করিম ফকিরের বন
বেহালার পরুই দাস পাড়া রোডে, পরুই মৌজায় আমাদের এক বন্ধু থাকে। তার নাম সুভাষ। বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের প্রাণবন্ত এই ছেলেটি আমাদের সহকর্মীও। একই অফিসে চাকরি করি আমরা। ওর বউ ফোর্ট উইলিয়ামে চাকরি করে। বেশ সুখী পরিবার ওদের।
তা একদিন হচ্ছিল কি, বৃষ্টি-বাদলার জন্য সেকশনে স্টাফেদের অনুপস্থিতির ফলে মাত্র কয়েকজন আমরা নানারকম গল্পগুজবে মেতে উঠেছিলাম। অশোকবাবু, নিমাই, মুকুলদা, বাচ্চুদা এইরকম কয়েকজন ছিলাম। নানারকম মুখরোচক গল্প করতে করতে একসময় ভূতের প্রসঙ্গে চলে এলাম। এইখানে একটু বলে রাখি, নিমাই থাকে হুগলি জেলার রূপরাজপুর গ্রামে। ও ওইসব জায়গা থেকে লোকমুখে শোনা কিছু অবাস্তব বা ভৌতিক ঘটনার কথা আমাদের কাছে গল্প করে। আর আমরা তা কানখাড়া করে শুনি। সেদিনও সে ওইরকমই কিছু একটা যেন বলছিল। এমন সময় সুভাষের আবির্ভাব।
সুভাষ খুব আমুদে ছেলে। কাজেই ও যখন ঘরে ঢোকে সবাই তখন টের পায় যে একজন এল । রোজের মতোই ঘরে ঢুকে সুভাষ একটা চেয়ার টেনে সবার মাঝখানে বসে বলল, “কীসের এত মজলিশ হচ্ছে জানতে পারি কী?”
বাচ্চুদা বলল, “গাঁজা না খেয়েও গাঁজাখুরির গল্প হচ্ছে আমাদের। নিমাইটা তো বিয়ে-থা করল না, এখন রোজই নাকি ভূত দেখছে।”
সুভাষ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তোমরা ভূতে বিশ্বাস করো?”
মুকুলদা বলল, “ভূত যদিও দেখিনি, তবুও কেউ যদি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে সে নিজে ভূত দেখেছে তা হলে হয়তো বিষয়টা বিবেচনা করে বিশ্বাস করে দেখতে পারি।” সুভাষ বলল, “তোমরা কেউ করো না করো, আমি করি। তার কারণ এই ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে আমার।”
“বলো কী!”
“ঠিকই বলছি। যদি শোনো, তোমরাও বিশ্বাস না করে পারবে না।”
সুভাষের এই কথায় সকলেই প্রায় চমকে উঠল । কেননা সুভাষকে যারা চেনে তারা কিছুতেই ওর কথা অবিশ্বাস করবে না। সব ব্যাপারে অবিশ্বাসী এমন কেউ যদি বলে যে বিশেষ ওই ব্যাপারটা সে বিশ্বাস করে, তাকে অবিশ্বাস করবে কে? সুভাষ যেমন বেপরোয়া, তেমনই ডাকাবুকো। কথায় কথায় সব ব্যাপারকে নস্যাৎ করে দেওয়ায় ওর জুড়ি নেই। যা ধ্রুব সত্য তাকেও এককথায় গুলতাপ্পি বলতে ওর আটকায় না। এহেন সুভাষ কিনা ভূতের মতো অদ্ভুত এবং অলীক একটা ব্যাপারকে বিশ্বাস করে? বলা যায় না কার দুর্বলতা কোথায় !
মুকুলদা বলল, “তা হলে বলো দেখি ভৌতিক বিষয়ে তোমার অভিজ্ঞতাটা কীরকম?
ভূত তো আমরা দেখিনি। বর্ষার দুপুরে সুভাষ বলল, “তোমরা হয়তো মনে মনে হাসছ, তা হাসো। কেউ বিশ্বাস করো না করো আমি করি। তার কারণ, ছোটবেলায় নিজেই আমি একবার ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম।” সুভাষের এই কথায় সবাই আমরা নড়েচড়ে বসলাম। চোখে ঔৎসুক্য নিয়ে তাকালাম ওর ।
ভূতের গল্পটাই শুনি।”
মুখের দিকে
বাচ্চুদা বনবিহারীকে চায়ের অর্ডার দিতে সুভাষ ওর গল্প শুরু করল। গল্পটা ওর মতো করেই বলছি :
আমার বয়স তখন বারো। আমি পূর্ববাংলার ছেলে। আমাদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ সাব ডিভিশনে (থানা-মসিদপুর) লখাইয়ের চর নামে একটি গ্রামে। তোমরা তো এদেশি ছেলে, পূর্ববাংলায়, মানে এখন যাকে বাংলাদেশ বলা হয়, সেখানকার গ্রাম সম্বন্ধে তোমাদের কীরকম ধারণা তা জানি না। তবে তখনকার সেই গ্রাম ছিল কবির কল্পনার গ্রাম। মাটির ঘর। খড়ের চালা। তার ওপর গজিয়ে ওঠা লাউপালার লকলকানি— সে যে কী সুন্দর তা বলে বোঝানো যাবে না। আর ছিল নারকেল, সুপারি ও কলাবউয়ের ঘোমটা টানা ছায়াশীতল আঙিনা। যেন স্বপ্নের দেশ ছিল। তা একবার হল কি, আমার মা আমাকে খেতের কিছু ডাল দিয়ে দূরের বাউসখালির হাটে পাঠালেন সেই ডাল বেচে কিছু মাছ কিনে আনতে। বাউসখালির হাট আমাদের গ্রাম থেকে অনেকদূর। প্রায় চার-পাঁচ মাইল তো হবেই। পথে একটা সাঁকোও পার হতে হয়। ভারী সুন্দর জায়গাটা। সেখানে একটা নদীও আছে। নদীর নাম কুমার নদী। সেই কুমার নদীর পাড়ে উঁচু বাঁধের ওপর বাউসখালির হাট বসে। সপ্তাহে একবার। কত কী যে বিক্রি হয় সেই হাটে, তা বলার নয়! হাটবারে সেই জায়গাটা যেন ছোটখাটো একটা মেলার রূপ নেয়। নদী পুকুরের টাটকা মাছ, কাঁচা আনাজ, বেতের বোনা ধামা-কুলো, গোরুর গাড়ির চাকা, লাঙল, তেলেভাজা, মিষ্টি, এমনকী দরজা-জানলা পর্যন্ত বিক্রি হয় সেই হাটে। অন্ধ ভিখারি গান গেয়ে, যাযাবরী মেয়েরা নাচ দেখিয়ে পয়সা নেয়। তা ছাড়া বায়োস্কোপের বাক্সয় ছবি দেখা, বন্দুকের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে বেলুন ফাটানো সবকিছুই হত সেই হাটে।
যাই হোক, আমি সেই ডাল বেচে যে পয়সা পেলাম তাতে বড় বড় কয়েকটা গলদা চিংড়ি কিনে হাট ঘুরতে লাগলাম। এই হাটের মজা ছিল এই যে, কোনও কিছু কেনবার না থাকলেও লোকে মেলা বেড়ানোর মতো এই হাটে বেড়াতে আসত। তা এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে বেলা গড়িয়ে গেল । সন্ধে হয় হয়। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সর্বনাশ! বাড়ি ফিরব কী করে? অনেক দূরের পথ। তাই সাহসে বুক বেঁধে কয়েকজন লোকের সঙ্গ নিয়ে পথ হাঁটতে লাগলাম।
কিছু পথ আসবার পর সেই লোকগুলোও আবার অন্যদিকে বেঁকে গেল। তখন তো এত মানুষজন ছিল না যে, সবসময়ই কোথাও না কোথাও লোক থাকবে! চারদিকে তখন বনজঙ্গল, ধানের খেত। মাঝে মাঝে বড় দিঘি। ছোটখাটো পুকুরও দু-একটা চোখে পড়ত। তা কী আর করি, আমি নিজের মনেই গান গাইতে গাইতে পূর্ণ উদ্যমে পথ চলতে লাগলাম। যেতে যেতেই সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে রাত্রি হল। আমাদের গ্রামে যাওয়ার সহজতম পথটি ধরেই আমি চলা শুরু করলাম।
অনেকটা পথ যাওয়ার পর হঠাৎ একসময় গায়ের ওপর কেমন যেন এক ধরনের শিরশিরিনি অনুভব করলাম আমি। প্রথমে ব্যাপারটায় ততটা আমল দিইনি। পরে যখন মনে হল কেউ যেন আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে মুখ এনে গায়ে নিশ্বাস ফেলছে তখনই কেমন একটা ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে গেল আমার সারা দেহে। সেই নিশ্বাস বরফের মতো শীতল। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকেই যখন দেখতে পেলাম না, তখন রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় পেলেও ভেঙে পড়লাম না একেবারে। কেননা ভেঙে পড়ে তো লাভ নেই। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতেই হবে। তাই সাহসে বুক বেঁধে আরও জোরে এগিয়ে চললাম।
যেতে যেতে একসময় আচানিপুকুরের পাড়ে এসে উঠলাম। এই পুকুরটা আবার ভীষণ দোষাস্ত পুকুর । কত ছেলে, মেয়ে, লোক যে স্নান করতে এসে ডুবে মরেছে এখানে, তার কোনও লেখাজোখা নেই। এই পুকুরের পাড়ে বাঁশবন। তার ভেতর দিয়ে এই রাতদুপুরে পথচলা একটা অসম্ভব ব্যাপার। আবার বাঁশবন বাদ দিলেও পুকুরের ধার ঘেঁষে করিম ফকিরের তালবাগান। সেও অতি সাংঘাতিক জায়গা। তবু আমি বাঁশবনে না ঢুকে করিম ফকিরের তালবনেই ঢুকে পড়লাম। ফাঁকা মাঠের বুকে সারিবদ্ধ তালগাছের ঘন সমারোহ। তারই ফাঁকে ফাঁকে পায়েচলার পথ। এই করিম ফকিরের তালবাগানকে নিয়েও অনেক রোমহর্ষক ঘটনার কথা শুনেছিলাম। এখানে আসামাত্রই এবার সেইসব কথাগুলো মনে পড়তে লাগল। ভূতের উপদ্রবের জন্য এই তালবাগানও কুখ্যাত ছিল খুব।
অজানা ভয়ে সারা শরীরের সমস্ত রক্ত যেন জমাট বেঁধেছে তখন আমার মুখে। হাত পা কাঁপছে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। আসলে ভয়ের ব্যাপারটা মনের মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে তাকে আর তাড়ানো মুশকিল। আমি ‘রাম রাম’ করতে করতে এগিয়ে চললাম। কিন্তু গেলে কী হবে, কিছু পথ আসার পরই বুঝতে পারলাম রাম নামেও সবসময় ভূত পালায় না। যেতে যেতেই আমার চোখে পড়ল ঠিক আমার পাশে-পাশেই দুটি কালো পা অস্পষ্টভাবে আমার সঙ্গে হাঁটায় পাল্লা দিচ্ছে। ওই দৃশ্য দেখে একবার মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। পরক্ষণেই, নিজেকে শক্ত করে নিলাম। ছেলেমানুষ হলে কী হবে, বরাবরই আমার মনোবল ছিল প্রবল। আমি চলেছি আর আড়চোখে দেখছি। শুধু দুটি কালো পা আর হাঁটুর ওপরে ধুতির একাংশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উপরিভাগ সম্পূর্ণই অদৃশ্য।
এইবার শুরু হল আর এক ঝামেলা। আমি যাচ্ছি আর যেতে যেতে বুঝতে পারছি আমার থলির ভেতর থেকে এক-একটি গলদা মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে মাটিতে পড়ছে। আর মজার ব্যাপার এই যে, যতবার আমি সেই মাছ কুড়িয়ে থলিতে ভরতে যাচ্ছি ততবারই একটা অদৃশ্য হাত এসে আমার আগেই মাছ কুড়িয়ে থলিতে ভরে দিচ্ছে। আমি যে এবার সত্যি-সত্যিই ভূতের পাল্লায় পড়েছি, তা বুঝতে আর দেরি হল না।
এই মাঠ পেরোলেই আমাদের গ্রাম। অথচ এতবড় মাঠ পেরোতেও সময় লাগে । কিন্তু এইভাবে কতক্ষণ যাওয়া যায়! আমি থলিটাকে মুঠো করে ধরে বুকের কাছে এনে প্রাণপণে দৌড় লাগালাম এবার। অমনই সে কী ফোঁসফোঁসানি। করিম ফকিরের বনে যেন ঝড় উঠল। আকাশে মেঘ নেই। তারার ফুল ফুটে আছে। আর তালবনে ঝড়। সেই ছোটার সময়ই দেখলাম, যে কালো পা দুটি আমার সঙ্গে হাঁটায় পাল্লা দিচ্ছিল সে দুটি ক্রমশ বড় হতে হতে বিশাল এক মানুষের আকার নিল। তালগাছ সমান চেহারা। তারপর একসময় মিলিয়ে গেল। আর আমি ছুটতে ছুটতে এসে আমাদের ঘরের উঠোনে ধড়াস করে পড়লাম।
সবাই ‘কী হল, কী হল’ করে এসে ধরল আমায়। চোখেমুখে জল দিতে লাগল। কিন্তু, আমি তখন কেমন যেন বোবা হয়ে গেলাম! সকলের মুখের দিকে অপরিচিতর মতো
তাকিয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে।
ইতিমধ্যে আমার দেরি দেখে বাড়ির লোকেরা দারুণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এমনকী আর একটু দেরি হলে আমার খোঁজে লোক পাঠানোর ব্যবস্থাও হচ্ছিল। তা নিজের থেকেই এসে যখন পড়লাম, তখন নিশ্চিন্ত হল সকলে।
আমার ঠাকুরমা আদর করে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, “ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে দ্যাখো। আসলে রাতদুপুরে মাছ নিয়ে আসছিল তাই করিম ফকিরের বনে ঠিক ভূতের পাল্লায় পড়েছিল। শিগগির তোমরা রোজা ডেকে আনো। না হলে সারাজীবন এইরকম কালাভোলা মেরে থাকবে।”
মা বললেন, “ওইজন্যই তো একা-একা ওকে কোথাও পাঠাই না। যা আড্ডাবেজে ছেলে। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু হাঁ করে দেখছিল, বা কারও সঙ্গে খেলছিল। না হলে এত রাত হওয়ার তো কথা নয়!”
ঠাকুরমা আবার বললেন, “তুই?”
আমি অতিকষ্টে বললাম, “হ্যাঁ।”
কি পথে কিছু দেখেছিলি?”
“করিম ফকিরের বন দিয়ে এসেছিলি নিশ্চয়ই?”
আমি কোনওরকমে হ্যাঁ বলে মুখ নামালাম। তারপর ঠাকুরমার নির্দেশে বাড়ির লোকেরা একজন ওঝাকে ডাকিয়ে আনল। ওঝা এসে অনেক ঝাড়ফুঁক করল আমাকে। পাটকাঠি পুড়িয়ে ধোঁয়া দিল। জলপড়া খাওয়াল। এর পর প্রায় ঘণ্টা দুই বাদে আমি একটু সুস্থ হলাম। এদিকে হয়েছে কি, আমার সেই থলিভর্তি মাছ যা ছিল, তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তবে দুঃখের বিষয়, সেই মাছগুলির মধ্যে শাঁস বলে কোনও পদার্থ ছিল না। এই বলে সুভাষ ওর গল্প শেষ করল।
ওর কথা আমরা কেউ অবিশ্বাস করলাম না। তার কারণ, সুভাষের মুখে কথার খই ফোটে। মুখে যা আসে তাই বলে, তবে কিনা ও কখনও মিথ্যে বলে না।