Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবুর চোখে জল || Sunil Gangopadhyay » Page 8

কাকাবাবুর চোখে জল || Sunil Gangopadhyay

জঙ্গলের মধ্যে একটা বাড়ি। চারপাশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। হয়তো একসময় ছোটখাটো একটা দুর্গ ছিল। এখন দু-এক জায়গা ভেঙে পড়েছে, সেখানে গাছ গজিয়ে গিয়েছে। একটা ভাঙা জায়গায় কয়েকটা বড় বড় শিংওয়ালা গোরু বাঁধা থাকে। দুটো বাছুরও রয়েছে। একজন দুধওলা আর তার বউ সেই গোরুর দুধ দোয়। কাছাকাছি গ্রামে দুধ বিক্রি করে আসে। লোকের ধারণা, ওই দুধওলা আর তার বউই ভাঙা বাড়িটা দখল করে আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে বেশি রাতে সেখানে গাড়ি আসে! ভিতরে কয়েকটা ঘর পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন। খাট-বিছানা পাতা। সামনে একটা সরু বারান্দা। সেটা বেশ লম্বা, কিন্তু খাঁচার মতো লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। বোধহয় জঙ্গল থেকে কোনও জন্তু-জানোয়ার এসে হঠাৎ না ঢুকে পড়ে, তাই এই জাল দিয়ে ঘিরে রাখার ব্যবস্থা। মাঝখানের একটা দরজা দিয়ে বাইরে বেরোনো যায়। এখন সেই দরজাটায় তালা ঝুলছে। বাইরের উঠোনের মাঝখানে একটা কুয়ো। তার পাশে বসে আছে একজন মাঝবয়সি মানুষ। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। সে একটা বেতের ঝুড়ি হাতে নিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। সে সারাদিনই মুড়ি খায়। তার পাশে রাখা আছে একটা বন্দুক!

একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল বিল্টু। ছাই রঙের হাফপ্যান্ট আর সাদা হাফশার্ট পরা। এই পোশাকে সে স্কুলে গিয়েছিল, পাঁচদিনের মধ্যে আর খোলা হয়নি! মাথার চুলও আঁচড়ানো নেই।

তালা লাগানো দরজাটার কাছে এসে বিল্টু বাইরের লোকটাকে বলল, অ্যাই, দরজাটা খুলে দাও। আমি উঠোনে যাব।

লোকটি একবার মুখ তুলে শুধু বিলুকে দেখল। উত্তর না দিয়ে মুড়ি খেতে লাগল আবার।

বিল্টু বলল, এই লটপট সিংহ, তালাটা খুলে দাও না!

লোকটির ভুরু কুঁচকে গেল। বোঝাই গেল যে, তার নাম লটপট সিংহ। নয়! তবু সে কোনও কথা বলল না।

বিল্টু বলল, তা হলে কিন্তু আমি দুধ খাব না।

কোনও উত্তর নেই।

বিল্টু বলল, রুটিও খাব না। ওই গোল গোল রুটি খেতে আমার বিচ্ছিরি লাগে। আমি পাঊরুটি খাই। আমাকে পাঊরুটি দেবে!

লোকটি আর মুখও তুলছে না।

বিল্টু বলল, আমি মুড়িও খাই না। এই বোবা সিংহ, তালা খুলে দেবে কিনা বলো! না হলে কিন্তু আমি এখানেই হিসি করে দেব।

লোকটি এবার তাড়াতাড়ি উঠে এসে কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে তালাটা খুলতে লাগল।

বিল্টু তার দিকে জিভ ভেঙিয়ে বলে উঠল,

“হুঁকোমুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা
মুখে তার হাসি নাই দেখেছ?
নাই তার মানে কী? কেউ তাহা জানে কি?
কেউ কভু তার কাছে থেকেছ?”

দরজাটা খোলা হতেই বিল্টু এক দৌড়ে উঠোনের এক কোণে চলে গেল। তারপর হিসি করতে লাগল একটা ঝোপের মধ্যে। সেখান থেকেই মুখ ফিরিয়ে বলল, এই যে হুঁকোমুখো সিংহ, আমার কাগজ আর রং-পেনসিল চাই।

লোকটি এবার চিৎকার করে বলল, মেরা নাম শিবু সর্দার। কোই সিংহ মিংহ নেহি হ্যায়।

বিল্টু বলল, শিবু সর্দার? তোমার নাম না বললে আমি জানব কী করে? আমার নাম নীলধ্বজ। বলতে পারবে? না উচ্চারণ করতে গেলে দাত ভেঙে যাবে? বি বলেও ডাকতে পারো।

শিবু সর্দার বলল, যাও, ভিতর যাও।

বিল্টু বলল, ইস! বললেই আমি যাচ্ছি আর কী! এখন আমি গাছে চড়ব!

শিবু সর্দার ধমক দিয়ে বলল, নেহি! যাও, ভিতর যাও!

বিল্টু ডান হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে নেড়ে বলল, যাব না! যাব না!

