আমরা শব্দটি ব্যবহার করলেন। অর্থাৎ ইনি ট্যুরিস্টদের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। প্রদীপ হাসল, ম্যাডাম, আপনার গলার হার একটু অদ্ভুত রকমের। কিছু মনে করবেন না, ওগুলো কি নীলমুক্তো?
মহিলা এবার ছড়িয়ে হাসলেন, আপনার চোখ দেখছি জহুরির।
ধন্যবাদ। আপনাদের সংস্থায় কমলাপ্রসাদ নামে কোনও ড্রাইভার আছে?
কেন বলুন তো?
আমি শুনলাম গতকাল কমলাপ্রসাদ যে বাস নিয়ে ট্যুরে গিয়েছিলেন সেই বাসের যাত্রীরা ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছেন। ব্ল্যাক লেপার্ড ভারতবর্ষে দেখতে পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারটা আমাকে বিস্মিত করেছে।
কমলাপ্রসাদ ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছে? কই আমরা তো একথা জানি না। এমন একটা। খবর চেপে রাখার লোক ও নয়।
আপনি ওর ঠিকানাটা দিতে পারেন?
প্রদীপ প্রশ্ন করতেই একটা রোগা বেঁটে লোককে অফিসে ঢুকতে দেখা গেল। ভদ্রমহিলা হাসলেন, কমলাপ্রসাদ, কালকে তুমি ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছ?
কালকে দেখিনি।
কবে দেখেছিলে?
মাসখানেক আগে। সিনেমায়। প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখি।
এই ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
কমলাপ্রসাদ প্রদীপের দিকে তাকাল। প্রদীপ হাসল, আমার নাম প্রদীপ গুরুং। গতকাল আপনি টিবেটিয়ান বর্ডারে ট্যুরিস্টদের নিয়ে গিয়েছিলেন?
জী হ্যাঁ।
ওখানে ব্ল্যাক লেপার্ড দেখার পর পুলিশ স্টেশনে জানিয়েছিলেন?
কমলাপ্রসাদ হেসে উঠল শব্দ করে, লোকে বলে আমি গল্প বানাই। কিন্তু আমাকে নিয়ে যে গল্প বানাতে পারে সে তো আরও বড় গুলবাজ।
প্রদীপ হতাশ হল, আপনি কিছু দেখেননি?
না স্যার। দেখে থাকলে সেটা অফিসে এসে জানাতাম। না দেখে-দেখে গল্প বানিয়ে এখন আমি ক্লান্ত। সত্যি যদি দেখার মতো কিছু পেতাম, সেটা ব্ল্যাক লেপার্ড হোক অথবা ইয়েতি হোক, আমার চেয়ে খুশি কেউ হতো না।
আপনি গতকাল কোন রুটে গিয়েছেন?
কমলাপ্রসাদ দেওয়ালে টাঙানো ম্যাপটার দিকে তাকাল। একটা স্কেল টেবিল থেকে তুলে সে দেখাল গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে কোন-কোন রাস্তায় সে বাস নিয়ে ঘুরেছে। প্রদীপ উঠে দাঁড়িয়ে লক্ষ করল।
সিকিম-টিবেট বর্ডারটা কোনদিকে?
এদিকে। স্কেল সরাল কমলাপ্রসাদ।
ওদিকে আপনাদের কোনও বাস গিয়েছিল?
না। ওখানে সাধারণত এভারেস্ট ট্যুরিজমের বাস যায়।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এভারেস্ট ট্যুরিজমের অফিসে পৌঁছে প্রদীপ দেখল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন। সরাসরি প্রশ্ন না করে প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল, আজ আপনাদের কোনও বাস তিব্বত বর্ডারে যাবে?
না।
গতকাল গিয়েছিল?
হ্যাঁ।
গতকাল যিনি বাসটা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
কেন বলুন তো?
ব্যাপারটা ব্যক্তিগত।
তা ব্যক্তিগত ব্যাপার যখন তখন অফিসে এসেছেন কেন? চন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে দেখা করুন। যত্তসব ঝুটঝামেলা।
চন্দ্রনাথের বাড়িটা কোথায়?
জিজ্ঞাসা করে নিন। বাইরে অনেক লোক আছে তাদের জিজ্ঞাসা করুন। লোকটা খেঁকিয়ে উঠল। প্রদীপের মনে হল এই চন্দ্রনাথের সঙ্গে লোকটির সম্পর্ক নিশ্চয়ই ভালো নয়। বাইরে বেরিয়ে আড্ডারত কিছু লোকের কাছে সে চন্দ্রনাথের খবর পেয়ে গেল। এখন এ সময় নাকি চন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকার লোক নয়। তাকে পাওয়া যাবে হংলুর ভাটিখানায়। জায়গাটা কোথায় জেনে নিয়ে বাইকে উঠে বসল প্রদীপ। লোকটা যদি মাতাল হয় তা হলে গিয়ে কোনও লাভ হবে না।
হংলুর ভাটিখানা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। এই সকাল পার হতে-না-হতেই সেখানে মাতালদের ভিড় জমে গেছে। প্রশ্ন করে করে চন্দ্রনাথের সামনে যখন পৌঁছল তখন নেশায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে। লোকটার স্বাস্থ্য এখনও ভালো। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। মুখে খোঁচা দাড়ি দাঁড়িয়ে।
প্রদীপ ওর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, কগ্লাস খেয়েছেন?
চোখ না খুলে চন্দ্রনাথ জবাব দিল, এই প্রশ্নের জবাব আমি আমার বউকেও দিই না। তুমি কে?
আমি আপনার খোঁজে এভারেস্ট ট্যুরিজমে গিয়েছিলাম। বুড়োটা খুব খারাপ ব্যবহার করল!
করবেই! শালা আমাকে সহ্য করতে পারে না। গতকাল ফিরে এসে যেই বলেছি আজ আর বেরুতে পারব না অমনি ওর মেজাজ খারাপ হয়েছে। কেন রে শালা, আমি কি তোর বাপের চাকর যে রোজ-রোজ গাড়ি চালাব? চোখ খুলে মাথা নাড়ল চন্দ্রনাথ।
ঠিক কথা।
কিন্তু ভাই, আমার খোঁজে কেন?
প্রদীপ বুঝল লোকটার মাথা পরিষ্কার আছে এখনও। সে বলল, কাল আপনি বাস নিয়ে বর্ডারের দিকে গিয়েছিলেন?
গিয়েছিলাম। কিন্তু ও ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। পুলিশ?
না। আমি পুলিশ নই। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি কিছু জানেন না। কিন্তু আপনার বাসে তিনজন ট্যুরিস্ট ছিল যারা ক্যামেরায় ছবি তুলেছে। তাদের চেনেন?
যাচ্চলে। কত লোক রোজ গ্যাংটকে বেড়াতে আসছে। তারা টিকিট কেটে বাসে ওঠে। আমি সেই বাস নিয়ে এখানে ওখানে যাই। তারা কে কী করে আমি চিনব কী করে?
ঠিক কথা। তবু মনে করে দেখুন, কিছু মনে পড়ে কি না। প্রদীপ একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে চন্দ্রনাথের সামনে রাখল। বাঁ-হাতে নোটটা তুলে নিয়ে চন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করল, ক্যামেরা কার কার হাতে ছিল এখন মনে নেই। বিকেলে গ্যাংটকে ফিরে এসে যে যার হোটেলে চলে গেল। তবে একজন লোক খুব মোটা ছিল। আড়াইজন মানুষের মতো মোটা। অথচ মাথাটা ছিল আপেলের মতো গোল। বাস থেকে নেমে লোকটা একজনকে জিজ্ঞাসা করছিল হলিডে হোটেলে যাওয়ার রাস্তাটার কথা। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। আসতে পারল অথচ যেতে পারছে না কেন?
ওই লোকটা ছাড়া আর কেউ?
একটা বিদেশি বুড়ি ছিল। খুব বকবক করছিল! ওই বুড়িই আমাকে বলেছিল থানায় খবর দিতে। ওখানে তো থানা নেই, একটা পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিয়ে এসেছিলাম।
ওই বুড়ি কোন দেশের?
তা বলতে পারব না। বিদেশিনীদের আমার একরকম লাগে। তবে বুড়ি উঠেছে ট্যুরিস্ট লজে। কারণ ফেরার সময় ওই লজের সামনে ওঁকে নামিয়েছি। চন্দ্রনাথ বলল।
আপনার বাসে কাল কজন যাত্রী ছিল?
আটজন।
রাস্তায় বেরিয়ে প্রদীপ নিজের বাইকের গায়ে হাত বোলাল। দুটো নাম পাওয়া গেল। বুড়ি ক্যামেরায় ছবি না তুললেও ক্যামেরাম্যানদের হদিশ দিতে পারেন। যারা সবসময়ে টিকটিক করেন তারা অনেক কিছু মনে রাখেন। সে সোজা ট্যুরিস্ট লজে চলে এল।
ভদ্রমহিলা ঘরে ছিলেন। নিজেকে সাংবাদিক হিসাবে রিসেপশনে পরিচয় দিয়ে সে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। রিসেপশন ভদ্রমহিলাকে সেকথা জানাতে তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। লাউঞ্জে চেয়ার সাজানো। তার একটায় বসল প্রদীপ। এখন ঘড়িতে যে সময় তাতে লিটনের ইতিমধ্যে এসে যাওয়ার কথা। কাজ প্রথম দিকে মোটেই এগোচ্ছিল না। কিন্তু চন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মনে হচ্ছে আজ বিকেলেই দার্জিলিং-এ ফিরে যেতে সে পারবে। তারপর পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে সোজা হোমে চলে যাবে। অবশ্য যদি লোকটা টাকা দিতে ঝামেলা করে তাহলে মুশকিল। সে ঠিক করল ছবিগুলো লিটনের কাছে রেখে সে আগে বাংলোয় গিয়ে দেখা করবে। লোকটা যদি দুনম্বরি করে তা হলে জীবনে ছবি পাবে না। প্রদীপ দেখতে পেল এক মধ্যবয়সিনী বিদেশিনী এদিক ওদিক তাকাতে-তাকাতে এগিয়ে আসছেন। মহিলার পরনে সাদার ওপর নীল বৃত্ত আঁকা সাধারণ গাউন।
প্রদীপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যালো।
ভদ্রমহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট নয়, দশ। মুখের চামড়া শুধু বলছে ওঁর বয়স হয়েছে কিন্তু শরীর এখনও মজবুত, ইয়েস?
প্রদীপ বলল, আমার নাম প্রদীপ গুরুং। আমি একজন সাংবাদিক।
ও। এতক্ষণে খবরটা পেয়েছেন? বসুন-বসুন। আমার নাম লিসা। ভদ্রমহিলা বসলেন। কিন্তু ওঁর মুখ আবার চলতে শুরু করল, এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল, পুলিশকেও জানানো হল কিন্তু কেউ যে মাথা ঘামাচ্ছে তা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। আসলে, কিছু মনে করবেন না, আপনাদের দেশের ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না।
আপনি কতদিন আছেন এখানে?
কালই চলে যাব। একা-একা এখানে যে কী বোরিং ব্যাপার। সময় কাটাবার কোনও ব্যবস্থাই নেই। অথচ কাঠমাণ্ডুতে কিন্তু অন্য আবহাওয়া।
ম্যাডাম, গতকাল আপনি ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলেন?
কপাল খারাপ। আমার ক্যামেরাটা হঠাই বিগড়ে গিয়েছিল। নইলে ক্যামেরা ছাড়া আমি কোথাও এক পা যাই না। খুব দামি ক্যামেরা বলে এখানে সারাতে দিতে চাই না।
আপনার বাসে তিনজন লোকের হাতে ক্যামেরা ছিল। তাদের মনে আছে?
না। আমি তো সহযাত্রীদের দেখব বলে এখানে আসিনি। বাসের জানলা দিয়ে প্রকৃতির এত কিছু দেখার জিনিস ছেড়ে সহযাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকব তেমন বয়স আমার নেই। তবু ওই লোকটা খুব বিরক্ত করছিল।
কোন লোকটা?
