Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু আর বাঘের গল্প || Sunil Gangopadhyay » Page 5

কাকাবাবু আর বাঘের গল্প || Sunil Gangopadhyay

বাঘিনিটা সত্যিই বাঘিনি। তার একটা পা খোঁড়া। বয়সও হয়েছে যথেষ্ট। দৌড়ে জঙ্গলের প্রাণী ধরার ক্ষমতা আর নেই বলেই সে মানুষের বসতিতে হানা দিতে শুরু করেছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে জালে বেঁধে বনবিভাগের লোকেরা নিয়ে চলে গেল। কোনও চিড়িয়াখানায় চালান করে দেওয়া হবে।

কিন্তু মানুষের বাচ্চাটাকে রাখা হবে কোথায়?

ছেলেটা ওই বাঘিনির সঙ্গে থাকত কী করে?

ছেলেটার হাতের নখ, পায়ের নখ বড় বড়। বেশ ধারালো। মাথার চুল ধুলো-ময়লা মাখা। জামা-প্যান্ট কিছুই পরা নেই, শুধু একটা বাঘের ছাল জড়ানো ছিল গায়ে। কোনও কথা বোঝে না, কথা বলতেও পারে না, শুধু গ-র-র গ-র-র আওয়াজ করে। চোখের দৃষ্টিও হিংস্র বুনো জন্তুর মতো।

কিন্তু জন্তু তো নয়, দশ-এগারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে।

কাকাবাবু বললেন, বাঘ-সিংহদের একটা গুণের কথা শোনা গিয়েছে। তারা বাচ্চা-ছেলেমেয়েদের কখনও মারে না। সম্ভবত খুব ছোট বয়সে এই ছেলেটা জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল, এই বাঘিনিটা ওকে নিজের সন্তানের মতন লালন-পালন করে। আগেও এরকম দু-একটা ঘটনার কথা কাগজে পড়েছি। তখন ঠিক বিশ্বাস করিনি। এখন দেখছি, এরকম সত্যিই হতে পারে।

কর্নেল বললেন, পৃথিবীতে কিছু কিছু এরকম ব্যাপার এখনও আছে, যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। কত মানুষ কুকুর-বিড়াল পোষে, বাঘ-ভাল্লুকও পোর চেষ্টা করে। এখন দেখছি, বাঘও পুষেছে একটা মানুষের বাচ্চাকে।

ছেলেটা এখন গেস্টহাউসে কাকাবাবুর ঘরে ঘুমোচ্ছে।

বনবিভাগের লোকেরা বলে দিয়েছে, তারা ওর দায়িত্ব নিতে পারবে না। সেটা ওদের কাজ নয়।

পুলিশ বলেছে, ছেলেটা তো ক্রিমিনাল নয়। ওকে জেলে ভরে রাখা যাবে। যতদিন না ওর বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়, ততদিন ওকে কোনও অনাথআশ্রমে রাখা যেতে পারে।

মাণ্ডুতে কোনও অনাথ আশ্রম নেই। ওকে পাঠাতে হবে উজ্জয়িনী কিংবা ভোপালে। তার জন্যও সময় লাগবে, আগে খোঁজখবর নিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, যতদিন না কিছু ব্যবস্থা হয়, ও আমাদের কাছেই থাক।

অনাথআশ্রমে পাঠানোর ব্যাপারেও কাকাবাবুর খুব আপত্তি আছে। সেখানে পাঠালে ওকে বাঁচানো শক্ত হবে। ও কারও কথা বুঝবে না, নিজেও কিছু বোঝাতে পারবে না। ওর স্বভাবটাও হিংস্র। কেউ ওকে বিরক্ত করলে ও আঁচড়ে-কামড়ে দেবে, তখন অন্যরা ওকে মারবে, মারতে মারতে মেরেও ফেলতে পারে।

ছেলেটা সন্তুকে আঁচড়েও দিয়েছে, কামড়েও দিয়েছে। অতটুকু ছেলে, কিন্তু ওর গায়ে বেশ জোর। কিন্তু সন্তুর সঙ্গে পারবে কেন! একটুক্ষণের মধ্যেই সন্তু ওকে মাটিতে চিত করে ফেলে হাত দুটো চেপে ধরেছিল। তখনও গর্জন করছিল রাগে। তারপর কিছুক্ষণের জন্য ওকে বেঁধে রাখা হয়।

এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই খুলে দেওয়া হয়েছে বাঁধন।

ছেলেটা বোধহয় ভেবেছিল, গুলি করে বাঘিনিটাকে মেরেই ফেলা হয়েছে। ও তো জানে, বাঘিনিটাই ওর মা। তাই রাগে-দুঃখে আক্রমণ করেছিল সন্তুকে। সন্তুই সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল বলে।

ছেলেটা ঘরের মধ্যে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাইরের বারান্দায় বসে আছেন। কাকাবাবু, সন্তু আর জোজো। অন্যরা একটু আগে ফিরে গিয়েছেন। এখন সকাল সাড়ে দশটা।

আজ আর বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই। আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল। কলকাতায় এরকম নীল আকাশ বড় একটা দেখা যায় না।

জোজো বলল, দশ-এগারো বছরের ছেলে, কিন্তু কথা বলতে পারে না কেন? ও কি বোবা?

কাকাবাবু বললেন, না, না, বোবা নয়, মুখ দিয়ে তো নানারকম আওয়াজ করছে। মানুষের বাচ্চারা তো বাবা-মায়ের কিংবা অন্যদের কথা শুনে শুনে ভাষা শেখে। ও যদি দু-তিন বছর বয়সে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে যেটুকু ভাষা শিখেছিল, তাও ভুলে গিয়েছে এতদিনে।

সন্তু বলল, বাঘেদের নিশ্চয়ই নিজস্ব ভাষা আছে। ও বোধহয় বাঘের ভাষা শিখে নিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, তা হতেই পারে। তোরা বোধহয় টারজানের সিনেমা দেখিসনি। আমাদের ছেলেবেলায় টারজানের সিনেমা খুব জনপ্রিয় ছিল। টারজানও জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে মানুষ হয়েছিল, সে ওদের ভাষাও জানত। টারজান মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করলে অমনই দৌড়ে চলে আসত হাতির পাল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, টারজানের সিনেমা এখন পাওয়া যায় না?

কাকাবাবু বললেন, খোজ করে দেখতে হবে। ডিভিডি পাওয়া যেতে পারে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আপনি যে বললেন, এই ছেলেটাই বিস্কুট চুরি করত, কিন্তু ও বিস্কুট খেতে শিখল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, কী করে শিখল, তা তো ঠিক বলতে পারব না। তবে, মনে হয়, জঙ্গলে তো অনেকে পিকনিক করতে যায়। সেরকমই কোনও দল খাবারদাবার নিয়ে বসেছিল, হঠাৎ বাঘের ডাক শুনে সব ফেলেটেলে ভয়ে পালিয়ে যায়। তারপর এই বাঘিনি আর ছেলেটা সেখানে এসে পড়ে। বাঘ কখনও নিরামিষ খাবার খায় না। কিন্তু মানুষের পেটে তো নিরামিষও সহ্য হয়। তাই ছেলেটা অন্যদের ফেলে যাওয়া বিস্কুট টিস্কুট হয়তো চেখে দেখেছিল। তারপর ভাল লেগে যায়। এটা আমি মনে মনে কল্পনা করছি।

জোজো বলল, আজ আমরা ওকে বিস্কুট খেতে দিয়ে দেখব, খায় কি না।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওর নাম কী হবে? ওর আগে কোনও নাম ছিল কি না কে জানে! ও নিজে বলতেও পারবে না। ওর একটা নতুন নাম দেওয়া দরকার।

কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক। তোরা একটা নাম ঠিক কর।

জোজো বলল, হারিয়ে যাওয়া ছেলে, ওর নাম হোক হারান।

সন্তু বলল, এটা বড় পুরনো ধরনের। আর খুব বাঙালি-বাঙালি। ও তো বাঙালি ছেলে নয়।

জোজো বলল, তা হলে নাম হোক বাজবাহাদুর। এখানে এসে বাজবাহাদুর আর রূপমতীর গল্প খুব শুনছি।

সন্তু বলল, ও নামও এখন চলে না।

কাকাবাবু বললেন, আমার এক বন্ধু ছিলেন শার্দুল সিংহ। খুব ভাল বক্সিং জানতেন। এখানে কারও কারও এ নাম হয়, শার্দূল।

জোজো জিজ্ঞেস করল, শার্দুল মানে কী?

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই জানিস?

সন্তু মাথা নেড়ে বলল, জানি। শার্দুল মানে বাঘ।

জোজো বলল, ওরে বাবা, ও নাম চলবে না। ও যখন স্কুলে ভরতি হবে, তখন ওই নাম শুনলেই অন্য ছেলেরা ওকে খেপাবে।

সন্তু বলল, তুই ভাবলি, ও স্কুলে যাবে?

কাকাবাবু বললেন, যাবে না কেন, যেতেই পারে। প্রথম কয়েকটা মাস ওকে খানিকটা আদর-যত্ন করে রাখতে হবে, স্নেহ-মমতা দিয়ে বোঝাতে হবে যে, মানুষ ওর শত্রু নয়। মানুষ ওর আপনজন। সেটা বুঝে ওর স্বভাবটা একটু নরম হলে, ও মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবে, তখন লেখাপড়াও শিখবে!

সন্তু বলল, তা হলে ওর নাম হোক আরণ্যক। এই নামে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী চমৎকার একটা বই পড়েছি।

কাকাবাবু বললেন, আরও ছোট করে শুধু অরণ্যও হতে পারে। আর পদবি হতে পারে চৌধুরী। বাঙালি, অবাঙালি অনেকেরই চৌধুরী পদবি হয়।

জোজো বলল, অরণ্য যদি ভালনাম হয়, তা হলে ডাকনাম হোক বুনো।

নাম ঠিক হয়ে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ছেলেটি। তার দুচোখে দারুণ অবাক অবাক ভাব।

বাঘের চামড়ার বদলে সন্তুর একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে। দুটোই ওর গায়ে ঢলঢল করছে।

জোজো বলল, অ্যাই শোনো, এখন থেকে তোমার নাম হয়েছে অরণ্য চৌধুরী। আমরা বুনো বলে ডাকব।

কাকাবাবু বললেন, বুনো নামটাও খারাপ নয়। একজন পণ্ডিতের নাম ছিল বুনো রামনাথ।

ছেলেটা এসব কিছুই বুঝল না। সে যেন খুবই বিরক্ত হল।

মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ করে সে দৌড়ে এল বারান্দার কাছে। রেলিংটা ধরে একটা ডিগবাজি খেয়ে লাফিয়ে পড়ল নীচে তারপর দৌড়োল গেটের দিকে।

কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, সন্তু, ধর, ধর ওকে!

সেকথা শোনার আগেই সন্তু নীচে নামতে শুরু করেছে।

বয়সের তুলনায় ছেলেটা খুব জোরে ছোটে। কিন্তু সন্তুর সঙ্গে পারবে কেন! ফোর ফর্টি মিটার রেসে সন্তু ফার্স্ট হয়।

গেটের কাছে পৌঁছোনোর আগেই ছেলেটাকে ধরে ফেলল সন্তু।

ছেলেটা সন্তুকে আঁচড়ে-কামড়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল। সন্তু তার কাঁধটা শক্ত করে ধরে বলল, অ্যাই, কামড়াবি না, তা হলে আমিও মারব কিন্তু!

বারান্দার রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু বললেন, না সন্তু, মারিস না।

ছেলেটা একবার সন্তুকে বেশ জোরে কামড়ে দিতেই সন্তু তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। সে আবার ছুটল পাইপাই করে।

তখনই গেট দিয়ে ঢুকছে মান্টো সিংহ। সন্তু চেঁচিয়ে বলল, মান্টো সিংহ, পাকড়ো উসকো।

মান্টো সিংহ দুহাতে ছেলেটাকে ধরে উঁচু করে তুলে ফেলল। ছেলেটা হাত-পা ছুড়ছে আর ঠিক বাঘের মতোই গ-র-র গ-র-র আওয়াজ করছে। মান্টো সিংহ তাকে নিয়ে বারান্দায় উঠে এসে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে চেপে ধরে রইল।

কাকাবাবু বললেন, এবার ওকে ছেড়ে দাও।

মান্টো সিংহ বলল, ইয়ে ভাগ যায়গা।

জোজো দৌড়ে গিয়ে ডাইনিংরুম থেকে এক প্যাকেট মিষ্টি বিস্কুট নিয়ে এসে ছেলেটার সামনে বাড়িয়ে দিল।

ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে বিস্কুটের প্যাকেটটা প্রায় কেড়ে নিয়ে কচমচ করে খেতে লাগল। একটার পর-একটা।

কাকাবাবু বললেন, ওর খিদে পেয়েছিল। মান্টো সিংহ, এক গেলাস দুধ নিয়ে এসো তো!

সন্তু বলল, ও দুপুরে কী খাবে? আমাদের মতো ভাত-রুটি খেতে পারবে?

কাকাবাবু বললেন, আজকেই বোধহয় পারবে না। আস্তে আস্তে অভ্যেস করাতে হবে।

জোজো বলল, ওকে কি কাঁচা মাংস দিতে হবে? ও তো রান্না করা মাছমাংস খায়নি কখনও।

কাকাবাবু বললেন, খুব খিদে পেলে আমরা যা দেব, তাই-ই খাবে।

সন্তু নিজের বুকে একটা আঙুল ঠেকিয়ে বলল, আমি মানুষ।

তারপর ছেলেটির দিকে আঙুল তুলে বলল, তুমি মানুষ! আমরা সবাই মানুষ। তুমি বাঘ নও।

বিস্কুট খেতে খেতে ছেলেটি সন্তুর দিকে তাকিয়ে রইল।

জোজো বলল, বল তো, আমি! আমি! আমি! ছেলেটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কোনও শব্দ উচ্চারণ করল না।

জোজো আবার বলল, মানুষ! মানুষ! মানুষ!

মান্টো সিংহ একটা কাচের গেলাস ভরতি দুধ এনে বলল, লে বাচ্চা, পি লে!

ছেলেটা ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল গেলাসটার দিকে। তারপর এক ঝটকায় সেটা ফেলে দিল মান্টো সিংহের হাত থেকে।

গেলাসটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে তো ভাঙলই, খানিকটা দুধ ছিটকে গিয়ে পড়ল কাকাবাবুর প্যান্টে।

মান্টো সিংহ রেগে গিয়ে হাত তুলে বলল, মারে গা এক ঝাঁপড়!

কাকাবাবু বললেন, না, মারবে না। ওকে আস্তে আস্তে শেখাতে হবে।

সন্তু বলল, ও দুধের প্যাকেটও চুরি করত। তা হলে দুধ খেতে চাইছে কেন?

কাকাবাবু বললেন, ও খেয়েছে গুঁড়ো দুধ চেটে চেটে। গেলাস ভরে দুধ তো কখনও দেখেনি। মান্টো সিংহ তোমার কাছে গুঁড়ো দুধ আছে?

মান্টো সিংহ বলল, না, নেই।

কাকাবাবু বললেন, এক প্যাকেট বিস্কুট তো প্রায় শেষ করে ফেলেছে। আপাতত ওকে আর-এক প্যাকেট বিস্কুট দাও।

মান্টো সিংহ বলল, সাহাব, একে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসুন। নইলে একে সামলানো যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, না, না, এখন ওকে জঙ্গলে ছেড়ে দিলে ও আর বাঁচবে। এতদিন বাঘিনিটার সঙ্গে ছিল, বাঘিনিটার ভয়ে অন্য কোনও জানোয়ার ওর ক্ষতি করতে পারেনি। এখন ও তো একটা বাচ্চা ছেলে, একা একা খাবার জোগাড় করবে কী করে?

সন্তু বলল, আমরা ওকে ঠিক সামলাতে পারব। কাকাবাবু, আমরা ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে পারি না? আমাদের বাড়িতে থাকবে।

কাকাবাবু বললেন, আগে দেখতে হবে, ওর মা-বাবার কোনও খোঁজ পাওয়া যায় কি না। ওর মা-বাবা কিংবা কোনও আত্মীয়-স্বজন থাকলে তাঁদের

অনুমতি ছাড়া তো আমরা ওকে আমাদের কাছে রাখতে পারব না?

জোজো বলল, একজন বুড়ি মহিলা বলেছিলেন যে বড় বাঘটার সঙ্গে একটা বাচ্চা-বাঘ আছে, কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি।

সন্তু বলল, ওর গায়ে একটা বাঘের চামড়া জড়ানো ছিল, সেটা কি ও নিজেই বুদ্ধি করে জড়িয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, ও যদি বাঘের ভাষা শিখে গিয়ে থাকে, তা হলে বাঘিনিটাই বোধ হয় ওকে এই বুদ্ধি দিয়েছিল।

জোজো বলল, ওর কথা বুঝতে হলে, আমাদেরও কি বাঘের ভাষা শিখতে হবে?

সন্তু বলল, জোজো, তুই সেটা সহজেই পারবি। কয়েকটা দিন চিড়িয়াখানায় গিয়ে একটা বাঘের খাঁচার পাশে বসে থাক।

জোজো বলল, আমি হালুম ডাকটার মানে জানি! জানি, কিন্তু এখন বলব না।

সন্তু বলল, বাঘের ভাষা শেখার আগে আপাতত ওর হাত আর পায়ের নখ কেটে দেওয়া দরকার। আঁচড়ে আমার রক্ত বের করে দিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক, এখানে ক্ষৌরকার পাওয়া যাবে মান্টো সিংহ?

মান্টো সিংহ বলল, বাজারের কাছে একটা সেলুন আছে। সেখানে খোঁজ করতে হবে। এখানে ক্ষৌরকার নেই।

জোজো বলল, ওকে সেলুনে নিয়ে গিয়ে ওর চুলে একটা কলকাত্তাই ছাঁট দিলেও তো হয়।

সন্তু বলল, সেলুনের লোকদের যদি ও আগেই আঁচড়ে-কামড়ে দেয়? আমি নেলকাটার দিয়ে ওর নখ কেটে দিতে পারি। দেখি চেষ্টা করে।

একটা নেলকাটার নিয়ে এসে সন্তু প্রথমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে কুটুস কুটুস করে নিজের এক হাতের নখ কাটল। তারপর ওর দিকে সেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দ্যাখো, মানুষের হাত এরকম হয়। মানুষের অত বড় নখের দরকার হয় না। এবার তোমার হাতটা সুন্দর করে দিই?

ছেলেটা সন্তুর নখ কাটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল, সন্তু ওর একটা হাত ধরতে যেতেই ও এক ধাক্কা দিয়ে সন্তুকে সরিয়ে দিল। চেয়ার ছেড়ে আবার দৌড় লাগাল রেলিং-এর দিকে।

কিন্তু এবারে কাকাবাবুই ওকে ধরে ফেললেন হাত বাড়িয়ে।

ছেলেটা কাকাবাবুর ঘাড় কামড়ে ধরল বেশ জোরে।

সন্তু এসে ওর চুল ধরে টেনে সরিয়ে আনল। কাকাবাবুর কাঁধে দাঁতের দাগ বসে গিয়েছে, একটু একটু রক্ত বেরোচ্ছে।

জোজো বলল, এবার ওকে বেশ করে মারা দরকার। ওকে বোঝাতে হবে যে, কামড়ালে ফামড়ালে শাস্তি পেতে হবে ওকে।

কাকাবাবু বললেন, না, মারলে ও বুঝবে না। ভাল ব্যবহার দিয়ে ওর মন জয় করতে হবে।

ঘাড়ে রুমাল চেপে ধরে কাকাবাবু ছেলেটির দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, ওহে অরণ্যকুমার চৌধুরী, তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ। মানুষ মানুষকে কামড়ায় না, বুঝলে?

এই সময় দেখা গেল, গেটের সামনে আট-দশজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। মান্টো সিংহ কথা বলছে তাদের সঙ্গে।

কাকাবাবু বললেন, এই রে, মনে হচ্ছে খবর রটে গিয়েছে। লোকজন দেখতে আসছে ওকে। এখনই লোকজনের সামনে ওকে বের করা ঠিক হবে না। সন্তু, তুই ওকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যা তো। দরজা বন্ধ করে রাখবি।

সন্তু আর জোজো ছেলেটিকে টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরের মধ্যে।

এর মধ্যেই খবর ছড়িয়েছে যে, জঙ্গল থেকে আনা হয়েছে একটি ছেলেকে, তার শরীরটা বাঘের মতো আর মাথাটা মানুষের মতো। অর্থাৎ অদ্ভুত একটা জন্তু। সুতরাং তাকে দেখার জন্য তো কৌতূহল হবেই।

লোকগুলো উঠে এল বারান্দায়।

কাকাবাবু প্রথমে ভালভাবে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, তারা ভুল শুনেছে। অদ্ভুত কোনও প্রাণী নয়। সে একেবারেই স্বাভাবিক মানুষের সন্তান। তাকে দেখার কিছু নেই।

লোকরা তা মানতে চায় না। তারা অন্তত একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। সবাই মিলে সেই দাবি জানাতে লাগল।

এবারে কাকাবাবু কঠোরভাবে বললেন, সে এখন ঘুমোচ্ছে। তাকে

কিছুতেই বিরক্ত করা চলবে না। দেখতে চাইলে বিকেলবেলা আসুন।

মান্টো সিংহকে তিনি বললেন, বাইরের গেট বন্ধ করে দাও!

আরও অনেক লোক এসে ফিরে গেল।

দুপুরবেলা কাকাবাবু ছেলেটিকে খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেদের ঘরেই খাবার আনালেন।

কাচের প্লেট ভেঙে ফেলতে পারে, তাই একটা স্টিলের থালায় ওর জন্য সাজিয়ে দেওয়া হল ভাত আর রুটি। খানিকটা তেঁড়স আর বেগুনের তরকারি। মুরগির ঝোলের ঝোলটা বাদ দিয়ে কয়েকটা টুকরো রাখা হল একপাশে।

প্লেটটার দিকে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে ছেলেটি এক টুকরো মুরগি তুলে নিয়ে মুখে দিল।

তারপরই মুখোনাকে বিচ্ছিরি করে সেটা ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে।

জোজো বলল, এই বুনো, এভাবে খাবার ফেলতে নেই। ঘর নোংরা করলে তোকেই পরিষ্কার করতে হবে কিন্তু!

কাকাবাবু বললেন, ওর বোধহয় ঝাল লেগেছে। একটুও ঝাল খাওয়া তো ওর অভ্যেস নেই।

তিনি একটা মুরগির ঠ্যাং নিজের জলের গেলাসে ড়ুবিয়ে ঝোল-মশলা ভাল করে ধুয়ে ফেললেন। তারপর সেটা ছেলেটির থালায় দিয়ে বললেন, এবার এটা খেয়ে দ্যাখো।

সে সেটা নিয়ে দু-তিন কামড় দিল, তবু ঠিক পছন্দ হল না। ফেলে দিল।

সন্তু বলল, সেদ্ধ করা খাবার ওর ভাল লাগছে না। কাঁচা মাংস দিলেই হত।

কাকাবাবু বললেন, না, ওকে এই খাবারই অভ্যেস করতে হবে। আয়, আমরা আমাদের মতো খাই, দেখি ও কী করে?

তিনজনে নিজেদের খাবার খেতে লাগলেন, ও তাকিয়ে দেখল। একটা রুটি নিয়ে দুহাত দিয়ে ছিড়ল, কিন্তু মুখে দিল না। ভাতও আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করল শুধু।

শেষ পর্যন্ত কাকাবাবুদের খাওয়া হয়ে গেল, ছেলেটা খেল না কিছুই।

সন্তু বলল, তা হলে কি ওকে শুধু বিস্কুট খাইয়ে রাখতে হবে?

কাকাবাবু বললেন, এখন আর কিছু দেওয়ার দরকার নেই। দেখা যাক, খিদে পেলে শেষ পর্যন্ত কী করে?

ঘণ্টাখানেক পরে ছেলেটি আবার পালাবার চেষ্টা করল। এবার আর তাকে ধরা গেল না।

কাকাবাবু বসে ছিলেন বারান্দায়। সন্তু বাথরুমে, জোজো পাহারা দিচ্ছিল বুনোকে। সে চেয়ারে বসে চোখ বুজে ঢুলছিল। হঠাৎ একসময় সে চোখ মেলে দেখল, জোজো একা রয়েছে ঘরে।

সে এত জোরে ধাক্কা দিল জোজোকে যে, জোজো চেয়ারসুদ্ধ উলটে পড়ে গেল মাটিতে। দৌড়ে বাইরে এসে, কাকাবাবু বই থেকে চোখ তুলে কিছু বোঝার আগেই সে বারান্দার রেলিং টপকে লাফিয়ে নেমে গেল নীচে।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু তিনি তো ছুটতে পারবেন না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই তাঁর অনেক সময় লেগে যায়। তিনি ডাকতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু, শিগগির আয়।

সন্তুর বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে যতটা সময় লাগল, ততক্ষণে বুনো পৌঁছে গিয়েছে গেটের কাছে। সন্তু তাড়া করে গিয়ে গেটের বাইরে আর তাকে দেখতে পেল না।

সামনের রাস্তাটা আঁকাবাঁকা। ও কোন দিকে যেতে পারে! জঙ্গলের দিকেই যাবে নিশ্চয়ই।

গেস্টহাউসের কর্মচারীদের কয়েকটা সাইকেল সেখানে দাঁড় করানো আছে। এরা তালাটালা দেয় না। সন্তু ঝট করে একটা সাইকেলে চেপে চালাতে লাগল বাঁইবাঁই করে।

ছেলেটাকে কোথাও দেখা গেল না।

খানিকটা গিয়ে সন্তু থেমে গেল। যত জোরেই ছুটুক, ছেলেটা তো এর মধ্যে এত দূর আসতে পারবে না। তা হলে কি উলটো দিকে গিয়েছে?

অথবা ছেলেটা যদি খাদে নেমে যায়?

রাস্তার একটা পাশে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে অনেকখানি। সেখানে ছোট ছোট ঝোপঝাড়। দু-একটা বাড়িও আছে। অনেক নীচে একটা সরু নদী, তার ওপাশে অন্য পাহাড়টায় ঘন জঙ্গল। ছেলেটার পক্ষে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে খাদের মধ্য দিয়ে জঙ্গলে যাওয়াই সহজ।

কিন্তু সন্তু তো সাইকেল নিয়ে খাদে নামতে পারবে না।

সন্তু দেখল, জোজোও আর-একটা সাইকেল নিয়ে আসছে।

সে কাছে আসার পর সন্তু বলল, এই দেখ, এই খাদ দিয়ে যদি বুনো নেমে গিয়ে ওধারের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, তা হলে তো পুরো জঙ্গলটা আবার খুঁজে দেখতে হবে।

জোজো বলল, আমরা দুজনে গিয়ে খুঁজলে কি পাব?

সন্তু বলল, কোথাও লুকিয়ে বসে থাকলে পাওয়া মুশকিল।

জোজো হতাশভাবে বলল, আর ওকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। লস্ট কেস। ও তো কিছুতেই আমাদের কাছে থাকতে চাইছে না।

সন্তু জোর দিয়ে বলল, ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। ওইটুকু ছেলে জঙ্গলে একা একা বাঁচবে কী করে? আরও লোকজন ডেকে, গাড়ি নিয়ে আবার ওই জঙ্গলে যেতে হবে।

জোজো বলল, চল, কাকাবাবুকে গিয়ে বলি। এই সময় শোনা গেল একটা কুকুরের ডাক।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে সন্তু দেখতে পেল, খাদের খানিকটা নীচে একটা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে একটা কুকুর ডাকছে। আর ল্যাজ নাড়াচ্ছে।

জোজো বলল, কুকুরটা কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। ঝোপের মধ্যে কী যেন আছে।

সন্তু বলল, কী আছে, আমাদেরও দেখতে হবে।

সাইকেলটা রেখে সে সরসরিয়ে নেমে গেল।

কুকুরটা ঝোপের চারপাশে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে, আর জোরে জোরে ডেকেই চলেছে। বেশ বড় কুকুর।

জোজো বড় সাইজের কুকুর দেখলে একটু ভয় পায়। সন্তুর ভয়ডর নেই। তার নিজেরই একসময় রকুকু নামে পোষা কুকুর ছিল।

সে কুকুরটার পাশে গিয়ে মুখ দিয়ে আঃ আঃ শব্দ করতে করতে ঝোপটার মধ্যে তাকাল।

সেখানে উবু হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে বুনো। তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ।

সন্তু কুকুরটাকে সামলে, হাত বাড়িয়ে বলল, আয় বুনো, বেরিয়ে আয়।

ছেলেটা তবু বেরোল না।

সন্তু আরও কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আয়, ভয় নেই। ভয় নেই।

ছেলেটা এবার বেরিয়ে আসতেই কুকুরটা আরও জোরে ডাকতে লাগল। ছেলেটা জড়িয়ে ধরল সন্তুকে।

সন্তু বলল, তুই কুকুর দেখে ভয় পাচ্ছিস! এরপর যদি একটা ভাল্লুক এসে পড়ে, তখন তুই কী করবি? তোর বাঘিনি-মা তো তোকে আর বাঁচাতে পারবে না!

ছেলেটাকে ধরে ধরে সন্তু নিয়ে এল উপরের রাস্তায়। কুকুরটা খানিকটা পিছন পিছন এসে এক জায়গায় থেমে গেল। সম্ভবত নীচের কোনও বাড়ির পোষা কুকুর।

জোজো বলল, এবার মনে হচ্ছে ছেলেটাকে বেঁধে রাখতেই হবে। কী রে, আর আমাদের কতবার দৌড় করাবি?

সন্তু বলল, সাইকেলে চাপবি? কোনওদিন চাপিসনি তো। দ্যাখ, কেমন লাগে।

সন্তু তাকে সামনের রডে বসিয়ে দিল। ছেলেটা বিশেষ আপত্তি করল না।

এর মধ্যে কাকাবাবু বারান্দা থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন গেটের কাছে। ওদের দেখে বললেন, পাওয়া গিয়েছে? যাক, খুব চিন্তা হয়েছিল।

জোজো বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, বাঘ-সিংহরা কি হাসতে পারে? কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন? আমি ঠিক জানি না। যত দূর শুনেছি, মানুষই শুধু হাসতে পারে, কাঁদতেও পারে। জন্তু-জানোয়াররা ওসব জানে না। হায়েনার হাসির কথা আবার শোনা যায়। ওটাও হাসি নয়, ওরকমই হায়েনার ডাক।

জোজো বলল, এ ছেলেটা বাঘের সঙ্গে মিশে মিশে হাসতে শোনেনি। সব সময় মুখটা গোমড়া করে থাকে। কিন্তু মানুষের বাচ্চা হিসেবে ওর তো হাসতে পারা উচিত। একবার পরীক্ষা করে দেখব?

কাকাবাবু বললেন, তুমি ওকে হাসাবে? কিন্তু ও তো তোমার গল্প বুঝবে না।

জোজো বলল, সন্তু, ওকে জোর করে চেপে ধর তো।

সন্তু সাইকেল থেকে ছেলেটাকে নামাতেই জোজো ওর বগলে কাতুকুতু দিয়ে দিল।

ছেলেটা প্রথমে ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল।

জোজো আরও কাতুকুতু দিতেই ও হি-হি-হি-হি করে হেসে উঠল। ঠিক একটা দশ বছরের সরল ছেলের মতো। মুখে আর হিংস্র ভাবও নেই।

সেই হাসি দেখে সন্তু আর কাকাবাবুও হাসতে লাগলেন।

সন্তু বলল, বাঘকে কাতুকুতু দিলে হাসে কি না সেটা কি কেউ পরীক্ষা করে দেখেছে?

কাকাবাবু বললেন, আমার এক বন্ধু বলেছিল, গন্ডারকে কাতুকুতু দিলে কী হয়?

গন্ডারের চামড়া তো খুব মোটা। তাই আজ কাতুকুতু দিলে সাতদিন পরে হেসে উঠবে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress