Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও মরণফাঁদ || Sunil Gangopadhyay » Page 6

কাকাবাবু ও মরণফাঁদ || Sunil Gangopadhyay

বিকেল থেকেই দারুণ মেঘ করে আছে। আকাশ একেবারে কালো, নেমে আসছে অন্ধকার।

সুকোমলের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। দুপুরে পুলিশের দুজন বড় অফিসার এসে দেখা করে গেছেন কাকাবাবুর সঙ্গে। তাঁদের ধারণা, ছেলেটাকে পাচার করে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে। এখানকার পুলিশ ওদিকে যেতে পারবে না।

তাঁরা আরও বললেন, এসব ব্যাপারে পুলিশ বাড়াবাড়ি করতে সাহস পায় না। ছেলেটাকে ওরা মেরে ফেলতে পারে। এরা এতই নিষ্ঠুর। আগে দু-একবার এরকম হয়েছে। এখন কাকাবাবু যদি কিছু বুদ্ধি দিতে পারেন!

কাকাবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছিলেন, আমি কী বুদ্ধি দেব? ছেলেটার প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে। আমার কোনও ভুলের জন্য যদি ছেলেটার প্রাণ যায়, তা হলে আমি সারাজীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।

পুলিশের এস পি বলেছিলেন, টাকা দিয়ে যদি ছেলেটাকে ছাড়িয়ে নিতে হয়, তা হলে ওরা লাই পেয়ে যাবে। বার বার এরকম করবে!

তাও ঠিক!

সারাদুপুর কাকাবাবু শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলেন।

জোজো আর সম্ভুর মুখেও কথা নেই। থিয়েটার তো বন্ধ হয়ে গেলই, এখন সুকোমলকে ভালয় ভালয় ফিরিয়ে আনাই বড় কথা। জোজো বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না।

একসময় সে বলল, এক কাজ করলে হয় না? মনে কর, পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে সুকোমলকে ছাড়িয়ে আনা হল। তারপর ব্যাটাগুলোকে ধরে এমন মার মারব!

সন্তু বলল, পাঁচ লাখ টাকা পাবি কোথায়? তারপর ব্যাটাগুলোকে ধরবিই বা কী করে?

জোজো বলল, পি সি সরকারকে খবর দিলে হয়! উনি তো ম্যাজিকে হাওয়া থেকে টাকা বানাতে পারেন। উনি টাকা বানিয়ে দেবেন, সেই টাকা ওদের দেওয়া হল, একটু পরেই টাকাগুলো আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে!

সন্তু বলল, তোর আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু কাগজে পড়েছি, পি সি সরকার এখন ইন্ডিয়াতেই নেই, রাশিয়ায় ম্যাজিক দেখাচ্ছেন!

জোজো বলল, ইস, তা হলে তো খুব মুশকিল! সন্তু জিজ্ঞেস করল, টাকা দেওয়ার পর তুই লোকগুলোকে ধরবি কী করে?

জোজো বলল, সেটা খুব সহজ। আমি এমন একটা মজার মন্ত্র জানি, সেটাতেই ধরা পড়ে যাবে। মন্ত্রটা শুনবি?

সন্তু বলল, শুনি।

জোজো বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ফাটল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস!

সন্তু বলল, এটা মন্ত্র নাকি?

জোজো তার হাতে একটা চাপড় মেরে বলল, তুই বল, একবার বলে দ্যাখ!

সন্তু বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ফাটল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস! এই তো বললাম, তাতে কী হল?

জোজো বলল, বললি তো। এবার এটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। কিছুতেই ভুলতে পারবি না। খানিক বাদে এটা মনে মনে বিড়বিড় করবি। তারপর জোরে জোরে বলবি। তারপর রাস্তা দিয়ে নিজেই পাগলের মতন চ্যাঁচাবি, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল…। যে লোক রাস্তায় এটা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে যাবে, পুলিশ তাকে ধরতে পারবে না।

সন্তু বলল, সর্বনাশ! আমারও সেই অবস্থা হবে নাকি?

জোজো বলল, তোকে আমি উলটো মন্ত্র দিয়ে চুপ করিয়ে দেব!

সন্তু বলল, ছেলেচোরেরা যদি রাস্তা দিয়ে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে এটা বলতে বলতে যায়, তা হলে তো আরও অনেক লোক শুনবে! সেই লোকেরাও তা হলে চ্যাঁচাবে?

জোজো বলল, তা হবে না। এই যে আমি তোর হাতে চাপ মারলাম! আমি যাকে ছুঁয়ে এই মন্ত্র দেব, তারই শুধু মাথায় এটা গেঁথে যাবে!

সন্তু বলল, তা হলে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করাই আগে দরকার।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাগানে বসা যাবে না। কাকাবাবু বিকেলে চা খেতে বসেছেন বারান্দায়।

সন্তুর হাতে বিস্কুটের কৌটো। একবার সেটা পড়ে গেল, মাটিতে ছড়িয়ে গেল কয়েকটা বিস্কুট।

সন্তু সেগুলো তুলতে গিয়ে একদিকে তাকিয়ে বলল, আরে, এটা এখানে কোত্থেকে এল? আগে তো ছিল না।

বারান্দায় কয়েকটা ফুলগাছের টব রয়েছে, তার মধ্যে দাঁড় করানো রয়েছে একটা মূর্তি। কাঠের কিংবা ফাইবার গ্লাসের। মূর্তিটা হাত দেড়েক লম্বা, সারা গা কালো রং করা, শুধু মুখোনা লাল রঙের।

মূর্তিটা সত্যিই আগে এখানে ছিল না।

জোজো সেটা ধরতে যেতেই সন্তু বলল, এই, এই, এই ধরবি না!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কোনও নতুন জিনিস দেখলে ছুঁয়ো না। সকালবেলা লাল বলটার কথা মনে নেই? এটা এখানে এল কী করে?

সন্তু ভেতর থেকে একটা টর্চ নিয়ে এল।

সেই আলোয় ভাল করে দেখা গেল। মূর্তিটার মুখোনা বীভৎস রকমের, ঠিক যেন একটা রাক্ষস। হাতদুটো দুদিকে ছড়ানো। হাতদুটো শরীরের তুলনায় বেশি লম্বা।

কাকাবাবু বললেন, এটা কি বাড়ির ভেতর থেকে কেউ এখানে এনে রেখেছে? রঘুকে ডাক তো।

রঘু এল, ছোটমামাও বেরিয়ে এলেন।

তিনি দেখে বললেন, এটা তো আমাদের বাড়ির জিনিস নয়। আমি কখনও দেখিইনি! এমন বিচ্ছিরি একটা পুতুল এখানে কে রাখল?

কাকাবাবু বললেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে, ওটা ধরা ঠিক হবে না!

এর পরেই অদ্ভুত কাণ্ড শুরু হল।

মূর্তিটা ঠক করে পড়ে গেল মাটিতে। তারপর নিজে নিজেই আবার উঠে দাঁড়াল।

জোজো বলল, আরিব্বাস! এটা জ্যান্ত নাকি?

যেন সেই কথা শুনেই মূর্তিটা ঠক ঠক করে এগিয়ে এল দুপা।

কাকাবাবু ছাড়া আর সবাই পিছিয়ে গেল ভয় পেয়ে। কাকাবাবু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন মূর্তিটার দিকে।

সেটা এবারে ঠক ঠক করে শুরু করে দিল নাচ। ঠিক পুতুল নাচের মতন। কিন্তু মূর্তিটায় কোনও সুতো বাঁধা নেই।

একবার বড় লাফ দিয়ে মূর্তিটা উঠে গেল শূন্যে। তারপর সবার মাথার ওপর দিয়ে ঘুরতে লাগল বোঁ বোঁ করে।

কাকাবাবু ছাড়া আর সবাই মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত। রঘু বলল, লাঠি দিয়ে এটাকে মারব?

কাকাবাবু বললেন, না। তার দরকার নেই। কয়েকবার ঘোরার পর মূর্তিটা বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল বাইরে। তারপর বাগান পেরিয়ে একটা পাখির মতন উড়তে উড়তে চলে গেল রাস্তার দিকে।

তারপরেই শোনা গেল একটা মোটরবাইরের স্টার্ট দেওয়ার শব্দ!

ছোটমামা হতভম্বের মতন বললেন, ব্যাপারটা কী হল?

কাকাবাবু বললেন, ছেলেখেলা!

ছোটমামা বললেন, তার মানে কী রাজাদা? একটা কাঠের মূর্তি নিজে নিজে উড়তে লাগল আমাদের চোখের সামনে? না কি চোখে ভুল দেখলাম।

কাকাবাবু বললেন, ঠিকই দেখেছ। তবে এমন কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। রিমোট কন্ট্রোল। অনেক খেলনা, রেলগাড়ি, এরোপ্লেন রিমোট কন্ট্রোলে চালানো যায়। বাগানের বাইরে থেকে এটাও কেউ চালাচ্ছিল। সকালে পুকুরের লাল বলটা এরকম রিমোট কন্ট্রোলেই ফাটানো হয়েছে। জোজো, তুমি মোটরবাইকে চড়া লোকটির হাতে যা দেখেছিলে সেটা মোবাইল ফোন নয়, রিমোট কন্ট্রোল।

জোজো বলল, খুব চমকে দিয়েছিল কিন্তু?

কাকাবাবু বললেন, আমাদের সঙ্গে এরকম ছেলেখেলা করার মানে কী? ছোটমামা বললেন, কে করছে এসব।

কাকাবাবু বললেন, সেটাই তো পুলিশের বার করার কথা।

সন্তু বলল, বার বার যে লোকটা মোটরসাইকেল চেপে আসছে আর পালাচ্ছে, ওকে আগে ধরা দরকার।

জোজো জিজ্ঞেস করল, সন্তু, তুই মোটরসাইকেল চালাতে জানিস?

সন্তু বলল, না, কখনও চেষ্টা করে দেখিনি।

জোজো বলল, আমি খুব ভাল পারি। একটা মোটরসাইকেল পেলে আমি তাড়া করে লোকটাকে ঠিক ধরে ফেলতাম। একবার সিডনিতে একটা লোক একজন ভদ্রমহিলার হ্যান্ডব্যাগ কেড়ে নিয়ে মোটরসাইকেলে চেপে পালিয়ে যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা অসহায়ভাবে চ্যাঁচামেচি করছেন, আমি আর থাকতে পারলাম না। পাশেই অন্য কার একটা মোটরসাইকেল রাখা ছিল, লাফিয়ে সেটায় উঠে পড়ে তাড়া করলাম চোরটাকে। সিডনির উঁচু-নিচু রাস্তা, চোরটা যত স্পিড দিচ্ছে, আমিও তত স্পিড বাড়াচ্ছি। চোরটা ট্র্যাফিকের লাল বাতি মানছে না, আমিও মানছি না। রাস্তার সব লোক অবাক হয়ে আমাদের দেখছে।

সন্তু বলল, ঠিক সিনেমার মতন।

জোজো বলল, লোকটাকে কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দিচ্ছি না। সিডনি শহরে তো গলিখুঁজি নেই, সব বড় রাস্তা, লোকটা লুকোবে কোথায়! খানিক পরে দেখি, রাস্তাটা অনেক উঁচু থেকে খাড়া নেমে গেছে, সামনেই সমুদ্র। ইন্ডিয়ান ওশান!

কাকাবাবু বললেন, সিডনি শহরের পাশে তো ইন্ডিয়ান ওশান দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়, ওটা প্রশান্ত মহাসাগর হতে বাধ্য।

জোজো বলল, তা হতে পারে। সব মহাসাগরের চেহারাই তো এক!

সন্তু বলল, তারপর কী হল? তোরা দুজনেই সমুদ্রে গিয়ে পড়লি!

জোজো বলল, তখন এত স্পিডে চালাচ্ছি যে, থামবার উপায় নেই। সোজা গিয়ে সমুদ্রে পড়তেই হবে। তখন চোরটাকে ধরা যাবে ঠিকই, কিন্তু ভদ্রমহিলার হ্যান্ডব্যাগটা যদি ড়ুবে যায়! সেটা উদ্ধার করার জন্যই তো তাড়া করেছি। চোরটাকে। তাই শেষ মুহূর্তে আমি মোটরসাইকেলের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লাম লোকটার ঘাড়ের ওপর। সমুদ্রের ধারে অনেক লোকজন ছিল, তারা ছুটে এল!

সন্তু বলল, সমুদ্রে গিয়ে পড়লে তোরও মুশকিল হত, তুই তো আবার সাঁতার জানিস না।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ ভাল গল্প। শোনো, আমি ভাবছি আমার একবার কলকাতায় যাওয়া দরকার।

সন্তু বলল, আমরাও যাব?

কাকাবাবু বললেন, না, তোরা এখানে থাকতে পারিস। আমি আবার ফিরে আসব। পুলিশের ওপর মহলের সঙ্গে এই ব্যাপারে একটু কথা বলে দেখি। বাংলাদেশের পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে মনে হচ্ছে।

এই সময় বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল।

জোজো বলল, আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি, দেবলীনা এসেছে।

ঠিক তাই, গাড়ির দরজা খুলে ছুটতে ছুটতে এল দেবলীনা। জিন্স আর শার্ট পরা, মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ।

বারান্দায় উঠেই বলল, কই, তোমাদের রিহার্সাল হচ্ছে না?

জোজো আর সন্তু চোখাচোখি করল।

কাকাবাবু বললেন, না, রিহার্সাল বন্ধ আছে।

দেবলীনা বলল, ভালই হয়েছে। তোমরা নাটক বদলাও!

ঝোলা-ব্যাগ থেকে সে একটা পাতলা বই বার করল। সে আবার বলল, আমি অন্য নাটকের বই এনেছি। সুলতানা রাজিয়া। এর নাম-ভূমিকায় আমি পার্ট করব।

সন্তু বলল, বাঃ! সুলতানা রিজিয়া, তোকে ভাল মানাবে!

জোজো বলল, গৈরিক পতাকা কিংবা লাল কেল্লা নাটকের নামভূমিকায় ওকে আরও ভাল মানাত।

সন্তু বলল, কিংবা বঙ্গে বর্গি নাটকটা আরও ভাল। দেবলীনা হবে বর্গি।

দেবলীনা কয়েক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে বুঝে নেওয়ার পর বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে?

সন্তু বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস। মাসির বাড়ি ভাঙল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস!

দেবলীনা বলল, ওটা আবার কী?

সন্তু বলল, এটা মুখস্থ বলতে পারবি? বল তো একবার!

দেবলীনা বলল, ওরকম বিচ্ছিরি কবিতা মোটেই আমি বলতে চাই না। কাকাবাবু মুচকি মুচকি হাসছেন।

দেবলীনা তাঁর দিকে ফিরে বলল, কাকাবাবু, তুমি ছেলেদুটোকে বড্ড লাই দিচ্ছ! তুমি সুলতানা রিজিয়া নাটকটা করবে কিনা বলো।

জোজো বলল, লাল কেল্লা!

সন্তু বলল, বঙ্গে বর্গি!

কাকাবাবু বললেন, এই, তোরা ওকে কেন রাগাচ্ছিস! শোনো দেবলীনা, যেকোনও নাটকে তুমি খুব ভাল পার্ট করতে পারবে জানি, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে নাটক আপাতত বন্ধ। আমাকে জরুরি কাজে কলকাতায় যেতে হবে। ভাবছি, তোমার সঙ্গেই চলে যাব।

দেবলীনা বলল, এই পাজিদুটোও যাবে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, না, সন্তু আর জোজো থাকবে। আমি আবার ফিরে আসব।

দেবলীনা বলল, বেশ হবে। ওরা এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুর গ্রামে পড়ে থাকুক। এমন বৃষ্টি হবে, ওরা কোথাও যেতেও পারবে না।

জোজো বলল, নদী থেকে ইলিশ মাছ ধরা হয়েছে, আমরা সেই টাটকা ইলিশ মাছ ভাজা আর গরম গরম খিচুড়ি খাব।

সন্তু বলল, অনেক বড় বড় চিংড়িও এনেছে, তুই দেখিসনি বুঝি!

দেবলীনা বলল, কলকাতাতেও অনেক ভাল ইলিশ আর চিংড়ি পাওয়া যায়।

একটু বাদেই কাকাবাবু তৈরি হয়ে নিলেন। দেবলীনাকে বললেন, চলো, বেরিয়ে পড়ি। বেশি রাত করার দরকার নেই।

দেবলীনা তখনও সন্তু আর জোজোর সঙ্গে ঝগড়া করে যাচ্ছিল, এবার সে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঝোলা-ব্যাগ থেকে দুটো বড় চকোলেটের প্যাকেট বার করে বলল, তোদের জন্য এনেছিলাম, এখন আর দেব না ভাবছি!

জোজো ঠোঁট উলটে বলল, চকোলেট? অ্যাঃ! আমরা মোটেই ভালবাসি না, তাই না রে সন্তু?

দেবলীনা এবার ফিক করে হেসে ফেলে প্যাকেটদুটো ওদের হাতে গুঁজে দিল।

জোজো দেবলীনার একটা হাত চেপে ধরে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ! পাগলা কুকুর কামড়ে দিল দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ভাঙল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস!

কাকাবাবু বললেন, আর দেরি কোরো না! চলো—

দেবলীনাদের গাড়ির ড্রাইভার অনেক দিনের পুরনো। তার নাম লছমনসিংহ, ওদের বাড়িতেই থাকে। দেবলীনাকে সে খুব ছোট্টবেলা থেকে দেখেছে বলে তাকে সে খুকুমণি বলে ডাকে।

কাকাবাবুকে দেখে সে নমস্কার করে বলল, ভাল আছেন সার?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, লছমন, তুমি ভাল আছ তো? কদিন ধরে বর্ষা হচ্ছে, রাস্তার অবস্থা কীরকম?

লছমন বলল, খুব খারাপ। আসবার সময় জ্যাম পেয়েছিলাম।

গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই একটু পরে পাশ দিয়ে একটা মোটরসাইকেল বেরিয়ে গেল জোর শব্দ করে।

কাকাবাবু কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলেন। চালকের মুখটা দেখতে পেলেন।

দেবলীনা বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ভাঙল হাঁড়ি খুট খট খট খটাস! কাকাবাবু, এর মানে কী?

কাকাবাবু বললেন, মানে আবার কী? কিচ্ছু নেই! জোজোর মাথা থেকে উদ্ভট বুদ্ধি বেরোয়!

দেবলীনা আবার বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল…নাঃ, এটা আর কিছুতেই বলব না! কিন্তু মুখস্থ হয়ে গেল যে!

কাকাবাবু বললেন, অন্য কবিতা ভাবো। তা হলে ওটা ভুলে যাবে। দেবলীনা একটু চিন্তা করে বলল, গান জুড়েছে গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা, আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লি থেকে বর্মা—তারপর কী যেন?

কাকাবাবু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন, উত্তর দিলেন না। মোটরসাইকেলটার শব্দ আর একবার শোনা গেল। আওয়াজটা খুব জ্বালাচ্ছে। লোকটা কি বাড়ির কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থেকে লক্ষ রাখছিল?

দেবলীনা বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল দুম পট পট…এই রে, আবার সেই বিচ্ছিরি পদ্যটা মনে আসছে! ও কাকাবাবু, বলো না, এটাকে মাথা থেকে তাড়াই

কী করে?

কাকাবাবু বললেন, একটা গান গাও, তা হলে ভুলতে পারবে!

দেবলীনা বলল, ধ্যাত! আমি কি গান জানি নাকি?

কাকাবাবু বললেন, এই গানটা শিখে নাও, খুব সহজ। জোজোকে দেখলেই গাইবে। শোন রে ওরে হনুমান, হও রে ব্যাটা সাবধান, আগে হতে স্পষ্ট বলে রাখি! তুই ব্যাটা জানোয়ার, নিষ্কর্মার অবতার, কাজেকম্মে দিস বড় ফাঁকি!

দেবলীনা উঁচু গলায় হেসে উঠল।

বড় রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে গাড়িটা থেমে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। সামনে পর পর অনেক ট্রাক। একে তো অন্ধকার, আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি।

এক জায়গায় গাড়ি একেবারে থেমেই গেল। সামনে অনেকখানি জ্যাম। লছমন উঁকি মেরে দেখে বলল, লেভেল ক্রসিং। আসবার সময়ও এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হয়েছিল। সামনের লরিটা কিছুতেই জায়গা ছাড়ছে না।

সে দু-একবার হর্ন বাজাতেই কাকাবাবু বললেন, শুধু শুধু হর্ন বাজিয়ো না। তাতে কী লাভ হবে?

বৃষ্টির জন্য সব জানলার কাচ ভোলা। একটা বাচ্চা ছেলে ধূপকাঠি বিক্রি করার জন্য কাকুতিমিনতি করছে।

দেবলীনা হাত নেড়ে বলল, চাই না। চাই না।

ছেলেটা তবু যাচ্ছে না।

লছমন তার দিকের জানলার কাচ নামিয়ে আর একবার সামনে উঁকি দিল।

বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে সেদিকে গিয়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, নিন না দিদি, ভাল ধূপ, নিন না, আমি সারাদিন কিছু খাইনি—

দেবলীনা হাত-ব্যাগ খুলে পয়সা বার করতে গেল।

তখনই একজন লোক বাচ্চা ছেলেটাকে টেনে সরিয়ে দিয়ে দাঁড়াল জানলার কাছে। তার হাতে একটা ছোট গ্যাস সিলিন্ডারের মতন জিনিস।

সেটা থেকে সে ফোঁসফোঁস করে কী যেন স্প্রে করে দিতে লাগল গাড়ির মধ্যে।

কাকাবাবু বললেন, এই, কী করছ, কী করছ?

তারপরই গ্যাসের গন্ধ পেয়ে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,দেবলীনা, শিগগির নাকে রুমাল চাপা দাও—

কিন্তু তিনি নিজেই পকেট থেকে রুমাল বার করার সময় পেলেন না। ঢলে পড়লেন অজ্ঞান হয়ে।

দেবলীনা আর লছমনও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

একজন লোক গাড়ির সামনের দরজা খুলে লছমনকে ঠেলে সরিয়ে নিজে বসল স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে।

অন্য একজন লোক পেছনের দরজা দিয়ে উঠে কাকাবাবুর হাত বেঁধে ফেলল লোহার চেন দিয়ে।

সে লোকটি সামনের লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটাকে নিয়ে কী করব?

সামনের লোকটি বলল, থাক, এখন অমনিই থাক।

তারপর সে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ল পাশের মাঠে। গাড়িটা লাফাতে লাফাতে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress