Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবুর প্রথম অভিযান || Sunil Gangopadhyay » Page 3

কাকাবাবুর প্রথম অভিযান || Sunil Gangopadhyay

পরদিন সকালে অনেকখানি জানা গেল ঘটনাটা।

বিষাক্ত ধোঁয়ায় সন্তু আর জোজো জ্ঞান হারালেও কাকাবাবু ঠিক ছিলেন। তিনি ওদের চোখে-মুখে জলের ছিটে দেওয়ায় একটু পরেই জ্ঞান ফিরেছিল। তারপর রাত্রে আর কিছু ঘটেনি। রাস্তায় গুলিটুলি চললেও কারও কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। জোজোকে আর রাত্রে বাড়ি ফিরতে দেওয়া হয়নি, সে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল।

সকালবেলাতেই নরেন্দ্র ভার্মা এসে হাজির। যত বড় ঘটনাই ঘটুক, তবু তাঁর হালকা ইয়ার্কির সুরে কথা বলা স্বভাব। তাঁর পোশাকও সবসময় নিখুঁত, ভাঁজটাজ লাগে না। মেরুন রঙের সুট তাঁর বেশি পছন্দ।

তিনি এসে কাকাবাবুকে বললেন, আঃ রাজা, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। তোমার জন্য কি কলকাতার লোক শান্তিতে থাকতে পারবে না?

কাকাবাবু বললেন, আমি আবার কলকাতার লোকের কাছে কী দোষ করলাম?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমার বাড়ির সামনে গোলাগুলি চলে, তাতে পাড়ার লোকের ঘুম নষ্ট হয় না? একগাদা শত্রু তৈরি করে রেখেছ, কে যে কখন তোমাকে মারতে আসবে, তার কি কোনও ঠিক আছে?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কাল কারা এসে হামলা করল, তুমি কিছু জানো?

কী করে জানব, আমি কি তখন উপস্থিত ছিলাম! নাগাল্যান্ড থেকে ফিরেছি অনেক রাতে। তখনই খবর পেলাম।

কী করে তুমি অত রাতে খবর পেলে? কে খবর দিল?

পুলিশ খবর দিয়েছে। তোমার অসুখ দেখেই আমার আশঙ্কা হয়েছিল, এবার তোমার ওপর একটা অ্যাটেমপ্ট হতে পারে। সুস্থ অবস্থায় তোমার শত্রুরা তোমাকে কঞ্জা করতে পারে না। তুমি দুর্বল হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকলে তোমাকে মারবার চেষ্টা করবে। সেইজন্যই তোমার বাড়ির ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার জন্য আমি পুলিশ পোস্টিং-এর ব্যবস্থা করে গিয়েছিলাম। কাল রাতে দুটোর সময় এসে এই রাস্তাটা আমি একবার দেখেও গেছি।

সন্তু জোজোর দিকে তাকাল। জোজো যাকে স্পাই ভেবেছিল, সে আসলে পুলিশের লোক!

নরেন্দ্র ভার্মা আবার বললেন, তোমার ঘরের মধ্যে দুটো গ্যাস বোমা ছুড়ে চলে গেল। একটা বোমা তাও ঘরের মধ্যে পড়েনি, শিকে লেগে বাইরে পড়েছে। যদি দুটোই ঘরের মধ্যে এসে পড়ত, আর পাঁচ-সাত মিনিট গ্যাস বেরোত, তা হলে তোমরা তিনজনেই বাঁচতে না!

কাকাবাবু বললেন, আমার ওপর কার যে এত রাগ তা তো বুঝতে পারছি না। আমি তো কয়েক মাস ধরেই চুপচাপ বসে আছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, পুরনো শত্রুরা প্রতিশোধের জন্য পাগল হতে পারে? তোমার দোষ কি জানো রাজা, তুমি সাঙ্ঘাতিক-সাঙ্ঘাতিক লোকগুলোকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দাও, ক্ষমা করে দাও। কিছুতেই তোমার শিক্ষা হয় না!

কাকাবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, তবু দেখলে তো, আমাকে মারা সহজ নয়!

নরেন্দ্র ভার্মাও হাসতে-হাসতে বললেন, একবার-না-একবার ঠিক ঘায়েল হয়ে যাবে, এই আমি বলে দিচ্ছি!

সন্তু বলল, নরেন্দ্ৰকাকা, কাল রাস্তায় কেউ কি রিভলভারের গুলি ছুড়েছিল? আমি শব্দ শুনেছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমাদের পুলিশের লোকটি ছুড়েছিল। একজনের গায়েও লেগেছে। কিন্তু কালো গাড়িটাকে আটকাতে পারেনি। আহত লোকটাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। গাড়ির নাম্বারটা নোট করেছিল সেই পুলিশ, কিন্তু বুঝতেই পারছ, সেটা ফল্স। চেক করে দেখা গেছে, ওই নাম্বারে কোনও গাড়ি নেই।

কাকাবাবু বললেন, গ্যাস বোমা। আইডিয়াটা নতুন। ছাত্র বয়েসে আমরা দেখেছি, পুলিশে টিয়ার গ্যাস বোমা ছুড়ত। দারুণ চোখ জ্বালা করত তাতে। আমি প্রথমে সেরকমই ভেবেছিলাম।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, আগেকার দিনে লোকে অসুখে পড়ার পর চেইঞ্জে যেত মনে আছে? হাওয়া বদলালে উপকার হয়। কলকাতার হাওয়া ছেড়ে তুমি কিছুদিন অন্য জায়গার হাওয়া খেয়ে এসো বরং। এবাড়িতে আবার হামলা হলে তোমার দাদা-বউদিও বিপদে পড়তে পারেন!

কাকাবাবু বললেন, কে আমাকে মারার চেষ্টা করছে সেটা বুঝতে পারলে তাকে ধরে ফেলা শক্ত হত না। যাই হোক, এখন কিছুদিন এবাড়ি থেকে দূরে থাকাই ভাল। জানো তো নরেন্দ্র, আমি আমার দাদাকে অনেকবার বলেছি, আমার জন্য যাতে তোমাদের বিপদে না পড়তে হয়, সেইজন্য আমার অন্য বাড়িতে থাকা উচিত। সল্ট লেকে একটা বাড়ি ঠিকও করেছিলাম। দাদা কিছুতেই যেতে দিলেন না। বউদিরও খুব আপত্তি।

সন্তু বলল, আমারও।

নরেন্দ্র ভার্মা সন্তুকে বললেন, সন্তু মাস্টার, এখন তো কলেজে সামার ভ্যাকেশন। তোমার কাকাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে এসো। জোজো, তুমিও যাবে নাকি?

জোজো বলল, বাবার সঙ্গে আমার হাওয়াই যাওয়ার কথা আছে। সেখান থেকে তাহিতি দ্বীপে। সামনের সোমবারই স্টার্ট করার কথা।

কাকাবাবু বললেন, ওরে বাবা, আমরা তো অতদূরে যেতে পারব না। কাছাকাছি কোনও জায়গা ঠিক করা যাক।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, পুরীতে যেতে পারো। সমুদ্রের ধারে। আর যদি পাহাড় যেতে চাও, কালিম্পং-এ ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিংবা দিল্লি কিংবা বম্বে (থুড়ি মুম্বই) তো যাওয়ার ইচ্ছে হয়, আমার মতে দিল্লিতে যাওয়াটাই ভাল, আমি কাছাকাছি থাকব।

কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, সাতনা! মধ্যপ্রদেশে সাতনা নামে একটা জায়গা আছে জার ধ?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, জানব না কেন? খাজুরাহো যাওয়ার রাস্তায় পড়ে। তুমি সেখানে যেতে চাও? মধ্যপ্রদেশে তো এখন খুব গরম।

কাকাবাবু বললেন, গরমে আমার কিছু আসে যায় না। কলকাতা কি কম গরম নাকি? দিল্লি আরও গরম। নরেন্দ্র, তোমার কামালুদ্দিন হোসেনকে মনে আছে? আমরা যাকে কামাল আতাতুর্ক বলে ডাকতাম?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, মনে আছে। তোমার সঙ্গে আফগানিস্তানে গিয়েছিল। ওর আর-একটা নাম ছিল কাটমিনস্কি। অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে কাটমিনস্কি ছিল, যে-কোনও সময়ে যে-কোনও জিনিস চাইলে যে জোগাড় করে আনত, আমাদের কামালুদ্দিনেরও সেই গুণ ছিল। সে বুঝি এখন সাতনায় থাকে?

কাকাবাবু বললেন, সেইরকমই তো জানি। ওখানে কামাল ব্যবসা করে। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সাতনায় একটা ভাল হোটেল আছে। ডাক বাংলো বা গেস্ট হাউসেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, হোটেলের চেয়ে আলাদা গেস্ট হাউসই ভাল। সন্তু, তোকে খাজুরাহোর মন্দিরও দেখিয়ে আনব।

জোজো বলে উঠল, তা হলে আমি আর হাওয়াই-তাহিতি দ্বীপে যাব না। আমিও সাতনায় যেতে চাই।

সন্তু বলল, সে কী রে? শুনেছি হাওয়াই অতি চমৎকার জায়গা।

জোজো ঠোঁট উলটে বলল, ওসব জায়গায় আমি যে-কোনও সময় যেতে পারি। এবার তোদের সঙ্গে বরং খাজুরাহো মন্দির দেখে আসি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা হলে ওই ঠিক হল। কালই ভোরবেলায় যাত্রা শুরু। আজ রাতটা সাবধানে থাকবে। আজ অবশ্য একগাড়ি ভর্তি পুলিশ পাহারা দেবে এই বাড়ি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি যে নাগাল্যান্ডে গিয়েছিলে, সেখানে কী হল?

নরেন্দ্র ভার্মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওখানে সীমান্তের ওপার থেকে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র চালান করছে একটা দল। সেই গ্যাংটাকে ধরার কথা ছিল। কিন্তু তোমাকে নিয়ে যাওয়া গেল না, তাই সুবিধে হল না।

কাকাবাবু বললেন, আমাকে নিয়ে গেলে কী সুবিধে হত? আমি অস্ত্র চালানটালান ব্যাপারে কিছুই জানি না।

নরেন্দ্র ভার্মার ঠোঁটের কোণে একটু ঝিলিক দিয়ে গেল। তিনি বললেন, কী সুবিধে হত জানো? একফোঁটা মধু ফেললে যেমন অনেক মাছি উড়ে আসে, সেইরকম তুমি যেখানেই যাও, সেখানকার দুবৃত্তদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। তোমাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তোমাকে মারতে এলে আগে থেকে ফাঁদ পেতে তাদের সবকটাকে জালে ফেলা যায়। তুমি গেলে না, তাই তারাও দূরে-দূরে রইল।

কাকাবাবু তেড়ে উঠে বললেন, ও, তার মানে আমাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করো তোমরা? আমার প্রাণের কোনও দাম নেই তোমাদের কাছে?

নরেন্দ্র ভার্মা একটু সরে গিয়ে জোরে-জোরে হাসতে-হাসতে বললেন, দেশের উপকারের জন্য প্রাণ দেবে, এটা তো পুণ্য কাজ!

কাকাবাবু বললেন, মোটেই আমার প্রাণ দেওয়ার ইচ্ছে নেই। তোমাদের কাজে আর কোথাও যাব না!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কাল ভোের সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সবাই রেডি থাকবে।

পরদিন হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপার বদলে ওরা একটা গাড়িতে রওনা হল খঙ্গপুরের দিকে। সাবধানের মার নেই। ট্রেন ধরা হবে খঙ্গপুর থেকে।

গাড়ি যখন বিদ্যাসাগর সেতু পার হচ্ছে, তখন জোজো বলল, কাকাবাবু, সেদিন আর আফগানিস্তানের গল্পটা শেষ হল না। এখন বলুন।

কাকাবাবু বললে, সাতনায় গিয়ে বলব। সেইজন্যই তো কামালের কথা মনে পড়ল। সে আমার সঙ্গে ছিল। সব কথা নিজের মুখে বলা যায় না। কিছুটা কামালের কাছ থেকে শুনবে। আমরা দুজনে একসময় সহকর্মী ছিলাম। কামালকে তোমাদের ভাল লাগবে।

দুপুরের আগেই পৌঁছে যাওয়া গেল খঙ্গপুরে। সেখানে লাঞ্চ খাওয়া হল। পুলিশের এস. পি. সাহেবের বাংলোতে। নরেন্দ্র ভার্মা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, কিন্তু নিজে আসেননি। তিনি ব্যস্ত মানুষ, দিল্লি ফিরে গেছেন।

বিকেলবেলা ট্রেনে ওঠার সময় জোজো যথারীতি একজন স্পাইকে দেখে ফেলেছে।

কাকাবাবু বললেন, বলা যায় না। স্পাইয়ের ব্যাপারে জোজো এক্সপার্ট। সন্তু, নজর রাখিস। আমি ট্রেনে বই পড়ব, আর ঘুমোব।

ওদের টিকিট হয়েছে একটা ফার্স্ট ক্লাস বগিতে। একটা কিউবিল-এ চারটে বার্থের মধ্যে তিনটি ওদের তিনজনের, অন্য বার্থটিতে একজন মহিলা। মাঝবয়েসী মহিলাটি কেমন যেন গোমড়ামুখো, একটা পত্রিকা খুলে পড়তে লাগলেন। ট্রেন ছাড়ার একটু পরেই তিনি উঠে গেলেন বাইরে, তারপর একজন টাকমাথা বেঁটে লোক এসে সেখানে বসে চেয়ে রইল জানলার বাইরে।

সেই লোকটিও মিনিটপাঁচেক পরে ধড়মড়িয়ে উঠে চলে গেল, আর সঙ্গে-সঙ্গে ঢুকল একজন দাড়িওয়ালা লম্বা লোক। লোকটি বেশ ট্যারা। এই লোকটিকে দরজার কাছে দেখেই ট্রেনে ওঠার সময় জোজো স্পাই বলে শনাক্ত করেছিল।

জোজো সন্তুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।

কাকাবাবু ওপরের বাঙ্কে শুয়ে বই পড়তে-পড়তেও এইসব লোকজনদের আসা-যাওয়া লক্ষ করছেন।

ট্যারা লোকটি প্যান্ট ও হাফশার্ট পরা, বসে পড়েই পা দোলাতে লাগল জোরে-জোরে। উলটো দিকেই সন্তু ও জোজো পাশাপাশি। লোকটি ওদের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু কোনও কথা বলছে না। অথচ কিছু যেন বলতে চায়।

সন্তু নিয়ে এসেছে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের রচনাবলী। যখের ধন, আবার যখের ধন-এর মতন পুরনো লেখাগুলো তার আবার পড়তে ইচ্ছে করে। মাঝে-মাঝে হাসি পায়। জোজো তাকে পড়তে দিচ্ছে না, মাঝে-মাঝেই হাঁটুতে ধাক্কা মারছে।

ট্যারা লোকটি একসময় সন্তুর দিকে চেয়ে বলে উঠল, ইয়ে, তোমরা ভাই। কতদূর যাবে?

সন্তু কিছু বলার আগেই জোজো ফস করে বলে দিল, কন্যাকুমারিকা!

ওপরের বাঙ্কে কাকাবাবু খুক করে একটু হেসে ফেললেন। জোজো তার স্পাইটিকে ভারতের শেষ সীমা পর্যন্ত দৌড় করাতে চায়। এই ট্রেন যাবে মোটে জব্বলপুর পর্যন্ত।

লোকটি খানিকটা অবাক হয়ে বলল, এই ট্রেন কি অতদূর যাবে?

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, মাঝপথে নামতে হবে, আমাদের কাজ আছে।

এই লোকটিও উঠে চলে গেল বাইরে।

জোজো বলল, দেখলি, দেখলি, সন্তু, আমাদের কাছ থেকে খবর জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কেমন গুলিয়ে দিলাম।

ওপর থেকে কাকাবাবু বললেন, তোমরাও লোকটিকে জিজ্ঞেস করলে না কেন, আপনি কতদূর যাবেন? সেটাই ভদ্রতা।

জোজো বলল, সেটা সন্তুর জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আমি ডিফেন্সে খেলি।

আরও একজন লোক এল এর পর। কোঁচানো ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি পরা, মাথার চুল ঢেউখেলানো, নাকের নীচে সরু তলোয়ারের মতন গোঁফ। গায়ের রং ফরসা, গুনগুন করে গান গাইছে।

এই লোকটি বেশ হাসিখুশি ধরনের। বসে পড়েই বলল, নমস্কার। আমাদের দলের মোট নখানা টিকিট, তার মধ্যে একখানা আপনাদের এখানে। এই সিটে কে বসবে তা ঠিক করতে পারছে না। আপনাদের অসুবিধে হচ্ছে না তো?

কাকাবাবু বললেন, না, বসুন না! আপনাদের যাত্রাপার্টি বুঝি?

লোকটি বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, বাগদেবী অপেরা। জব্বলপুরে পাঁচটা শো আছে।

সন্তু আর জোজো দুজনেই অবাক হল। কাকাবাবু কী করে বুঝতে পারলেন?

কাকাবাবু লোকটিকে বললেন, আপনি যে গানটি গাইছিলেন, সেটা কদমতলায় কে এসেছে হাতেতে তার মোহন বাঁশি তাই না? ছেলেবেলায় আমি খুব যাত্রা শুনতাম। এখন কি আর এইসব পুরনো পালা চলে?

লোকটি বলল, এখন লোকে আবার আগেকার অনেক পালা দেখতে চাইছে। নতুনগুলো একঘেয়ে হয়ে গেছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই বুঝি হিরো? আপনার নাম কী?

লোকটি হেঁ-হেঁ করে হেসে বলল, আমার বাপ-মায়ের দেওয়া নাম যাদুগোপাল চক্রবর্তী, কিন্তু এ-লাইনে ওরকম নাম চলে না। তাই ডালিমকুমার নাম নিয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, ডালিমবাবু, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুব খুশি হলাম। আপনি নামকরা লোক। আপনি ওই গানটা ভাল করে শোনান না!

ডালিমকুমার দুহাত নেড়ে মেজাজে গান ধরলেন। কাকাবাবুও খুব তারিফ করতে লাগলেন হাততালি দিয়ে দিয়ে। সন্তু আর জোজোর মোটেই ভাল লাগল না। কেমন যেন নাকি-নাকি সুর।

গানটা হঠাৎ এক জায়গায় থামিয়ে ডালিমকুমার বললেন, এ-লাইনের ট্রেনে প্রায়ই ডাকাতি হচ্ছে, রাত্তিরবেলা সাবধানে থাকতে হবে।

সন্তু বলল, ট্রেনে ডাকাতির কথা খবরের কাগজে মাঝে-মাঝে পড়ি। আমরা যতবার ট্রেনে চেপেছি, কখনও দেখিনি।

জোজো বলল, বাঃ, আরাকু ভ্যালি যাওয়ার সময় কী হয়েছিল মনে নেই?

সন্তু বলল, সে তো অন্য ব্যাপার। ডাকাতরা কি মানুষ ধরে নিয়ে যায় নাকি?

জোজো বলল, একবার বাবার সঙ্গে রাজস্থানে যাচ্ছিলাম, ট্রেনটার নাম প্যালেস অন হুই, গোটা দশেক দুর্দান্ত ডাকাত ঘোড়া ছুটিয়ে ট্রেনটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেতে-যেতে গুলি ছুড়তে লাগল …

ডালিমকুমার চোখ বড় বড় করে গল্পটা শুনে বললেন, ঠিক সিনেমার মতন।

তারপর বললেন, যদি সত্যি ডাকাত পড়ে, তা হলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা কোরো না ভাই। ঘড়ি, টাকা-পয়সা যা আছে দিয়ে দেওয়াই ভাল। নইলে প্রাণটা যাবে। এরা বড় নিষ্ঠুর, পট করে পেটে ছোরা বসিয়ে দেয়! আমার হাতে যে পাঁচটা আংটি দেখছ, এর একটাও সোনার নয়, সব গিল্টি করা। পকেটে থাকে মোটে একশো টাকা।

কাকাবাবু বললেন, দরজা ভাল করে লক করে দিলেই তো হয়। তা হলে আর ডাকাত ঢুকবে কী করে!

ডালিমকুমার তক্ষুনি উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

কিন্তু খানিক বাদেই কে যেন দরজায় ধাক্কা দিল বাইরে থেকে।

ডালিমকুমার ভয়-ভয় চোখে বললেন, খুলব?

কাকাবাবু বললেন, মোটে তো আটটা বাজে। দেখুন বোধ হয় আপনারই। দলের লোক। তা ছাড়া খাবার দিতেও তো আসবে।

ডালিমকুমার জিজ্ঞেস করলেন, কে? বাইরে থেকে উত্তর এল, খুলুন, টিকিট চেকার!

এবার ডালিমকুমার উঠে গিয়ে দরজাটা খুলতেই তাঁকে ধাক্কা দিয়ে একজন ভেতরে ঢুকে এল। পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়েস হবে, খাকি প্যান্ট আর শার্ট পরা, মুখে একটা রুমাল বাঁধা। এক হাতে পাইপগান, অন্য হাতে একটা চটের থলে।

ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় সে বলল, সব চুপ! ট্যাঁ-ফোঁ করলে জানে মেরে দেব, কার কাছে টাকাকড়ি কী আছে ছাড়ো। ঘড়ি, টাকা-পয়সা সব এই থলিতে দাও!

ডালিমকুমার সিঁটিয়ে গিয়ে বললেন, দিচ্ছি! দিচ্ছি!

বাঙ্কের ওপর থেকে কাকাবাবু বললেন, আরে, সত্যি-সত্যি ডাকাত এসে গেল। ও মশাই, আপনার কথা মিলে গেল যে!

ডাকাতটি পাইপগানটা কাকাবাবুর দিকে উঁচিয়ে বলল, অ্যাই বুড়ো, চুপ করে থাক। নো স্পিকিং। মানিব্যাগ বার কর, চটপট, চটপট।

কাকাবাবু বললেন, আমার কাছে তো টাকা রাখি না। ওই ছেলেটির কাছে আছে। কী রে সন্তু, টাকা-পয়সা সব দিয়ে দিবি নাকি?

সন্তু বিরক্ত মুখ করে বলল, তা হলে তো আবার সুটকেস খুলতে হবে।

ডাকাতটি জোজো আর ডালিমকুমারের দিকে ঘুরে তাকাল। ডাকাতরা বড়দের সঙ্গেও তুই-তুই করে কথা বলে। সে ডালিমকুমারকে বলল, আংটিগুলো খোল, টাকা বার কর।

জোজো শুকনো মুখে বলল, আমার কাছে একটা ডট পেন ছাড়া কিছু নেই!

ডালিমকুমার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে ছুড়ে দিলেন ডাকাতের থলির মধ্যে, তারপর আংটিগুলো খুলতে লাগলেন।

সন্তু নিচু হয়ে সিটের তলা থেকে সুটকেসটা বার করছে, ডাকাতটা তার পেছনে এক লাথি কষিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, দেরি করছিস কেন?

স্প্রিংয়ের মতন পেছন দিকে ঘুরে সন্তু ডাকাতটার পা ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিল। সে দড়াম করে পড়ে একদিকের সিটে। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে সে পাইপগানটা তোলার চেষ্টা করল সন্তুর দিকে। সন্তু ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, সে প্রায় শূন্যে লাফিয়ে উঠে একপায়ে লাথি কষাল ডাকাতটির গলায়।

সন্তু এখন ক্যাপ্টেন ভামিঙ্গো। সে আকাশে উড়তে পারে। মনে-মনে বলছে, বিলিবিলি খান্ডা গুলু!

ডাকাতটির হাত থেকে পাইপগানটা খসে গেছে, সন্তু তাকে ঠেসে ধরেছে একদিকের দেওয়ালে।

আর একটি ডাকাত মস্তবড় একটা ছোরা নিয়ে ঢুকে পড়ল। সে এমনভাবে তেড়ে গেল, যেন ছোরাটা এক্ষুনি বসিয়ে দেবে সন্তুর পিঠে।

কাকাবাবু ওপরের বাঙ্ক থেকে একটা ক্রাচ দিয়ে বেশ জোরে মারলেন দ্বিতীয় ডাকাতটির ঘাড়ে। সে আর্ত শব্দ করে বসে পড়ল মেঝেতে।

কাকাবাবু উৎফুল্লভাবে বললেন, আর আছে নাকি? আমাকে নামতে হবে?

পাশের কিউবিল-এ চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, সেখানেও ডাকাত পড়েছে। জোজো এবার লাফিয়ে গিয়ে চেনটা ধরে ঝুলে পড়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, ডাকাত, ডাকাত!

সন্তু প্রথম ডাকাতটির হাত থেকে পাইপগান কেড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় ডাকাতটির হাতে ছোরাটা এখনও আছে। সে আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু বললেন, এই যে দেখে নাও, আমার হাতে এটা কী রয়েছে।

কাকাবাবুর রিভলভারটা ঠিক তার কপালের দিকে তাক করা।

সে একলাফে চলে গেল দরজার বাইরে। ট্রেনটা ছুটছে অন্ধকার মাঠের মধ্য দিয়ে, চেন টানার জন্য তার গতি কমে এল।

অন্য ডাকাতটা টপাটপ লাফিয়ে পড়ে পালালেও সন্তু যাকে ধরে আছে, সে পালাতে পারল না। সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এখন কী করব, একে ছেড়ে দেব?

কাকাবাবু কড়া গলায় বললেন, না, ধরে থাক, ওকে পুলিশে দিতে হবে। এই বেকার ছেলেগুলো মনে করে একটা পাইপগান আর দু-একটা ছোরাছুরি জোটালেই রেলের নিরীহ যাত্রীদের টাকা-পয়সা লুট করা যায়। এদের ধরে আচ্ছা করে মার দেওয়া দরকার। তারপর কিছুদিন জেলের ঘানি ঘোরালে উচিত শিক্ষা হবে!

তারপর মুচকি হেসে বললেন, ওহে, তোমাকে যদি আমি একটা চাকরি দিই, তা হলে সৎপথে থাকবে?

ছেলেটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, সার, আমাকে পুলিশের হাতে দেবেন না। আপনি নিজে শাস্তি দিন। আপনি যে কাজ দেবেন, তা-ই করতে রাজি আছি।

কাকাবাবু বললেন, হু-উ-উ! অমনই অন্যরকম সুর বেরিয়েছে। আগে আমাকে বলেছিলে বুড়ো, তুই, আর এখন বলছ সার, আপনি! ধরা পড়লেই দয়াভিক্ষা। কিন্তু নিজেরা কাউকে দয়া করো না!

ট্রেনটা থেমে গেছে, শোনা যাচ্ছে হুইলের শব্দ, কারা যেন ছুটে আসছে এদিকে।

ডাকাতটি হাতজোড় করে বলল, বাঁচান সার, মা কালীর দিব্যি করে বলছি, আর কক্ষনও একাজ করব না। আপনি যদি চাকরি দেন, আপনার পায়ে পড়ে থাকব

কাকাবাবু বললেন, চটপট সিটের তলায় শুয়ে পড়ো। সাবধান, পুলিশ যেন টের না পায়। সন্তু, ওর পাইপগানটা জানলা দিয়ে ফেলে দে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress