কাঞ্চনকন্যা
বাংলা ছায়াছবির যখন সুবর্ণযুগ তখন অধিকাংশ বাংলা ছবিরই শুটিং হত বল্লভপুরে। তা আমার আশৈশবের সঙ্গী রমেনদের বাড়ি ছিল সেখানে। ওই আমাকে ওদের গ্রামের একজনের মারফত জানিয়েছিল, “যদি নামকরা সব সিনেমা আর্টিস্টদের দেখতে চাস তো শিগগির আমাদের এখানে চলে আয়। প্রায় দশ-বারোদিন ধরে একটানা একটি ছবির শুটিং হবে এখানে।”
তখন আমার বয়স চোদ্দো বছর। স্কুলে পড়ি। কাজেই লাফিয়ে উঠলাম এই খবর শুনে। অনেক কষ্টে বাড়িতে রাজি করিয়ে এক সকালে হাওড়া ময়দানে এসে চেপে বসলাম মার্টিন কোম্পানির ট্রেনে। ছোটবেলায় এই ট্রেনে চাপার আনন্দ যে কী ছিল তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। যাই হোক বেলা দশটা নাগাত বল্লভপুরে এসে যখন পৌঁছলাম, রমেন তখন ওর বন্ধুদের নিয়ে স্টেশন সংলগ্ন একটি বটগাছের ঝুরি ধরে দোল খাচ্ছিল। আমাকে দেখেই হইহই করে ছুটে এল আমার দিকে।
অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে আমিও আনন্দে আত্মহারা হলাম। তারপর সবাই মিলে কলবল করতে করতে ওদের বাড়িতে যখন এলাম, তখন ওর মা-বাবাও আমাকে দেখে খুশি হলেন খুব।
দুপুরে একটা স্কুলবাড়ির সামনে শুটিং হল। স্কুলের ছেলেরা দেবদারু পাতা দিয়ে গেট তৈরি করছে, তারই শুটিং। ছবির নাম ‘কাঞ্চনকন্যা’। ছবিতে ছেলেদের দলে রমেনও অংশ নিল। ওর অনুরোধে আমিও অংশ নিতে গিয়ে বাধা পেলাম। কিছু ছেলে আপত্তি করে বলল, “ও কি আমাদের স্কুলের ছেলে যে, ও অংশ নেবে? ওকে নিলে আমাদেরও সবাইকে নিতে হবে। তা না হলে ওকেও বাদ দেওয়া হোক।” মনটা আমার খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম এদের দলে থাকলে নিজের মুখটা বড় পর্দায় বেশ বড় আকারে দেখতে পাব আমি। আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কাছে কত কদর হবে আমার। তার জায়গায়—। চোখে আমার জল এসে গেল। এই নিয়ে তো রমেনের মাথা গরম। আমাকে বাদ দেওয়ার কথা শুনে অন্য ছেলেদের সঙ্গে হাতাহাতি লাগিয়ে দিল সে। এই ছবির পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান দু’জনেই খুব ভালমানুষ । তাঁরা বললেন, “হলই বা বাইরের ছেলে। তবু একজন থাকলে ক্ষতি কী? তা ছাড়া বেশ তো ফুটফুটে ছেলেটি। থাকুক না আমাদের ছবিতে।” কিন্তু বললে কী হবে? রমেন তখন মারামারির দায়ে স্যারেদের আপত্তিতে নিজেই বাদ। ও তখন দারুণ রেগে ‘ধ্যুৎ তেরি’ বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সেখান থেকে। আশাহত হয়ে মনটা আমার খুবই খারাপ হয়ে গেল।
পরদিন দুপুরে কানা দামোদরের তীরে আমরা দু’ বন্ধুতে বসে প্রকৃতির শোভা দেখছি হঠাৎ সেখানে শুটিং পার্টি গিয়ে হাজির। ক্যামেরাম্যান আমাদের দেখেই বললেন, “এই তো, তোমরা দু’জনেই আছ দেখছি। আমাদের এখনকার দৃশ্যে তোমরাই থাকবে। আর কাউকেই নেওয়া হবে না।”
পরিচালকেরও ওই একই মত। তাঁর নির্দেশে একজন মেকাপম্যান আমাদের দু’জনকে একটু ঠিকঠাক করে দিলেন। এই ছবির নায়িকা ছিলেন একজন নামকরা চিত্রাভিনেত্রী। তিনি এসে আমাদের দু’জনের মাঝখানে বসে কত গল্প করতে লাগলেন। সেই অভিনেত্রীকে দেখে বা তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমাদের জীবন তো ধন্য হয়ে গেল।
এদিকে ক্যামেরা রেডি করে পরিচালক আমাদের বুঝিয়ে দিলেন ছবির দৃশ্যটা কেমন হবে। রমেনের কাজ হবে গুলতি হাতে নদীর ভাঙন বেয়ে জলের দিকে নেমে যাওয়া আর আমার কাজ হবে অভিনেত্রীর ছেলে সেজে একটি পুঁটুলি হাতে নিয়ে বনের পথ ধরে অভিনেত্রীর সঙ্গে চলা। আমার ডায়লগ ছিল, “মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?” অভিনেত্রী বলবেন, “কথা বলিস না, চুপ।” সেই মর্মে শুটিং হল। অতবড় একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে শুটিং, এ কী কম কথা? আমার আনন্দের আর অবধি রইল না।
তখনকার মতো শুটিং তো হল। কিন্তু গণ্ডগোল হল পরের শুটিং-এ।
পরের শুটিং হল অন্ধকার নেমে আসার পর। অভিনেত্রী আলুথালু বেশে ছুটে আসছেন “খোকা খোকা” করে। কৃত্রিম আলোয় আলোচিত করা হয়েছে বনপথ। ক্যামেরা রেডি। শুটিং স্টার্ট। অভিনেত্রী ছুটে আসছেন। উদ্বিগ্ন মুখে ডায়লগ, “খোকা খোকা!” সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার বনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, “আমি এখানে মা!” পরিচালক চেঁচিয়ে উঠলেন, “কাটকাট কাট।”
কে বলল এই কথা? ধারেকাছে কেউ তো নেই। তা হলে! অবশেষে অনেক অনুসন্ধানের পর কাউকেই যখন পাওয়া গেল না, তখন আবার শুরু হল শুটিং।
কিন্তু আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ক্যামেরাম্যান ও পরিচালক মাথায় হাত দিয়ে বসলেন।
কিছুক্ষণ পর ফের শুটিং শুরু হতেই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। অভিনেত্রী “খোকা! খোকা!” বলে ছুটে আসতেই দেখা গেল যেন মাটি ফুঁড়ে ফুটফুটে একটি শিশু উঠে এসে “মা আমি এখানে। মা!” বলে পিছু নিল।
অভিনেত্রী দারুণ ভয় পেয়ে আছড়ে এসে পড়লেন ক্যামেরার সামনে। ভয়ে কাঁপতে লাগলেন থরথর করে।
আবার শুরু হল খোঁজাখুঁজির পালা। কাদের শিশু? কোথা থেকে এল? কিন্তু না। কারও অস্তিত্বও পাওয়া গেল না সেখানে।
ক্যামেরাম্যান কিছুক্ষণ ক্যামেরায় চোখ রেখে একসময় বললেন, “এখানে আর শুটিং করা সম্ভব নয়।”
অভিনেত্রী বললেন, “সম্ভব হলেও আমি আর রাজি নই ওই দৃশ্যে অভিনয় করতে।” পরিচালক গম্ভীর মুখে বললেন, “ব্যাপারটা কী হচ্ছে বলো তো?”
ক্যামেরাম্যান ইশারায় ডাকলেন পরিচালককে। তারপর ক্যামেরায় চোখ রাখতে বললেন।
পরিচালক ক্যামেরায় চোখ দিয়েই দেখতে পেলেন অগ্নিদগ্ধা এক ভয়ঙ্করী নারীমূর্তি একটি মৃত শিশুকে বুকে নিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে । সেই দৃশ্য দেখেই জ্ঞান হারালেন তিনি।
শুটিং বন্ধ হল।
অনেক পরে পরিচালকের সংবিৎ ফিরলে উনি ওঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতেই অভিনেত্রীও বললেন, ওই একই দৃশ্য তিনিও দেখে খুব ভয় পেয়েছিলেন। অতএব নীরবে প্রস্থান।
পরদিন সকাল হতেই শুটিং পার্টি বিদায় নিল গ্রাম থেকে। এই অলৌকিক এবং অবাস্তব ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ল লোকের মুখে মুখে। সবাই দিনের আলোয় চারদিক তোলপাড় করেও এই রহস্যের কোনও কিনারা করতে পারল না।
আমিও দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে এলাম বাড়িতে। ব্যর্থতার কারণে মনটা দারুণভাবে আচ্ছন্ন হয়ে রইল কয়েকটা দিন। সেই ছবির কাজও অসমাপ্ত রয়ে গেল পরিচালকের আকস্মিক মৃত্যুতে। তবুও সেদিনের সেই ঘটনার কথা মনে হলে আজও আমার ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। যদিও ক্যামেরায় চোখ রেখে ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখার মতো দুর্ভাগ্য আমার হয়নি।