কাকাবাবু জঙ্গলের রাস্তাও চেনেন না
কাকাবাবু জঙ্গলের রাস্তাও চেনেন না, এখন আর কিছু দেখাও যাচ্ছে না। তবু কাকাবাবু এলোমেলোভাবে গাড়ি চালিয়ে জায়গাটা থেকে সরে যেতে চাইলেন।
খানিক বাদে জিপটা থামিয়ে কান পেতে শুনলেন। পেছনে কোনও শব্দ নেই, কেউ তাড়া করে আসছে না।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, গৌতম, কী দেখলি? লোকটা বেঁচে আছে?
গৌতমকাকু বললেন, হ্যাঁ, বেঁচে আছে এখনও। বুকে লাগেনি, গুলি লেগেছে কাধে। প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে। রক্ত বন্ধ করতে না পারলে বাঁচানো যাবে না। জায়গাটা বাঁধব কী দিয়ে?
কাকাবাবু ড্যাশবোর্ড খুলে দেখলেন, সেখানে একটা টর্চ রয়েছে। সেটা জ্বেলে গাড়িটার সব জায়গা দেখতে দেখতে পেছনের সিটের তলায় পেয়ে গেলেন একটা চৌকো বাক্স আর একটা পলিথিনের বালতি।
বাক্সটা খুলে তিনি বললেন, লোকটার ভাগ্য ভাল, এটাতে ফার্স্ট এডের জিনিসপত্র রয়েছে। তুলো, গজ-ব্যান্ডেজ, বেঞ্জিন।
গাড়ি থেকে নামিয়ে শঙ্কর রায়বর্মনকে শুইয়ে দেওয়া হল মাটিতে।
কাছেই জলের কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোনও ঝরনা বা ছোট নদী আছে।
গৌতমকাকু বললেন, একটা গুলি গেঁথে আছে। ওটাকে এক্ষুনি বের করে ফেলা দরকার। রাজা, তুই এক কাজ কর, খানিকটা জল নিয়ে আয়। দেখি, কতটা কী করা যায়!
কাকাবাবু জল আনার পর শঙ্কর রায়বর্মনের ক্ষতটা পরিষ্কার করতে করতে গৌতমকাকু বললেন, ওরা গুলি চালিয়েই থেমে গেল, তেড়ে এল না কেন?
কাকাবাবু বললেন, খুব সম্ভবত আমাদের দেখতে পায়নি, শুধু আওয়াজ শুনেছে। তা ছাড়া, এত বৃষ্টি, বৃষ্টিই আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে বলতে পারিস।
গৌতমকাকু জিজ্ঞেস করলেন, তোর আর একটা ক্রাচ কোথায়? তুই একটা নিয়ে দৌড়োলি কী করে?
কাকাবাবু বললেন, একটা ফেলে এসেছি। দুটো থাকলে শঙ্করকে ধরতাম কী করে! একটা নিয়ে দৌড়োতে খুবই কষ্ট হয়, কিন্তু বিপদের সময় কষ্টের কথা মনে থাকে না।
শঙ্কর রায়বর্মন অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। তার ক্ষতস্থানে খানিকটা বেঞ্জিন ছোঁয়াতেই সে যন্ত্রণায় উঃ আঃ করে ছটফটিয়ে উঠল।
ছোট ছেলেকে ধমক দেওয়ার মতন গৌতমকাকু বললেন, চুপ করে শুয়ে থাকো। নড়াচড়া করবে না।
সে ধড়মড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করতেই গৌতমকাকু আবার বকুনি দিয়ে বললেন, বললাম না, ছটফট করবে না।
কাকাবাবুও অন্যদিকে তাকিয়ে তাকে জোর করে চেপে ধরে রইলেন।
শঙ্কর রায়বর্মন চোখ মেলে জিজ্ঞেস করল, আমার কী হয়েছে? আমি কোথায়?
