হাউইয়ে আগুন ধরিলে
হাউইয়ে আগুন ধরিলে সে যেমন আত্মহারা উন্মত্ত গতিতে ছুটিয়া চলে, ইন্দ্র রায়ও ইহার পর তেমনি দুরন্ত গতিতে ধাবমান হইলেন। রাধারাণীর নিরুদ্দেশের ফলে যে অপমান বারুদের মত সর্বনাশা ক্ষোভ লইয়া বুকের মধ্যে পুঞ্জীভূত হইয়াছিল, সে অপমানের বারুদস্তূপকে ভস্মীভূত করিয়া ইন্দ্র রায়ের বংশকে অগ্নিশুদ্ধ করিয়া লইবার উপযুক্তমত নিষ্কলুষ অগ্নিকণা দিতে পারিত একমাত্র চক্রবর্তী-বংশই, সেই পরম বাঞ্ছিত অগ্নিকশার সংস্পর্শ পাইয়া ইন্দ্র রায়ের এমনি ভাবে অপূর্ব আনন্দে বহ্নিমান হইয়া দশ দিক প্রতিভাত করিয়া তোলাই স্বাভাবিক। সংসারে স্বভাবধর্মের বিপরীত কিছু কদাচিৎ ঘটিয়া থাকে, ইন্দ্র রায় স্বভাবধর্মের আবেগেই ছুটিয়াছিলেন। অগ্রহায়ণের আর ছয়টা দিন মাত্র অবশিষ্ট ছিল, ইহারই মধ্যে তিনি পাত্র-কন্যা আশীর্বাদ অনুষ্ঠান শেষ করিয়া ফেলিলেন। সুনীতির নাম দিয়া অহীন্দ্রকে টেলিগ্রাম করা হইল, ইন্দ্র রায় নিজে টেলিগ্রাম করিলেন অমলকে, অবিলম্বে উমাকে সঙ্গে লইয়া চলিয়া এস।
সেই দিনই গভীর রাত্রে অহীন্দ্র এবং উমাকে সঙ্গে করিয়া অমল আসিয়া উপস্থিত হইল। দুই বাড়িই প্রতীক্ষামান হইয়া ছিল, অহীন্দ্র ডাকিবামাত্র মানদা ছুটিয়া গিয়া দরজা খুলিয়া দিয়া হাসিমুখে বলিল, দাদাবাবু!
অহীন্দ্র উৎকণ্ঠিত হইয়া প্রশ্ন করিল, বাবা কেমন আছেন মানদা?
ভাল আছেন গো দাদাবাবু, সবই ভাল আছে। মানদার মুখে কৌতুক-সরস হাসি ঝলমল করিতেছিল।
তবে? এমনভাবে টেলিগ্রাম কেন করলে মানদা?
আপনার বিয়ে গো দাদাবাবু, উ-বাড়ির উমাদিদির সঙ্গে।
অহীন্দ্রের সর্বাঙ্গে একটা অদ্ভুত শিহরণ বহিয়া গেল, বুকের ভিতরটা এক অপূর্ব অনুভূতিতে চঞ্চল অস্থির হইয়া উঠিল। মুহূর্তে অনুভব করিল, উমাকে সে ভালবাসে–হ্যাঁ, সত্যিই সে ভালবাসে।
ঠিক এই সময়েই সুনীতি আসিয়া দাঁড়াইলেন, অতি মিষ্ট মৃদু হাসি হাসিয়া বলিলেন, আয়, বাড়ির ভেতরে আয়, আমরা জেগেই বসে আছি তোর জন্যে।
মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া অহীন্দ্রের মনে পড়িয়া গেল দাদাকে; সুনীতির সুন্দর মুখখানির উপর তাঁহার জীবনের মর্মন্তুদ দুর্ভাগ্যগুলি কেমন একটি পরিস্ফুট বেদনার্ত সকরুণ ভঙ্গির ছাপ রাখিয়া গিয়াছে। সুনীতির মুখে বর্তমানের দীপ্ত আনন্দের উজ্জ্বলতা জ্বলজ্বল করিলেও তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেই অতীত দুঃখের স্মৃতিগুলি মুহূর্তে জাগিয়া উঠে। বেদনার আবেগে অহীন্দ্রের বুক ভরিয়া উঠিল, সে কাতর স্বরে বলিয়া উঠিল, ছি ছি, এ করেছ কি মা? না না না, এ যে হয় না, হতে পারে না।
সুনীতি আশঙ্কায় চকিত হইয়া উঠিলেন, শঙ্কাতুর কণ্ঠে বলিলেন, কেন হয় না অহি? আমরা যে কথা দিয়েছি বাবা।
অহীন্দ্রের চোখ হইতে জল ঝরিয়া পড়িল, সে বলিল, দাদার কথা কি ভুলে গেলে মা?
সুনীতির মুখে একটা সকরুণ হাসি ফুটিয়া উঠিল, গাঢ় শীতের জোৎস্নার মত সে-হাসি- তীক্ষ্ণ কাতর স্পর্শময়ী অথচ উজ্জ্বল রূপ সে-হাসির, অহীন্দ্রের মাথাটি গভীর স্নেহে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, তবু তোকে বিয়ে করতে হবে, উপায় নেই। এ তোর বাপ-মায়ের আজ্ঞাপালন; কোন অপরাধ তোকে স্পর্শ করবে না বাবা।
অহীন্দ্র মুখে কোন প্রশ্ন করিল না, কিন্তু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সুনীতি বলিলেন, ঘরে আয়।
বাড়ির ভিতর উপরে অহীন্দ্রের ঘরে বসিয়া সুনীতি সমস্ত বুঝাইয়া বলিয়া বলিলেন, তোর বড় মা আমার দিদি, আমি স্থির জানি অহীন, তিনি বেঁচে নেই। কোন দুরন্ত অভিমানে তিনি আত্মহত্যা পর্যন্ত গোপন করেছেন, যার আঘাতে তোর বাপ এমন করে পাগল হয়ে গেছেন অহি। কিন্তু কলুষের কালি এ ওর মুখে মাখিয়ে, মানুষ ভগবানের পৃথিবীকে করে তুলছে সঙ-সার। সেখানে মানুষ তো রেয়াত কাউকে করে না, তারা তাঁর স্মৃতির ওপর কালি বুলিয়ে দিয়েছে বাবা। এ কালি তোমাকে আর উমাকেই মুছে তুলতে হবে।
অহীন্দ্র স্তব্ধ হইয়া অভিভূতের মত মায়ের কথা শুনিতেছিল। সুনীতি আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া আবার বলিলেন, সেদিন উমার মা বললেন, তোর বড় মায়ের নাম করে যে, এ বিয়ে না হলে তিনি শান্তি পাচ্ছেন না, তাঁর গতি হচ্ছে না; এত বড় সত্যি কথা আর হয় না।
প্রথমেই পাত্র-আশীর্বাদ শেষ হইল। ইন্দ্র রায় সমারোহ করিয়া অহীন্দ্রকে আশীর্বাদ করিয়া গেলেন। তিনি রায়-বংশের প্রত্যেককে তাঁহার সঙ্গে পাত্র আশীর্বাদ করিতে চক্রবর্তী-বাড়ি যাইবার নিমন্ত্রণ জানাইলেন। চক্রবর্তী-বাড়িতে আহারের আয়োজন হইয়াছিল। ইন্দ্র রায়ের নায়েবের ভাইপো চক্রবর্তী-বাড়ির নূতন নায়েব; ইন্দ্র রায়েরই আদেশ অনুযায়ী সে সমস্ত বন্দোবস্ত করিতেছিল। সেই নায়েবই একদিন যোগেশ মজুমদারকে সুনীতির নাম করিয়া সাদর আহ্বান জানাইয়া আসিল, কর্তাবাবুর অবস্থা তো জানেন, গিন্নীমা বললেন, এ বাড়ির মর্যাদা জানেন এক আপনি, আপনি না গেলে এ-সব কাজ কি করে হবে?
মজুমদার কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপর বলিল, যাব আমি, বলবেন, আমার ক্ষমতায় যা হবে, তার কসুর আমি করব না।
আর ও-বাড়ির রায় মশায়ও একবার দেখা করবার জন্যে বার বার করে বলেছেন।
কে, ছোট রায় মশায়?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি তার ছেলেকেই পাঠাতেন, তা
বাধা দিয়া মজুমদার বলিল, না না না, আমি নিজেই যাব।
মজুমদার আসিতেই সাদর আহ্বান করিয়া রায় বলিলেন, তোমার মনটা সেদিন বড় পবিত্র ছিল যোগেশ, কথাটা মা তারা সত্যি প্রমাণ করে দিলেন। তোমাকে আমি বলেছিলাম, সত্যি হলে তুমি জানবে সর্বাগ্রে, সেটা আমার মনে আছে। এখন তোমাকে কিছু ভার নিতে হচ্ছে ভাই, চক্রবর্তী-বাড়ি তোমার পুরানো বাড়ি। ওখানকার কাজকর্মের ভার তোমাকেই নিতে হবে। আর কন্যা-আশীর্বাদ করতে রামেশ্বর তো আসতে পারছেন না, আশীর্বাদ করবেন ও বাড়ির কুলগুরু, তা সেদিন তুমি আসবে ও-বাড়ির প্রতিনিধি হয়ে।
মজুমদার মুখে কিছু বলিতে পারিল না, কিন্তু রায়ের কথা প্রাণপণে পালন করিবার চেষ্টা করিল এবং অকপট অন্তরেই চেষ্টা করিল।
কলের মালিক বিমলবাবুকে সাদরে আহ্বান করা হইয়াছিল। তিনিও পাত্র আশীর্বাদের আসরে উপস্থিত হইয়াছিলেন। ইন্দ্র রায় অকস্মাৎ একটা কাজ করিয়া বসিলেন; বিমলবাবুকে দেখিবামাত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া কি ভাবিয়া লইলেন, তারপর ব্যস্তভাবে তাঁহার হাতে গোলাপজল-ভরা গোলাপপাশটি ধরাইয়া দিলেন এবং আতরদানবাহী চাকরটাকে তাঁহার সঙ্গে দিয়া বলিলেন, আপনি হলেন চক্রবর্তী-বাড়ির লোক, আমরা আজ আপনাদের কুটুম্ব এসেছি। আপনি আজ আমাদের খাতির করুন, আপনার খাতির করব আমি আমার বাড়িতে।
বিমলবাবু প্রত্যাখ্যান করিলেন না, করিবার যেন উপায় ছিল না।
বাহিরে বিস্তৃত প্রাঙ্গনে সাঁওতালেরা মাদল বাজাইয়া মহা আনন্দে গান গাহিয়া নাচ জুড়িয়া দিয়াছিল। এই উপলক্ষে বাগদীপাড়ার লাঠিয়াল দলের প্রত্যেকে হাত দশেক লম্বা এক গজ চওড়া একফালি করিয়া লাল শালু ও একটি করিয়া ফতুয়া পাইয়াছিল; নতুন ফতুয়া গায়ে লাল পাগড়ি মাথায় তাহারা লাঠি হাতে মোতায়েন ছিল। তাহারা এবং সাঁওতালেরা মদ খাইয়াছে প্রচুর। নবীন বাগদীর স্ত্রী মতি এখন বাগদীদের সর্দারনী, সে নূতন কাপড় পাইয়াছে, গাছকোমর বাঁধিয়া আঁটসাঁট করিয়া কাপড় পরিয়া সে লাঠি হাতে অন্দরের দরজায় মোতায়েন থাকিয়া হাঁক-ডাক জাহির করিতেছে।
আশীর্বাদের অনুষ্ঠানের শেষ হইতেই অহীন্দ্র অমলের সঙ্গে সাঁওতালদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
পরস্পরে কোমরে জড়াইয়া ধরিয়া সাদা ধবধবে কাপড়-পড়া কালো মেয়েগুলি অর্ধচন্দ্রাকারে সারি বাঁধিয়া জলের ঢেউয়ের মত হিল্লোলিত ভঙ্গিতে দুলিয়া দুলিয়া নাচিতেছে, সম্মুখে পুরুষেরা মাদল, নাগরা, বাঁশী ও নিজেদের তৈয়ারি সারঙ্গ বাজাইয়া ঝড়ের দোলায় আন্দোলিত শালের মত দীর্ঘ আন্দোলিত ভঙ্গিতে দীর্ঘ দৃঢ় পদক্ষেপে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিতেছে। মেয়েরা গাহিতেছিল বড় মজার গান, উহাদেরই নিজেদের রচনা করা বাংলা ভাষার গান
রাজা যাবে সোরানে সোরানে (পাকা রাস্তা)
রাণী আসছে ডুলির উপর চেপ্যে,
রাঙাবাবুর বিয়া হবে;
লাল ফুলের মালা কুথা পাব গো
পালতে পেলাশ জবাফুলের মালা গো!
গান শুনিয়া সকৌতুকে অমল হাসিয়া বলিল, বাঃ!
অহীন্দ্র হাসিমুখে দলটির এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রত্যেককে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিল। দেখিয়া মুখের হাসি তাহার মিলাইয়া গেল। কমলকে এবং সারিকে না দেখিয়া তাহার মন সপ্রশ্ন বিস্ময়ে ভরিয়া উঠিল। গানটি শেষ হইতেই মেয়েগুলি কলকল করিয়া অহীন্দ্র ও অমলের দিকে আঙুল দেখাইয়া কলরব জুড়িয়া দিল, কালো মুখের মধ্যে সাদা চোখগুলি উজ্জ্বলতর হইয়া অহীন্দ্রের মুখের উপর অসঙ্কোচে নিবদ্ধ হইল। চূড়া মাঝি মাদলটা গলায় ঝুলাইয়া আসিয়া নত হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল, গড় করছি গো বাবাঠাকুর রাঙাবাবু! প্রণাম করিয়া উঠিয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, আপনার বিয়াতেই গানটি আমি করলম। আমি নিজে। আপনি শুধাও উয়াদিগে।
অমল বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, বাঃ বাঃ, খুব ভাল গান হয়েছে।
চূড়া উৎসাহিত হইয়া বলিল, আমি-বুঝলি বাবু, এই আমি। বুকে হাত দিয়া সে নিজেকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া দেখাইয়া বলিল, আমি মন্তর জানি, ভূত তাড়াতে জানি, গান বানাতে জানি, বুঝলি বাবু, অ্যানেক জানি আমি। তা-তা-কি বুলব আর? বলিয়া সে খানিকটা চিন্তা করিয়া লইয়া বলিল, আমাদিগে আরও হাঁড়িয়া দিতে হবে বাবু, আপনারা যা দিলি, উই মেয়েগুলো সব বেশী খেয়ে লিলে; দেখ কেনে, চুরচুর করছে সব।
মেয়েগুলি এবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। অহীন্দ্র একটু মৃদু হাসিয়া বলিল, আচ্ছা সে হবে। কিন্তু তোদের সর্দার কই? কমল মাঝি? আর সেই তীরন্দাজ শিকারী মাঝি, যে সাপ মারলে, কমলের নাতজামাই, সেই লম্বা মেয়েটির বর। তারা আসে নি কেন সব?
সমস্ত সাঁওতালের দলটি এ প্রশ্নে এক মুহূর্তে নীরব হইয়া গেল। বার বার অকারণে গলা ঝাড়িয়া, চূড়া মাঝি হাতজোড় করিয়া অত্যন্ত বিনয় করিয়া বলিল, আপনাকে আমরা বুলছি বাবাঠাকুর রাঙাবাবু, আপুনি আমাদের রাজা বটে। সি রাঙাঠাকুরের লাতি বট আপুনি। তেমনি আগুনের পারা রং! বাব্বা রে! আপনাকে মিছা বুলতে নাই। হল কি-উয়ারা করলে কি-উয়ারা
অহীন্দ্র ভ্রু কুঁচকাইয়া প্রশ্ন করিল, কি করলে ওরা?
চূড়া হাত তুলিয়া অত্যন্ত বিজ্ঞভাবে বলিল, তাই গো বুলছি বাবু। উয়ারা-পাপ করলে? আমাদের ‘পঞ্চ’ বুললে, তুদের সাথে আমরা খাব না, তুদের সাথে করুন-কাম করব না, বিয়া শাদি দিব না। হুঁ, ভিন করে দিলে উয়াদিগে! ঘেন্না করলে। তাথেই বুড়ার শরম লাগল, ইখানে থাকতে লারলে। চলে গেল, পালিয়ে গেল। লাজের কথা কিনা।
অহীন্দ্র বলিল, তারা করেছিল কি?
অত্যন্ত লজ্জা প্রকাশ করিয়া চূড়া জিভ কাটিয়া বলিল, ছি! উটি লাজের কথা বটে, খারাপ কথা বটে। উ আপনাকে শুনতে নাই। ছি! বাবা রে!
অহীন্দ্র আর প্রশ্ন করিতে পারিল না। কিন্তু ইহাদিগের কথাবার্তাগুলি অমলের বড় ভাল লাগিতেছিল, সে বলিল, তা হলে এখন সর্দার কে? তুমি?
চূড়া পরম বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল, আপনি উয়াদিগে শুধাও, আমি বুলি নাই। উয়ারাই বুললে, আমি অনেক জানি কিনা, আমি লোকটি খুব বিদ্যে জানি। ওস্তাদ বেটে আমি। বোঙার পূজা জানি-মরং বোঙা, মরং বোঙা বুঝছ তো। ভগোবান। উয়ার মন্তর জানি আমি। ভূত তাড়াতে জানি, ওষুধ জানি। অনেক বিদ্যে জানি, হুঁ। তা সোবাই বুললে, আমি বুলি নাই। ছি, লিজে থেকে বুলতে নাই। শরমের কথা, ছি। উয়াদিগে শুধান আপুনি।
অমল হাসিয়া বলিল, ব্যাপারটা একটু জটিল মনে হচ্ছে অহীন। এতখানি বিনয় তো ভাল নয়।
অহীন্দ্র বলিল, হুঁ। পরে জানতে হবে, ব্যাপারটা কি। এখন নাচাগানা করছে করুক।
তাহাদের মৃদু স্বরের কথা ভাল বুঝিতে না পারিলেও চূড়া এটুকু বুঝিয়াছিল যে, কথাটা তাহাদের সম্পর্কেই হইতেছে। সে আবার বিনয় করিয়া বলিল, উই চরাটোতো সিটল-পিন্টি (সেটেলমেন্টের জরিপ) যখন হল, রাঙাবাবু গেল, মোড়লেরা গেল, তখুনি আমি হিসাব করলম, মাপের দাঁড়া ধরলম। আমি সকুলই জানি কিনা। তাথেই আমাকে উয়ারা মোড়ল করলে।
অহীন্দ্র বলিল, বেশ বেশ। এখন তোরা নাচগান কর। তুইও তো খুব ভাল লোক, তুই মোড়ল হয়েছিস, সেও বেশ ভালই হয়েছে।
চূড়া খুশী হইয়া মাদলটা দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া লাফ দিয়া মেয়েদের সম্মুখীন হইয়া মাদলে ঘা দিল ধিতাং-তাং, ধিতাং-তাং। বাঁশী, সারঙ্গ, নাগড়া আবার বাজিতে আরম্ভ করিল। মেয়েরা আবার সারি বাঁধিয়া দাঁড়াইল।
অহীন্দ্র সমস্ত দলটির দিকে চাহিয়া দেখিয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলিয়া পারিল না। সেই সচল পাহাড়ের মত কমল মাঝি, বাবরি চুলওয়ালা সেই শিকারী বংশীবাদক তরুণটি না হইলে পুরুষের দলটি যেন মানায় না, আর মেয়েদের ওই শ্রেণীটির ঠিক মধ্যস্থলে থাকিত দীর্ঘাঙ্গিনী সারী; তাহার মাথাটা ঠিক মধ্যস্থলে সকলের চেয়ে উঁচু হইয়া থাকিত, মুকুটের মাঝখানের কালো পাখীর উজ্জ্বল পালকের মত।
পরদিন সন্ধ্যাতেই উমাকে আশীর্বাদ করিয়া আসিলেন চক্রবর্তী বাড়ির কুলগুরু। ইন্দ্র রায় সমারোহ করিলেন প্রচুর; রায়-বংশের সকলকেই নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইলেন। অনুষ্ঠানের শেষে তিনি যোগেশ মজুমদারকে ডাকিয়া একখানি দামী ধুতি ও গরদের চাদর হাতে দিয়া বলিলেন, তুমি আজ আমার বেয়াইয়ের তুল্য মাননীয় ব্যক্তি, কর্মচারী হলেও রামেশ্বর তোমাকে ভাইয়ের মতই স্নেহ করেন, অহীন্দ্র তোমাকে বলে– কাকা। বেয়াই-বাড়ির এ সম্মান তোমার প্রাপ্য।
বিমলবাবু আজ আর আসেন নাই। শরীর খারাপ বলিয়া সবিনয়ে মার্জনা ভিক্ষা করিয়া পাঠাইলেন। ইন্দ্র রায় তাঁহাকে গোলাপপাশ বহন করাইয়াই ক্ষান্ত হন নাই, সামাজিক ভোজনে পংক্তির মধ্যেও পর্যন্ত বসিতে দেন নাই। তাঁহাকে স্বতন্ত্রভাবে খাইতে দেওয়া হইয়াছিল। রায় চেয়ার-টেবিলের বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। হাসিয়া টেবিলের উপর একটি বিলাতী মদের বোতল নামাইয়া দিয়া বলিয়াছিলেন, আপনার জন্যেও হাঁড়িয়ার বন্দোবস্ত আমরা রেখেছি।
সাঁওতালি ভাষায় মদের নাম হাঁড়িয়া।
পরদিন অপরাহ্নে হেমাঙ্গিনী উমাকে লইয়া রামেশ্বরের সহিত দেখা করিতে আসিলেন। রামেশ্বরকে প্রণাম করাইবার জন্যই উমাকে লইয়া আসিলেন। উমা রামেশ্বরকে প্রণাম করিয়া সলজ্জভাবে সঙ্কুচিত হইয়া বসিল।
রামেশ্বর সস্নেহে হাসিয়া বলিলেন, প্রথমে যেদিন মাকে আমার দেখেছিলাম, সেদিন কুমার সম্ভবের উমার বাল্যরূপের বর্ণনা মনে পড়েছিল; আজ মনে পড়ছে উমার ভাবী বধূরূপ। মহা কবি কালিদাস, তিনি বলেছেন
সা সম্ভবদ্ভিঃ কুসুমৈর্লতেব জ্যোতির্ভিরুদ্যদ্ভিরিব ত্রিযামা।
সরিদ্বিহঙ্গৈরিব লীয়মানৈ রামুচ্যমানাভরণা চকাশে।।
অর্থাৎ উমা অলঙ্কার পরিধান করলে কেমন শোভা হল, না-কুসুমিতা লতার মত, জ্যোতির্লোক উদ্ভাসিত রাত্রির মত, আশ্রয়ার্থী হংস- বলাকাশোভিত নদীর মত। তা হ্যাঁ মা উমা, তুমি আমার মা হতে পারবে তো? দেখছ তো আমি ব্যাধিগ্রস্থ, আমার পুত্রবধূ হতে তোমার কোন দ্বিধা নেই তো?
উমা মুখে কিছু বলিতে পারিল না, কেবল গভীর বেদনায় কাতর দৃষ্টিভরা চোখে রামেশ্বরের মুখের দিকে চাহিল; কিন্তু সেও মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই লজ্জিত হইয়া দৃষ্টি নত করিল। হেমাঙ্গিনী কাতরভাবে বলিলেন, কেন আপনি বার বার ও-কথা বলেন চক্রবর্তী মশায়? কোথায় আপনার ব্যাধি? এই সেদিনও তো আপনার রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে, তারা তো বলেছে, আপনার কোন ব্যাধি নেই। ও আপনার মনের ভ্রম।
রামেশ্বর বলিলেন, রায়-গিন্নী, ভগবানের শাস্তি, মৃত্যু, ব্যাধি এগুলোর নির্ণয় হয় না, চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও জ্ঞানের বাইরে এগুলো। কিন্তু ও তর্ক থাক। মা আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আমি ধন্য হয়েছি রায়-গিন্নী। হ্যাঁ, আর একটা কথা। মা উমা, আমি দরিদ্র, লক্ষ্মী আমাকে পরিত্যাগ করেছেন। আর তার জন্যে আমার দুঃখ নেই। জান মা, দারিদ্রকে প্রণাম করে আমি বলি
দারিদ্র্যায় নমস্তুভ্যং সিদ্ধোহহং তৎপ্রসাদতঃ!
জগৎ পশ্যামি যেনাহং ন মাং পশ্যন্তি কেচন।
বলি হে দারিদ্র্য, তোমাকে নমস্কার, তোমার প্রসাদে আমি সিদ্ধ হয়েছি, যেহেতু কেউ আমার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে না, আমি জগৎকে দেখি, আমি দ্রষ্টা হতে পেরেছি। তবে মা, তোমার আগমনে লক্ষ্মীকে আবার ফিরতে হবে, তবু কথাটা তুমি জেনে রাখ।
উমা এবার চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না, সে একে সপ্রতিভ মেয়ে, তার উপর কলিকাতার স্কুলে পড়াশুনা করিয়াছে এবং রামেশ্বর তাহার অপরিচিত তো নন-ই, বরং কাব্যালাপের মধ্য দিয়া একটি হৃদ্য আত্মীয়তার স্মৃতিই তাহার মনে জাগরূপ ছিল। সে মৃদুস্বরে বলিল, কবিতাটি ভারী সুন্দর!
হেমাঙ্গিনী হাসিয়া বলিলেন, নিন, এবার বেটার বউকে সংস্কৃত শেখান।
পরম উৎসাহে রামেশ্বরের চোখ দুইটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, বলিলেন, নিশ্চয় শেখাব। মা আমাকে পড়ে শোনাবেন, আমি শুনব। জান মা, তোমার সেই বাঙালী কবি, রবীন্দ্রনাথের বই আমাকে অহীন্দ্র এনে দিয়েছে, কিন্তু চোখের জন্য পড়তে পারি না; তুমি আমায় শোনাবে মা? ওই দেখ, আন তো মা, তোমার কণ্ঠে কবির কাব্য সুর লাভ করে সঙ্গীত হয়ে উঠবে। শোনাও তো মা আমাকে কিছু। বহুদিন কিছু শুনিনি।
উমা দেখিল, সে আমলের পুরানো টেবিলের উপর একখানি ‘চয়নিকা’ সযত্নে রাখা রহিয়াছে; সে বইখানি আনিয়া বসিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, আমি নীচে সুনীতির কাছে যাচ্ছি চক্রবর্তী মশায়, আপনারা শ্বশুর-পুত্রবধূতে মিলে কাব্য করুন বসে বসে।
হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলেন। রামেশ্বর বলিলেন, পড় তো মা, মৃত্যু সম্বন্ধে তোমাদের কবির কোন কবিতা যদি থাকে, তবে তাই পড়ে আমাকে শোনাও।
উমা বাছিয়া বাছিয়া বাহির করিল—
অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
প্রথমে লজ্জায় সঙ্কোচে ঈষৎ মৃদু সুরেই উমা আরম্ভ করিল, কিন্তু পড়িতে পড়িতে কাব্যের প্রভাবে অভিভূত হইয়া স্থানকালকে অতিক্রম করিয়া সে স্বচ্ছন্দ হইয়া উঠিল, কণ্ঠস্বরে সঙ্কোচের জড়তা রহিল না, আবেগপূর্ণ অকুণ্ঠিত কণ্ঠে ছন্দে ছন্দে তালে তালে সঙ্গীতের মাধূর্য্য ফুটাইয়া তুলিয়া আবৃত্তি করিয়া চলিল–
তব পিঙ্গল ছবি মহাজট
সে কি চূড়া করি বাঁধা হবে না।
তব বিজয়োদ্ধত ধ্বজপট
সে কি আগে-পিছে কেহ ববে না!
তব মশাল-আলোকে নদীতট
আঁখি মেলিবে না রাঙাবরন
ত্রাসে কেঁপে উঠিবে না ধরাতল,
ওগো মরণ, হে মোর মরণ?
বিস্ফারিত চক্ষে রামেশ্বর স্তব্ধ হইয়া শুনিতেছিলেন, আবেগে নাকের প্রান্তভাগ বার বার ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছিল। কবিতা শেষ হইয়া গেল, উমা নীরব হইল। কিন্তু সমস্ত ঘরখানা তখনও যেন আবৃত্তির ঝঙ্কারে পরিপূর্ণ বলিয়া বোধ হইতেছিল। অকস্মাৎ রামেশ্বর বলিলেন, ওখানটা আর একবার পড় তো মা, ওই যে- তবে শঙ্গে তোমার তুলো নাদ, তারপর কি মা?
উমা পড়িয়া বলিল–
তবে শঙ্খে তোমার তুলো নাদ
করি প্রলয়শ্বাস ভরণ,
সঙ্গে সঙ্গে রামেশ্বর আবৃত্তি করিলেন—
তবে শঙ্খে তোমার তুলো নাদ
করি প্রলয়শ্বাস ভরণ,
আমি ছুটিয়া আসিব ওগো নাথ,
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
ইহার পর রামেশ্বর যেন কাব্যের মোহে স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, উমার উপস্থিতি পর্যন্ত ভুলিয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর হাত দুইটি তুলিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে আরম্ভ করিলেন। মৃদুস্বরে বলিলেন, তোমার শঙ্খনাদ আমি শুনতে পাচ্ছি, প্রলয়শ্বাসের ঢেউ আমার অঙ্গে এসে লাগছে। এঃ, একেবারে জীর্ণ করে দিয়েছে আঙুলগুলো!
উমা শঙ্কিত হইয়া উঠিল, সে ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার জন্য সন্তর্পণে উঠিয়া দাঁড়াইল। ঘরের প্রদীপের আলোর তাহার ছায়াখানি দীর্ঘ হইয়া মেঝের উপর চঞ্চল হইয়া জাগিয়া উঠিল।
রামেশ্বর চমকাইয়া উঠিয়া বলিলেন, কে?
উমা শঙ্কিত ও কুণ্ঠিত স্বরে বলিল, আমি।
তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রামেশ্বর যেন স্মরণ করিয়া বলিলেন, ও, মা, আমার মা জননী। তোমাকে আশীর্বাদ করি মা
আখগুলো সমো ভর্তা জয়ন্ত প্রতিমঃ সুতঃ
আশীরণ্যা ন তে যোগ্যা পৌলমী মঙ্গলা ভব।।
উমা আবার তাঁহাকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইয়া সন্তর্পণেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
রামেশ্বরের ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্দরমহলের দিকে টানাবারান্দা দিয়া উমা সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হইল। খানদুয়েক ঘর পার হইয়াই সে দেখিল, অহীন্দ্র আপনার ঘরে খোলা জানালার ধারে বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে। এদিকে ওদিকে চাহিয়া উমা মৃদুস্বরে বলিল, গুড-আফটারনুন সায়েব।
অহীন্দ্র চকিত হইয়া হাসিমুখে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল, নমস্কার শ্রীমতী উমা দেবী।
তাহাদের উভয়ের এই সম্বোধনের একটু ইতিহাস আছে।
কয়েক বৎসর পূর্বে এই চক্রবর্তী-বাড়িতেই বালিকা উমা একদিন অহীন্দ্রকে বলিয়াছিল, আপনাকে দেখলেই লোকে চিনতে পারবে এ-ই স্কলারশিপ্ পেয়েছে। যে সায়েবদের মত ফরসা রং!
তারপর অহীন্দ্র কলিকাতায় গেলে অমল উমাকে প্রশ্ন করিয়াছিল, কে বল্ দেখি?
উমার স্কুলের তখন বাস দাঁড়াইয়া, সে দীর্ঘ বেণীটি দোলাইয়া বলিয়াছিল, সায়েব। পরক্ষণেই খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিল, জিজ্ঞেস করনা সায়েবকে, রায়হাটে ওঁদের বাড়িতেই ওঁর নাম দিয়েছি সায়েব। গুড মর্নিং সায়েব।
অহীন্দ্র হাসিয়া বলিয়াছিল, নমস্কার শ্রীমতি উমা দেবী। আমি কিন্তু তোমাকে বাঙালিনীই দেখতে চাই।
উমা মাথাটি ঈষৎ নত করিয়া বলিয়াছিল, বাঙালী কালো মেয়ের স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছে, অতএব বলিয়াই বেণী দোলাইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল।
আজ উমা বলিল, এমন ধ্যানমগ্নের মত বসে যে?
অহীন্দ্রের জানলা হইতে চরটা স্পষ্ট দেখা যায়, সে চরটার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল, চরটাকে দেখছি। ইন্দ্রজালের মত ময়দানবের পুরী গড়ে উঠল। এই এবার পুজোর সময়েও দেখেছি, সবুজ ঘাসে ঢালা শান্ত এক টুকরো ভূখণ্ড, মধ্যে ছোট্ট একটা সাঁওতালপল্লী। একেবারে এক প্রান্তে কটা ইঁটের ভাটি।
উমা বলিল, চরটা তো তোমাদের?
অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ, তোমাদের?
উমার মুখ লাল হইয়া উঠিল, লজ্জায় এবার আর সে জবাব দিতে পারিল না। অহীন্দ্র বলিল, জান, ওই চরের ওপর আমার এক দল পূজারিণী আছে। তারা আমাকে দেখে লজ্জায় রাঙা হয় না, অসঙ্কোচ আনন্দে একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে।
উমা বলিল, জানি, একটি মেয়ে আজ আমাকে দেখতে এসেছিল। আমাকে বললে- রাঙাঠাকরুণ। বললে, বাবুকে বলি রাঙাবাবু, তোমাকে বলব-রাঙাঠাকরুন।
অহীন্দ্র একটু উচ্ছ্বসিত হইয়াই বলিল- চমৎকার নাম দিয়েছে।
উমা বলিল, তার নিজের নামটিও বেশ-সারী, সারী।
সবিস্ময়ে ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া অহীন্দ্র বলিল, সারী? খুব লম্বামত মেয়েটি?
হ্যাঁ। একটু বেশী লম্বা। কিন্তু আর নয়, চললাম। মা-রা হয়তো এক্ষুনি ওপরে চলে আসবেন। পালাচ্ছি আমি। সে আর উত্তরের অপেক্ষা করিল না, ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল।
কয়েক মিনিট পরেই অহীন্দ্র নীচে নামিয়া আসিয়া এদিক ওদিক চাহিয়া মানদাকে ডাকিয়া বলিল, আমি চরের দিকে বেড়াতে যাচ্ছি। অমল এলে বলিস, দাদাবাবু আপনাকে যেতে বলে গেছেন।
অহীন্দ্র চলিয়া যাইতেই মানদা উচ্ছ্বসিত হইয়া সুনীতি ও হেমাঙ্গিনীর নিকট আসিয়া বলিল, শাশুড়িকে দেখে দাদাবাবুর লজ্জা হল, আমাকে ডেকে চুপিচুপি—বলিতে বলিতে সে হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল।
.
২৭.
চরের উপর কর্মকোলাহল তখনও স্তব্ধ হয় নাই। শেডটার লৌহকঙ্কাল তৈয়ারী ইহারই মধ্যে শেষ হইয়া গিয়াছে, আজ তাহার উপর কারোগেটেড শীট পিটানো হইতেছে। বোল্টগুলির উপর হাতুড়ির ঘা পড়িতেছে। আকাশমূখী সুদীর্ঘ চিমনিটার আকার এইবার সরু হইতে আরম্ভ করিয়াছে; আজ আবার নূতন মাচান বাঁধা হইতেছে। নীচে কোথাও গাঁথনির কাজে কার্ণিকের শব্দের ধাতব ধ্বনিত হইতেছে। ছাদের উপর অসংখ্য পিটনের আঘাত একসঙ্গে পড়িয়া চলিয়াছে, মেয়েগুলি কিন্তু এখন আর গান গাহিতেছে না, আর বোধ হয় ভাল লাগে না। একটা লরির এঞ্জিন কোথায় দুর্দান্তভাবে গর্জন করিতেছে, বোধ হয় কোন দুরন্ত বাধা ঠেলিয়া চলিতে হইতেছে। মাঝে মাঝে অবরুদ্ধ স্টীমে বয়লারটা থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। এ সমস্তকে একটা ক্ষীণ আচ্ছাদনের মত আবরণে আবৃত করিয়া মানুষের কোলাহল-কলরবের উচচ গুঞ্জনরোল অবিরাম গুঞ্জিত হইয়া চলিয়াছে। অহীন্দ্র নদীর বুকে দাঁড়াইয়া এই অর্ধনির্মিত যন্ত্রপুরীটির দিকে বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিল; সে নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র, বিজ্ঞানকে সে মনে মনে নমস্কার করিল।
নদী হইতে চরের ঘাটে উঠিয়াই সে দেখিল, বেনাঘাসের মধ্যে গরুর গাড়ির চাকার রেখার চিহ্নিত সে কাঁচা পথটি আর নাই; রাঙা কাঁকর বিছানো প্রশস্থ সুগঠিত রাজপথের মত একটি পথ, ঘাটের মুখ হইতে গুণ টানা ধনুকের মত দীর্ঘ ভঙ্গিতে বাঁকিয়া কারখানার দিকে চলিয়া গিয়াছে। কিছুদূর আসিয়া তাহাকে সে-পথ ছাড়িয়া ডান দিকে ফিরিতে হইল, এতক্ষণে সেই কাঁচা পথটির দেখা মিলিল। পথটি চলিয়া গিয়াছে সাঁওতাল পল্লীর দিকে। দুই পাশে সাঁওতালদের চাষের ক্ষেত। ক্ষেতগুলি সমস্তই অকর্ষিত, কোথাও ফসল নাই; সমস্ত ক্ষেত্ৰভূমিটাই একটা ধূসর উদাসীনতায় সদ্য-বিধবার মত বিষণ্ণ, রিক্ত। সে বিস্মিত হইয়া গেল, এ কি! সাঁওতালেরা জমিগুলিকে এমন অযত্নে একেবারে রিক্ত করিয়া ফেলিয়া রাখিয়াছে! গত বৎসরে এই সময়ের ক্ষেত্রের ছবি তাহার মনে পড়িয়া গেল, বিচিত্রবর্ণের ফুলে ফসলে ভরা সে যেন একখানি সবুজ গালিচা। আলুর সতেজ সবুজ গাছে ভরা ক্ষেতগুলির চারিপাশে ফুলে ভরা কুসুমফুলের গাছ, পুস্পিত মটরশুটির লতা-ভরা ক্ষেত; এক চাপ সবুজের মত ছোলা ও মসুরের ক্ষেত, তাহার ভিতর অসংখ্য বেগুনি রঙের কুচি কুচি মসিনার ফুল; সদ্যোগত সবুজ কোমল শীষে ভরা গম ও যবের ক্ষেত। সকলের চেয়ে বাহার দিত সরিষার ক্ষেতগুলি, হলুদ রঙের ফুলগুলি চাপ বাঁধিয়া ফুটিয়া থাকিত গাঢ় সবুজের মাথায় একটি পীতাভ আস্তরনের মত। ক্ষেতের আইলে সাঁওতাল চাষীরা অকারণে ঘুরিয়া বেড়াইত, তাহাদের কালো মুখে সাদা চোখে আনন্দ প্রত্যাশার সে কি বিপুল ব্যগ্রতা! অহীন্দ্রের মনে পড়িয়া গেল সচল পাহাড়ের মত বিপুলদেহ কঠিনপেশী কমল মাঝিকে। শেষ সে তাহাকে দেখিয়াছে বর্ষার সময় জলে-ভরা এই ধানক্ষেতের মধ্যে, কর্দমাক্ত দেহে সে তখন হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া ধানক্ষেতের কাদানো জমি সমান করিয়া দিতেছিল। বন্য বরাহের মত হামা দিয়া এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত নরম মাটি যেন দলিয়া খুঁড়িয়া ফেলিতেছিল। কমল থাকিলে বোধ হয় ক্ষেতের চাষের এমন দুর্দশা হইত না। অহীন্দ্র বেশ বুঝিল, দৈনিক নগদ মজুরির আস্বাদ পাইয়া ইহারা এমন করিয়া চাষ পরিত্যাগ করিয়াছে। কমল বোধ হয় কাছকাছি কোথাও আড্ডা গাড়িয়াছে; নহিলে সারী কেমন করিয়া উমাকে দেখিতে আসিল? উমা তো বলিল, খুব লম্বামত মেয়েটি, নামটি বেশ-সারী। মাঠ পিছনে ফেলিয়া অহীন্দ্র সাঁওতাল-পল্লীর ছায়াঘন প্রান্তসীমায় প্রবেশ করিল। পল্লীটা নীরব নিস্তব্ধ; কেবল গোটাকয়েক কুকুর তাহাকে দেখিয়া তারস্বরে চীৎকার করিয়া পথরোধ করিয়া দাঁড়াইল। অহীন্দ্র শঙ্কিত না হইলেও সতর্ক না হইয়া পারিল না, সে ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। ঠিক সেই মুহূর্তেই নিকটতম বাড়ি হইতে একটি মেয়ে বোধ হয় ঘটনাটা কি দেখিবার জন্য বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল এবং রাঙাবাবুকে দেখিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, রাঙাবাবু!
অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ রে। কিন্তু তোদের কুকুরগুলো যে আমাকে যেতে দেবে না বলছে।
মেয়েটি বেশ একটু ত্রস্ত হইয়া কুকুরগুলোকে তাড়াইয়া দিবার জন্য হাত তুলিয়া অগ্রসর হইয়া বলিল, হড়িচ-হড়িচ! কুকুরগুলো তবু গেল না, মেয়েটির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিয়া লেজ নাড়িতে নাড়িতে চীৎকার আরম্ভ করিল, মেয়েটি এবার অত্যন্ত ক্রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, ই- রে কম্বড়ো সে- তা হড়িচ-হড়িচ! অর্থাৎ, ওরে চোর কুকুর, পালা বলছি, পালা বলছি, পালা। এবার কুকুরগুলো মাথা নীচু করিয়া মৃদু গর্জনে আপত্তি জানাইতে জানাইতে সরিয়া গেল।
অহীন্দ্র অগ্রসর হইয়া বলিল, তোরা সব কেমন আছিস?
মেয়েটি একটু আশ্চর্য বোধ করিয়া বলিল, কেনে, ভাল আছি। সেই যি তুমার বিয়ার ‘ল সম্বন্ধিতে’ (নব সম্বন্ধ উপলক্ষে) নেচ্যা এলম গো! হাঁড়িয়া খেলম, গান করলম।
অহীন্দ্র হাসিয়া ফেলিল, বলিল, তা বটে, নেচে যখন এলি, তখন খারাপ থাকবি কি করে? ঠিক কথা।
মেয়েটি সবিস্ময়ে অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই কথার অর্থ উপলব্ধি করিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিল, হেঁ। লইলে নেচ্যা এলম কি করে?
রাঙাবাবু!
রাঙাবাবু! এ বাবা গো!
হালে–ভালা-রাঙাবাবু গো
হাসির ধ্বনি শুনিতে পাইয়া আশেপাশের বাড়িগুলি হইতে তিনচারটি মেয়ে উঁকি মারিয়া দেখিয়া বিস্ময়ে আনন্দে রাঙাবাবুর আগমনবার্তা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়া অহীন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে দেখিতে দলবদ্ধ হইয়া তরুণীর দল তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিল। বয়স্কা মাঝিনেরা তাড়াতাড়ি ছোট্ট একটা চৌপায়া আনিয়া তাহাদের ‘জহর সার্না’ অর্থাৎ দেবতার কুঞ্জভবন কৃষ্ণচূড়াগাছের ছায়ায় পাতিয়া দিয়া সম্ভ্রমভরে বলিল, আপুনি বোস্ বাবু।
তরুণী পরস্পরের গলা ধরিয়া দাঁড়াইয়া আপানাদের মধ্যেই নিজেদের ভাষায় অনর্গল কথা বলিতেছিল, তাহার সমস্তই অহীন্দ্রকে লইয়া। অহীন্দ্র বলিল, কি এত সব বলছিস তোরা?
মেয়েগুলো খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। একটি মধ্যবয়স্কা মেয়ে বলিল, উয়ারা বুলছে, রাঙাবাবুকে শুধা, বহুটি কেমন হল? কত বোড়ো বেটে বহুটি? তাই ই উয়াকে বুলছে, তুই শুধা; উ ইয়াকে বুলছে, তুই শুধা; শরম লাগছে উয়াদের।
অহীন্দ্র বলিল, এই এদের মতই হবে।
এবার একটি মেয়ে বলিল, আ আমদের পারা কালো বেটে, না গোরা বেটে?
অহীন্দ্র বলিল, সে আমি বলব কেন? তোরা গিয়ে দেখে আয়। সারী গিয়েছিল দেখতে, সে আমার বউয়ের নাম দিয়ে এসেছে–রাঙাঠাকরুন।
মেয়েগুলি একসঙ্গে অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া স্তব্ধ হইয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত পরে গম্ভীর মৃদুস্বরে দুই একজনের মধ্যে দুই-একটা বাদানুবাদের সুরে কথা আরম্ভ হইল। অহীন্দ্র বুঝিতে পারিল না এবং লক্ষ্যও করিল না তাহাদের আকস্মিক সুরবৈষম্য। সে অত্যন্ত তীক্ষ্মভাবে সপ্রশ্ন হইয়া উঠিয়াছিল, ভ্রূ এবং কপাল কুঞ্চিত করিয়া সে বলিল, ভাল কথা, সারীরা এখন কোথায় থাকে রে? কমল মাঝিরা এখান থেকে উঠেই গেল কেন?
মেয়েগুলি আবার স্তব্ধ হইয়া গেল, তাহাদের অপ্রসন্নতার গাম্ভীর্য অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রকট হইয়া উঠিল। অহীন্দ্র তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিত হইয়া বলিল, কি, তোরা সব গুম্ মেরে গেলি যে? তাহার সন্দেহ হইল যে, ইহাদের সকলে চূড়ার নেতৃত্বে দল পাকাইয়া কমলকে তাড়াইয়াছে।
একটি তরুণী এবার বলিয়া উঠিল, উ মেয়েটার নাম তু করিস না রাঙাবাবু, ছি।
আরও বিস্মিত হইয়া অহিন্দ্ৰ বলিল, কেন?
সকলের মুখে ঘৃণার অতি তীব্র অভিব্যক্তি ফুটিয়া উঠিল, যে-মেয়েটি কথা বলিতেছিল সে বলিল, ছি, উ পাপী বেটে, পাপ করলে।
পাপ করলে?
হেঁ, পাপ করলে; আপোন বরকে-মরদকে ছেড়ে উ ওই সায়েবটার ঘরে থাকছে।
অহীন্দ্র চমকিয়া উঠিল, বাক্যের অর্থে অর্থে সম্পূর্ণভাবে কথাটা না বুঝিলেও অর্থের আভাস সে একটা বুঝিতে পারিতেছিল, তীক্ষ্ণ তির্যক দৃষ্টিতে চাহিয়া সে প্রশ্ন করিল, বরকে ছেড়ে সায়েবের ঘরে থাকছে? সায়েব কে?
ওই যি কল বানাইছে, উয়াকে আমরা সায়েব বলি।
হুঁ। ছোট একটা ‘হুঁ’ বলিয়াই অহীন্দ্র স্তব্ধ হইয়া গেল।
অপর একটি মেয়ে বলিয়া উঠিল, উ এখুন ভাল কাপড় পরছে, গোন্দ মাখছে, উই সায়েব দিচ্ছে উকে।
অহীন্দ্র প্রশ্ন করিল, সেইজন্য বুঝি কমল মাঝি আর সারীর বর এখান থেকে পালিয়ে গেছে?
হে, শরম লাগল উয়াদের, আমরা সব উয়াদের সঙ্গে খেলম নি, তাতেই উয়াদের শরম বেশি হল, উয়ারা সব চলে গেল। হেঁ।
অন্যান্য মেয়েগুলি আপনাদের ভাষায় অনর্গল কিচির-মিচির করিয়া আলোচনা করিয়া চলিয়াছিল দলবদ্ধ সারিকা পাখির মত। অকস্মাৎ একটি মেয়ে আপনাদের ভাষায় বলিয়া উঠিল, দে দেখ, রাঙাবাবুর মুখখানা কেমন হইছে দেখ।
সবিস্ময়ে আর একটি মেয়ে বলিয়া উঠিল, জেঙ্গেৎ-আরা (অর্থাৎ টকটকে রাঙা)! উ বাবা রে!
অহীন্দ্র আবার স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল, দুঃখে ক্রোধে তাহার মনের মধ্যে একটা আলোড়ন জাগিয়া উঠিল। সেই দীর্ঘতনু মুখরা মেয়েটিকে তাহার বর ভাল লাগিত, তাহার পরিণতি শেষে এই হইল? আর তাহাদেরই অধিকৃত ভূমির মধ্যে একজন আগন্তুক ধনের দর্পে এমনি করিয়া অত্যাচার করিল সরল নিরীহ জাতির নারীর উপর?
মাথার মধ্যে সে কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করিল, রক্তের চাপে মাথাটা যেন ভারী হইয়া উঠিতেছে।
একটি প্রৌঢ়া মেয়ে বলিল, হাঁ বাবু, কেনে তুরা ওই সায়েবটাকে ইখিনে কল বোসাতে দিলি? ওই মেয়েটাকে উ জোর করে বশ করলে। উয়ার ভয়ে কেউ কিছু বলতে লারলে।
অহীন্দ্রের স্থিরদৃষ্টি একটি স্থানেই আবদ্ধ হইয়া ছিল, তাহার মনের মধ্যে বিদ্যুৎগতিতে ছবি ভাসিয়া যাইতেছিল, সবই ওই সারী ও কমল মাঝির স্মৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাহার মনে পড়িল, ওই সম্মুখের উঠানে যেখানে তাহার দৃষ্টি আবদ্ধ হইয়া আছে, ওইখানেই প্রথম দিন সে আসিয়া বসিয়াছিল। তখন চারিপাশে ছিল কাশ ও বেনাবন। সম্মুখে উবু হইয়া একখানা বিরাট পাথরের মত বসিয়া ছিল কমল। আর সম্মুখেই পরস্পরের গলা জড়াইয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল মেয়েগুলি, ঠিক মাঝখানে ছিল সারী।
বৃদ্ধা বলিয়াই চলিয়াছিল, আবার এই দেখ, আমাদের জমিগুলি উ সব কেড়ে লিছে।
অহীন্দ্র যেন গর্জন করিয়া উঠিল, কেড়ে নিচ্ছে?
তাহার এই গর্জনে সমস্ত দলটি চমকিয়া উঠিল, অহীন্দ্রকে এমন রূপে তাহারা কখনও তো দেখেই নাই, এমন রূপের প্রকাশকেও তাহারা কল্পনা করিতে পারে না। যে প্রৌঢ়াটি কথা বলিতেছিল সেও ভয়ে চুপ করিয়া গেল। অহীন্দ্র অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বরে আবার প্রশ্ন করিল, জমি কেড়ে নিচ্ছে কি মেঝেন?
ভয়ে ভয়ে প্রৌঢ়া বলিল, বুলছে, তোদের কাছে আমি টাকা পাব। জমিগুলা আমাকে দিতে হবে। লইলে লালিশ করব।
টাকা পাবে? কিসের টাকা?
ওই যে চিবাস মোড়ল, উয়ার কাছে আমরা সোব ধান খেতম বর্ষাতে, তাই চিবাস খত করে লিলে ধানের দামে। উহার কাছ হতে উই সায়েব আবার কিনে লিলে খতগুলান। তাথেই বুলছে, জমিগুলা দে, তুদিকে আরও টাকা দিব, খতও শোধ করে লিব! লইলে লালিশ করব।
করুক নালিশ, খবরদার তোরা জমি লিখে দিবি না। যে টাকা পাবে সে আমরা শোধ করে দেব।
মেয়েটি হতভম্বের মত খানিকক্ষণ অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া সহসা কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, জমি যে বাবু লিলে।
লিখে নিলে?
হেঁ বাবু। আজকে সেকালে মরদগুলাকে লিয়ে শহরে পাঠায়ে দিলে তুদের সেই মজুমদারের সোঙ্গে হাকিমের ছামুতে টিপছাপ লিযে, রেজস্টালি করে লিবে।
অহীন্দ্র অনুশোচনায় অস্থির হইয়া উঠিয়া বলিল, ছি ছি ছি! তোরা দিলি কেন? আমাদের ওখানে গেলি কেন?
মেয়েটি সকরুণ স্বরে বলিল, উ যি বলতে বারণ করলে রাঙাবাবু। উয়াকে দেখলে যে আমরা ডরে মরে যাই। পাহাড়ে চিতির ছামুতে ছাগল ভেড়ার মোতন আমরা লড়া-চড়া করতে লারি বাবু।
সমবেত সকলেই যেন এতক্ষণ উদ্বেগে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, প্রৌঢ়ার কথা শেষ হইতেই দুঃখে হতাশায় দীর্ঘ প্রক্ষেপে সে নিঃশ্বাস তাহারা ত্যাগ করিল। মৃদুস্বরে আক্ষেপ করিয়া দুই-চারিজন বলিয়া উঠিল, আঃ আঃ! হায় রে!
অহিন্দ্রের চোখের উপর চকিতে ভাসিয়া উঠিল, সে যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল, সম্মুখেই একটা স্থানে একটা বিরাট অজগরের মৃতদেহ, নিস্পন্দ চিত্রিত মাংসস্তূপ। ঠিক ওইখানেই সেটা সেদিন পড়িয়া ছিল, তীরে তীরে বধ করিয়াছিল সেটাকে সারীর স্বামী। সে উঠিয়া দাঁড়াইল, দাঁড়াইয়া অনুভব করিল, সর্বশরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। মাথাটা যেন অবরুদ্ধ ক্রোধে ফাটিয়া পড়িতেছে।
এমন দুর্দমনীয় ক্রোধের অস্থিরতা সে জীবনে অনুভব করে নাই; দুই কান দিয়া আগুন বাহির হইতেছে, শীতের কনকনে বাতাসের স্পর্শেও আরাম বোধ হইতেছে না। রগের শিরা দুইটা দপদপ করিয়া স্পন্দিত হইতেছে। বারা বার তার ইচ্ছা হইতেছিল, ওই কলের মালিকের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইতে। একবার খানিকটা অগ্রসরও হইয়াছিল, কিন্তু পথ হইতেই ফিরিল; এই অবস্থার মধ্যেও তাহার শৈশব হইতে মায়ের দৃষ্টান্তে অভ্যাস করা আত্মসংযম তাহাকে নিবৃত্ত করিল। আর একটা চিন্তা তাহার পথ রোধ করিল, সে তাহাদের বংশপ্রচলিত মর্যাদা-রীতি। সে রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী অহীন্দ্রের এমন করিয়া বিমলবাবুর ওখানে যাওয়া চলে। চক্রবর্তীদের আসনের সম্মুখেই ওই কলওয়ালাকে আসিয়া দাঁড়াইতে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই সে ফিরিল। শীতের কালিন্দীর বালুকাময় তটভূমি ধরিয়া একটা নির্জন স্থানে আসিয়া সে বসিল। সম্মুখেই পশ্চিম দিকে অপরাহ্নের সূর্য দিকচক্ররেখার দিকে দ্রুত নামিয়া চলিয়াছে, ইহারই মধ্যে শুকতারাটি ক্ষীণ প্রভায় প্রকাশিত হইয়াছে।
বসিয়া বসিয়া সে ভাবিতেছিল ওই কলওয়ালার অত্যাচারের কথা। নিরীহ সরল জাতির নারী কাড়িয়া লইয়াছে, ভূমি কাড়িয়া লইয়াছে। আর তাহাদের পৃথিবীতে আছে কি? আর কি অপদার্থ ভীরু জাতি এই সাঁওতালেরা! তীর ধনুক লইয়া কারবার করে, বুনো শূকর মারিয়া খায়। কুমীর মারে, বাঘও নিস্তার পায় না, অতি কদর্য ভয়াল অজগর, ওই সারীর স্বামীই সে অজগরটাকে বধ করিয়াছিল, আর এটাকে পারিল না! ওই সাঁওতাল রমণীটি তো মিথ্যা বলে নাই, অর্থের শক্তিতে বুদ্ধির কুটিলতায় ও অজগরই বটে; পাক দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া পেষণে পেষণে রক্তহীন হত্যা করিয়া ধীরে ধীরে গ্রাস করিতে থাকে। অজগরই বটে! সারীর স্বামী এ অজগরটাকে বধ করিতে পারিল না? এমনি ধারার অত্যন্ত নিষ্ঠুর কামনা তাহার মাথার মধ্যে যেন চিতাগ্নিশিখার মত পাক খাইয়া খাইয়া ফিরিতে আরম্ভ করিল।
কিছুক্ষণ পর সে ধীরে ধীরে উঠিয়া বালুরাশি ভাঙ্গিয়া কালিন্দীর ক্ষীণ জলস্রোতের কিনারায় আসিয়া আঁজলা আঁজলা জল মাথায় মুখে দিয়া ধুইয়া ফেলিল। কনকনে ঠাণ্ডা জলের উপর শীতের বাতাসের স্পর্শে এবার একটু শীত বোধ করিল। মস্তিষ্ক যেন এতক্ষণে সুস্থ হইয়া আসিতেছে। বেশ পরিস্ফুট কণ্ঠে সে বলিয়া উঠিল, আঃ!
ধীরে ধীরে সে বালির উপর দিয়া হাঁটিয়া চলিল। উঃ, কি কঠিন ক্রোধই না তাহার হইয়াছিল। ওই লোকটার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলে আজ একটা অঘটন ঘটিয়া যাইত। কিন্তু এই যে অন্যায় অত্যাচার, ধনদর্পিত স্বেচ্ছাচার-স্বেচ্ছাচার কেন, ব্যভিচার-ইহার প্রতিকার করিতে হইবে। করিতে যে সে ধর্মত ন্যায়ত বাধ্য। ওই নিরীহ সাঁওতালগুলি তাহাদেরই প্রজা, শুধু প্রজাই নয়, তাহার পিতামহ হইতে আজ পর্যন্ত তাহাদের বংশকে উহারা দেবতার মত মান্য করে। শুধু তাই বলিয়াই কেন? মানুষ হিসাবে তাহার কর্তব্য। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করার অধিকারই মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার। সকল ব্যাথিতের বেদনায় ব্যাথিতা অশ্রুমুখী মায়ের মুখ তাহার মনে জাগিয়া উঠিল, তাহার মা ননী পালের মৃত্যুর জন্য কাঁদেন, অথচ পুত্রের দ্বীপান্তরের আদেশ অবিচলিত ধৈর্যের সহিত সহ্য করেন।
অকস্মাৎ পাশের বেনাবন আন্দোলিত হইয়া উঠিতেই সে ঈষৎ চকিত হইয়া উঠিল। চরের এই খানিকটা অংশের বেনাবন এখনও সাফ হয় নাই। বেনাবনের ও-পাশেই চরের উপর সারি সারি ইঁটের পাঁজা; ওগুলিই এখন সরিসৃপ ও বন্যজন্তুদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখিয়া একটু সরিয়া অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আত্মরক্ষার্থে একটা পাথরের নুড়িও নদীর বালি হইতে কুড়াইয়া লইল। জানোয়ার নয়, মানুষ। বেনাবনের অন্তরালে একেবারে সমুখেই আসিয়া পৌঁছিয়াছে, সাদা কাপড় স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। অহীন্দ্র হাতের ঢেলাটি ফেলিয়া দিয়া আবার ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হইল। তাহার মনে পড়িল, রবীন্দ্রনাথের ‘গান্ধারীর আবেদনে’র কথা। পাপে আসক্ত পুত্রের প্রতি অভিশাপের বজ্র নিক্ষেপ করিতে করিতে দৌপ্রদীর লাঞ্ছনায় চোখে তাঁহার জল আসিয়াছে। কৃষ্ণার লাঞ্ছনার চেয়ে কৃষ্ণকায়া হতভাগিনী সারীর লাঞ্ছনা তো কম নয়।
রাঙাবাবু! পিছন হইতে মৃদুস্বরে কে ডাকিল, রাঙাবাবু!
অহীন্দ্র পিছন ফিরিয়া দেখিল, বেনাবনের পটভূমির গায়ে দাঁড়াইয়া সারী, হাতে দুইটি গাঢ় লাল রঙের ফুল। মুহূর্তে তীব্র কঠিন ক্রোধে আবার তাহার মাথা হইতে পা পর্যন্ত স্নায়ুগুলি গুণ-দেওয়া ধনুকের ছিলার মত টান হইয়া টঙ্কার দিয়া উঠিল। দুর্নীতিপরায়ণা মেয়েটার উপর ক্রোধের তাহার সীমা রহিল না। তাহার চোখে পড়িল না সারী কত শীর্ণ হইয়া গিয়াছে; তাহার কালো রঙের উপরও চোখের কোলে গাঢ়তর কালির রেখায় আঁকা গভীর ক্লান্তির অতি স্পষ্ট ছাপটিও সে দেখিতে পাইল না।
সারী হাসিয়া ফেলিল; তাহার সেই হাসির মধ্যে একটা শঙ্কার আভাস, সে বলিল, আমি দেখলাম আপোনাকে; নদীর বালিতে বালিতে রাঙা আগুনের পারা মানুষ, তখুনি চিনতে পারলম। ফুল নিয়ে এলম। কথা বলিতে বলিতেই কৃষ্ণাভ-রাঙা মখমলের রঙের গোলাপ ফুল দুইটি তাহার দিকে প্রসারিত করিয়া ধরিল। অহীন্দ্র সে-দিকে দৃষ্টিপাতই করিল না, কে স্পর্শ করিয়া প্রসারিত তাহার অতি তীব্র দৃষ্টি সারীর মুখের উপরেই স্থিরভাবে নিবদ্ধ ছিল। অগ্নিবর্ণ উত্তপ্ত লৌহশলাকার মত সে-দৃষ্টি মর্মঘাতি তীক্ষ্ণ। সারী সভয়ে হাতটি গুটাইয়া লইয়া চরমদণ্ডে দণ্ডিতা অপরাধিনীর মত নীরবে বিহ্বল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
নিষ্করুণ কঠিন কণ্ঠে এতক্ষণে অহীন্দ্র বলিল, সরে যা আমার মুখ থেকে। তোর লজ্জা করে না। মানুষের সামনে দাঁড়াতে? যা এখান থেকে।
সারীর চোখ হইতে দুইটি অশ্রুর ধারা গাল বাহিয়া ঝরিয়া পড়িল। ভয়ার্ত বিহ্বলতার মধ্যেও সে অস্ফুট স্বরে বলিল, আমাকে ঘরের ভিতর এই এত বড় ছুরি দেখালেক বাবু, কাঁড়ার চাবুক করে আমাকে মারে, ওগো রাঙাবাবু গো!
অতীন্দ্র অসহিষ্ণু হইয়া তীব্রস্বরে বলিল, যা যা, এখান থেকে যা বলছি!
সারী আর সাহস করিল না, ক্লান্ত বাহুবিক্ষেপে বেনাবন ঠেলিয়া তাহারই মধ্যে ডুবিয়া গেল।
সারী চলিয়া গেল। আরও কয়েক পা অগ্রসর হইয়া অহীন্দ্র আবার স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। বেড়াইতেও আর ভাল লাগিতেছে না, সে একটা গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিল। দীর্ঘনিঃশ্বাসের মধ্য দিয়া বুকের আবেগ অনেকটা বাহির হইয়া আসিল কাঁপিতে কাঁপিতে, যেন কত অফুরন্ত কান্না সে কাঁদিয়াছে। সে নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজিয়া ভাবিয়া লইয়া সে আবার কালিন্দীর জলস্রোতের কিনারায় আসিয়া চোখ-কান আর একবার ধুইয়া ফেলিল। ধুইয়া সেইখানেই সে বসিল, প্রয়োজন হইলে আবার একবার মাথা ধুইয়া ফেলিবে। মাথার মধ্যে ক্রোধের এমন যন্ত্রণা হয় সে তাহা জানিত না। জ্বরোত্তপ্ত মস্তিষ্কের যন্ত্রণার চেয়ে এ-যন্ত্রণা তো কোন অংশে কম নয়! তাহার মনে পড়িল, আরও একদিন ক্রোধে তাহার মাথা ধরিয়াছিল। নবীন বাগদী ও রংলাল মোড়ল তাহাকে বলিয়াছিল, আইনে পান তো লেবেন সেলামী। তাহার মা সেদিন সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে যন্ত্রণার উপশম হইয়াছিল। সেদিনের যন্ত্রণা আজিকার যন্ত্রণার তুলনায় নগণ্য, তুচ্ছ। আজও সে মায়ের হাতের স্পর্শের জন্য লালায়িত হইয়া উঠিল। এমন কোমল শান্ত স্পর্শ মায়ের হাতের, আর এত শীতল সে হাত! সে বাড়ি যাইবার জন্যই উঠিয়া পড়িল।
কিছুদূর আসিতেই দেখা হইল অমলের সঙ্গে। অমল বলিল, বাঃ বেশ! খুঁজে খুঁজে হয়রান তোমাকে যাকে বলে গরু খোঁজা তাই। পরমুহর্তে সে বিস্ময়মুগ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, বাঃ, আকাশের গোধূলি যে তোমার মুখে নেমেছে হে! ওঃ, সো বিউটিফুল ইউ লুক? মুখে যেন লাল রুজ মেখেছ মনে হচ্ছে। না, রক্তসন্ধ্যাই হবে আরও মিষ্টি–
অহীন্দ্র বলিল, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার অমল। অত্যন্ত রাগে আমার ভয়ঙ্কর মাথা ধরে উঠেছে।
রাগে? তুমি আবার রাগ করতে শিখলে কবে?
আজই। বস বলি।
ধীরে ধীরে সমস্ত বলিয়া সে বলিল, এরই মধ্যে সাঁওতালদের অবস্থা যা হয়েছে, সে কি বলব। মাঠগুলো পড়ে ধু ধু করছে। তাদের পাড়াতে সে গান নেই, আনন্দ নেই। তাদের মুখের হাসি যেন ফুরিয়ে গেছে। অমল, তাদের মেয়েদের ওপর পর্যন্ত অত্যাচার আরম্ভ করেছে এর প্রতিকার করতেই হবে।
অমল স্লান হাসি হাসিয়া বলিল, আজই পড়ছিলাম গোল্ডস্মিথের Deserted Village। –বলিয়া সে আবৃত্তিও করিয়া গেল–
Ill fares the land, to hastening ills a prey
Where wealth accumulates, and men decay,
Princes and lords may flourish, or may fade
A breath can make them, as a breath has made;
But a bold Peasantry, their country’s pride
When once destroyed, can never be supplied.
অহীন্দ্রেরও মনে পড়িয়া গেল। স্মৃতি-স্মরণের মধ্যে আবৃত্তি করিতে করিতে অস্কুটম্বরে আবৃত্তি করিয়া উঠিল–
His best companions, innocence and health,
And his best riches, ignorance of wealth.
ঠিক ঐ সাঁওতালদের ছবি। ওদের বাঁচাতেই হবে অমল, bold Peasantry কে রক্ষা করতেই হবে।
অমল বলিল, চল, আজ বাবাকে গিয়ে বলি। বাবাও লোকটার উপর খুব চটে আছেন। কালিন্দীর ওই বাঁধটা, ওই যে পাম্প করে জল তুলছে, ওটা নিয়ে বোধ হয় শিগগিরই একটা গোলমাল হবে। ফৌজদারিই হবে বলে মনে হচ্ছে।
অহীন্দ্র বার বার ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিল, নো নো অমল, নট অ্যাজ এ প্রিন্স অর এ লর্ড, জমিদার বা ধনী হিসেবে নয়। মানুষ হিসেবে মানুষের দুঃখ দূর করতে হবে। জমিদার আর কলওয়ালার তফাৎ কোথায়?
অমল বিস্মিত হইয়া অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া থাকার পর নদীর বালির উপর অর্ধশায়িত হইয়া অহীন্দ্র যেন আপনাকে এলাইয়া দিল, এমন আকস্মিক উগ্র উত্তেজনার ফলে তাহার দেহ ও মন যেন বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে।
অমল বলিল, এ কি, শুয়ে পড়লে যে। চল, বাড়ি চল।
অহীন্দ্র ক্লান্তির একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, চল।
.
২৮.
অমলের মুখে অহীন্দ্রের মাথা ধরার সংবাদ এবং অপরাহ্নের সমস্ত ঘটনার কথা শুনিয়া হেমাঙ্গিনী মাত্রতিরিক্তরূপে চিন্তিত হইয়া উঠিলেন। রায় তর্পণের আসনে নীরবে জপে ব্যাপৃত ছিলেন, তাঁহার সম্মুখে বসিয়াই কথা হইতেছিল, তাঁহার ধ্যানগম্ভীর মুখে একটু মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল; বিশেষ একটা উপলব্ধির ভঙ্গিতেই হাসির মৃদুতার সহিত সমতা রাখিয়া মাথাটি বার কয়েক দুলিয়া উঠিল।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অহীনের তো রাগ কখনও দেখি নি। ওর স্বভাব হল ওর মায়ের মত। অমল হাসিয়া বলিল, পূর্বে কখনও রাগ হয় নি বলে পরে কখনও রাগ হতে পারে না, এ তোমার অদ্ভুত যুক্তি মা!
হেমাঙ্গিনী দৃঢ় স্বরে বলিলেন, না, রাগ করতে পারে না। এমন মায়ের ছেলে সে কারও ওপর রাগ করবে কেন? সুনীতির দয়ামায়ার কথা তোরা জানিস, গোটা পৃথিবীর ওপর তার মায়া ছড়ানো আছে। তার ছেলে–
মায়ের স্বভাব কন্যার প্রাপ্য, গিন্নী, ছেলে পাবে পৈতৃক স্বভাব। তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন, অহীন্দ্র হল শাক্ত জমিদার-বংশের সন্তান! তার স্বভাব হবে সিংহের মত। দুর্বলকে সে স্পর্শ করবে না, যুদ্ধ হবে তার সবলের সঙ্গে। অহীন্দ্রের তেজস্বিতায় আমি খুব খুশি হয়েছি। তারা, তারা মা!–রায়ের জপের এক পর্যায় শেষ হইয়াছিল, সেই অবসরে তিনি এই কথা কয়টি বলিয়া কারণ-পাত্র পুনরায় পূর্ণ করিয়া লইয়া ক্রিয়া আরম্ভ করিলেন।
হেমাঙ্গিনী কিন্তু অপ্রসন্ন হইয়া উঠিলেন, স্বামীর কথাগুলি তাঁহার ভাল লাগিল না। বলিলেন, তোমাদের ওই এক ধারার কথা। শাক্ত জমিদার-বংশের ছেলে হলে তাকে রাগ করে মাথা-ধরাতে হবে, কিংবা দাঙ্গাহাঙ্গামা করতে হবে কেন শুনি? এমন কিছু শাস্ত্রের নিয়ম আছে নাকি?
ক্রিয়ায় নিযুক্ত রায় কোন উত্তর দিতে পারিলেন না, কিন্তু মুখে তাঁহার মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওদের গুষ্টির রাগকে আমার বড় ভয় করে বাপু। ওর বাপের রাগের সে থমথমে মুখ মনে হলে হাত-পা যেন গুটিয়ে আসে।
রায়ের মুখও গম্ভীর হইয়া উঠিল। হেমাঙ্গিনী বলিয়াই চলিয়াছিলেন, অহীনের এখন থেকে এ-সব মাথা ঘামানোই বা কেন? সে এখন পড়ছে পড়ে যাক। বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার, তুমি রয়েছ, যেমনই অসুস্থ হোন তার বাপ রয়েছেন, সে-সব তাঁরা যা হয় করবেন।
বলিয়াই তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন, অমলকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, চল, তুই আমার সঙ্গে চল, একবার দেখে আসি, আর বলে আসি। উমিটা কোথায় গেল? সেও চলুক।
অহীন্দ্র একখানা ডেক-চেয়ারে চোখ বুজিয়া ক্লান্তভাবে হেলান দিয়া শুইয়া ছিল। পদশব্দে চোখ খুলিয়া সে দেখিল; তাহার মা, এবং মায়ের পিছনে হেমাঙ্গিনী ও অমল! ব্যস্ত হইয়া সে উঠিবার উপক্রম করিল, হেমাঙ্গিনী বলিলেন, না, না, উঠতে হবে না। তোমার শরীর খারাপ হয়ে রয়েছে, শুয়ে থাক তুমি। তারপর, তুমি নাকি এত রাগ করেছিলে যে, তোমার মাথা ধরে উঠেছে? ছি বাবা, রাগ চণ্ডাল, তাকে এত প্রশ্রয় দিও না। যে-মায়ের ছেলে তুমি, তাতে রাগ তোমার শরীরে থাকাই উচিত নয়।
অহীন্দ্র দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আপনারা জানেন না, কি অমানুষিক অত্যাচার ওই কলওয়ালাটি করেছে ওই নিরীহ সাঁওতালদের ওপর।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বেশ তো, তার জন্য তোমার বাবা রয়েছেন, তোমার–। বলিয়াই তিনি হাসিয়া ফেলিলেন, হাসিতে হাসিতে বলিলেন, মামা বলা তো আর চলবে না, শ্বশুর বলতে হবে; তাই বলি, তোমার শ্বশুর রয়েছেন, তাঁরা তার প্রতিকার নিশ্চয় করবেন। গরিব প্রজা, তাদের বাঁচাতে হবে বই কি। এটা তো জমিদারের ধর্ম। যত কিছু দোষ রায়-হাটের বাবুদের থাক, ও-ধর্ম তাড়া কখনও অবহেলা করেন না। তোমার এখন পড়ার সময়, তুমি লেখাপড়া কর।
সুনীতি বলিলেন, আমি বলি কি অহীন,আমাদের খাসে যে জমিটা আছে, যেটা সাঁওতালরাই ভাগে চাষ করছে, ওইটে ওদের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হোক। তা হলে ওদের দুঃখও ঘুচবে, আর কলের মালিককে বুঝিয়ে বলে দিলেই হবে যে, ওটাতে যেন আর তিনি হাত না দেন।
অমল হাসিয়া এবার বলিল, পিসীমার ধর্মটি কিন্তু বড় ভাল। ও ধর্মের মহিমায় সকল সমস্যার সমাধান জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়।
সুনীতি লজ্জা পাইলেন, কিন্তু হেমাঙ্গিনী বলিলেন, পড়িলে ভেড়ার শিঙে ভাঙে রে হীরার ধার! গোঁ ধরা শাক্ত-তান্ত্রিকের বংশ তোমাদের, তোমরা আর এ ধর্মের মহিমা কি বুঝবে বল? ওরে, ও-ধর্ম যদি সকলে বুঝত, তবে কি পৃথিবীতে এত দুঃখ থাকত?
অমল হাসিয়াই উত্তর দিল, সে তো অস্বীকার করছি না মা, কিন্তু পিসিমার ধর্মে মুশকিল কি জান? মুশকিল হচ্ছে, নিঃসম্বল অবস্থায় আর ও-ধর্ম নিয়ে চলা যায় না। মানে, ব্রহ্মাণ্ড যাঁর উদরভাণ্ড, সেই তিনি যখন ননীগোপাল সেজে ননীলোলুপ হয়ে ওঠেন, তখন যশোদাকে মুশকিলে পড়ে ও-ধর্ম ছেড়ে বিপরীত ধর্ম গ্রহণ করতে হয়, দায়ে পড়ে তখন ননীগোপালকে খুঁটির সঙ্গে বাঁধতে হয়। পৃথিবীতে মানুষ মাত্রেই যে ব্রহ্মাণ্ড ভণ্ডোদর বিষয়-গোপাল-বিপদ যে ওইখানে।
অমলের কথার ভঙ্গিতে সবাই হাসিল, হাসিল না কেবল অহীন্দ্র, সে যেমন গম্ভীর মুখে অবসন্ন ভঙ্গিতে ডেক-চেয়ারে এলাইয়া পড়িয়া ছিল, তেমন ভাবেই রহিল। হেমাঙ্গিনী হাসিতে হাসিতে বলিলেন, তুই কিন্তু ভারী জ্যাঠা হয়েছিস অমল।
অহীন্দ্র চোখ বুজিয়াই ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিল, তুমি ভুল বুঝেছ অমল, মায়ের ধর্ম যশোদার ধর্ম নয়, মায়ের ধর্ম গান্ধারীর ধর্ম। দাদার গুলিতে যখন ননী পাল মল, তখন মা ননী পালের জন্যে কেঁদেছিলেন, কিন্তু দাদার দ্বীপান্তরের হুকুম যেদিন হল, এক ফোঁটা চোখের জল তিনি ফেলেন নি। শুধু পাথরের মূর্তির মত বসে রইলেন।
লজ্জা এবং দুঃখ একই সঙ্গে সুনীতিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, সেই তো বাবা, হাজার অপরাধ করলেও তোমার মা কখনও কারও ওপর রাগ করেন না। অন্যায় করেও কেউ দণ্ড পেলে তোমার মা তার জন্যে কাঁদেন। সেই মায়ের ছেলে তুমি, রাগ করা তো তোমার সাজে না।
অহীন্দ্র নীরবে কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, হ্যাঁ, রাগ করাটা আমার অন্যায় হয়েছে। কিন্তু রাগ তো আমি ইচ্ছে করে করি নি, হঠাৎ যেন কেমন হয়ে গেলাম আমি। তা নইলে অত্যাচার অবিচার কোথায় নেই বলুন? ধনী দরিদ্রও পৃথিবীর সর্বত্র, অত্যাচার অবিচারও সর্বত্র। কজনের ওপর রাগ করব?
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, না না না, তা বললে চলবে কেন? যতটুকু তোমার আয়ত্তের মধ্যে, তার ভেতর অন্যায়ের প্রতিকার করতে হবে বৈ কি। আর সে হবেও। লোকটিকে ভালমত শিক্ষা দেবার জন্যে উনি উঠে পড়ে লেগেছেন। তবে আমাদের তরফ থেকে যাতে অন্যায় না হয়, সেজন্যে আমি বার বার করে বলেছি। বলেছি, ও লোকটি অন্যায় করেছে, তাকে শাস্তি দিতে হলে ন্যায়পথে চলে শাস্তি দিতে হবে, কৌশল অবলম্বন করতে পারবে না।
অহীন্দ্র এ কথার কোন জবাব দিল না, নীরবে চোখ বুজিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া শুইয়া রহিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, মাথা কি এখনও ধরে রয়েছে তোমার? এক কাজ কর, ওডিকোলনের একটা পটি দাও কপালে, না হয় পিপামেন্ট জলে গুলে কপালে বুলিয়ে নাও। তারপর সুনীতির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, চল, আমরা যাই, একবার চক্রবর্তী মশায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি চল।
সুনীতি গভীর চিন্তায় দিশাহারা হইয়া বলিলেন, আমার বড় ভয় দিদি। ওই চরটা সর্বনাশা চর; যখনই চর নিয়ে কোন হাঙ্গামা বাধে, আমার বুক থরথর করে কেঁপে ওঠে। অহি আবার চর নিয়ে যে কি করবে, ওর ভাবগতিক আমার ভাল লাগল না দিদি। কেমন উদাসী মন হয়ে গেছে দেখলেন!
হেমাঙ্গিনী হাসিয়া বলিলেন, ও তুমি কিছু ভেবো না সুনীতি, ও সব ঠিক হয়ে যাবে। উমার আমার স্বামীভাগ্য খুব ভাল; তাছাড়া উমা একালের লেখাপড়া জানা চালাক মেয়ে। বিয়ে হোক না, কেমন মন-উদাসী থাকে, দেখব। দেখবে? এক্ষুনি বাবার মন ভাল করে দিচ্ছি বলিয়াই তিনি উচ্চকণ্ঠে ডাকিলেন, অমল!
অমল আসিতেই বলিলেন, একটা কাজ যে ভুলেছি বাবা! এক্ষুনি তোকে বাড়ি যেতে হবে, গিয়ে স্যাকরাকে বলে পাঠাতে হবে যে, উমার রুলির প্যাটার্নটা অন্য রকম হবে; আজই সেটা আরম্ভ করার কথা, সেটা যেন আজ আরম্ভ না করে। কাল সকালে আমার কাছে এলে আমি সব বুঝিয়ে দেব। তিনি ইচ্ছা করিয়াই অহীন্দ্রের নিকট হইতে সরাইয়া অমলকে বাড়ি পাঠাইয়া দিলেন।
অমল চলিয়া গেল; হেমাঙ্গিনী ওডিকোলনের জল তৈয়ারি করিয়া ডাকিলেন, উমা!
উমা মানদা ঝির পাল্লায় পড়িয়াছিল, ভাবী বউদিদিকে মানদা ছোটদাদাবাবুর বাল্যকালের কথা বলিয়া নিজের গুরুত্ব এবং প্রবীণত্বের দাবি প্রতিষ্ঠিত করিতেছিল। উমারও শুনিতে মন্দ লাগিতেছিল না। মায়ের আহ্বান শুনিয়া সে উপরে আসিয়া সুনীতি ও হেমাঙ্গিনীর সম্মুখে দাঁড়াইল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, এই ওডিকোলনের জলটা আর এই ন্যাকড়ার ফালিটা দিয়ে আয় তো মা। আমরা দুজনে চক্রবর্তী মশায়ের ঘরে যাচ্ছি। তুই বরং ন্যাকড়াটা ভিজিয়ে কপালে একটা পটিই লাগিয়ে দিয়ে আসবি। বড্ড মাথা ধরেছে অহির।
উমা লজ্জায় স্থানুর মত হইয়া না গেলেও সঙ্কুচিত অনেকটুকুই হইল। রক্তাভ মুখে সে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, হেমাঙ্গিনী ওডিকোলনের পাত্রটি হাতে তুলিয়া দিয়া বলিলেন, তোমার তো লজ্জা করলে চলবে না মা; বাড়িতে একটি ননদ-দেওর নেই যে, তাকে পাঠিয়ে দেবেন তোমার শাশুড়ী। যাও, দিয়ে এস।
উমা পাত্রটি হাতে করিয়া চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী সুনীতির দিকে চাহিয়া ফিক করিয়া হাসিয়া বলিলেন, এ কি আর আমাদের কাল আছে ভাই? সেকালে আর একালে অনেক তফাত।
সুনীতি মৃদু ম্লান হাসি হাসিলেন, বসিলেন, তারপর বলিলেন, ভাল আর মন্দ ভাই, যে কালের যে ধারা। এরপর আবার কত হবে, নাতি-নাতনীর আমলে বেঁচে থাকলে সেও দেখতে হবে। এ প্রসঙ্গ শেষ করিয়া ক্ষণিক স্তব্ধ থাকিয়া আবার বলিলেন, চল, চক্রবর্তী মশায়কে একবার দেখে আসি। আজই একবার দেখা হয়েছে, তবু যখন এসেছি চল।
অহীন্দ্র চোখ বুজিয়াই শুইয়া ছিল, ঠিক ঘুমায় নাই-কিন্তু সজাগও ঠিক ছিল না। জাগ্রত পৃথিবীর সকল সংস্পর্শকে দূরে সরাইয়া দিয়া সে যেন আপন অন্তরের চিন্তালোকের গভীর-গর্ভ রুদ্ধদ্বার এক কক্ষের মধ্যে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল। অকস্মাৎ কপালের উপর শীতল একটি স্পর্শ যেন করাঘাত করিয়া তাহাকে বাহির। হইতে ডাকিল। উমা আসিয়া তাহাকে ঘুমন্তই মনে করিয়াছিল; ডাকিয়া ঘুম না ভাঙাইয়া সন্তর্পণে ওডিকোলনের পটিটি কপালে বসাইয়া দিয়াছিল।
অহীন্দ্র স্বপ্নচচ্ছন্ন চোখ মেলিয়া উমার মুখের দিকে চাহিল।
উমা লজ্জা পাইল, আরক্তিম মুখে বলিল, ওডিকোলনের পটি! আমি ভেবেছিলাম, ঘুম আর ভাঙাব না।
স্মিত হাসিতে অহীন্দ্রের মুখ ঈষৎ দীপ্ত হইয়া উঠিল, সে বলিল, আমি ঘুমুই নি।
ঘুমোও নি? তবে এমন ভাবে শুয়ে ছিলে যে? মাথা বুঝি খুব ধরেছে?
মাথার যন্ত্রণা অনেকটা কমেছে; কিন্তু মন যেন কেমন vacant হয়ে গেছে।
উমা মৃদু হাসিয়া এবার বলিল, সায়েবলোকের কিন্তু এ-রকম দুর্বল হওয়া উচিত নয়। রাগ দুর্বলচিত্তের একটি লক্ষণ।
অহীন্দ্রের মুখের হাসি এবার আরও একটু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে বলিল, কথাটা তোমার মুখে শোভন হল না, হে বাঙালিনী শ্রীমতি উমা দেবী। যেহেতু স্মরণ কর, পুরাকালে পর্বত দুহিতা উমার প্রিয়তম পরম যোগী শঙ্করেরও একদা ক্রোধ হয়েছিল, যে ক্রোধের অগ্নিতে কাম হয়েছিল ভস্মীভূত।
উমা হাসিয়া বলিল, তুমি কি ওই কলওয়ালাটিকে ভস্মীভূত করতে চাও নাকি?
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলিয়া অহীন্দ্র বলিল, তখন তাই চেয়েছিলাম। কিন্তু আর তা চাই না। একটু আগে মনকে ওই চিন্তা থেকে মুক্ত করবার জন্যে পড়ছিলাম, রবীন্দ্রনাথের ‘গান্ধারীর আবেদন’, তার কটা লাইন আমাকে পথ দেখিয়ে দিলে। লাইন কটি মুখস্থ হয়ে গেছে আমার–
দণ্ডিতের সাথে–
দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে,
সর্বশ্রেষ্ট সে বিচার। যার তরে প্রাণ
কোন ব্যাথা নাহি পায়-তারে দণ্ড দান
প্রবলের অত্যাচার।
আমি লোকটাকে শাস্তি দিতে চাই, তার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই, কিন্তু তার ওপর কোন বিদ্বেষ আমি রাখতে চাই না।
অহীন্দ্রের কথাগুলি শুনিতে শুনিতে উমার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে এ যুগের মেয়ে, তাহার তরুণ মন আদর্শের স্বপ্নে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। অহীন্দ্রের গৌরবে সে গরবিনী হইয়া উঠিয়াছে।
ও-দিকে রামেশ্বরের ঘর হইতে ফিরিয়া নীচে নামিবার পথে সিঁড়ির একটি গোপন স্থানে সুনীতি ও হেমাঙ্গিনী আপনা-আপনিই যেন দাঁড়াইয়া উমা ও অহীন্দ্রকে লক্ষ্য করিয়া দেখিতে ছিলেন। হেমাঙ্গিনী আত্মসম্বরণ করিতে পারিলেন না, সুনীতিকে স্পর্শ করিয়া ফিসফিস করয়া বলিলেন, দেখলে?
সুনীতি বলিলেন, ফাজ্জনের প্রথমেই দিন ঠিক করুন দিদি। আমার অদৃষ্টকে আমার সর্বদাই ভয় হয়। আমার সম্বলের মধ্যে অহি। উমার হাতে ওর ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই।
হেমাঙ্গিনী উৎসাহে ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন, রণবাদ্যে উৎসাহিত যুদ্ধের ঘোড়ার মত। ফাল্গুনেই বিবাহ। দিবার জন্য তিনিও ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। বিবাহের মধ্যে যেন একটা কল্পলোকের মাদকতা আছে, পাড়াপড়শি পর্যন্ত নিদ্রা বিসর্জন দিয়া মাতিয়া উঠে, এ-ক্ষেত্রে তো মেয়ের মা এবং ছেলের মা। সুনীতিও সঞ্জীবিত হইয়া উঠিলেন। রায়ের মনেও উৎসাহের সীমা ছিল না। রাধারাণীর অন্তর্ধানের লজ্জায় ক্ষোভে আগুন ধরিয়া পুড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, কিন্তু এখনও তাহাতে পূর্ণাহুতি পড়ে নাই। কিন্তু তিনি পুরুষমানুষ, সাত-পাঁচ ভাবিয়া বৈশাখে বিবাহ দিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। ফাৰ্জুন ও চৈত্র দুই মাস জমিদারদের দারুণ ঝাটের সময়। বাকিবকেয়া আদায়, বৎসরান্তে আখেরী হিসাবনিকাশ লইয়া মাথা তুলিবার অবসর থাকে না। সেই সব ঝঞ্জাট মিটাইয়া তিনি বৈশাখে বিবাহ দিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন।
কিন্তু হেমাঙ্গিনী কিছুতেই শুনিবেন না, বলিলেন, বোশেখ মাস গরমের সময়, গা প্যাচ-প্যাচ করবে ঘামে–
বাধা দিয়া রায় হাসিয়া বলিলেন, আমি নিজে তোমার পাংখা-বরদার হব। পাখা নিয়ে পেছনে পেছনে বাতাস করে ফিরব, তা হলে হবে তো?
না। খেয়ে-দেয়ে কোথায় কার বদহজম হবে—
বাড়িতে একটা ডাক্তার আমি বসিয়ে রাখব, খাওয়ার পর প্রত্যেককে একদাগ হজমী ওষুধ দেওয়া হবে।
হেমাঙ্গিনী রাগ করিয়া উঠিয়া গেলেন, যাইবার সময় বলিলেন, ছেলের মায়ের মতটা তো মানতে হবে। যত খাতিরই তোমাকে সুনীতি করুক, তুমি মেয়ের বাপ, সে ছেলের মা।
রায় হাসিয়া পাঁজি খুলিয়া বসিলেন।
ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহেই বিবাহের দিন পাওয়া গেল, শুক্লা ত্রয়োদশী তিথি। রায় উৎসব-আয়োজনের ত্রুটি রাখিলেন না; গ্রামস্থ লোক, প্রজা সজ্জন সমস্ত নিমন্ত্রিত হইল।
সাঁওতালদেরও সমস্ত দলটিকে বরযাত্রী যাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করা হইল। কিন্তু তাহারা কেহ আসিল না।
অচিন্ত্যবাবু আসিয়াছিলেন, তিনি ফিসফিস করিয়া বলইলেন, বারণ করে দিয়েছে মশায়। যে আসবে, তার জরিমানা হবে।
চক্রবর্তী-বাড়ির নায়েব বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, বারণ করে দিয়েছে! কে? জরিমানাই বা কে করবে শুনি?
মুখার্জি সাহেব-মিস্টার মুখার্জি।
নায়েব গম্ভীরভাবে ডাকিল, কে রয়েছিস রে, বাগদী পাইকদের ডাক্ তো এখানে।
অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, ঠকবেন মশায়, ঠকবেন। এমন কাজটি করবেন না। সাঁওতালদের প্রজাই-স্বত্ব এখন মুখার্জি সায়েবের। তারা এখন মুখার্জি সায়েবের প্রজা। আপনাদের প্রজা হল মুখার্জি সায়েব, সাঁওতালরা মুখার্জি সায়েবের প্রজা, মজুর, আশ্রিত, তিনিই এখন ওদের মা-বাপ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সব।
কথাটা অহীন্দ্রের কানেও উঠিল। বরবেশে চতুর্দোলে বসিয়া, কুঞ্চিত ললাটে সে জ্যোৎস্নার আলোকে আলোকিত চরখানির দিকে চাহিয়া দেখিয়া, গভীর বেদনা অনুভব করিল। দলিলের কৌশলে সাঁওতালদের বিচিছন্ন করিয়া লইল। জাল দলিলে মানুষ বিকাইয়া গেল।
রাঙা ইঁটের তৈয়ারী সুদীর্ঘ চিমনিটা শাসনরত তর্জনীর মত উদ্যত হইয়া আছে।
ও-দিকে সংবাদটা শুনিয়া ইন্দ্র রায় সারাদিনের উপবাসে পরিশ্রমে ক্লান্ত দেহখানিকে টানিয়া মুহূর্তে সোজা হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলিবার বা করিবার পূর্বেই হেমাঙ্গিনী আসিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, আজ তুমি কিছু করতে পাবে না, আজ আমার উমার বিয়ে।
.
২৯.
ইন্দ্র রায় বউভাত উপলক্ষ করিয়া আবার সাঁওতালদের নিমন্ত্রণ করিলেন।
কিন্তু সে নিমন্ত্রণও সাঁওতালরা গ্রহণ করিতে সাহস করিল না। শুভার্থী সকলেই নিষেধ করিয়াছিল, হেমাঙ্গিনী বার বার বলিয়াছিলেন, দেখ আমি বারণ করছি, ও তুমি করো না। বিয়ের রাত্রে যখন আসতে দেয় নি ওদের, তখন আবার নেমন্তন্ন করে বেচারাদের বিপদে ফেলা কেন? ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।
সুনীতি সকরুণ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিয়াছিলেন, ঝগড়া বিবাদ করে কাজ নেই দাদা।
ইন্দ্র রায় কাহারও কথায় কর্ণপাত করিলেন না, চোখ বুঝিয়া গভীর চিন্তায় কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া ধীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া অনুরোধ অস্বীকার করিলেন, বলিলেন, উলুখাগড়ার প্রাণ যায় বলে দুঃখ করছ, কিন্তু ও মিথ্যে দুঃখ। এমনি ভাবে মরবার জন্যেই উলুখাগড়ার সৃষ্টি। তিনি হাসিলেন।
হেমাঙ্গিনী, সুনীতি দুজনেই ইন্দ্র রায়ের হাসির ভঙ্গি দেখিয়া নীরব হইয়া রহিলেন; ক্ষুরের মতই ক্ষুদ্ৰপরিসর এবং মর্মান্তিক তীক্ষ্ণধার সে হাসি। ধীরে ধীরে সে হাসিটুকু রায়ের মুখ হইতে মিলাইয়া গেল। গম্ভীরভাবে আবার বলিলেন, এ-সংসারে যার ইজ্জত নেই, তার জাত নেই। এ হল চক্রবর্তী-বাড়ি রায় বাড়ির ইজ্জত নিয়ে কথা, এ ব্যাপারে তোমরা কথা বলো না।
তিনি ও-পারের চরে নিমন্ত্রণ পাঠাইলেন, শুধু সাঁওতালদের নিকটই নয়, চরের সকলের নিকট- এমন কি বিমলবাবুর নিকট পর্যন্ত। নিমন্ত্রণ লইয়া গেল একজন গোমস্তা ও একজন পাইক। বিমলবাবু ব্যাতীত সকলের নিকট মৌখিক নিমন্ত্রণই পাঠানো হইল, কেবল বিমলবাবুর নিকট পাঠানো হইল একখানি পত্র।
চূড়া মাঝি বিব্রত হইয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; অন্যান্য সাঁওতালরা নীরব চিন্তান্বিত মুখে চূড়ার দিকে চাহিয়া রহিল, মুখরা মেয়েগুলি শুধু মৃদুস্বরে আপনাদের মধ্যে দুই-চারিটা কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিল।
গোমস্তাটি বলিল, যাস যেন সব, বুঝলি?
এতক্ষণে চূড়া বলিল, কি করে যাব গো বাবু? দু বেলা খাটতে হচ্ছে যি সাহেবের কলে।
গোমস্তা একটু হাসিয়া বলিল, ভাল। যাস নে তা হলে। আর কোন কথা না বলিয়া সে চলিয়া আসিল। কিছুদূর সে আসিয়াছে এমন সময় পিছন হইতে চূড়া তাহাকে ডাকিল, বাবু মশায়! গোমস্তাবাবু!
কি?
বাবু মশায়, সায়েব যি রাগ করেছে গো, বুলছে-তুদের বাড়ি গেলে পরে ইখান থেকে তাঁড়িয়ে দেবে।
আচ্ছা, তাই বলব আমি কর্তাবাবুকে।
চূড়ার বুক ভয়ে কাঁপিয়া উঠিল, সে বলিল, না গো বাবু মশায়; তা বুলিস না গো; সায়েব রাগ করবে গো।
গোমস্তা কোন উত্তর দিল না, অতি অবজ্ঞা ও ঘৃণার হাসি হাসিয়া সে চলিয়া গেল। চূড়া হতভম্বের মত দাঁড়াইয়া রহিল, ভয়ে তাঁহার পা দুইটি ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে; আঃ, কেন এ কথাটা সে উহাকে বলিল?
সাঁওতালরা আসিল না।
শুধু আসিল না নয়, সন্ধ্যা হইতেই চরের বুকে মাদল, করতাল ও বাঁশীর সমবেত ধ্বনিতে একটি উৎসবের বার্তা ঘোষণা করিয়া দিল। বিমলবাবু পাকা ব্যবসায়ী লোক; এই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিতে সাঁওতালদের মনঃক্ষুণ্ণতার কথা তিনি বেশ বুঝিয়াছিলেন। তিনি অপরাহ্নে তাহাদের ডাকিয়া প্রচুর পরিমানে মদের এবং দুইটা শূকরের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন, বলিলেন খুব নাচগান করতে হবে তোদের।
হাঁড়িয়ার কথা শুনিয়া প্রথমটা কেহ উৎসাহ প্রকাশ করিল না, চুপ করিয়া এ উহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
বিমলবাবু ব্যাপার বুঝিয়াও কোন কথা বলিলেন না, একেবারে অ্যাকাউন্ট্যান্ট অচিন্ত্যবাবুকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, একখানা দশ টাকার ভাউচার করুন তো। সাঁওতালদের বকশিশ। আর মদের দোকানের ভেণ্ডারকে একখানা স্লিপ লিখে দিন, সাঁওতালদের যে যত মদ খেতে পারে মদ দেয় যেন-আপ-টু-টেন রুপীজ।
টাকাটা হাতে পাইয়া সাঁওতালদের মন ঈষৎ চাঙ্গা হইয়া উঠিল। তারপর মদের দোকানে আসিয়া তাহারা পরস্পরের মধ্যে খানিকটা জোর তর্ক আরম্ভ করিয়া দিল; কেহ কাহারও কথার প্রতিবাদ করিতেছিল না, অথচ উত্তেজিত কলরবে তুমুল তর্ক। সকলেই বলিতেছিল।
রাঙাবাবু কি বুলবে?
উয়ার শ্বশুরটি? বাবা রে বাঘের মতন তাকানি উয়ার। উ কি বুলবে?
রাগ করবে, ধরে লিয়ে যাবে। তখুন কি হবে?
ইধরে সায়েব রাগ করছে। বাবা রে, উ তো কম লয়। উয়ার আবার বন্দুক আছে, মেরে ফেলাবে গুলি দিয়ে।
এই তর্কের মধ্যেই মদ আসিয়া পৌঁছিল। কিছুক্ষণ পর তাহাদের তর্ক ভীষণাকার ধারণ করিল, উচ্চকণ্ঠে আস্ফালন করিয়া সকলেই বলিতেছিল, কি করবে রাঙাবাবুর শ্বশুর আমাদের? আমরা উয়াকে মানি না।
আমাদের সায়েব রইছে, উয়াকেই আমরা মানব, হেঁ।
অতঃপর মেয়েদের জন্য প্রকাণ্ড জালাতে করিয়া মদ লইয়া তাহারা পাড়ায় ফিরিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাদল-করতাল-বাঁশী বাজাইয়া প্রচণ্ড উৎসাহে নাচগান জুড়িয়া দিল।
ও-দিকে বউভাতের খাওয়ান-দাওয়ানের জের তখনও মেটে নাই, তবে প্রধান অংশ শেষ হইয়া আসিয়াছিল। ইন্দ্র রায় এখন কেবল পরিবেশনকারীর দল ও ঠাকুর-চাকরদের খাওয়ানোর তদারক করিতেছেন। মাদল-করতাল-বাঁশীর উচ্ছ্বসিত ধ্বনি আসিয়া কানে প্রবেশ করিতেই তিনি গম্ভীর হইয়া উঠিলেন। মনে মনে ব্যাপারটা তিনি অনুমান করিয়া লইলেন।
অমল কর্মান্তরে ব্যস্ত ছিল, তাহাকে ডাকিয়া খাওয়ান-দাওয়ানের ভার দিয়া তিনি রামেশ্বরের ঘরের গিয়া প্রবেশ করিলেন। রামেশ্বর খোলা জানলায় দাঁড়াইয়া কৃষ্ণা-দ্বিতীয়ার প্রায়-পূর্ণচন্দ্রের পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় আলোকিত উন্মত্ত সঙ্গীত-মুখর ওই চরটার দিকেই চাহিয়া ছিলেন।
রায় ডাকিলেন, রামেশ্বর!
রামেশ্বর চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, কে?
আমি ইন্দ্র।
ইন্দ্র! এস, এস ভাই। খাওয়া-দাওয়ান সব হয়ে গেল?
হ্যাঁ। আমি নিজে দাঁড়িয়ে সব শেষ করে তোমার কাছে আসছি। যারা কাজকর্ম করেছে, তারাই খাচ্ছে। এখন; অমল দাঁড়িয়ে দেখছে সেখানে।
রামেশ্বর অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া ডাকিলেন, বউমা! বউমা!
রায় হাসিলেন, উমার শ্বশুর উমাকে ডাকিতেছেন! বধূবেশিনী উমা আসিয়া ঘরে ঢুকিয়া বাবাকে দেখিয়া একটু হাসিল, হাসিয়া শ্বশুরের কাছে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে বলিল, আমাকে ডাকছিলেন?
রামেশ্বর বলিলেন, হ্যাঁ রে বেটী, হ্যাঁ। আমার মা হয়ে তোর কোন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই! দেখছিস না, কে এসেছেন! সমস্ত দিন তোর বাড়িতে খাটলেন, এখনও মুখে জল দেন নি। দে, হাত-পা-মুখ ধোবার জল দে। খাবার জায়গা করে দে। এ ঘরে নয়, অন্য ঘরে-অন্য ঘরে। চকিত তাঁহার দৃষ্টি একবার আপনার হাত দুইখানির দিকে নিবদ্ধ হইয়া আবার ফিরিয়া আসিল।
রায় হাসিয়া বলিলেন, হাত-মুখ আমি ধুয়েছি; খাবার জায়গা করতে নেই, ও থাক!
চকিত হইয়া রামেশ্বর প্রশ্ন করিলেন, কেন, ইন্দ্র খাবার জায়গা করতে নেই কেন?
তুমি একটা মূর্খ। রায় হাসিয়া বলিলেন, কাকে কোলে করে খেতে বসব? দাঁড়াও আমার দাদুভাইয়ের আগমন হোক, তবে তো!
বার বার ঘাড় নাড়িয়া রায়ের কথা স্বীকার করিয়া রামেশ্বর বলিলেন, বটে, বটে। তুমি যেদিন দাদুভাইকে কোলে নিয়ে খেতে বসবে ইন্দ্র, সেদিন যে আমার ঘরের কি শোভাই হবে হে, আমি কল্পনাই করতে পারছি না। কবি কালিদাসও এর উপমা দিয়ে যান নি। কুমার কার্তিকেয়কে গিরিরাজের কোলে দিয়ে তিনি দেখেন নি। সূর্যবংশের রাজারা তো পুত্র উপযুক্ত হলে আর গার্হস্থ্যাশ্রমে থাকতেন না। আমাকেই একটা শ্লোক রচনা করতে হবে দেখছি।
উমা একালের মেয়ে হইলেও বাঙালীর মেয়ে- সে লজ্জায় ঘামিয়া উঠিতেছিল। লজ্জায় রক্তোচ্ছ্বাসে তাহার সুন্দর মুখের প্রসাধন-শুভ্রতাও রক্তাভ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার উপর সারাটা মুখ ভরিয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম। ইন্দ্র রায় তাহাকে পরিত্রাণ দিলেন, তিনি বলিলেন, উমা, যা মা, তোর শাশুড়ির খাওয়া-দাওয়া হল কিনা দেখ। তোর মাকেও বল্, একটু তাড়াতাড়ি সেরে নিতে।
উমা পলাইয়া আসিয়া যেন বাঁচিল, ঘর হইতে বাহির হইয়া দরদালানের নির্জনতায় আসিয়া পুলকিত সলজ্জ হাসিতে তাহার মুখ ভরিয়া উঠিল।
বাড়িতে বাহিরের দিকের টানা বারান্দায় রেলিঙের উপর মাথা রাখিয়া সুনীতি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ হইয়া গেলে তিনি অবসর পাইয়া কাঁদিতে আসিয়া ছিলেন মহীনের জন্য।
তাঁহার মহীন-দীর্ঘদেহ, সবলপেশী, উদ্ধতদৃষ্টি, উন্নতিশির মহীন্দ্র।
প্রথমে তো তাহারই বধূর কল্যাণঘট কাঁখে করিয়া এ-ঘরে প্রবেশ করিবার কথা। অহীন্দ্রের বিবাহে, তাহারই দৃপ্ত উচ্চ আদেশ-ধ্বনিতে এ-বাড়ির প্রতিটি কোণ মুখরিত হইয়া থাকিবার কথা।
এ সর্বনাশ না হইলে হতভাগ্য ননী পালও আজ এ বাড়িতে খাইয়া হাসিমুখে বলিত, আঃ খুব খেলুম বাপু।
বেচারা নবীন বাগদী আর তাহার সঙ্গী কয়েকজনকে তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। সেই অজানা মুসলমান। লাঠিয়ালটি যে নবীনের লাঠির আঘাতে মরিয়াছে, সে থাকিলে সেও আজ আসিয়া বকশিশ হইয়া যাইত, লুচি মিষ্টি খাইয়া যাইত।
একটা সুগভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সুনীতি চন্দ্রালোকিত চরটার দিকে চাহিলেন। আজও সাঁওতালরা খাইতে আসে নাই; কলের মালিকও খাইতে আসেন নাই; ও-বাড়ির দাদার মুখ থমথমে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপর মাদল-করতাল-বাঁশী বাজাইয়া এ উহারা করিতেছে কি? না না না, এটা উহারা বিষম অন্যায় করিতেছে। স্তব্ধ হইয়া তিনি চরটার দিকে চাহিয়া রহিলেন। এত উচ্চ রূঢ় বাজনা কখনও বাজে না। বিরোধ বাধাইতে উহারা কি বদ্ধপরিকর হইয়া উঠিয়াছে? ডঙ্কা বাজাইয়া চরটা যেন যুদ্ধ ঘোষণা করিতেছে! আতঙ্কে তিনি শিহরিয়া উঠিলেন। পায়ের তলায় বাড়িটা যেন দুলিয়া উঠিল, চোখের সম্মুখে চরটা ঘুরিতেছে।
উমা আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইল।
সুনীতি মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিলেন, উমা? বউমা?
অন্ধকারের মধ্যে মৃদু হাসিয়া উমা বলিল, আপনি খাবেন আসুন মা। পরক্ষণেই এই গিন্নীপনার জন্য লজ্জা অনুভব করিয়া সে বলিল, মা নীচে ডাকছেন আপনাকে। এই মা অর্থে তাহার মা হেমাঙ্গিনী।
সুণিতি যেন উদ্ভ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। বিচলিত মস্তিষ্কের রক্তের চাপে স্নায়ু-শিরার চাঞ্চল্যে চরটাকে তিনি ঘুরিতে দেখিয়াছেন! এই মাদল ও করতালের উচ্চ ধ্বনির মধ্যে তিনি যুদ্ধোদ্যমের ঘোষণা শুনিয়াছেন, তাঁহার ধরিত্রীর মত সহিষ্ণু মনও আজ থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। এই মুহূর্তেই সমুখে বধূকে দেখিয়া সে কম্পন-চাঞ্চল্য যেন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। অহীন্দ্রের জন্য তিনি ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন, কোনমতেই তাহাকে সঙ্ঘর্ষের সম্মুখীন হইতে তিনি দিবেন না। যেমন করিয়া হউক তিনি নিবারণ করিবেন। ও-বাড়ির দাদার পায়ে তিনি উমাকে ফেলিয়া দিবেন। অহীন্দ্রের গৃহদ্বারে দুই বাজুতে হাত দিয়া পথরোধ করিয়া তিনি নিজে দাঁড়াইবেন।
উমা আবার ডাকিল, মা?
উত্তরে সুনীতি প্রশ্ন করিলেন, অহীন কোথায় বউমা?
উমা লজ্জিত হইয়া চুপ করিয়া রহিল। সুনীতি উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই বাহির হইয়া গেলেন।
অহীন্দ্র পড়ার ঘরে বসিয়া ছিল। একখানা মোটা বইয়ের মধ্যে আঙুল পুরিয়া মানদার মুখের দিকে চাহিয়া হাসিমুখে তাহার তিরস্কার শুনিতেছিল।
মানদা তাহাকে তিরস্কার করিতেছিল, না বাপু, এ কিন্তু আপনার ভাল কাজ নয় দাদাবাবু, সে আপনি যাই বলুন-হ্যাঁ। আজকে হল মানুষের জীবনের একটা দিন। আজ পাঁচজনা মেয়েছেলে এসেছে, ঠাট্টা-তামাসা করবে, গান করবে, ছড়া কাটবে, আপনার গান শুনবে সব। ফুলশয্যের দিন। আর আপনি ইয়া মোটা বইয়ের ভিতর মুখ গুঁজে বসে রয়েছেন।
অহীন্দ্র কোন উত্তর দিল না, মৃদু হাসিমুখেই তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। মানদা কোন উত্তর না পাইয়া আবার বলিল, বলি, উঠবেন কি না, বলুন? উঠে আসুন, কাপড় ছাড়বেন, মেয়েরা সব গজগজ করছে।
সুনীতি আসিয়া প্রবেশ করিলেন, মানদা অভিযোগ করিয়া বলিল, এই দেখুন, আজকের দিনে একখানা মোটা বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে বসে রয়েছেন। এলাম যদি, তা মানুষের খেয়াল নাই। কি রস যে ওই কালির হিজিবিজির মধ্যে আছে, কে জানে বাপু!
সুনীতি বলিলেন, চল্ তুই মানদা, আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে।
মানদা ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, নাও হল! আপনি আবার ধর্মকথা আরম্ভ করুন এখন এক পহর! ও দিকে মেয়েরা সব চলে যাক।
না রে, না। চল্ তুই, আমি এলাম বলে ওকে নিয়ে। এই উদ্ভ্রান্ত মনেও সুনীতি মানদার স্নেহের শাসনে হাসিয়া আনুগত্য না জানাইয়া পারিলেন না।
অহীন্দ্রও মনে করিল সুনীতি তাহাকে ডাকিতেই আসিয়াছেন, সে বইখানার মধ্যে সুদৃশ্য কাগজের লম্বা টুকরা দিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিল, বলিল, যাচ্ছি মা আমি। তারপর মৃদু হাসিয়া বলিল, বইখানা বড় ভাল বই, পড়তে বসে আর ছাড়তে ইচ্ছে যায় না।
কি বই রে?
পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ট মনীষীর লেখা মা, জাতিতে তিনি জার্মান, তাঁর নাম কার্ল মাক্স। আমরা যাঁদের বলি ঋষি, তিনি তাই। পৃথিবীর এই যে ছোট-বড় ভেদাভেদ, কোটি কোটি লোকের দারিদ্র আর মুষ্টিমেয় ধণীর বিলাস, রাজ্যসম্পদ নিয়ে এই যে হিংস্র পশুর মত মানুষের কাড়াকাড়ি, তিনি তার কারণ নির্ধারণ করেছেন এবং নিবারণের উপায়-পথ নির্দেশ করে দিয়েছেন।
সুনীতি মুগ্ধবিস্ময়ে ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। পৃথিবী জুড়িয়া সম্পদ লইয়া কাড়াকাড়ি, মানুষে মানুষে হিংসা দ্বেষ, কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র-নিবারণের উপায়। কয়েক মুহূর্ত পর তিনি অভিভূতের মত বলিলেন, সে-উপায় তবে কেন মানুষ নেয় না, অহী?
অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, সে-পথে বাধার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে জমিদার আর ধনীর দল মা- আমরা, ওই বিমলবাবু। আমার এই প্রভুত্ব, এই পাকা বাড়ি, জমিদারী চাল, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তা হলে যে থাকবে না মা। সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি যা করি, আমরাই তো করি, নিরীহ গরীবের সম্পত্তি অর্থ কেড়ে নিয়ে আমরাই তো তাদের গরীব করে দিই। ওই চরটার কথা ভাল করে ভেবে দেখ, তা হলেই বুঝতে পারবে। চর উঠল নদীর বুকে, একেবারে নতুন এক টুকরা মাটি
সুনীতি মধ্য পথেই বাধা দিয়া বলিলেন, আমি ওই চরের কথাই তোকে বলতে এসেছি অহি। চর নিয়ে যে আবার বিরোধ বেধে উঠল বাবা।
অহীন্দ্র হাসিল, স্বল্পায়তন তিক্ত হাসি। বলিল, বিরোধ তো বাধবেই মা। একদিকে জমিদার অন্যদিকে মহাজন। এ বিরোধ যে অবশ্যম্ভাবী।
সুনীতি আর্তভাবে বলিলেন, ওরে, ও-চরে আমাদের কাজ নেই, তুই বল্ তো শ্বশুরকে, ওটা বিক্রি করে দিন। ওই চর আমার সর্বনাশ করবে রে!
অহীন্দ্র বলিল, ও-কথাটা তোমার স্বীকার করতে পারলাম না। অপরাধ চরের নয়, অপরাধ আমাদের।
তুই জানিস নে অহীন, সে তোরা বুঝতে পারিস নে, সে তোরা দেখতে পাস নে। আমি বুঝতে পারি, দেখতে পাই-সুনীতি বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন, যেন সে দৃষ্টির সম্মুখে চরটার রহস্যময় রূপ প্রত্যক্ষ হইয়া শূন্যলোকে ভাসিতেছে।
মায়ের সে ভয়কাতর বিবর্ণ মুখ দেখিয়া অহীন্দ্র স্নেহার্দু স্বরে বলিল, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন মা? কিসের ভয়?
ওরে তুই বল চরটা বিক্রি করে দেওয়া হোক। আর, তুই যেন এই দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্যে যাস নে বাবা। ওরে, তোদের বংশের রাগকে আমি বড় ভয় করি রে! রাগের বসে মহীন কি সর্বনাশ করলে, বল দেখি?
অহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল ৷ তাহার চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল ননী পালের রক্তাক্ত দেহ। তারপরেই সে দেখিল, কাঠগড়ার মধ্যে তাহার দাদাকে, শীর্ণ কিন্তু দৃপ্ত মুখ, অনবনত ঋজু দেহ। একটা উন্মাদনা তাহাকে স্পর্শ করিল। ওই কুটিলচক্রী কলওয়ালা, যাহাকে সাঁওতাল রমণীরা বলিয়াছে পাহাড়ে চিতি, নিষ্ঠুর অজগর, উহার দেহটা যদি সে এমনি ভাবে লুটাইয়া দিত।
সুনীতি কাতরস্বরে ডাকিলেন, অহীন!
অহীন্দ্র মায়ের মুখের দিকে চাহিল। সুনীতি বলিলেন, চল, তুই একবার চল, তোর বাপ ও-বাড়ির দাদা বোধ হয় ওই চরের কথাই বলছেন। তুই চল্।
রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিয়া মাতা পুত্রে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। রামেশ্বরের সে মূর্তি অদ্ভুত! অহীন্দ্র জীবনে কখনও দেখে নাই, সুনীতি বহুপূর্বে দেখিয়াছিলেন, এ-কালে সে মূর্তি আর স্মরণেও আনিতে পারিতেন না। ন্যুব্জদেহ তিনি সোজা খাড়া করিয়া দাঁড়াইয়াছেন লোহার খুঁটির মত শীর্ণ হাতের আঙুলগুলি বাঁকাইয়া তীক্ষ্ণ দৃঢ় বাঘনখের মত ভংগি করিয়া রায়কে তিনি বলিতেছেন, মুণ্ডুটা তার ছিঁড়ে আনতে পারা যায় না ইন্দ্র, কিংবা আমাবস্যার রাত্রে মা-সর্বরক্ষার কাছে বলি-?
রায় বলিলেন, না। সে-কাল আর নেই রামেশ্বর; এখন আমাদের আইনের পথ ধরেই চলতে হবে। আইন বাঁচিয়ে দাঙ্গা করতে পেলে পেছব না। আমাদের খাসের জমি, সেগুলো সাঁওতালদের ভাগে দেওয়া আছে, কালই সেগুলো দখল করতে হবে। সাঁওতালদেরও রীতিমত শিক্ষা দেব আমি। আর ওই যে বললাম, কালিন্দীর বুকে কলওয়ালা যে বাঁধ দিয়ে পাম্প বসিয়েছে, ওটাকে তুলে দিতে হবে। বাধবে, দাঙ্গা ওইখানেই বাধবে বলে বোধ হচ্ছে।
অহীন্দ্র বলিল, মা একটা কথা বলছেন। তিনি চান না যে, চর নিয়ে কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। তাঁর একটা অদ্ভুত সংস্কার রয়েছে যে, চরটা থেকে কেবল আমাদের অমঙ্গলই হচ্ছে! সেইজন্য তিনি বলেছেন, চরটাকে বিক্রি করে দেওয়া হোক।
বজ্রগর্ভ স্বরে রামেশ্বর বলিলেন, না।
প্রচণ্ড উত্তেজনায় দৈহিক দুর্বলতা মানসিক বিহ্বলতা বিলুপ্ত হইয়া রামেশ্বর অকস্মাৎ যেন পূর্ব-রামেশ্বর হইয়া উঠিয়াছেন।
রায় বলিলেন সুনীতিকে লক্ষ্য করিয়া, তোমার কাছে আমি এই কথাটা শুনব প্রত্যাশা করি নি বোন। যাক, তুমি কোন ভয় করো না, যা করবার আমি করব।
ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতেই অমলের সঙ্গে দেখা হইল, অমল হাত-পা ধুইয়া তাহার সন্ধানেই উপরে আসিয়াছিল। তাহার স্বাভাবিক মুখরতা আজ আবার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছে। সে বলিল, বাপ রে বাপ রে, খুব খাঁটিয়ে নিলে যা হোক। আমার বিয়েতে আমি এর শোধ নেব, দাঁড়াও না।
অহীন্দ্র একটু হাসিল-অর্থহীন হাসি। অমলের কথাগুলি তাহার মনের মধ্যে প্রবেশ করিতে পায় নাই। সে বলিল, চর নিয়ে আবার দাঙ্গা বাধল- কাল সকালে।
অমল বলিল, দাঙ্গা-টাঙ্গা না করে ওই লোকটাকে- দ্যাট কলওয়ালাটাকে হুইপ করা উচিত।
অহীন্দ্র আবার একটু হাসিল। অমল বলিল, বিয়েটা না চুকতেই এখনই দাঙ্গাটাঙ্গাগুলো না করলেই হত। কিন্তু না করেই বা উপায় কি? লোকটা যেন দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে উঠেছে।
অহীন্দ্র হাসিয়া এবার বলিল
বণিকের মানদণ্ড দেখা দিবে, পোহালে শর্বরী
রাজদণ্ডরূপে।
সুতরাং তার গতিরোধের চেষ্টা রাজকুলের স্বাভাবিক।
অমল হাসিয়া বলিল, তুমি যেন নিজেকে রাজকুল থেকে বাদ দিতে চাইছ মনে হচ্ছে। বুদ্ধদেব হয়ে উঠলে যে! ওরে উমা!
হাসিয়া বাধা দিয়া অহীন্দ্র বলিল, ভয় নেই, এ-যুগে গৌতমেরা সংসার ত্যাগ করে নির্বাণের জন্য বনে যান না। এ-যুগের নির্বাণ নিহিত আছে সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে। ঘরে বসেই সে তপস্যা করে। সুতরাং উমা নামধারিণী গোপাকে ডেকে সাবধান করার কোন প্রয়োজন নেই।
.
৩০.
পরদিন প্রভাতেই জমিদার পক্ষ সাজিয়া চরের উপর হাজির হইল, সাঁওতালদের ভাগে বিলি করা জমি দখল করা হইবে।
জমিদার পক্ষকে মোটেই বেগ পাইতে হইল না। লোক জুটিয়া গেল বিস্তর। আদেশ অথবা অনুরোধ। করিয়াও লোক ডাকিতে হইল না। আপনা হইতেই গ্রামের সমস্ত চাষী হাল-গরু লইয়া ছুটিয়া আসিল, দলের সর্বাগ্রে আসিল রংলাল। চরের উর্বর মাটির উপর লোভের নিবৃত্তি তাহাদের কোন দিনই হয় নাই। নিরুপায়ে সে কেবল নিরুদ্ধ হইয়া ছিল। সংবাদটা পাইবামাত্র তাহারা পুলকিত হইয়া সাঁওতালদের সযত্নে গড়ে তোলা জমিগুলি দখল করিতে উদ্যত হইল। বাগদীপাড়ার নবীনের দল এবং রায়েদের লাঠিয়ালের দল লাঠি হাতে চক্রবর্তী-বাড়ির ভাগে বিলি জমির সীমানার মাথায় খুঁটি পুঁতিয়া দাঁড়াইল। চাষীরা বিপুল উৎসাহে গরুগুলিকে প্রচণ্ড চীৎকারে তাড়না করিয়া জমিগুলির উপর লাঙ্গল চালাইয়া দিল-হেৎ-তা-তা-তা-তা- তা-হেৎ-হেৎ!
সাঁওতালদের পুরুষের দল আপনাদের পাড়ার প্রান্তভাগে বসিয়া উদাস বিষণ্ণ দৃষ্টিতে শক্তিমত্ত দখলকারী জনতার দিকে নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল। পিছনে মেয়েদের দল শুধু ব্যাকুল হইয়া কাঁদিল। কেহ কেহ গালি পাড়িতেছিল আপনাদের পুরুষদের, কেন মিছামিছি রাঙাবাবুদের সহিত বিবাদ করিলি তোরা? এ তোদের উপযুক্ত হইয়াছে, ঠিক হইয়াছে। সায়েব ওদিকে জমি কাড়িয়া লইয়াছে, এ-দিকে রাঙাবাবুরা জমি কাড়িয়া লইল, এইবার কি করবি কর! মরিতে হইবে না, না খাইয়া শুকাইয়া মরিতে হইবে।
এক বৃদ্ধা আক্ষেপ করিয়া বলিল, আমি তখুনি বললম গো, তুরা চিবাস মোড়লের কাছে লিস না, ধান। ধার তুরা লিস না। ‘কাই হড়’ (পাপী লোক) বেটে উ! হিঁদু সাউয়েরা পুরানো বাঘ বেটে। হাডিড তাকাত চিবায়ে খাবে উ। লে ইবার হল তো! আঃ, হায় হায় গো!
একজন বলিল উয়ার কি দোষ হল? উ কি করবে?
দোষটি কার হল? উ নোকটি যদি সায়েবকে খতগুলান বেচে না দিথো, তবে সায়েব কি করে জমিগুলান লিথো? কি করে জমিদার হথো উ?
একটি তরুণী বলিল, হেঁ! তা হলে রাঙাবাবুর বিয়েতে যেতে কি করে মানা করত?
চূড়া মাঝির স্ত্রী এবং আর কয়েকজন মাতব্বর মাঝির স্ত্রী অঝোরঝরে কাঁদিতেছিল, মৃদুস্বরে বিলাপ করিতেছিল, আঃ-আঃ, হায় হায় গো! সব জমিনজেরাত চলে গেল গো! এখুন যে পরের দুয়ারে চাকর খাটতে হবে গো! লইলে ভিখ মাগতে হবে গো! গুগা (বোবা) ভিস্থ করে গো! কাঁড়া (অন্ধ) ভিস্থ করে গো! লেঢ়া (খোঁড়া) ভিস্থ করে গো! উয়াদিগে যেমন লোকে থো (থুথু) দেয়, তেমনি করে থো খেতে হবে, হায় হায় গো! হায় হায় গো!
বাগদী লাঠিয়ালেরা প্রতিদ্বন্দীর অভাবে শূন্যের সহিত লড়াই জুড়িয়া দিল। অকারণে লাঠি ঘুরাইয়া, হাক মারিয়া, কুক দিয়া তাহারা যেন তাণ্ডবে মাতিয়া উঠিল। আসিয়াছিল তাহারা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীতার সম্ভাবনায় সতর্ক ধীরতার সহিত সংযত পদক্ষেপ; কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে উজ্জ্বল উল্লাস আত্মপ্রকাশ করিল বাধ-ভাঙা জলের মত। জমির উপরে লাঙলগুলাও এলোমেলো গতিতে যেন ছুটিয়া বেড়াইতেছিল। চাষীরা সব উল্লাসে গরুগুলিকে ছুটাইয়া যেন গরু-দৌড় প্রতিযোগীতা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সমগ্র ভূমিখণ্ডটাকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া তাহারা দখল সম্পূর্ণ করিল।
রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির দুই নায়েবও উপস্থিত ছিল। এই মাতনের ছোঁয়া তাহাদিগকেও স্পর্শ করিয়াছিল। তাহারা দৃপ্ত উল্লাসে এইবার হুকুম দিল, কাট এইবার কালিন্দীর বাঁধ। পাইপ-টাইপ সব উখার দেও। উত্তেজনায় খানিকটা হিন্দীও বাহির হইয়া গেল।
লাঠিয়ালের দল গিয়া পড়িল বাধের উপর; এইবার তাহারা একটু সতর্ক এবং সংযত হইল। কলের কুলির দল অদূরে জটলা বাঁধিয়া বসিয়া আছে।
আশ্চর্যের কথা তাহারা কেহ আগাইয়া আসিল না। ইহারা বাঁধ কাটিয়া পাইপ ছাড়াইয়া তছনছ করিয়া দিল, তাহারা দর্শকের মত দাঁড়াইয়া দেখিল মাত্র। জনতা হইতে দূরে একটি গাছতলায় একা দাঁড়াইয়া একটা দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়েও সমস্ত দেখিতেছিল। এ-সবের কোন কিছুই তাহাকে স্পর্শ করিল না, এ-সমস্তের কোন অর্থই তাহার কাছে নাই।
মুখার্জি সাহেব কাল হইতে সারীকে বাংলোর আউটহাউস হইতে তাড়াইয়া দিয়াছেন; তাঁহার শখ মিটিয়া গিয়াছে। কুলী-ব্যারাকের মধ্যে সে এবার বসতি পাতিয়াছে। সরকারবাবু শূলপাণি রায় বাছিয়া বেশ একখানি ভাল ঘরই তাহাকে দিয়াছে। খুব তেজি পাকা হাঁড়িয়াও তাহাকে খাওয়াইয়াছে। তাহার মাথাটা এখনও কেমন করিতেছে। সে শুধু দেখিতেছিল, অনেক লোক; অনেক লোক, বাবা রে! রাঙাবাবু কই? না, সে নাই। সায়েব কই? লম্বা চোঙার মত বন্দুকটা লইয়া সে তো কই তাক্ করিয়া এখনও দাঁড়ায় নাই। বাবা রে!
সত্য সত্যই বিমলবাবু এত বড় উত্তেজিত আহ্বানের উত্তরেও একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। কোন উদ্যমই তিনি প্রকাশ করিলেন না। তিনি যে প্রস্তুত ছিলেন না, তাহাও নয়। সংবাদ তিনি বেশ সময় থাকিতেই পাইয়াছিলেন। পূর্বদিন রাত্রির প্রথম প্রহরেই সংবাদটা তাঁহার কানে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল।
সংবাদ প্রথম আনিয়াছিলেন অচিন্ত্যবাবু। কথাটা কানে উঠিবামাত্র ভদ্রলোক ভীষণ চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। রায় মহাশয় ও চক্রবর্তী-বাড়ির লাঠিয়ালরা তো সামান্য জীব নয়, উহারা প্রত্যেকেই ডাকাত। নবীন বাগদীর এক লাঠির ঘায়ে সেই মুসলমান লাঠিয়ালের মাথাটি ডিমের মত ফাটিয়া গিয়াছিল; ইহারা সব তাহারই সাকরেদ দোসর। ও-দিকে মিস্টার মুখার্জির হিন্দুস্থানী কুলীর দল সাক্ষাৎ যমদূতের দল! তাহার উপর সাহেবের বন্দুকগুলা একেবারে তৈয়ারী হইয়াই থাকে। কোন রকমে তাগ ফস্কাইয়া যদি একটা বিপথে ছোটে, তবে যে কাহাকে খতম করিবে, সে কি বলিতে পারে? হরেকে তাগ করিয়া শঙ্করাকে মারাই বাঙালীর অভ্যাস। আর বাগদী-লাঠিয়ালের দল যদি আপিস চড়াও করে, তবে তো ভীষণ বিপদ! তিনি তৎক্ষণাৎ পরদিন ছুটি লইবার সঙ্কল্প করিলেন এবং সেই রাত্রেই নগদ দুই আনা পয়সা দিয়া একজন ডোম রক্ষক লইয়া বিমলবাবুর বাংলোয় হাজির হইলেন।
বিমলবাবু তখন সারীকে বাংলো হইতে তাড়াইয়া দিয়া সবে পঞ্চম পেগ লইয়া বসিয়াছেন। দ্রুকুঞ্চিত করিয়া তিনি প্রশ্ন করিলেন, কি ব্যাপার? রাত্রে?
একখানা দরখাস্ত আগাইয়া দিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, আজ্ঞে ছুটি সার।
ছুটি? কেন?
আজ্ঞে আমার স্ত্রী-সার
কদিনের জন্যে?
দুদিনের আজ্ঞে, দু দিন সার।
এর জন্যে এই রাত্রে আপনি জ্বালাতে এসেছেন? ননসেন্স! দরখাস্তখানা তিনি ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন, তারপর বলিলেন, আচ্ছা, আসবেন না দু দিন।
অচিন্ত্যবাবু সবিনয়ে বলিলেন, আজ্ঞে, আরও একটা খবর আছে, জমিদারেরা ফৌজদারী করবার জন্যে সাজছে সার।
ফৌজদারী? বিমলবাবু এবার সজাগ হইয়া বসিলেন।
সবিস্তারে সমস্ত বলিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, সেই জন্যেই আমার আরও আসা সার।
বিমলবাবু গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। অচিন্ত্যবাবু সরিয়া আসিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন।
গভীর চিন্তা করিয়া বিমলবাবু কোন উদ্যম প্রকাশ করিলেন না। সকাল হতেই যোগেশ মজুমদার এবং জমিদারবিদ্যা-বিশারদ হরিশ রায়কে লইয়া চার-পাঁচটি ফৌজদারী এবং দেওয়ানী মকদ্দমার আরজির খসড়া প্রস্তুত করাইতে বসিলেন।
ও-দিকে দীর্ঘকাল পরে চক্রবর্তী-বাবুদের কাছারী-বাড়ি গমগম করিয়া জাঁকিয়া উঠিল, চাষী-প্রজার দল ও বাগদী লাঠিয়ালেরা কাছারির বারান্দা পরিপূর্ণ করিয়া বসিল। নায়েব-গোমস্তারা ডেমিতে ভাগচাষের কবুলতি লিখিতেছে; ওই সব দখল-করা জমি চাষীদের ভাগচাষে বিলি হইবে। রায় প্রসন্ন তৃপ্ত মুখে বসিয়া আছেন, তাঁহার মনের গ্লানি অনেকখানি কাটিয়া গিয়াছে। প্রসন্ন মনেই তিনি নূতন কোন দ্বন্দের পরিকল্পনা চিন্তা করিতেছেন। মধ্যে মধ্যে ঘাড় হেঁট করিয়া চিন্তানিবিষ্ট মনে বোধ করি আপনার অজ্ঞাতসারেই মৃদু মৃদু দুলিতেছেন। সহসা একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের উচ্চ ধ্বনি কানে আসিয়া পৌঁছিল, মৃদু হাসিয়া তিনি সজাগ হইয়া উঠিলেন। কণ্ঠস্বরটি অচিন্ত্যবাবুর; কোন ব্যক্তিকে ধরিয়া বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি পথ দিয়া চলিয়াছেন; স্লো অ্যাণ্ড স্টেডি উইনস্ দি রেস। ঈসপ্স্ ফে পড়েছ? দি হেয়ার অ্যাণ্ড দি টটয়েজের গল্প? ইংরেজের আইনে, নো লাঠি অ্যাণ্ড নো ফাটি। ব্রেন অ্যাণ্ড মানি এভরিথিং। পাঁচ-পাঁচ-খানি ফৌজদারী মকদ্দমা। অল বেস্ট প্লীডার্স এগে। সিরিয়াস চার্জ- রায়টিং, ট্রেসপাস, অ্যাণ্ড অনেক কিছু। এই চলল লোক লরিতে চড়ে।
রায় হাসিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিলেন, ও অচিন্ত্যবাবু! ও মশায়!
তাঁহার কথাকে ঢাকিয়া দিয়াই অচিন্ত্যবাবুর ত্বরিত উত্তর ভাসিয়া আসিল, আই ডোন্ট নো এনিথিং আই ডোন্ট নো।
আরও অনেক কিছু তিনি বলিলেন, কিন্তু ক্রমবর্ধমান দূরত্ব হেতু সেগুলি এত অস্পষ্ট যে, তাহার কিছুই বুঝা গেল না। ইন্দ্র রায় কিন্তু এইটুকুতেই অনেক বুঝিলেন এবং খাড়া হইয়া বসিয়া গোঁফে তা দিতে আরম্ভ করিলেন।
মুহূর্ত চিন্তা করিয়া তিনি পাশের ঘরে প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন, মিত্তির!
প্রবীণ মিত্তিরও কথাগুলির কিছু কিছু বুঝিয়াছিল, সে তাড়াতাড়ি কাজ ছাড়িয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। রায় বলিলেন, সদরে যাবার পথে গ্রাম পেরিয়ে যে সাঁকোটা আছে,
পাকা নায়েব মুহর্তে উত্তর দিল, আজ্ঞে, হাঁ। তা হলে আর লরি যেতে পারবে না। আদ্ধেক খানা খসিয়ে দিলেই হবে। সে ব্যবস্থা আমি করছি। আমাদের চাষ-বাড়িতে গাঁইতি আছে, আধ ঘন্টায় কাজ হাসিল হয়ে যাবে।
রায় বলিলেন, সকলের চেয়ে যে ‘পাউড়ে’, তাকে পাঠাও সদরে। মুখুজ্জে, সেন আর সিংহীকে ওকালতনামার বায়না পাঠিয়ে দাও। ওদের চেয়ে ফৌজদারী উকিল আর ভাল কেউ নেই। আমাদের তরফ থেকে মামলা প্রথম দায়ের হয়ে যাক।
নায়েব লঘু দ্রুত পদে বাহির হইয়া গেল।
রায় ফিরিয়া আসিয়া বসিলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার দুলিতে আরম্ভ করিলেন।
বাড়ির ভিতরে বিবাহের গোলযোগ তখনও প্রায় পূর্ণমাত্রায় বর্তমান। বউভাত মিটিয়া গিয়াছে, আজ। বাসি-ভোজ; পরিবেশক, ঠাকুর-চাকর আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনবর্গকে ভাল করিয়া খাওয়ানো হইবে। তাহার সঙ্গে এই দাঙ্গার সমস্ত লোকগুলিকেও খাওয়ানোর ব্যবস্থা হইয়াছে। বিবাহের ভাণ্ডারে গ্রামেরই কয়েকজন পাকা দোকানদার ভাণ্ডারীর কাজ করিতেছে। তাহারা লোক হিসাব করিয়া জলখাবার মাপিতে ব্যস্ত। মানদা চীৎকার করিয়া ফিরিতেছে, বাড়ির মধ্যে দাঙ্গার উত্তেজনাটাকে সে একাই বজায় করিয়া রাখিয়াছে। হেমাঙ্গিনী সমস্ত দিনের তদ্বির-তদারক করিতেছেন। সুনীতি সমস্ত সকালটা প্রাণহীণ প্রতিমার মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। ওই চরটার কথাই তিনি ভাবিতেছিলেন। তিনি কল্পনা করিতেছিলেন, চরের মাটি রক্তমাখা; দাঙ্গায় নিহত মানুষের হাত-পা দেহ-মাথা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়া আছে। বার বার তাহার অন্তরাত্মা প্রশ্ন করিতেছে, এ পাপ কাহার? সঙ্গে সঙ্গে সভয়ে তাহার চোখ আপনি যেন বন্ধ হইয়া আসিতেছে।
মানদা আসিয়া দর্পিত কণ্ঠে সংবাদ দিল, দাঙ্গায় আমরা জিতেছি মা। ওরা কেউ আসে নাই ভয়ে, ল্যাজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকেছে সব।–বলিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া সে গড়াইয়া পড়িল।
পরম আশ্বাসের একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সুনীতি যেন দুঃস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিলেন, তা হলে খুন-জখম কিছু হয়নি, না রে মানদা?
হেমাঙ্গিণী মানদার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি হাসিয়া কহিলেন, না ভাই। তুমি এবার ওঠ দেখি, উঠে ঠাকুর-জামাইয়ের স্নান-টানের ব্যবস্থা কর। উমা হাজার হলেও ছেলেমানুষ, তার ওপর জানাশোনাও তো নেই কিছু।
সুনীতা হাসিমুখে উঠিলেন, বলিলেন, আহা দিদি, মানুষের জীবন গেলে তো আর ফেরে না। সারা সকালটা আমার বুকে কে যেন পাষাণ চাপিয়ে দিয়েছিল।
নীচে ইন্দ্র রায়ের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কই রে, উমা কোথায় গেলি? তোর শ্বশুর কি করছেন রে?
উমার অপেক্ষা না করিয়াই তিনি উপরে উঠিয়া আসিয়া রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চ হাসির সঙ্গে শোনা গেল, ফৌজদারী মামলা করে কলওলা আমাদের জব্দ করবে! বলিয়া অবজ্ঞাপূর্ণ কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হাসি-হা-হা-হা-হা।
সে হাসির শব্দ নীচে বাগদী লাঠিয়ালদের কলরব মিশিয়া সমস্ত মহলটা যেন গমগম করিয়া উঠিল। ভাণ্ডারের দুয়ারে তাহারা জলখাবার লইতে আসিয়া গোলমাল করিতেছিল। মানদা রেলিঙের উপর বুক দিয়া ঝুঁকিয়া বলিল, খুব তো চেঁচাচ্ছিস সব! সেই বিভীষণ মজুমদারের একটা ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে আসতিস, তবে বুঝতাম। কিংবা একপাটি দাঁত
বলিতে বলিতে সে সসম্ভ্রমে সঙ্কুচিত হইয়া চুপ হইয়া গেল।
ভারি গলায় কণ্ঠনালী পরিস্কার করিয়া লওয়ার উচ্চ গম্ভীর শব্দ জানাইয়া দিল রায় বাহির হইয়া আসিতেছেন। রায় ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ডাকিলেন, উমা!
মানদা ত্রস্তপদে গিয়া উমাকে ডাকিয়া দিল। উমা আসিয়া বাপের সম্মুখে দাঁড়াইতেই সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইয়া রায় বলিলেন, খুব যে বউ সেজে গেছিস মা! তোকে একেবারে দেখবারই জো নেই।-বলিয়া উমার মুখের দিকে চাহিয়া তিনি যুগপৎ বিস্মিত এবং শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। উমার মুখ নিশান্তের জ্যোৎস্নার মত সকরুণ পাণ্ডুর। পরমুহূর্তেই মনে পড়িল, কাল রাত্রে ফুলশয্যা গিয়াছে। হাসিয়া বলিলেন, তোর শাশুড়ীকে বল্ মা, রামেশ্বরের স্নান-আহ্নিকের ব্যবস্থা করে দিন। দুর্বল শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তোরাও স্নান-টান করে সব বিশ্রাম ক।
উমাকে রামেশ্বরের পরিচর্যার জন্য বলিবেন সঙ্কল্প করিয়া ডাকিয়াছিলেন। কিন্তু উমার এমন ক্লান্ত ভঙ্গি দেখিয়া সুনীতিকে ডাকিবার জন্য বলিলেন। গত রাত্রির রামেশ্বর আজ আর নাই, রায়ের উচ্চ হাস্য, উল্লাস তাঁহাকে স্পর্শও করিতে পারে নাই। রোগ যেন আজ বাড়িয়া গিয়াছে।
.
রায় সত্য দেখিয়াও ভ্রম করিলেন। উমার মুখ সত্যই সকরুণ পাণ্ডুর, কিন্তু সে ফুলশয্যার রজনীর আনন্দে অবসাদে নয়। গোপন অন্তরে নিরুদ্ধ সুগভীর অভিমান ও দুঃখের দাহে তাহার মুখের লাবণ্যের সজীবতা এমন শুকাইয়া গিয়াছে। জীবনের প্রথম মিলন-বাসরে অহীন্দ্রের মধ্যে সে পরম বাঞ্ছিত জনকে খুঁজিয়া পায় নাই, এমন কি এতদিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু-অহীন্দ্রেরও দেখা পায় নাই। স্তব্ধ উদাসীন, এ যেন অস্বাভাবিক অপরিচিত এক অহীন্দ্র! দৃষ্টিপাত অবরোধ করিয়া দাঁড়াইয়াও তাহার দৃষ্টিতে পড়া যায় না। সকাল হইতে এতটা বেলা পর্যন্ত বাহিরের বারান্দায় সে পায়চারি করিতেছে, কত বার তাহার দৃষ্টির সাথে তাহার দৃষ্টি মিলিয়াছে, উমার দৃষ্টি সুস্পষ্ট অভিমানের বার্তা জানিয়াছে, কিন্তু অহীন্দ্রের দৃষ্টি যেন বধির মূক হইয়া গিয়াছে; কোন বার্তা সে–দৃষ্টির গোচরে আসে নাই, কোনও উত্তরও দিতে পারে নাই। মানদা অদূরে দাঁড়াইয় ছিল, রায় নীচে চলিয়া যাইতেই বলিল, চলুন বৌদিদি, চান করবেন চলুন। মুখ আপনার বড্ড শুকিয়ে গিয়েছে।