একটা গাছের তলায় শুয়ে ছিলেন
একটা গাছের তলায় শুয়ে ছিলেন কাকাবাবু। ফুরফুরে হাওয়া, নানারকম পাখির ডাক। ওপরের আকাশ দেখতে দেখতে কাকাবাবুর ঘুম এসে গেল।
খানিক বাদে ভুড়ু এসে ডাকল তাঁকে।
কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে বসতেই ভুড়ু বলল, আমার সঙ্গে আসুন, একটা মজার জিনিস দেখাব।
কাকাবাবু ভুড়ুর সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন।
দুটো ছোট পাহাড়ের মাঝখানে খানিকটা উপত্যকা। সেখানে এর মধ্যেই কয়েকটা চালাঘর বানানো হয়েছে। মাঝখানটা ফাঁকা। সেখানে একটা লম্বা খুঁটি পুঁতে একজন মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে।
কাছে গিয়ে কাকাবাবু লোকটিকে চিনতে পারলেন। মোহন সিং।
কাকাবাবু মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
আজ বিক্রম ওসমানের পোশাক অন্যরকম। সে পরে আছে শেরওয়ানি। কোমরে ঝুলছে তলোয়ার। মাথায় একটা পালক বসানো নীল পাগড়ি।
সে গর্বিতভাবে বলল, কী বাঙালিবাবু, এবার বুঝলে তো, মোহন সিংকে ধরে আনার ক্ষমতা আমার আছে কি না!
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তোমার ক্ষমতা আছে দেখছি!
ওসমান বলল, এবার দ্যাখো, ওকে আমি কী শাস্তি দিই!
মোহন সিংয়ের সারা গায়ে জল কাদা মাখা, জামা ছিঁড়ে গেছে। বোঝা যায় যে, ধরে আনার সময় তাকে বেশ চড়-চাপড়ও মারা হয়েছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে একে ধরে আনলে?
ওসমান বলল, সমুদ্রের ধারে সিনেমার শুটিং করছিল। সেখান থেকে তুলে এনেছি। এবার একটা একটা করে ওর হাত আর পা আমি কেটে ফেলব নিজের হাতে। আমার সঙ্গে বেইমানি!
সে খাপ থেকে সড়ত করে তলোয়ারটা টেনে বার করল।
কাকাবাবু বললেন, ওকে মেরে ফেলবে? তোমাদের সঙ্গে এতকালের সম্পর্ক। একটা মোটে ভুল করে ফেলেছে। না, না, মেরে ফেলাটা ঠিক হবে না!
মোহন সিংয়ের চোখ রাগে জ্বলজ্বল করছিল, এবার সে অবাক হয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। এই লোকটা তাকে বাঁচাতে চাইছে?
ওসমান ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এর ওপর তোমার দয়া হল কেন? এই লোকটাই তো তোমাকে বেচে দিয়েছিল আমার কাছে।
কাকাবাবু বললেন, তা হোক। তবু ওকে বাঁচিয়ে রাখলেই তোমাদের লাভ হবে।
ভুড়ু বলল, ঠিক বলেছেন। ও আমাদের দশ লাখ টাকা ঠকিয়েছে। ওর কাছ থেকে বিশ লাখ টাকা আদায় করতে হবে।
এ-কথা শোনামাত্র মোহন সিং বলল, আমি বিশ লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে ছেড়ে দাও! শুটিং নষ্ট হচ্ছে, অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, গেলেই ওই টাকাটা পেয়ে যাবে।
কাকাবাবু ভুড়ুর দিকে মুখ ফিরিয়ে ভুরু তুলে একটা ইঙ্গিত করে বললেন, মাত্র কুড়ি লাখ?
ভুড়ু বলল, ঠিক ঠিক। আপনার জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল, সেই টাকাটা ওর কাছ থেকেই আদায় করা উচিত।
ওসমান বলল, ওর কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকার চিঠি লিখিয়ে নে।
কাকাবাবু এবার ওসমানের দিকে ফিরে বললেন, ওরা হিন্দি সিনেমা বানায়। ওদের কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকাও কিছুই না। অন্তত এক কোটি টাকা চাও!
ওসমান বলল, হ্যাঁ, এটাই ঠিক কথা। পঞ্চাশ লাখ ওর মুণ্ডুর দাম, আর পঞ্চাশ লাখ ফাইন!
মোহন সিং একটু আগে ভেবেছিল কাকাবাবু ওর জীবন বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এবার রেগে কটমট করে তাকাল। তারপর ওসমানকে বলল, ভাইসাব, তোমার সঙ্গে আমার এতকালের কারবার, এখন তুমি ওই শয়তান রায়চৌধুরীটার কথা শুনছ?
ওসমান একটা আঙুল দেখিয়ে বলল, এক কোটি! নইলে মুণ্ডু ঘ্যাচাং!
মোহন সিং বলল, এক কোটি টাকা জোগাড় করা কি সোজা কথা? অনেক সময় লাগবে।
ওসমান বলল, যতদিন না টাকাটা আসে, ততদিন তুই এই ভাবে থাকবি বেইমানের এই শাস্তি!
তলোয়ারটা খাপে ভরে ওসমান হা হা করে একটা অট্টহাসি দিল।
কুলসম বলল, এই লোকটাকে আমার কোনওদিনই ভাল লাগে না। একে কিছু খেতে দেওয়াও উচিত না।
ওসমান বলল, কিছু খেতে দিবি না। শুধু জল চাইলে জল দিবি।
তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, আজ মেজাজটা বেশ খুশ আছে। চলো বাঙালিবাবু, তোমার সঙ্গে দাবা খেলি?
ওসমান ভিড়ের মধ্যে দাবা খেলা পছন্দ করে না। তাই বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায়, গাছের ছায়ায় খেলতে বসা হল।
ওসমান বলল, তুমি ভাল বুদ্ধি দিয়েছ। আমার এত রাগ হয়েছিল, আমি আর একটু হলে মোহন সিংকে কেটেই ফেলতাম। তা হলে আর এক কোটি টাকা পাওয়া যেত না।
কাকাবাবু বললেন, মানুষকে কেটে ফেললে কী পাওয়া যায় জানো? জেল কিংবা ফাঁসি।
ওসমান ঠোঁট উলটে বলল, ওসব আমি পরোয়া করি না। আমাকে কে ধরবে?
কাকাবাবু বললেন, তোমার রাজা সামলাও। এই কিস্তি দিলাম!
ওসমান দাবার গুটিগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মহাবিস্ময়ের সঙ্গে বলল, তুমি আমাকে এত সহজে হারিয়ে দিলে? অ্যাঁ? এর আগে তুমি বারবার হেরেছ!
কাকাবাবু বললেন, তখন তো ইচ্ছে করে হেরেছি।
ওসমান বলল, কেন, ইচ্ছে করে হেরেছ কেন?
কাকাবাবু বললেন, তোমাকে খুশি করার জন্য। নইলে, দাবা খেলায় তুমি আমার কাছে ছেলেমানুষ!
ওসমান বলল, বাজে কথা। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই তুমি জোচ্চুরি করে এই দানটা জিতেছ। আর এক দান খেলে দ্যাখো!
আবার ছক সাজানো হল। এবার কাকাবাবু আরও তাড়াতাড়ি ওসমানকে হারিয়ে দিলেন।
ওসমান হাঁ করে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, তোমার খেলা দেখেই বুঝেছি। তুমি আমাকে একবারও হারাতে পারবে না।
ওসমান বলল, আমি দাবায় চ্যাম্পিয়ান। আমায় কেউ কখনও দাবা খেলায় হারাতে পারেনি।
কাকাবাবু বললেন, আমাদের বাংলায় একটা কথা আছে। বন-গাঁয়ে শিয়াল রাজা। তুমি হচ্ছ তাই। তুমি তো খেলো শুধু তোমার দলের লোকদের সঙ্গে। বাইরের লোকদের সঙ্গে তো খেলোনি!
হঠাৎ ওসমানের চোখদুটো জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সে বলল, তোমাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। এক্ষুনি মেরে ফেলতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, আরে আরে, অত রেগে যাচ্ছ কেন? খেলায় তো হার-জিত আছেই!
ওসমান তবু দুহাত বাড়িয়ে এল কাকাবাবুর গলা টিপে ধরার জন্য।
কাকাবাবু সেই হাতদুটো ধরে ফেলে ঝটকা টান দিয়ে তাকে শূন্যে তুলে ছুড়ে দিলেন দূরে!
তারপর বললেন, এখন যাকে কুংফু ক্যারাটে বলে, আমাদের সময় সেটাকে বলা হত যুযুৎসু! সেটা আমি ভালই জানি। এক জাপানির কাছে শিখেছিলাম।
ওসমান রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে তলোয়ারটা বার করে বলল, এবার?
কাকাবাবুও উঠে দাঁড়িয়ে একটা ক্রাচ ফেলে দিয়ে আর একটা ক্রাচ তুলে বললেন, ওতেও তুমি খুব সুবিধে করতে পারবে না। আমি এটা দিয়ে লড়ব।
ওসমান বলল, তুমি একটা বেওকুফ। তোমার পা খোঁড়া, ওই একটা লাঠি দিয়ে তুমি আমার তলোয়ারের সঙ্গে লড়বে? এবার তুমি মরবে। আমার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না।
কাকাবাবু বললেন, খোঁড়া পায়ের জন্য খানিকটা অসুবিধে হয় বটে, কিন্তু তাতেও অনেকেই হেরে যায়। চেষ্টা করে দ্যাখো।
ওসমান তলোয়ার চালাতে শুরু করলে কাকাবাবু প্রথম কয়েকবার ঠুক ঠুক। করে আটকালেন শুধু। তারপর হঠাৎ যেন খেপে উঠে নিজে এগিয়ে এসে দড়াম দড়াম করে মারতে লাগলেন। একবার লাফিয়ে উঠে ওসমানের হাতে এত জোর মারলেন যে, তার হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে পড়ে গেল।
ওসমান কয়েক মুহূর্ত হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দূরে একজন লোককে দেখে চেঁচিয়ে ডাকল, আপ্পা রাও! আপ্পা রাও!
কাকাবাবু বললেন, এবার তোমার লোকজন ডাকবে? অনেক লোক ঘিরে ফেললে কিছু করতে পারব না, আমি দৌড়তে পারি না যে! আর বন্দুক পিস্তলের বিরুদ্ধেও খালি হাতে লড়তে পারব না। কিন্তু তুমি আমাকে মারবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠলে কেন?
আপ্পা রাও ছুটতে ছুটতে কাছে এসে দাঁড়াল।
ওসমান বলল, একটা ঘোড়া নিয়ে এসো। চোখ বাঁধার কাপড় আর দড়িও আনবে।
আপ্পা রাও দৌড়ে ফিরে গেল।
ওসমান বলল, বাঙালিবাবু, আমি তোমার সম্পর্কে মত বদলে ফেলেছি। তোমায় মারব না। তোমায় মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি ফিরে যাও।
কাকাবাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, সে কী! এমনি এমনি মুক্তি দিয়ে দেবে?
ওসমান বলল, হ্যাঁ। মোহন সিংয়ের কাছ থেকে এক কোটি টাকা পেলে তোমার টাকাটাও ওতেই উশুল হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে আর ধরে রাখার কারণ নেই। শুধু একটা শর্ত আছে। আমি যে তোমার কাছে দাবা আর তলোয়ারে হেরেছি, এ কথা কাউকে বলতে পারবে না।
কাকাবাবু হেসে বললেন, ঠিক আছে, সে কথা কাউকে বলব না। কিন্তু আমি এখন মুক্তি পেতে চাই না।
ওসমান চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি মুক্তি চাও না? কেন?
কাকাবাবু চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, এই জায়গাটা আমার বেশ লাগছে। আরও কিছুদিন থেকে যেতে চাই!
ওসমান বলল, তোমার মাথা খারাপ? কখন রাগের চোটে আমি তোমাকে মেরে বসব তার ঠিক আছে? ছেড়ে দিচ্ছি, পালাও।
কাকাবাবু বললেন, পালাবার আমার একটুও ইচ্ছে নেই। বেশ আছি!
ওসমান বলল, এরকম কথা কোনও বন্দির মুখে আমি আগে কখনও শুনিনি। তোমাকে দেখছি জোর করে তাড়াতে হবে।
আপ্পা রাও একটা ঘোড়ায় চড়ে ফিরে এল।
আপ্পা রাওয়ের কাছে রিভলভার আছে, সুতরাং গায়ের জোর দেখিয়ে লাভ নেই। ওরা যখন তাঁর হাত ও চোখ বাঁধল, তিনি প্রতিবাদ করলেন না।
ওসমান বলল, আপ্পা রাও, তুমি এই বাঙালিবাবুকে হলদিঝোরা পর্যন্ত নিয়ে যাও। ওকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। দেখো যেন, কোনও অসুবিধে না হয়। গাড়ির রাস্তায় পৌঁছে যায়।
আপ্পা রাও বেশ অবাক হলেও কোনও কথা না বলে কাকাবাবুকে ঘোড়ায় তুলে নিল।
খানিক দূর যাওয়ার পর সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের সর্দার তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিল কেন?
কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না। আপ্পা রাও বলল, আমি হলে তোমাকে কিছুতেই ছাড়তাম না। টাকা আদায় হলে তোমাকে দিয়ে চাকরবাকরের কাজ করাতাম।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো!
আপ্পা রাও বলল, সর্দারের হুকুম। তার ওপরে কথা বলা যায় না।
হঠাৎ কাকাবাবুর মাথায় একটা জোরে ঘুসি মেরে সে বলল, সোজা হয়ে বোসো! আমার গায়ে হেলান দিচ্ছ কেন?
কাকাবাবু মোটেই হেলান দেননি। আপ্পা রাওয়ের কথা শুনলেই বোঝা যায়, রাগে তার হাত নিশপিশ করছে!
খানিক বাদে সে আবার একটা ঘুসি মেরে বলল, এই হারামজাদা, ঘুমোচ্ছিস কেন রে? সোজা হয়ে বসে থাক। না হলে গুলি করে তোকে মেরে সর্দারকে গিয়ে বলব, তুই পালাবার চেষ্টা করছিলি!
কাকাবাবু ঘুমোননি। কোনও উত্তরও দিলেন না। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর ঘোড়াটা এক জায়গায় থামল।
আপ্পা রাও বলল, তোমাকে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাব। ঝরনাটার ওপারে একটুখানি গেলেই একটা পাকা রাস্তা দেখতে পাবে। ওখান দিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি যায়। কোনও গাড়ি থামিয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করবে। একদিন লাগতে পারে, দুদিনও লাগতে পারে।
সে কাকাবাবুর চোখের বাঁধন, হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, নেমে পড়ো!
কাকাবাবু ঘোড়া থেকে নামার বদলে ঘুমন্ত মানুষের মতন উলটে পড়ে গেলেন। আর উঠলেন না।
আপ্পা রাও নিজের মনেই বলল, লোকটার কী হল? মরেই গেল নাকি? সে নিজে ঘোড়া থেকে নেমে কাকাবাবুকে টেনে তুলতে গেল।
কাকাবাবু ওসমানের মতন একেও ধরে তুলে এক আছাড় মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওর বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরে বললেন, তুমি আমাকে অকারণে ঘুসি মেরেছ, গুলি করে মারতে চেয়েছিলে। এবার দ্যাখো, কেমন লাগে।
আপ্পা রাও আঁ আঁ করে শব্দ করতে লাগল, চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে। কাকাবাবু আরও জোরে চাপ দিলেন। ক্রমে আপ্পা রাওয়ের গোঙানি থেমে চোখ বুজে এল।
কাকাবাবু এবারে তার গলা ছেড়ে দিয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে বুঝলেন নিশ্বাস পড়ছে। মরেনি, অজ্ঞান হয়ে গেছে।
ওর রিভলভারটা নিজের পকেটে পুরলেন কাকাবাবু। দড়ি দিয়ে হাত আর পা বাঁধলেন। তারপর টানতে টানতে নিয়ে চললেন রাস্তার ধারে।
এর মধ্যে আপ্পা রাওয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে।
কাকাবাবু বললেন, এবারে তুমিই কোনও গাড়ি দেখলে চেঁচিয়ে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করো। বিদায়!
কাকাবাবু ঘোড়াটায় চেপে ফেরার পথ ধরলেন। চোখ বাঁধা ছিল, তিনি পথ চেনেন না। কিন্তু তিনি জানেন, ঘোড়াকে অন্য দিকে না চালালে সে নিজে নিজে ঠিক ডেরাতে ফিরে যায়। তিনি রাশটা আলগা করে ধরে রইলেন।
ঘোড়াটা ঠিকই এক সময় সেই পাহাড়ের কাছে এসে পৌঁছল। এর মধ্যে সন্ধে হয়ে গেছে। কাকাবাবু উপত্যকা পর্যন্ত গেলেন না। এক জায়গায় একটা ছোট্ট জলাশয় আছে, তার পাশে ঘন জঙ্গল, সেখানে থামলেন। ঘোড়াটাকে এক জায়গায় বেঁধে অপেক্ষা করলেন সারারাত।
ভোরবেলা আর-একটা ঘোড়ার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন। আগের দিন সকালেই তিনি দেখেছিলেন, বিক্রম ওসমান এই সময় এই নির্জন জায়গাটায় এসে প্রার্থনা করে।
কাকাবাবু একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন।
বিক্রম ওসমান ঘোড়া থেকে নেমে জলাশয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। তারপর হাঁটু মুড়ে নমাজে বসল।
কাকাবাবু অপেক্ষা করে রইলেন। নমাজ শেষ হওয়ার পর বিক্রম ওসমান উঠে দাঁড়াতেই তিনি ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, এই যে, সুপ্রভাত?
মুখ ঘুরিয়ে ভূত দেখার মতন চমকে উঠে ওসমান বলল, তুমি! ফিরে এসেছ? কেন?
কাকাবাবু বললেন, ইচ্ছে হল, তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাই।
ওসমান বলল, তোমার দেখছি সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?
কাকাবাবু বললেন, আমি যেখানে যাব, সেখানে!
ওসমান বলল, তুমি নিতে চাইলেই বা আমি যাব কেন? কাল তোমাকে মেরে ফেলিনি, এটাই তোমার পরম ভাগ্য। আজ তোমাকে শেষ করে দিতেই হবে! তুমি খুব জ্বালাচ্ছ।
কাকাবাবু রিভলভারটা দেখিয়ে বললেন, আজ যে আমার সঙ্গে এটা আছে?
ওসমান বলল, ওটা থাকলেই বা কী হবে? আমি হাঁক দিলেই আমার দলের লোক ছুটে আসবে।
কাকাবাবু বললেন, তার আগেই যদি আমি গুলি চালিয়ে দিই?
ওসমান বলল, তোমাকে আগেই বলেছি, আমার মৃত্যুভয় নেই। আমি মরলে পরের নেতা কে হবে, তাও ঠিক করা আছে। আমাকে মারলে আমার দলের লোক এসে তোমাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলবে!
কাকাবাবু বললেন, মৃত্যুভয় নেই? দ্যাখো তো এটা কেমন লাগে।
তিনি একটা গুলি চালালেন। সেটা ওসমানের ডান কানের সামান্য একটু অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল। ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল সেখান থেকে।
ওসমানের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। কানটা চেপে ধরে সে বলল, তুমি সত্যি গুলি চালালে? নির্বোধ! গুলির শব্দ শুনে কয়েকজন ছুটে আসবেই।
কাকাবাবু বললেন, তাদের আসতে দেখলে আমার এখনও ঘোড়া নিয়ে ছুটে পালাবার সুযোগ আছে। কিংবা ধরা পড়লেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু তার আগে কী করব জানো? আমি একটা গুলিতে তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে দেব। যাতে তুমি জীবনে আর কখনও এই হাতে তলোয়ার বন্দুক ধরতে না পারো। আর-একটা গুলিতে একটা হাঁটু গুঁড়িয়ে দেব, যাতে চিরকালের মতন খোঁড়া হয়ে থাকবে। তুমি বেঁচে থাকবে বটে, কিন্তু ডাকাত দলের সর্দারি করা ঘুচে যাবে। আমার যে কথা, সেই কাজ। এখন বলল, তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাও, না ওইভাবে বাঁচতে চাও? আমি পাঁচ পর্যন্ত গুনব। এক-দুই-তিন—
ওসমান চেঁচিয়ে বলে উঠল, না, না, গুলি কোরো না!
কাকাবাবু বললেন, সকলেই ভয় পায়। নাও, এবার ঘোড়ায় উঠে পড়ে ঠিক পথে চলো। কাল ফেরার সময় আমি পথ অনেকটা দেখে রেখেছি, আমায় ঠকাতে পারবে না।
কাকাবাবু নিজেও ঘোড়ায় চড়ে ওসমানের পাশাপাশি চলতে চলতে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই একবার খুব জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে কিংবা হঠাৎ অন্যদিকে বেঁকে গিয়ে আমার চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা করবে? তার ফল কী হবে জানো?
ওসমান বলল, কী?
কাকাবাবু বললেন, আমার হাতের টিপ খুব ভাল। পালাতে গেলেই আমি তোমার পায়ে গুলি করব। এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দেব। তারপর তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা একেবারে থেঁতলে দেব ঠিকই। সুতরাং ও-চেষ্টা কোরো না।
ওসমান বলল, বাঙালিবাবু, আমি তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছি।
এমনকী তোমাকে ছেড়েও দিয়েছিলাম, তবু তুমি কেন আমায় ধরিয়ে দিচ্ছ?
কাকাবাবু বললেন, তুমি আমাকে ভাল খাইয়েছ-দাইয়েছ ঠিকই। কিন্তু কাল হঠাৎ রেগে গিয়ে আমায় খুন করতে গিয়েছিলে। আমার বদলে অন্য মানুষ হলে মরেই যেত। সে জন্যও নয়। তুমি মানুষ খুন করো। জঙ্গল ধ্বংস করে তুমি সারা দেশের ক্ষতি করছ, এজন্য তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।
ওসমান বলল, আমার রাগটা বেশি। যখন-তখন রাগ হয়ে গেলে আর নিজেকে সামলাতে পারি না।
কাকাবাবু বললেন, রাগের বশেই হোক বা যে-জন্যই হোক, যে তোক মানুষ খুন করে, তার কোনও ক্ষমা নেই!
ওসমান বলল, আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ো না। এখানেই গুলি করে মেরে রেখে যাও। এই অনুরোধটা অন্তত রাখো।
কাকাবাবু বললেন, মানুষ মারা আমার কাজ নয়। তবে তোমার একটু সুবিধে করে দিতে পারি। তোমার অপরাধের জন্য তোমার ফাঁসি হওয়ারই কথা। তবে, আমি যদি না বলি যে তোমাকে ধরে এনেছি, তুমি যদি বলো যে তুমি নিজে থেকে ধরা দিতে এসেছ, আত্মসমর্পণ যাকে বলে, তা হলে তোমার শাস্তি কমে যেতে পারে। ফাঁসির বদলে জেল হবে।
ওসমান বলল, সারাজীবন জেলে কাটাতে হবে?
কাকাবাবু বললেন, আজকাল সারাজীবন কাটাতে হয় না। বড়জোর চোদ্দো বছর। ফুলন দেবীও তো ছাড়া পেয়ে গেছে। তুমিও একসময় ছাড়া পাবে!
ওসমান বলল, আমি ধরা দিলে আমার দলের লোকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না?
কাকাবাবু বললেন, ওদেরও ধরা দিতে হবে। নইলে ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরবে।
পাহাড় ছেড়ে ঘোড়াদুটো ঢুকে গেল গভীর জঙ্গলে।
কাকাবাবু বললেন, তোমার দলের লোকরা আওয়াজ শুনতে পায়নি, কেউ তো তাড়া করে এল না।
এর পর আর কোনও কথা হল না অনেকক্ষণ। এক সময় সেই পাকা রাস্তাটা দেখা গেল।
কাকাবাবু বললেন, ওসমান, তুমি ঘোড়াসুদ্ধ মাঝরাস্তায় দাঁড়াও। কোনও গাড়ি এলে থামতে বাধ্য হবে।
মিনিটদশেক পরেই একটা গাড়ি এল। তাতে শুধু একজন ড্রাইভার।
কাকাবাবু তাকে বললেন, আমাদের একটু লিফ্ট দাও, সামনের শহর পর্যন্ত।
লোকটি বলল, হবে না, হবে না!
কাকাবাবু রিভলভারটা দেখালেন।
লোকটি বিনা বাক্যব্যয়ে দরজা খুলে দিল। ঘোড়াদুটো ছেড়ে দিয়ে কাকাবাবু ওসমানকে বসালেন ড্রাইভারের পাশে। নিজে বসলেন জানলার দিকে।
একটু গাড়ি চলার পর ওসমান ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমায় চেনো না?
লোকটি বলল, না। ওসমান বলল, বিক্রম ওসমানকে চেনে না, এই তল্লাটে এমন কেউ আছে?
লোকটি এমনই ভয় পেয়ে গেল যে, হাত থেকে স্টিয়ারিং ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম। সে বলল, ওরে বাবা রে, বাবা রে! আপনি বিক্রম ওসমান? আপনাকে এই লোকটা পিস্তল দেখিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে? আমি নিয়ে যেতে পারব না।
কাকাবাবু কঠোরভাবে বললেন, ঠিক করে গাড়ি চালাও!
লোকটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমায় মাপ করুন স্যার। এর পর ওঁর দলের লোক আমাকেই খতম করে দেবে। আমি গাড়ি থামাচ্ছি।
কাকাবাবু বললেন, গাড়ি থামালে আমি যে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব, সেটার কী হবে?
লোকটি বলল, ওরে বাবা, এ যে দেখছি মহাবিপদ! হয় আপনার হাতে মরতে হবে, না হয় ওঁর দলের হাতে।
কাকাবাবু বললেন, ওর দলকে ভয় পাওয়ার আর দরকার নেই। আর দুদিনেই ওর দল ভেঙে যাবে!
জঙ্গল ফুরোবার পর আর দুএকটা গাড়ি দেখা যেতে লাগল রাস্তায়। ড্রাইভার বলল, কতদূর যেতে হবে সার?
কাকাবাবু বললেন, সামনে যেখানে বড় থানা আছে, সেখানে গাড়ি ঢোকাবে।
ওসমান বলল, এদিককার কোনও থানা আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।
কাকাবাবু বললেন, দেখা যাক।
আরও কিছুক্ষণ পরে উলটো দিক থেকে একটা গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখে কাকাবাবু চমকে উঠলেন। মনে হল, সেই গাড়িতে সন্তুও কাকাবাবুকে দেখতে পেয়েছে। তাদের গাড়ি থেমে গেল। সবাই এদিকে দৌড়ে এল।
কাকাবাবু ওসমানকেও নামালেন। তারপর সন্তু, জোজোর সঙ্গে অমল আর রফিক আলমকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে বললেন, আলমসাহেব, আপনিও এসে গেছেন? এই নিন আপনার উপহার। বিক্রম ওসমানকে কিন্তু আমি জোর করে ধরে আনিনি। সে নিজে থেকে ধরা দিতে যাচ্ছে।
আলমের চোখ-মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল। ফস করে পকেট থেকে রিভলভার বার করে বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি সরে দাঁড়ান।
ওই নরকের কুত্তাটাকে আমি নিজের হাতে শেষ করব!
কাকাবাবু বললেন, সে কী! আপননি মারবেন কেন? ওর বিচার হবে, তাতেই শাস্তি পাবে।
আলম বলল, বিচার-টিচারের দরকার নেই। আমিই ওকে শাস্তি দেব। ওকে গুলি করে খতম করে রিপোর্ট দেব যে, ও পালাবার চেষ্টা করেছিল।
কাকাবাবু বললেন, তা আমি হতে দেব না। আইন আপনি নিজের হাতে নিতে পারেন না।
আলম বলল, ও কী করেছে জানেন? আমার ভাই, সেও পুলিশ অফিসার ছিল, তাকে এই শয়তানটা মেরেছে। বিক্রম ওসমান, তোমার মনে নেই, তুমি গত
বছর পুলিশ অফিসার হাসানকে গুলি করে মেরেছ?
কাকাবাবু ওসমানকে আড়াল করে দাঁড়ালেন।
আলম বলল, আপনি সরে যান। নইলে আমি আপনার ওপরেও গুলি চালাতে বাধ্য হব!
কাকাবাবু বললেন, সন্তু!
সঙ্গে-সঙ্গে সন্তু পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আলমের গলা চেপে ধরল। তার হাত থেকে রিভলভারটা খসে পড়তেই ওসমান কাকাবাবুকে ঠেলে দিয়ে সেটা তুলতে গেল। তার আগেই জোজো এক লাথি দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দিল দূরে।
অমল সেটা হাতে নিয়ে বলল, আমিও কিন্তু গুলি চালাতে জানি!
কাকাবাবু আলমের কাছে গিয়ে বললেন, ছিঃ, অত মাথা গরম করতে নেই।
আলম এবার কেঁদে ফেলে বলল, ও আমার ছোট ভাইকে মেরেছে। হাসানকে আমি এত ভালবাসতাম, নতুন বিয়ে হয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, সেজন্য ওসমানকে শাস্তি পেতেই হবে।