এবার শিবু সর্দার দৌড়ে ওকে ধরতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিন্দু চলে এল কুয়োটার অন্য দিকে।

তারপর শিবু সর্দার যতই ওকে ধরার চেষ্টা করে, ততই জোরে বিন্দু ঘোরে কুয়োর চারপাশে। শিবু সর্দার ওকে ধরতে পারে না, বিল্টু খিলখিল করে হাসে।

খানিক পরে হাঁফিয়ে গেল শিবু সর্দার। সে বিল্টুর দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, একবার পড়নে সে বহুত মারব তুমাকে!

বিল্টু আবার জিভ ভেঙিয়ে বলল,

“রামগরুড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা
হাসির কথা শুনলে বলে,
“হাসব না-না-না-না!”
সদাই মরে ত্রাসে, এই বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশেপাশে।
ঘুম নাহি তার চোখে আপনি বসে-বকে
আপনারে কয়, “হাসিস যদি
মারব কিন্তু তোকে!”

শিবু সর্দার দুহাতে কান চাপা দিয়ে বলল, উফ, পাগল কর দেগা এ লেড়কা!

বিল্টু হেসে হেসে মাথা দোলাতে লাগল।

শিবু সর্দার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, তুমার বাবা-মা তুমসে ওয়াপস নেহি লেগা। তুম ঘর নেহি জায়েগা।

বিল্টু জিজ্ঞেস করল, ওয়াপস মানে কী?

শিবু সর্দার বলল, তুমাকে বাবা-মা ফিরত চায় না। তুমাকে এখানেই থাকতে হবে।

বিন্দু হাততালি দিয়ে বলতে লাগল, এখানেই থাকতে হবে? কী মজা!কী মজা! রোজ রোজ স্নান করতে হবে না। স্কুল যাওয়ার জন্য মোজা পরতে হবে না। মাল্টি ভিটামিন খেতে হবে না, কী মজা! এই জঙ্গলে বাঘ আছে?

শিবু বলল, হ্যায়। বাঘ তুমাকে খাবে।

বিল্টু বলল, আমার আগে তোমাকে খাবে। তোমার গায়ে বেশি মাংস।

শিবু বন্দুকটা দেখিয়ে বলল, হাম গোলি মার দেগা। শের খতম হো যায়েগা।

বিল্টু বলল, না, বাঘ মারবে না! বাঘ আমার বন্ধু। আমি বাঘের ছবি আঁকি। তুমি বন্দুক রাখো কেন? তোমরা বুঝি ডাকাত?

শিবু সর্দার বলল, বকবক মাত করো। যাও, অভি ঘরে যাও!

বিল্টু বলল, ও, কথা বলতে গিয়ে অনেকক্ষণ বুঝি মুড়ি খাওয়া হয়নি? খাও, একটু খেয়ে নাও। আমি মোটেই এখন ঘরে যাচ্ছি না। তুমি চোর পুলিশ খেলতে জানো?

শিবু সর্দার দারুণ চমকে উঠে বলল, পুলিশ? পুলিশকা নাম মাত করো।

বিল্টু তবু বলল, আমি পুলিশ আর তুমি চোর। ডাকাত আর চোর তো একই!

শিবু সর্দার রেগে গিয়ে বলল, ঝুট বাত। চোর লোক ছোটালোক। ডাকাত সব বড়া আদমি।

বিল্টু আবার হি হি করে হেসে উঠল।

রাগ করে মুড়ি খেতে শুরু করল শিবু সর্দার। এ ছেলেটা কিছুতেই ভয় পায় না, ভয় দেখালেও হাসে।

পাশের জঙ্গলে কীসের যেন একটা হুড়মুড় করে শব্দ হল। এ উঠোন থেকে কিছু দেখা যায় না। ডেকে উঠল একটা গোরু।

বিল্টু বলল, বাঘ এসেছে? আমি দেখব, আমি দেখব!

সে পাঁচিলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই শিবু সর্দার খপ করে চেপে ধরল তার একটা হাত। সে বলল, শের নেহি, শোর হো সকতা। দিনকা টাইম মে শের!

বিল্টু বলল, শোর মানে কী?

শিবু বলল, শোর মানে শোর। ঘোঁত-ঘোঁত আওয়াজ করে।

বিল্টু বলল, ও বুঝেছি। শূকর। কিংবা যদি বানর হয়?

শিবু বলল, হাঁ হ্যাঁ, বান্দর। তুমহার মতন।

বিল্টু বলল, আমি বান্দর? মোষকে হিন্দিতে কী বলে? তুমি একটা হিন্দি মোষ। হাত ছাড়ো!

শিবু ওর হাত ছাড়ল না। টানতে টানতে নিয়ে গেল বারান্দাটায়। দরজা বন্ধ করে লাগিয়ে দিল তালা।

বিল্টু বলল,

“লটপট সিং ঝটপট সিং
শিং শিং দুটো শিং
মুড়ি খায় ভুঁড়ি দাস
গান গায়, ইয়ে, কী যেন, হাঁসফাস
প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক
ভুঁড়ি দাস প্যাঁক প্যাঁক
প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক”

শিবু সর্দার রেগেমেগে তালা খুলে বিন্দুকে মারতে আসতেই বিন্দু দৌড়ে ঢুকে গেল একটা ঘরে। সেখানে খাটে শুয়ে ঘুমোচ্ছে আর-একটি লোক। শিবু সেই ঘরে ঢুকল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress