সকালবেলা চা খেতে-খেতে
সকালবেলা চা খেতে-খেতে কাকাবাবু অংশুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, কবিতা মেলাতে পারলে?
অংশু কাঁচুমাচুভাবে বলল, আমার দ্বারা হবে না সার। আমার সাতপুরুষে কেউ কখনও ওকর্ম করেনি।
কাকাবাবু বললেন, তুমি কী করে জানলে? সাতপুরুষের সকলের কথা জানো? তোমার বাবা ছুতোর মিস্তিরি, ঠাকুদা কী ছিলেন? ঠাকুর্দার বাবা?
অংশু বলল, আমার ঠাকুদাকে আমি কখনও চোখেই দেখিনি। আগে আমাদের মেদিনীপুরের কোনও গ্রামে বাড়ি ছিল, বাবা চলে এসেছিলেন সোদপুরে।
কাকাবাবু বললেন, মেদিনীপুরের গ্রামে তোমার ঠাকুর্দা হয়তো কবিয়াল ছিলেন। অনেক ছুতোর মিস্তিরি, নৌকোর মাঝি, গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান নিজেরা গান বানান। পোস্ট অফিসের এক পিওনের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অনেক গান শিখেছিলেন, তা জানো?
অংশু এসব কথায় কান না দিয়ে মুখ গোঁজ করে বলল, তা যাই বলুন সার, কবিতা-ফবিতা আমি পারব না। আপনি আমাকে মাটি কাটতে বলুন, কাঠ কাটতে বলুন, কুয়ো থেকে জল তুলতে বলুন, সব পারব। শুধু কবিতা-ফবিতা, না, অসম্ভব, অসম্ভব!
কাকাবাবু বললেন, ফবিতা জিনিসটা কী আমি জানি না। সেটা আমিও পারব না। কিন্তু একটু মাথা খাটালে সবাই কবিতা মেলাতে পারে। শোনো, তোমাকে ছাড়া হবে না। যতক্ষণ না মেলাতে পারছ, ততক্ষণ চাকরি হবে না। এখান থেকে পালাতেও পারবে না। ভাবো, ভাবো। লাইনটা মনে আছে। তো? বনের ধারে ফেউ ডেকেছে নাচছে দুটো উল্লুক।
অংশু বলল, হ্যাঁ, মনে আছে। ফেউ মানে কী সার?
কাকাবাবু বললেন, শেয়াল। শেয়ালের ডাক।
অংশু বলল, শেয়াল তো হুক্কা-হুয়া করে ডাকে।
কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক। সন্ধে হলেই শেয়াল হুক্কা-হুয়া করে ডাকে। কিন্তু কাছাকাছি যদি বাঘ দেখা যায়, অমনি শেয়ালের গলা পালটে যায়। ভয়ের চোটে ডাকে ফেউ-ফেউ।
অংশু জিজ্ঞেস করল, এ-লাইনটা আপনি বানিয়েছেন, না কোনও বই থেকে নিয়েছেন?
কাকাবাবু বললেন, আমি বানিয়েছি। কেন, আমি বানাতে পারি না? তুমিও পারবে।
অংশু উঠে বাগানে চলে গেল।
জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি বেচারাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছেন। কবিতা মেলাতে হবে ভেবে-ভেবে ওর মুখ শুকিয়ে গেছে।
সন্তু বলল, প্রথমবারেই বড্ড শক্ত হয়ে গেল ওর পক্ষে। আর-একটু সোজা দিলে পারতে।
কাকাবাবু বললেন, এমন কিছু শক্ত না!
জোজো বলল, আমি এক মিনিটে মিলিয়ে দিতে পারি। বলব?
কাকাবাবু বললেন, খবদার না। তোমরা কেউ কিছু বলবে না।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, অংশু একটা জামা আর প্যান্ট পরে আছে। আমাদের জামা-প্যান্ট ওর লাগবে না, ও বেশি লম্বা। ও কি দিনের পর দিন ওই এক জামা-প্যান্ট পরে থাকবে? গা দিয়ে গন্ধ বেরোবে যে!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছিস। ওকে দুসেট জামা-প্যান্ট-গেঞ্জি কিনে দিতে হবে।
একটু পরে একটি স্টেশান-ওয়াগন এসে গেল। কামালসাহেব নিজে আসেননি, একজন ড্রাইভার সেটা চালাচ্ছে। ড্রাইভারের হাতে একটা চিঠি। কামালসাহেব সবাইকে তাঁর বাড়িতে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে সকলে তৈরি হয়ে নাও। অংশুঁকে ডাকো।
অংশু নিজেই এগিয়ে এসে কাকাবাবুকে বলল, সার, হয়ে গেছে।
যেন একটা কঠিন অঙ্ক দেওয়া হয়েছিল, সে কোনওরকমে করে ফেলেছে। হাসি ফুটেছে মুখে।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? শুনি।
অংশু বলল, জল দিয়ে পতপত করে ভেসে যাচ্ছে একটা শালুক!
সন্তু মুচকি হেসে ফেলল, আর জোজো হেসে উঠল খুব জোরে।
অংশু রেগে গিয়ে বলল, কেন, মেলেনি? ভাল্লুকের সঙ্গে শালুক মেলে না?
কাকাবাবু নিজে হাসি চেপে ওদের দুজনকে ধমক দিয়ে বললেন, এই, তোরা হাসছিস কেন? হাসির কী আছে!
তারপর অংশুঁকে বললেন, না, তোমার হয়নি। প্রথম কথা, আমার লাইনটাতে ভাল্লুক ছিল না, ছিল উল্লুক। উল্লুকের সঙ্গে শালুক ভাল মিল হয় না। দ্বিতীয় কথা, কবিতার একটা ছন্দ থাকে। সেটা বুঝতে হবে আগে। আমি যে লাইনটা বলেছি, তার ছন্দ হবে এইরকম :
বনের ধারে
ফেউ ডেকেছে
নাচছে দুটো
উল্লুক।
তোমাকেও এই ছন্দে বানাতে হবে লাইন।
জোজো পেট চেপে হাসি সামলাতে সামলাতে বলল, জল দিয়ে পতপত করে ভেসে যাচ্ছে একটা শালুক! পতপত করে কিছু ভেসে যায় নাকি? পতপত করে তো পতাকা ওড়ে! আর শালুক ফুল তো ভেসে যায় না, একজায়গায় ফুটে থাকে।
কাকাবাবু বললেন, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে, আর-একটু চিন্তা করলেই ঠিক পারবে। চেষ্টা তো করেছ। এবার চলো, যাওয়া যাক।
বাংলোর গেট থেকে খানিকটা দূরে একটা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। কাকাবাবুদের গাড়িটা ছাড়তেই সেটা পেছনে পেছনে আসতে শুরু করল।
কাকাবাবু ড্রাইভারকে থামাতে বলে পুলিশের গাড়ির ইনস্পেক্টরকে ডেকে বললেন, শুনুন, আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে আসতে হবে না। আমি মন্ত্রীও নই, ভি. আই. পি-ও নই। রাত্তিরবেলা আপনাদের ইচ্ছে হলে পাহারা দেবেন, দিনের বেলা আপনাদের থাকার দরকার নেই।
পুলিশটি বলল, সার, আমাদের ওপর অর্ডার আছে, আপনাকে সর্বক্ষণ চোখে-চোখে রাখতে হবে। এটা আমাদের ডিউটি।
কাকাবাবু কড়া গলায় বললেন, আমিই তো বারণ করছি আপনাদের। ওপরওয়ালাকে গিয়ে সেই কথা বলুন। সর্বক্ষণ আমি পুলিশ নিয়ে ঘুরতে পারব না।
পুলিশের গাড়িটা থেমে রইল। এ-গাড়ির ড্রাইভার কুড়ি মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দিল কামালসাহেবের বাড়িতে।
হলুদ রঙের বাড়িটা তিনতলা। সামনে লোহার গেট। একতলা, দোতলা, তিনতলার বারান্দা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝখানেও একটা লোহার দরজা।
একতলায় দুটো দোকান ঘর। সকলে এসে বসল দোতলায়।
কামালসাহেবের স্ত্রীর নাম জুলেখা। ছেলেমেয়ে দুটির নাম অরণ্য আর তিস্তা। ছেলের বয়েস এগারো, মেয়ের বয়েস সাড়ে আট।
কাকাবাবু ওদের আদর করে বললেন, বাঃ, বেশ সুন্দর নাম তো?
কামাল বললেন, ওদের বাংলা নাম রেখেছি। এখানে থেকে থেকে যাতে অবাঙালি না হয়ে যায়, সেইজন্য আমার স্ত্রী রোজ ওদের বাংলা পড়ায়, বাংলা গান শেখায়।
কাকাবাবু বললেন, তোমরা একটা গান শুনিয়ে দেবে না কি?
কামাল বললেন, না, না, দাদা। বাড়িতে কোনও অতিথি এলে ছোট ছেলেমেয়েদের দিয়ে তাদের সামনে গান গাওয়ানো কিংবা কবিতা আবৃত্তি করা খুব হাসির ব্যাপার। আরও আসবেন মাঝে-মাঝেই, কোনও এক সময় সবাই মিলে গান গাওয়া হবে।
ছেলেমেয়েদের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে কামাল জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাত্তিরে কোনও উৎপাত হয়নি তো?
কাকাবাবু বললেন, কিচ্ছু না। চমৎকার ঘুমিয়েছি।
কামাল বললেন, এদিকে দুটি অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। কাল আমি যখন থানায় গেলাম, আমাকে কিছু বলতেই হল না। থানার অফিসার বললেন, জব্বলপুর থেকে এক্ষুনি অর্ডার এসেছে, রাজা রায়চৌধুরী কোল ইন্ডিয়ার গেস্ট হাউসে রয়েছেন। সেখানে সর্বক্ষণ পুলিশের পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনি যেখানেই যান, সেখানেই কি পুলিশের পাহারার ব্যবস্থা থাকে?
কাকাবাবু বললেন, কক্ষনও না। অনেক সময় পুলিশরা আমার কথা জানতেই পারে না। শুধু-শুধু আমাকে পাহারা দিতে হবে কেন?
কামাল বললেন, থানার অফিসার কিন্তু বেশ গুরুত্ব দিয়েই বললেন। খুব ওপর মহল থেকে অর্ডার এসেছে মনে হচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, এতে তো আমার সম্পর্কে লোকের কৌতূহল বাড়বে। যারা জানত না, তারাও জেনে যাবে।
কামাল বললেন, জানতে কারও বাকি নেই। এই দেখুন, এখানকার ইংরিজি খবরের কাগজ। তাতে আপনার ছবি বেরিয়েছে, খবরে লিখেছে যে, আপনি মধ্যপ্রদেশে কোনও রহস্যের সন্ধানে এসেছেন।
কাকাবাবু অনেকখানি ভুরু তুলে বললেন, সে কী? আমি এত বিখ্যাত হলাম কবে থেকে? তা ছাড়া, এত তাড়াতাড়ি আমার এখানে আসার কথা খবরের কাগজের লোকেরা জানবে কী করে?
সন্তু-জোজোরা ঝুঁকে পড়ে কাগজটা দেখল। প্রথম পাতায় ডান দিকের শেষ কলামে কাকাবাবুর ছবি, সেইসঙ্গে কাকাবাবু সম্পর্কে অনেকটা লেখা।
জোজো বলল, ওই যাত্রার দলের লোকেরা নিশ্চয়ই বলে দিয়েছে।
সন্তু খবরের কাগজটার সবকটা পাতা উলটেপালটে দেখে বলল, কিন্তু ওই যাত্রার দলের কোনও খবর তো বেরোয়নি।
কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, তা হলে তো এখানে আর থাকা চলে না। নানারকম লোক এসে দেখা করতে চাইবে! বিরক্ত করবে। এখান থেকে ঝাঁসি চলে গেলে কেমন হয়? সেটাও বেশ ভাল জায়গা। এখানকার গেস্ট হাউসটা খুব পছন্দ হয়েছিল।
জোজো বলল, না, আমরা এখানেই থাকব। কাল রাত্তিরে দারুণ খাইয়েছে!
কামাল বললেন, পুলিশকে বলে দেওয়া হবে, কেউ যেন বাংলোর মধ্যে ঢুকতে না পারে। কয়েকটা দিন অন্তত দেখা যাক।
কামালের স্ত্রী জুলেখা এই সময় টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিলেন। পাকা পেঁপে, ডিমসেদ্ধ, পরোটা, আলুর দম, মাংসের কিমা, পাকা খেজুর, ফিরনি, কাঁচাগোল্লা
কাকাবাবু বললেন, ওরে বাবা, এত খাবার?
জোজোর চোখ চকচক করে উঠল, সেও বলল, সত্যিই, এত খাবার দেওয়ার কোনও মানে হয়? তারপরই সে একটা আস্ত ডিমসেদ্ধ মুখে পুরে দিল।
কাকাবাবু বললেন, কাল রাতে ইউসুফ মিঞা আমাদের বিরিয়ানি, কাবাব-কালিয়া কতরকম যে খাইয়েছে! অতি সুস্বাদু বটে! কিন্তু বাঙালির পেটে এত মোগলাই খাবার রোজ-রোজ সহ্য হবে না। একবেলা অন্তত আমার ডাল-ভাত-মাছের ঝোল চাই।
কাকাবাবু সামান্যই খেলেন। সন্তুও তাই। জোজো আর অংশু সবরকমই চেখে দেখল।
চা শেষ করে কাকাবাবু বললেন, জুলেখা, তোমার হাতের চা চমৎকার। মাঝে-মাঝে এসে খাব। চলো কামাল, তোমার বাড়িটা ঘুরে দেখি। মস্ত বড় বাড়ি বানিয়েছ!
জোজোর পায়ে এখন ব্যান্ডেজ নেই, সিঁড়ি দিয়ে দিব্যি তরতর করে উঠে যাচ্ছে। সত্যি তার পা মুচকেছিল, নাকি হেলিকপ্টার থেকে লাফাবার গল্পটা বলার জন্যই ওটা বেঁধেছিল, তা বুঝতে পারল না সন্তু।
সিঁড়িতে প্রত্যেক তলায় কোলাপসিবল গেট, জানলাগুলোয় গ্রিলের সঙ্গে মোটা তারের জাল, ছাদও পুরোটা খুব শক্ত জাল দিয়ে ঘেরা।
কাকাবাবু বললেন, তোমার বাড়িটা দেখছি দুর্গের মতন দুর্ভেদ্য। ছাদটা এমনভাবে ঘেরা কেন? বাঁদর-হনুমানের উৎপাত হয় বুঝি?
কামাল বললেন, নাঃ, এখানে বাঁদর নেই। তবে মানুষের বাঁদরামি খুব বেড়েছে। সন্ধের পর রাস্তাঘাটে ছিনতাই হয়। একদিন আমার বাড়ির ছাদে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। মাঝরাত্তির পেরিয়ে গেছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ একটা ঠুকঠুক শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা হয়েই চলেছে। আমার বাড়ির নীচে সব দোকানঘর। রাত্তিরে কেউ থাকে না। আমিই একলা পুরুষমানুষ। জুলেখাকে না জাগিয়ে আমি উঠে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে। ছাদের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তখনও কেউ ঠুকঠুক শব্দ করছে। আমি দরজাটা খুলে ফেললাম!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি খালি হাতে ছাদে উঠে গেলে?
কামাল বললেন, আমার বন্দুকের লাইসেন্স আছে। রিভলভারও সঙ্গে রাখি। কিন্তু সে-রাত্তিরে ওগুলো নেওয়ার কথা মনে হয়নি। চোর-ডাকাত হলে তো ঠুকঠুক শব্দ করবে না। আমি কোনও জন্তু-জানোয়ারের কথাই ভেবেছিলাম। তাই সঙ্গে একটা লাঠি নিয়েছিলাম। ছাদের দরজাটা খুলে ফেললাম আস্তে-আস্তে। কাউকে দেখা গেল না। অমাবস্যার রাত, ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। তবু আমি ছাদের এদিক-ওদিক ঘুরলাম। হঠাৎ আমার পেছন দিক থেকে কে যেন আমার কাঁধে একটা কিছু দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মারল। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম মাটিতে। উঠে দাঁড়াবার আগেই একজন লোক আমার বুকের ওপর লাফিয়ে পড়ে একহাতে গলা টিপে ধরল, তার অন্যহাতে একটা ছুরি। আমি তার ছুরিধরা হাতটা চেপে ধরলাম। কাঁধের সেই আঘাতের চোটে আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল, প্রথমে গায়ে জোর পাইনি। লোকটার গায়ে খুব শক্তি। সে আমার বুকে ছুরিটা বসিয়ে দেওয়ার বদলে, মনে হল যেন সে আমার একটা চোখ খুবলে নিতে চায়। প্রায় পেরেও গিয়েছিল। এই যে আমার ভুরুর ওপর কাটা দাগ দেখছেন, এই পর্যন্ত ছুরিটা বসিয়ে দিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে আমি অন্য হাত দিয়ে একটা প্রচণ্ড ঘুসি কলাম ওর মুখে। এবার ও ছিটকে পড়তেই আমি উঠে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়ে গেলাম। তারপর শুরু হল মারামারি। ওর হাতে একটা লম্বা ছুরি ছিল বটে, আমিও লাঠিটা তুলে নিতে পেরেছি। আপনি জানেন দাদা, আমার হাতে লাঠি থাকলে কেউ ছুরি কিংবা তলোয়ার দিয়েও সুবিধে করতে পারে না। লোকটাকে কয়েক ঘা লাঠির বাড়ি কষালাম বটে, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ধরে ফেলা গেল না। হঠাৎ একবার লাফিয়ে ছাদের পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাল। অন্ধকারে তার মুখও দেখতে পাইনি।
কাকাবাবু বললেন, তোমার চোখটা খুব জোর বেঁচে গেছে।
কামাল বললেন, সবচেয়ে আশ্চর্য কী জানেন দাদা, পরদিন সকালে আবার ছাদে এসে দেখি আমাদের সেই মারামারির জায়গাটায় একটা পাথরের চোখ পড়ে আছে। নিশ্চয়ই এটা সেই আততায়ীর চোখ। যখন আমি ঘুসি মেরেছিলাম, তখন খুলে পড়ে গেছে!
জোজো উত্তেজিতভাবে বলল, পাথরের চোখ! কাকাবাবু, আপনার কাছে সেই যে একটা লোক এসেছিল, তারও একটা চোখ পাথরের।
কাকাবাবু হেসে বললেন, তার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই। সন্তুর মনে হয়েছিল, সেই লোকটির দুচোখের দৃষ্টি দুরকম, অন্য কারণেও হতে পারে। কামাল, তোমার এই ঘটনাটা কবে ঘটেছিল?
কামাল বললেন, মাসদেড়েক আগে। ঠিক একমাস একুশ দিন।
কাকাবাবু বললেন, আমার কাছে মাত্র দু-চারদিন আগে একজন লোক এসেছিল, সম্ভবত তার পাথরের চোখ। কিন্তু সেই লোকই যে এখানে এসেছিল, তা কি বলা যায়? আরও অনেকের পাথরের চোখ থাকতে পারে।
কামাল বললেন, লোকটা চুরি-ডাকাতি করতে আসেনি। আমাকে ছাদে টেনে এনে খুন করতে চেয়েছিল, তার আগে একটা চোখ খুবলে নিয়ে
কাকাবাবু বললেন, ইংরিজিতে প্রতিশোধের ব্যাপারে বলে, অ্যান আই ফর অ্যান আই, আ টুথ ফর অ-টুথ। চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত। তুমি কি কখনও কারও একটা চোখ নষ্ট করে দিয়েছ?
কামাল জোরে মাথা নেড়ে বললেন, কক্ষনও না। আমি এখন ব্যবসা করি। লোকের সঙ্গে মারামারি করতে যাব কেন? সে কীসের প্রতিশোধ নিতে এসেছিল, তা কিছুই বুঝতে পারিনি। যদি আবার হামলা করে, সেইজন্য ছাদ ঘিরে দিয়েছি জাল দিয়ে।
কাকাবাবু বললেন, বেশ করেছ। সাবধানে থাকাই ভাল। ক্রিমিনালদের মধ্যে কতরকম পাগল যে থাকে তার ঠিক নেই। প্রতিশোধের নেশাতেই তারা পাগল হয়ে যায়। জানো কামাল, কদিন আগে কেউ একজন আমার ঘরে গ্যাস বোমা ছুড়ে মেরেছিল।
কামাল আঁতকে উঠে বললেন, গ্যাস বোমা? এরকম তো আগে শুনিনি!
কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন তাকে চিনতে পারা যায়নি। সে যদি আবার আসে, তাকে আমি এমন শাস্তি দেব!
কামাল বললেন, আপনি এবারে ক্ষমা করা বন্ধ করুন। অন্তত জেলে ভরে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
অংশু এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিল। কামালের শেষ কথাটা শুনে সে মাথা নিচু করে ফেলল।
সবাই মিলে নেমে আসা হল নীচে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, কামালকাকু, আপনি কখন আসছেন আমাদের ডাকবাংলোতে?
কামাল বললেন, আজ তো আমার ব্যবসার কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হবে। এখন তো যেতে পারব না।
জেজো বলল, আফগানিস্তানের সেই গল্পটা শুনতে হবে না? মাঝখানে এমন একটা জায়গায় থামিয়ে রেখেছেন!
কামাল বললেন, ঠিক আছে, সন্ধের পর যাব। বাকি গল্প শোনানো যাবে তখন। দিনের বেলা তোমরা একটা কাজ করতে পারো। পান্নার হিরের খনি ঘুরে এসো। গাড়ি তো আছেই সঙ্গে, ড্রাইভার চিনিয়ে নিয়ে যাবে।
সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া হল বাজারের দিকে। অংশুর জন্য কেনা হল দুজোড়া প্যান্ট-শার্ট, আর গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া। জোজো কিনে ফেলল একজোড়া চটি, সন্তু কিনল একটা মাউথ অগান।
বাজারে কত লোকজন, সবাই ব্যস্ত হয়ে কেনাকাটা করছে, দোকানদাররা খাতির করে ডাকছে খদ্দেরদের। একদল স্কুলের ছেলে একরকম পোশাক পরে চলে গেল গান গাইতে-গাইতে। একজন মোটামতন লোক রাস্তায় একটি ষাঁড়কে আদর করে কলা খাওয়াচ্ছে। কোথাও কোনও অশান্তি নেই, এখন মনেই হয় না যে পৃথিবীতে কত চোর-ডাকাত, খুনেবদমাশও ঘুরে বেড়ায়।
গাড়ি ছুটল পান্নার দিকে।
কাকাবাবুর পাশে বসেছে অংশু, কাকাবাবু তার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন, কী হে, মুখটা এমন গোমড়া করে আছ কেন?
জোজো বলল, আপনি ওর ওপর এমন দায়িত্ব চাপিয়েছেন! কবিতা মেলাতে হবে, ভেবে-ভেবে বেচারা ঘেমে যাচ্ছে!
সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওকে একটা সোজা লাইন দিলে হয় না? ধরো এইরকম : বৃষ্টি পড়ে কলকল, ভরে ওঠে নদীর জল। জলের সঙ্গে অনেক মিল দেওয়া যায়! ও পেরে যাবে!
কাকাবাবু বললেন, উঁহু! আমার মাথায় প্রথম যে লাইনটা এসেছে, সেটার সঙ্গেই মেলাতে হবে!
জোজো বলল, উল্লুকের সঙ্গে খুব ভাল মিল হয় মু—
কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, এই, চুপ! তোমরা কেউ কিছু বলবে না!
সন্তুর কথা শুনে অংশুর মুখোনা একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, আবার নিভে গেল!
কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, দেখি সন্তু, মাউথ অর্গানটা কেমন কিনলি! সুর ঠিক আছে কি না বাজিয়ে দেখতে হয়।
কাকাবাবু সেটাকে ভাল করে মুছেটুছে বাজাতে লাগলেন। বেশ ভালই বাজাতে পারেন তিনি। একটু পরে মুখ তুলে বললেন, এটা কী গানের সুর বাজাচ্ছি, বুঝতে পারছিস?
সন্তু-জোজো দুজনেই দুদিকে মাথা নাড়ল।
কাকাবাবু বললেন, নজরুলের গান, একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল, কে বিদেশি মন-উদাসী, বাঁশের বাঁশি বাজায় বনে— এইটা শুনেছিস, বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিস নে আজি দোল—।
বাকিটা রাস্তা কাকাবাবু বাজাতে বাজাতে গেলেন।
পান্নায় অবশ্য দেখার কিছু নেই। হিরের খনির মধ্যে ঢোকা যায় না, খুব কড়াকড়ি। এখানে কাকাবাবুকেও কেউ চেনে না। বাইরে থেকে হিরের খনির ব্যাপারটা বোঝাই যায় না। খানিকটা জায়গা উঁচু পাঁচিল আর কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, স্টেনগান হাতে নিয়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। একটা জায়গায় মাঠের মধ্যে পোড়া কয়লা আর ছাই স্থূপ হয়ে আছে। তার পাশের জমিতে চাষ করছে কৃষকরা।
সেইখানে সন্তু, জোজো আর অংশু গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ ঘুরল। যদি মাঠের মধ্যে হঠাৎ একটা হিরে পাওয়া যায়! কত হাজার হাজার লোক যে আগে এখানে খুঁজে গেছে, তা ওদের খেয়াল নেই।
কাকাবাবু গাড়িতেই বসে আছেন, একসময় জোজো কাছে এসে বলল, কাকাবাবু, ডান দিকের সরু রাস্তাটায় দেখুন, বড় একটা তেঁতুলগাছের নীচে একটা নীল রঙের ফিয়াট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ওই গাড়িটাকে সারা রাস্তা আমাদের পেছনে-পেছনে আসতে দেখেছি। নিশ্চয়ই কোনও স্পাই আমাদের ফলো করছে।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? গাড়িটাতে কজন লোক আছে দেখেছ?
জোজো বলল, ড্রাইভার আর একজন। ড্রাইভারের খাকি পোশাক, আর অন্য লোকটির চোখে কালো চশমা, সারামুখে দাড়ি।
কাকাবাবু বললেন, হুঁ, কালো চশমা আর সারামুখে দাড়ি থাকলে সন্দেহ হতে পারে ঠিকই। স্পাই হতে পারে, ডিটেকটিভ হতে পারে, ডাকাত হতে পারে। কী বলে? ড্রাইভার ছাড়া মোটে একজন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আরও কিছুক্ষণ খেলিয়ে দেখা যাক!
জোজোর কথাটা মিথ্যে নয়। ফেরার পথেও নীল রঙের ফিয়াট গাড়িটা দেখা গেল মাঝে-মাঝে। কখনও খুব কাছে আসছে না। এক-একবার চোখের আড়ালেও চলে যাচ্ছে।
সন্তু বলল, কাকাবাবু এক কাজ করলে হয়। এ-গাড়িটা চট করে একবার থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দাও। আমি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকব। ফিয়াট গাড়িটা এলে দেখে নেব ভেতরে কে আছে।
কাকাবাবু বললেন, দুর, ওসব দরকার নেই। ওর যদি স্বার্থ থাকে, ও নিজেই একসময় দেখা দেবে।
কাকাবাবু আবার মাউথ অগানটা বাজাতে লাগলেন আপন মনে।