Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও এক ছদ্মবেশী || Sunil Gangopadhyay

কাকাবাবু ও এক ছদ্মবেশী || Sunil Gangopadhyay

ভোরবেলা হোটেলের সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন কাকাবাবু।

বুক ভরে টাটকা বাতাসের শ্বাস নিয়ে বললেন, আঃ! যেন মনে হল, তিনি ফুলের গন্ধ নিচ্ছেন। সত্যি, এখানকার বাতাসে যেন পবিত্র পবিত্র গন্ধ আছে।

ডান পাশেই পাহাড়ের পর পাহাড়। চুড়ায় বরফ জমে আছে। সারাদিন বরফের রং একটু-একটু পালটায়। এখন ভোরের সূর্যের আলোয় বরফের রং লালচে মতন।

সামনের দিকে, রাস্তার ওপারে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতরটা এখনও অন্ধকার। কাছাকাছি কয়েকটা গাছের পাতায় ঝিলমিল করছে রোদ। একটা পাখি এক গাছ থেকে আর-একটা গাছে উড়ে গিয়ে বসল। বেশ বড় পাখি, অনেকখানি ঝোলা লেজ। কাকাবাবু পাখিটা চিনতে পারলেন, ওর নাম ম্যাগপাই। বিদেশে এই পাখি দেখেছেন। এদেশেও যে ম্যাগপাই দেখা যায়, তিনি জানতেন না। ম্যাগপাইয়ের বাংলা কী? বাংলায় এরকম পাখি নেই, তাই বাংলা নামও কেউ দেয়নি।

সন্তু আর জোজো এখনও ঘুমোচ্ছে। কাকাবাবু ওদের ডাকলেন না। হোটেলের একজন বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করল, সার। চা খাবেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আনো। বেশি করে। অন্তত যেন দুকাপ হয়।

একটু পরেই বেয়ারাটি পটে করে চা নিয়ে এল। কাকাবাবু বারান্দায় বসে বেশ তৃপ্তি করে চা খেলেন। শীতের মধ্যে সকালের প্রথম গরম চা-টা খেতে আরাম লাগে বেশ।

অনেকদিন আগে কাকাবাবু চুরুট খেতেন। এখন ছেড়ে দিয়েছেন। এতদিন পর আজ আবার মনে হল, এখন এই ঠাণ্ডায়, একটা চুরুট ধরাতে পারলে বেশ হত!

সেই ইচ্ছেটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন রাস্তায়।

কাকাবাবু ওভারকোট পরে আছেন। তবু ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। নাকের ডগাতেই শীত লাগে বেশি। কাকাবাবু নাকটা খানিকক্ষণ ঘষে গরম করে নিলেন। তারপর ক্রাচ বগলে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন সামনের দিকে।

কাছেই একটা ছোট নদী আছে। ছোট হলেও খুব স্রোত। নদীটির নাম পার্বতী। কাকাবাবু ঠিক করলেন, সেই নদীর ধারে বসে থাকবেন কিছুক্ষণ।

শীতের জন্য অনেকেই এখানে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। ভোরের দিকে দুটো কম্বল গায়ে দিতে হয়!

রাস্তায় আর মানুষজন নেই। শুধু দুটি ফরসা তরুণ-তরুণী একটু পরে তাঁর পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল। ওরা বিদেশি। কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় যে দুটো একটা কথা শোনা গেল, তাতে কাকাবাবু বুঝলেন, ওরা ইতালিয়ান।

হিমালয়ের কোলে প্রায় নাম-না-জানা এই ছোট্ট জায়গাটাতেও অনেক বিদেশি আসে বেড়াতে। কেন যেন ইতালি থেকেই ভ্রমণকারীরা এখানে আসে বেশি। অনেকে চার-পাঁচ মাস থেকেও যায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে কিছু কিছু বাড়ি রয়েছে, এক-একটা বাড়ি ঠিক সাহেবদের দেশের বাড়ির মতন দেখতে। কোনও কোনও বাড়ি এত উঁচুতে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতেই দম বেরিয়ে যাবে মনে হয়। তবু সাহেব-মেমরা ওইরকম বাড়িই পছন্দ করে।

রাস্তার একপাশে পাহাড়, আর একপাশে পরপর আপেলবাগান। আলাদা আলাদা মালিকরা মাঝে-মাঝে বেড়া দিয়ে রেখেছে। গাছে গাছে আপেল ফলে আছে, এখনও বেশ কচি।

এক জায়গায় নদীতে যাওয়ার পথ। পথ মানে, সেরকমভাবে কেউ তৈরি করেনি, ছোট-বড় পাথর ছড়ানো। এইরকম এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে খুব অসুবিধে হয়। কাকাবাবু সাবধানে হাঁটতে লাগলেন। একটা পাখি সুন্দর শিস দিচ্ছে, সেই পাখিটাকেও তার চোখ খুঁজছে।

পাখিটাকে দেখতে গিয়ে কাকাবাবু আছাড় খেয়ে পড়লেন। তেমন কিছু লাগেনি, কিন্তু লজ্জা পেয়ে গেলেন খুব। কাছাকাছি কোনও বাচ্চা ছেলেমেয়ে থাকলে নিশ্চয়ই হেসে উঠত। বয়স্ক লোকদের আছাড় খেতে দেখলে সকলেরই। হাসি পায়।

তাড়াতাড়ি উঠে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কাকাবাবু এদিক তাকালেন। কেউ দেখেনি।

তখনই কাকাবাবুর মনে হল, আছাড় খাওয়া কেন বলে? এর মধ্যে খাওয়ার কী আছে? বাংলা ভাষাটা বড় অদ্ভুত। খাওয়া নিয়ে কত কী যে হয়। ভাত খাওয়া আর জল খাওয়া তো আছেই, যদিও ইংরিজিতে ইট আর ড্রিঙ্ক আলাদা। তার ওপর, সিগারেটও খাওয়া হয় কী করে? ধমক খাওয়া? আদর খাওয়া? বুড়োধাড়ি ছেলে মায়ের কোলে শুয়ে খুব আদর খাচ্ছে, লোকে বলে না? এমনকী হাওয়া খাওয়াও বলে।

এইসব ভাবতে ভাবতে কাকাবাবু নদীর ধারে এসে একটা বড় পাথরের ওপর বসলেন।

বসতে না বসতেই একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল।

এই রাস্তাটা চলে গেছে মণিকরণের দিকে। সেটা একটা তীর্থস্থান। সেইজন্য দিনের বেলা অনেক গাড়ি যায়। আজ সকালে এটাই প্রথম গাড়ি।

এরকম শান্ত, নির্জন জায়গায় গাড়ির আওয়াজ একেবারে মানায় না। বিশ্রীভাবে নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়। ধোঁয়া ছড়ায়।

গাড়িটা খানিকটা এগিয়েই থেমে গেল হঠাৎ। তারপর পিছিয়ে আসতে লাগল। থামল নদীর রাস্তাটার কাছে। গাড়ি থেকে দুটি লোক নেমে হন হন করে, প্রায় দৌড়ে আসতে লাগল কাকাবাবুর দিকে।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।

এরা কারা? বন্ধু, না শত্রু?

অনেক বড় বড় অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছেন কিংবা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন কাকাবাবু। তাদের দলের লোক, চ্যালা-চামুণ্ডাদের তো রাগ থাকবেই তাঁর ওপর। অনেকে অনেকবার প্রতিশোধ নেওয়ারও চেষ্টা করেছে। কে যে কখুন কোথা থেকে উদয় হবে। তার তো ঠিক নেই।

কাকাবাবু একবার কোটের পকেট থাবড়ে দেখলেন।

রাত্তিরে ঘুমোবার আগে রিভলভারটা তিনি রাখেন বালিশের তলায়। এখন সকালে বেড়াতে এসেছেন, সঙ্গে সেটা আনেননি। ঘুম থেকে উঠেই কি মারামারি, গুলি ছোড়াছুড়ির কথা কারও মনে পড়ে?

এরা যদি শত্রু হয়, এদের সঙ্গে অস্ত্র থাকবেই। দুজনেরই চেহারা বেশ গাঁট্টাগোট্টা। কাকাবাবু ডান হাতের ক্রাচটা শক্ত করে চেপে ধরলেন।

তারপর ওদের যেন গ্রাহ্যই করছেন না, এইভাবে মুখ ফিরিয়ে নদী দেখতে লাগলেন। এমনও তো হতে পারে, ওরাও আসছে নদীর ধারে বসবার জন্য। কিন্তু তা হলে দৌড়ে দৌড়ে আসবে কেন?

একটা আওয়াজ শুনে কাকাবাবুকে আবার মুখ ফেরাতেই হল।

ওদের মধ্যে একজন আছাড় খেয়ে পড়েছে। একটু আগে কাকাবাবু নিজে আছাড় খেয়েছেন, তবু তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল। ওরা তো খোঁড়া নয়, তা হলে আছাড় খাবে কেন?

অন্য লোকটি কাছে এসে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, নমস্কার সার, আপনার নাম কি রাজা রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু বললেন, আগে জানতে পারি কি, কেন আমার নাম জিজ্ঞেস করছেন?

লোকটি বলল, আমরা রাজা রায়চৌধুরীকে খুঁজছি। খুব দরকার। হোটেলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। একজন বেয়ারা বলল, আপনি এইদিকে বেড়াতে বেরিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, হোটেলের বেয়ারাটি ঠিক কাজ করেনি। সকালবেলা কেউ বেড়াতে বেরুলে তাকে ডিস্টার্ব করা উচিত নয়। যাই হোক, আপনাদের তো আমি চিনি না, আমার সঙ্গে আপনাদের কী দরকার থাকতে পারে?

অন্য লোকটির আছাড় খেয়ে বেশ লেগেছে। সে একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে এর মধ্যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার সে বলল, এস পি সাহেব আমাদের পাঠিয়েছেন। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনাকে এক্ষুনি মাণ্ডি যেতে হবে।

কাকাবাবুর এবার ভুরু কুঁচকে গেল।

অচেনা উটকো লোকদের বিশ্বাস করা যায় না। এরা পুলিশের বড়কর্তার নাম করছে। সেটা সত্যি কি না কে জানে! অনেক সময় জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার বদলে এরা মিথ্যে কথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সেবারে কালিকটে মোহন সিং যেরকম জোজোকে সিনেমায় পার্ট দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।

খানিকটা বিরক্তভাবে কাকাবাবু বললেন, আপনাদের এস পি সাহেবকেও আমি চিনি না। তাঁর কথায় আমাকে মাণ্ডি যেতে হবে কেন? আমার আপাতত এ জায়গাটা ছেড়ে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই।

প্রথম লোকটি বলল, এস পি সাহেব বিশেষ করে বলেছেন, আপনাকে নিয়ে যেতে, গাড়ি এনেছি।

আগেকার দিনে এখানে অনেক ছোট খাটো রাজা-মহারাজা ছিল, তাদের কথাতেই সবকিছু চলত। এখন রাজা-মহারাজাদের দিন শেষ। এখন পুলিশের বড় সাহেবরাই সব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাদের সবাই ভয় পায়।

কাকাবাবু কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই অন্যজন বলল, একটা খুব জরুরি কেস আছে, সার। এস পি সাহেব আপনাকে কাজে লাগাবেন। সেইজন্যই মাণ্ডি যেতে হবে আপনাকে।

কাকাবাবু এবার রীতিমতন ধমক দিয়ে বললেন, কেস আছে মানে? আমি তার কী করব? আপনাদের এস পি সাহেব ভুল করেছেন, তাঁকে গিয়ে বলুন!

লোকদুটি কাকাবাবুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

কাকাবাবু ভাবলেন, এবার বোধ হয় ওরা পকেট থেকে রিভলভার কিংবা ছোরা-ছুরি বের করবে। তিনি তৈরি হয়ে রইলেন।

একজন সত্যিই পকেটে হাত দিল। কিন্তু কোনও অস্ত্রের বদলে বের করল একটা নোটবই। খানিকটা নিরাশভাবে বলল, আপনি যে সার যেতে রাজি নন, সেটা এখানে লিখে দিন।

কাকাবাবু বললেন, কেন, লিখব কেন? আপনারা কি আমার নামে কোনও চিঠি এনেছেন? চিঠি আনলে লিখে উত্তর দিতাম। আপনারা মুখে বললেন, আমিও উত্তর দিলাম মুখে।

লোকদুটি এবার নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলল, তারপর ফিরে গেল গাড়ির দিকে।

কাকাবাবু মনে মনে বললেন, জ্বালাতন! এরা ভাবে কী! কেউ এসে হুট করে কিছু বললেই তার সঙ্গে যেতে হবে? এস পি হোক বা যে-ই হোক।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনটা খুব ভাল হয়েছিল, এই উৎপাতে খানিকটা খিচড়ে গেছে। মেজাজটাকে আবার প্রসন্ন করার জন্য কাকাবাবু নদীর দিকে মন দিলেন।

ছোট নদী, কিন্তু স্রোতের জন্য বেশ কুলুকুলু শব্দ আছে। বড় বড় পাথরে ঘা খেয়ে খেয়ে বইছে নদী। ওপারের গাছপালার জন্য পাহাড়ের চুড়োগুলো আড়ালে পড়ে গেছে। নদীর জল খুব টলটলে পরিষ্কার!

কাকাবাবু ভাবলেন, আমি তো কবি নই। কোনও কবি এই নির্জন নদীর ধারে বসলে নিশ্চয়ই একটা কবিতা লিখে ফেলত। নদীর সঙ্গে সবাই মিল দেয়, যদি। আর কি কোনও মিল হয়? একটু চিন্তা করতেই মনে পড়ল আর একটা মিল, নিরবধি। আর কোনও শব্দ আছে? আর কিছু মনে পড়ল না।

এর পর তিনি গান ভাববার চেষ্টা করলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান আছে, ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা…। ওঁরই আর একটা গান, ও নদী রে, একটি কথা শুধাই তোমায় বলো না….।

কাকাবাবু দ্বিতীয় গানটা গাইতে লাগলেন গুগুন্ করে। তাঁর গলায় ঠিক সুর আসে না। কিন্তু এখানে তো আর ভুল ধরবার কেউ নেই।

ছোটবেলায় তিনি জগদীশচন্দ্র বসুর একটা লেখা পড়েছিলেন। গঙ্গার তীরে বসে বাচ্চা জগদীশচন্দ্র জিজ্ঞেস করতেন, নদী, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? নদী উত্তর দিত, মহাদেবের জটা হইতে। পৌরাণিক কাহিনীতে আছে, গঙ্গা নদী নেমেছে স্বর্গ থেকে, কিন্তু মহাদেবের মাথার বিশাল জটার মধ্যে আটকে গিয়েছিল। ভগীরথ নামে একজন রাজা সেখান থেকে গঙ্গাকে মুক্ত করে পথ

দেখিয়ে সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে যান। সেইজন্যই গঙ্গার আর এক নাম ভাগীরথী।

এই পার্বতী নদী কোথা থেকে আসছে? নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোনও পাহাড়ের চূড়ার বরফ থেকে। যদি পা খোঁড়া না হত, তিনি এই নদীর ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে

পাহাড়চূড়ায় উৎসস্থানটা দেখে আসতেন।

খানিকটা বেলা বাড়তেই রাস্তা দিয়ে অনেক গাড়ি চলাচল শুরু হয়ে গেল। কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে। কাকাবাবু উঠে পড়লেন। শীত অনেকটা কমে এসেছে। ওভারকোটটা খুলে ফেলতে হল। ফিরে এলেন হোটেলে।

এই হোটেলে খুব বড় ঘর, সুইট যাকে বলে, তা নেই। তাই দুটো আলাদা ঘর নিতে হয়েছে। জোজো আর সন্তুকে ডেকে তুলবেন ভেবে তাদের ঘরের দরজায় উঁকি মারলেন কাকাবাবু।

জোজো আর সন্তু এর মধ্যে জেগে তো উঠেছেই, খাবার খেতে শুরু করে দিয়েছে। দুজনের সামনের ট্রেতে দুধ আর কর্ন ফ্লেক্স, টোস্ট আর ওমলেট।

জোজো বলল, কাকাবাবু আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? আপনাকে ঘরে দেখতে পেলুম না। আমাদের খুব খিদে পেয়েছিল, তাই ব্রেকফাস্ট খেতে শুরু করে দিয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, বেশ করেছ।

জোজো জিজ্ঞেস করল, আপনার ব্রেকফাস্ট এখানে দিতে বলব?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আমি তো ব্রেকফাস্ট খেতে পারব না। আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

ওরা দুজনেই অবাক হয়ে একসঙ্গে বলে উঠল, কেন?

কাকাবাবু বললেন, ব্রেকফাস্ট মানে উপবাস ভঙ্গ। আমি তো আগেই চা পান করে ফেলেছি, তাই উপোস ভেঙে গেছে। এখন আমাকে জলখাবার খেতে হবে। আমাদের ছোটবেলায় জলখাবারই বলত, ব্রেকফাস্ট কথাটার চল ছিল না।

জোজো আধখানা ডিম মুখে পুরে দিয়ে বলল, জলখাবার তো বাড়িতে খাই, হোটেলে ব্রেকফাস্ট। এই যে এদের মেনুতে লেখা আছে, ব্রেকফাস্টে কী কী পাওয়া যায়, তার মধ্যে পুরি-তরকারিও আছে!

কাকাবাবু বললেন, কথাটা মেনু নয়, মেনিউ। আমরা বাংলা বাংলা করে নিয়েছি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, ছোট হাজরি ঠিক কী? বিশেষ ধরনের খাবার?

কাকাবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, তুই ছোট হাজরি জানলি কী করে?

সন্তু বলল, একটা পুরনো বাংলা বইতে পড়েছি। একজন সাহেবকে সকালবেলা তার আর্দালি ছোট হাজরি এনে দিচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, আগেকার বইতে থাকত বটে। তোরা দীনেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা পড়েছিস? রহস্য লহরী সিরিজ। দারুণ ডিটেকটিভ গল্প। সবই অবশ্য ইংরিজির অনুবাদ। সেই সিরিজের ডিটেকটিভের নাম রবার্ট ব্লেক। আমার খুব ভাল লাগত ওইসব লেখা, এখন আর কেউ বোধ হয় পড়ে না। ওইসব বইতে ব্রেকফাস্টের বদলে লেখা হত ছোট হাজরি। ছোট মানে তো ঠিকই আছে, হারি কেন বলা হত, তা আমি জানি না।

সন্তু বলল, ব্রেকফাস্টের বাংলা, জলখাবার? আর কোনও বাংলা নেই?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, প্রাতরাশ। মানে হল সকালের খাবার। কিন্তু এটা বড় শুদ্ধ বাংলা, লোকের মুখে চলেনি।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনার জন্য কী প্রাতরাশ অর্ডার দেব?

কাকাবাবু বললেন, তোমরা যা খাচ্ছ তাই-ই। তবে কর্নফ্লেক্স লাগবে না। জোজো উঠে গিয়ে টেলিফোন তুলল। কাকাবাবু চেয়ার টেনে বসে পড়ে বললেন, সন্তু, তোরা এত তাড়াতাড়ি আরামের বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লি যে? আমি নদীর ধারে ঘুরে এলাম। তোরা ঘুমোচ্ছিলি দেখে ডাকিনি।

সন্তু বলল, একটা টেলিফোনের ঝনঝনানিতে ঘুম ভেঙে গেল। বাজছে তো বাজছেই। খুঁজছিল তোমাকে।

কে? নাম বলেনি। বলল, খুব জরুরি দরকার।

আমরা যে এখানে এসেছি, তা তো কারও জানার কথা নয়। কাউকেই খবর দিইনি। গত বছর বিমান বলল, যদি সত্যিকারের নিরিবিলিতে থাকতে চান, তা হলে কসোল-এ গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসুন। সত্যিই জায়গাটা বড় মনোরম, আর নিরিবিলিও বটে।

যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি তোমাকে না পেয়ে খানিকটা নিরাশ হয়েছেন মনে হল। বোধ হয় তোমার খোঁজে এখানে আসবেন।

এই রে, এইবার মনে হচ্ছে উৎপাত শুরু হবে। নদীর ধারে ও দুটো লোক আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।

জোর করে? কারা?

জোর করে, মানে, হাত ধরে টানাটানি করেনি। বলল তো পুলিশের লোক। আসল পুলিশ না নকল পুলিশ তার ঠিক কী! এবার এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।

কাকাবাবু জলখাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলেন। হোটেল থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেল। সেই গাড়ি ছুটল মণিকরণের দিকে।

হিমাচলপ্রদেশ ভারতের একটিমাত্র রাজ্য, যার পুরোটাই পাহাড়।

পাহাড়ের পর পাহাড়, তাই রাস্তা কখনও উঁচুতে উঠে গেছে, কখনও নিচুতে। দুদিকের দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। কোনও কোনও পাহাড়ের চূড়ায় বরফ ঝলসে উঠছে রোদ্দুরে, কোথাও জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে সরু সরু পথ। কত উঁচুতে এক-একটা গ্রাম। কোনও কোনও জায়গায় গ্রাম নেই, একটি বা দুটি বাড়ি রয়েছে চূড়ার কাছে।

রাস্তাটা চলেছে নদীর গা দিয়ে দিয়ে।

গাড়িতে যেতে যেতে নদী নিয়ে কে কটা কবিতা বা গান বলতে পারে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতে লাগল জোজো আর সন্তুর মধ্যে। সন্তুর অনেক বেশি মুখস্থ থাকে, জোজো তার সঙ্গে পারবে কেন?

হেরে গিয়ে জোজো বলল, শুধু বাংলা-ইংরিজি কেন, অন্য ভাষাতেও নদী নিয়ে অনেক গান আছে। তুই এটা জানিস, লা হিলা হুলা হাপা, গুলগুল টরে টরে, ইয়াগু হামপা…

সন্তু নিরীহ মুখ করে জিজ্ঞেস করল, এটা কী ভাষা?

জোজো বলল, এটা অস্ট্রেলিয়ার একটা আদিবাসীদের গান। বাবার সঙ্গে একবার সেন্ট্রাল অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলাম তো, সেখানকার এক শহরের মেয়রের ছোট মেয়ের একটা অদ্ভুত অসুখ হয়েছিল, তাকে বাঁচাতে। সেখানে হাপা নামের একটা মজার নদী আছে। সেই নদীটাকে লোকে এত ভালবাসে যে, এই গানটা সবসময় শোনা যায়, ছোট ছেলেমেয়েরাও জানে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, গানটার মানে কী?

জোজো বলল, ওগো হাপা নদী, তোমাকে এত ভালবাসি, তোমার জলে স্নান করে এত আরাম পাওয়া যায়, পৃথিবীর আর কোনও নদী সেই আরাম দিতে পারে না।

সন্তু বলল, বাঃ! গানটা আর একবার শোনা তো!

জোজো সুর করে গেয়ে উঠল, লা হিলাহুলা হাপা, গুলগুল টরে টরে, ইয়াপু হাপা…

সন্তুও গাইবার চেষ্টা করে বলল, এর মধ্যে গুলগুল টরে টরে, এই জায়গাটাই আমার বেশি ভাল লাগছে।

জোজো বলল, গুলগুল টরে টরে মানে স্নান করে কী আরাম, স্নান করে কী আরাম! পৃথিবীর সব নদীর তুলনায় ওই নদীতে স্নান করে বেশি আরাম কেন বল

তো?

সন্তু বলল, আমি কী করে জানব? আমি অস্ট্রেলিয়াতেও যাইনি, আর ওই হাপা নদীও দেখিনি।

জোজো বলল, ওই জায়গাটায় খুব শীত, বুঝলি। আর নদীটার জল গরম! শীতকালে চান করার সময় আমাদের গরম জল করে নিতে হয়, ওদের তা দরকার হয় না, নদীতেই গরম জল পেয়ে যায়। পৃথিবীতে আর কোনও নদী আছে, যার জল সারা বছরই গরম থাকে? পাশের দিকে কম গরম, সেখানে চান করে আরাম, আর মাঝখানে বেশি গরম, একেবারে ফুটছে, লোকে কেটলি ভরে সেই জল এনে চা বানিয়ে ফেলে!

সামনের সিটে বসে কাকাবাবু কানখাড়া করে সব শুনছিলেন আর জোজোর গান শুনে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। এবার বললেন, জোজো, তোমার ওই গুলগুল টরে টরে নদীই একমাত্র গরম নয়। পৃথিবীর আরও অনেক নদী গরম হতে পারে। এমনকী, এই যে পার্বতী নদী দেখছ, এটাও আমি গরম করে দিতে পারি।

সন্তু বলল, এই তো পাহাড়ি নদী, বরফগলা জল, নিশ্চয়ই খুব ঠাণ্ডা, কাশ্মীরে যেমন দেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, বরফগলা জলও ম্যাজিকে গরম হয়ে যেতে পারে। এই নদীর দিকে ভাল করে তাকিয়ে থাক।

মণিকরণ নামে ছোট্ট শহরটা একেবারে কাছে এসে গেছে। দুপারে অনেক বাড়িঘর। তবু নদীটাকে দেখা যায় গাড়ি থেকে।

কাকাবাবু বললেন, এখন নেমে গিয়ে হাত দিয়ে দেখ!

জোজো অবিশ্বাসের সুরে বলল, যাঃ, কী বলছেন কাকাবাবু!

কাকাবাবু বললেন, ব্রিজের ওপারে নদীর ধারটার দিকে তাকাও তা হলে! এবারে জোজোর চোখ গোল গোল হয়ে গেল। সত্যিই নদীর ওধারে জল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এক জায়গায় জল ফুটছে টগবগ করে।

কাকাবাবু বললেন, এর মধ্যে অবশ্য ম্যাজিক কিছু নেই। কোনও জায়গায় আসবার আগে সেই জায়গাটা সম্পর্কে একটু পড়েশুনে আসতে হয়। এখানে অনেক উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। সেখান থেকে গরম জল বেরোয়, সেই গরম জল নদীতে মেশে। এই জায়গাটায় পার্বতী নদীর জল সারা বছরই গরম!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress