বেঁচে আছি না মরে গেছি
ঘুম ভাঙার পর সন্তুর প্রথমেই মনে হল, বেঁচে আছি না মরে গেছি?
চারদিকে মিশমিশে অন্ধকার। দিন না। রাত্রি তা বোঝার উপায় নেই। কোথায় সে শুয়ে আছে?
পাশ ফিরতে গিয়েই সন্তু টের পেল তার হাত আর পা বাঁধা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
আস্তে-আস্তে তার আগেকার কথা মনে পড়ল। রিভলভারটা? যাঃ, রাজকুমারের কাছ থেকে ওটা কেড়ে নিয়ে কোনও লাভই হল না। যারা তার হাত-পা বেঁধেছে, তারা নিশ্চয়ই সেটা নিয়ে গেছে! এ-ঘরে যে একটা ব্যাটারির আলো ছিল, সেটাও নেই।
কাকাবাবু কোথায়?
সন্তু অতি কষ্টে উঠে বসল। হাতদুটো পিঠের দিকে মুড়ে বেঁধেছে, তাই টনটিন করছে কাঁধের কাছে। কাকাবাবু কোথায়?
সন্তু কাকাবাবুর নাম ধরে ডাকতে গেল, কিন্তু কোনও শব্দ শোনা গেল না। তার মুখও বাঁধা।
কাকাবাবুও কি কাছাকাছি কোথাও এরকম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছেন? এখনও ঘুম ভাঙেনি? সন্তু কান খাড়া করল, কোনও নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় কি না! কোনও শব্দ নেই। সন্তুর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। কাকাবাবু আর সে আলাদা হয়ে গেছে? কাকাবাবুকি নিজেই কোথাও চলে গেছেন? না, তা অসম্ভব!
কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছে, তাও বুঝতে পারছে না। সে। কিন্তু বেশ খিদে পেয়েছে। মাঝখানে কি গোটা একটা দিন কেটে গিয়ে আবার রাত এসে গেছে?
কিছুই করবার নেই, চুপ করে বসে থাকা ছাড়া।
প্রত্যেকটা মুহূৰ্তকে মনে হচ্ছে বিরাট লম্বা। সন্তু মনে-মনে এক দুই গুনতে লাগল। এতে তবু সময় কাটবে।
চার হাজার পর্যন্ত গোনার পর সন্তুর আর ধৈর্য রইল না; কেউ কি তা হলে আসবে না? কিংবা রাজকুমারের লোকেরা তাকে একটা পাতাল-গুহায় ফেলে রেখে গেছে, এখান থেকে আর উদ্ধার পাবার আশা নেই? কিংবা এই জায়গাটারই নাম নরক?
আর একটা নতুন বিপদ দেখা দিল। সন্তুর দারুণ বাথরুম পেয়ে গেছে। হাত-পা বাঁধা, সে বাথরুমে যাবে কী করে? এবারে সন্তুর ডাক ছেড়ে কান্নার উপক্রম।
ঠিক এই সময় দরজা খুলে গিয়ে আলো ঢুকতেই সন্তু মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে টাইগার। তার বিশাল চেহারা প্ৰায় পুরো দরজাটা ঢেকে দিয়েছে।
টাইগার বলল, ঘুম ভাঙ্গিয়েসে? ওরে বাপ রে বাপ, কী ঘুম, কী ঘুম! হামি তিন-তিনবার এসে দেখে গেলাম! আভি আখি খুলেসে?
টাইগার কোমর থেকে একটা ছুরি বার করে এগিয়ে এল সন্তুর দিকে।
এতক্ষণ পর একজন মানুষকে দেখেই সন্তুর ভাল লেগেছিল। হঠাৎ আলোতে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চোখটা ঠিক হতেই সে দেখল টাইগারের হাতে ছুরি। বাধা দেবার কোনও উপায় নেই। তা হলে এটাই কি তার শেষ মুহূর্ত?
টাইগার কিন্তু কাছে এসে সেই ছুরি দিয়ে ঘাঁচ-ঘ্যাঁচ করে কেটে দিল সন্তুর হাত আর পায়ের বাঁধন। সন্তুর তখন শুধু একটাই চিন্তা। মুখের বাঁধন খোলার আগেই সে হাত দিয়ে বাথরুমের দিকটা দেখিয়ে দিয়ে কাতর শব্দ করতে লাগল।
টাইগার হেসে বলল, যাও, গোসল করকে আও!
সেদিকে ছুটে যেতে যেতে সন্তু ভাবল, টাইগারের মতন ভাল মানুষ আর হয় না। সে একজন দেবদূত!
বাথরুমে ঢুকে সন্তু নিজেই খুলে ফেলল মুখের বাঁধনটা।
খানিকটা বাদে সন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে দেখল টাইগার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কোমরে হাত দিয়ে। মুখে মিটমিটি হাসি।
সে বলল, আরে লেড়কা, তুই কাল হামার সাহেবকে লাথ মেরেছিস? মাহেবের হাঁথি থেকে তুই পিস্তল ছিনাকে লিয়েছিস? বা রে লেড়কা, বাঃ, তোর তগত আছে।
থাবার মতন হাত দিয়ে সে থাবড়ে দিল সন্তুর পিঠ।
শত্রুপক্ষের কাছ থেকে এরকম প্ৰশংসা পেয়ে সন্তু খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল। টাইগার হয়তো ততটা শত্রুপক্ষ নয়, তার ব্যবহারে তো খারাপ কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাজকুমার মিথ্যেমিথ্যি ভয় দেখিয়েছিল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, টাইগারজি, আমার কাকাবাবু কোথায়?
টাইগার বলল, খোঁড়াবাবুকা তো খদের মিলে গেল, তাই ঝটপট বিক্রি ভি হয়ে গেল। লেকিন তোমার তো খদের আখুনো মেলেনি!
কাকাবাবু বিক্রি হয়ে গেছেন?
চলো, নীচে চলো। সাহেব তুমাকে বুলাচ্ছেন।
কাকাবাবু কাকাবাবু যাবার সময় আমাকে কিছু বলে গেলেন না?
তুমি তো তখন ঘুমাচ্ছিলো! চলো, বাহার আও!
নিশ্চয়ই খুব বেশি ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল তাকে। তাই মাথাটা এখনো টলছে। ঘরের বাইরে এসে সন্তু দেখল একটা বেশ টানা বারান্দা, সেখানে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে এখন। বারান্দার দুপাশে তিনটে তিনটে ছটা ঘর, একেবারে শেষে একটা জানলা। সেই জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে, দেখে মনে হয়। সদ্য সন্ধে হয়েছে।
সন্তু স্তম্ভিত হয়ে গেল। কাল মাঝরাত্তির থেকে সে আজ সন্ধে পর্যন্ত ঘুমিয়েছে? সকাল, দুপুর কিছু টের পায়নি? এরকম তার জীবনে হয়নি। আগে।
কোণের আর-একটা ঘরের দরজা খোলা, বাকি সব বন্ধ। সেই ঘরগুলোতেও কি বিক্রির জন্য মানুষদের বন্দী করে রাখা হয়েছে?
টাইগার একটা টুল দেখিয়ে সন্তুকে বলল, বৈঠ যাও!
সেই টুলের পাশেই পড়ে রয়েছে একটা রবারের গদা। যা দিয়ে মারলে রক্ত বেরোয় না, কিন্তু সাংঘাতিক লাগে!
একটা দেয়াল-আলমারি থেকে টাইগার একগোছা দড়ি বার করতে করতে বলল, সাহেব তুমাকে নীচে ঝুলিয়েছেন, গাড়ি ভি তৈয়ার। মনে তো হচ্ছে, তোমার খদের মিলে গেল। দাও, হাঁথি বাড়াও!
টাইগার আবার তার হাত বাঁধবে। আপত্তি করে কোনও লাভ নেই; কোনও রকম গোলমাল করার শক্তিও নেই এখন সন্তুর। সে বাধ্য ছেলের মতন বাড়িয়ে দিল তার হাত দুটো।
ঠিক আগের মতনই হাতদুটো পেছন দিকে মুড়ে খুব শক্ত করে বাঁধা হল। তারপর পা। মুখটা বাঁধা হবে একটা বড় স্কার্ফের মতন কাপড় দিয়ে। সেটা আনতেই সন্তু জিজ্ঞেস করল, টাইগারজি, সত্যি আমাকে বিক্রি করে দেবে?
টাইগার বলল, হ্যাঁ! তুমার ভয় লাগছে নাকি? আরে লেড়কা, তোমার তগত আছে, ভয় কী? আরব দেশে যাবে, বহোত রূপেয়া কামাবে, মাংস খাবে, খেজুর খাবে, ভাল থাকবে। এখানে কী আছে?
এমন আদর করে সে বলছে কথাগুলো যেন সে সন্তুকে মামাবাড়ির দুধভাত খাওয়াতে পাঠাচ্ছে।
এরা তাকে আরব দেশে পাঠিয়ে দিতে চাইছে শুনে সন্তুর ভয় হচ্ছে না। কিন্তু কাকাবাবুকে আর তাকে আলাদা আলাদা জায়গায় পাঠানো হবে কি না, সেইটাই তার প্রধান চিন্তা।
পা বাঁধা অবস্থায় সন্তু হটতে পারবে না। টাইগার অবলীলাক্রমে তাকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর তরতর করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।
একতলার উঠোনে আজ রয়েছে একটা স্টেশান ওয়াগান। তার সামনে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার। বিশাল কুকুরটা তার পায়ে মাথা ঘষছে। রাজকুমারের কপালে একটা স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো।
টাইগার সন্তুকে নামিয়ে দিতেই রাজকুমার ধমকে জিজ্ঞেস করল, এত দেরি হল কেন? আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি!
টাইগার বলল, এ লোড়কা গোসল করতে গেল যে!
সন্তুর সঙ্গে রাজকুমারের চোখাচোখি হতেই রাজকুমারের মুখটা রাগে বিকৃত হয়ে গেল। সে এগিয়ে আসতে-আসতে দাঁত কিড়ামিড় করে বলল, হারামজাদা ছেলে! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি শেষ করে দিই!
কাছে এসে সে সন্তুর বাঁ। গালে জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরল।
সন্তুর চিৎকার করারও উপায় নেই। আগুনে পোড়ার জ্বালা অত্যন্ত সাংঘাতিক, তবু সন্তু চোখের জল আটকে রাখল। প্ৰাণপণে।
টাইগার এক টানে সন্তুকে সরিয়ে নিয়ে বলল, দাম কমে যাবে! খদ্দের কমতি দাম দেবে।
রাজকুমার বলল, নে, এটাকে গাড়িতে তোল!
টাইগার সন্তুকে উঁচু করে তুলে স্টেশন-ওয়াগনটার মেঝেতে শুইয়ে দিল। সন্তু চমকে উঠে দেখল, আগে থেকেই সেখানে আর-একজনকে শোয়ানো আছে। কিন্তু কাকাবাবু নয়। সন্তুরই বয়েসি একটি মেয়ে, ফ্রক পরা।
বিদ্যুৎ-চমকের মতন সন্তুর মনে হল, দেবলীনা?
রাজকুমার বলেছিল না যে কাকাবাবুর জন্য সে টোপ ফেলেছিল একটা? এই-ই তা হলে সেই টোপ! দেবলীনা কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, রাজকুমার নিজে কিংবা তার কোনও লোক সেটা লক্ষ্য করেছে। তারপর দেবলীনাকে ওরা চুরি করে নিয়ে গিয়ে ভেবেছে, নিশ্চয়ই কাকাবাবু দেবলীনার বাড়িতে খোঁজ নিতে যাবেন। ঠিক তাই-ই হয়েছে। দেবলীনার ঠিকানা জানা ওদের পক্ষে শক্ত কিছুই না। কাজ হয়ে গেছে, ওরা এখন দেবলীনাকেও বিক্রি করে দেবে!
মেয়েটি হয় ঘুমিয়ে আছে, অথবা অজ্ঞান। একেবারে নড়াচড়া করছে না।
একটু বাদে রাজকুমার উঠে এল গাড়ির মধ্যে। গাড়ি চালাবে অন্য কেউ। রাজকুমার একটা সিটের ওপর বসে হুকুম দিল, নাউ স্টার্ট।
তারপর রাজকুমার তার জুতোসুন্ধু পাটা তুলে দিল সন্তুর বুকের ওপর।
একজন মানুষের পা আর কত ভারী হতে পারে? সন্তুর মনে হচ্ছে, তার বুকের ওপর যেন একটা একশো কেজি ওজন চেপে আছে। প্ৰায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। রাজকুমার এর পর আর একটু জোরে চাপ দিলেই তার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। অথচ বাধা দেবার কোনও উপায় নেই সন্তুর, সে অসহায়।
কাল রাত্তিরে রাজকুমারকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে রিভলভারটা কেড়ে নেবার চেষ্টাটা খুব ভুলই হয়েছে তার। সবচেয়ে বড় ভুল, সে শুধু রিভলভারটাই কাড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তারপর কী ঘটবে বা ঘটতে পারে সেটা ভাবেনি। এরকম ভুলের জন্য তার প্রাণটাও চলে যেতে পারত!
সেই ঘটনার আগে রাজকুমার অন্তত মৌখিক কিছু খারাপ ব্যবহার করেনি। শারীরিক অত্যাচারও করেনি। এখন সে শোধ তুলে নিচ্ছে।
গাড়ির জানলা দিয়ে যেটুকু দেখতে পাচ্ছে সন্তু, তাতে বুঝতে পারছে যে, তারা আবার শহরের মধ্যেই ঢুকছে। রাস্তায় আলো আছে, দুপাশে ঘেঁষাৰ্ঘেষি বাড়ি। তাদের অন্য কোনও নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। কী সাহস এদের! সন্ধেবেলা কলকাতার পথে-পথে অজস্র লোক, কত গাড়ি, মোড়ে-মোড়ে পুলিশ, তারই মধ্যে দিয়ে এরা হাত-মুখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে দুটি ছেলেমেয়েকে। চম্বলের ডাকাতরাও বোধহয় এত দুঃসাহসী নয়।
রাজকুমার আবার গুনগুন করে কী একটা গান গাইছে!
গাড়িটা চলছে তো চলছেই, গোটা কলকাতা শহরটাকে একেবারে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে চলেছে মনে হয়। হয়তো সন্তুদের বাড়ির পাশ দিয়েও যাচ্ছে। অদ্ভুত, অদ্ভুত ব্যাপার! মা-বাবা এতক্ষণ কী করছেন কে জানে!
বুকের ওপর কষ্টটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। গালের ছাঁকা-লাগা জায়গাটাতেও জ্বালা করছে। সন্তু পাশ ফেরার চেষ্টা করল, উপায় নেই। সে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
গাড়িটা থামতেই সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল। রাজকুমার নেমে গেল। আগে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কেউ এল না। সন্তুর মনে হল তারা দুজন যেন মানুষ নয়, মালপত্র। অন্যদের সুবিধেমতন নামানো হবে।
একটু বাদে দুজন লোক এসে ওদের নামাল। সন্তু দেখল গাড়িটা ঢুকে এসেছে একটা গ্যারাজের মধ্যে। গ্যারাজের পেছনে একটা ছোট দরজা। সেই দরজা দিয়ে ওদের বয়ে নিয়ে যাওয়া হল দোতলায়। বাড়িটা বেশ পুরনো আমলের, সিঁড়িগুলো মোর্বল পাথরের। ওপরের দালানেও সাদা-কালো চৌখুপ্লি পাথর বসানো!
একটা বেশ বড় ঘরে এনে ওদের শুইয়ে দেওয়া হল। সেই ঘরে গোটা চারেক জানলা, হাট করে খোলা। দুটো আলো জ্বলছে।
ধপধাপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিপর একজন মাঝবয়েসি লোক এসে ঢুকলেন ঘরে, হাতে একটা রুপো-বাঁধানো ছড়ি, ঠোঁটে পাতলা গোঁফ, মাথার কোঁকড়ানো চুলের মাঝখানে সিঁথি। আগেকার দিনের জমিদারদের মতন চেহারা।
তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে ওদের দেখলেন, তারপর তাঁর লোকদের হুকুম দিলেন, এই, ছেলেমেয়ে দুটোর বাঁধন খুলে দে! এঃ, কী বিচ্ছিরিভাবে বেঁধেছে। ওদের কি চোখের চামড়া নেই? খুলে দে, খুলে দে!
সন্তু বাঁধন-মুক্ত হয়ে উঠে বসে লোকটির দিকে চেয়ে রইল। তিনি ভুরু নাচিয়ে বললেন, কী, খিদে পেয়েছে? একটু বোসো, খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ওঁকে দেখলে গুণ্ডা-বদমাশ মনে হয় না একটুও, বরং সন্ত্রম জাগে। রাজকুমারের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমাদের এখানে ধরে এনেছে কেন?
ভদ্রলোক বললেন, যা হয়েছে তা তো হয়ে গেছেই। আমার কাছে এসে পড়েছি, আর তোমাদের কোনও চিন্তা নেই। খাওয়া-দাওয়া করো, তারপর সব কথা হবে।
ভদ্রলোক চলে গেলেন, অন্য লোক দুটিও বাইরে বেরিয়ে গেল, খোলা রয়ে গেল। দরজাটা।
সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই গেল একটা জানলার ধারে। ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। রাজকুমার তাদের এইখানে পৌঁছে দিল, এবারে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি? তবে যে বলেছিল আরব দেশে পাঠাবে? কাকাবাবুর কী হল?
জানলার বাইরে একটা বাগান। সেখানে আলো নেই, ঘরের আলোতেই যেটুকু বোঝা যাচ্ছে। বাগানের শেষের দিকে একটা উঁচু পাঁচিল। বাগান দিয়ে দুজন লোক হেঁটে গেল। এটা যেন একটা স্বাভাবিক বাড়ি, বন্দিশালা বলে মনে হবার কোনও কারণ নেই। ঘরের দরজা খোলা, সেখানে কোনও পাহারাও নেই।
উঃ উঃ শব্দ শুনে সন্তু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। দেবলীনা ছটফট করছে। তার জ্ঞান ফিরে আসছে।
সন্তু দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মারল। কাছাকাছি কারুকে দেখা যাচ্ছে না। দোতলায় অনেকগুলো ঘর। চওড়া বারান্দাটা ডান দিকে আর বা দিকে বেঁকে গেছে।
সন্তু আবার ঘরের মধ্যেই ফিরে এল। এতটা স্বাধীনতা তাকে দেওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে কোনও ফাঁক থাকতে পারে। অপেক্ষা করেই দেখা যাক।
দেবলীনা শরীরটা মোচড়াচ্ছে, কিন্তু চোখ খুলছে না। একবার সে ফিসফিস ক:ে ালে উঠল, জল, জল খাব?
সন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনও জলের পাত্ৰ দেখতে পেল না। পাশেই বাথরুম রয়েছে। ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার। কল খুলে একটা কাচের জগে। করে খানিকটা জল এনে সে প্রথমে দেবলীনার চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিল।
দেবলীনা এবারে চোখ মেলে বলল, কে? আমাকে মারছ কেন? আমায় মেরো না!
সন্তু চুপ করে রইল।
দেবলীনা নিজের মুখে হাত বুলোল। মুখ ঘুরিয়ে সারা ঘরটা দেখল, তারপর বলল, এই, আমার চশমা কোথায়? চশমা দাও!
সন্তু এবারেও কোনও উত্তর দিল না। সে বুঝতে পারছে, মেয়েটির এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
দেবলীনা বলল, চুপ করে আছ কেন? তুমি কে? আমার চশমাটা দাও!
সন্তু বলল, তোমার চশমা আমার কাছে নেই। আমার নাম সন্তু!
আর কোনও কথা হল না, এই সময় একটি লোক এল দু প্লেট খাবার নিয়ে। টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ।
সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে খাওয়াতে মন দিল। খিদের সময় তার শরীর দুর্বল হয়ে যায়, মাথাও ঠিক কাজ করে না।
লোকটি আবার ফিরে গিয়ে জল নিয়ে এল।
দেবলীনা খাবারে হাত দেয়নি, সে একদৃষ্টি চেয়ে আছে সন্তুর দিকে।
সন্তু বলল, তোমার খিদে পায়নি? খেয়ে নাও!
দেবলীনা বলল, তোমার নাম সন্তু? মিথ্যে কথা! তুমি এখানে এলে কী করে? আমিই বা এখানে এলাম কী করে?
সন্তু বলল, আগে খেয়ে নাও!
আমি ডিম খাই না! আমি টেস্টও খাই না।
এখানে তুমি লুচি-মাংস কোথায় পাবে?
আমার কিছু চাই না। তুমি আমার খাবারটা খেয়ে নাও!
তুমি সত্যি খাবে না?
আমি আজেবাজে জায়গায় খাই না।
সন্তু দ্বিধা করল না, নিজের প্লেটটা শেষ করে সে দেবলীনার খাবারও খেতে শুরু করে দিল। তার মনে হল, মেয়েরা বোধহয় বেশি খিদে সহ্য করতে পারে। তার মা মাঝে-মাঝেই সারাদিন উপোস করে থাকেন।
সন্তুর খাওয়া শেষ হয়নি, বারান্দায় শোনা গেল। খট্খট্ শব্দ। সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুর শরীরে শিহরন হল। এই শব্দ তার খুব চেনা। কাকাবাবুর ক্রাচের শব্দ!
সত্যিই কাকাবাবু! সন্তু হাত থেকে আধা-খাওয়া টোস্টটা ফেলে দিল।
কাকাবাবু এক্ষুনি স্নান করেছেন মনে হচ্ছে, তাঁর মাথার চুল ভিজে। তিনি একলাই ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে আর কোনও লোক নেই। তিনি ওদের দেখে খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, এই যে, তোরা এসে গেছিস? কেমন আছ দেবলীনা?
সন্তু বড়-বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি আগের ঘটনা সব দুঃস্বপ্ন ছিল, এখন তা কেটে গেছে?
দেবলীনা সন্তুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইনি কে?
সন্তুর এবার সন্দেহ হল, এই মেয়েটা সত্যিই দেবলীনা তো? কিংবা ওর মতন দেখতে অন্য কেউ?
কাকাবাবু কাছে এসে একটি চেয়ারে বসলেন। তারপর সন্তুকে বললেন, আমাকে ভোরবেলা ঘুমের মধ্যে এখানে নিয়ে এসেছে, বুঝলি? তাই তোকে জানিয়ে আসতে পারিনি। এখানে এসে জানতে পারলুম যে, দেবলীনাকেও ওরা ধরে রেখেছে।
দেবলীনা বলল, আপনি কাকাবাবু? আমি চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছি না। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। আমার চশমাটা কোথায় গেল?
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের বড় বেশি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিল। সেইজন্যই ওরকম হচ্ছে। একটু বাদে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চশমাটা কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে?
এই সময় একটা জাহাজের ভোঁ বেজে উঠল। খুব কাছে। সন্তু চমকে উঠল।
কাকাবাবু বললেন, এ-বাড়িটা গঙ্গার একেবারে পাশে। রাত্তিরের অন্ধকারে চুপিচুপি অনেক কিছু জাহাজে তুলে দিতে পারে এখান থেকে।
দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, আমি বাড়ি যাব কখন?
কাকাবাবু হাসলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে থুতনিটা ঘষতে-ঘষতে বললেন, তোমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে, না! দেখি, কী ব্যবস্থা করা যায়! দেবলীনা, তুমি আমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে যে, আমি তোমায় কোনও অ্যাডভেঞ্চারে নিয়ে যেতে চাই কি না! আর দ্যাখো, তোমার জন্যই আমি আর সন্তু কী রকম এক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়লুম। এরপর কী হয় কে জানে।
এই সময় খাকি প্যান্ট-শার্ট পরা একজন লোক এসে কাকাবাবুকে বলল, বাবু আপনাকে ডাকছেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে?
লোকটি আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল, চার তলায়?
কাকাবাবু মুখে বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে বললেন, আমার সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়, তা এরা কিছুতেই বুঝবে না! চলো, দেখি কী বলে!
দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, আমিও যাব?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এসো! তুমি এখানে এক-একা বসে থেকে কী করবে? যদি চোখে ভাল দেখতে না পাও, তা হলে সন্তু তোমাকে ধরে নিয়ে আসবে।
দেবলীনা বলল, এখন অনেকটা দেখতে পাচ্ছি।
খাকি পোশাক পরা লোকটি ঘরের বাইরে এসে বলল, আপনাকে সিঁড়ি ভাঙতে হবে না। লিফট আছে, এদিকে আসুন।
কাকাবাবু বললেন, এরকম পুরনো বাড়ি, তাতেও লিফট! বেশ ভাল ব্যবস্থা তো!
সন্তুও অবাক হয়ে গেল। বড়-বড় থামওয়ালা বাড়ি, শ্বেত পাথরের সিঁড়ি, এখানেও লিফট?
দরজা খুলে লিফটে ঢুকে সন্তু আর একটা জিনিস দেখে অবাক হয়ে গেল। লোকটি বলল চার তলায় যেতে হবে, কিন্তু সে বোতাম টিপল ছ নম্বরের। আর লিফট গিয়ে ছ। তলাতেই থামল।
কাকাবাবুও নিশ্চয়ই এটা লক্ষ করেছেন। তিনি তাকালেন একবার সন্তুর দিকে।
লিফট থেকে নেমেই প্রথম যে ঘরটা চোখে পড়ল, সেখানে বসে আছে রাজকুমার আর টাইগার। রাজকুমার কায়দা করে সিগারেট টানছে। কাকাবাবু সেই ঘরের সামনে থমকে দাঁড়ালেন।
খাকি পোশাক পরা লোকটা বলল, এই ঘরে না, আপনি ডান পাশে চলুন। বাবু অন্য জায়গায় রয়েছেন।
কাকাবাবু রাজকুমারের দিকে আঙুল তুলে বললেন, তুমি চলে যেও না, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
রাজকুমার বলল, আমি চলে যাব? কেন? হা-হা-হা-হা! সে একেবারে অট্টহাস্য করে উঠল।