কাকাবাবু বললেন, তোমার কাধে গুলি লেগেছে। আমরা তোমাকে নিয়ে কোনওরকমে পালিয়ে এসেছি।
গৌতমকাকু বললেন, গুলিটা যদি আর একটু নীচে, তোমার বুকে লাগত, তা হলে আর কিছু করার থাকত না। আশা করি তোমায় বাঁচিয়ে তুলতে পারব। তবে, বাঁ হাতটা অনেকদিন ব্যবহার করতে পারবে না।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে শঙ্কর রায়বর্মন জিজ্ঞেস করল, মালু কোথায়?
কাকাবাবু বললেন, জানি না। তাকে আর দেখতে পাইনি, দৌড়ে পালিয়েছে, গুলি খেয়েছে, কে জানে! ওখানে ওকে দেখতে পাইনি।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, মা নেই। আমি গুলি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে ছিলাম, আপনারা সেই সুযোগে পালালেন না কেন?
কাকাবাবু বললেন, মানুষকে বিপদে ফেলে পালাবার অভ্যেস আমাদের নেই।
শঙ্কর রায়বর্মন আবার বলল, গৌতমবাবু, আপনাদের আমি বন্দি করে এনেছি, চড় মেরেছি, তবুও আপনি আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেন কেন?
গৌতমকাকু বললেন, আমি ডাক্তার, আমাদের কাছে শত্রু-মিত্র কিছু নেই। যে-কোনও অসুস্থ লোককে চিকিৎসা করার শপথ নিতে হয় আমাদের। একটু ডান পাশে ফেরো তো!
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমার রিভলভারটা কোথায়?
কাকাবাবু বললেন, সেটা আমার কাছে রেখেছি। ওরা তাড়া করে এলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হত তো!
আবার একটুক্ষণ চুপ করে থেকে শঙ্কর রায়বর্মন আপন মনে বলতে লাগল, আমার কাছে রিভলভার নেই, মালু কোথায় কে জানে, এখন আপনারা প্রতিশোধ নিতে পারেন, আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারেন।
কাকাবাবু বললেন, তোমাকে পুলিশে ধরাবার ব্যাপারে আমাদের মাথাব্যথা নেই। তার চেয়ে অনেক জরুরি কাজ আছে। আমাদের এক্ষুনি ওই তাবুর কাছে আর একবার ফিরে যেতে হবে।
গৌতমকাকু দারুণ অবাক হয়ে বললেন, ওখানে ফিরে যেতে হবে? কেন?
কাকাবাবু বললেন, বিদেশি কমান্ডোরা এসে আমাদের এখানে গোপন ঘাঁটি গেড়েছে। তারা কী মতলবে এসেছে, কোথায় কী ধ্বংস করতে চায়, তা জানতে হবে না?
গৌতমকাকু বললেন, আমরা কী করে জানব? দেখলিই তো, ওদের কাছে লাইট মেশিনগান আছে, কাছে গেলে ঝাঝরা করে দেবে। বরং কাল সকালে পুলিশকে খবর দিলে, তারাই ব্যবস্থা করবে।
কাকাবাবু বললেন, এইসব ব্যাপারে কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় না। যদি আজ রাত্তিরেই ওরা কিছু শুরু করে দেয়? মাটি খুঁড়ে বহুদূর পর্যন্ত তার বসিয়েছে, নিশ্চয়ই কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা উড়িয়ে দিতে চায়। মনে কর, আজ রাত্তিরেই যদি ওরা একটা এয়ারপোর্ট ধ্বংস করে দিতে পারে, তা হলে কাল আমাদের আপশোশের শেষ থাকবে? নিজেদেরই দায়ী মনে হবে না?
