কালচক্র
আমার নাম বাণী সাহা। সেবার বড়দিনে, পাড়ার ‘কিশোর মহল’ ক্লাবের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে পিকনিক করতে যাই বারুইপুরের একটা বাগান বাড়িতে । তখন আমার বয়স পনেরো বছর। বেশ হৈ-হুল্লা আর মজা করে সারাটা দিন কেটে গেল আনন্দে। ফেরার সময় অয়নদা, আমাকে ডেকে বলল, চল আমরা সবার আগে গিয়ে গাড়ির ভাল সিটটা দখল করে বসি। অয়নদা পড়াশােনায় বেশ ভাল। পাড়ার সকলে তাকে ভাল ছেলে বলে জানে। তার প্রস্তাবটা মন্দ লাগলাে না। আসার সময় আরামে বসে আসা হয়নি। পিছনের সিটে বসে বেশ ঝাঁকুনি লাগছিল। অয়নদার কথায় তাই রাজি হয়ে গেলাম। তার সঙ্গে এসে বাসের একটি ভাল সিট দখল করে জানলার ধারে বসলাম। অয়নদা আমার পাশেই বসলাে। আমি জানলা দিয়ে বাইরে, মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম। আকাশ চুঁইয়ে নীরবে গড়িয়ে অন্ধকার নামছে মাটির বুকে। পাখিরা আকাশের বুক চিরে রেখা টেনে নীড়ে ফিরছে। দেখতে দেখতে আমি বিভোর ছিলাম যখন, হঠাৎ অয়নদা আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেল। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে, বাস থেকে নেমে একছুটে চলে গেলাম দূরে। মনে মনে খুব রাগ হল। কিস্তু ভয়ে কাউকেই কিছু বলতে পারলাম না।
এই ঘটনার পর থেকে ছেলেদের সম্পর্কে আমার ভয় বেড়ে গেল। সব সময় ছেলেদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতাম। ধারে কাছে কাউকে ঘেঁসতে দিতাম না। কেউ কোন রকম ইশারা ইঙ্গিত করলে, না বোঝার ভান করে এড়িয়ে যেতাম । ছেলেরা যা খুশি করতে পারে, তাতে কোন দোষ হয় না। মেয়েরা একটু হাসলে, কিংবা কারও দিকে মুখ তুলে একবার তাকালে বা এক দৃষ্টিতে কিছু দেখলে, অপরাধ হয়ে যায়। এসব কথা আমি বুঝতে পারি পনেরো বছর বয়সেই।
অভিভাবকেরা বলেন, ছেলেরা এক-আধটু এসব করতেই পারে অল্প বয়সে, তেমন কিছু দোষের হয় না। আর মেয়েদের নামে মিথ্যে কিছু রটলেও, আর রক্ষে নেই। লোকের মুখে মুখে রটে গিয়ে মুখরোেচক আচারের মতাে রসাল হয়ে উঠবে। ফুলে ফেঁপে তিল থেকে তাল হয়ে যাবে। নীরব সত্যের চেয়ে সরব মিথ্যে লোকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে।
আমার বয়স যখন যোল। তখন অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছি আমি। ওই বয়সেই আমি বুঝে ফেলেছিলাম, ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে ভগবানের সৃষ্ট সামান্য পার্থক্যের চেয়ে, মানুষের তৈরি প্রভেদ অনেক বেশি। ছেলেদের থেকে মেয়েদের দূরে দূরে থাকতে হয়। না হলেই বিপদ। অথচ তাদের কারও না কারও কাছে নিজেদের সঁপে দিত হবে শেষপর্যন্ত, আশ্চর্য।
আমাদের পাশের বাড়ির পুরনো ভাড়াটে চলে যাওয়ার পর দু-তিন মাসের মধ্যেই সেখানে নতুন ভাড়াটে এলো। এক বৃদ্ধা ও তার নাতি। নাতির বয়স কুড়ি-বাইশ হবে। যণ্ডা মার্কা চেহারা। তার ডাক নাম মুন্না। পড়াশোেনা করে না। মাস্তানি করে বেড়ায়। পাড়ার মাস্তানদের সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যেই তার বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
আমাকে দেখার পর থেকেই আমার ওপরে মুন্নার কুনজর পড়ল। সব সময় নজরে রাখত, কখন আমি ঘর ছেড়ে বাইরে বের হই। একদিন সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে আমাকে চোখের ইশারায় ডাকল। আমি না বোঝার ভান করে চলে এলাম ঘরে। মা বাবাকে বলতে সাহস হল না। তাহলে হয়তো ঘরের বাইরে বেরনােই আমার বন্ধ হয়ে যাবে। কাউকে কিছু জানালাম না। তবে মুন্নার দৃষ্টি এড়িয়ে চলতাম সব সময়। ও বাড়িতে আছে বুঝতে পারলে মােটেও ঘর ছেড়ে বাইরে বের হতাম না।
সেদিন ছিল শিবরাত্রি। বাবা অফিস এক বন্ধুর বাড়ি যাবে । সেখান থেকে রাত করে বাড়ি ফিরবে বাড়িতে বলেই গেছিল।
মা সারাদিন উপোস করে, বিকেলের দিকে কাছেই একটি শিব মন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢালতে গেছে। আমার মাথা ধরেছে বলে আমি যাইনি। ঘরে শুয়ে আছি। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলস্যে আর উঠে আলো জ্বালিনি। ভাবছি, মা কখন ফিরবে?
হঠাৎ দেখলাম, দরজায় কার ছায়া পড়েছে। ভাবলাম, মা বােধহয় ফিরল। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। দেখলাম, না মা নয়, মুন্না এসে ঘরে ঢুকলা।
তাকে দেখে আমি রুক্ষ স্বরে বললাম, কি চাই ?
– তোমাকে
– মানে?
সে তার কোন উত্তর না দিয়ে, আমাকে জড়িয়ে ধরে, জোর করে বিছানায় ফেলে, আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘটনার আকম্মিকতায় আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। তবু আমি বললাম, আমি কিন্তু চিৎকার করব। চেচিয়ে লোক ডাকব।
– ডাকো, আমিও বলব , তুমি আমাকে ঘরে ডেকেছো।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। প্রতিরোধের চেষ্টা করলাম। প্রতিরোধ করেও কোন লাভ হল না । আমি চিৎকার করতে যেতেই সে জোর করে আমার মুখ চেপে ধরল। প্রতিরোধের ফল হল না কোনও । সে তার যৌন ইচ্ছা পূরণ করে একটু পরেই আমাকে বিছানায় ফেলে রেখে চলে গেল। আমি পড়ে রইলাম সেখানে অসহায়ের মতো একা।
মা বাবা ফিরে এলেও তাদের কারও কাছে কিছু খুলে বলতে পারলাম না ভয়ে। আরও মাথা ধরার ভান করে পড়ে রইলাম বিছানায়। নিজেকে অসহায় লাগছিল খুব। মনে এই ভেবে খুব ভয় হয়েছিল, যে হয়তো মা আমার মুখ দেখে সব বুঝে ফেলবে। মা অনেক সাধাসাধি করলেও সে রাত্রে আর খেতে যাইনি। খুব মাথা ধরার ভান করে, সেদিনের মতো নিজেকে আড়াল করেছিলাম। অনেক রাত পর্যস্ত বিছানায় পড়ে ছট্ফট করেছিলাম। কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম কাল মুখ দেখাবে কেমন করে ? এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, টেরও পাইনি। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, প্রথমেই আয়নায় নিজের মুখ দেখে নিলাম। দেখলাম মুখে কোন অপরাধের ছাপ আছে কিনা। কেউ কিছু বুঝতে পারবে কিনা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজের চোখের দৃষ্টি। কয়েকদিন ভয়ে ভয়ে কাটল খুব। মুন্নাকে দেখলেই বুকটা কেঁপে উঠত ভয়ে-শঙ্কায়, আতঙ্কে, ঘৃণায়।
তারপর থেকে আমি যেন ওর কেনা বাদী হয়ে গেলাম। মুন্না যা বলত তাই করতে হত আমাকে। না হলে সবাইকে সব জানিয়ে দেবে বলে ভয় দেখাত। আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিত কবে, কখন, কোথায় দেখা করতে হবে। যাব না ভাবতাম। দুর্নাম রটার ভয়ে আমাকে যেতেই হত শেষপর্যন্ত। তাকে দেখে দরজায় খিল এঁটে দিতাম। তার ইশারায় শেষ পর্যন্ত আমাকে সেটা খুলে দিতে হত, এরপর থেকে ওর নেশার সামগ্রীর জন্য টাকা যােগান দিতে হত আমাকে। তা না করে আমার আর কোন উপায় ছিল না। বাগে যখন একবার পেয়েছে, রাজী না হলেই হাটে হাঁড়ি ভাঙবে বলে, আমাকে ভয় দেখাত। তার চাল-চলন, হাব-ভাব ব্যবহার, তার হাসি, তার চাউনি সব কিছুই খুব খারাপ লাগত আমার। তবু আমি দিশেহারা, নিরুপায়। কাকে বলব এসব কথা? তাই সব সহ্য করতে হত মুখ বুজে।
মনে মনে ভবেছি অনেকবার, ফুঁসে উঠবাে। কিন্তু পারিনি। ভেবেছিলাম গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ব। না হলে রেল লাইনে মাথা দিয়ে এই কলুষিত জীবন শেষ করে দেব। কিত্তু শেষপর্যন্ত মরতেও সাহসে কুলায় নি।
ইচ্ছে হয়েছিল, মা বাবাকে সব খুলে বলে দিই। পরক্ষণেই ভয় হয়েছিল। যদি মারধোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় আমাকে, বাবা যা রাগী মানুষ। তারচেয়ে কোন কিছু না বলাই ভাল। পঙ্কিল হয়ে উঠল আমার জীবন। চোখের চাউনি, কাজকর্ম সব কিছুর মধ্যেই যেন অপরাধী ভাবটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
শেষপর্যন্ত একদিন সব কিছু জানাজানি হয়ে গেল।
আমাদের ঘরে ঢুকে মুন্না সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে …। মা কি কাজে পাশের বাড়ি গেছিল। ঠিক সেই সময় ঘরে এসে ঢুকল। সে, তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে, মায়ের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি বিমূঢ়ভাবে বিছানায় পড়ে রইলাম। মা সেই মুহুর্তে আমার ওপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করল না। মুখেও বলল না কিছু।
আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। সমানে লাথি ঘুঁষি মারতে লাগলেন। তারপর সেই অবস্থায় ফেলে রেখে, কি সব বিড় বিড় করতে লাগলেন মনে মনে।
বাবা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মা ফিসফিস্ করে তাকে কি সব বললেন। শুনে বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা শক্ত লাঠি দিয়ে আমাকে সমানে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলেন। মারতে মারতে লাঠিটা ভেঙে গেল। এতেও বাবার রাগ পড়লে কিনা ঠিক বােঝা গেল না। এতাে মার খেয়ে ছিলাম বলে তেমন কোন দুঃখ ছিল না। ভাবলাম এবার হয়তো মুন্নার হাত থেকে মুক্তি পাবো। বাবা ওকে দেখতে পেলে আর আস্ত রাখবেন না।
পরের দিন বাবা তাকে দেখতে পেয়েও কিন্তু কিছু বললেন না। শুধু আমাকে শাসিয়ে ওকে শুনিয়ে বললেন, আর একবার যদি ছেলেটা এ ঘরে আসে, আমাকে বলিস, সেদিন ওর ঘাড়ে মাথা থাকবে না।
তারপর দিন বাবা ঘরের কোণে লুকিয়ে থেকে, আমাকে বললেন বাড়িতে কেউ না থাকার ভান করে বিছানায় পড়ে থাকতে। মাকে পাশের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মুন্না টোপ গিলল। পা টিপে টিপে ঘরে এসে ঢুকল আমার।
বাবা ওকে মারার জন্য দরজার মােটা খিলটা খুলে নিলেন হাতে। বাড়ি মারতে যাবেন ওর মাথায়, এমন সময় মুন্না বাবার হাত চেপে ধরে বললে, খবরদার বলছি। লাঠির একটাও ঘা যদি আমার গায়ে লাগে, তাহলে …।
তাহলে কি করবে তুমি ? বাবা বললেন অগ্নিশর্মা হয়ে।
– হাটে হাঁড়ি ভাঙব। ঢি ঢি পড়ে যাবে আপনার মেয়ের নামে।
– তার আগে, আমি তােমাকে মেরে থানায়, পুলিশে দেবে।
– ওরা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই দেখুন আপনার মেয়ের হাতের লেখা চিঠি।
বাবা চট্ করে ওর হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন।
মুনা, শ্লেষের হাসি হেসে বললো, ও রকম চিঠি আরও আছে।
– এ কথা সত্যি? বাবা রাগত স্বরে আমার কাছে জানতে চাইলেন। আমি চুপ করে রইলাম।
মুন্নাকে বাড়িতে না আসার জন্য মিনতি করে দু’একবার চিঠি লিখে ছিলাম, এ কথা মিথ্যে নয়।
তারপর আর কোন কথা নেই। বাবা মুন্নার দিক থেকে ঘুরে, আমার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলে, আমাকে মারতে শুরু করলেন।
হঠাৎ কি হল, মুন্না বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ওকে আর মারলে, আপনাকে আমি খুন করে ফেলব। বলে মুন্না বাবার গলা টিপে ধরল। মুহুর্তে বাবার মুখের সমস্ত রক্ত মাথায় উঠে গেল।
চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল। বিবর্ণ মুখে, বাবা ছটফট করতে লাগলেন। আমি তখন মুন্নাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম, ছাড় বাবাকে।
মুন্না বাবাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।
এরপর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই মুন্না আমাদের ঘরে যাতায়াত শুরু করল। দিনে, রাতে যখন খুশি আসতা। ওকে দেখেও বাবা না দেখার ভান করে থাকত। মা ওর সঙ্গে ভালভাবে ব্যবহার করত। নিজের হাতে চা তৈরি করে খাওয়াত। মেয়েরা বোধহয় এ ধরনের ছেলেদের প্রতি সহজেই আকৃষ্টি হয়ে পড়ে ! মুন্নাকে আগের মতো আর আমার অতাে খারাপ লাগত না। ধরেই নিয়েছিলাম, এটাই আমার ভবিতব্য।
সেই ঘটনার পর থেকেই বাবা মা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। ওদের চোখে ঘুম নেই, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া নেই। বাবার শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। তাদের এক ভাবনা, একবার আমার নামে বদনাম ছড়িয়ে পড়লে, তাদের পক্ষে আমাকে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এই ভয়ে বাবা মা তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
যেমন কোনাে এঁটো জিনিষ দেবতার ভােগ লাগে না। একজন পুরুষ যখন কোন নারীকে এঁটো করে দেয়। তাকে কেউ বিয়ে করে না। বড়জোর রক্ষিতা করে রাখতে পারে।
যেন মেয়েদের জীবনের একটিই উদ্দেশ্য। তা হল বিয়ে। তাতেই স্বস্থি, তাতেই শান্তি। মেয়ে হয়ে জন্মানোই যেন বিয়ের জন্য, আর ঘরের কাজ কর্ম গুছিয়ে রেখে, সস্তান প্রসবের জন্য। আর তাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করে অবার তাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য। মেয়েদের জন্মের আর অন্য কোন মানে নেই, থাকতে নেই যেন। থাকতে পারে না। এ রকম একটা ধারনা নিয়ে বড় হয়েছিলাম আমি। আর ছেলেদের জন্মানো যেন, কাজকর্ম করে রােজগার করবে, বিয়ে করবে। বিয়ের অর্থ সামাজিকভাবে একজন পুরুষের একজন নারীর ওপর সব রকম অত্যাচার করার অধিকার লাভ করতে আইনত অঙ্গীকারে। পুরুষ নারীর উপর অত্যাচার করবে সারা জীবন। কোন রেহাই নেই। প্রতিবাদ করেও কোন লাভ নেই। পুরুষ শাসিত সমাজে, প্রতিবাদ করলেই আইন, সমাজ সবই একসঙ্গে তােমার উপর হুমড়ি খয়ে পড়বে।
স্বামীকে ভাল না লাগলেও মুখ ফুটে কিছু বলার উপায় নেই। বললে বাড়তি অত্যাচার জুটবে নানাভাবে। তাই অভিনয় করে, যেতে হবে সারাজীবন, স্বামী আমার মনের মতো। এ যেন দোকানের কেনা ইডলি-ধোসার মতাে। দোকানদারের কথায় বিশ্বাস করে কিনতে হবে। কিনেছ যখন, তখন ভাল না লাগলেও খেতে হবে। ফেলে দেওয়া চলবে না, তাে এই হলাে আমাদের পবিত্র বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান।
অনেক চেষ্টা করে বাবা মা, বরপণের অস্বাভাবিক লোভ দেখিয়ে (যা বাবার পক্ষে দেওয়া কোনদিনই সম্ভব নয়), একজন লোভী ছিট কাপড়ের দোকানের কর্মচারীকে পাওয়া গেল। সম্প্রতি যার বউ গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মারা গেছে। বাবা মা তাতেই রাজী হয়ে গেল। কথাবার্তা শুরু হলো। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল।
এরকম আত্মাহূতিতে আমার কোন সম্মতি ছিল না। বাবা মা আমার মতের কোন আমল দিলেন না। মুন্নাকে আমি সব খুলে বললাম। সব শুনে সে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালাবার ব্যবস্থা করল।
পরদিন সকালে আমাকে নিয়ে এসে উঠল বেহালার এক বস্তিতে। কয়েকমাস বেশ ভালই কাটল আমাদের। নতুন জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলাম। মুন্নাও বােধহয় আমাকে সত্যিকারের ভালবেসে ফেলেছিল। আমার কষ্ট হচ্ছে দেখলে, আমার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত। তখন ওর প্রতি আমার মনে আর কোন ক্ষোভ বা গ্লানি ছিল না।
হঠাৎ একদিন খবর এলো, পোর্ট এলাকায় স্মাগলিং করতে গিয়ে এনকাউন্টারে মারা গেছে মুন্না। সেখানে গিয়ে দেহ শনাক্ত করে আসতে হয়েছিল আমাকে। এরপর অকূল পাথারে পড়লাম আমি। কি করব, কিভাবে বাঁচব ভাবতে পারলাম না।
বুকে সাহস সঞ্চয় করে ফিরে গেলাম বাবা মায়ের কাছে। সেখানেও আমার ঠাঁই হল না। দূর দূর করে আমাকে তাড়িয়ে দিলেন। রাত সেখানে কাটিয়ে পরের দিনই ফিরে আসতে হয়েছিল বেহালার বস্তিতে।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এখন আমার ঠিকানা হলো, কালীঘাটের গঙ্গা পারের একটা নােংরা গলিতে।
হঠাৎ মহালয়ার দিন অয়নদা এই গলিতে এসে আমায় দেখতে পেয়েই চিনতে পারে। সেদিন সারা রাত আমার ঘরে কাটাল সে। অন্য কিছু না করে আমার এই পরিণতির করুণ কাহিনি শুনে বোধহয় তার মায়া হল। আবার আসবে বলে পরদিন সকালে সে আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে চলে গেল।
কয়েকদিন পর সে আবার এল। সারাদিন থাকল এখানে, খাওয়া দাওয়া করল, সন্ধ্যায় আবার সে কিছু টাকা দিয়ে চলে গেল। আবার সে এক সপ্তাহ পরে এসে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল।
আমি বললাম, তা হয় না, আমি এখন নষ্ট নারী। আমাকে বিয়ে করলে সমাজ সেটা মেনে নেবে না। তোমাকেও একঘরে করবে।
– সে আমি বুঝব। বলে সে সেদিনও চলে গেল।
কিছুদিন পর সত্যিই সে এসে, আমায় এখান থেকে নিয়ে গেল তার ভাড়া করা নতুন ঘরে। সত্যি এমন কিছু ঘটতে পারে আবার আমার জীবনে, আমার বিশ্বাস হছিল না।
এখন আমাদের সংসার খুবই সুখের। সে টিউশন করে সকাল সন্ধ্যায়। আমি একটা সেলাই মেশিন কিনে নিয়েছি। বাড়িতে বসেই পাড়ার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের জামা প্যান্ট সেলাই করে আমিও বেশ কিছু রোজগার করি, তাতে আমাদের সংসার চলে যায়।
জীবন একটা প্রবাহিত নদীর মতো, কখনও কখনও চড়ায় আটকে পড়ে কিন্তু থেমে থাকে না, সামনের দিকে সে এগিয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে।