কলকাতায় কাঁটাপুকুর আছে
কলকাতায় কাঁটাপুকুর আছে, ফড়েপুকুর আছে, বেনেপুকুর, মনোহরপুকুর, পদ্মপুকুর সব আছে, কিন্তু শেয়ালপুকুর আবার কোন্ চুলোয়! হিসেবমতো শেয়ালদার কাছাকাছিই তার থাকা উচিত, কিন্তু সেখানে তাকে পাওয়া গেল না পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় কলকাতার রাস্তার যে-লিস্টি থাকে, তাই থেকেই শেষ পর্যন্ত জানা গেল, শেয়ালপুকুর সত্যিই আছে দক্ষিণের শহরতলিতে। জায়গাটা ঠিক কোনখানে, তা আর তোমাদের নাই বললুম।
শেয়ালপুকুরের সন্ধান তো পাওয়া গেল, তেরো নম্বরও নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু প্রশ্ন হল, জায়গাটাতে আদৌ যাওয়া উচিত হবে কি না? কাঁটাপুকুরে কোনও কাঁটা নেই—সে আমি দেখেছি; মনোহরপুকুরে আমার মাসতুতো ভাই লোটনদা থাকে সেখানে কোনও মনোহরপুকুর আমি দেখিনি, ফড়েপুকুরেও নিশ্চয়ই ফড়েরা সাঁতরে বেড়ায় না। শেয়ালপুকুরের চারপাশেও খুব সম্ভব এখন আর শেয়ালের আস্তানা নেই—বেলা তিনটের সময় সেখানে গেলে নিশ্চয়ই আমাদের খ্যাঁক-খ্যাঁক করে কামড়ে দেবে না। কিন্তু–
কিন্তু চাঁদনির সেই সন্দেহজনক আবহাওয়া? সেই ঝোল্লা গোঁফ আর কপালে আবওলা চক্রধর সামন্ত কিংবা সেই নাকেশ্বর চন্দ্রকান্ত—যাদের এখনও আমরা দেখিনি? সেই তেলেভাজা-খাওয়া হলধর আর তালঢ্যাঙা সেই খলিফা-চেহারার লোকটা? এসবের মানে কী? ছড়াটা দেখছি ওরা সবাই ই জানে আর এই ছড়ার ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনও সাংকেতিক রহস্য। পটলডাঙার বিচ্ছুমাকা কম্বল ও-ছড়াটা পেলেই বা কোথায়, আর কারাই বা তাকে নিরুদ্দেশ করল?
চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে ঝালমুড়ি খেতে-খেতে এই সব ঘোরতর চিন্তার ভেতরে আমরা চারজন হাবুড়ুবু খাচ্ছিলুম। বাঙাল হাবুল সেন বেশ তরিবত করে একটা লাল লঙ্কা চিবুচ্ছিল, আর তাই দেখে গা শিরশির করছিল আমার। টেনিদার খাড়া নাকটাকে দু-আনা দামের একটা তেলেভাজা সিঙাড়ার মতো দেখাচ্ছিল, আর ক্যাবলার নতুন চশমাটা ইস্কুলের ভূগোল স্যারের মতো একেবারে ঝুলে এসেছিল ওর ঠোঁটের ওপর।
টেনিদা মুড়ি চিবুতে চিবুতে বললে, পুঁদিচ্চেরি! মানে, ব্যাপার খুব ঘোরালো।
আমরা তিনজনেই বললুম, হুঁ।
টেনিদা বললে, যতই ভাবছি, আমার মনটা ততই মেফিস্টোফিলিস হয়ে যাচ্ছে।
ক্যাবলা গম্ভীর হয়ে বললে, মেফিস্টোফিলিস মানে শয়তান।
শাটাপ!—টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, বিদ্যে ফলাসনি। লোকগুলোকে কী রকম দেখলি?
আমি বললুম, সন্দেহজনক।
হাবুল লঙ্কা চিবিয়ে জিভে লাল টেনে উস-উস করছিল। তারই ভেতরে ফোড়ন কাটল : হ, খুবই সন্দেহজনক। ক্যামন শিয়াল-শিয়াল মনে হইল।
আমি বললুম, তাই শেয়ালপুকুরে থাকে।
ক্যাবলা বললে, খামোশ! চুপ কর দেখি। আমি বলি কি টেনিদা, আজ দুপুরবেলা যাওয়াই যাক ওখানে।
টেনিদা শিঙাড়ার মতো নাকটাকে খুচুর-খুচুর করে একটুখানি চুলকে নিলে। তারপর বললে, যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু যদি ফেঁসে যাই? মানে—লোকগুলো–
চার-চারজন আছি, দিন-দুপুরে আমাদের কে কী করবে?
তা ঠিক। তরে কিনা–টেনিদা গাঁইগুঁই করতে লাগল।
হ, সক্কল দিক ভাইবা-চিন্তাই কাম করন উচিত।—ভাবুকের মতো মাথা নাড়তে লাগল হাবুল সেন :
আর—তোমার হইল গিয়া কম্বলটা একটা অখাদ্য মানকচু। অরে শুয়ারেও খাইব না। খামকা সেইটারে খুঁজতে গিয়া বিপদে পড়ম ক্যান?
হবে না! ছিঃ ছিঃ!—এমনভাবে ধিক্কার দিয়ে কথাটা বললে– ক্যাবলা যে, হাবুল একেবারে নেতিয়ে গেল, স্রেফ মানকচু সেদ্ধর মতো। চশমাটাকে আরও ঝুলিয়ে দিয়ে এবারে সে অঙ্কস্যারের মতো কটকটে চোখে চাইল হাবুলের দিকে।
তুই এত স্বার্থপর। একটা ছেলে বেঘোরে মারা যাচ্ছে, তার জন্যে কিছু না করে স্বার্থপরের মতো নিজের গা বাঁচাতে চেষ্টা করছিস! শেম—শেম।
হাবুল জব্দ হচ্ছে দেখে আমিও বললুম, শেম-শেম! কিন্তু বলেই আমার মনে হল, হাবুলও কিছু অন্যায় বলেনি। কম্বলের মতো একটা বিকট বাঁদর ছেলে-যে কুকুরের কানে লাল পিঁপড়ে ঢেলে দেয়, লোকের গায়ে পটকা ফাটায় আর প্রণামের ছল করে খ্যাঁচখেঁচিয়ে পায়ে খিমচে দেয়, সে যদি আর নাই ফিরে আসে, তাতে দুনিয়ার বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। কিন্তু তক্ষুনি আমি ভাবলুম, কম্বলের মার কী হবে? ছেলে-হারানোর দুঃখ তিনি কেমন করে সহ্য করবেন? আর, কোনও ছেলে যদি খারাপ হয়েই যায়, তা হলেই কি তাকে বাতিল করা উচিত? খারাপ ছেলের ভালো হতে কদিনই বা লাগে? না হলে, ক্লাইভ কী করে ভারতবর্ষ জিতে নিলেন?
আমি ভাবছিলুম, ওরা কী বলছিল শুনতেই পাইনি। এবার কানে এল, টেনিদা বলছে, কিন্তু শেয়ালপুকুরে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে ওরা যদি আমাদের আক্রমণ করে?
করুক না আক্রমণ। আমাদের লিডার টেনিদা থাকতে কী ভয় আমাদের?–ক্যাবলা টেনিদাকে তাতিয়ে দিয়ে বললে, তোমার এক-একটা ঘুষি লাগবে আর এক-একজন দাঁত চরকুটে পড়বে।
হে–হে, মন্দ বলিসনি।–সঙ্গে-সঙ্গে টেনিদার দারুণ উৎসাহ হল আর সে ক্যাবলার পিঠ চাপড়ে দেবার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু ক্যাবলা চালাক, চট করে সরে গেল সে, তার পিঠ সঙ্গে সঙ্গেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল, আর চাটিটা এসে চড়াৎ করে আমার পিঠেই চড়াও হল–
আমি চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠলুম, আর হাবলা দারুণ খুশি হয়ে বললে, সারছে সারছে দিছে প্যালার পিঠখান অ্যাঁক্কেবারে চ্যালা কইরা! ইচ্-চ্—পোলাপান!
টেনিদা বললে, সাইলেন্স—নো চ্যাঁচামেচি! বেশি গণ্ডগোল করবি তো সবগুলোকে আমি একেবারে জলপান করে ফেলব। যা বাড়ি পালা এখন। খেয়েদেয়ে সব দেড়টার সময় হাজিরা দিবি এখানে। এখন টুপ ডিসপার্স কুইক।
বাস থেকে নেমে একটু হাঁটতেই আমরা দেখলুম দুটো রাস্তা বেরিয়েছে দু দিকে। একটা ধোপাপাড়া রোড, আর একটা শেয়ালপুকুর রোড। হাবুল আমাকে বললে, এই রাস্তার ধোপারা গিয়া না ওই রাস্তার শিয়ালপুকুরে কাপড় কাচে। বোঝছস না প্যালা?
আমি বললুম, তুই থাম, তোকে আর বোঝাতে হবে না।
তরে একটু ভালো কইর্যা বুঝান দরকার। তর মগজ বইল্যা তো কিছুই নাই, তাই উপকার করবার চেষ্টা কোরতে আছি। বুঝিস নাই?
এমন বিচ্ছিরি করে বলছিল যে ইচ্ছে হল হাবুলের সঙ্গে আমি মারামারি করি। কিন্তু তার আর দরকার হল না, বোধহয় ভগবান কান খাড়া করে সব শুনছিলেন, একটা আমের খোসায় পা দিয়ে দুম করে আছাড় খেল হাবুল।
টেনিদা আর ক্যাবলা-আগে-আগে যাচ্ছিল। টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, আঃ, এই প্যালা। আর হাবলাকে নিয়ে কোনও কাজে যাওয়ার কোনও মানে নেই, দুটোই পয়লানম্বরের ভণ্ডুলরাম। এই হাবলা–কী হচ্ছে?
আমি বললুম, কিছু হয়নি। হাবলার মগজে জ্ঞান একটু বেশি হয়েছে কিনা, তাই বইতে পারছে না–ধপাধপ আছাড় খাচ্ছে।
হয়েছে, তোমায় আর ওস্তাদি করতে হবে না। শিগগির আয় পা চালিয়ে।
রাস্তার দুধারে কয়েকটা সেকেলে বাড়ি, কাঁচা ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ উঠছে। গাছের ছায়া ঝুঁকে পড়েছে এখানে-ওখানে। ভর দুপুরে লোকজন কোথাও প্রায় নেই বললেই চলে। কোথায় যেন মিষ্টি গলায় দোয়েল ডাকছিল। এখানে যে কোনওরকম ভয়ের ব্যাপার আছে তা মনেই হল না।
আরে, এই তো তেরো নম্বর! উঁচু পাঁচিল-দেওয়া বাগানওলা একটা পুরনো বাড়ি। গেটের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে বাংলা হরফে নম্বর লেখা। গেট খোলাই আছে, কিন্তু ঢোকবার জো নেই। গেট জুড়ে খাটিয়া পেতে শুয়ে আছে পেল্লায় এক হিন্দুস্থানী দারোয়ান, তার হাতির মতো পেট দেখে মনে হল, সে বাঘা কুস্তিগির আর দারুণ জোয়ান—আমাদের চারজনকে সে এক কিলে চিড়ে-চ্যাপটা করে দিতে পারে।
আমরা চারজন এ-ওর মুখের দিকে তাকালুম। এই জগদ্দল লাশকে ঘাঁটানো কি ঠিক হবে?
টেনিদা একবার নাক-টাকগুলো চুলকে নিলে। চাপা গলায় বললে, পুঁদিচ্চেরি! তারপর আস্তে আস্তে ডাকল :
এ দারোয়ানজী!
কোনও সাড়া নেই।
ও দারোয়ান স্যার।
এবারেও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
পাঁড়ে মশাই!
দারোয়ান জাগল। ঘুমের ঘোরে কী যেন বিড়বিড় করতে লাগল। আর তাই শুনেই আমরা চমকে উঠলুম।
দারোয়ান সমানে বলছিল : চাঁদ—চাঁদনি চক্রধর—চাঁদ—চাঁদনি–চক্রধর—
টেনিদা ফস করে বলে বসল : চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর।
কথাটা মুখ থেকে পড়তেই পেল না। তক্ষুনি—যেন ম্যাজিকের মতো উঠে বসল দারোয়ান। হড় হড় করে খাটিয়া সরিয়ে নিয়ে, আমাদের লম্বা সেলাম ঠুকে বললে, যাইয়ে—অন্দর যাইয়ে—
আমরা বোধহয় বোকার মতো মুখ চাওয়া-চাউয়ি করছিলুম। ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঠ্যাঙানি দেবে নাকি? যা রাক্ষসের মতো চেহারা, ওকে বিশ্বাস নেই।
দারোয়ান আবার মুচকি হেসে বললে, যাইয়ে—যাইয়ে–
এরপরে আর দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। আমরা দুরুদুরু বুকে দারোয়ানের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলুম। আর ঢুকতেই তক্ষুনি খাটিয়াটা টেনে গেট জুড়ে শুয়ে পড়ল দারোয়ান—যেন অঘোর ঘুমে ড়ুবে গেল।
কিন্তু আমরা কোথায় যাই?
সামনে একটা গাড়িবান্দাওলা লাল রঙের মস্ত দোতলা বাড়ি। জানলার সবুজ খড়খড়িগুলো সাদাটে হয়ে কবজা থেকে ঝুলে পড়ছে, তার গায়ের চুনবালির বার্নিশ খসে যাচ্ছে, তার মাথায় বট-অশ্বথের চারা গজিয়েছে। একটা ভালো ফুলের বাগান ছিল, এখন সেখানে আগাছার জঙ্গল। একটা মরকুটে লিচু গাছের ডগায় কে যেন আবার খামকা একটা কালো কাকতাড়ুয়ার হাঁড়ি বেঁধে রেখেছে।
আমরা এখানে কী করব বোঝবার আগেই বাড়ির ভেতরে থেকে তালট্যাঙা লোকটা—সেই যাকে আমরা চাঁদনির বাজারে দেখেছিলুম—মাছিমাকা গোঁফের নীচে মুচকি হাসি নিয়ে বেরিয়ে এল।
এই যে, এসে গেছেন! তিনটে বেজে দু সেকেন্ডবাঃ, ইউ অর ভেরি পাংচুয়েল।
আমরা চারজনে গা ঘেঁষে দাঁড়ালুম। যদি বিপদ কিছু ঘটেই, এক সঙ্গেই তার মোকাবেলা করতে হবে!
টেনিদা আমাদের হয়ে জবাব দিলে, আমরা সর্বদাই পাংচুয়াল।
গুড!-ভেরি গুড!—লোকটা এগিয়ে চলল, তা হলে আগে চলুন মা নেংটীশ্বরীর মন্দিরে। তিনি তো এ-যুগের সব চাইতে জাগ্রত দেবতা।
নেংটীশ্বরী!
লোকটা অবাক হয়ে ফিরে তাকালো : নাম শোনেননি? মা নেংটীশ্বরীর নাম শোনেননি? অথচ চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরের খবর পেয়েছেন? এটা কী রকম হল?
আমরা বুঝতে পারছিলুম, একটা-কিছু গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। ক্যাবলা সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলে। না-না, নাম শুনব না কেন? না হলে আর এখানে এলুম কী করে?
তাই বলুন।—লোকটা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল; আমায় একেবারে ধোঁকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। জয় মা নেংটীশ্বরী।
আমরাও সমস্বরে নেংটীশ্বরীর জয়ধ্বনি করলুম।