গৌতমকাকু বললেন, কিন্তু আমরা তো হঠাৎ দেখে ফেলেছি। ভাঙা বাড়িটার কাছে যদি না যেতাম-
কাকাবাবু বললেন, একবার দেখে ফেললে আর দায়িত্ব এড়ানো যায় না। আমাকে যেতেই হবে।
তারপর তিনি শঙ্কর রায়বর্মনের দিকে ফিরে বললেন, শোনো শঙ্কর, তুমি তোমার এলাকা স্বাধীন রাজ্য করতে চাও, তা তুমি পারবে কি পারবে না, তা। আমরা জানি না। সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু একটা কোনও বিদেশি শক্তি যদি আমাদের দেশের ক্ষতি করতে চায়, তখন তুমি কী করবে? তাদের সাহায্য করবে?
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, মোটেই না। আমি তখন ভারতীয় হিসেবে লড়ব!
কাকাবাবু বললেন, বাঃ! তা হলে এখন আমরা সবাই এক দলে!
গৌতমকাকু বললেন, কিন্তু রাজা, আমরা মাত্র তিনজন মিলে কী করে ওদের আটকাব?
কাকাবাবু বললেন, তিনজনও লাগবে না। আমি একাই যাব। তোরা দুজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ করবি।
গৌতমকাকু বললেন, একা? তোর কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে?
কাকাবাবু বললেন, না, আমার মাথা যেমন ছিল তেমনই আছে। তোর কতদূর হল?
শঙ্কর রায়বর্মনের কাঁধ থেকে গুলিটা বার করে ফেলা হয়েছে। তুলো আর ওষুধ দিয়ে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে ফেলেছেন গৌতমকাকু। শঙ্কর রায়বর্মনের মাথায় হাত রেখে বললেন, এ ছেলেটার মনের জোর আছে। ব্যথা লেগেছে। খুবই, কিন্তু একটুও চ্যাঁচামেচি করেনি। কী, এখন উঠে দাঁড়াতে পারবে?
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, পারব।
কাকাবাবু বললেন, সবাই জিপে ওঠো। আমি চালাব। শঙ্কর, তুমি এ-জায়গাটা চিনতে পারছ? ওই তাবুর দিকে ফেরার রাস্তা তুমি বলে দিতে পারবে তো? একেবারে কাছে যেতে হবে না। খানিকটা দূরে নামব।
শঙ্কর রায়বর্মনের নির্দেশ অনুযায়ী কিছুক্ষণ গাড়ি চালাবার পর সে বলল, তাঁবু দুটো এরই কাছাকাছি থাকার কথা। কিন্তু আলোটালো তো জ্বলছে না।
কাকাবাবু বললেন, বড় আলো জ্বালবে না। ঠিক আছে, তোমরা গাড়িতেই বোসো। আমি নেমে দেখছি।
গৌতমকাকু কাকাবাবুর একটা হাত চেপে ধরে বললেন, রাজা, তোকে আমি একা যেতে দেব না!
কাকাবাবু বললেন, এইসব জায়গায় অনেক লোকের বদলে একজনই যাওয়া সুবিধেজনক। তাতে লুকিয়ে থাকা যায়।
গৌতমকাকু বললেন, আমি তোর সঙ্গে যাব। এই বিপদের মধ্যে আমি তোকে কিছুতেই একা যেতে দেব না।
কাকাবাবু বললেন, শোন, আমার জীবনের কোনও দাম নেই। দেশের কাজের জন্য যদি আমি মরেও যাই, তাতে কিছু যায় আসে না। তোর বউ-ছেলে আছে, অনেক দায়িত্ব আছে, আমার সেসব কিছু নেই।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, তা হলে আমি যাব আপনার সঙ্গে।
কাকাবাবু বললেন, তুমি এই অবস্থায় যাবে কী করে? তোমাকে নিয়েই আমি মুশকিলে পড়ব। শোনো, যা করবার খুব তাড়াতাড়ি সারতে হবে। তোমরা এখানে ঠিক আধঘণ্টা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। তার মধ্যে আমি ফিরবই। যদি না ফিরি, শঙ্কর, তুমি যেমন করেই হোক গৌতমকে কাছাকাছি কোনও থানায় পৌঁছে। দেবে। গৌতম সব জানাবে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে।
একটামাত্র ক্রাচ নিয়ে কাকাবাবু নেমে পড়লেন জিপ থেকে।
গাছের আড়াল দিয়ে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন তাবু দুটো। এর মধ্যে খানিকটা জ্যোৎস্না ফুটেছে। বৃষ্টি থেমে গেলেও এখনও মেঘ আছে আকাশে। মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ছে চাঁদ।
এবার কাকাবাবু মাটিতে শুয়ে পড়ে বুকে হাঁটতে লাগলেন কচ্ছপের গতিতে। ছাত্র বয়েসে এন সি সি-তে এসব ট্রেনিং নিয়েছিলেন, এখন কাজে লেগে গেল।
আর একটু কাছে গিয়ে দেখলেন, তাবুর মধ্যে খুব মৃদু কোনও আলো জ্বলছে। একজন কালো পোশাক পরা তোক হাতে একটা স্টেনগান নিয়ে দুটো তাবুর চারপাশ ঘুরে আসছে।
সে চোখের আড়ালে গেলে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলেন কাকাবাবু। এইভাবে তিনি একটা তাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এই লোকটাই বোধ। হয় আগে গুলি চালিয়েছে। কিন্তু এখন সে খুব একটা মনোেযোগ দিচ্ছে না, হাতের অস্ত্রটা নীচের দিকে করে হাঁটছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।
লোকটি একবার কাকাবাবুর কাছাকাছি এসেও কিছু দেখতে পেল না। সে একটু এগিয়ে যেতেই কাকাবাবু এক লাফে গিয়ে হাতের ক্রাচ দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মারলেন তার মাথায়।
প্রায় কোনও শব্দই হল না, লোকটি ঝুপ করে পড়ে গেল। কাকাবাবু তার স্টেনগানটা তুলে নিলেন।
এই অস্ত্র তিনি আগে কখনও ব্যবহার করেননি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বুঝলেন, ব্যবহার করা এমন কিছু শক্ত নয়। অতি মারাত্মক অস্ত্র। বৃষ্টির মতন গুলি বেরোয়।
প্রথম তাঁবুটার একটা জানলা আছে। খুব সাবধানে সেখান দিয়ে উঁকি মেরে কাকাবাবু দেখলেন, কয়েকজন লোক মাটিতে শুয়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর দুজন লোক মোমবাতি জ্বালিয়ে তাস খেলছে।
কাকাবাবু একবার ভাবলেন, জানলা দিয়ে বন্দুকটা গলিয়ে একবারেই সবকটা লোককে মেরে ফেলা খুবই সহজ।
তারপরই মনে হল, শত্রুপক্ষ তোক আর যা-ই হোক, মানুষ তো। মানুষকে এমনভাবে মারা যায়?
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এদের যে কোনও দয়ামায়া নেই। এদের মাথার মধ্যে এমন সব ভুল শিক্ষা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না। এরা সুযোগ পেলে একসঙ্গে কয়েকশো বা কয়েক হাজার লোককেও মেরে ফেলতে পারে। এদের নিজেদেরও প্রাণের ভয় মুছে দেওয়া হয়েছে।
তবু কাকাবাবু গুলি চালালেন না।
অস্ত্রটা খুব ভারী, তাই দুহাতে ধরতে হয়। ক্রাচটা ফেলে দিয়ে কাকাবাবু অন্য তবুটার কাছে গেলেন। তার ভেতরটা একেবারে অন্ধকার। কাকাবাবু সেটার পেছন দিকে গিয়ে জানলায় টর্চ জ্বেলে দেখলেন, ভেতরে রয়েছে নানারকম বাক্স ও টিনের কৌটো। কোনও লোক নেই।
কাকাবাবু কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। ঢুকে পড়লেন সেই তাঁবুর মধ্যে।
টর্চ জ্বেলে দেখতে লাগলেন সেই বাক্স ও কৌটোগুলো। তাতে রয়েছে প্রচুর ডিনামাইট, বোমা ও অন্য সব মারাত্মক অস্ত্র। এতসব বিস্ফোরক দিয়ে অনেক সেতু, রেল স্টেশন, বিমানবন্দর উড়িয়ে দিতে পারে।
কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানুষ কত কষ্ট করে, কত টাকা খরচ করে এসব বানায়, আবার একদল মানুষই সেসব ধ্বংস করে। পৃথিবীতে সব দেশের মানুষ কি হিংসা ভুলে শান্তিতে থাকতে পারবে না কোনওদিন?
এক জায়গায় একটা পেট্রলের টিন দেখতে পেয়ে কাকাবাবু সেটা নিয়ে চলে এলেন বাইরে।
পাশের তাঁবুতে এখনও কোনও সাড়াশব্দ নেই। সেই কিছু টের পায়নি। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় কাকাবাবু হাতের ঘড়ি দেখলেন। এর মধ্যে কুড়ি মিনিট কেটে গেছে।
স্টেনগানটা নামিয়ে রেখে তিনি পেট্রল ছড়াতে লাগলেন দুই তাঁবুর মাঝখানের জায়গাটায়। একদিক থেকে আর একদিকে এসে প্রথম তাবুটার সামনে ঢেলে দিলেন বাকি সব পেট্রল।
তারপর তিনি ঘুরে দাড়াতেই দেখলেন একজন লোক বেরিয়ে আসছে প্রথম তাবু থেকে। লোকটা হয়তো বাথরুমের জন্য বেরিয়েছিল, কাকাবাবু লুকোবার চেষ্টা করেও লুকোতে পারলেন না।
লোকটি একটা দুর্বোধ চিৎকার করে তেড়ে এসে কাকাবাবুর গলা চেপে ধরল।
কাকাবাবু স্টেনগানটা রেখেছেন খানিকটা দূরে। সেটা যে-কোনও উপায়ে হাতে নিতেই হবে। তিনি লোকটির বুকে একটু ঘুসি কষাতেই সে ছিটকে গেল।
কিন্তু সে-লোকটিরও গায়ের জোর কম নয়। সে আবার এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু একপাশে সরে গিয়ে দৌড় লাগালেন।
লোকটাও স্টেনগানটা দেখতে পেয়ে গেছে। সেও ছুটে গেল সেদিকে। কাকাবাবু খোঁড়া পায়ে দৌড়োচ্ছেন, তার আগেই লোকটা প্রায় পৌঁছে গেল স্টেনগানটার কাছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে কাকাবাবু পা দিয়ে স্টেনগানটা ঠেলে দিলেন। কিন্তু এক পায়ে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন মাটিতে।
লোকটা স্টেনগানটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সেটা হাতে নিয়ে তার উঠে দাঁড়াতে যেটুকু সময় লাগল, তার মধ্যেই কাকাবাবু দ্রুত চিন্তা করলেন, এবার কী করবেন? তার কাছে রিভলভারটা রয়েছে, তিনি লোকটাকে গুলি করতে পারেন।
কিন্তু গুলির শব্দে তাঁবুর ভেতরের লোকগুলো বেরিয়ে আসবে। ওরা সবাই মিলে গুলি চালালে তিনি একা সামলাতে পারবেন কি? এদিকে এই লোকটাকে এক্ষুনি গুলি না করেও উপায় নেই।
তিনি রিভলভারটা বার করার আগেই একজন লোক ছুটে এসে একটা বড় ছুরি বসিয়ে দিল লোকটির ঘাড়ে।
লোকটি বিকট চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। কাকাবাবু দেখলেন, ছুরি মেরেছে শঙ্কর রায়বর্মন।
তিনি লাফিয়ে এপাশে চলে এসে স্টেনগানটা নিজের হাতে নিয়ে রিভলভারটা দিলেন শঙ্কর রায়বর্মনের হাতে। বললেন, আমাদের এক্ষুনি পালাতে হবে। ওর চিৎকার শুনে অন্যরা বেরিয়ে আসবে। বেরোলেই তুমি গুলি চালাবে—
কাকাবাবু গোলা-বারুদ-ভরা তাবুটার দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে দিলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে বিস্ফোরণ শুরু হল, পেট্রলের আগুন এগোতে লাগল দ্বিতীয় তাবুটার দিকে। অন্য লোকগুলো অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরোবার আগেই কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, শঙ্কর, দৌড়োও!
শঙ্কর রায়বর্মন তবু দাঁড়িয়ে পড়ে গুলি চালাচ্ছিল, কাকাবাবু তার হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলেন। তারপর ছুটতে লাগলেন পেছন দিকে।
গৌতমকাকুও নেমে এসেছেন গাড়ি থেকে।
কাকাবাবু বললেন, শিগগির ফিরে চল, গৌতম। আমাদের কাজ হয়ে গেছে। গাড়ি স্টার্ট কর।
শঙ্কর রায়বর্মন ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। গৌতমকাকু তাঁকে তুলে কঁধের ওপর নিয়ে পৌঁছে গেলেন জিপটার কাছে। কাকাবাবু উঠে বসলেন পেছনের সিটে।
কানফাটানো শব্দে গোলাগুলি ফাটছে, আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে দুটো তাঁবু। এক-একটা আগুনের হলকা হাউইয়ের মতন উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে।
গাড়িটা চালাতে-চালাতে গৌতমকাকু বললেন, আমি এর মধ্যে একটা কাজ করেছি। মাটিতে নালা খুঁড়ে ওরা যে তার বসিয়েছিল, সে তার আমি কেটে দিয়েছি।
কাকাবাবু বললেন, খুব ভাল করেছিস। ওটা আগেই করা উচিত ছিল, আমার মনে পড়েনি। যাই হোক, ওরা আর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
গৌতমকাকু বললেন, শঙ্কর ছেলেটার সাহস আছে। ঠিক আধ ঘণ্টা হতে-না-হতেই ও এই অবস্থাতেও গাড়ি থেকে নেমে তোকে খুঁজতে গেল। হাতে শুধু একটা ছুরি।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক সময়ে গিয়ে এক হিসেবে ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমার একটা প্রধান দুর্বলতা, আমি সামনাসামনি কাউকে গুলি করে মারতে পারি না। আমার হাত কাঁপে। ওই লোকটা স্টেনগানটা তুলে নিলে আমায় শেষ করে দিত। তবে ওরা আজ খানিকটা অসাবধান ছিল, একে তো খুব বৃষ্টি হয়েছে, তার ওপর দারুণ শীত, গায়ে কম্বল জড়িয়ে ছিল। এইরকম রাতে কেউ ওদের আক্রমণ করবে, ওরা কল্পনাই করেনি।
গৌতমকাকু জিজ্ঞেস করলেন, ওদের সবকটা কি আগুনে পুড়ে মরবে?
কাকাবাবু বললেন, তা নিশ্চয়ই না। এদিক-ওদিক পালাবে। তবে ওদের গোলাবারুদ শেষ। এখন ওদের খুঁজে বার করার দায়িত্ব পুলিশ বা আর্মির।
গৌতমকাকু বললেন, সামনে কিছুটা দূরে আলো দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, গাড়ির আলো। একটা না, কয়েকটা।
কাকাবাবু বললেন, বিস্ফোরণের আওয়াজ বহুদূর পৌঁছেছে বোধ হয়। নিশ্চয়ই পুলিশের গাড়ি।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, পুলিশের গাড়ি যদি হয়… আমাকে এখানে নামিয়ে দেবেন?
কাকাবাবু বললেন, তোমাকে এখানে নামিয়ে দেব মানে? অসম্ভব!
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে চান?
গৌতমকাকু বললেন, পুলিশের কাছে নিজেই ধরা দাও না বাপু! তা হলে কম শাস্তি হবে। কতদিন আর রাজাগিরি চালাবে। শেষে একদিন বেঘোরে মরবে।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, কিছুতেই না। আমি জান দেব, তবু পুলিশের কাছে ধরা দেব না।
ফস করে সে রিভলভারটা বার করে গৌতমকাকুর গলায় ঠেকিয়ে বলল, গাড়ি থামান।
কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, খবরদার, স্টেনগানটায় হাত দেবেন না। আমি গুলি চালাব।
গৌতমকাকু ফ্যাকাসে গলায় বললেন, এ কী, তুমি এখনও আমাদের মারতে চাও!
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, দরকার হলে মারতেই হবে!
কাকাবাবু হেসে উঠে বললেন, গুলি চালাবে? তখন এলোমেলো ভাবে কটা গুলি চালিয়েছ, তা গুনেছ? চেম্বারে আর গুলি নেই। নতুন গুলি ভরতে হবে না? এই জ্ঞান নিয়ে তুমি যুদ্ধ করবে?
শঙ্কর রায়বর্মন দারুণ অবাকভাবে বলল, গুলি নেই?
সে রিভলভারটা জানলার বাইরের দিকে ফিরিয়ে ট্রিগার টিপে পরীক্ষা করতে গেল। দারুণ শব্দে বেরিয়ে গেল একটা গুলি।
ততক্ষণে পেছন দিক থেকে কাকাবাবু সাঁড়াশির মতন দুহাতে তার গলা টিপে ধরে বললেন, ওই একটা বাকি ছিল। এবার রিভলভারটা পায়ের কাছে ফেলে দাও!
গৌতমকাকু বললেন, বাপ রে বাপ! ওর মধ্যে একটা গুলি আছে জেনেও রাজা তুই ওকে ধোঁকা দিতে পারলি? আমার তো এই শীতের মধ্যেও ঘাম বেরিয়ে গেছে!
কাকাবাবু বললেন, লড়াইয়ের নিয়মকানুন শিখতে ওর আরও অনেকদিন লাগবে। ওহে রাজামশাই, তোমাকে জিপ থেকে নামিয়ে দিতে চাইনি, কারণ, তুমি আহত শরীর নিয়ে হেঁটে হেঁটে কতদূর যাবে? তোমাকে পুলিশের হাতেও তুলে দিতে চাই না, কারণ দেশের শত্রুদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তুমি আমাদের পাশে থেকেছ। আমরা নেমে পড়ে, এই জিপটাই তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। তুমি এবার পালাতে পারো তো পালাও। গৌতম, গাড়ি থামা, আমরাই বরং নেমে পড়ে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করি!
শঙ্কর রায়বর্মন একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ফিসফিস করে বলল, আমি আপনাকে মারতে চেয়েছিলাম, তবু আপনারা আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? গাড়িটাও দিচ্ছেন?
গৌতমকাকু বললেন, শোনো, শোনো। মানুষকে কী করে ক্ষমা করতে হয় শেখো। তবে এমনি এমনি ছাড়া হবে না। তুমি আমাদের তোমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে বাধ্য করেছিলে। এখন চটপট আমার আর রাজার পা ছুঁয়ে প্রণাম করো।
শঙ্কর রায়বর্মন ঝপ করে নেমে এসে দুজনের পায়ে হাত দিল।
কাকাবাবু বললেন, তোমার কয়েকটা থাপ্পড়ও পাওনা ছিল। এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। মহাদেবীকে গিয়ে বোলো, তুমি বাজি হেরে গেছ। কী বাজি ছিল?
শঙ্কর রায়বর্মন মাথা নিচু করে বলল, সে আপনাদের বলা যাবে না।
কাকাবাবু বললেন, বলে ফেলো, বলে ফেলো। লজ্জা কী? দেরি কোরো না, পুলিশের গাড়ি আর বেশি দূরে নেই।
শঙ্কর রায়বর্মন বলল, বাজি হয়েছিল, কাকাবাবু যদি পালাতে পারে, তা হলে আমাকে মহাদেবীর পা ধোয়া জল খেতে হবে। গৌতমকাকু হো-হো করে হেসে উঠলেন।
কাকাবাবু বললেন, আগেকার দিনে বউরা স্বামীদের পা ধোয়া জল খেত। একালে তুমি না হয় স্বামী হয়ে তোমার বউয়ের পা ধোয়া জল খাবে একদিন। মন্দ কী! নাও, এবার পালাও!
শঙ্কর রায়বর্মন জিপে উঠেই স্টার্ট দিয়ে সেটা ঘুরিয়ে নিল। তারপর মিলিয়ে গেল জঙ্গলে।
কাকাবাবুর দুটি ক্রাচই গেছে। স্টেনগানটা পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে বন্ধুর কাধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেন।
তিনখানা গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে এগিয়ে আসছে এদিকে।
প্রথম গাড়িতেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে সন্তু, জোজো আর আমজাদ আলি। আর হাতকড়া বাঁধা নীলকণ্ঠ মজুমদার।
সার্কিট হাউসে সন্তুদের না দেখে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ নিতে শুরু করেছিল। শহরের মধ্যে বইয়ের দোকানের সামনে আমজাদ আলির জিপটা দেখেই তারা চিনতে পারে। ঠিক যখন নীলকণ্ঠ মজুমদার আমজাদ আলিকে গুলি করতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভেতরের ঘরটায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে পুলিশ।
জেরার চোটে নীলকণ্ঠ মজুমদার সব স্বীকার করেছে। সে সত্যিই শঙ্কর রায়বর্মনের ভাই। শহরে বসে, বইয়ের দোকানের মালিক সেজে সে গুপ্তচর চক্র চালায় আর অস্ত্র সংগ্রহ করে।
তাকে নিয়ে আসা হচ্ছিল শঙ্কর রায়বর্মনের জঙ্গলের ডেরা চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। নীলকণ্ঠ মজুমদারকে ধরে রাখা হয়েছে জানলে শঙ্কর রায়বর্মন বন্দিদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। ভাইকে সে সত্যি ভালবাসে।
দু গাড়ি পুলিশ সমেত ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িটা অন্যদিকে যাচ্ছিল, বিস্ফোরণের শব্দ শুনে এদিকে ঘুরে এসেছে।
কাকাবাবু আর গৌতমকাকু দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার মাঝখানে।
তাঁরা দুহাত তুলে গাড়ি থামালেন। সন্তু আর জোজো তড়াক করে নেমে ছুটে এল। কাকাবাবু ওদের দুজনের কাধে হাত রেখে বললেন, দ্যাখো, এবারেও মরিনি। কী করে যে বেঁচে যাই, কে জানে! আমাকে ধরে ধরে নিয়ে চলো। পায়ে বড্ড ব্যথা!
রণবীর গুপ্তও নেমে এসে বললেন, কাকাবাবু, কাকাবাবু, আপনার কোনও ক্ষতি হয়নি তো? জঙ্গলের মধ্যে দারুণ আগুন জ্বলছে, বোমা ফাটছে, এসব কী ব্যাপার? এও কি শঙ্কর রায়বর্মনের কীর্তি নাকি?
কাকাবাবু বললেন, না। সেসব অনেক কথা, পরে বলব। পেছনের গাড়ির লোকদের বলো, যদি আগুন নেভাবার ব্যবস্থা করতে পারে। আজ আর কাউকে ধরা যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের কোনও বাংলায় নিয়ে চলো। বিকেল থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়া হয়নি। এখন একটু চা খেতে হবে।
গৌতমকাকু বললেন, এত রাতে তুই চা খাবি রাজা? আমার দারুণ খিদে পেয়েছে। আমি ভাত খেতে চাই। কদিন ধরে শুধু রুটি আর রুটি খাইয়েছে। এখন আমার খেতে ইচ্ছে করছে, গরম গরম ভাত আর ডাল আর বেগুন ভাজা…