Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও চন্দনদস্যু || Sunil Gangopadhyay » Page 3

কাকাবাবু ও চন্দনদস্যু || Sunil Gangopadhyay

সকালবেলা অমলই পৌঁছে দিয়ে গেল এয়ারপোর্টে। প্লেন ছাড়ল ঠিক সময়ে। জোজো জানলার ধারে বসেছে। তারপর সন্তু, একপাশে কাকাবাবু।

সন্তু ফিসফিস করে বলল, কাকাবাবু, সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটাও এই প্লেনে উঠেছে।

জোজো বলল, কোথায়? কোথায়?

সন্তু বলল, আমাদের পেছনে, দুটো সারি পরে।

কাকাবাবু বললেন, হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয়।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই কাকতালীয় কথাটা বইতে মাঝে মাঝে পড়ি। কথাটার ঠিক মানে কী?

কাকাবাবু বললেন, মানে জানোনা? তোমাদের দোষ নেই। যে ছেলেমেয়েরা শুধু শহরেই থাকে, তারা তালগাছ আর নারকোল গাছের তফাত বোঝে না। শহরের লোকেরা তাল খায়ও না। আগে আমরা অনেক তাল খেয়েছি, তালের বড়া, তালের ক্ষীর—

সন্তু বলল, আমরা তালশাঁস খাই। খুব ভাল খেতে। কা

কাবাবু বললেন, হ্যাঁ তালশাঁসও ভাল। লোকে পাকা তাল পছন্দ করে না বলে কাঁচা অবস্থায় তালশাঁস বের করে নেওয়া হয়। পাকা কাঁঠালের বদলে আমরা যেমন এঁচোড়ের তরকারি খাই। তাল কাঁঠাল নিয়ে এক সময় বাংলায় বেশ সুন্দর সুন্দর কথা তৈরি হয়েছিল। যেমন, তিলকে তাল করা। তাল পাকলে কাকের কী? গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। সাধলে জামাই খায় না কাঁঠাল ভুচড়ো নিয়ে টানাটানি! এইসব কথার মধ্যে বেশ একটা করে গল্প আছে। কিন্তু ফলগুলো সম্বন্ধে ভাল করে না জানলে সেই গল্প ঠিক বোঝা যায় না।

সন্তু বলল, তুমি শেষেরটা যা বললে, সাধলে জামাই না কি, ওটা কখনও বইতেও দেখিনি।

কাকাবাবু বললেন, এখনকার লেখকরা নিজেরাই এসব জানেন না, তাই লেখেনও না। ওটার গল্পটা বেশ মজার। জামাই-আদর কাকে বলে জানিস তো? বাড়িতে জামাই এলে তাকে খুব খাতিরযত্ন করতে হয়। সেইরকমই গ্রামের এক বাড়িতে জামাই এসেছে। সে জামাই খুব লাজুক। তাকে যাই খেতে দেওয়া হয়, সে খাবে না খাবে না বলে। তার জন্য গাছ থেকে একটা পাকা কাঁঠাল পেড়ে আনা হয়েছে। জামাই কাঁঠাল খেতে ভালবাসে, কিন্তু কাঁঠাল খাওয়ার জন্য তাকে যখন সাধাসাধি করা হল, সে লজ্জায় না না বলতে লাগল। তখন বাড়ির লোকরাই কাঁঠালটা খেয়ে ফেলল। কাঁঠালের কোয়াগুলো বার করে নিলেও মোটা খোসাটার মধ্যে সরু সরু এক ধরনের জিনিস থাকে, তাকে বলে ভুচড়ো। সেগুলো কেউ খায় না। মাঝরাত্তিরে শাশুড়ি উঠে এসে দেখেন কী, বাড়ির উঠোনে ফেলে দেওয়া সেই কাঁঠালের খোসাটা থেকে ভুচড়োগুলো তুলে তুলে খাচ্ছে সেই জামাই।

জোজো জিজ্ঞেস করল, আর, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল?

কাকাবাবু বললেন, কাঁঠালের মধ্যে আঠা থাকে, হাত দিয়ে ছাড়াতে গেলে চটচট করে। তাই যে কাঁঠাল ছাড়ায়, সে হাতে তেল মেখে নেয়। এখন, একটা গাছে একটা কাঁঠাল ঝুলছে, তাই দেখে একজন লোকের খুব লোভ হয়েছে। সে হাতে তেল-টেল মেখে রেডি হয়ে আছে, কিন্তু না পাকলে খাবে কী করে? হাতের তেল গোঁফে লাগিয়ে সে কাঁঠালের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। এইসব কথার এখন অনেকরকম মানে হয়। যাকগে, কথা হচ্ছিল কাকতালীয় নিয়ে।

জোজো বলল, তালীয় মানে তালের ব্যাপার? মানে তাল ফল? আমার ধারণা ছিল গানের তাল। কিংবা এক হাতে তালি বাজে না, সেই তালি।

কাকাবাবু বললেন, না। পাকা তাল গাছ থেকে আপনি আপনি খসে পড়ে। মনে করো, একটা তালগাছে একটা কাক বসে আছে। এক সময় কাকটা যেই উড়ে গেল, অমনই ধুপুস করে একটা পাকা তাল খসে পড়ল। কাকটা ভাবল, সে উড়ল বলেই খসে পড়ল তালটা। তা কিন্তু নয়, ওই সময় তালটা এমনই পড়ত। অর্থাৎ একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটল, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে কয়েনসিডেন্স!

জোজো বলল, ও কয়েনসিডেন্স? এরকম তো অনেকই হয়।

কাকাবাবু বললেন, সেইরকমই, বড় জুলপিওয়ালা লোকটাকে কাল এয়ারপোর্টে দেখা গেছে, আজ আবার সে আমাদের সঙ্গে এই প্লেনে চেপেছে, এর মধ্যে হয়তো কোনও যোগাযোগ নেই। যেতেই তো পারে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, সাধলে জামাই… পুরো কথাটা কী রে সন্তু?

সন্তু বলল, সাধলে জামাই খায় না কাঁঠাল, ভুচড়ো নিয়ে টানাটানি!

জোজো বলল, বেশ কথাটা। আমার মনে পড়ল, একবার স্পেনের রাজা আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল, কী দারুণ দারুণ সব খাবার। বাবা বলে দিয়েছিলেন, হ্যাংলার মতন সবকিছু খাবে না, আর কোনও জিনিসই দুবার দিতে এলে নেবে না। বাবা যেগুলো না না বলছেন, আমিও লাগবে না বলছি। একটা খাবার দেখে এমন লোভ হয়েছিল, ছোট ছোট হাঁস, আস্ত রোস্ট করা, বাবা মাথা নেড়ে দিতেই বাধ্য হয়ে আমিও…

সন্তু বলল, রাত্তিরে বুঝি সেই হাঁসের পালকগুলো খেলি?

এর মধ্যেই ঘোষণা করা হল, প্লেন কালিকটে নামছে।

সন্তু আর জোজো জানলা দিয়ে তাকাল বাইরে।

পরিষ্কার রোদঝলমলে দিন। নীচে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র। একদিকে ভারতের সীমারেখা। ম্যাপে যেরকম দেখা যায়। এখানে এত সবুজ গাছপালা যে, বাড়িঘর চোখেই পড়ে না।

এয়ারপোর্ট থেকে কাকাবাবু একটা গাড়ি ভাড়া করলেন।

সন্তু সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটির দিকে নজর রেখেছে। সে ওদের দিকে তাকাচ্ছেই না। গাড়িতে ওঠার আগে সন্তু ইচ্ছে করে লোকটির পাশে গিয়ে একটা ধাক্কা লাগিয়ে বলল, খুব দুঃখিত, মাপ করবেন।

লোকটি হিন্দিতে বলল, ঠিক হ্যায়, কুছ নেই হুয়া।

ফিরে এসে গাড়িতে উঠে সন্তু বলল, লোকটি বাঙালি নয়। তবু কাল রাত্তিরে এয়ারপোর্টে অমলদার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল কেন?

কাকাবাবু বললেন, শুনছিল, না দেখছিল?

সন্তু বলল, কী দেখছিল?

কাকাবাবু বললেন, আমি খোঁড়া লোক বলে অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

জোজো বলল, ছাড় তো সন্তু। তুই লোকটাকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবছিস। কাকতালীয়ই ঠিক!

আগে থেকে হোটেল ঠিক করা ছিল না। দু-তিনটে হোটেল ঘুরে একটা পছন্দ হয়ে গেল। হোটেলটা একেবারে নতুন, সেইজন্যই ঝকঝকে পরিষ্কার। ঘরগুলো বড় বড়। একটা ঘরের নাম ফ্যামিলি রুম, সেখানে চারজন শুতে পারে। সেই ঘরটাই নেওয়া হল।

জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলার পর কাকাবাবু বললেন, গাড়িটা সারাদিনের জন্য ভাড়া করা হয়েছে, চল, এই শহরটা আর কাছাকাছি জায়গাগুলো একটু ঘুরে দেখে আসি৷

ড্রাইভারের নাম অ্যান্টনি। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়েস, কুচকুচে কালো গায়ের রং, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। সে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি জানে।

শহরটাতে সত্যি দেখার মতন কিছু নেই। ছোট শহর যেমন হয়। কিছু অফিসটফিস, দোকানপাট আছে। শহরের বাইরেটা ঢেউখেলানো। ছোট ছোট পাহাড় আর প্রচুর নারকোল গাছ। এক এক জায়গায় মনে হয় যেন নারকোল গাছের জঙ্গল।

গরমও প্রচণ্ড। সেইসঙ্গে ঘাম। গাড়ির সবকটা জানলার কাচ নামানো, কিন্তু হাওয়া নেই, দরদর করে ঘামতে হচ্ছে।

জোজো বলল, অমলদা তো ঠিকই বলেছিল। এখানে নারকোল গাছ আর গরম ছাড়া কিছুই নেই। খুব জলতেষ্টা পাচ্ছে।

রাস্তার ধারে ধারে ডাব বিক্রি হচ্ছে। এক জায়গায় গাড়ি থামানো হল।

ডাবওয়ালা দৌড়ে এসে বলল, টেন্ডার কোকোনাট। ভেরি গুড।

তার মানে ডাবের জল খাওয়ার পর সেটা কেটে দিল। ভেতরে নরম নেওয়া। খেতে খুব ভাল।

ড্রাইভার অ্যান্টনি বলল, আপনারা চিকিৎসা করাতে এসেছেন তো? আমি খুব ভাল নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে পারি।

কাকাবাবু সন্তুদের বললেন, শুনেছিলাম বটে যে এখানকার কাছাকাছি একটা জায়গায় খুব ভাল কবিরাজি চিকিৎসা হয়। সারা ভারতের দূর দূর জায়গা থেকে শক্ত শক্ত অসুখের রুগিরা এখানে চিকিৎসা করাতে আসে। আমার খোঁড়া পা দেখে ধরে নিয়েছে, আমি এটা সারাতে এসেছি।

তিনি অ্যান্টনিকে বললেন, সেখানে পরে যাওয়া যাবে। এখন গরমে আর টেকা যাচ্ছে না, তুমি হোটেলে ফিরে চলল।

হোটেলের ঘরটা এয়ার কন্ডিশনড। সেখানে ফিরে বেশ আরাম হল।

কাকাবাবু বললেন, এ যা দেখছি, সারাদিন ঘরেই বসে থাকতে হবে। এ গরমে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। সন্ধের পর গরম কমে কি না দেখা যাক।

জোজো বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

সন্তুও দমে গেছে খানিকটা। এ-জায়গাটা সত্যিই বেড়াবার মতন নয়। বিশেষত গরমকালে। এর চেয়ে চেরাপুঞ্জি গেলে কত ভাল লাগত। সেখানে গরম নেই, যখন-তখন বৃষ্টি হয়। তবু কাকাবাবু এখানেই এলেন কেন?

সে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি সত্যিই ভূতে বিশ্বাস করো?

কাকাবাবু বললেন, বিশ্বাস থাক বা না থাক, ভূতের গল্প শুনতে বেশ ভাল লাগে। তাই না?

জোজো বলল, আমি কিন্তু ভূত দেখেছি। তিনবার। একবার মেক্সিকোতে, একবার কাঠমাণ্ডুতে, আর একবার… ইয়ে অস্ট্রেলিয়ায়…

সন্তু জোজোর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, তুই বাঙালি ভূত দেখিসনি?

জোজো বলল, হ্যাঁ, কাঠমাণ্ডুর ভূতটা বাংলায় কথা বলছিল। তবে মজা কী জানিস, বাবা আমাকে মন্ত্ৰপড়া একটা সুপুরি দিয়েছেন, সেটা তুলে ধরলেই ভূতগুলো একেবারে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়।

সন্তু বলল, কাচের মতন?

জোজো বলল, অনেকটা কাচের মতন, তবে দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায়। হাতে ধরা যায় না।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ। সেই সুপুরিটা সঙ্গে এনেছ তো? এখানে কাজে লাগতে পারে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি আগে কক্ষনও তোমার কাছে ভূত-টুতের কথা, শুনিনি। কেউ ভূতের কথা বললে, তুমি হেসে উড়িয়ে দিতে।

কাকাবাবু বললেন, মানুষ মরে গেলে তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, কিংবা কবর দেওয়া হয়। সেখানেই সব শেষ। তার পরেও কিছু আছে কি না, তার কোনও স্পষ্ট প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সেইজন্যই অনেকে ভূত-পেত্নি, স্বর্গ-নরক— এসবে বিশ্বাস করে না। আবার অনেকে মনে করে, মৃত্যুতেই সব শেষ নয়, পুনর্জন্ম আছে, স্বর্গ-নরক আছে। আমি প্রথম দলে। কিন্তু অনেক লোক মিলে যদি বলে তারা একজন মৃত মানুষকে চলাফেরা করতে দেখেছে, সেই অনেক মানুষের মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষিত, দায়িত্বপূর্ণ লোকও থাকে, তা হলে সেই ঘটনাটা সঠিকভাবে জানার জন্য কৌতূহল হবে না?

সন্তু আবার বলল, তার সঙ্গে এখানে আসার সম্পর্ক কী?

কাকাবাবু বললেন, এটা কত সাল। ১৯৯৮ তো? আজ কত তারিখ? ২৩ মে? ঠিক পাঁচশো বছর আগে, অর্থাৎ ১৪৯৮ সালে, এই দিনটিতে ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়েছিল।

সন্তু তবু ভুরু কুঁচকে বলল, ঠিক বুঝলাম না। তেইশে মে এখানে কোনও উৎসব হয়?

কাকাবাবু বললেন, না, না, উৎসব হবে কেন? ভাস্কো দা গামা ভারতের বহু ক্ষতি করেছে, বহু লোককে মেরেছে, তাকে নিয়ে আবার উৎসব কীসের?

জোজো বলল, বুঝলি না, ভাস্কো দা গামা ভূত হয়ে এই দিনটায় ফিরে আসে।

কাকাবাবু বললেন, জোজো ঠিক ধরেছে। এখানে অনেকের ধারণা, প্রতি বছর তেইশে মে ভাস্কো দা গামাকে দেখা যায়। বেশ অনেকক্ষণ ধরে। গত বছর প্রায় দেড়শোজন তোক দেখেছে। তাদের মধ্যে আছে একজন ইতিহাসের অধ্যাপক, একজন পুলিশের কর্তা, দুজন সাংবাদিক, একজন ডাক্তার। অন্তত চোদ্দোপনেরোজন চিঠি লিখে কিংবা টেলিফোন করে ঘটনাটা আমাকে জানিয়েছে। এই লোকেরা কি নেহাত একটা আজগুবি কথা রটাবে?

সন্তু বলল, এরা সবাই… এত দূর থেকে তোমাকে ঘটনাটা জানাল কেন? তুমি তো ভূত ধরার ওঝা নও!

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক বলেছিস। আমার বদলে বরং জোজোকে জানানো উচিত ছিল। জোজো মন্ত্র পড়া সুপুরি দেখিয়ে ভাস্কো দা গামার ভূতকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিত। তবে জোজোকে তো এরা এখনও চেনে না। আমাকে জানাবার একটা কারণ আছে অবশ্য। তোরা তো জানিস, আমি ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করতে ভালবাসি। মাঝে মাঝে দু-একটা প্রবন্ধও লিখি। গত বছর আমি বম্বের একটা কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম, সেটার নাম ছিল, ভাস্কো দা গামা কি খুন হয়েছিলেন? খুব আলোচনা হয়েছিল সেটা নিয়ে। অনেক লোক আমার পক্ষে-বিপক্ষে চিঠি লিখেছিল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ভাস্কো দা গামা সত্যি খুন হয়েছিলেন?

কাকাবাবু বললেন, স্পষ্ট কোনও প্রমাণ নেই। তবে এদেশে তার অনেক শত্রু ছিল। আরব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার ঝগড়া মারামারি হয়েছে অনেকবার। লোকটা ছিল খুব অহঙ্কারী আর নিষ্ঠুর ধরনের। এমনকী তার নিজের দেশের অনেক লোকও তাকে পছন্দ করত না। পর্তুগিজরা ক্রমে ক্রমে কোচিন, গোয়া এইসব জায়গা দখল করে বসে। সেখানে অনেক পর্তুগিজ কর্মচারী ছিল, তারা অনেকে ভাস্কো দা গামার ব্যবহার সহ্য করতে পারত না। ভাস্কো দা গামা মারা যায় কোচিনে, এক ক্রিসমাসের দিনে। জানিস তো, ক্রিসমাসের আগের রাত্তিরে খুব বড় পার্টি হয়। মদ খেয়ে হইহল্লা করার সময় কেউ তার পেটে একটা ছুরি বসিয়ে দিতেও পারে।

সন্তু বলল, ভাস্কো দা গামা মারা গেল কোচিনে। ভূত হয়ে থাকলে তো তাকে। সেখানেই দেখতে পাওয়ার কথা। এখানে আসবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, কোচিনেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরে তার হাড়গোড় সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পর্তুগালে। সেখানে আবার কবর দেওয়া হয়। সেখান থেকে সাগর পেরিয়ে ভূতটা আসে, প্রথম যেখানে এসেছিল।

সন্তু বলল, পাঁচশো বছরের বুড়ো ভূত!

কাকাবাবু বললেন, ভূতেরা নাকি বুড়ো হয় না। এখানে যারা দেখেছে, তারা নাকি ভাস্কো দা গামাকে আগের চেহারাতেই দেখেছে।

জোজো বলল, ভাস্কো দা গামার ভূতটাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়, তুমি কি খুন হয়েছিলে? না এমনি এমনি মরেছ?

কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছ। আজ মাঝরাত্তিরে একবার যেতে হবে পোর্টে, সেখানেই যাকে বলে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করা যাবে।

জোজো বলল, কী বললেন? কী বললেন? ওই কথাটার মানে কী?

সন্তু বলল, এর মানে আমি জানি। কান আর চোখ। লোকে অনেক কিছু বলে, তা আমরা কান দিয়ে শুনি কিন্তু চোখে তা দেখা না গেলে বিশ্বাস হয় না। এই নিয়ে চোখ আর কানের ঝগড়া। কানে যা শোনা যায়, চোখের দেখাতেও তা মিলে গেলে ঝগড়া মিটে যায়। তাকে বলে বিবাদ ভঞ্জন।

কাকাবাবু বললেন, এটা আগেকার বাংলা, এখন আর বিশেষ কেউ বলে না বা লেখে না। তবে মাঝে মাঝে শুনতে বেশ লাগে। তোদের খিদে পায়নি? এবারে কিছু খেলে হয়।

জোজো বলল, খিদে পায়নি মানে? পেটে আগুন জ্বলছে। এখানে নিশ্চয়ই চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়?

কাকাবাবু বললেন, দেখা যাক। পাওয়া উচিত।

তিনি বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিতে গেলেন।

বেয়ারাটি বলল, এই হোটেলে ঘরে খাবার এনে দেওয়ার নিয়ম নেই। একতলায় ডাইনিং হল আছে, সেখানে গিয়ে খেতে হবে।

ঘর বন্ধ করে ওরা নেমে এল নীচে। মস্ত বড় ডাইনিং হল। কয়েকটা টেবিলে কিছু লোক খেতে শুরু করেছে। কোণের একটা টেবিলে এক ঝলক তাকিয়েই সন্তু বলল, সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটা এখানেও এসেছে।

সত্যিই সেই লোকটি আর দুজন লোকের সঙ্গে বসে আছে। সামনে জলের গেলাস, এখনও টেবিলে খাবার দেয়নি।

সন্তু বলল, এটাও কি কাকতালীয়?

কাকাবাবু বললেন, হতেও পারে। হয়তো এই হোটেলের খাবার বিখ্যাত। অনেকেই খেতে আসে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress