কড়ি দিয়ে কিনলাম (Kari Diye Kinlam) : প্রথম খণ্ড – 02
সত্যিই সমস্ত কালীঘাটের যত লোক, সকলের চেয়ে যেন আলাদা ওই কাকাবাবুরা। কত বাড়ি দেখেছে দীপঙ্কর। ছোটবেলায় কত বাড়ির ভেতরে গিয়েছে। একেবারে অন্ধরমহলে। কিরণদের বাড়ি লক্ষ্মণদের বাড়ি। বিমান, ফটিক, রাখাল সকলের বাড়ি। কিন্তু কাকাবাবুদের বাড়ির সঙ্গে কারো মিলতো না। কালীঘাটে কারো বাড়িতে অমন ঠাকুর-চাকর ছিল না। কিরণদের তো ভিক্ষে করেই সংসার চলতো। পৈতে বিক্রী করে চাল-ডাল-আলু কিনতো ওরা। শুধু তাই নয়। মধুসূদনের বাড়ি গিয়ে দেখেছে মধুসূদনরা সব ভাই-বোন মিলে ভাত খেতে বসেছে। একটা বগি থালায় মধুসূদনের মা একগাদা ভাত ডাল মেখে দিয়েছে আর সব ভাইবোন গোল হয়ে বসেছে ঘিরে। একলা মধুসূদনের মা একের পর এক সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছে। ফটিক থাকতে পাথরপটির গুলিতে। ফটিকের মা মুড়ি ভাজতো। মুড়ি ভেজে রাস্তার দোকানে দিয়ে আসতো। সেই পয়সায় সংসার চলতো ওদের। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন দিয়ে বেরিয়ে কালী লেনের মধ্যে ছিল হালদারদের বাড়ি। তাদরে বাড়ি যজমানরা আসতো, কুমারী পুজো হতো, ভোগ আসতো, প্রসাদ আসতো। কালীপুজোর সময় কতদিন মা’র সঙ্গে সে-বাড়ি গিয়েছে। তাদের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের দেখেছে। সে-বাড়ির চেহারাও এমন নয়। আর অঘোরদাদু! অঘোরদাদুরও তো অনেক টাকা। অঘোরদাদুর যে কত টাকা তা। অঘোরদাদু নিজেই জানতো না। তবু অঘোরদাদুর বাড়িটা ছিল যেন লক্ষ্মীছাড়া। অঘোরদাদুকে দেখে সত্যিই সেই পাঁজিতে ছাপা বুড়োটার ছবির কথা মনে পড়তো। সমস্ত বাড়িটার মধ্যে শুধু বিন্তিদিরই যা একটু লক্ষ্মীশ্রী ভাব।
বিন্তিদির গলার শব্দও শোনা যেত না সারাদিনের মধ্যে।
মা বলতো–এ কি কাপড় পরেছ মা, একটা ভালো শাড়ি পর না, আজ বছরকার দিন–
বিন্তিদি হাসতো মুখ বুজে।
মা বলতো–কেন, কাপড় নেই বুঝি? এত লাল পেড়ে কাপড়ের ডাঁই, সব কি যায় হালদারদের ডালার দোকানে? বাবার কী আক্কেলটা বলো তো–
বিন্তিদি ভয় পেয়ে যেত। বলতো–তুমি যেন আবার বোল না দাদুকে, দাদু ভাববে আমি বুঝি বলেছি তোমাকে–
মা বলতো তোমারও কপাল মা–নইলে তোমারই বা এমন করে কপাল পুড়বে কেন?
সেদিন অঘোরদাদু বাড়ি আসতেই মা ধরলে।
বললে–বাবা, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল–
–টাকা?
অঘোরদাদুর হাতে নতুন গামছার পুঁটলি। আর এক হাতে লাঠি। কপালে ফোঁটা। মাথায় দু’একটা গাঁদা ফুলের পাপড়ি। পায়ে খড়ম। একটু আগেই বাইরে রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে পয়সা নিয়ে। হঠাৎ বাড়ির ভেতরে ঢুকেই যেন আবার ভয় পেয়ে এক-পা পেছিয়ে গেল। এখানেও টাকা!
বললে–টাকা? মুখপোড়া টাকা এখন আমি কোথায় পাবো মেয়ে? আমার কি টাকার গাছ দেখেছ তুমি?
মা বললে–টাকার কথা বলছি না আপনাকে, আপনার টাকা আপনারই থাক, কিন্তু নাতনীটার তো বিয়ে দেবেন-না দেবেন না?
অঘোরদাদু এতক্ষণে যেন একটু আশ্বস্ত হলো। বললে–বিয়ে! তা মুখপোড়া বিয়েতেও তো টাকা লাগে! টাকা আমি কোথায় পাবো শুনি?
-তা টাকা লাগবে বলে বিয়ে দেবেন না? কী-রকম দাদামশাই আপনি! এত ধর্ম কর্ম করেন, এটাও তো ধর্ম! পরকালে এর জন্যে তো জবাবদিহি করতে হবে আপনাকেই। আর যদি না পারেন তো গলায় কলসী বেঁধে মেয়েটাকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিন গিয়ে, ল্যাঠা চুকে যাক–
অঘোরদাদু খানিকটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
মা বলে–মেয়ের দিকে তো একবার চেয়েও দেখেন না-মেয়ের বয়েস হচ্ছে তা তো আপনি দেখতে পান না-আপনি না দেখলে কে দেখবে–
এবার রেগে ওঠে অঘোরদাদু। বলে–আমি? আমি কেন দেখতে যাবো মুখপোড়াকে–আমি কে? মুখপোড়া মাকে খেয়েছে, মুখপোড়া বাপকে খেয়েছে, এবার মুখপোড়া আমাকে খাবে নাকি? আমি পারবো না ও-সব–
-তা আপনি না পারলে কে পারবে?
-তার আমি কি জানি মুখপোড়া, আমি কি জানি তার–আমি কি ওর বাপ, নাকি আমি ওর মা? আমি কেউ না–
বলতে বলতে অঘোরদাদু খট খট করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। ওপরে গিয়েও গজ গজ করতে লাগলো-মুখপোড়ারা টাকা দেখেছে আমার, মুখপোড়ারা আমার টাকা দেখেছে–আমি বের করে দেব মুখপোড়াদের বাড়ি থেকে বেরো বেরো মুখপোড়ারা, বেরিয়ে যাবেরো সব–
সে গজ-গজানি আর থামে না।
অঘোরদাদু ওপরে যেতেই বিন্তিদি বেরিয়ে এসেছে। এসে মার কাছে দাঁড়িয়ে ভয়ে থর-থর করে কাঁপতে লাগলো।
-দিদি–
মা বললে–তুই থাম তো বাছা, অত ভয় করলে চলে না, মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছিস সহ্য করতে হবে না! সহ্য না করলে তুই-ই ভুগবি, কেউ তোর জন্যে কিছু করবে না তুই একটু শক্ত হ’ দিকিনি–
তারপর মা বলতে লাগলো-ও-রকম আমি অনেক দেখেছি, এক-কাপড়ে এত টুকুন ছেলেকে নিয়ে আমি বিধবা মানুষ গা ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলুম, আমায় তো কত ভয় দেখিয়েছিল জ্ঞাতি-কুটুমরা, কউ আমি তোর মতন ভয় পেয়েছি তখন? ভয় পেলে আর এই ছেলেকে মানুষ করতে হতো না।
সত্যিই কী করে যে মা মানুষ করতো তাকে! পরের সংসারের সমস্ত কাজ করে মা কত দিক দেখেছে। কোথায় ইস্কুলের হেডমাস্টারকে বলে ফ্রি করে দিয়েছে মা। নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে চিড়িয়াখানায়। বাঘ-সিংহ-হাতি দেখিয়েছে। বাঁদরকে ছোলা খাইয়েছে। মা তাকে কত শিখিয়েছে। মা-ই তো তাকে কালীঘাট ব্যায়াম-সমিতিতে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। আজ যদি মা বেঁচে থাকতো! দীপঙ্করের এক-একবার মনে হতো মা বেঁচে থাকলে কি তাকে দেখে খুশী হতো! মা কি তার পদমর্যাদা দেখে খুশী হতো! তার এই সেন-সাহেব হওয়াই কি মা চেয়েছিল। মা চেয়েছিল ছেলেকে মানুষ করতে। কিন্তু মানুষ কি সে হয়েছে? একেই কি মানুষ হওয়া বলে? এই চাকরিতে প্রমোশন? এই ডি-টি-আই, এই ডি-টি-এস?
মনে আছে একবার এক কাণ্ড হয়েছিল। কালীঘাট ইস্কুলের ছাত্র তখন সে। কালীঘাট ইস্কুলের ফ্রি-স্টুডেন্ট। ছেলেদের থিয়েটার হবে। মাকে বলে গিয়েছির দীপঙ্কর ফিরতে একটু রাত হবে। থিয়েটার হলো ‘বিসর্জন’। সন্ধ্যে ছ’টার পর সমস্ত ইস্কুলটা ভর্তি হয়ে গেল ছেলেদের ভিড়ে। দীপঙ্কর গিয়ে বসেছিল সকলের সামনে। কিরণও ছিল পাশে। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা থিয়েটারে পার্ট করবে। ঢং করে ঘণ্টা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে ড্রপ সিন্ উঠলো। ওঃ, সে এক জগৎ! দেখতে দেখতে কোথায় কত দূরে যে তলিয়ে গেল দীপঙ্কির। মনে হলো সে যেন আর নেই। সেই আলো, সেই ভিড়, সেই ঘণ্টার শব্দ, সেই কালীঘাট, সেই সব কিছু পেরিয়ে সে তখন আর এক জগতে গিয়ে হাজির হয়েছে।
কিরণ মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছিল–
কিন্তু দীপঙ্করের সেসব দিকে খেয়ালই ছিল না। মনে হচ্ছিল প্রাণমথবাবু যেন একদিন এই কথাই বলেছিলেন তাদের কাসে। একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীতে রাজাও ছিল না, রাজ্যও ছিল না, দণ্ডও ছিল না, দণ্ডদাতাও ছিল না–কিন্তু ক্রমে একদিন মোহ এল, ধর্ম লোপ পেয়ে গেল পৃথিবী থেকে। দেবতারাও ভয় পেয়ে গেলেন। তারা ছুটলেন ব্রহ্মার কাছে–
দীপঙ্করের মনে হলো আবার যেন সেই অবস্থা এসেছে। আবার যেন রাজা অত্যাচার শুরু করেছে। পৃথিবীতে। এ-রাজা অন্যায় করে, এ-রাজা অত্যাচার করে, এ রাজা হত্যা করে। কিন্তু এবার কে এর প্রতিকার করবে? কোথায় এখন প্রতিবিধান এর? দেবতারা এখন কোথায়? ব্রহ্মার কাছে কারা যাবে? কে সৃষ্টি করবে পৃথু রাজাকে? কোথায় সেই বিষ্ণুর অবতার?
থিয়েটার দেখতে দেখতে দীপঙ্করের চোখ দিয়ে ঝর-ঝর করে জল পড়তে লাগলো। মনে হলো অপর্ণার সঙ্গে যেন দীপঙ্করও কেঁদে উঠলো একসুরে। বললে–
মা তুমি নিয়েছ
কেড়ে দরিদ্রের ধন! রাজা যদি চুরি
করে, শুনিয়াছি নাকি, আছে জগতের
রাজা,–তুমি যদি চুরি কর, কে তোমার
করিবে বিচার!
সত্যিই তো, কে বিচার করবে! রাজা যদি অত্যাচার করে, কার কাছে বিচার-প্রার্থনা করবে? কোথায় সেই জগতের রাজা? বিন্তিদির বিয়ে যদি অঘোরদাদু না দেয় তো কে দেবে? কিরণের বাবার যদি অসুখ না সারে তো কার কাছে কিরণ প্রতিকার চাইবে? কোথায় সেই জগতের রাজা? কী করে তাঁকে দেখা যায়? কোথায় কোন্ রাজ্যে থাকেন তিনি? মা বলেছিল–মাকে মন দিয়ে ডাকলে মা শুনতে পান। শুধু মা নয়, ওই গণেশ, ষষ্ঠী, ভুবনেশ্বরী, মধুসূদন যত ঠাকুর আছে কালীঘাটে সবাই শুনতে পান। কিন্তু ঠাকুরগুলোর চেহারাগুলো যেন কেমন লাগতো দীপঙ্করের। দেখতে মোটে ভালো নয়। সেবার সেই এক সাধু এসেছিল কালীঘাটে। সেই অনেকদিন আগে। কী বিরাট সাধু এসেছিল একটা! আগাগোড়া ন্যাংটা। সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল একশো উট, পঞ্চাশটা ঘোড়া, তিরিশটা হাতি। সমস্ত কালীঘাট ভেঙে পড়েছিল সেদিন সেই সাধুকে দেখতে। মা’র সঙ্গে দীপঙ্করও গিয়েছিল দেখতে। বাবার মন্দিরের চাতারের সামনে ঠিক নাটমন্দিরের দক্ষিণে যেখানে একটা হাড়িকাঠ পোঁতা আছে সেইখানে এসে দাঁড়িয়েছিল সাধুটা–
একটা একটা করে পাঁঠা এনে হাড়িকাঠে ঝুলিয়ে দিয়ে বলি হচ্ছিল।
কত লোক সেই হাড়িকাঠে এসে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে। তলার মাটিটা আঙুলে ছুঁয়ে জিভে ঠেকায়।
একটা পাঁঠা নিয়ে এসে যেই কামারটা বলি দিতে যাবে, ওমনি সাধুবাবা হাত তুলে থামতে বললে। সাধু কথা বলে না। তারপর নিজের গলাটা সেই হাড়িকাঠে লাগিয়ে সাধু–
কী ইঙ্গিত করলে।
সে কী কাণ্ড! সমস্ত জায়গাটা ভরে একটা গন গন্ শব্দ উঠলো। দীপঙ্করের ভয় হয়েছিল। যদি সত্যি সত্যিই গলাটা এবার কেটে দেয় সাধুর! যদি সত্যিই বলি দেয় সাধুকে! হঠাৎ কোথা থেকে পুলিস এল, দারোগা এল। তারা এসে কী সব বললে বোঝা গেল না। ভিড়ের চোটে তখন আর শোনা গেল না কিছু। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল সমস্ত কালীবাড়ি। হৈ-চৈ হট্টগোলের মধ্যে মা শক্ত করে ধরে রইল দীপঙ্করের হাতটা।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল মাকে–পুলিস কী বললে মা?
মা বলেছিল–পুলিস পাঁঠা-বলি বন্ধ করে দেবে–
-কেন? মা বলেছিল–ওদেরও তো প্রাণ আছে, ওদেরও তো লাগে-
-কিন্তু মা-কালী যে পাঁঠা খায়, মা-কালী কী খাবে তাহলে?
মা বলেছিল–মা-কালী তো ঠাকুর, ঠাকুর-দেবতারা কিছু না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারেন।
মা সেদিন জানতো না। জানতো না যে দেবতার নাম করে যারা ঠকায়, দরকার হলে দেবতার নাম না করেও তারা ঠকাতে পারে। যারা সত্যিকারের অত্যাচার করতে জানে তাদের কোনও উপলক্ষ্যের অভাব হয় না। তাছাড়া কেউ দেবতার নাম করে অন্যায় করে, কেউ রাজার নাম করে অন্যায় করে, কেউ আবার দেশের নাম করেও অন্যায় করে। ও একই কথা। দেবতা হোক, রাজা হোক আর দেশই হোক। আসলে ওটা উপলক্ষ্যই। পাঁঠা নিরীহ জীব, তাই কিছু বলতে পারে না। কিন্তু মানুষও কি নিরীহ? অঘোরদাদু ঠাকুরের নামে যজমানদের ঠকায়, কিন্তু কোনও যজমানই তো তার জন্যে কোনও দিন প্রতিবাদ করেনি?
একদিন দীপঙ্কর অঘোরদাদুকে জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা অঘোরদাদু, তুমি যজমানদের যে ঠকাও তা তারা কিছু বলে না?
অঘোরদাদু বোধ হয় সেদিন ভালো প্রণামী পেয়েছিল। মেজাজ খুশী ছিল তার। বললে–দূর মুখপোড়া, বলবে কেন? তারাও যে ঠকায়!
-কাদের ঠকায় তারা? ঠাকুরদের?
-দূর, দূর, আমার উকীল-যজমানরা ঠকায় মক্কেলদের, ডাক্তার-যজমানরা ঠকায় রোগীদের–
-আর মক্কেলরা কাদের ঠকায়? রোগীরা কাদের ঠকায়?
অঘোরদাদুর বুদ্ধি দেখে সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। অঘোরদাদু সব জানতো। মা’র চেয়েও বেশি জানতো। কাকাবাবুর চেয়েও বেশি জানতো। হয়তো প্রাণমথবাবুর চেয়েও বেশি জানতো। চোখে দেখতে পেত না অঘোরদাদু, কানেও শুনতে পেত না; কিন্তু আশ্চর্য, এতও জানতো!
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল–তাহলে পৃথিবীতে সবাই-ই সবাইকে ঠকায় বলতে চাও?
অঘোরদাদু বলেছিল–হ্যাঁ রে হ্যাঁ মুখপোড়া–সবাই সবাইকে ঠকায়। আমি ঠকাই বিন্তি কে, বিন্তি ঠকায় ছিটেকে, ছিটে ঠকায় ফোঁটাকে।
দীপঙ্কর বলেছিল–আমি কিন্তু কাউকে ঠকাবো না অঘোরদাদু-দেখো–
অঘোরদাদু বলেছিল–কেন রে মুখপোড়া, তউ ঠকাবি তোর মাকে, তোর মা আবার ঠকাবে আমাকে–
দীপঙ্কর বলেছিল–না অঘোরদাদু, আমি কোনও দিন কাউকে ঠকাবো না, তুমি দেখে নিও–
অঘোরদাদু রেগে গিয়েছিল। বলেছিল–তবে মরগে যা তুই মুখপোড়া-না ঠকাতে পারলে তুই-ই মরবি, তুই-ই ভুগবি, আমার কী! আমার কাঁচকলা, আমার কচুপোড়া–
কিন্তু কী আশ্চর্য! অঘোরদাদুর কথা এমন করে তার জীবনে ফলে যাবে কে ভেবেছিল! লক্ষ্মণ কি একাই তার ওপর অত্যাচার করেছিল! লক্ষ্মণ কি একাই তার রাজপ্রসাদ কমলালেবু আর কদমা কেড়ে নিয়েছিল! লক্ষ্মণ কি পৃথিবীতে একজনই! এই এতদিন ধরে সংসারে বাস করে এল দীপঙ্কর, এতদিন ধরে এত দেখেশুনে এসে আজ এই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং পর্যন্ত পৌঁছিয়ে কি একজন লক্ষ্মণেরই সাক্ষাৎ পেয়েছে!