তোমাকে কী বলব। অনেক মোটা মানুষ আমি দেখেছি কিন্তু অমন মোটা কখনও দেখিনি। উঃ। শুনেছিলাম বেশি মোটা হয়ে গেলে মানুষের মন থেকে কুচিন্তা চলে যায়। এর তো পুরোমাত্রায় আছে। ও ছবি তুলেছিল। আর পাশের লোকটাকে অনবরত ক্যামেরা সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছিল।
সেই লোকটা কেমন?
আমি লক্ষ করিনি। একে মনে আছে কারণ ওই চেহারা আর দ্বিতীয়ত আমাকে ডিনার খাওয়াতে চেয়েছিল বলে।
আপনি একাই এসেছেন ম্যাডাম?
নিশ্চয়ই। সারা পৃথিবী একা ঘুরে বেড়াই আমি।
অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম। প্রদীপ উঠে পড়ল।
পুলিশ কোনও অ্যাকশন নিয়েছে?
না। স্পটে গিয়ে পুলিশ কিছুই দেখতে পায়নি।
তা পাবে কী করে? এমন অলস মানুষ আমি কখনও দেখিনি।
বাইরে বেরিয়ে এসে একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে এস টি ডি করল প্রদীপ। প্রথমবারেই লাইন পাওয়া গেল। এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে তিনিই রিসিভার তুললেন। স্যার আমি গ্যাংটক থেকে বলছি।
বুঝেছি।
আমি ট্যুরিস্টবাসটাকে খুঁজে বের করেছি।
গুড।
একজন ফটোগ্রাফারের হদিশ পেয়েছি। তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
হু ইজ হি?
এখনও নাম জানি না। ড্রাইভারের কাছে জানতে পেরেছি।
ড্রাইভার কে?
চন্দ্রনাথ লোকটার নাম। এভারেস্ট ট্যুরিজমের গাড়ি।
ঠিক আছে। ক্যারি অন।
.
লোকটার নাম রণতুঙ্গা। এত মোটা মানুষ জীবনে দেখেনি প্রদীপ। রিসেপশনে খবর দিতে ঘরেই ডেকে পাঠিয়েছিল তাকে। কোনওরকম ভনিতা না করে প্রদীপ তাকে সরাসরি বলল, মিস্টার রণতুঙ্গা, আপনি টিবেটিয়ান বর্ডারে যে ছবিগুলো তুলেছিলেন সেগুলো আমার চাই।
মাংস এবং চর্বিতে লোকটার দুকান প্রায় ঢাকা। সেই অবস্থায় যেভাবে তাকাল তাকে অবাক হওয়া নিশ্চয়ই বলা চলে।
এখানে বুঝি চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায়?
তার মানে?
আমি তো অনেক কিছু চাইছি অথচ কিছুই পাচ্ছি না। একটা ক্যাসিনো নেই যে জুয়ো খেলব! এমনকী একটি ভালো মহিলা এসকর্ট পর্যন্ত পাচ্ছি না। আর আপনি এসে যেই বললেন। ছবিগুলো চাই আর আমি দিয়ে দেব?
প্রদীপ বুঝল লোকটা বোকা নয়। সে বলল, ওই ছবিগুলো নিয়ে আপনি কী করবেন?
যা ইচ্ছে তাই করতে পারি।
আপনি কটা ছবি তুলেছেন?
তোলার সময় হিসেব করিনি। তাছাড়া আমার ফিল্ম এখনও শেষ হয়নি।
আপনার পাশে আর এক ভদ্রলোক, খুব নামী ফটোগ্রাফার বসেছিলেন।
কে বলেছে নামী ফটোগ্রাফার? লোকটা ক্যামেরার সি বোঝে না। ওর উচিত হটশটে ছবি তোলা। অ্যাপারচার লেন্স সম্পর্কে কোনও আইডিয়াই নেই।
তাই নাকি?
ইয়েস। আমি একটু কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। রণতুঙ্গা বলল, ভদ্রলোক ব্যবসাপত্তর। করেন। কলকাতায় তো ছবিই তোলেন না।
বাঙালি?
হতে পারে। ড্রিমল্যান্ড না কি একটা হোটেলে উঠেছে।
নামটা কী?
জিজ্ঞাসা করিনি। ওরকম নির্বোধ ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। রণতুঙ্গার হঠাৎ খেয়াল হল, আমার কথা আপনাকে কে বলল?
আপনাদের বাসে এক বিদেশিনী মহিলা ছিলেন। তাঁর নাম লিসা। উনি বলছিলেন আপনার ক্যামেরা সেন্স খুব ভালো।
বলছিল? অথচ আমি যখন কথা বলতে গেলাম তখন খেঁকিয়ে উঠল। গাল চুলকাল রণতুঙ্গা, শুনুন মশাই, আপনি কি পুলিশের লোক?
না। আমি একজন সাংবাদিক।
তা হলে খুব ভালোই হল। আমি যে ছবি তুলেছি, মানে আমার কাছে যে ওই ঘটনার ছবি আছে তা ভুলে যান। আমি জানি পুলিশ খবর পেলেই ফিল্মটা নিয়ে যাবে। আমিও ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে যাব। আমার আজ সকালেই চলে যাওয়া উচিত ছিল। কাল ফিরে আসার সময় আমরা আলোচনা করেছিলাম পুলিশ জানতে পারলে এই ছবির জন্যে আমরা বিপদে পড়ব। আপনাকে বলছি, এই ছবি আমাদের পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাই আমি।
প্রদীপ হাসল, আমাদের দেশের পুলিশের মাথা ঘামানোর মতো বিষয় অনেক আছে, এটা একধরনের মানুষের কাছে খুব মূল্যবান হলেও আমাদের পুলিশ এ নিয়ে চিন্তিত হবে না।
সে কি? রণতুঙ্গা অবাক হয়ে বলল।
হ্যাঁ। আমি আপনাকে একটা অফার করছি। ছবিগুলোর জন্যে শ-পাঁচেক দিতে পারি।
অসম্ভব।
প্রদীপের খুব ইচ্ছে করছিল এই সময় পিস্তলটা বের করতে। লোকটার গোল মুখের ওপর ওটা উঁচিয়ে ধরলে ফিল্ম না দিয়ে পার পাবে না। কিন্তু পরে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারে। সে বাইকে চেপে এসেছে। হোটেল থেকে পুলিশে খবর দিলে ওঁরা তাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। অতএব তাড়াহুড়ো নয়। ধীরস্থির হয়ে কাজটা করতে হবে।
প্রদীপ হাসল। ঠিক আছে। তা হলে একটা সাহায্য করুন। আপনাদের বাসে তৃতীয় একজন ক্যামেরাম্যান ছিলেন। তার কথা মনে আছে?
হ্যাঁ। লম্বা। খুব স্বাস্থ্য ভালো। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। নাম জানি না।
কোন হোটেলে উঠেছেন?
তাও জানি না। তবে লোকটা আজকেও একবার ওই স্পটে যাবে বলেছিল। বাইরে বেরিয়ে এল প্রদীপ। তারপর পাবলিক বুথ থেকে ফোন করে রণতুঙ্গার কথা জানিয়ে দিল। এখন কেউ ফোন ধরেনি। আনসারিং মেশিন জানাল তিনি বাড়িতে নেই। প্রদীপ ঘটনাটা বলে আশ্বস্ত করল। পরে আর-একবার চেষ্টা করবে ছবি পেতে।
ড্রিমল্যান্ডে ফিরে প্রদীপ দেখল লিটন রিসেপশনের সামনে মুখ কালো করে বসে আছে। তাকে দেখে উঠে এল। তুমি গুরু অবাক করলে!
কেন?
হোটেলে এসে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করতে বলল বেরিয়েছে। ঘরে যেতে চাইলাম কিন্তু ওরা চাবি দিল না। তুমি বলে যাওনি?
সরি লিটন, একদম খেয়াল ছিল না। খারাপ লাগছিল প্রদীপের।
কিন্তু তোমার ঘরে নাকি একজন মহিলা আছে?
মহিলা?
তোমার সঙ্গে একই বাইকে এসেছে। তুমি মাইরি দার্জিলিং থেকে একা রওনা হলে, পথে আবার মহিলা জোটালে কোত্থেকে?
জোটাইনি, নিজেই জুটে গিয়েছিল, কিন্তু এখন সে চলে গেছে। প্রদীপ রিসেপশনে গেল। এক্সকিউজ মি, এক বাঙালি ভদ্রলোক, কলকাতায় থাকেন, ব্যবসা করেন, কোন রুমে আছেন বলুন তো?
বাঙালি কোনও ভদ্রলোক তো এখন হোটেলে নেই স্যার।
গতকাল ছিলেন?
গতকাল? না স্যার।
কলকাতার কোন বিজনেস ম্যান?
হ্যাঁ। এস. কে. শর্মা। উনি একটু আগে শিলিগুড়ি চলে গিয়েছেন।
শিলিগুড়ি?
হ্যাঁ। আজ সন্ধেবেলার দার্জিলিং মেলে ওঁর ফার্স্টক্লাসে রিজার্ভেশন করা আছে।
প্ৰদীপ অসহায়ের মতো তাকাল। লোকটা হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন চেষ্টা করলে সে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে গিয়ে লোকটাকে ধরতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে গ্যাংটক ছেড়ে সে যায় কী করে? লিটনকে পাঠানো যায়। সে দূরে বসা লিটনের দিকে তাকাল। লিটন ইতিমধ্যে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছে। না, ওকে একা পাঠালে কাজ হাসিল না করতে পারলে গায়ের জোর দেখিয়ে ফেলতে পারে। তার চেয়ে দার্জিলিং-এ ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেই হয়। সে রিসেপশনিস্টকে বলল দার্জিলিং-এ একটা টেলিফোন করবে।
.
রিসিভার তুললেন তিনিই, হ্যালো।
স্যার, আমি প্রদীপ বলছি।
নতুন কোনও খবর?
হ্যাঁ স্যার। দ্বিতীয় ফটোগ্রাফারকে খুঁজে পেয়েছি।
সো নাইস অফ ইউ। থাপা আমাকে ঠিক লোক দিয়েছে। ওর নাম?
এস কে শর্মা। কলকাতায় বাড়ি, বিজনেসম্যান। এখন গ্যাংটকে নেই।
কোথায় গিয়েছে?
আজই শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গিয়েছে।
কোনও ঠিকানা?
নো স্যার। ঠিকানা নেই। কলকাতার ঠিকানা জোগাড় করতে পারি কিন্তু উনি দার্জিলিং মেলের ফার্স্টক্লাসের প্যাসেঞ্জার। আজকের ট্রেন।
গুড। তোমাকে আর শর্মাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। এবার তিন নম্বর ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো। লাইনটা ডেড হয়ে গেল।
লিটনকে নিয়ে ঘরে এল প্রদীপ। চাবি খুলে খাটে গড়িয়ে পড়ল সে। অত তাড়াতাড়ি যে কাজ উদ্ধার হবে তা কে ভেবেছিল। দুজনের সম্পর্কে তার দায়িত্ব অনেকটা শেষ। শুধু রণতুঙ্গার কাছ থেকে ফিল্মের রোলটা উদ্ধার করতে হবে। তিন নম্বর লোকটি এক্স মিলিটারি ম্যান। সহজ হবে না ব্যাপারটা। লোকটা আজও ওই স্পটে গিয়েছে। চান্স পেয়ে আরও কিছু ছবি তোলার ধান্দা নিশ্চয়ই। যেন ছেলের হাতের মোয়া। লিটনকে বাথরুমে ঢুকে যেতে দেখল সে। এবং তখনই দরজায় শব্দ হল।
প্রদীপ বলল, কাম ইন।
দরজা খুলল সুজাতা। প্রদীপ উঠে বসল, কী ব্যাপার?
সুজাতার অবস্থা বেশ উদভ্রান্ত। বোঝাই যাচ্ছে সারারাতের কষ্টকর বাইক-যাত্রার পর সে একটুও বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। সুজাতা দুর্বল গলায় বলল, আমি আসতে পারি?
নিশ্চয়ই। প্রদীপ খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।
ঘরে ঢুকল সুজাতা। তারপর এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।
কী হয়েছে? পিসির দেখা পেয়েছ?
না। পিসি শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছে। বাড়ি তালা বন্ধ।
ও। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর স্বামীর সঙ্গে গোলমাল, আমাকে থাকতে দিতে ভরসা পেল না। আমি এখন কী করি? কোথায় যাই। আমার সঙ্গে টাকাকড়িও নেই। দুহাতে মুখ ঢাকল সুজাতা। ওর শরীর কাঁপছিল।
বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকল প্রদীপ। লোকটা এলে তিনটে গরম চা আর স্যান্ডউইচ আনতে বলল। তারপর সুজাতার দিকে তাকাল, আর যেখানেই যাও নিশ্চয়ই দার্জিলিং-এ যাবে না।
সুজাতা মুখ তুলে তাকাল, কিছু বলল না। কিন্তু ওর দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে প্রদীপের মায়া হল। হঠাৎই মেয়েটার অসহায়ত্ব বড় হয়ে দেখা দিল তার কাছে।
সে হুকুম করল, উঠে দাঁড়াও।
চোখের দৃষ্টি পালটাল সুজাতার। তাতে প্রশ্ন।
এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে দ্বিতীয় খাটের কাছে নিয়ে এল প্রদীপ। সেখানে বসিয়ে দিয়ে বলল, শুয়ে পড়ো। টেক রেস্ট। খাবার এলে উঠে খেয়ে নিও। তুমি ঘুমাও যতক্ষণ ইচ্ছে। না, যা বলছি তাই করো। আমি রেগে গেলে খুব খারাপ লোক হয়ে যাই।
সুজাতার চোখে এবার স্বস্তি এল। ধীরে-ধীরে সে বিছানায় শুয়ে পড়তেই প্রদীপ তার শরীরের ওপর কম্বল টেনে দিল। দার্জিলিং-এর সন্ধেবেলায় যখন ও মতিলালের বাড়িতে এসেছিল তখন সামান্যই শীতবস্ত্র পরেছিল। তাড়াহুড়োতে পালিয়ে আসার সময় তার কিছুটা মতিলালের শোয়ার ঘরে ফেলে আসায় এখন অবস্থা বেশ কাহিল। ফলে কম্বলের আরাম এবং অনেকক্ষণ বাদে শোওয়ার আরাম পেয়ে সুজাতার চোখ জুড়ে এল। ব্যাপারটা লক্ষ করে প্রদীপ কম্বলটাকে আর-একটু টেনে দিতেই বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল লিটন, গুরু আমি শালা কানে বেশি শুনছি।
তাই নাকি? প্রদীপ নির্লিপ্ত গলায় বলল।
সত্যি বলছি। আমার মনে হচ্ছিল এই ঘরে মেয়ে কথা বলছে। যাক গে, আমি এখন পুরো ফিট। এখন হুকুম করো কী করতে হবে!
গ্যাংটক শহরটায় ঘুরে বেড়াও, আর কী করবে!
রেগেমেগে কিছু বলতে গিয়ে বিছানার দিকে নজর যেতেই হকচকিয়ে গেল লিটন। কম্বলে মোড়া থাকায় শরীরের কোনও অংশ সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু অনুমান করতে অসুবিধে হচ্ছিল না। প্রদীপের দিকে তাকিয়ে সে নিঃশব্দে জানতে চাইল কে শুয়ে আছে? প্রদীপ বলল, যার কথা জিজ্ঞাসা করছিলি সে। বেচারা কাল সারারাত ঘুমায়নি, সকাল থেকে রাস্তায় ঘুরেছে, খুব টায়ার্ড!
টায়ার্ড? লিটন চোখ ছোট করল।
তাই তো মনে হল।
ও কি এই ঘরে থাকবে?
ঠিক করেনি এখনও।
মেয়েছেলে এই ঘরে থাকলে আমি এখানে থাকব না।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
তার মানে?
ঘরে দুটো খাট আছে। তৃতীয়জনের শোওয়ার ব্যবস্থা তো নেই।
উঃ। তাই বলে তুমি একটা উটকো মেয়েকে এই ঘরে শুতে দেবে?
মেয়েটা যাকে বলে উটকো তা নয়, কিন্তু আমি তোকে বলেছি এখনও ভাবিনি কী করব!
এই সময় বেয়ারা চা এবং স্যান্ডউইচ নিয়ে এল। লোকটা চলে যাওয়ার পর প্রদীপ দ্বিতীয় বিছানার দিকে ঝুঁকে ডাকল, শুনছ? এই। চটপট চা খেয়ে নাও। শরীর ভালো লাগবে!
সুজাতা কম্বল সরাল। বোঝা গেল সে একটুও ঘুমায়নি।
লিটনের চোখ বিস্ফারিত।
আরে! একে তো আমি দেখেছি! কোথায় যেন দেখেছি!
মাথায় হাত দিল সে।
প্রদীপ হাসল, কাল রাত্রে মতিলালের বাড়িতে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, পিস্তল আনতে গিয়ে পুলিশের ভয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল? ওরেব্বাস, তখন থাপার মুখটা একরকম হয়ে গিয়েছিল। অ্যাই, তোমাকে পেলে থাপা চিবিয়ে খেয়ে নেবে। এ জীবনে দার্জিলিং-এ যেও না। তারপর প্রদীপের দিকে তাকাল লিটন, ও তোমার সঙ্গে মোটরবাইকে এতটা পথ এসেছে?
হ্যাঁ। তুই চলে যাওয়ার পর ওর দেখা পেয়েছিলাম।
এলেম আছে। আরে হাঁ করে দেখছ কী, খেয়ে নাও। স্যান্ডউইচের প্লেট এগিয়ে দিল লিটন, পেটে কিছু পড়লে তবেই ঘুম আসবে।
সুজাতা কথা না বলে খাবার এবং চা খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। ওরা ধীরেসুস্থে চা খেয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। লিটন বলল, মেয়েটাকে নিয়ে এখন কী করবে গুরু?
একটা লোকের কাছে তোকে যেতে হবে। লোকটা গতকাল ওর ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছে। মনে হয় ফিল্মটা এখনও ক্যামেরার মধ্যেই আছে। লোকটা উঠেছে হলিডে হোটেলে। সারাদিন ঘরে বসে থাকার লোক ও নয়। যদি ক্যামেরা নিয়ে বের হয় তাহলে ওকে ফলো করে সুবিধেমতন ক্যামেরা ছিনিয়ে নিবি। যদি ঘরে ক্যামেরা রেখে বের হয় তাহলে ওটাকে হাতিয়ে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কেউ যেন টের না পায়। লিটনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কথাগুলো বলল প্রদীপ। লিটন হাত নাড়ল, কিন্তু এই মেয়েটা কোথায় থাকবে?
আমি তোকে এতক্ষণ যা বললাম তা কানে ঢোকেনি?
ঢুকেছে। লোকটার নাম কী?
রণতুঙ্গা। প্রদীপ বলল, লোকটা প্রচণ্ড মোটা। কিন্তু মারপিট করার দরকার নেই। লোকটা যদি পুলিশের কাছে যায় তাহলে যেন তোর নামে কমপ্লেন করার সুযোগ না পায়।
বুঝলাম। ছবিগুলো খুব দামি?
না হলে আমি গ্যাংটকে আসতাম না।
হলিডে হোটেলটা কোথায়?
এখান থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তাটা ধরে মিনিট পাঁচেক এগোলেই দেখতে পাবি। বড় হোটেল। সাবধানে কাজ করতে হবে।
ঠিক হ্যায়।
কোনও প্রমাণ না রেখে ক্যামেরা নিয়ে চলে আসতে হবে। লিটন হাসল, কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু আমি থাকব কোথায়?
থাকতে হবে কি না এখনই বলতে পারছি না। কাজ হয়ে গেলে আজই দার্জিলিং-এ ফিরে যাব। না যেতে পারলে ঘর নেওয়া যাবে।
আমরা দার্জিলিং-এ ফিরে গেলে মেয়েটা কোথায় যাবে?
সেটা আমাদের দুজনের চিন্তার বিষয় নয়।
তুমি কি হোটেলে থাকছ?
না। আমি যেখানেই যাই ঠিক তিনটের সময় হোটেলে ফিরে আসব।