সকালবেলা প্রথম ঘুম ভাঙল সন্তুর
সকালবেলা প্রথম ঘুম ভাঙল সন্তুর, নীচে চেঁচামেচি শুনে।
সন্তু খাট থেকে নেমে জানলাটা খুলে দিল। প্রথমেই চোখে পড়ল, বাড়ির সামনের দিকটায় আর রাস্তায় বেশ জল জমে আছে। বৃষ্টি হয়েছে সারারাত। গাছপালাগুলো স্নান করে সেজেগুজে আছে।
নীচে তিন-চারজন লোক কথাবার্তা বলছে উত্তেজিতভাবে। আর-একজন কেউ কাঁদছে।
সন্তু অন্যদের না জাগিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। অন্য ঘরগুলোর দরজা বন্ধ, দোতলায় আর কারও ঘুম ভাঙেনি বোধহয়।
নীচে এসে দেখল, গোরু নিয়ে হাজির হয়েছে গয়লা আর কাপড়ের বস্তা কাধে একজন ধোপা। জগোদাদা আদ্ধেক দাঁত মেজেছে, আঙুলে ছাই লাগা। আর হাউ হাউ করে কাঁদছে বৃদ্ধ দরোয়ান নটবর সিংহ।
সন্তু ওদের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করেই ঘটনাটা জেনে গেল।
লোহার সিন্দুকটা চুরি গেছে। যারা চুরি করতে এসেছিল, তারা নটবর সিংহের হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখেছিল। সকালবেলা প্রথমে গয়লা এসে ওই
অবস্থায় নটবর সিংহকে দেখে খুলে দিয়েছে বাঁধন। সন্তু ভিতরে গিয়ে সিন্দুকের ঘরটা দেখে এল।
অতবড় সিন্দুকটা ঘষটে ঘষটে টানতে টানতে নিয়ে গেছে, মেঝেতে দাগ পড়ে গেছে। আর কোনও চিহ্ন নেই।
সন্তু দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল, কাকাবাবু উঠে বসেছেন।
সন্তু কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, কী, সিন্দুকটা চোরে নিয়ে গেছে তো?
সন্তু মাথা নাড়ল।
কাকাবাবু বললেন, কাল রাত্তিরেই আমার এ-কথা মনে হয়েছিল। হাজার হাজার লোক এসে দেখেছে সিন্দুকটা। অনেকেরই ধারণা, ওর মধ্যে গুপ্তধন
আছে। চোরেদের তো লোভ হবেই।
সন্তু বলল, এখন কী হবে?
কাকাবাবু কাঁধ কঁকিয়ে বললেন, কী আর হবে? আমাদের কি সারারাত ধরে ওটা পাহারা দেওয়ার কথা ছিল? আমরা তো সেজন্য এখানে আসিনি!
সন্তু বলল, সিন্দুকটার মধ্যে কী ছিল, তা জানাই গেল না।
কাকাবাবু পালঙ্ক থেকে নেমে বললেন, এখন যে একটু চা দরকার। কাল বেড টি-র কথা বলতে ভুলে গেছি। প্রবীরদের কাউকে দেখতে পেলি?
সন্তু বলল, না। জগোদাদা রয়েছে নীচে। আর কেউ জাগেনি।
কাকাবাবু বললেন, কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। তাতে খুব সুবিধে হয়েছে চোরদের। সবাই জানলা বন্ধ করে শুয়েছে, কেউ কোনও সাড়াশব্দ পায়নি।
একটু পরেই ছুটতে ছুটতে এল কমলিকা।
চোখ বড় বড় করে বলল, কাকাবাবু, কী হয়েছে জানেন? যাঃ, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, কী হয়েছে?
কমলিকা বলল, নীচে চলুন, দেখবেন চলুন!
কাকাবাবু বললেন, কী দেখব?
কমলিকা বলল, লোহার সিন্দুকটা নেই।
কাকাবাবু বললেন, না থাকলে আর নীচে গিয়ে দেখব কী করে?
কমলিকা বলল, সেটা চুরি হয়ে গেছে!
কাকাবাবু বললেন, চুরি হয়ে গেলে তো দেখা যাবে না ঠিকই!
কমলিকা বলল, বাঃ, কে চুরি করল আপনি দেখবেন না?
কাকাবাবু বললেন, আমি কী করে চোরকে দেখব? সে কি আমার জন্য বসে আছে?
কাকাবাবুর ঠান্ডা ব্যবহারে কমলিকা বেশ নিরাশ হল। সে ভেবেছিল, চুরির খবর শুনেই কাকাবাবু হন্তদন্ত হয়ে নেমে যাবেন।
কাকাবাবু আবার বললেন, সেই যে রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নাটকে একটা গান আছে:
চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে
চোর চাই
যে করেই হোক, চোর চাই
হোক না সে যে-কোনো লোক
চোর চাই
নইলে মোদের যাবে মান…
বেসুরো গলায় গুনগুনিয়ে এইটুকু গান গেয়ে কাকাবাবু বললেন, ওহে। রাজকুমারী, চোর ধরা তো পুলিশের কাজ। আমি পুলিশও নই, আমি ডিটেকটিভও নই। তোমার বাবা নেমন্তন্ন করেছেন বলে এসেছি এখানে।
কমলিকা তখন সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই জোজো, তুমি এতদিন কাকাবাবুর সঙ্গে থেকে কিছু শেখোনি?
সন্তু বলল, পটৌডির নবাবের বেগমসাহেবার যখন হিরের নেকলেস চুরি গেল, তখন কাকাবাবু ছিলেন বিদেশে, আমরা ভোপালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন আমিই তো বলেছিলাম, নেকলেসটা কোনও সাধারণ চোর চুরি করেনি, নিয়েছে একটা বাঁদর। ওখানে খুব বাঁদরের উৎপাত। ঠিক একটা বাঁদরের গলা থেকে পাওয়া গেল!
কাকাবাবু অবাক হয়ে সন্তুর কথা শুনলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন,
নেকলেসটা হিরের ছিল, না মুক্তোর? বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা!
সন্তু কমলিকার দিকে তাকিয়ে বলল, পঢৌডির বেগমসাহেবা কে জানো তো? শর্মিলা ঠাকুর!
কমলিকা বলল, সত্যি?
সন্তু বলল, সত্যি না তো কী? ফ্যাক্ট!
কাকাবাবু বললেন, রাজকুমারী, কাল রাত্তিরে চোর এসেছিল বলে কি আমরা সকালে চা পাব না? আমার ঘুম ভাঙলেই খুব চায়ের তেষ্টা পায়।
কমলিকা বলল, আমি এক্ষুনি চায়ের ব্যবস্থা করছি।
সে বেরিয়ে যেতেই কাকাবাবু হাসতে হাসতে সন্তুকে বললেন, তুই যে জোজোকেও টেক্কা দিচ্ছিস রে সন্তু! বাঁদরের গলায় শর্মিলা ঠাকুরের নেকলেস? তবে এইসব গল্প জোজোকেই বেশি মানায়। এবার তোরা নাম বদলের খেলা শেষ করে দে। আমিই ভুল করে তোকে সন্তু বলে ডেকে ফেলব!
জোজো এখনও ঘুমোচ্ছে। সন্তু তার গায়ে হাত রেখে ডাকল, কী রে, এখনও উঠবি না?
জোজো চোখ পিটপিট করে বলল, আমি আগেই জেগে গেছি। সব শুনছি! সন্তুটা কী গুলবাজ দেখলেন? আমিই তো ওকে ভোপালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ও কি ভোপালের নবাবকে চিনত? পটৌডি তো আমাদের বাড়িতে আমার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেকবার এসেছে। বাঁদরটা যখন মুক্তোর মালাটা চুরি করল, তখন আমিই তো, মানে বাঁদরটাকে ধরাই যাচ্ছিল না। এক গাছ থেকে আর-এক গাছে লাফিয়ে পালাচ্ছিল, আমিই তো হিপনোটাইজ করে বাঁদরটাকে মাটিতে নামিয়ে আনলাম, সন্তু সে-কথা বললই না!
সন্তু বলল, এবার থেকে তুই একাই সব বলবি।
কাকাবাবু বললেন, তোরা দুই বন্ধুতে চেষ্টা করে দ্যাখ না, যদি এই সিন্দুক-রহস্য কিছু সমাধান করতে পারিস। আমি ওটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। আমার মাথায় এখন অন্য চিন্তা।
সন্তু বলল, নানাসাহেব!
একটু বাদেই কমলিকা চায়ের ট্রে নিয়ে এল।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা ঘুম থেকে উঠেছেন?
কমলিকা বলল, হ্যাঁ, এইমাত্র। আপনাদের কিন্তু ঠিক নটার সময় ব্রেকফাস্ট খেতে যেতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, তারপর আমি একবার মন্দিরটা দেখতে যাব।
পরপর দুকাপ চা খেয়ে কাকাবাবু টয়লেটের জন্য নামলেন নীচের তলায়।
বাড়ির সদর দরজার সামনে এখন আরও অনেক লোকের ভিড় জমে। গেছে। তক্ষুনি সাইকেল চেপে এসে পড়লেন বিনয়ভূষণ মহাপাত্র।
বিনয়ভূষণ বললেন, নমস্কার, রায়চৌধুরীবাবু। শরীরটরির সব ঠিক আছে তো?
কাকাবাবু প্রতি-নমস্কার জানিয়ে বললেন, সব ঠিক আছে। বিনয়ভূষণ বললেন, কী কাণ্ড বলুন দেখি, আপনি এখানে উপস্থিত থাকতেও সিন্দুকটা চুরি হয়ে গেল?
কাকাবাবু বললেন, আপনি তো কাল আমায় এই সিন্দুকটার কথা কিছু বলেননি
বিনয়ভূষণ ভুরু তুলে বললেন, সে কী! আমি তো ধরেই নিয়েছি, আপনি সব জানেন। আপনার সাহায্য নেওয়ার জন্যই কিরণচন্দ্র ভঞ্জদেও আপনাকে এখানে আনিয়েছেন। নইলে এত ছোট জায়গায় কেউ কি বেড়াতে আসে?
কাকাবাবু একটু বিরক্তভাবে বললেন, আমি এই সিন্দুকটার কথা কিছুই জানতাম না। সিন্দুক পাহারা দেওয়া আমার কাজ নয়।
বিনয়ভূষণ বললেন, চলুন স্যার, ভিতরে গিয়ে দেখি চোরেরা অত ভারী জিনিসটা কীভাবে সরাল।
কাকাবাবু বললেন, আপনি গিয়ে দেখুন। তাতেই হবে। হ্যাঁ, ভাল কথা, আমাদের গাড়ি যে চালাচ্ছিল, গুরুপদ রায়, তার কী খবর?
বিনয়ভূষণ বললেন, সে সারারাত বাড়ি ফেরেনি। আজ সকালেও তার বাড়িতে লোক পাঠিয়েছি, তার কোনও খবর নেই, তবে ও মাঝে মাঝেই এরকম করে। কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যায়। আমাদের থানার ড্রাইভার ভাল হয়ে গেছে, তাকে নিয়ে এসেছি, জিপটা ফেরত নিয়ে যাবে।
একজন লোক জিপগাড়িটা স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছে। কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন সেদিকে।
লোকটি কাকাবাবুর কথা আগেই শুনেছিল বোধহয়, তাই সে কঁচুমাচু মুখে বলল, প্ৰণাম নেবেন স্যার, আমি কাল যেতে পারিনি, মাপ করবেন।
কাকাবাবু বললেন, আপনার তো শরীর খারাপ হয়েছিল। এখন কেমন আছেন?
ড্রাইভার বলল, একদম ভাল হয়ে গেছি। আশ্চর্য ব্যাপার স্যার, কাল চব্বিশ বার ইয়েতে যেতে হয়েছিল, প্রায় মরেই যাচ্ছিলাম, বাড়ির লোক ভয় পেয়ে ডাক্তার ডেকে আনল। ডাক্তারবাবু একটামাত্র ওষুধ দিলেন, তাই খেয়েই সব বন্ধ হয়ে গেল।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, খুব ভাল ডাক্তার তো!
ড্রাইভার বলল, ডাক্তারবাবু কী বললেন জানেন? বললেন, এই ওষুধটা খেয়ে যদি তোমার ইয়ে বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে বুঝবে, তোমার ফুড পয়জনিং হয়েছে, ভয়ের কিছু নেই। আর যদি না কমে, তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। কমে গেল, তাই হাসপাতালে যেতে হল না।
কাকাবাবু বললেন, এক ওষুধেই কমে গেল? ফুড পয়জনিং, বাড়িতে। আর কারও কিছু হয়নি?
ড্রাইভার বলল, সেইটাই তো আশ্চর্য ব্যাপার স্যার। আমার বাড়িতে অনেক লোক, সবাই একই খাবার খেয়েছি। ডাল, ভাত আর ঝিঙে-পোস্ত। আমরা মাছ-মাংস খাই না, বাড়িতে আসেই না। আমার মা রান্না করেন। আমার মায়ের রান্নার সুখ্যাতি আছে। বাড়ির আর কারও কিছুই হয়নি। শুধু আমারই একার…
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে কিছুই খাননি?
ড্রাইভার বলল, না স্যার। আমার দোকানের খাবার খাওয়ার অভ্যেস নেই। বাড়িতেই খাই। তবে, মাঝে মাঝে চা খাই।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কাল কোন দোকানে চা খেয়েছিলেন?
ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ, আমাদের থানার কাছেই একটা ছোট চায়ের দোকান, শুধু এক কাপ চা খেয়েছিলাম। বিস্কুট টিস্কুটও কিছু খাইনি। চা খেলে কি ফুড পয়জনিং হয়? কত লোকই তো এ-দোকানে চা খায়।
কাকাবাবু বললেন, ওই দোকানে সে-সময় আপনার চেনাশুনো কেউ ছিল?
ড্রাইভার বলল, হ্যাঁ, ছিল কয়েকজন!
কাকাবাবু বললেন, গুরুপদ ছিল?
ড্রাইভার খানিকটা অবাক হয়ে বলল, গুরুপদ? হ্যাঁ স্যার, সে দাঁড়িয়েছিল দোকানের সামনে, আমাকে রাস্তায় দেখে ডেকে বলল, এসো, এক কাপ চা খেয়ে যাও?
কাকাবাবু বিনয়ভূষণের দিকে ফিরে বললেন, এবার বুঝলেন, কেন কাল আমাদের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল?
কাকাবাবু ড্রাইভারের পেটখারাপ নিয়ে এত খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করছেন দেখে বিনয়ভূষণ বেশ অবাকই হচ্ছিলেন। এখন বললেন, ও কিন্তু সব সত্যি কথা বলছে স্যার। সত্যিই ওর আর কাল বাড়ি থেকে বেরোনোর মতন অবস্থা ছিল না।
কাকাবাবু বললেন, সত্যি কথা বলছে বলেই তো আসল কারণটা বোঝা গেল। গুরুপদ ওকে ডেকে নিয়ে গেছে চায়ের দোকানে। তারপর ওর চায়ের সঙ্গে অনেকখানি জোলাপ মিশিয়ে দিয়েছে। যাতে ওকে বারবার বাথরুমে যেতে হয়, আর গাড়ি চালাতে না পারে। আপনারা বাধ্য হয়ে তখন গুরুপদকে নিলেন।
বিনয়ভূষণ বললেন, ও নিজেই এসেছিল থানায়। মাঝে মাঝে আমরা ওকে কিছু কিছু কাজ দিই। ও যে গ্যারাজে কাজ করে, সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া নিতে হয়। কাল থানায় এসে বলল, স্যার, অনেকদিন আমায় কোনও কাজ দেননি। আমি ভাবলাম, ভালই হল, ও গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, তারপর গুরুপদ ইচ্ছে করে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগাল, তার আগে লাফিয়ে নেমে পড়ল নিজে। আমাদের হয়তো একেবারে মেরে ফেলতে চায়নি। খানিকটা আহত টাহত হতে পারি। আসল ব্যাপার হল, ও ভেবেছিল, বিনয়ভূষণ গাড়ি চালাতে জানেন না, আমিও খোঁড়া মানুষ, গাড়ি ড্রাইভ করতে পারব না, গাড়িটাও আর স্টার্ট না নিতে পারে। অর্থাৎ রাত্তিরের মধ্যে আমরা এখানে পৌঁছোতে পারব না। সেটাই গুরুপদর উদ্দেশ্য ছিল।
বিনয়ভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, কেন? এতে ওর লাভ কী?
কাকাবাবু বললেন, ওর পিছনে অন্য কেউ আছে। বা কোনও দল। তারা ঠিক করেছিল, আমাদের জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখে লোহার সিন্দুকটা রাজবাড়ি থেকে চুরি করবে।
বিনয়ভূষণ বললেন, আমারও ধারণা ছিল, আপনি সিন্দুকটা দেখার জন্যই এখানে আসছেন। কিন্তু স্যার, আপনি গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলেন, তাও তো চুরি হয়ে গেল সিন্দুক। ওর ভিতরে কত ধন-সম্পদ আছে কে জানে!
কাকাবাবু বললেন, আমি তো সিন্দুকটা পাহারা দেওয়ার জন্য আসিনি। ওটার কথা জানতামই না।
বিনয়ভূষণ বললেন, সিন্দুকটা থানায় জমা দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে আর এই ঝামেলা হত না।
কাকাবাবু বললেন, হু। পুকুর খোঁড়ার সময় সিন্দুকটা দেখা গিয়েছিল পাঁচদিন আগে, সেটা ওখানে ফেলে রাখা হয়েছিল কেন এই কদিন?
বিনয়ভূষণ বললেন, জিনিসটা খুব ভারী, কাদার মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে, তোলা খুব শক্ত ছিল। তা ছাড়া মাঝখানে একটা লক্ষ্মীপুজো পড়েছিল বলে দুদিন কোনও কাজ হয়নি। লক্ষ্মীপুজোর মেলা হয়।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, আপনি আপনার কাজ করুন। আমি যাচ্ছি ভিতরে।
বিনয়ভূষণ বললেন, কিছু দরকার লাগলে বলবেন স্যার। এইসময় আর-একটা জিপগাড়ি এসে থামল। জিন্স আর কোমরে গোঁজা লাল রঙের ফুলহাতা শার্ট-পরা একজন লম্বামতন লোক সেই জিপ থেকে নেমে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল এদিকে।
কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে দুহাত তুলে বলল, নমস্কার! আপনি নিশ্চয়ই। কাকাবাবু, মানে রাজা রায়চৌধুরী? আপনার সঙ্গে ক্রাচ দেখে বুঝেছি।
কাকাবাবুও নমস্কার করে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই রুদ্রকুমার ভঞ্জদেও?
লোকটি বলল, হ্যাঁ। আপনি কী করে বুঝলেন? কাকাবাবু হেসে বললেন, আমার শার্লক হোমসের মতন ক্ষমতা নেই। তবে আপনার গলায় একটা সোনার হার রয়েছে, কিরণচন্দ্র ভঞ্জদেওর গলাতেও ঠিক এইরকম হার দেখেছি। আপনাদের পরিবারের লোকদের বোধহয় এরকম হার পরা নিয়ম, তাই না?
রুদ্রকুমার বলল, ঠিক ধরেছেন। একুশ বছর বয়স হলেই এই হার পরতে হয়। এখানকার মন্দিরের হেড পুরুতমশাই পরিয়ে দেন। আপনারা তো কাল রাত্তিরে এসেছেন, পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
কাকাবাবু বলল, না, সেরকম কিছু না। রুদ্রকুমার বলল, দাদা বলেছিলেন, আপনারা আসবেন, কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে দেখবেন, তাই জিপটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। ড্রাইভার আছে, যেখানে যেতে চাইবেন, নিয়ে যাবে।
এবার বিনয়ভূষণ বললেন, ছোটবাবু, সিন্দুকটা চুরি হয়ে গেছে, শুনেছেন?
রুদ্রকুমার দারুণ অবাক হয়ে বলল, অ্যাঁ সিন্দুকটা… যেটা পুকুরের মধ্যে ছিল? কবে তোলা হল?
বিনয়ভূষণ বললেন, কালই তুলতে পারা গিয়েছিল!
রুদ্রকুমার খুবই বিরক্তভাবে বলল, একরাতেই চুরি হয়ে গেল! থানা থেকে? আপনারা আছেন কী করতে? যত সব অপদার্থ!
বিনয়ভূষণ বললেন, আজ্ঞে, থানা থেকে চুরি হয়নি। এ-বাড়িতেই রাখা হয়েছিল।
কেন?
মন্দিরের পুরুতরা বলল, এ-বাড়িতেই, সবার সামনে তালা ভেঙে দেখা হবে।
রুদ্রকুমার বলল, এ-বাড়িতে রাখার কোনও মানে হয়? কে পাহারা দেবে? এই নটবর সিংহ? আপনারা পুলিশ পোস্টিং করেননি কেন?
বিনয়ভূষণ খানিকটা চুপসে গিয়ে বললেন, সেরকম কেউ বলেনি। মানে, আমাদের উপর কোনও অর্ডার ছিল না।
রুদ্রকুমার বলল, অতবড় সিন্দুকটা নিল কী করে? চোরেরা কি লরিটরি এনেছিল?
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সে বলল, এই যে মাটিতে দাগ, ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে গেছে। মিস্টার রায়চৌধুরী, দেখুন, দেখুন।
কাকাবাবু কোনওরকম আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন একই জায়গায়।
রুদ্রকুমার আর-একটু এগিয়ে বলল, এই যে ভিতর থেকে নিয়ে এসেছে, সিমেন্টের উপরেও দাগ, তারপর বাড়ির বাইরে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টিতে সব ধুয়ে গেছে!
তারপর রুদ্রকুমার কাকাবাবুর কাছে ফিরে এসে বলল, ইস, ছি ছি ছি, সিন্দুকটার মধ্যে কী ছিল, তা জানাই গেল না! হয়তো খুব দরকারি কোনও দলিলপত্র ছিল! এ তো চুরি নয়, ডাকাতি!
কাকাবাবু বললেন, সিন্দুকটার মধ্যে অনেক কিছুই থাকতে পারে। ডাকাতরা নিশ্চয়ই এতক্ষণ তালা ভেঙে ফেলেছে। এখন সেই ডাকাতদের ধরা পুলিশের কাজ।
বিনয়ভূষণের দিকে ফিরে কাকাবাবু বললেন, আমি এখন ভিতরে যাচ্ছি। আমাদের কালকের ড্রাইভার গুরুপদর কোনও খোঁজ পেলে আমাকে জানাবেন।
ঠিক নটার সময় সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট খেতে যেতে হল।
টেবিলের উপর প্লেট নেই, তার বদলে টুকরো টুকরো কলাপাতা। তার উপর পাকা কলা, সবেদা, আম আর পাকা পেঁপে। আর রয়েছে নানারকমের মিষ্টি।
কমলিকা খাবার তুলে দিতে দিতে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এরপর চা না কফি?
কাকাবাবু বললেন, কফি। সকালে উঠে প্রথমবার চা খাই। তারপর সারাদিন কফি।
কমলিকা জোজোকে জিজ্ঞেস করল, এই সন্তু, তুমি চা খাও নাকি?
জোজো বলল, খাব না কেন? আমিও খাই, জোজোও খাও।
কমলিকা বলল, আমি চা খাই না। দাদাও খায় না। বাজে অভ্যেস।
প্রবীর বলল, আমি অবশ্য আমাদের কলেজের সামনে কফি হাউজে গিয়ে মাঝে মাঝে কফি খাই। বন্ধুরা জোর করে।
এই সময় জগোদাদা একটা হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল, তাতে বসে আছেন কিরণচন্দ্র ভঞ্জদেও। তার কোলের উপর একটা চাদর পাতা। মুখোনা একেবারে শুকনো। মনে হয় খুবই অসুস্থ।
তাঁকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল।
কিরণচন্দ্র আস্তে আস্তে বললেন, বসুন, সবাই বসুন। রায়চৌধুরীদাদা, রাত্রে ঠিক ঘুম হয়েছিল তো?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু আপনার এই অবস্থা হল কবে? আর হাঁটতেই পারেন না?
কিরণচন্দ্র বললেন, না, পায়ে একেবারে জোর নেই। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
কাকাবাবু বললেন, ইস! আপনি তো আমার চেয়ে বয়সে বেশ ছোট?
কিরণচন্দ্র বললেন, আমার যে মনের জোরটাও কমে গেছে! থাক সেসব কথা। আপনারা বেড়াতে এলেন, এর মধ্যে কী ঝঞ্ঝাট শুরু হল বলুন তো! একটা সিন্দুক নাকি চুরি হয়েছে, তার ফলে যখন-তখন পুলিশ আসছে। পুলিশদের তো আর নিষেধ করা যায় না। ও সিন্দুকটা আমাদের বাড়িতে রাখারই বা কী দরকার ছিল?
কাকাবাবু বললেন, অনেকের ধারণা হয়েছে, ওই সিন্দুকটার খবর পেয়েই আমি আপনার কাছে এসেছি!
কিরণচন্দ্র একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল তো একমাস আগে। আপনাকে ওসব সিন্দুক ফিন্দুক নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। ভাইপোদের নিয়ে এসেছেন, একটু চারদিক বেড়িয়ে টেড়িয়ে দেখুন। বেড়াবার অনেক জায়গা আছে।
তারপর তিনি প্রবীরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর ছোটকাকা ফিরেছে শুনলাম। সে কোথায়? ব্রেকফাস্ট খেতে এল না?
প্ৰবীর বলল, ছোটকাকা একটু আগে ফিরেছে। তারপরই ঘুমিয়ে পড়ল?
কিরণচন্দ্র বললেন, এখন ঘুমোচ্ছে? সে কী!
কমলিকা বলল, ছোটকাকা মাঝে মাঝেই সকালবেলা ঘুমোয়, আর রাত্তিরবেলা জেগে থাকে।
কিরণচন্দ্র বললেন, সে কী!
কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে দেখা করেছে আমার ছোটভাই? ও কিন্তু কলকাতায় যেতে চায় না, এই ভাঙা বাড়িতে থাকাই পছন্দ করে।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। রুদ্রকুমারের সঙ্গে আমার দু-একটা কথা হয়েছে।
কিরণচন্দ্র বললেন, আপনি যে ইতিহাস নিয়ে চর্চা করছিলেন, তার কতটা এগোল?
কাকাবাবু বললেন, কিছু কিছু সূত্র পেয়েছি। আপনাদের এই জায়গাটারও তো অনেক ইতিহাস আছে।
কিরণচন্দ্র বললেন, তা তো আছেই। তবে অনেক কিছুই লিখে রাখা হয়নি, হারিয়ে যাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, আপনি একটা হিসেবের খাতার কথা আমাকে বলেছিলেন।
কিরণচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ। কিছুদিন আগে আমি কয়েকখানা হিসেবের খাতা খুঁজে পেয়েছি। খুব পুরনো। তাতে লেখা আছে আমাদের রাজবাড়ির প্রতিদিনের হিসেব। অনেক লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে, তবে, আতশ কাচ, দিয়ে কষ্ট করে পড়া যায়।
জোজো সন্তুর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল।
সন্তু বলল, আতশ কাচ হচ্ছে ম্যাগনিফাইং গ্রাস।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেইসব হিসেব কি ওড়িয়া ভাষায় লেখা?
কিরণচন্দ্র বললেন, প্রথম চারখানা খাতা বাংলায় লেখা। তখন এখানে বাংলা ভাষা চালু ছিল। পরেরগুলো ওড়িয়া ভাষায়। মোট সাতখানা মোটা মোটা খাতা। তাতে অনেক মজার মজার খবর পাওয়া যায়। যেমন হাতির বিয়েতে কত খরচ হয়েছিল। বাঘ মারার জন্য একজন সাহেব শিকারিকে ডেকে আনা হয়েছিল, তার জন্য খরচ। সে শিকারির সঙ্গে এসেছিল একজন মেমসাহেব। এই অঞ্চলের মানুষ তার আগে কোনও মেমসাহেব দেখেনি। সেই মেমসাহেব ডাবের জল ছাড়া অন্য জল খেতই না! তার জন্য শত শত ডাব আনানো হয়েছিল বাংলা মুল্লুক থেকে। এখানে তো ডাব পাওয়া যায় না! কয়েকটা যুদ্ধের কথাও আছে। কিছু কিছু ব্যাপার অবশ্য বুঝতেও পারিনি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম খাতাটা কত পুরনো?
কিরণচন্দ্র বললেন, তারিখ লেখা আছে, প্রথমটা শুরু হচ্ছে এইট্টিন ফিটি ওয়ান থেকে। প্রথম বছরেই আছে হাতির বিয়ের কথা। রাজার নিজস্ব একটা হাতি ছিল, আর রানিরও ছিল এক হস্তিনী। খুব ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দুজনের, তখনকার দিনে খরচ হয়েছিল সাত হাজার টাকা। এখনকার দিনে সাত লাখ টাকার সমান।
প্ৰবীর বলল, বাবা, আমি খাতাগুলো পড়তে চাই। ওর থেকে গল্প লিখব।
কমলিকা বলল, আমিও পড়ব।
কাকাবাবু বললেন, তোমরা তো পড়বেই। তোমাদের বাড়ির জিনিস। আগে আমি একবার পড়ে নিতে পারি কি?
কিরণচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, রায়চৌধুরীদাই আগে পড়বেন। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। সঙ্গে আমার আতশ কাচটাও দিয়ে দেব। আমি এবার যাই? কিছুক্ষণ কথা বললেই ক্লান্ত লাগে।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি বিশ্রাম নিন। আমাদেরও তো খাওয়া শেষ হয়ে গেছে!