একদিন সতী বলেছিল–তুমি মানুষ নও দীপু-তুমি মানুষ হলে…… দীপঙ্কর বলেছিল কিন্তু দেবতাও তো আমি নই সতী সতী বলেছিল–তাহলে তুমি কী? দীপঙ্কর বলেছিল–তাহলে আমি কী বলো–তুমিই না হয় বলো?
সতী বলেছিল–তুমি পশু, তুমি একটা জানোয়ার দীপু, তোমার মুখ দেখলেও পাপ হয়, তুমি আর আমায় জ্বালিও না, তুমি চলে যাও এখান থেকে, তুমি বেরিয়ে যাও–
বলতে বলতে হাউহাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল। আর দীপঙ্কর সেদিন সতাঁকে সান্ত নাও দেয়নি, আশ্বাসও দেয়নি। সতাঁকে সেই অবস্থাতেই সেখানে ফেলে দীপঙ্কর চলে এসেছিল।
অথচ সেই সতীই যখন প্রথম এসেছিল কলকাতায় সেদিন সে কী দুর্যোগ! সে কি বিপর্যয়ের দিন! তবু কী সুন্দর লেগেছিল দীপঙ্করের! ঝাকড়া ঝাঁকড়া চুল। সতী খোঁপা বাঁধতে না। কোঁকড়ানো চুলগুলো বিছিয়ে থাকতো কাঁধটা জুড়ে। শাড়িটা কাঁধ থেকে ঝুলতো পিঠের ওপর। বড় সুন্দর দেখতে হতো। এই ঝাঁকড়া চুল নিয়েই ইস্কুলে যেত সতী। ওই কলেজে পড়বার সময়ও ওই চুলগুলো দেখবার জন্যে দীপঙ্কর কতবার পেছন থেকে চেয়ে থাকতো সতীর দিকে। চুলের যে অত বাহার হয় তা দীপঙ্কর আগে কখনও জানতো না। বিন্তিদির চুল ছিল না মোটে। মা বেঁধে দিত এক-একদিন। কিন্তু সতীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন তার মাথার চুলে এসে বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু লক্ষ্মীদি তো সতীরই বোন, আপন মায়ের পেটের বোন। সেই লক্ষ্মীদির কিন্তু অত চুল ছিল না। চেহারাটা দুজনের এক রকমই ছিল–তফাৎ যা কিছু ও মাথার চুলের বাহারে।
লক্ষ্মীদি একদিন নিরিবিলিতে পেয়ে ডেকেছিল দীপঙ্করকে। সেদিন ইস্কুলের ছুটি। আমড়া গাছের ডালে একটা কাক অনেকক্ষণ কা-কা করে ডেকে চলেছে।
হঠাৎ সেই দিকে নজর পড়তেই দেখলে লক্ষ্মীদি। একতলায় খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে–
দৌড়ে কাছে গেছে দীপঙ্কর।
লক্ষ্মীদি বললে–আয় ভেতরে আয়–
ভেতরে যেতেই লক্ষ্মীদি দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। লক্ষ্মীদি মাথায় বোধ হয় কী এক রকম গন্ধ তেল মেখেছিল-খুব ভুরভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে। দীপঙ্কর সোজা-সুজি চাইলে লক্ষ্মীদির মুখের দিকে। কোনও অপরাধ করেছে নাকি সে! অমন গম্ভীর-গম্ভীর মুখ যে লক্ষ্মীদির!
লক্ষ্মীদি বললে–এই, তুই চিঠিটা দিসনি কালকে–
-কেন?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। দেয়নি মানে? ঠিক লোকের হাতেই তো বরাবর চিঠি দিয়ে এসেছে সে।
বললে–কেন? রোজ যার হাতে চিঠি দিই, তাকেই তো দিয়েছি, পায়নি সে?
লক্ষ্মীদি বললে–তাহলে চিঠি পায়নি কেন সে আমাকে লিখেছে যে–
দীপঙ্কর বললে–বা রে, এতদিন ধরে এত চিঠি তোমার দিয়ে এলাম আর কালকের চিঠিটা দেব না? তুমি তো বেশ–
-তাহলে পায়নি কেন সে? কী করেছিস সে-চিঠি নিয়ে বল?
লক্ষ্মীদির চোখে যেন রাগের ছায়া ফুটে উঠলো এতক্ষণে! অনেকদিন ধরে এমন রাগ করেনি লক্ষ্মীদি।
-বল, কী করলি সে-চিঠিটা। কাকে দিয়েছিস? কোথায় রেখেছিস, বল?
দীপঙ্কর বললে–বা রে, আমার ওপর তুমি রাগ করছো মিছিমিছি, আমি তোমার চিঠি নিয়ে কী করব? এতগুলো চিঠি ঠিক লোককে দিয়েছি আর এ-চিঠিটা দেব না?
-তাহলে সে কি মিথ্যে কথা লিখেছে?
দীপঙ্কর বললে–তা আমি কি জানি?
-তুই জানিস না তো কে জানে? আমি তো তোর হাত দিয়েই চিঠিটা পাঠিয়েছি-
-তা আমি কি তোমার চিঠি খেয়ে ফেলবো বলতে চাও?
-চিঠিটা কাকে দিয়েছিস, সত্যি বল লক্ষ্মীটি—
হঠাৎ যেন আদর দেখাতে লাগলো লক্ষ্মীদি। একেবারে চিবুকে হাত দিয়ে আদর করতে লাগলো।
বললে–আমি কিছু বলবো না, মারবো না, ধরবো না, কিছু করব না, তুই বল সে-চিঠি নিয়ে কী করেছিস? কোথাও হারিয়ে গিয়েছে বুঝি?
-ওমা, হারাবে কেন? আমি তো রোজ পকেটে করে নিয়ে যাই–পকেটে করেই তো চিঠিটা কাল নিয়ে গিয়েছিলুম–
-কিন্তু চিঠির তো পাখা নেই যে উড়ে পালাবে অমনি–জানিস সে-চিঠির মধ্যে কত কথা লেখা ছিল, সেটা যদি কারোর হাতে পড়ে? কেউ যদি দেখতে পায়?
দীপঙ্কর হঠাৎ যেন একটু সোজা হয়ে মাথা উঁচু করলো।
বললে–কিন্তু কেন তুমি চিঠি লেখো ওকে লক্ষ্মীদি? ও তোমার কে?
লক্ষ্মীদি হঠাৎ যেন থতমত খেয়ে গেল।
দীপঙ্কর বললে–লোকটা রোজ সকালে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকে তোমার চিঠির জন্যে, কেন, বাড়িতে আসতে পারে না? বাড়িতে সকলের সামনে তুমি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারো না? আর এত তোমাদের কী কথা গো যে, রোজ রোজ চিঠি লিখতে হয়?
লক্ষ্মীদি অনেকক্ষণ গম্ভীর থেকে বললে–তুই নিশ্চয়ই চিঠি পড়েছিস আমার-না?
দীপঙ্কর বললে–তোমার চিঠি আমি কেন মিছিমিছি পড়তে যাবো, আমার দায় পড়েছে তোমার চিঠি পড়তে–কিন্তু ও-লোকটা তোমাদের বাড়ি আসতে পারে না?
লক্ষ্মীদি বললে–ঠিক বলছিস তুই আমার চিঠি পড়িস না?
-সত্যি বলছি লক্ষ্মীদি, আমি তোমার একখানা চিঠিও পড়িনি!
-ঠিক বলছিস তো?
-বলছি আমি মিথ্যে কথা বলি না!
-কিন্তু তবে ও চিঠি পেলে না কেন?
লক্ষ্মীদি কেমন যেন ভাবনায় পড়লো। মনে হলো যেন আকাশ-পাতাল অনেক কিছু ভাবছে।
হঠাৎ বললে–পরশু সকালবেলা আর একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারবি?
দীপঙ্কর বললে–কেন পারবো না।
-তাহলে যাবার আগে আমার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে যাস, কেমন?
দীপঙ্কর বললে—বেশ—
বলে দীপঙ্কর চলেই আসছিল, হঠাৎ লক্ষ্মীদি আবার ডাকলো-শোন্ দীপু—
দীপঙ্কর থমকে দাঁড়াল।
লক্ষ্মীদি বললে–দাঁড়া, আমি এখুনি আসছি–
বলে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। তারপর খানিক পরেই আবার তর তর করে এক দৌড়ে নেমে এল। একেবারে হাঁফাতে হাফাতে দৌড়ে এসেছে সামনে।
বললে–এই নে।
হাত বাড়িয়ে লক্ষ্মীদি আবার এক মুঠো চকোলেট গুঁজে দিতে এল দীপঙ্করের হাতে।
দীপঙ্কর হাতটা পেছনে সরিয়ে নিয়ে বললে–কী?
লক্ষ্মীদি বললে–সেদিন যা দিয়েছিলুম,–
দীপঙ্কর বললে–তোমার ও চকোলেট আমি নেবো না—
লক্ষ্মীদি চমকে উঠলো যেন। বললে–কেন? নিবি না কেন? চকোলেট খাস্ না তুই?
দীপঙ্কর বললে–খাই, কিন্তু তোমার কাছ থেকে নেবো না–
-কেন? আমি কী দোষ করলাম?
দীপঙ্কর বললে–সেদিনকার সে-চকোলেটও আমি খাইনি। তুমি যেমন দিয়েছ আমি তেমনি রেখে দিয়েছি–তুমি আমায় চকোলেট আর দিও না লক্ষ্মীদি।
-কেন? কী হলো?
দীপঙ্কর বললে–তুমি চকোলেট না দিলেও আমি তোমার চিঠি দিয়ে আসবো যতদিন দিতে বলবে ততদিন দেব-তুমি যে কাজ করতে বলবে সব আমি করবো কিন্তু চকোলেট তুমি দিও না আমায় তোমার পায়ে পড়ি–
লক্ষ্মীদি বললে–কেন রে? কী হলো বল না?
দীপঙ্কর বললে–তুমি ভাবো চকোলেট না দিলে আমি তোমার চিঠি দিয়ে আসবো না, না?
লক্ষ্মীদি বললে–তা চিঠি দিয়ে আসিস না, ভালোই তো–কিন্তু চকোলেট নিতে কী হয়েছে?
দীপঙ্কর বললে–না দিয়েই দেখ না, চিঠি দিয়ে আসি কি না।
লক্ষ্মীদি হেসে কাছে সরে এল। দু’হাত দিয়ে দীপঙ্করের মুখটা ধরে আদর করতে করতে বললে–কেন রে? আমার কাজ করতে তোর এত ভালো লাগে কেন রে?
দীপঙ্কর মুখটা নিচু করে বললে–এমনি–
-কিন্তু আমি যে তোকে কত মারি? তবু আমার ওপর তোর রাগ হয় না?
দীপঙ্কর কিছু উত্তর দিলো না। লক্ষ্মীদির বুকের ভেতর মুখ গুঁজে থাকতে খুব ভালো লাগছিল। কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছিল লক্ষ্মীদির গা থেকে।
লক্ষ্মীদি বলতে লাগলো–আর আমি তোকে মারবো না, জানিস—
বলে দীপঙ্করের হাতের মধ্যে চকোলেটগুলো গুঁজে দিলে।
বললে–আমি বলছি চকোলেটগুলো তুই নে, আমি দিচ্ছি, নিতে হয়-ছিঃ লক্ষ্মীটি–
দীপঙ্কর চকোলেটগুলো নিলে। এবার আর আপত্তি করলে না নিতে।
লক্ষ্মীদি বললে–পরশুদিন সকালবেলা চিঠিটা দিয়ে আসবি তো ঠিক?
দীপঙ্কর বললে–দেব
লক্ষ্মীদি বললে–এবার যা তুই—
তারপর একটু থেমে বললে–মনে থাকে যেন পরশুদিন সকালবেলা–
বলেই লক্ষ্মীদি চলে গেল ওপরে। আর দীপঙ্কর খিড়কির দরজাটা পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। ঝা ঝা করছে রোদ উঠোনে। কাকটা তখনও অকারণে ডাকছে কা-কা করে। মা এখনও ঘুমোচ্ছে। আমড়া গাছটার ছায়ার তলায় খানিকক্ষণ দাঁড়াল দীপঙ্কর।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই রইল। গরমের দুপুরে সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে হয়তো, অঘোরদাদুও হয়তো বেরোতে পারেনি সেদিন। চনীও সকাল সকাল কাজ টাজ সেরে নিয়ে হয়তো তার দরজা বন্ধ করে ঝিমোচ্ছে। বিন্তিদি তার একতলার ঘরটাতে কী করছে কে জানে। ছিটে-ফোঁটা এক সময়ে খেয়ে নিয়ে কোথায় গিয়ে হয়তো আড্ডা জমাচ্ছে। হয় পাথরপটির কোনও তবলার দোকানে, নয়ত আরো দূরে বাজারের উত্তরের কোনও খোলর ঘরের বস্তিতে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের দুপুরবেলার একটা নিজস্ব রূপ ছিল। এধারে ওধারে গোলপাতার চালাঘর। অনেক দূরে নীল আকাশটার গায়ে কয়েকটা চিল উড়ছে ঘুরে ঘুরে-তাদের ছাদের মাথায় তখন একটা বাঁশের ডগায় একটা ঘুড়ি আটকে গিয়ে ঝুলছে। রাস্তা দিয়ে আর একটু পরেই বাসনওয়ালারা একে একে ঢং ঢং করে কাঁসি বাজাতে বাজাতে যাবে। তারপর আসবে কাঠি বরফ। তারপর আসবে রাস্তার জল দেবার গাড়ি। তারপর ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজবে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিকেল হয়ে যাবে কালীঘাটে।
কিন্তু অনেকক্ষণ সেই আমড়া গাছটার তলায় দাঁড়িয়েও দীপঙ্কর কী করবে বুঝতে পারলে না। কেন লক্ষ্মীদি তাকে এত আদার করলে আজ। তার মুখটা ধরে তার চিবুকটা ধরে কত আদর করেছে। তখনও যেন বাতাসে লক্ষ্মীদির গায়ের মিষ্টি গন্ধটা লেগে রয়েছে। হঠাৎ দীপঙ্করর মনে হলো দুপুরটা যেন অন্য দিনের মতো নয়। এ-দুপুরটা যেন একটু বেশি মিষ্টি মিষ্টি। কাকটার ডাকও যেন আর তত কর্কশ নয়। নীল আকাশের একেবারে মাথায় যে চিলগুলো ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে তারাও যেন আর চিল নয় দীপঙ্করের মনের সব ইচ্ছে। দীপঙ্করের মনের ইচ্ছেগুলোই যেন চিল হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। বড় চমৎকার লাগলো দীপঙ্করের সেই গ্রীষ্মের দুপুরটা। এমন তো কখনও হয় না। এমন তো হয় না কখনও। আমড়া গাছের তলাটায় ছায়ায় রোদের নিচেয় দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর যেন বড় তৃপ্তি পেলে মনে। তারপর হঠাৎ গাছের দিকে চাইতেই দেখলে কাকটাও তার দিকে যেন একদৃষ্টে চেয়ে আছে। এতক্ষণ কা-কা করে ডাকছিল, এখন আর ডাকছে না। তার দিকে চেয়ে চেয়ে যেন কী ভাবছে আপন মনে। ও-কাকটাও তার মতো আজ একলা।
-এই আঃ আঃ আঃ—
হাতটা বাড়িয়ে ডাকতে লাগলো দীপঙ্কর।
কাকটা প্রথমটায় একটু চমকে উঠেছিল। পালিয়ে যাবার জন্যে পাখা-ঝাঁপটা দিচ্ছিল। কিন্তু কী ভেবে আবার থেমে গেল। আবার দীপঙ্করের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
দীপঙ্করের মনে পড়লো এই কাকটাই যেন সেদিন তার পাত থেকে ছোঁ মেরে ভাত নিয়ে গিয়েছিল। এই কাকটাই বোধ হয় অঘোরদাদুর ঘরে ঢুকে চাল-কলা-সন্দেশ খেয়ে যায় রোজ। ওই হাজি কাশিমের বাগানের কোণে কতকগুলো নারকোল গাছ আছে, ওইগুলোতেই বোধ হয় থাকে এই কাকটা। সেদিন এই কাকটাই বোধ হয় চিলেকোঠার ঘুলঘুলি থেকে পায়রার ডিম খেয়ে ফেলেছিল। বড় বদমাইশ কাক এটা। অনেক দিন দীপঙ্কর দেখেছে ওই কাকটার সঙ্গে একটা বাচ্চা কাক থাকে। গায়ে তার ভালো করে পালক ওঠেনি তখনও। মুখটা হাঁ করে কা কা করে চেঁচায়। আর কোথা থেকে এই ধাড়ি কাকটা একমুখ খাবার এনে বাচ্চাটার মুখে গুঁজে দেয়। বাচ্চাটার মুখে ভেতরটা লাল টক টক করে। বোধ হয় বাচ্চাটা একেবারে কচি। তারপর একদিন সকালবেলা ফুল তুলতে গিয়ে দেখে বাগানে অনেকগুলো কাক একেবারে একসঙ্গে কা-কা করে চারদিক মাত করে তুলেছে। প্রায় একশো দু’শো তিনশো কাক জড়ো হয়েছে। প্রথমটায় দীপঙ্কর কেমন ভয় পেয়েছিল। এত কাক ভোরবেলা কিসের সভা বসিয়েছে। গাছের নিচু নিচু ডালের ওপর বসে ব্যস্ত-এস্ত হয়ে কা-কা করছে সবাই। একবার এ-ডালে যাচ্ছে একবার ও-ডালে যাচ্ছে। হৈ-চৈ হল্লার অন্তর নেই।
প্রথমটায় বুঝতে পারেনি দীপঙ্কর। তারপরকাছে গিয়ে দেখলে একটা বাচ্চা কাক কাদার ওপর চিত হয়ে মরে পড়ে আছে। তার পালকগুলো চারদিকে ছড়ানো। চোখ খোবলানো। আহা, কে মারলে বাচ্চাটাকে। বাজপাখি?
তারপর থেকে বাচ্চাটাকে আর দেখতে পায়নি দীপঙ্কর। এই ধাড়ি কাকটাই তারপর থেকে একলা এসে বসে আমড়া গাছটার ডালে আর একলা একলা চেঁচায়। একলাই অঘোরদাদুর ঘরে ঢুকে চাল-কলা-সন্দেশ ছোঁ মারবার চেষ্টা করে, মা’র রান্নাঘরে এটো-কাঁটায় মুখ দেয়। ভাতের থালা, মাছের আঁশের দিকে নোলা দেয়। মা কাকটাকে দেখলেই হাতটা উঁচু করে তাড়া করে–হুঁশ-শ-শ। কিন্তু কাকটা বেশি দূর পালায় না। ওই আমড়া গাছটার ডালের ফাঁকে এসে বসে। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে আর সময়ে অসময়ে কা-কা করে ডাকে।
দীপঙ্কর আবার ডাকলে–এই আঃ আঃ আঃ–
কাকটার তখনও সন্দেহ যায়নি। ঘাড় কাত করে দেখতে লাগলো দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর এক মুঠো চকোলেট নিয়ে সোজা ছড়িয়ে দিলে সামনের উঠোনে।
-খা তুই, সবগুলো খা, তোকে আমি এমনিই সব দিলাম, সব তোর, পেট ভরে খেয়ে নে-লক্ষ্মীদি যত চকোলেট দেবে সব তোকে দেব এবার থেকে-আঃ আঃ।
কাকটা ভয়ে ভয়ে গাছ থেকে উড়ে এসে নামলো উঠোনে।
–আমার চকোলেট দরকার নেই রে, লক্ষ্মীদির চিঠি এমনিই দিয়ে আসবো, চকোলেট দিলেও দিয়ে আসবো, লক্ষ্মীদিকে যে আমার ভালো লাগে, এগুলো তুই খা, তুই খা এগুলো—
ভোর বেলা উঠতেই মা বললো রে, এত ভোরে যাচ্ছিস, আজ আর না-ই গেলি–
দীপঙ্কর বললে–আমি দৌড়ে গিয়ে দিয়ে আসবো মাগলির ভেতর দিয়ে গিয়ে দিয়ে আসবো একদৌড়ে–
মা বললে কিন্তু যা মেঘ করেছে, এখুনি বৃষ্টি নামবে–দেখিস–
আকাশের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। যেন রাত চারটে বেজেছে মনে হচ্ছে এমন অন্ধকার। এখান থেকে মন্দিরের ঘণ্টা শোনা যায়। পুজো হচ্ছে চণ্ডীবাবুদের মন্দিরে। চণ্ডীবাবুদের বাড়িতে রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রহ ছিল। তেমন জাক-জমক হতো না অন্য সময়। শুধু জন্মাষ্টমী হতো ঘটা করে। কিরণ আর দীপঙ্কর কত দিন জন্মাষ্টমীর দিন গিয়ে বাতাসা খেয়ে এসেছে। যে যেত তাকেই বাতাসা প্রসাদ দেওয়া হতো সেদিন।
যেদিন সেই কালীঘাট ইস্কুলে ‘বিসর্জন’ থিয়েটার দেখে ফিরছিল, তখন অনেক রাত। অনেক রাত্রে থিয়েটার ভাঙলো। সেদিন এই চণ্ডীবাবুর বাড়ির পাশেই ভূত দেখেছিল দীপঙ্কর।
একেবারে জ্যান্ত ভূত।
সংসারে বড় হয়ে অনেকবার অনেক ভূত দেখেছে দীপঙ্কর। কিন্তু সেদিন যে-ভূত দেখেছিল তার বোধহয় তুলনা হয় না।
তখনও ‘বিসর্জন’ থিয়েটারের সেই কথাগুলো যেন কানে বাজছে দীপঙ্করের। সেই প্রাণমথবাবুর গল্পটা যেন মনে পড়লো। সেই কোন্ সত্যযুগেরও আগে পৃথিবীতে রাজা ছিল না, দণ্ড ছিল না। সকলে ধৰ্ম আশ্রয় করে পরস্পরকে রক্ষে করতো। তারপর একদিন মোহ এল, লোভ এল, ক্রোধ এল। তার থেকে এল আসক্তি। লোকের কাণ্ডজ্ঞান চলে গেল। বেদ লোপ পেল। যাগযজ্ঞ আর কেউ করে না। দেবতারা তখন যজ্ঞের নৈবিদ্যি খেয়ে বেঁচে থাকতো। তারাও উপপাসী হয়ে রইল।
এমন সময় দেবতারা সবাই ব্রহ্মার কাছে দরবার করলেন।
ব্রহ্মা বললেন–তোমরা বিষ্ণুর কাছে যাও–তিনি এর বিধান করবেন—
শেষে দেবতারা গেলেন বিষ্ণুর কাছে।
বললেন–পৃথিবীর লোকেরা কেউ আর যজ্ঞ করে না, বেদ পড়ে না–আমরা কী খেয়ে বাঁচি, আপনি এর বিধান করুন–
বিষ্ণু বললেন–তোমরা বাড়ি যাও–আমি এর বিধান করছি–
শেষ পর্যন্ত বিধান হলো। কী বিধান? না, পৃথিবীতে একজন রাজা সৃষ্টি করলেন তিনি।
বললেন–এবার আর কোনও ভয় নেই, এবার এই রাজাই সমস্ত মানুষকে শাসন করবে। যারা দুষ্ট তাদের দমন করবে, আর যারা শিষ্ট তাদের পালন করবে।
এমনি করেই পৃথু রাজার সৃষ্টি হলো। পৃথিবীতে শান্তি ফিরে এল। আনন্দ ফিরে এল। ধর্ম ফিরে এল। সব ফিরে এল। আবার সুখে-শান্তিতে বাস করতে লাগলো পৃথিবীর লোক।
কিন্তু হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটলো আবার।
কিরণও থিয়েটার দেখে ফিরে আসছিল সঙ্গে সঙ্গে।
বললে–জানিস দীপু, ইংরেজরাই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। ওরা চলে গেলেই দেখবি বেড়ে আরামে থাকবো আমরা, তখন আর কিছু কিনতে টাকা লাগবে না দেখবি–
দীপঙ্কর বললে–কে বললে তোকে?
কিরণ বললে–আমি মিটিং-এ গিয়ে লোর শুনে এসেছি। সেদিন একজন বলছিল মিটিং-এ, এত সমুদ্র আছে আমাদের দেশের চারদিকে, আমরা সেই সমুদ্রের জল নিয়ে নুন তৈরি করবো আর খাবো-এখনকার মতো নুন কিনতে আর পয়সা লাগবে না–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু অত নুন নিয়ে কী হবে!
কিরণ বললে–নুনটাই তো আসল রে, আমি তো এক-একদিন শুধু নুন দিয়ে বাত খেয়ে ইস্কুলে আসি, শুধু নুন আর ভাত, যেদিন নুন থাকে না সেদিন ভাত খেতে পারি না মোটে–
দীপঙ্কর বললে–তোর বাবা এখনও ভালো হয়নি? কিরণ বললে–দাঁড়া না, আগে স্বরাজ হোক তবে তো-আর তো বেশি দেরি নেই–
কবে কেমন করে যে স্বরাজ হবে তা কিরণ জানতো না। শুধু পার্কে গিয়ে বক্তৃতা শুনতো আর এসে বলতো দীপঙ্করকে। আর বক্তৃতা শুনে এসেই গরম হয়ে উঠতো। টগ বগ করে ফুটতো কিরণের রক্ত। কিরণ যেন ছটফট করতে কদিন ধরে। তার মুখে আর কোনও কথা নেই সে কদিন। রাগলে কিরণের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠতো কেমন। ফরসা চেহারা ছিল কিরণের। ময়লা জামা-কাপড়ে সে রংটা সব সময় ধরা যেত না। কিন্তু একটু ফরসা জামা-কাপড় পরলেই আবার যেন অন্যরকম হয়ে উঠতো তার চেহারা।
থিয়েটার দেখে ফেরার পথে অন্ধকার কালী লেনের মধ্যে দিয়ে আসছিল সেদিন দুজনে। কালী লেনের গলিটা পেরিয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলী ফার্স্ট লেন। সেইখানটা এসে কিরণ অন্যদিকে যাবে। আর দীপঙ্কর সোজা যাবে নিজের বাড়ির দিকে। রাস্তাটা নির্জন হয়ে গেছে। একটাও লোক দেখা যায় না।
কিরণ থামলো এবার।
বললে–এবার তুই ঠিক যেতে পারবি দীপু?
দীপঙ্কর বললে–পারবো।
-ভয় পাবি না?
দীপঙ্কর বললে–না, ভয় কিসের?
-তাহলে তুই যা, আমি বাড়ি যাই–
কিরণ চলে গেল। দীপঙ্কর সামনের দিকে একবার চেয়ে দেখলে। টিম টিম্ করে সামনের বাঁকের মুখে গ্যাসটা জ্বলছে। তারপর ওই গ্যাসটা পেরিয়েই তাদের বাড়ি। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন। আবার নিজের মনেই তার মনে পড়তে লাগলো থিয়েটারের কথাগুলো। সে-ও যেন এ-সংসারে অপর্ণা হয়ে গেছে–সে বললে–
মা তুমি নিয়েছ
কেড়ে দরিদ্রের ধন! রাজা যদি চুরি
করে, শুনিয়াছি নাকি, আছে জগতের
রাজা,-তুমি যদি চুরি কর, কে তোমার
করিবে বিচার!
থিয়েটারের কথাগুলো পুরো মনে ছিল না। সত্যিই তো রাজারও তো রাজা আছে। জগতের রাজা। যে সব অপরাধের বিচার করে। সব অপরাধের শাস্তি দেয়, সব অপরাধ ক্ষমা করে! সেই জগতের রাজা যদি অন্যায় করেকে তা বিচার করবে?
হঠাৎ মনে হল চণ্ডীবাবুদের বাড়ির ঠিক পাশের বাগানেই যে কী একটা নড়ে উঠলো।
-কী? ওটা কী?
জায়গাটা বেশ অন্ধকার। অন্ধকার আরো ঘন হয়ে এসেছে ঠিক বাগানটার কাছে। আর একটু এগোতে পারলেই এক দৌড়ে বাড়িতে যাওয়া যাবে। কিন্তু চলতে গিয়েও কেমন যেন চলতে পারলে না দীপঙ্কর। পা দুটো থেমে এল হঠাৎ। সমস্ত গা’টা কেমন ছছ করে উঠলো। পা দুটো থর থর করে কাঁপতে লাগলো।
-কী ওটা কী ওখানে?
মনে হলো যেন একটা ভূত দাঁত বের করে তার দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে আর মাথা নেড়ে নেড়ে হাসছে। সেই নিঃশব্দ হাসিটা যেন সমস্ত লেনটা একেবারে মুখর করে তুলল। আর সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্করের সমস্ত শরীর যেন বরফের মতো হিম হয়ে গেল এক মুহূর্তে। দীপঙ্কর প্রাণপণে আর্তনাদ করতে চেষ্টা করলো সমস্ত শক্তি দিয়ে কিন্তু ছায়ামূর্তিটা সেই অন্ধকারের মধ্যেই আরো জোরে বিকট এক হাসি হেসে উঠলো। আর সেই নিঃশব্দ হাসির প্রতিধ্বনিতে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সমস্ত অন্ধকারের কালো পর্দাগুলো ছিঁড়ে একেবারে খা খা হয়ে গেল।
মা জেগেই ছিল। বাইরে শব্দ হতেই দরজাটা খুলে দিয়েছে।
-কে? খোকা এলি? এত রাত হলো যে? কিন্তু দীপঙ্করের মুখের দিকে চেয়ে মা অবাক হয়ে গেছে। দীপঙ্করের মুখ যেন বোবা হয়ে গেছে। ঘাম ঝরছে সারা গায়ে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই একেবারে মাকে জড়িয়ে ধরেছে দুহাতে।
-কী রে, কী হয়েছে রে তোর?
দীপঙ্কর বললে–মা, আমি ভূত দেখেছি—
ভূত!
মা যেন অবাক হয়ে গেল। দীপঙ্করকে তক্তপোশের ওপর বসিয়ে পাখার হাওয়া করতে লাগলো। থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল হঠাৎ এ কী হলো ছেলের!
জিজ্ঞেস করলে–থিয়েটার দেখেছিস?
দীপঙ্কর হাঁপাতে হাঁপাতে বললে–থিয়েটার দেখে আসছি হঠাৎ চণ্ডীবাবুদের বাড়ির কোণে দেখি একটা ভূত আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে মা–
মা হেসে উঠলো। বললে–দূর, কী দেখতে কী দেখেছিস-ভূত-টুত বাজে কথা ভূত কোথায়? ভূত বলে কিছু নেই, এত বয়স হলো, এখনও তোমার ভূতের ভয়?
দীপঙ্কর বললে–না মা, আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি–আমার দিকে চেয়ে ভূতটা হাসছিল যে–তুমি চলো তোমাকেও দেখিয়ে দিতে পারি–
–চল্ তাহলে–কোথায় তোর ভূত দেখি–
সেদিন সেই রাত্রেই মা দীপঙ্করকে নিয়ে বেরিয়েছিল। রাত তখন বারোটাও হতে পারে, একটাও হতে পারে। কালীঘাটের সব লোক তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর নিম্নতি চারিদিকে। রাস্তায় জন-মানব নেই। চণ্ডীবাবুদের বাড়িটা তিরিশ নম্বর। তিরিশ নম্বর ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন। গলির মধ্যেই তিনমহলা বাড়ি। চণ্ডীবাবুদের বাড়িতে জন্মাষ্টমীর মেলা দেখতে অনেকবার মা’র সঙ্গে গিয়েছে। বিরাট বাড়ি। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। রাসলীলা হয় ভেতরে পুজোর দালানের উঠোনে। লাল-নীল-সবুজ ডুম জ্বলে সখীদের হাতে। অষ্ট সখী, বিশাখা, রুক্মিণী কত রকম ঠাকুর। গলির মধ্যেই সেদিন তেলেভাজা পাপরভাজার দোকান বসে যায়। লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায় উঠোনটা। উঠোনের চারধারে কৃষ্ণলীলার সব পুতুল। কালীয়দমন। শ্রীকৃষ্ণের বস্ত্রহরণ, কংসবধ, পূতনা-রাক্ষসী-কত রকমের পুতুল সব। সেই পুতুল দেখতে দেখতে দোলমঞ্চের কাছে গিয়ে দাঁড়াত। একটা ইলেকট্রিকের দোলনায় রাধা-কৃষ্ণ দুলছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের একটা করে বাতাসা-প্ৰসাদ দিত সেখানে।
পুজোর সময় বেশ ভিড় হতে চণ্ডীবাবুদের বাড়ি। কিন্তু অন্যসময়ে, রাসবাড়িটা অন্ধকার থাকতো। লোকজন বেশি যেত না কেউ, ফাঁকা উঠোনটায় দু-চারজন বাড়ির ছেলে-মেয়ে বিকেল বেলা এক্কা দোক্কা খেলতো। একবার এই চণ্ডীবাবুই দীপঙ্করকে তাড়া করেছিলেন।
তখন আরো ছোট। ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলে পড়তো তখন। ভবানীপুরে তখন কোথাও একটা কী কাণ্ড হয়েছে। এই বিকেল ছ’টা নাগাদ। কিরণের সঙ্গে হরিশ পার্ক ছাড়িয়ে আরো অনেকদূর এগিয়ে গেছে। একেবারে পোড়াবাজারের কাছাকাছি। মাঠে। ফুটবল খেলা হচ্ছিল। ফুটবল খেলা দেখে হরিশ মুখার্জি রোড দিয়ে ফিরছে। বিকেল তখন পাঁচটা কি ছ-টা। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো। যেন বোমা ফাটলো কোথাও।
একেবারে কানে তালা-ধরবার মতো শব্দ হয়েছে। দীপঙ্করও চমকে উঠেছে। রাস্তায় যে-যেখানে ছিল সবাই চমকে উঠেছে। সবাই দৌড়তে আরম্ভ করেছে এদিকে ওদিকে।
কিরণ বললে–পালিয়ে আয় দীপু–
বলেই দৌড়েছে কিরণ।
দীপঙ্করও পালিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।
আর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার যে-যেখানে ছিল সব পালাতে শুরু করেছে। তারপর আর একটা বোমা ফাটলো। আর হঠাৎ দেখলে একটা লোক, একটা পুলিসের লোক সাইকেল চড়ে যাচ্ছিল, সে পড়ে গেল চিৎপাত হয়ে। পেছনে আর একটা লোক যাচ্ছিল সাইকেল চড়ে। তাকেও কে একটা গুলি মারলে, সে-ও পড়ে গেল চিৎপাত হয়ে। আর ঠিক দীপঙ্করদের একেবারে সামনে। গল গল করে রক্ত পড়তে লাগলো তার গা থেকে। দেখে তখন জ্ঞান হারাবার অবস্থা দুজনেরই। দুজনেই তখন ছুটছে প্রাণপণে!
সেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রীট থেকে দৌড়তে শুরু করেছিল দুজনে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল একেবারে হাজরা রোডের মোড়ের মাথায়। তখনও চীৎকার গণ্ডগোল চলছে।
কে একজন দৌড়তে দৌড়তে এসে খবর দিলে-বসন্ত চাটুজ্জেকে মেরে ফেলেছে—
-কে মেরেছে?
-স্বদেশীরা!
