ঋষিকোণ্ডায় যে গেস্ট হাউজ
ঋষিকোণ্ডায় যে গেস্ট হাউজে নরেন্দ্র ভার্মা থাকার ব্যবস্থা করেছেন, তার কাছাকাছি আর কোনও বাড়ি নেই। বেলাভূমি একেবারে ফাঁকা। সমুদ্র আর আকাশ ছাড়া এখানে আর কিছু নেই। া, কিছু সি-গাল পাখি আছে। এখানে বালির রং হলুদ, আকাশ আর সমুদ্র গাঢ় নীল, আর পাখিগুলো ধপধপে সাদা।
কাকাবাবু, নরেন্দ্র ভার্মা আর সন্তু সকালবেলা অনেকক্ষণ সাঁতার কাটল সমুদ্রে, প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি। জোজো বসে রইল পাড়ে। নরেন্দ্র ভার্মা অনেকবার বলেছিলেন, খানিকটা নামমা, আমরা তোমাকে ধরে থাকব, কোনও ভয় নেই। জোজো কিছুতেই রাজি হয়নি।
এখানে বাতাস বেশ স্নিগ্ধ, শীতও নেই, গরমও নেই। জোজো দেখল, বড় বড় ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে সন্তু অনেকটা এগিয়ে গেছে, তাকে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতন দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকাতেই জোজোর বুকটা শিরশির করে ওঠে, যদি সন্তু আর ফিরে আসতে না পারে?
কত সময় যে কেটে যাচ্ছে, তা ওদের খেয়ালই নেই। জলের মধ্যে থাকতে মানুষের এত ভাল লাগে?
জোজো মনে মনে কবিতা বানাবার চেষ্টা করতে লাগল।
আকাশের কোনও সীমানা থাকে না
সমুদ্র অতলান্ত…
এবার অতলান্তের সঙ্গে কী মিল দেওয়া যায়? শান্ত, ভ্রান্ত, না ক্লান্ত? আরও হতে পারে, আন তো, জানত ক্ষান্ত…। কবিতা কি আগে থেকে এরকম মিলের তালিকা করে রাখে? অবশ্য আর একরকম কবিতাও লেখা হয়, তাতে মিল থাকে না।
পরের লাইন আর কিছুতেই মাথায় আসছে না। জোজো বিড়বিড় করতে লাগল, আকাশের কোনও সীমানা থাকে না, সমুদ্র অতলান্ত, মানুষের তবু ভয়ডর নেই, মানুষের তবু ভয়ডর নেই, এমনই সে দুর্দান্ত!
জোজো নিজেই নিজের কাধ চাপড়ে দিল। অতলান্ত-এর সঙ্গে দুর্দান্ত, এই মিল ভাল হয়নি? দুর্দান্ত! এটা সন্তুকে শোনাতে হবে। সন্তু অবশ্য ভাববে, আমি অন্য কারও লেখা থেকে মুখস্থ বলছি। ও আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করতে চায় না।
হঠাৎ ডানদিকে চোখ পড়তেই জোজো চমকে উঠল। সেদিকে একটা বালির প, তার আড়াল থেকে একটা জুতো পরা মানুষের পা দেখা যাচ্ছে।
প্রথমে জোজো ভাবল, ওখানে কি কোনও মৃতদেহ পড়ে আছে?
তারপর ভাবল, অনেক লোক সমুদ্রের ধারে বালির ওপর চিৎপাত হয়ে রোদ পোহায়, সেরকমও কেউ হতে পারে। কিন্তু এদিকে তো কোনও লোককে আসতে দেখা যায়নি, আর গেস্ট হাউজেও অন্য কোনও অতিথি নেই।
আর একটা কথা ভেবে ভয়ে সন্তুর বুক কেঁপে উঠল। যদি কোনও শত্রুপক্ষের লোক হয়? ডিমেলোর দলের সেই লম্বা লোকটা বসেছিল, সন্তু কিংবা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে।
এখন যদি জোজোকে ধরে নিয়ে যেতে চায়, তা হলে তো কাকাবাবুরা টেরও পাবেন না। জোজো একা বাধা দেবে কী করে? এমন যে বিপদ হতে পারে, সে কথা কাকাবাবুর মনে পড়েনি।
ওরা তিনজন সাঁতার কাটছে, ওদের কাছে কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই। যখন ওপরে উঠে আসবে, তখন যদি কেউ গুলি করে? সাবধান করে দেওয়াও তো জোজোর পক্ষে সম্ভব নয়।
জোজো কি একদৌড়ে গেস্ট হাউজে চলে যাবে? কিন্তু ওই লোকটা যদি গুলি করতে চায়, জোজো দৌড়ে পালাতে পারবে না।
বালিয়াড়ির আড়াল থেকে শুধু একটা জুতো পরা পা-ই দেখা যাচ্ছে। যদি জোজোকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতলব থাকে, তা হলে এতক্ষণ অপেক্ষা করবে কেন?
এক-একসময় মানুষ হঠাৎ সাহসী হয়ে ওঠে। ওখানে কে লুকিয়ে আছে, তা জোজোকে দেখতেই হবে।
সে বালির ওপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। তারপর উঁকি মেরে আরও
অবাক হল।
একটা খুব গাঁট্টাগোট্টা চেহারার লোক, তার মুখ ভরতি দাড়ি, বসে আছে। সেখানে পা ছড়িয়ে। তার পাশে একটা রাইফেল। লোকটি ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে।
একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জোজোর ঠোঁটে হাসির ঝিলিক খেলে গেল। এইবার সে বুঝেছে। যারা গুন্ডা-বদমাশ, তারা কখনও কাজে এসে ঘুমোয় না। ঘুমোয় কারা? যারা পাহারা দেয়। পুলিশ ঘুমোয়, কারখানার দারোয়ান ঘুমোয়। কয়েকদিন আগেই তো কলকাতায় একটা ব্যাঙ্কের এক বন্দুকধারী গার্ড ঝিমোচ্ছিল, কয়েকটা বাচ্চা বাচ্চা ডাকাত তার বন্দুকটা কেড়ে নেয়।
এই লোকটাকে তা হলে পাহারা দেওয়ার জন্যই রাখা হয়েছে। জোজো ভাবল, এর রাইফেলটাও সরিয়ে রাখলে কেমন হয়!
লোকটির ঘুম একেবারে কুম্ভকর্ণের মতন। জোজো কাছে গিয়ে রাইফেলটা তুলে নিল, এমনকী একবার গলা খাঁকারি দিল, তবু সে জাগল না।
জোজো কখনও রাইফেল চালায়নি। সন্তু রিভলভার চালাতে ভালই পারে, কিন্তু সেও রাইফেল শেখেনি। হাতে এত বড় একটা অস্ত্র থাকলে নিজেকে খুব হিরো হিরো মনে হয়। জোজো এমনভাবে রাইফেলটাকে তাক করল, যেন তার সামনে রয়েছে একদল শত্ৰু, সে সবাইকে খতম করে দিচ্ছে। র্যাট-ট্যাট-ট্যাটট্যাট-ট্যাট…
সেফ্টি ক্যাচ সরে যেতেই দারুণ শব্দে একটা গুলি বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস, রাইফেলের নলটা ছিল আকাশের দিকে। ভালভাবে ধরতে জানে না বলে বাঁটের পেছন দিকটায় একটা ধাক্কা লাগল জোজোর বুকে।
এবার দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোকটির ঘুম ভাঙতে বাধ্য। সে জোজোর হাতে রাইফেল দেখে এমনই ঘাবড়ে গেল যে, কী একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়ল মাথার ওপর হাত তুলে।
হঠাৎ গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় জোজোও বেশ ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু লোকটির ভয় পাওয়া মুখ দেখে হাসিও পেল তার। এই নাকি পাহারাদার?
গুলির শব্দ সন্তুরাও শুনতে পেয়েছে। তিনজনই উঠে এল পাড়ে। নরেন্দ্র ভার্মা আগে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার জোজো? এ লোকটা কে?
জোজো বলল, আপনি ওকে পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে গিয়েছিলেন, আর ও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমি তো পাহারাদার রাখিনি।
জোজো বলল, তাই বলুন! আমারও প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল। ও নিশ্চয়ই কাকাবাবুকে মারতে এসেছে। তাই আমি ওর রাইফেলটা কেড়ে নিয়েছি। ওর গায়ের জোর বেশি হতে পারে, কিন্তু আমি এমন একটা ক্যারাটের প্যাচ মারলুম…
এর মধ্যে কাকাবাবু এসে গেলেন এক পায়ে লাফাতে লাফাতে। ক্রাচ দুটো তুলে নেওয়ার পর বললেন, একে তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুলিশ। পুলিশদের চেহারা দেখলেই চেনা যায়।
লোকটি এবার দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, পুলিশ, পুলিশ!
লোকটি ইংরিজি কিংবা হিন্দি জানে না। নরেন্দ্র ভার্মা ওর সঙ্গে তেলুগু ভাষায় কয়েকটা কথা বলার পর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ, রাজা। পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভন ওকে পাঠিয়েছেন আমাদের দেখাশুনো করার জন্য। এ যা দেখছি, একেই পাহারা দেওয়া দরকার।
কাকাবাবু বললেন, আহা বেচারা, ঘুমিয়ে পড়েছিল। নিশ্চয়ই রাত্তিরে ঘুম হয়নি। ওকে বকাঝকা কোরো না।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে জোজো, তুই সত্যিই ওর কাছ থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিয়েছিস?
জোজো বলল, ম্যাজিক, ম্যাজিক! আমি হুকুম করলুম, অমনি রাইফেলটা ওর হাত থেকে চলে এল আমার হাতে।
গেস্ট হাউজের দিকে ফিরে যেতে যেতে নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরা এতক্ষণ মজা করে সমুদ্রে সাঁতার কাটলাম, আর জোজো বেচারা একা একা তীরে বসে রইল। ওকে একটা কিছু প্রাইজ দেওয়া দরকার।
কাকাবাবু বললেন, জোজো, তুই এবার একটু কষ্ট করে সাঁতারটা শিখে নে।
জোজো বলল, এবারে পুজোর ছুটির সময় বাবার সঙ্গে ব্রাজিল যাচ্ছি, ওখানে ঠিক সাঁতার শিখে নেব।
সন্তু বলল, সাঁতার শেখার জন্য ব্রাজিল যেতে হবে? কেন, এ দেশে সাঁতার শেখা যায় না?
জোজো বলল, বাঃ, ব্রাজিলের জল খুব হালকা। সাঁতার শিখতে মাত্র দুদিন লাগে, তুই জানিস না?
সন্তু তবু বলল, জল আবার হালকা আর ভারী হয় নাকি?
জোজো বলল, বাঃ, হয় না? সব সমুদ্রের জল কি একরকম? এমন সমুদ্রও আছে যাতে মানুষ পড়ে গেলেও ড়ুববে না! ব্ল্যাক সি?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা ঠিকই বলেছে। জোজো অনেক কিছু জানে। শোনো জোজো, আজ খাওয়াদাওয়ার পর তোমাকে এমন একটা জিনিস দেখাব, যা তুমি সারা জীবনেও ভুলবে না।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, শুধু জোজোকে দেখাবেন?
নরেন্দ্র ভার্মা মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ।
খাওয়ার পর একটুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া হল। রাইফেলধারী পুলিশটিকে ছুটি দেওয়া হলেও সে ছুটি নিতে চায় না। বারবার কান মুলে বলতে লাগল, সে আর ঘুমোবে না।
তবু নরেন্দ্র ভার্মা তাকে বোঝালেন যে তার নামে নালিশ করা হবে না। এখন সত্যিই তাকে দরকার নেই।
নরেন্দ্র ভার্মাকে সমুদ্রের দিকেই এগোতে দেখে জোজো সন্দিগ্ধভাবে বলল, আপনি আমাকে কী যেন দেখাবেন বললেন, তা হলে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছেন কেন?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কেন, সমুদ্রে বুঝি কিছু দেখার নেই?
জোজো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমি জলে নামব না।
নরেন্দ্র ভার্মা তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, তোমাকে জলে নামতে হবে না। জলে পা না ভিজিয়েও তো সমুদ্রে ঘোরা যায়।
ওরা বেলাভূমিতে এসে দাড়াতেই দূর থেকে ভটভট শব্দ করতে করতে একটা মোটরবোট এসে গেল কাছে।
তাতে উঠতে উঠতে কাকাবাবু বললেন, আজ সমুদ্র বেশ শান্ত।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরা খুব লাকি। যা দেখতে যাচ্ছি, এইসব দিনেই তা দেখা যায় ভাল করে।
মোটরবোটে একজন চালক রয়েছে। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল, তার নাম ফ্রেড। তিরিশের কাছাকাছি বয়েস, জিনসের প্যান্টশার্ট পরা, থুতনিতে অল্প দাড়ি।
বোটটা চলতে লাগল বেশ জোরে। চারদিকেই সমুদ্র। জোজো মনে মনে ভাবল, সমুদ্র তো একই রকম, এতে বিশেষ কিছু দেখবার কী থাকতে পারে? কিছু সিন্ধুসারস বা সি-গাল পাখি ওড়াউড়ি করছে, আর শুধু ছোট ছোট ঢেউ। প্রায় আধঘণ্টা চলার পর দেখা গেল, সমুদ্রের বুকে কিছু গাছপালা।
কাকাবাবু বললেন, ওখানে বুঝি একটা দ্বীপ আছে?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, ওখানেই আমরা যাব।
ফ্রেডের কাছ থেকে একটা দূরবিন চেয়ে নিয়ে তিনি দ্বীপটা দেখতে লাগলেন। সেটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল, গাছপালাগুলো বড় হয়ে গেল। মনে হতে লাগল যেন সেই দ্বীপে একটা ভাঙাচোরা বাড়িও রয়েছে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এই দ্বীপটার নাম কী?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ম্যাপে এই দ্বীপের নাম নেই। খুবই ছোট, অনেকখানি আবার জোয়ারের সময় ড়ুবে যায়। যারা সমুদ্রে মাছ ধরে, তারা ছাড়া আর বিশেষ কেউ এই দ্বীপের কথা জানে না। সেই জেলেরা বলে রাবার দ্বীপ। রাবার আয়ল্যান্ড!
সন্তু বলল, রাবার? এরকম অদ্ভুত নাম কেন?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, লোকের মুখে মুখে নাম বদলে যায়। রবার্ট নামে এক সাহেব এই দ্বীপে একটা বাড়ি বানিয়েছিল অনেক কাল আগে। সেই রবার্ট সাহেবের দ্বীপ হিসেবে এর নাম ছিল রবার্টস আয়ল্যান্ড। তাই থেকে এখন রাবার দ্বীপ।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এরকম বদলায়। রবীন্দ্রনাথদের জমিদারি ছিল যে শিলাইদহে, সেই শিলাই আসলে শেলি নামে একজন সাহেবের নাম থেকে হয়েছে।
নরেন্দ্র ভার্মা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কবি শেলি? তিনি বেঙ্গলে এসেছিলেন নাকি?
কাকাবাবু বললেন, না, না, এ অন্য শেলি। বোধহয় নীলকর সাহেব। বোটটা কিন্তু দ্বীপটার তীর পর্যন্ত গেল না, একটু দূরে থেমে গেল।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এবার সবাই পা তুলে বসো। নীচের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো!
সন্তু দারুণ অবাক হয়ে বলল, আরেঃ!
এতক্ষণ বোঝা যায়নি, এখন দেখা গেল বোটের তলার দিকটা এক ধরনের স্বচ্ছ কাচের তৈরি। জলের নীচে অনেকখানি দেখা যায়।
সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য রঙিন মাছ। ছোট, বড়, নানা ধরনের।
কাকাবাবু বললেন, গ্লাস বটম বোট! এটা কি কোরাল রিফ?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, তলার পাথরগুলো দ্যাখো। কত রং, ওর মধ্যে কিছু কিছু পাথর কিন্তু জ্যান্ত!
সন্তু বলল, অপূর্ব দৃশ্য! ডিসকভারি চ্যানেলেই শুধু এরকম প্রবাল দ্বীপ দেখেছি। এত কাছ থেকে, নিজের চোখে দেখা।
সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখল কিছুক্ষণ।
এক সময় মুখ তুলে সন্তু জিজ্ঞেস করল, নরেনকাকা, তুমি তখন বললে, শুধু জোজোকেই অপূর্ব কিছু দেখাবে। এখন তো আমরা সবাই দেখছি।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তুমি আর রাজা নিজেরাই দেখতে পারো। ইচ্ছে করলে জলে নেমে গিয়ে একেবারে কাছ থেকে। জোজো তো তা পারবে না, ওকে দেখাতে হবে।
জোজো বলল, এই তো আমি নিজে নিজেই দেখছি।
যেন তার কথা শুনতেই পেলেন না, এইভাবে নরেন্দ্র ভার্মা সন্তুকে বললেন, তোমরা সাঁতার জানো, তোমরা স্কুবা ডাইভিং করতে পারো, সব জিনিসপত্র রেডি আছে। একেবারে নীচে গিয়ে হাত দিয়ে অনুভব না করলে এর সৌন্দর্য অনেকটা অনুভব করা যায় না।
কাকাবাবু এর মধ্যেই কোট খুলে ফেলেছেন। প্যান্টও খুলতে খুলতে বললেন, জলে তো নামব নিশ্চয়ই।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমরা আগে নামো। তারপর আমি আর জোজো নামব একসঙ্গে।
জোজো চেঁচিয়ে উঠে বলল, না, না, আমি জলে নামব না! আমি এখান থেকেই ভাল দেখতে পাচ্ছি।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, শোনো, ওরা করবে স্কুবা ডাইভিং, আর আমরা করব স্নারকেলিং। তাতে সাঁতার না জানলেও চলে। তোমার কোনও ভয় নেই, আমি তোমায় ধরে থাকব।
জোজো তবু চেঁচিয়ে বলল, না, না, আমার কোনও দরকার নেই!
নরেন্দ্র ভার্মা বোটের চালককে জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রেড, তোমার কাছে রকেলিং-এর জন্য চশমা আর মুখোশ-টুখোশ আছে তো?
ফ্রেড বলল, ইয়েস স্যার।
নরেন্দ্র ভার্মা জোজোকে বললেন, তুমি জামা-প্যান্ট খুলবে? না সবকিছু ভেজাবে? ভেতরে জাঙিয়া আছে নিশ্চয়ই।
জোজো বলল, বলছি তো আমি জলে নামব না। কেন বারবার বলছেন?
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোর বন্ধুকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দে তো!নইলে ওর জলের ভয় কাটবে না। স্নারকেলিং-এ তো ইচ্ছে করলেও ড়ুবতে পারবে না। রবারের টায়ার ওকে বাঁচিয়ে রাখবে!
জোজোর মুখের চেহারা একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।
সন্তু বলল, জামা খুলে ফেল জোজো। স্পিড বোটের পাটাতনের নীচে অনেক কিছু রাখা আছে। ফ্রেড সেখান থেকে বার করে আনল অনেক সরঞ্জাম।
নরেন্দ্র ভার্মা জোজোকে বুঝিয়ে দিলেন, এই দ্যাখো, এই রবারের বেলুনের মতন জামা তোমাকে পরিয়ে দেব, তুমি কিছুতেই ড়ুববে না। আর এই মুখোশের মতন জিনিসটা থেকে একটা নল বেরিয়ে থাকবে জলের ওপরে, তার থেকে হাওয়া আসবে। তুমি নিশ্বাস নিতে পারবে, আর এই যে বড় বড় গলসের মতন চশমা, এদিয়ে জলের মধ্যেও স্পষ্ট দেখা যায়।
ওইসব জিনিস জোজোকে পরাতে সাহায্য করল সন্তু। সে নিজে আগেই পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে নিয়েছে।
নরেন্দ্র ভার্মা জোজোর হাত ধরে বললেন, শোনো জোজোবাবু, এর পরেও যদি ভয় করে, আমার হাত ছাড়বে না। আমার লাইফ সেভিং সার্টিফিকেট আছে।
জোজোকে নিয়ে তিনি ঝাপ দিলেন সমুদ্রে।
কাকাবাবু আর সন্তু নেমে গেল অনেক নীচে। জোজো আর নরেন্দ্র ভার্মা ভাসতে লাগল, চোখ জলের মধ্যে। জল এখানে পাতলা নীল রঙের আর খুব পরিষ্কার, দেখা যাচ্ছে অসংখ্য রঙিন মাছ। ছোটগুলো ঝক ঝক, আর কয়েকটা বেশ বড়ও আছে।
কোরাল রিফ বা প্রবালের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আর চোখ ফেরানো যায় না। কী অপূর্ব তার গড়ন, কোথাও অনেকটা ছড়ানো ফুলের মতন, কোথাও যেন গাছ, কোথাও যেন ঝাড়লণ্ঠন, কোথাও পাথরের ছবি। কতরকম রং আর সেসব রঙই খুব স্নিগ্ধ। চোখ জুড়িয়ে যায়। যেন স্বর্গের কোনও দৃশ্য। জলের নীচে যে এমন একটা জগৎ আছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না।
এক-একবার নরেন্দ্র ভার্মা জোজোকে একটু টান মেরে খানিকটা ড়ুবিয়ে দিচ্ছেন জোর করে। জোজো ভয় পেয়ে আঁকুপাকু করে উঠতেই তিনি আবার ভেসে উঠে বললেন, ভয় পেয়ো না। তোমার নাকের সঙ্গে যে নলটা লাগানো আছে, সেটা বেশি ড়ুবে গেলে সেটা থেকে হাওয়া আসার বদলে জল ঢুকে যাবে। তাই আমি তোমাকে একটুখানি নীচে নিয়ে যাচ্ছি। ভয় পাওয়ার বদলে তুমি কোরালগুলোকে একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দ্যাখো।
বিস্ময়ের পর বিস্ময়! যে রঙিন জিনিসগুলো মনে হচ্ছিল পাথরের তৈরি, সেগুলোর গায়ে হাত ছোঁয়াতেই এক-একটা খানিকটা গুটিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ওরা জীবন্ত! কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। ওরা কামড়ায় না। এমনকী যে মাছগুলো গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে, তারাও মানুষকে গ্রাহ্যও করে না।
এক সময় নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এবার উঠতে হবে। তখন জোজোই বলল, না, না, এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না! আর একটু থাকব।
আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। সমুদ্রের সব কিছুই আকাশের ওপর নির্ভর করে। আকাশ মেঘলা হলে সমুদ্রের জলও ঘোলাটে হয়ে যায়। আকাশে ঝড় উঠলে সমুদ্রও উত্তাল হয়।
মেঘের জন্য বিকেল ফুরিয়ে গেল। এখন আর কিছু দেখা যাবে না। সন্তু আর কাকাবাবু ফিরে এলেন। ফ্রেড এতক্ষণ একলা বসে অনবরত চুরুট টেনে যাচ্ছিল, এবার সে বলল, উই শুড গো ব্যাক নাউ।
সে কয়েকখানা শুকনো তোয়ালে দিল সবার গা মোছার জন্য।
জোজো বলল, কাকাবাবু, তুমি ভাগ্যিস আমাকে বললে! আমার জলের ভয় কেটে গেছে। ওঃ, কী দৃশ্য দেখলুম, জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলব না!
সন্তু বলল, একেবারে নীচে গেলে, বুঝলি জোজো, মনে হবে যেন পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও এসেছি। এরকম রঙের গোলা আগে কখনও দেখিনি। আমি কোরাল রিফ ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চলে গিয়েছিলুম।
জোজো বলল, আমি কলকাতা ফিরেই সাঁতারের ক্লাসে ভরতি হব। ব্রাজিল যাওয়ার তো অনেক দেরি আছে।
নরেন্দ্র ভার্মা বোটচালককে বললেন, ফ্রেড, তুমি ফ্লাস্কে কফি আনোনি? একটু একটু শীত করছে, এখন একটু কফি পেলে মন্দ হত না।
ফ্রেড বলল, স্যার, আমার কাছে স্পিরিট ল্যাম্প, কফিটফি সবই আছে। তবে আমার মনে হয়, এখন আমাদের ফিরে যাওয়াই উচিত।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, একটু কফি খেয়ে নিই। এক্ষুনি ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
কাকাবাবু ভিজে পোশাক বদলে ফেলেছেন, কিন্তু এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। তার ভুরু দুটো কোঁচকানো, কী যেন চিন্তা করছেন।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, তোমার কী ব্যাপার, গম্ভীর হয়ে আছ? তোমার ভাল লাগেনি? তুমি বোধ হয় স্কুবা ডাইভিং আগেও করেছ?
কাকাবাবু বললেন, ভাল লাগবে না কেন? ফ্যানটাস্টিক! আগে এরকম দেখেছি আন্দামানে, তবে এখানে কোরাল রিফ যেন আরও বড়। খালি একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে, নরেন্দ্র কীসের সঙ্গে যেন আমার একবার ধাক্কা লাগল। খুব জোরে। জলের মধ্যে কোনও আঘাতই জোর হয় না। কিন্তু আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, সমুদ্রের তলায় সাঁতার কাটতে গেলে খুব সাবধানে থাকতে হয়। কত রকমের ড়ুবো পাথর থাকে, বোঝাই যায় না। তা ছাড়া হাঙর এসে পড়তে পারে। অবশ্য সাধারণত হাঙররা …
কাকাবাবু একটু রেগে গিয়ে বললেন, তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ নরেন্দ্র। তোমার থেকে বোধহয় অনেক বেশিবার আমি সমুদ্রের তলায় স্কুবা ডাইভিং করেছি একসময়। আমি সাবধানই ছিলাম। দ্বীপটিপের এত কাছে হাঙর আসে না। পাথরও ছিল না! কিছুই দেখতে পাইনি।
তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে কাকাবাবু বললেন, আই অ্যাম সরি নরেন্দ্র। হয়তো আমারই ভুল। তুমি এই জায়গাটায় আমাদের নিয়ে এলে, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
নরেন্দ্র ভার্মা মিটিমিটি হাসছেন। তিনি কাকাবাবুর এমনই বন্ধু যে বকুনি খেলেও রাগ করেন না। অবশ্য তিনিও অন্য সময় বকুনি দিতে ছাড়েন না।
কাকাবাবু বললেন, বেশ লাগছে। আমাকে আর একটু কফি দাও তো, আছে?
ফ্রেড কাকাবাবুর কাপে আর একটু কফি ঢেলে দিল। আকাশে মেঘ ঘোরাফেরা শুরু করেছে। বাতাসও ফিনফিনে।
কাকাবাবু বললেন, দ্বীপের মধ্যে ওই যে বাড়িটা, ওখানে একবার যাওয়া যায় না? নরেন্দ্র, তুমি কখনও ওই বাড়িটার মধ্যে গিয়ে দেখেছ?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এখান থেকে দ্বীপে ওঠার ব্যবস্থা নেই। খানিকটা ঘুরে যেতে হবে।
তিনি বোটচালককে জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রেড, চলো, আমরা আয়ল্যান্ডটা একবার ঘুরে যাই।
ফ্রেড বলল, দ্যাট ইজ ইমপসিবল স্যার!
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কেন ইমপসিবল? ওদিকে জেটি আছে।
ফ্রেড বলল, একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। তারপর ওখানে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, তা আপনি স্যার ভালই জানেন। আমাকে এখন ফিরতে হবেই।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ফ্রেড, তোমাকে যদি ফিরতেই হয়, তুমি আমাদের ওখানে নামিয়ে দাও। আমরা আজকের রাতটা অ্যাডভেঞ্চার করি। তুমি কাল সকালে এসে আমাদের ফেরত নিয়ে যেয়ো।
ফ্রেড কয়েক মুহূর্ত রাগ-রাগ চোখে তাকিয়ে রইল নরেন্দ্র ভার্মার দিকে।
তারপর তিক্ত গলায় বলল, স্যার আপনি যা বলছেন, তা আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ফ্রেড, এই বোটটা আমি ভাড়া নিয়েছি। আমি যা অর্ডার করেছি, তা মানতে তুমি বাধ্য।
ফ্রেড দুকাঁধ ঝাকাল।
তারপর সে চালু করে দিল ইঞ্জিন। একটু পরেই বোঝা গেল, সে নরেন্দ্র ভার্মার হুকুম একেবারে অগ্রাহ্য করেছে।
বোটটা ক্রমশ চলে যাচ্ছে দ্বীপ থেকে অনেক দূরে।