শুধু ওইটুকুই কানে গেছে তখন! কে বসন্ত চাটুজ্জে, কে মেরেছে তাকে, তাও শোনা হলো না। যে যেদিকে পারছে তখন ছুটছে। আর দাঁড়ানো হলো না সেখানে। সঙ্গে সঙ্গে আবার দৌড়েছে। দৌড়তে দৌড়তে একেবারে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে এসে একটু সবে হাঁপ ছেড়েছে। হঠাৎ মনে হলো ওদিক থেকে একটা লোক যেন সাইকেল চড়ে আসছে। দেখেই কেমন আঁতকে উঠেছিল দুজনে। যদি তাদের ধরে ফেলে?
হঠাৎ কিরণ বললে–পালিয়ে আয় দীপু–
সামনেই এই চণ্ডীবাবুদের রাস-বাড়ির লোহার গেটটা খোলা ছিল। কিরণ তার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে। দীপঙ্করও ঢুকেছে পেছন পেছন। ততক্ষণ সারা কলকাতায় খবরটা রটে গেছে, পুলিসের ডেপুটি-কমিশনার বসন্ত চাটুজ্জেকে স্বদেশীরা গুলি করে মেরেছে! চণ্ডীবাবু বড়মানুষ। একটা চেয়ারে বসে গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছিলেন উঠোনে।
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে আঁকলেন–রামধনি গেট বন্ কর দেও–
রামধনি কোথায় ছিল এতক্ষণ। সে দৌড়ে এসে গেট বন্ধ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই দুজনে ঢুকে পড়েছে ভেতরে।
চণ্ডীবাবু দেখতে পেয়েই উঠে এলেন।
বললেন–গেট আউট, গেট আউট–গেট আউট–
মনে আছে সেই চণ্ডীবাবুকে দেখে সেদিন কিরণ আর দীপঙ্কর সন্ধ্যের অন্ধকারে নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে গলির বাইরে আবার বেরিয়ে এসেছিল। দুটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে সেদিন আশ্রয় দেয়নি চণ্ডীবাবু। ভাগ্যের হাতে তাদের ফেলে দিয়ে তিনি নিজে হয়তো নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ভাগ্য-বিধাতা তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে দেননি।
কিন্তু সে অনেক পরের ঘটনা।
আবার সেই চণ্ডীবাবুর বাড়িতেই যেতে হবে। রাস্তায় লোকজন বিরল হয়ে এসেছে। দীপঙ্করকে নিয়ে আবার তার মা সেই পথেই চললো। শেতলাতলাটা পেরিয়ে একটা মোড় ঘুরেই চণ্ডীবাবুর বাড়ি। বাড়িটার দক্ষিণে বাগান। চারদিকে চেয়ে দীপঙ্করের তখনও ভয়-ভয় করছিল।
মা বললে–কিছু ভয় নেই, আমি তো রয়েছি—এসো–কই, কোথায় ভূত?
দীপঙ্কর যেন সামনে চোখ মেলে চাইতে পারলো। সেই অন্ধকার, অন্ধকারের মধ্যে যেন তখনও ভূতটা সেইরকম হাসছে। ঠিক সেই দাঁত বার করা হাসি হাসছে তেমনি আগেকার মতন।
দীপঙ্কর বললে–ওই দেখ–ওই তো–
মাও দেখলে খানিকক্ষণ সেইদিকে চেয়ে। এপাশ ওপাশ থেকে ভালো করে নজর করে দেখতে লাগলো মা।
দীপঙ্কর বললে–দেখলে তো, আমি বলেছিলুম
মা বললে–আচ্ছা, এদিকে এসো তো–
বলে চণ্ডীবাবুর গেটের কাছে এল। গেটের পাশেই দারোয়ানের ঘর। তারা সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু গেটের ওপর গ্যাসবাতিটা জ্বলছে দপ্ দপ করে। ঘরটার দরজা বন্ধ। সবাই ঘুমে অসাড়। রাত্তিরে, কে আর জেগে থাকবে তখন!
মা ডাকলে–রামধনি, ও রামধনি–
মা বললে–রামধনি একবার বাইরে শুনবে বাবা—
রামধনি বাইরে এল–বাইরে এসে বললে–কৌন?
মা বললে–আমি দীপুর মা বাবা–তোমাদের বাগানের দিকের আলোটা একবার জ্বালবে বাবা? ওই বাতিটা একবার জ্বালতে পারো?
রামধনি পুরোন লোক। মা-ও পুরোন লোক। রামধনি সেই অন্ধকারেই চিনতে পারলে মাকে।
বললে–কে? দীপুর মা? কী চাই গো দীপুর মা?
মা বললে–তোমাদের বাগানের দিকের আলোটা একবার জ্বালো তো রামধনি, একটিবার জ্বাললেই হবে’খন।
রামধনি আলোর সুইচটা টিপতেই বাগানের দিকটা আলো হয়ে গেল। মা দেখলে, দীপঙ্করও দেখলে। বাগানের লাউমাচার ওপর একটা বাঁশের লাঠির ওপর একটা সোলার টুপি বসানো। মুখে একটা মাটির কালো হাঁড়ি। আর গায়ে একটা ছেঁড়া শার্ট। হনুমান তাড়াবার জন্যে একটা মানুষের মূর্তি করা হয়েছে। হাওয়ায় টুপিটা দুলছে অল্প অল্প। জামাটার গায়ে ডোরা ডোরা দাগ। আশ্চর্য, অদ্ভুত! দিনের বেলা কতবার ওখান দিয়ে গিয়েছে দীপঙ্কর। কখনও নজরে পড়েনি তো!
মা রামধনিকে বললে–এবার তোমার আলো নিভিয়ে দাও রামধনি—
তারপর দীপঙ্করকে বললে–দেখলে তো, ভূত কেমন আছে দেখলে তো তুমি?
সেদিন মা-ই সেই অত রাত্রে চাক্ষুষ প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, ভূত বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। ভূত বলতে লোকে যা বোঝে তা মানুষের অলীক কল্পনা শুধু। কিন্তু যত বড় হয়েছে দীপঙ্কর ততই বুঝেছে মা ঠিক জানতো না। এককালে হয়তো ভূত বলতে কিছু ছিল না সত্যি। কিন্তু আবার ভূত হয়েছে। আবার ভূত জন্মেছে পৃথিবীতে। আবার মানুষের সংসারে অসংখ্য ভূতের আমদানি হয়েছে। তাদের চেহারা তাদের পোশাক পরিচ্ছদ সবই ঠিক মানুষের মতো কিন্তু আসলে তারা মানুষই নয়। তারাই ভূত। মানুষ নাম নিয়ে তারাই মানুষের সমাজে ঘুরে বেড়ায়। আর দরকার হলে ভয়ও দেখায়। আবার দরকার হলে চোখের আড়ালে কখনও অদৃশ্যও হয়ে যায়। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা দীপঙ্করের।
সেদিন হাজি কাশিমের বাগান থেকে তাড়াতাড়ি ফুলটা তুলে নিয়েই দৌড়েছিল মন্দিরের দিকে। প্রথমে মায়ের মন্দিরে। মায়ের মন্দিরে কয়েকটা জবা ফুল দিতে হয়। তারপর সত্যনারায়ণ, তারপর গণেশ, তারপর জগন্নাথ, তারপর ষষ্ঠীতলা আর ভুবনেশ্বরী।
দীপঙ্কর বললে–একটু তাড়াতাড়ি নিন পণ্ডিতমশাই, খুব বিষ্টি আসছে–
সত্যিই আকাশ ছেয়ে মেঘ করেছিল। নাটমন্দিরের ছাদের মাথায় মেঘটা কালো করে এসেছে একেবারে। তারপর সেই চাতালের ওপর মাথাটা ঠেকিয়েই মন্দিরটা ঘুরে গলি গিয়ে কুণ্ডুপুকুরের দরজার দিকে যাবার রাস্তা। ওপাশে জুতো রাখবার জায়গা। পেঁড়ার দোকান। পেঁড়া তৈরি হয় ভেতরে। তারপরে পুবমুখো দরজাটা।
ততক্ষণে মন্দিরে বেশ ভিড় হতে শুরু করেছে। বড় বড় গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। গাড়ি থেকে ফরসা ফরসা মাড়োয়ারী মেয়ে-পুরুষ খালিপায়ে নামছে। সঙ্গে পেছনে পেছনে ভিখিরিদের দল পিছু নিয়েছে। ফরসা পাতলা কাপড়, ফরসা টক্ টক্ করছে গায়ের রং। ওদের ভক্তি খুব। ওরা পাণ্ডাদের ভালো দক্ষিণে দেয়। ওদের দেখলে পাণ্ডারা বেশি খাতির করে। দীপঙ্করকে খাতিরই করে না মোটে। একটা পয়সাও প্রণামী দেয় না দীপঙ্কর। শুধু ফুল খেয়ে কি পেট ভরবে মা-কালীর?
হঠাৎ দু-একটা বৃষ্টির ফোঁটা টন্ টন্ করে পড়লো গায়ের ওপর।
দীপঙ্কর খিলেনটার নীচে এসে দাঁড়াল। মাথাটা ভিজবে না এখানে দাঁড়ালে। চিঠিটাও ভিজবে না। লক্ষ্মীদির চিঠিটাও পকেটে রয়েছে। ওখান থেকে যতদূর চোখ যায় ততদূর চেয়ে দেখতে লাগলো। বৃষ্টিটা পড়েই চলেছে। হয়তো ভদ্রলোক বৃষ্টির জন্যে। আসতে পারছে না। কিংবা হয়তো মেঘলা দিনে ঠিক সময়টা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। আজ কি একটু আগে এসে পড়েছে দীপঙ্কর? সাতটা কি বেজেছে? ওপাশের পেঁড়ার দোকানে একটা দেয়ালঘড়ি আছে। ঘড়িটা দেখলে হতো!
এপাশে মাথাটা বাঁচিয়ে দোকানের সামনে এসে ঘড়িটা দেখলে দীপঙ্কর। সাতটা বেজে কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে। আজ তো অন্যদিনের চেয়ে লেট হয়ে গেছে। এতক্ষণে তো এসে যাবার কথা! এমন সময়েই তো আসে সেই ভদ্রলোক। চমৎকার চেহারা কিন্তু লোকটার।
এক-একদিন সেই ভদ্রলোকই আগ এসে দাঁড়িয়ে থাকে।
দীপঙ্কর কাছে যেতেই ভদ্রলোকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
বলে–এসে গেছ খোকা?
দীপঙ্কর পকেট থেকে চিঠিটা বের করে বলে–এই নিন—
তারপর দীপঙ্করের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে খামটা ছিঁড়ে পড়তে থাকে। দীপঙ্কর ভদ্রলোকের মুখের দিকে চেয়ে দেখে সে-মুখটা যেন চিঠি পড়তে পড়তে হঠাৎ কেমন লাল হয়ে ওঠে। মুখটা খুব ফরসা। সিল্কের দামী কোট-প্যান্ট পরা। সকালবেলাই ফিটফাট সাজগোজ করে আসে। চিঠি পড়তে পড়তে পকেট থেকে একটা সিগারেটের কৌটো বার করে–তারপর দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরায়। তারপর একটা লম্বা ধোয়া ছাড়ে মুখ দিয়ে। একবার পড়া শেষ করে আবার পড়ে। আবার পড়ে। এত কী কথা লেখা থাকে লক্ষ্মীদির চিঠিতে কে জানে! দেরি হলে ভদ্রলোক আবার এক-একদিন ট্যাক্সি করে এসে নামে। নেমেই দীপঙ্করের দিকে দৌড়ে আসে। অনেক সময় চিঠিটা বার বার পড়ে পকেটে রাখে, তারপর আবার বার করে পড়ে। কতবার যে পড়ে চিঠিটা তার ঠিক নেই।
আর দীপঙ্কর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ফুলের সাজিটা হাতে নিয়ে।
শেষবারের মতো সিগারেটটায় টান দিয়ে ভদ্রলোক বলে–গুড় বয়—
বলে সোজা পূর্ব দিকে হন্ হন্ করে হাঁটতে আরম্ভ করে।
তারপর দীপঙ্কর আস্তে আস্তে কুণ্ডুপুকুরের দক্ষিণ পার দিয়ে আবার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের দিকে ফেরে। যতক্ষণ চিঠিটা দেয়, ততক্ষণ বেশ লাগে দীপঙ্করের। ভালো বাঙলা বলতে পারে না। কী জাত কে জানে! কিন্তু যেন অন্যরকম। যেন কারোর সঙ্গে মেলে না তার। কালীঘাটের কারোর সঙ্গেই মেলে না। মধুসূদনের রোয়াকে বসে যারা আড্ডা দেয়, ওই মধুসূদনের বড়দা, দুনিকাকা তাদের মতন নয়। ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলের প্রাণমথবাবু রোহিণীবাবু ওঁদের মতনও নয়। কিংবা হরিশ পার্কে মিটিং শুনতে গিয়ে যাদের দেখেছে তাদের মতনও নয় লোকটা। লোকটা অনেকটা সায়েব-ঘেঁষা। আলিপুরের ওদিকে চিড়িয়াখানার দিকে যে-সব বড় বড় সাহেবদের বাড়ি আছে, ওদিককার লোকদের মতো। চণ্ডীবাবুরাও বড়লোক, চণ্ডীবাবুদেরও দারোয়ান আছে, সরকার মুহুরি গোমস্তা আছে, কিন্তু তাদের ছেলেদের চেহারা এমন নয়। ভবানীপুরে কিছু কিছু লোকের ওই রকম চেহারা। পোড়াবাজারে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে ও রকম লোকদের দেখেছে দীপঙ্কর। যেদিন সেই পুলিসের ডেপুটি কমিশনার বসন্ত চাটুজ্জেকে খুন করে ফেলেছিল সেদিন দীপঙ্কর দেখেছিল ওই রকম চেহারার দুজন লোককে। কোট-প্যান্ট পরা নয়, আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে। বেশ ফরসা টক্ টক্ করছে গায়ের রং। কোচানো ধুতি, হাতের আঙুলে সিগারেট। দুম্ দুম্ দুটো শব্দ হবার পরই লোক দুটো তাদের পাশ দিয়ে উড়ে-পাড়ার বস্তির দিকে চলে গিয়েছিল।
মনে আছে দীপঙ্কর সেদিন লক্ষ্মীদির চিঠিটা দিয়ে বাড়ি আসছিল, হঠাৎ দেখলে কিরণ দৌড়ে আসছে–
সামনে এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললে–সর্বনাশ হয়েছে রে দীপু–
নিশ্চয় কিরণের বাবা মরে গেছে! দীপঙ্কর হাঁ করে চেয়ে রইল কিরণের মুখের দিকে।
-কেন? কী হলো?
কিরণের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–তোর বাবা মারা গেছে নাকি? কখন?
কিরণ বললে–না, খবরের কাগজে বেরিয়েছে ভাই–সি আর দাশ মারা গেছে-কী হবে?
সি আর দাশ মারা গেছে? কী হবে? কিরণ যে বড় আশা করেছিল। আশা করেছিল সি আর দাশ রাজা হবে? কি হবে তাহলে। কিরণের মুখ যেন শুকিয়ে গেছে। কিরণ বোবার মতো দীপঙ্করের দিকে চেয়ে রইল।
কিরণ বলল–সাধুটা যে বলেছিল সি আর দাশ রাজা হবে দেশের–
দীপঙ্কর কী উত্তর দেবে বুঝতে পারলে না। সেও হাঁ করে চেয়ে রইল কিরণের মুখের দিকে। সমস্ত পৃথিবী যেন হঠাৎ শূন্য হয়ে গেছে কিরণের চোখে। রাজাই যদি মরে যায়, তাহলে কী করে সকলের অবস্থা ভালো হবে। কী করে কিরণের বাবার অবস্থা ভালো হবে। তবে কী তাকে সারাজীবন পৈতে বিক্রী করতে হবে? সারা জীবন ভিক্ষে করতে হবে? তাহলে তাদের বাড়ি হবে কী করে? তাহলে স্বরাজ হবে কী করে? সেদিন কিরণ যেন তার সমস্ত সমস্যার কোনও সমাধান না খুঁজে পেয়ে হতাশ হয়ে গিয়েছিল একেবারে।
দীপঙ্কর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করেছিল-ইস্কুল যাবি না?
কিরণ বলেছিল–ইস্কুল আজকে ছুটি-কালকেও ছুটি–
তারপর একটু থেমে বললে–ক্যাওড়াতলায় কাল আনবে সি আর দাশকে, দেখতে যাবি ভাই?
দীপঙ্কর বললে–যাবো, একসঙ্গে দুজনে যাবো–
কিরণ বললে–একটু সকাল সকাল যাবো বুঝলি-নইলে খুব ভিড় হবে ক্যাওড়াতলায়–
সেদিন বাড়ি এসেই প্রথমে গিয়েছিল লক্ষ্মীদির কাছে। নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের মোড়ে মধুসূদনের রোয়াকের ওপর তখন তুমুল জটলা চলেছে। খবরের কাগজখানা তখন মাটিতে লুটোচ্ছে। পড়া হয়ে গেছে সব। সবাই হাত-পা নেড়ে তর্ক বাধিয়েছে।
দীপঙ্কর এক মিনিট দাঁড়াল সেখানে। নানা বয়সের লোক। দুনিকাকাই সকলের সেরা।
দুনিকাকা বলছে–মরে গেছে বেশ হয়েছে, ও-সব চরকা-ফরকা কেটে কী লাভ হতো ভাই, চরকা কেটে আয়ার্ল্যান্ড স্বাধীন হয়েছে? না চরকা কেটে আমেরিকা স্বাধীন হয়েছে? বল, বুঝিয়ে দে আমাকে?
মধুসূদনের বড়দা বললে–গান্ধীরই সুবিধে হলো জানলেন দুনিকাকা, গান্ধীর কথা প্রোটেস্ট করবার মতো আর লোক রইল না কেউ–
পঞ্চুদা দাঁড়িয়েছিল। বললে–ও গান্ধী-ফান্ধীর কম্ম নয় বুঝলে হে, ছিল একটা বাঙালি সে-ও চলে গেল। এখন বুঝতে পারছেন না আপনারা, পরে বুঝবেন–দাত থাকতে হতো দাঁতের মর্যাদা বোঝে না লোকে–
ছোনেদাও দাঁড়িয়েছিল একপাশে। বললে–এখন ওই জে এম সেনগুপ্তই ভরসা। আমাদের সবেধন নীলমণি–
পঞ্চাদা কথাটা লুফে নিলে। বললে–আরে রাখ রাখ, কার সঙ্গে কার তুলনা! সেই কথায় বলে না হাতি ঘোড়া গেল তল….
মধুসূদনের বড়দা এক ফাঁকে বললে–দেখা যাক আমাদের সুভাষ বোসটা কী করে–
দুনিকাকা সবজান্তা মানুষ। তার এক-একটা কথার ফুকারে তাবড় তাবড় লোক নস্যাৎ হয়ে যায়। দুনিকাকা গোটা পৃথিবীটাকেই তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে ওস্তাদ, এক বৃটিশ গভর্নমেন্ট ছাড়া। সেই দুনিকাকা বললে–ওরে যার নাম আরশোলা তারই নাম ছারপোকা, ও তোদের সুভাষ বোসই বল্ আর জে এম সেনগুপ্তই বল, এক-একটা টিপুনিতেই সব কুপোকাৎ–
কিছুই বুঝছিল না দীপঙ্কর এ-সব কথার। এ-রকম আলোচনা তো বরাবরই হয়, বরাবরই হয়েছে। কিন্তু সি আর দাশ মারা গেছেন, কই কেউ তো কাঁদছে না? কেউ তো কিরণের মতো শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েনি! কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর সেদিন!
চলেই আসছিল দীপঙ্কর সেখান থেকে। হঠাৎ ছোনেদা ডাকলে–এই দীপু শোন তো, শোন্ ইদিকে–
দীপঙ্কর কাছে যেতেই ছোনেদা বললে–এই, তোদের বাড়িতে কারা ভাড়াটে এসেছে রে?
দীপঙ্কর বললে–লক্ষ্মীদিরা–
-লক্ষ্মীদি! ও, যে মেয়েটা গাড়ি করে ইস্কুলে যায়, ইউনাইটেড মিশনারিতে পড়ে! দেখেছি বাটা আসে বটে। তা ওর বাবা কী করে, শচীনবাবু কী করে?
দীপঙ্কর বললে–শচীনবাবু তো লক্ষ্মীদির বাবা নয়, ওর কাকা, ওর বাবা বর্মায় কাঠের কারবার করে, ওরা খুব বড়লোক।
-তা ওর কাকা কী করে জানিস তুই?
দীপঙ্কর বললে–আপিসে চাকরি করে।
আবার ছোনেদা জিজ্ঞেস করলে–কিসের আপিস?
দীপঙ্কর বললে–তা জানি না—
দুনিকাকা ছোনেদাকে জিজ্ঞেস করলে–তুই ঠিক জানিস?
ছোনেদা বললে–আমি দেখেছি যে–আমি নিজের চোখে দেখেছি দুনিকাকা–
তারপর সবাই মিলে কী সব গুজু গুজু করতে লাগলো কাকাবাবুর কথা নিয়ে। দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। তার কেবল মনে হলো, কই, কেউ তো সি আর দাশের মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সবাই তো ঠিক সেইরকম আগেকার মতোই আড্ডা দিচ্ছে। কোথাও কিছু বদলায় নি তো।
দীপঙ্কর এসেই লক্ষ্মীদির বাড়িতে ঢুকলো। নিচের বারান্দায় বসে কাকীমা কুটনো কুটতে বসেছেন। স্নান করা হয়ে গেছে। ভিজে চুল এলো করে পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছেন। দীপঙ্কর সামনে গিয়ে বললে–কাকীমা লক্ষ্মীদি কোথায়?
কাকীমা বললেন–ওপরে পড়ছে, দেখগে যাও–
-শুনেছেন কাকীমা, সি আর দাশ মারা গেছেন?
-কোথায়? জিজ্ঞেস করলে কাকীমা অন্যমনস্ক হয়ে।
দীপঙ্কর বললে–দার্জিলিঙে-ওঃ, কালকে যা ভিড় হবে না ক্যাওড়াতলায়–
কাকীমা যেমন তরকারি কুটছিলেন, তেমনিই কুটতে লাগলেন। দীপঙ্কর কত কথা বলে গেল, কোনও কথাই যেন কানে গেল না কাকীমার। কাকীমা ঠাকুরকে কালিয়ায় ক’টা আলু লাগবে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। আশ্চর্য! এরা কি কেউ একবার ভাবছে না কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল বাঙালীদের! আশ্চর্য! আশ্চর্যই বটে! দীপঙ্কর সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। ওপরে কোণের সেই ঘরটায় কাকাবাবু তখন একমনে খবরের কাগজ পড়ছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। দীপঙ্করের পায়ের শব্দও পেলেন না। দীপঙ্কর একেবারে সামনে গিয়ে ডাকলে-কাকাবাবু–
কাকাবাবু এতক্ষণে মুখ তুললেন। বললেন–ও, দীপুবাবু—
বলেই আবার খবরের কাগজে মন দিলেন।
দীপঙ্কর বললে–সি আর দাশ মারা গেলেন, কী হবে কাকাবাবু?
কাকাবাবু কাগজ পড়তে পড়তেই বললেন–কী বলছো?
দীপঙ্কর বললে–সি আর দাশ যে মারা গেলেন–কী হবে তাহলে কাকাবাবু?
কাকাবাবু সেইরকম ভাবে কাগজের দিকেই চোখ রেখে বললেন–কী আর হবে, কিছুই হবে না–
–কিছুই হবে না?
কাকাবাবু সে-কথার আর কোনও উত্তর দিলেন না। দীপঙ্করের অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেইখানে। দেখলে বড় বড় অক্ষরে কাগজের ওপর লেখা রয়েছে–
DESHBANDHU PASSES AWAY
A Bolt From The Blue
আর চারদিকে একটা মোটা কালো লাইন টানা রয়েছে। মধ্যখানে একটা ছবি দেশবন্ধুর! দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ধরে দেখলে ছবিখানার দিকে। চাদর গায়ে। খদ্দরের চাদর। মাথার ওপর একটি তালগাছের পাতার খানিকটা দেখা যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! কেউ কিছু বলছে না! এরা সবাই কিছু বলছে না কেন? সি আর দাশ মারা গেলে কিছুই আসবে যাবে না? কারও ক্ষতি হবে না কিছু? তাহলে প্রাণমথবাবু কেন বার বার সি আর দাশের কথা বলতেন! কেন কিরণ অমন করে কেঁদে ফেললে! তাহলে লক্ষ্মীদি অন্তত নিশ্চয়ই কাঁদছে এতক্ষণ!
লক্ষ্মীদির ঘরটায় উঁকি মেরে দেখলে দীপঙ্কর। নিজের পড়ার টেবিলে বসে একটা ছবি দেখছে। দীপঙ্করের দিকে পেছন ফিরে বসে আছে। দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির ঘরে ঢুকলো। আস্তে আস্তে কাছে গেল। ছবিটার দিকে চেয়ে দেখলে। আশ্চর্য, সেই লোকটার ছবি! যে-লোকটাকে রোজ চিঠি দিয়ে আসে দীপঙ্কর।
দীপঙ্করের পায়ের আওয়াজ পেতেই লক্ষ্মীদি চমকে উঠেছে। তাড়াতাড়ি হাতের ছবিটা শাড়ির তলায় লুকিয়ে নিলে।
বললে–কে রে? দীপু? চিঠিটা দিয়েছিস?
দীপঙ্কর কী বলবে ভেবে পেলে না। একটু থেমে বললে–লক্ষ্মীদি, সি আর দাশ মারা গেছেন শুনেছ?
লক্ষ্মীদি অবাক হয়ে চাইল দীপঙ্করের মুখের দিকে। তারপর বললে–শুনেছি, কিন্তু চিঠিটা দিয়েছিলি তো ঠিক!
দীপঙ্কর বললো দিয়েছি–
তারপর একটু থেমে বললে–আচ্ছা লক্ষ্মীদি, এই যে সি আর দাশ মারা গেলেন, এতে কিছু হবে না?
-কী হবে?
দীপঙ্কর বললে–এত বড় লোক মারা গেলেন, আর কিছুই হবে না?
লক্ষ্মীদি অন্যমনস্কর মতো বললে–কী আবার হবে? সবাই-ই তো একদিন মারা যাবে।
কথাটা দীপঙ্করের ভালো লাগল না। সবাই-এর সঙ্গে কি সি আর দাশের তুলনা? সি আর দাশ কি আর সকলের সঙ্গে সমান? কেমন ভালো লাগলো না লক্ষ্মীদির কথাটা। কেউ বুঝছে না কী সর্বনাশটা হলো। পঞ্চাদা ঠিক বলেছে-দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না তোক।
চলেই আসছিল দীপঙ্কর ঘর থেকে। হঠাৎ মনে পড়লো কথাটা। বললে–তোমার একটা চিঠি আছে লক্ষ্মীদি–
চিঠি! লক্ষ্মীদি তড়াক করে একেবারে বাঘের মতো লাফিয়ে উঠেছে যেন। বললে–চিঠি আছে লক্ষ্মীদি–
চিঠি! লক্ষ্মীদি তড়াক করে একেবারে বাঘের মতো লাফিয়ে উঠেছে যেন। বললে– চিঠি আছে তো বলিসনি কেন?দে–
দীপঙ্কর পকেট থেকে চিঠিটা বার করে দিয়ে বললে ভুলে গিয়েছিলাম একেবারে–
চিঠিটা হাতে নিয়ে মাথাটা ছিঁড়ে একনিঃশ্বাসে পড়তে লাগলো লক্ষ্মীদি। লক্ষ্মীদিকে যে কী চমৎকার দেখাচ্ছে! হঠাৎ বড় সুন্দর মনে হলো লক্ষ্মীদিকে। সকালবেলা চান সেরে নিয়ে পড়তে বসেছে। একটা লাল রং-এর শাড়ি পরেছে। গলায় চিক্ চিক্ করছে সোনার হারটা। গলার অনেকখানি খোলা। ফরসা গলাটা নিটোল নির্ভাজ। বিন্তিদির গলা এমন ভোলা নয়। ঢাকা থাকে শেমিজ দিয়ে। কিন্তু লক্ষ্মীদির জামাটা অনেকখানি ভোলা। লক্ষ্মীদি অনেকক্ষণ মন দিয়ে চিঠিটা পড়তে লাগল। এত কী কথা লেখা থাকে চিঠিতে! লক্ষ্মীদিই বা এত কী লেখে চিঠিতে রোজ রোজ! সেই লোকটাই বা সব কাজ ফেলে চিঠির জন্যে কেন রোজ দৌড়ে আসে কুণ্ডুপুকুরের ধারে? চিঠি পড়বার সময় তার মুখটাই বা অমন জ্বলজ্বল করে ওঠে কেন? কেন লাল হয়ে ওঠে কান দুটো। কেন ঘন ঘন সিগারেট খায়? সিগারেট খায় আর কেন বার বার পড়ে চিঠিগুলো?
লক্ষ্মীদি চিঠিটার দিকে চোখ রেখে নিজের মনেই যেন বললে–কাল তো যেতে পারবো–
দীপঙ্কর বললে–কোথায় যেতে পারবে না লক্ষ্মীদি?
-না, তোকে বলছি না–
তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–দেখ দিকিনি কী মুশকিল, কাল তো যেতে পারবো না আমি–
দীপঙ্কর বললে–তোমায় কোথাও যেতে লিখেছে বুঝি লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি বললে–সে তুই বুঝবি না, সে একটা জায়গা আছে, কিন্তু কাল যে সতী আসছে–
–সতী! সতী আসছে?
লক্ষ্মীদি বললো, কাল যে সতাঁকে আনতে যেতে হবে, সতী আসছে কিনা কাল, বাবা চিঠি লিখেছেন–কাল বিকেল পাঁচটার সময় সতীর জাহাজ এসে পৌঁছবে যে–
সতী! সতীর কথা এত শুনেছে দীপঙ্কর যে সতাঁকে যেন তার দেখা হয়ে গিয়েছে। সতাঁকে দেখতে যেন আর তার বাকি নেই। অনেকদিন সতীর চেহারাটাও যেন সে চোখের সামনে দেখছে। এত গল্প শুনেছে কাকাবাবুর কাছে, কাকীমার কাছে, লক্ষ্মীদির কাছে যে সতী আর তার অচেনা নয়। সতী যেন লক্ষ্মীদির মতোই একেবারে আপনার জন হয়ে গেছে দীপঙ্করের।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–সতী আসবে কাল আমাকে তো বলোনি তুমি আগে
লক্ষ্মীদি বললে–আজই তো বাবার টেলিগ্রাম এল–
-কিন্তু কার সঙ্গে আসবে? সতী একলা আসতে পারবে?
লক্ষ্মীদি বললে–বর্মা থেকে আর একজনরা আসছে কলকাতায়, তাদের সঙ্গেই বাবা পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেখানে লেখা-পড়া ভালো হচ্ছে না, তাই-ওই দেখছিস না, ওই বিছানা করা হয়েছে সতীর জন্যে, সতী শোবে ওইখানে–
এতক্ষণে নজর পড়লো দীপঙ্করের। ঘরের এক পাশে লক্ষ্মীদির শোবার খাট ছিল। ওপাশে আর একটা খাট রাখা হয়েছে।
সেদিন বাড়ি ফিরেও যেন অনেকক্ষণ ধরে সতীর কথাই মনে পড়ছিল দীপঙ্করের। তখনও দেখেনি দীপঙ্কর সতাঁকে, কিন্তু মনে হয়েছিল অন্তত বাড়ির মধ্যে একটা খেলার সঙ্গী পাবে সে। লক্ষ্মীদি বড়, বিন্তিদি বড়, ছিটে-ফোঁটা সবাই ওর চেয়ে বড়। কারো সঙ্গে খেলা যায় না। খেলতে গেলে সেই কিরণদের বাড়ি যেতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে। এবার সতী আসবে, সতী তো তারই মতন ছোট। সতী তো তার চেয়েও ছোট–
মনে আছে সেদিন রাত্রে ভালো করে ঘুমও হয়নি দীপঙ্করের। মনে আছে, সমস্ত রাতই যেন উসখুস করেছিল বিছানায় শুয়ে।
আস্তে আস্তে মাকে ডেকেছিল-মা–
-কী রে, ঘুমোসনি এখনো?
দীপঙ্কর বললে–যদি সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয় আমাকে ডেকে দিও তো মা–
অথচ কেন যে সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে তার তা-ও জানা ছিল না। তবু মনে হয়েছিল যেন দেরি হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
ভোর হতে না হতেই উঠে পড়েছে দীপঙ্কর। হঠাৎ যেন তার মনে হলোকই, ভোরবেলাটা ঠিক অন্যদিনকার মতোই তো। কোনও তফাত নেই। অন্যদিন যেমনভাবে সূর্যটা ওঠে পূর্বদিকে, আর আমড়া গাছটার ডালে এসে রোদ লাগে, সেদিনটাও তো তেমনি। চন্নুনী ঠিক অন্যদিনকার মতোই উঠোন ঝাট দিতে শুরু করেছে। আর কাকে লক্ষ্য করে যেন গালাগালি দিচ্ছে–শতেক-খোয়ারীরা, তোরা মর, তোরা রক্তবমি করে মর, তোদের খাটে করে চিতেয় তুলে দিয়ে আসি ক্যাওড়াতলায়, যত ড্যাারা জুটেছে। বাড়িতে, তোদের ছাদ্দে আমি পিণ্ডি চট্ৰকাই, ওলো হাড়হাবাতে মাগী, তোর মুখে আমি…
আস্তে আস্তে উঠোনের কোণে গিয়ে মুখ ধুয়ে দীপঙ্কর ভাবলে, চন্নুনী হয়তো জানে যে, সি আর দাশ মারা গেছেন।
দীপঙ্কর বললে–চন্নুনী শুনেছ?
–কী শুনবো বাছা, শোনবার কি আমার পিণ্ডি রেখেছে–শতেক-খোয়ারীরা আমার হাড়মাস ভাজা ভাজা করে ছেড়েছে, হতচ্ছাড়ীদের জ্বালায় কি আমার শোনবার সময় আছে বাছা, আবাগীদের মুখে আমি…
কোথা দিয়ে যে সকালটা কেটেছিল সেদিন! ভাত খেয়ে নিয়ে রাস্তায় যেতেই দেখলে দলে দলে লোক চলেছে ক্যাওড়াতলার দিকে। কিরণের বাড়িতে গিয়ে বাইরে থেকে ডাকলে-কিরণ, কিরণ–
ভেতরে যাবার উপায় নেই। মা বারণ করে দিয়েছে। ততক্ষণে পার্কটা ভর্তি হয়ে গিয়েছে লোকে-লোকে। নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রীটের ভেতর দিয়ে পার্কটায় ঢাকবার পথে অনেক ভিড়। রেলিংটা ভরে গেছে মানুষের মাথায়। সকাল সাড়ে ছটায় ট্রেনটা শেয়ালদা স্টেশনে এসে পৌঁছবার কথা। তারপর সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে হাজরা রোড ধরে কালীঘাট রোড দিয়ে টালিগঞ্জ রোডে এসে পড়বে। ততক্ষণ গাছের ওপর সব লোক উঠে বসেছে। ছোট-বড় সব গাছেই মানুষ। দুপুর বারোটা বাজলো, একটা বাজলোতবু দেখা নেই।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে দেখলে–কিরণ!
-এই কিরণ! তুই এখানে! তোদের বাড়িতে গিয়ে কত ডাকলুম–
কিরণ বললে–তোর জন্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষে চলে এলুম আমি-আয় এখানে। দাঁড়া, এখানে দাঁড়ালে ভালো দেখা যাবে–
শেষে আড়াইটের সময় হঠাৎ মনে হলো যেন মানুষের একটা বিরাট ঢেউ সামনের দিকে এগিয়ে এল। আর সেই ঢেউ-এর আঘাতে সকলের সব আশা-আকাঙ্খ-কামনা বাসনা এক মুহূর্তে যেন উদ্বেল হয়ে উঠলো। যেন বিরাট এক জন-সমুদ্রের তরঙ্গ সমস্ত মানুষের বেদনা-কাতর দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে এক নিমেষে মুখর হয়ে উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সব প্রতীক্ষার সমাধি হলো আর্ত চীৎকারে। যেন কেউ কোথাও নেই। কোনও সাড়া-শব্দ নেই কারো। বড় নির্জন নিরিবিলি হয়ে গেল কলকাতা শহর। দীপঙ্করের মনে হলো সেই নিস্তব্ধতার প্রাচীর ভেঙে যেন একটা ফুলের পাহাড় এগিয়ে আসছে তার দিকে। শুধু ফুল আর ফুল। এত ফুলও ছিল পৃথিবীতে! দীপঙ্করের সমস্ত অন্তরাত্মা যেন আর্তনাদ করতে চাইলে প্রাণভরে যেন চীৎকার করতে পারলেই খানিকটা তৃপ্তি পাওয়া যেত, যেন আর্তনাদ করতে পারলেই খানিকটা সান্ত্বনা পাওয়া যেত।
ফুলের পাহাড়টা সামনে দিয়ে চলে গেল। তখনও দীপঙ্করের জ্ঞান নেই।
হঠাৎ কিরণের গলার শব্দে দীপঙ্করের যেন জ্ঞান ফিরে এল।
কিরণ বললে–ওই দেখ প্রাণমথবাবু–
সেই উস্কোখুস্কো চুল, এলোমেলো খদ্দরের জামা, সেই গোড়ালি-দোমড়ানো জুতো! সেই পান চিবোচ্ছেন!
কিরণ বললে–ওই দেখ মহাত্মা গান্ধী রে–
একে একে অনেককে চিনিয়ে দিলে কিরণ। কিরণ সকলকে চেনে। সকলকে দেখেছে মিটিং-এ।
দীপঙ্কর বললে–ওই দেখ অঘোরদাদু–
অঘোরদাদু যে অঘোরদাদু সে-ও এসে ফুটপাথের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি নেই, তবু কী দেখতে এসেছে কে জানে! দেখা গেল ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে নির্মল পালিতকে। তাদের ইস্কুল থেকে সাউথ সাবার্বানে চলে গেছে। সে-ও এসেছে। দাঁড়িয়ে আছে হাঁ করে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কমলালেবু খাচ্ছে, সঙ্গে আছে তাদের দারোয়ান। দেখা গেল ফটিককে। দেখা গেল লক্ষ্মণকে। লক্ষ্মণচন্দ্র সরকার। সে-ও এসেছে কিনা এখানে। বাড়িতে গিয়ে শুনেছিল মা-ও এসেছিল নাকি বিন্তিদিকে নিয়ে। দুনিকাকাও ফতুয়া গায়ে দিয়ে এসেছে। ছোনেদা, মধুসূদনের বড়দা, পঞ্চাদা সবাই দল বেঁধে এসেছে।
দীপঙ্কর বললে–ওই দেখ, ছিটে এসেছে–
অঘোরদাদুর বড় নাতি ছিটে এসেছে। সিগারেট টানছে মুখে। কাপড়টা পরেছে লুঙ্গি করে। অনেক ভিড়। কেউ আর আসতে বাকি রাখেনি। কেবল কাকাবাবু, কাকীমা আর লক্ষ্মীদিই এল না। ওরা যেন অন্য দলের, ওরা যেন সকলের চেয়ে আলাদা–
হঠাৎ টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো একটু–
আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরাট শিরীষ গাছের ডাল মড় মড় করে ভেঙে পড়লো মাটিতে। আর একপাল লোক সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে পড়লো নিচেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে–
হৈ হৈ হল্লা উঠলো চারদিক থেকে। বল হরি হরি বোল…
সকাল থেকে সমস্ত দিনটা কেমন শোকাচ্ছন্ন হয়ে কাটলো যেন। যেন সমস্ত কলকাতার সমস্ত লোকের আত্মীয়-বিয়োগ হয়েছে। এখন আর সেদিনটার কথা কারো মনে নেই। সবাই ভুলে গেছে। সব কথা কি মানুষ মনে রাখতে পারে! সমস্ত রাতই ঘুম হয়নি দীপঙ্করের। সেদিন মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে ছিল। বাড়ি ফিরে গিয়েও যেন ভালো লাগেনি।
কিরণ রাস্তায় ফেরবার সময় বলেছিল–চল দীপু, সেই সাধুটার কাছে যাই, জিজ্ঞেস করে আসি বেটাকে–
শ্মশান থেকে ফিরে কিরণের সঙ্গে দীপঙ্কর সেদিন সোজা গিয়েছিল সোনার কার্তিকের ঘাটের সাধুর কাছে। কেন এমন হলো! সি আর দাশ যদি মারা গেল তো কী হবে তাহলে? এর উত্তর কেউ-ই দিতে পারেনি দীপঙ্করকে। দুনিকাকা, ছোনেদা, পঞ্চাদা, কাকাবাবু, কাকীমা, লক্ষ্মীদি কেউই দিতে পারেনি। কারোর মনেই যেন লাগেনি শোকটা। অথচ এত বড় ঘটনাটা ঘটে গেল চোখের সামনে। সব শেষ হয়ে গেল ছাই হয়ে। চিতার ধোঁয়ায় আকাশ কালো হয়ে উঠলো। এত লোক, এত লোকের শোক কি তবে অর্থহীন?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–সুভাষ বোস এল না কেন রে কিরণ?
কিরণ বললে–সুভাষ বোস যে জেলে তুই জানিস না?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তা হলে কী হবে ভাই?
কিরণ বললে–চল্ না সাধুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি সেইটে–
পাথরপটি পেরিয়ে মন্দিরের মুখোমুখি সোনার কার্তিকের ঘাটে যাবার রাস্তা। দুপাশে ডালার দোকান। পাণ্ডাদের যাত্রীনিবাস। পাথরে বাঁধানো রাস্তাটা। একটু আগে অল্প অল্প বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিরণ সোজা টেনে নিয়ে চললো পশ্চিম দিকে। পশ্চিম দিকেই গঙ্গা। গঙ্গার ওপরেই সোনার কার্তিকের ঘাট। কিরণ একটা গলি দিয়ে বাঁ দিকে ঢুকলো।
কিরণ বললে–সাধুর কাছে গিয়ে সাধুর পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করবি, জানলি–
-কেন?
-কেন আর, তাহলে সাধু খুব খুশী হবে, নমস্কার করলে কে না খুশী হয়–ওরাও তো মানুষ রে, নমস্কার করতে দোষ কী তোর, তাতে তো পয়সা লাগবে না।
তারপর কিরণ একটু থেমে বললে–পয়সাটাই হলো আসল জিনিস দীপু, সাধুই হোক আর সাধু না-ই হোক–
-কিন্তু আমার কাছে তো পয়সা নেই—
কিরণ বললে–আমার কাছেও পয়সা নেই, পয়সা দিতে হলে সাধুর কাছে আসবো কেন–পয়সা লাগবে না বলেই তো সাধুর কাছে আসি–
-কিন্তু তাহলে? তাহলে ওরা খাবে কী? কী খেয়ে বাঁচবে?
কিরণ বললে–পয়সা দেবার লোক আছে অনেক, তারা সাধুদের খাওয়াতে পারলে বেঁচে যায়। কিন্তু এ-সাধুটা সে-রকম নয়, এ শুধু গাঁজা খায়, এ হিমালয়ের সাধু কি না–আর কিছু খায় না।
কিন্তু ঘাটের সামনে গিয়ে কিরণ থমকে গেল। কিছু কথা বলতে পারলে না কিছুক্ষণ।
বললে–এই রে, বোধহয় হিমালয়ে চলে গেছে আবার–
-তা হলে?
কিরণ বললে–নাঃ, আমাদের কপালটাই খারাপ, কয়েকদিন পৈতে বিক্রী করতে গিয়েছিলাম ভবানীপুরে, এদিকে আসতে পারিনি-নইলে টের পেতাম–
আবার ফিরতে হলো। আবার পাথরপটি দিয়ে বাড়ির দিকে আসতে হবে। কিরণ নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের ভেতর ঢুকে পড়লো। আর দীপঙ্কর গিয়ে ঢুকলো সোজা লক্ষ্মীদির বাড়ির মধ্যে। সতী এসেছে নাকি! সতীর তো আসবার কথা ছিল। সেই লক্ষ্মীদির বোন! আজই তো আসবার কথা। লক্ষ্মীদি বলেছিল। রান্নাঘরের ভেতরে উনুনে আগুন দেওয়া হয়েছে। একতাল আটা নিয়ে মাখছে ঠাকুর। রঘু ঘর ঝাঁট দিচ্ছে।
দীপঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো। নতুন একটা খাট পাতা হয়েছিল সতীর জন্যে। সতী আর লক্ষ্মীদি এক ঘরে শোবে।
সিঁড়ির মুখেই লক্ষ্মীদির সঙ্গে দেখা। লক্ষ্মীদি নামছিল। দীপঙ্করকে দেখেই
লক্ষ্মীদি বললে–কী রে দীপু, কী! এরকম চেহারা হয়েছে কেন তোর?
দীপঙ্কর বললে–শুশানে গিয়েছিলুম-আজকে সি আর দাশ মারা গেল কি না–
-ও, আমরাও তো এখন আসছি।
-কোথা থেকে?
লক্ষ্মীদি বললে–সতাঁকে আনতে গিয়েছিলুম—
দীপঙ্করের বুকটা কেমন যেন দুলে উঠলো।
বললে–সতী এসেছে নাকি? কই দেখি? কী রকম দেখতে, দেখি?
লক্ষ্মীদি হেসে বললে–না রে, আসেনি, জাহাজ ছাড়েনি সেখান থেকে, খুব ঝড় হয়েছিল কি না।
দীপঙ্কর যেন হতাশ হলো কথাটা শুনে। তবু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। যেন অনেক আশা করেছিল সে। অথচ কিসের যে আশা, কেন যে আশা, সতী তার কে–তারই ঠিক নেই।
লক্ষ্মীদি নিচেয় নামতে লাগলো। দীপঙ্করও নিচে নামতে লাগলো পেছন পেছন। পেছন থেকে হঠাৎ
দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা লক্ষ্মীদি–
-কী রে? কী বলছিস?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–সতাঁকে বুঝি তোমার মতন দেখতে?
লক্ষ্মীদি ফিরে দাঁড়াল হঠাৎ। বললেও মা, তুই বুঝি দিনরাত সতীর কথা ভাবিস?
কেমন লজ্জা হলো দীপঙ্করের। মুখটা নিচু করে বললে–না–
-তবে? সতীর কথা এত জিজ্ঞেস করিস কেন রে তুই?
কেন যে দীপঙ্কর সতীর কথা এত করে জিজ্ঞেস করে তা কি দীপঙ্করই জানতো? কিন্তু তার কেবল মনে হতো সতী যেমনই হোক, সে যেন এমন করে লক্ষ্মীদির মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কাউকে চিঠি না পাঠায়। সতী যেন লক্ষ্মীদির মতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন করে না নাচে। সতী যেন এমন করে লক্ষ্মীদির মতো পড়ার টেবিলে বসে অন্য কারুর ছবি না দেখে। সতী যেন আরো ভালো হয়। লক্ষ্মীদির চেয়ে সতী আরো ভালো হলে যেন ভালো হয়। সতী যেন সত্যিই সতীর মতন হয়।
সেদিন সেই টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে কালীঘাট মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর সেই সেদিনকার কথাই ভাবছিল। সতী হয়তো আসবে না শেষ পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত হয়তো আসাই হবে না সতীর। অত দূর থেকে আসা কি সহজ! কোথায় বর্মা, কোথাকার কোন কাঠের কারবারী ভুবনেশ্বর মিত্রতার ছোট মেয়ে সতী কি এতদূর পথ একলা আসতে পারবে। যদি আসে যেন এমন করে চিঠি না পাঠায় তার হাত দিয়ে। সে-ও যেন দীপঙ্করকে এত কষ্ট না দেয়। এমন করে চিঠির জন্যে ভোরবেলা বৃষ্টিতে না ভিজোয়–
এইবার লোকটা আসছে। সেই কোট-প্যান্ট পরা লোকটা!
একটা ট্যাক্সি তীরের মতো ছুটে আসছে কুণ্ডুপুকুরের দিকে। কিন্তু না, ট্যাক্সিটা কুণ্ডুপুকুরের ধার দিয়ে এসে গলির ভেতরে ঢুকে গেল।
দীপঙ্কর আর একবার পেঁড়ার দোকানে গিয়ে ঘড়িটা দেখে এল। সর্বনাশ! আটটা বাজে। কখন সে পড়বে, কখন সে ইস্কুলে যাবে, কখন সে ভাত খাবে! বৃষ্টি তখন বেড়েছে আরো। আরো জোরে জল পড়ছে।
দীপঙ্কর সেই বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় নেমে পড়ল। মায়ের মন্দির থেকে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন অনেকদূর পথ। সমস্ত জামা প্যান্ট সব ভিজে একসা হয়ে গেল। ছুট ছুট ছুট। ছুটতে ছুটতে একেবারে লক্ষ্মীদিদের বাড়ির দরজায় যখন পৌঁছুলো তখন একেবারে চান করে উঠেছে। দরজাটা খোলা ছিল। সোজা ভেতরে গিয়ে লক্ষ্মীদিকে চিঠিটা দিয়ে আসতে হবে। বলতে হবে, সে ভদ্রলোক আসেনি। লক্ষ্মীদি হয়তো রাগ করবে খুব। যা রাগী মেয়ে! কিন্তু দীপঙ্করের দোষ কী! ভদ্রলোক যদি না আসে তো সে কী করতে পারে।
সিঁড়ির নিচে রান্নাঘরের দিকে কাকীমার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রঘু একটা থালায় চাল ধুচ্ছে কলতলার সামনে।
দীপঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে চলে গেল। ওপরেও বারান্দায় কেউ নেই। ডানদিকে পাশাপাশি শোবার ঘর, পড়বার ঘর।
দীপঙ্কর উঁকি মেরে দেখলে ভেতরে।
–লক্ষ্মীদি!
সেখানেও কারো সাড়া-শব্দ নেই। তার পাশের ঘরেও তাই। সমস্ত দোতলাটা যেন ফাঁকা মনে হলো। কেউ নেই দোতলায়। দীপঙ্করের গায়ের জামা ভিজে চপ চপ করছে। এ-ঘর ও-ঘর সমস্ত ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলে বার বার। কোথায় গেল লক্ষ্মীদি! কাকাবাবুই বা কোথায় গেলেন? অন্যদিন তো এই বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়েন। সেই সি আর দাশ যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিনও তো ওখানে বসেই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। লক্ষ্মীদির ঘরের ভেতরে সতীর খাটটাও সাজানো রয়েছে। দুদিকের দেয়ালে লাগানো দুটো খাট। বিছান-টিছানা সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সাজানো। শুধু ছোট টেবিলটার ওপর তিনটে চায়ের কাপ ডিশ খালি পড়ে আছে।
-লক্ষ্মীদি!
আবার ডাকলো দীপঙ্কর।
তারপর সিঁড়ি দিয়ে তেতলার ছাদে উঠলো। তেতলার ছাদে শুধু একখানা ঘর। ঘরখানায় কাকাবাবু শোন। সে-ঘরে গেলে সমস্ত কালীঘাটটা ছবির মতন নজরে পড়ে। ছোট ছোট বাড়ি, বস্তি, খড়ের চালা, মায়ের মন্দির, হালদারদের বাড়ি। চণ্ডীবাবুর বার-বাড়ির চূড়োটা, আরো অনেক কিছু। আর ওদিকে সেই টিপু সুলতানের ভূতুড়ে বাড়িটা তার ওধারে আগুনখাকীর পুকুর-আর তার ওদিকে ঢালা ধানক্ষেত। সে ধানক্ষেত একেবারে সোজা দক্ষিণে রেল-লাইন পর্যন্ত গিয়ে মিশেছে–
ওপরে উঠেই দীপঙ্কর কাকাবাবুর ঘরটার দিকে চেয়ে দেখলে। ঘরের দরজা খোলা। অন্যদিন সব সময়েই ঘরটায় চাবি বন্ধ থাকে। ঘরের ভেতরেও লক্ষ্মীদি নেই। দরজার পাল্লাটা ধরে ঝুঁকে আবার ভেতরে উঁকি মেরে দেখলে। খাটটার ওপর খবরের কাগজটা উল্টে রয়েছে। মনে হয়, একটু আগেই যেন ঘরে কেউ ছিল। সেলফের ওপর অনেকগুলো বই। অনেকগুলো কাগজপত্রের বান্ডিল। আর একটা ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্কে একটা ছোট তালা ঝুলছে। সকালের রোদ এসে পড়েছে মেঝের ওপর, বিছানার চাদরে আর দেয়ালের কুলুঙ্গিতে।
কোথায় গেল লক্ষ্মীদি!
আবার নিচেয় নেমে কাকীমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এত সকালে কাকাবাবুই বা কোথায় গেলেন! আর লক্ষ্মীদিই বা কোথায় গেল!
হঠাৎ মনে হলো ছাদের উত্তর-পূর্ব কোণে লক্ষ্মীদি দাঁড়িয়ে আছে। দীপঙ্করের দিকে পেছন ফেরা। কাকাবাবুর দূরবীনটা চোখে দিয়ে অনেক দূরে কী যেন দেখছে। দীপঙ্করকে দেখতে পায়নি।
আস্তে আস্তে দীপঙ্কর কাছে গেল।
তখনও দূরবীনে চোখ দিয়ে লক্ষ্মীদি একদৃষ্টে কী দেখছে।
হঠাৎ দীপঙ্কর ডাকলে—লক্ষ্মীদি—
লক্ষ্মীদি চম্কে উঠেছে। চম্কে পাশ ফিরে দীপঙ্করকে দেখে অবাক।
-তুই? তুই কখন এলি?
দীপঙ্কর বললে–আমি অনেকক্ষণ এসেছি–সব জায়গায় খুঁজেছি তোমাকে–
–চিঠি দিয়েছিস?
-না। তিনি আসেননি।
-আসেননি কি রে! আসেনি মানে? তাহলে চিঠি কাকে দিলি!
দীপঙ্কর বললে–কাউকে দিইনি–এই নাও—
লক্ষ্মীদি চিঠিটা নিয়ে একটু দেখেই টুকরো টুকরো করে ছাদে ছড়িয়ে দিলে।
দীপঙ্কর বললে–এই দেখ না, চিঠিটা নিয়ে আটটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলুম-তুব কেউ এল না—
-তা আর একটু দাঁড়ালি না কেন? আসবে না তো কোথায় যাবে!
-আমি তো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম-তারপর এমন বিষ্টি এল-এই দেখ না বিষ্টিতে একেবারে ভিজে গিয়েছি–
লক্ষ্মীদিও দেখলে দীপঙ্করের সর্বাঙ্গ ভেজা।
বললে–বৃষ্টি তো তখুনি থেমে গেল, একটু পরেই রোদ উঠলো, আর একটু দাঁড়ালেই পারতিস–
দীপঙ্কর বললে–এবার থেকে তুমি একটু বলে দিও লক্ষ্মীদি, যেন ঠিক সময়ে আসে-দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যথা হয়ে যায়–
লক্ষ্মীদি বললে–অনেকদূর থেকে আসতে হয় কিনা, তাই একটু দেরি হয়–তা এবার আর দেরি হবে না, আমি বলে দেব–
দীপঙ্কর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলে–এটা দূরবীন, না লক্ষ্মীদি?
-হ্যাঁ বাইনোকুলার–
-দেখা যায়?
-দেখবি?
বলে লক্ষ্মীদি বাইনোকুলারটা দীপঙ্করের চোখে লাগিয়ে দিলে। তারপর বললে–দেখতে পাচ্ছিস?
দীপঙ্কর দেখলে। কোথায় কত দূরের জিনিস যেন একেবারে হাতের কাছে, একেবারে যেন হাতের মুঠোয় এসে গেছে! সেই মায়ের মন্দির, নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীট, কিরণদের টিনের চালা, পাথরপটিতে ফটিকদের বাড়ি, ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুল, কত–
দূরের জিনিস সব হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠলো দীপঙ্করের সামনে।
হঠাৎ দীপঙ্কর দূরবীনটা লক্ষ্মীদির দিকে ফেরালো। লক্ষ্মীদিকে বরাবর সামনা সামনিই দেখে এসেছে এতদিন। দূরবীন দিয়ে লক্ষ্মীদিকে কেমন দেখায় তাই দেখবার ইচ্ছে হলো।
-কী রে, আমাকে দেখছি নাকি?
দীপঙ্করের চোখের সামনে তখন সব ঝাপসা হয়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করলে–তোমাকে এত ঝাপসা দেখাচ্ছে কেন লক্ষ্মীদি! কিছু দেখতে পাচ্ছি না যে–
লক্ষ্মীদি হাসলো। বললে–আমি যে কাছের মানুষ রে–
-তা কাছের মানুষকে ঝাপসা দেখাবে কেন-তোমাকে আমি দূরবীন দিয়ে দেখবো না-বলে দূরবীনটা সরিয়ে নিলে চোখ থেকে।
-কেন?
-না-না, বড় খারাপ দেখায় তোমাকে, তোমাকে চেনাই যায় না একেবারে!
-তা তো চেনাই যাবে না, দূরবীন তো দূরের মানুষকেই দেখার জন্যে। কাছের জিনিস দেখতে কি দূরবীন লাগে!
কথাটা শুনে সেই অল্প বয়েসে কেমন হতবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। সত্যিই তো, লক্ষ্মীদি তার কাছের মানুষ। একেবারে মনের কাছাকাছি। কাছের মানুষ না হলে কি লক্ষ্মীদি তার হাত দিয়ে চিঠি পাঠাতো! তাকে এত বিশ্বাস করতো! আর তা ছাড়া কাছের মানুষকে দূরবীন দিয়ে দেখতে গেলেই তো যত গণ্ডগোলের সূত্রপাত! কাছে এলেই যেন সব ঝাপসা ঠেকে! যেন বড় দূর-দূর মনে হয়। অথচ লক্ষ্মীদিও যখন দূরে চলে গিয়েছিল–যখন একেবারে নাগালের বাইরে, তখনই মনে হয়েছিল যেন লক্ষ্মীদিকে ভালো করে কাছে পেয়েছে, স্পষ্ট করে দেখতে পেয়েছে, সহজ করে বুঝতে পেরেছে!
দীপঙ্কর দূরবীনটা দিয়ে দিলে লক্ষ্মীদির হাতে—
বললে–আমাকেও দূরবীন দিয়ে দেখো না তুমি লক্ষ্মীদি—
লক্ষ্মীদি হাসলো। বললে–কেন রে?
-না, আমাকে ঝাপসা দেখাবে–
-ঝাপসা দেখালে আমিই ঝাপসা দেখবো, তাতে তোর কী?
-না, তাতে যে তুমি আমাকে চিনতে পারবে না!
বলে আর দাঁড়াল না দীপঙ্কর। যেন লক্ষ্মীদির সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জা হলো তার। তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে একেবারে রাস্তায় এসে পড়লো। পাশের দরজা দিয়ে নিজের বাড়িতেই ঢুকতে হয়তো, কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এর গলিটার মুখে মনে হলো যেন কাদের একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছে। গলিতে আবার ট্যাক্সি এল কাদের বাড়িতে! নতুন কোনও ভাড়াটে এল নাকি! ভেতরে মেয়েরা বসে আছে। অনেক মালপত্র পেছনে বাঁধা।
ট্যাক্সি থেকে কে একজন নেমে এসে বাড়ির নম্বরগুলো দেখতে দেখতে আসছিল।
দীপঙ্করের কাছে এসেই জিজ্ঞেস করলে–এই, উনিশের একের বি কোন্ বাড়িটা রে?
-এইটেই তো, কাকে খুঁজছো?
-অঘোর ভট্টাচার্যির বাড়ি-
-হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বাড়িটাই–
বলে এগিয়ে গেল দীপঙ্কর ট্যাক্সির দিকে। পেছনের বসবার জায়গায় দুজন মেয়ে মানুষ বসে ছিল। দীপঙ্করের চোখের সামনে যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল। সতী নয় তো!
–এই ছোকরা, মালগুলো ধরতে পারবি?
বলে ভদ্রলোক নামলেন গাড়ি থেকে। গরমের কোট-প্যান্ট পরা। বেশ বয়েস হয়েছে। তারপর পেছনের মালগুলো ট্যাক্সিওয়ালা নামিয়ে দিলে। ফরসা মেয়েটা ভেতর থেকে বললে–এত জায়গা থাকতে কোথায় বাড়ি নিয়েছে কাকাবাবু-আর জায়গা পেলে–
ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন–উনিশের একের বি চিনিস তো তুই?
দীপঙ্কর বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ–
-তাহলে এই মালগুলো ওঠা তো-বেশি ভারি নয়, একটা বিছানা আর একটা সুটকেস–
মেয়েটি নামলো গাড়ি থেকে। বললে–আপনি না থাকলে বাড়িই খুঁজে পাওয়া যেত না–
পরনের কাপড়টা আর মাথার চুলের খোঁপাটা ঠিক করে নিলে একবার। এধারের ওধারের বাড়িগুলো দেখতে লাগলো চোখ মেলে। যেন যেদিকেই চাইছে অবাক হয়ে যাচ্ছে।
বললে–এই জায়গায় দিদি আছে কী করে তাই ভাবছি–
ভদ্রলোক বললেন–এ কি আর তোমার বর্মা পেয়েছে–অত বড় বাগান-অত বড় সমুদ্র–
তারপর হঠাৎ বললেন–ওরে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন বাবা-মাথায় তোল–বেশি ভারি নয়।
তারপর আর বেশি কথা না বলে বিছানাটা দীপঙ্করের কাঁধে তুলে দিলেন।
বললেন–পারবি তো? দীপঙ্কর কাঁধের ওপর বিছানাটা আর হাতে সুটকেসটা নিয়ে বললে–পারবো—
-দেখিস, যা রোগা-পটকা চেহারা, পারলে হয়, ফেলে দিস্ নে যেন বাবা—
সামনে আগে আগে চলতে লাগলো দীপঙ্কর-আর পেছনে ভদ্রলোক আর মেয়েটি। দীপঙ্করের মনে হলো এ কেমন করে হলো! হঠাৎ কী যে হলো–সব ঘটনাটা কেমন বড় তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। কিছু ভাববার কিছু বলবার অবসর ছিল না।
কাকাবাবুদের বাড়ির দরজা তখনও খোলাই ছিল।
-এই বাড়ি?
দীপঙ্কর কাঁধ থেকে মালটা নামিয়ে বললো—হ্যাঁ–
মেয়েটি বললে–কত নিবি তুই?
দীপঙ্কর হতবাক্ হয়ে গেছে। একবার মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। এর কথাই কি এতদিন শুনে এসেছে লক্ষ্মীদির কাছে! এই-ই কি সতী! এই রকম চেহারার কথাই তো শুনেছে, ঠিক এইরকম ফরসা কোঁকড়ানো চুল,–
ভদ্রলোক বললেন–এক আনা পয়সা দিয়ে দাও ওকে
দীপঙ্কর বললে–না, পয়সা দিতে হবে না–
ভদ্রলোক বললেন–কেন? দুটো তো মাত্র হালকা জিনিস, ওর জন্যে চারটে পয়সা কি কম হলো? এক গলা মাটি খুঁড়লে চারটে পয়সা আসে? বড় যে লবাব হয়ে গেছ সব একেবারে, ও তো আমি নিজেই বয়ে আনতে পারতুম–
মেয়েটি বললে–ওই চার পয়সার বেশি আর দেব না–নে—
হাত বাড়িয়ে পয়সা চারটে দিতে গেল মেয়েটি।
দীপঙ্কর বললে–না–
ভদ্রলোক বললেন–এই জন্যেই বাঙালীদের কিসসু হয় না–ভারি তো দুটো হালকা জিনিস, তার জন্যে দুগণ্ডা পয়সা দিতে হবে নাকি-না নেয় না নেবে-বয়ে গেল–
মেয়েটি আবার বললে–নিবি তো নে।
দীপঙ্কর বললে,-না–
ভদ্রলোক বললেন–তুমি আর খোশামোদ কোরো না সতী-ও থা–চার পয়সা ও কী করে উপায় করে দেখি–
দীপঙ্কর আস্তে আস্তে রাস্তায় বেরিয়ে এল। আর একটু দাঁড়ালেই হয়তো ওরা দেখতে পেত। ভিজে জামার হাতটা দিয়ে চোখটা মুছে নিলে একবার।
হঠাৎ গায়ে এসে লাগলো যেন কী জিনিস! পেছন ফিরতেই দেখলে ভদ্রলোক চারটে পয়সা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন। আর পয়সা চারটে তার গায়ে লেগে মাটিতে পড়ে ঝন্ ঝন্ করে শব্দ হলো। দীপঙ্করের মনে হলো যেন তার অন্তরাত্মা হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলো। তা হলে সেই সতীও আর সকলের মতন হয়ে গেল! লক্ষ্মীদিও তাকে চকোলেট দিয়েছিল। সতীও কি লক্ষ্মীদির মতোন! কোনও তফাৎ নেই! তাহলে সংসারে সবাই-ই কি অঘোরদাদু!
বাড়ি আসতেই মা দেখতে পেয়েছে। বললো রে, এতক্ষণ লাগলো ফুল দিয়ে আসতে?
তারপর কাছে আসতেই ভিজে জামাটা দেখে বললে–এই ভিজে জামা পরে কোথায় ছিলি এতক্ষণ, ইস্কুলে যাবি না? খো-খো ভিজে জামা, খুলে ফ্যা। যদি জ্বর হয় তখন তো আমাকেই জ্বালাবিনা, তোকে আর ফুল দিয়ে আসতে হবে না–এবার থেকে আমি নিজেই যাবো–
জোর করেই মা জামাটা টেনে খুলে দিলে। গামছা দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দিল। নিজের মনেই মা ব ব করতে লাগলো অনেকক্ষণ–আমার যেমন কপাল, আমি যে এই সারাদিন রান্না করছি পরের বাড়িতে, চোখে দেখেও ছেলের জ্ঞান হয় না, আর কবে জ্ঞান হবে, কবে বুদ্ধি-বিবেচনা হবে যে ছেলের–
মা’র কথাগুলো শুনতে শুনতে দীপঙ্করের ভারি দুঃখ হতো। মা তো জানতো না দীপঙ্করের মনের ভেতর কত কথার কত ভাবনার পাহাড় জমেছিল তিলে তিলে! মা’র যেমন নিজের ভাবনা আছে দীপঙ্করেরও যে তেমনি নিজের ভাবনা আছে কত। ঘরটার দাওয়ায় বসে বসে উঠোনের মাথায় আকাশটাকে দেখেও কত ভাবনা উঠতো দীপঙ্করের মাথায়। কেন সকাল হলেই রোদ হয়, কেন সন্ধ্যে হলেই তারা ওঠে ওখানে! যে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে, সেই আকাশ থেকেই আবার কী করে আগুন ঠিকরে পড়ে দুপুর বেলা! শুধু কি তাই? ওই উঠোনের কোণে যে আমড়াগাছটা দাঁড়িয়ে আছে, এক জায়গায় ওর পাতাগুলো কেমন সবুজ, কিন্তু সাদা হয়ে গেলেই কেন মাটিতে ঝরে পড়ে? আর সেই কাকাটা! কাকটা রোজ আসে, রোজ এসে ওই গাছের ডালে বসে। কোথায় গেল সেই ওর লাল-মুখো বাচ্চাটা! হাজি কাশিমের বাগানে সেবার মরে পড়ে থাকতে দেখেছিল। তারপর থেকেই ও যেন কেমন হয়ে গেছে। এঁটো ভাত পেলেই খেয়ে নিয়ে আবার ওই ডালে গিয়ে বসে। তারপর সন্ধ্যে হবার আগেই কোথায় চলে যায়। ওর বোধ হয় কেউ নেই পৃথিবীতে। পৃথিবীতে কেউ না-থাকা খুব কষ্টের বোধ হয়। সেদিন দীপঙ্কর সেই লক্ষ্মীদির দেওয়া চকোলেটগুলো ওকে দিয়েছিল, কাকটা গপ গপ করে সব খেয়ে নিয়েছিল। ও বেশ আছে, লজ্জাও নেই অভিমানও নেই। সত্যিই বেশ আছে।
দীপঙ্কর ডাকে–আঃ আঃ আঃ–
কাকটা তেরছা দৃষ্টি দিয়ে দীপঙ্করের দিকে দেখে-ঘাড় কাত করে দেখে সত্যি তার হাতে কিছু খাবার আছে কি না। সত্যিই তাকে খেতে দিচ্ছে না স্তোকবাক্য শোনাচ্ছে—
মা একদিন দীপঙ্করকে নিয়ে প্রাণমথবাবুর কাছে গিয়েছিল দুপুরবেলা। ছুটির দিন। মা একটা ফরসা কাপড় বার করে পড়েছিল। নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের একেবারে শেষ প্রান্তে প্রাণমথবাবুর বাড়ি। এককালে খুব আবস্থা ভালো ছিল প্রাণমথবাবুর পূর্ব পুরুষদের। এখন ভেঙে ভেঙে পড়ছে।
মা বললে–আমি বৌদিকে বলে রেখেছি তোকে কিছু ভাবতে হবে না—
দীপঙ্কর বলেছিল–আমি কিন্তু চাকরি করবো না মা–
মা বললে–চাকরি করবে না তো কী করবে শুনি, বসে বসে ভাত গিলবে?
দীপঙ্কর বললে–আমি পড়বো–
মা খুব রেগে গিয়েছিল। বলেছিল–পড়তে মাইনে লাগবে না? মাইনে আমি কোত্থেকে দেব শুনি? অঘোরদাদু কদ্দিন খাওয়াবে দুজনকে! আমি তোমার মাইনে গুনতে পারবো না বাপু-এই বলে রাখলুম-আমার শরীরে আর বইছে না–
প্রাণমথবাবু বাড়ির ভেতরে খালি গায়ে তখন চরকা কাটছিলেন। চারিদিকে আলমারি। বই ভর্তি আলমারি।
বললেন–না দীপুর মা, ওর যখন পড়তে ইচ্ছে, তখন ওকে পড়াও তুমি–
মা বললে–কিন্তু দাদা, আপনি তো আমার অবস্থা জানেন, কোত্থেকে মাইনে গুনবো আমি–সেই এক মাস বয়েস থেকে আমি এতদিন টেনে টেনে চালালুম, এখন আমার নিজের শরীরেও আর বয় না, ওর একটা কিছু করে যেতে পারলে আমি তবু নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুঝতে পারি–
প্রাণমথবাবু পান চিবোচ্ছিলেন। বললেন–তুমি ঢুকিয়ে দাও তো কলেজে, মাইনের কথা ভাবতে হবে না–
সত্যিই মাইনের কথা ভাবতে হয়নি মাকে আর। কলেজে পড়বার সময় মাইনে দিতেন প্রাণমথবাবু নিজের পকেট থেকে। প্রতি মাসের প্রথম দিকে গিয়ে হাজির হতো দীপঙ্কর। সকাল বেলা যেত। অনেক কাজের মধ্যেও প্রাণমথবাবু তাকে দেখেই বলতেন–এসেছ?
চাইতে হতো না, কিছু না, তাকে দেখেই ড্রয়ার থেকে ছ’টা টাকা দিয়ে দিতেন।
বলতেন–তোমার মা কেমন আছেন?
দীপঙ্কর বলতো ভালো আছে স্যার–
-পড়াশুনো চলছে তো ঠিক? পঞ্চান্ন সিংহী মশায় কেমন আছেন?
পঞ্চানন সিংহ ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল। দীপঙ্কর বলতো–ভালো আছেন স্যার–
-তাকে আমার কথা বলো, জানো? যদি কোনও অসুবিধে হয় তাঁকেও জানিও—
তারপর বলতেন–বড় হও, মানুষ হও, তোমাকে মানুষ হতে দেখলে আমি খুব খুশী হবো–
দীপঙ্কর বলতো–স্যার, পরের মাস থেকে আপনাকে আর টাকা দিতে হবে না–
-কেন?
দীপঙ্কর বললে–আপনি তো আমাকে অনেক সাহায্য করলেন, কেউ কারোর জন্যে এমন করে না–সামনের মাসে আমি একটা টিউশানি যোগাড় করবো ভাবছি–
-টিউশানি?
প্রাণমথবাবু কী যেন ভাবলেন খানিকক্ষণ। বললেন–টিউশানি পেয়েছ?
-না পাইনি এখনও, তবে খুঁজলে পেয়ে যাবো। আজকাল কালীঘাটে অনেক নতুন-নতুন লোক এসেছে, দশ টাকার টিউশানি একটা যোগাড় করতে পারবো–
প্রাণমথবাবু বললেন–দাঁড়াও–
প্রাণমথবাবুর গম্ভীর গলার আওয়াজে দীপঙ্কর যেন চমকে উঠলো। প্রাণমথবাবু গম্ভীর গলায় ডাকলেন–হরিপদ–
হরিপদ আসতেই প্রাণমথবাবু বললেন–বাড়তি হিসেবের খাতটা বার করে দে তো–
হরিপদ অনেক বই-খাতার মধ্যে থেকে একটা লাল খেরো-বাঁধানো খাতা টেনে বার করে দিল।
প্রাণমথবাবু খাতটা তুলে তারই একটা পাতা বার করে বললেন–পড়, পড়ে দেখ–
দীপঙ্কর পড়ে দেখলে। পড়ে কিছু বুঝতে পারলে না। পাতা-ভর্তি অনেক লোকের নামের লিস্ট। প্রত্যেকের নামের পাশে টাকার অঙ্ক বসানো। কারোর নামের পাশে পাঁচ, কারোর নামের পাশে দশ, কারোর নামের পাশে দুই। এই রকম অনেক নাম, অনেক টাকা। তার নিজের নামও রয়েছে। তার নামের পাশে লেখা রয়েছে ছ’ টাকা।
-বুঝলে কিছু?
-না স্যার।
প্রাণমথবাবু বললেন–তুমি একলাই টাকা পাও না, অনেকেই পায়, সবাই এসে নিয়ে যায়, কিন্তু তোমার মতো টাকার দরকার নেই কেউ বলে না তো, এই আজ তুমিই প্রথম বললে শুনলাম–
দীপঙ্কর কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।
প্রাণমথবাবু বললেন–তা আসলে এ-টাকা আমিও আমার পকেট থেকে দিই না তোমাকে। আমার অত টাকাও নেই। কলকাতার কিছু বড় বড় লোক গরীবদের সাহায্য করবার জন্যে মাঝে মাঝে আমার হাতে কিছু টাকা দেয়, সেই টাকাই আমি কেবল তোমাদের হাতে তুলে দিই–তা আমার কাছ থেকে টাকা নিতে তোমার লজ্জা করার কোনও কারণ নেই, যতদিন তোমার দরকার তুমি নিয়ে যেও, তারপর যেদিন আর দরকার হবে না, সেদিন নিও না–
দীপঙ্কর এবারও কোনও উত্তর দিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ প্রাণমথবাবু গম্ভীর গলায় বললেন–যাও এবার–
আর-এক মুহূর্ত দেরি না করে দীপঙ্কর রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। যেন সত্যিই লজ্জা হলো বেশিক্ষণ প্রাণমথবাবুর সামনে থাকতে। ইনিও তো মানুষ! পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মধ্যে প্রাণমথবাবুও তো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন। কিন্তু এমন মানুষ-বা কটা আছে পৃথিবীতে। দীপঙ্করের মনে হলো আসবার সময় প্রণাম করলেও যেন তাকে ছোট করা হতো। প্রাণমথবাবু যেন সমস্ত ভদ্রতা-অভদ্রতা, সমস্ত নিয়ম কানুন, সমস্ত কেতা-দুরস্তের উর্ধ্বে। যারা চকোলেট দেয়, যারা পয়সা দেয়, যারা সন্দেশ দেয়, সেই লক্ষ্মীদি, সতী, অঘোরদাদুদের কেউ নয় যেন প্রাণমথবাবু। অথচ প্রাণমথবাবুও তো দেবতা নন। সাধারন, অতি সাধারণ কালীঘাট নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটেরই একজন মানুষ মাত্র। প্রাণমথবাবু তো তাদের মতো টাকা-কড়ি দিয়ে, ঘুষ দিয়ে তাকে কিনতে চাননি। দীপঙ্করকে টাকা দিয়ে তিনিও সম্মান, লজ্জা, বিনয়, কৃতজ্ঞতা সবই তো দীপঙ্করের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। কিন্তু তা তো তিনি করলেন না!
মনে আছে প্রথম যেদিন প্রাণমথবাবুর কাছে মা নিয়ে গিয়েছিল, প্রাণমথবাবু একটা কথা বলেছিলেন।
চরকা কাটতে কাটতে বলেছিলেন-মহাভারত পড়েছ?
দীপঙ্কর বলেছিল–মা’র কাছে মহাভারতের গল্প শুনেছি, পড়িনি—
প্রাণমথবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন–আচ্ছা বলো তো পৃথিবীর চেয়ে বড় কী?
প্রশ্নটা শুনে কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। এই পৃথিবী, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে বড় কী জিনিস থাকতে পারে এ-সংসারে! আর যদি পৃথিবীর চেয়ে বড় হবে তো সেটা পৃথিবীর মধ্যে ধরবেই বা কেমন করে। বাটি যতটুকু, ততটুকুই তো তেল ধরবে, তাতে। একসেরা বাটিতে তো আর দুসের তেল ধরতে পারে না!
প্রাণমথবাবু নিয়ম করে রোজ চরকা কাটতেন। সেই চরকায় কাটা সুতো দিয়ে নিজের কাপড় তৈরি করতেন। প্রাণমথবাবুর স্ত্রীও নিজে চরকা কাটতেন। স্বামী-স্ত্রী অদ্ভুত দুজনে। ছেলে-পুলে ছিল না। পরে অনেকেই চরকা কাটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। চরকায় যখন হুজুগ এসেছিল, তখন সবাই কেটেছে। পাড়ায় পাড়ায় চরকা ঘুরতে ঘর ঘর করে। খদ্দর পরা একটা স্টাইল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সব হুজুগের মতো একদিন খদ্দরের হুজুগও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু প্রাণমথবাবু সারাজীবন আর তা ছাড়লেন না। একেবারে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
প্রাণমথবাবু আবার বললেন–বলো, পৃথিবীর মধ্যে পৃথিবীর চেয়েও বড় কী জিনিস, বলো?
মা বললেন–দাদা, আমি ভেতরে বৌদির সঙ্গে দেখা করে আসি–
-যাও-বলে প্রাণমথবাবু আবার চরকা কাটতে লাগলেন।
তারপর বলতে লাগলেন–মহাভারতে আছে একবার এক বক যুধিষ্ঠিরকে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিল–
দীপঙ্কর বললে–হা জানি, বকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বলে ভীম অর্জুন সবাই মরে গিয়েছিল–শুধু যুধিষ্ঠিরই শেষ পর্যন্ত উত্তর দিতে পেরেছিল স্যার।
প্রাণমথবাবু জিজ্ঞেস করলেন–তা বলো তো কার হৃদয় নেই? কে জেগে ঘুমোয়? জন্মের পরেও নিঃশ্বাস পড়ে না কার? কোন্ জিনিস বাতাসের চেয়েও বেগবান? তৃণের চেয়েও কোন্ জিনিস অধিক?
পর পর অনেকগুলো প্রশ্ন করে গেলেন প্রাণমথবাবু।
দীপঙ্কর একটিরও উত্তর দিতে পারেনি।
প্রাণমথবাবু বললেন–ভীম অর্জুন নকুল সহদেবরা না হয় মহাভারত পড়েন নি, তাই উত্তর দিতে পারেননি–কিন্তু আমরা তো মহাভারত পড়েছি, আমাদের উত্তরগুলো–
তো জানা উচিত–
দীপঙ্কর এবারও চুপ করে রইল।
প্রাণমথবাবু বললেন–বড় হয়ে মহাভারতটা পড়ো, বুঝলে? এখন পৃথিবীর চেয়ে বড় কী, এটা শোন–
দীপঙ্কর চেয়ে ছিল প্রাণমথবাবুর মুখের দিকে।
প্রাণমথবাবু চরকা থামিয়ে বললেন–পৃথিবীর চেয়ে বড় হলে জননী-বুঝলে জননী-তোমার মা।
দীপঙ্কর চুপ করে রইল।
-হ্যাঁ, জননী। তোমার মার কথাই ভাববো না, তুমি জানো না, কত কষ্ট করে তোমার মা তোমাকে মানুষ করেছেন। প্রতিদানে কিছুই চাননি। তুমি যখন ছোট ছিলে তোমার এই বিধবা মা, সেদিন তোমার জন্যে রাতের ঘুম, দিনের বিশ্রাম সব কিছু ত্যাগ করেছেন–আর তুমি? তুমি সেটা তোমার ন্যায্য পাওনা হিসেবে দাবি করেছ। আরো স্নেহ, আরো যত্ন, আরো সেবা দাবি করেছ!…
একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন–এ-ছাড়াও আর একজন মা আছে তোমার, তার কথা তুমি কখনও ভেবেছ কী?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে–আর একজন মা?
প্রাণমথবাবু বললেন–হা, আর একজন মা। সে হচ্ছে তোমার জননী-জন্মভূমি–
বলতে বলতে যেন প্রাণমথবাবুর গলার স্বর বন্ধ হয়ে এল। উত্তরে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত যে-মাতৃভূমি পায়ের তলায় প্রসারিত, যে-মাতৃভূমি ক্ষুধায় অন্ন দেয়, রোগে ওষুধ দেয়, বস্ত্র, আশ্রয় সব যে দেয়, শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় হেমন্তে শরতে বসন্তে যে প্রতিপালন করে, সেই জননী-জন্মভূমি যে পৃথিবীর চেয়েও বড়! তার মতন কে আছে পৃথিবীতে…
বলতে বলতে প্রাণমথবাবু থেমে গিয়ে আবার চরকা কাটতে লাগলেন।
মা ভেতর থেকে এসে হঠাৎ ডাকলে—খোকা–
দীপঙ্কর মার দিকে চাইলে।
মা বললে–ভেতরে এসো-মামীমাকে প্রণাম করো—
দীপঙ্কর উঠে ভেতরে গিয়ে দেখলে প্রাণমথবাবুর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন।
দুই পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকিয়ে দীপঙ্কর প্রণাম করলে।
প্রাণমথবাবুর স্ত্রী আশীর্বাদ করলেন–মানুষ হও বাবা, মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো–
এর পর প্রতিমাসেই দীপঙ্করকে যেতে হতো প্রাণমথবাবুর বাড়ি। প্রাণমথবাবুর কাছে গেলে দীপঙ্কর যেন অন্যরকম হয়ে যেত।
প্রাণমথবাবু বলতেন–আমার বাড়িতে অনেক বই আছে, তোমার যদি পড়বার ইচ্ছে হয় কখনও, আমার এখানে এসে পড়তে পারো, দেখবে বই-এর মতন বন্ধু পৃথিবীতে আর নেই-বই কখনও বঞ্চনা করে না–
মনে আছে প্রাণমথবাবুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে মা বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিল। দীপঙ্করকে তখন কলেজের দিকে যেতে হবে। ভর্তির ফরম নিয়ে এসে টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে কলেজে। মা কতদিন থেকে এক টাকা দুটাকা করে জমাচ্ছে। একটি পয়সা মার কাছে অমূল্য জিনিস। সেই কাঠের বাক্সটার ভেতরে একটি-একটি পয়সা রেখে মা জমাতো, পয়সা জমিয়ে টাকা করতো।
দীপঙ্কর যদি বলতো–একটা পয়সা দেবে মা?
মা জিজ্ঞেস করতো–পয়সা কী করবি?
দীপঙ্কর বলতো–চিনেবাদাম খাবো–
মা বলতোবড় হয়ে অনেক চিনেবাদাম খেতে পারবে বাবা, অনেক ঘুগনিদানা খেতে পারবে, এখন এ-পয়সা তোমারই কাজের জন্যে জমাচ্ছি, তোমার পেছনেই কত টাকা খরচ হবে জানো–আর আমি তো এ-পয়সা সঙ্গে নিয়ে যাবো না–
মা এক বিচিত্র উপায়ে পয়সা উপায় করতো। পাড়ার কোনও বড়লোকের বাড়ির বউ এর জন্যে কাঁথা সেলাই করতে হবে, মাকে দিয়ে যেত ছেঁড়া কাপড়। মা হয়তো দুআনা পয়সা পেত সেই কথা সেলাই করে। শুধু কাঁথা সেলাই নয়। চিঠি লেখা, জামা সেলাই করা, মুড়ি ভাজা, কত লোকের কত রকমের কাজ করে দিত মা। তার বদলে একটা কি চারটে পয়সা। মা পেত। সেই চারটে পয়সাই মা তুলে রাখতে কাঠের বাক্সের মধ্যে। প্রাণ ধরে মা খরচ করতো না। মা ভাবতো, দীপুর জন্যে থাকু, দীপুর লেখাপড়ার খরচ আছে, দীপুর জামা কাপড়ের খরচ আছে, দীপুর কত খরচ আছে। সামনেই কত বড় জীবন পড়ে আছে দীপুর। দীপু মানুষ হবে, দীপু বড় চাকরি করবে, দীপু আর পাঁচজনের একজন হবে। দীপুর জন্য মার ভাবনার অন্ত ছিল না।
ঠিক হাজরা রোডের কাছে আসতেই কিরণের সঙ্গে দেখা। চোখ-মুখ বসে গেছে রোদ্দুরে। স্নান-খাওয়া হয়নি বোধহয় তখনও।
দীপঙ্করকে দেখে কিরণ এগিয়ে এল। একগাল হেসে বললে–তোকেই তো খুঁজছিলুম দীপু–
দীপঙ্করের কাছে এসে বললে–খুব সুখবর আছে একটা রে–
দীপঙ্কর বললে–কী খবর?
কিরণ বললে–নির্মল পালিতকে মেম্বার করেছি আমাদের লাইব্রেরীতে জানিস-মাসে এক টাকা করে চাঁদা দেবে–আমাকে যেতে বলেছে–
সেই নির্মল পালিত! কালীঘাট ইস্কুল থেকে ফিফথ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে সাউথ সাবার্বন ইস্কুলে চলে গিয়েছিল। বরাবর ফার্স্ট হতো। একদিন দীপঙ্কর আর কিরণ গিয়েছিল আবার। তখন কিরণের বাড়ির বাইরের দিকে একটা চালাঘরে সবে লাইব্রেরী হয়েছে। অনেক বই যোগাড় হয়েছে। কিরণের বাড়িতে যত পুরোন পাঁজি ছিল, রামায়ণ মহাভারত ছিল, অ্যালজেব্রা, জিওমেট্রি ছিল, সব জড়ো করে কিরণ তার লাইব্রেরী করেছে। মেম্বারদের নাম লিখেছে একটা খাতায়। সকলকে চাঁদা দিতে হবে। তারপর লাইব্রেরীটা আরো বড় হলে তখন একটা বাড়ি করা হবে হাজার টাকা দিয়ে।
কিরণ বলতো–দেখবি তিন হাজার বই করে ফেলবো আমি আর কটা দিনে–
তারপর দীপঙ্কর আর কিরণ এর বাড়ি ওর বাড়ি বই ভিক্ষে করে নিয়ে আসতো। পড়ার বই আর কারো বাড়ি রইল না। যত বই বাড়িতে ছিল সব একদিন দিয়ে এল কিরণকে।
কিরণ বলতো–একদিন চাঁদার খাতটা নিয়ে ঘুরতে হবে বাড়ি বাড়ি–
বই হলো, কিন্তু চাঁদা আর ওঠে না।
রাখাল ছিল চণ্ডীবাবুদের বাড়ির ছেলে। বড়লোক খুব। দুপুরবেলা বাড়ির দারোয়ান রামধনি টিফিনের সময় একটা কাঁসার গ্লাসে ঢাকা দেওয়া দুধ আনতো আর চারটে রসগোল্লা। ইস্কুলের দারোয়ান দুপুরবেলা গেট বন্ধ করে দিত। যে-ছেলেরা পয়সা পেত বাড়ি থেকে, তারা গেটের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে আলুকাবলি, ঘুগনিদানা, আমসত্ত্ব কিনতো। লটারির বিস্কুটও ছিল। একটা নম্বর-লাগানো থালার ওপর একটা কাঁটা ঘুরিয়ে দিত। কাঁটাটা ঘুরতে ঘুরতে যত নম্বরে এসে থামতো সেই ততগুলো বিস্কুট দিত এক পয়সায়। আর টিফিনের ঘণ্টা বাজবার একটু আগে থেকেই রামধনি এসে দাঁড়িয়ে থাকতো দুধের গ্লাস নিয়ে। জায়গাটা বেশ ছায়া ছায়া। একটা মাধবীলতার গাছ গেটের ওপর উঠে ঢেকে দিয়েছিল জায়গাটা। মাধবীলতার শেকড়টাও অশ্বথ গাছের মতো মোটা হয়ে গিয়েছিল।
রামধনি ডাকতো–এ-দাদাবাবু, এ-দাদাবাবু–
রাখাল মোটা-সোটা নাদুস-নুদুস চেহারার ছেলে। হাফ প্যান্ট, শার্ট এটে বসে থাকতো ক্লাসে। টিফিনের ঘণ্টায় ইস্কুলের মাঠে লাটু ঘোরাতে সবাই ব্যস্ত তখন। কিংবা চোর-পুলিস। চোর-পুলিস খেলাটাই ছিল বেশি মজার। একজন চোর হতো আর সবাই পুলিস হয়ে তাকে খুঁজে বেড়াতো। তারপর ছিল ঘূর্ণিফল। ঘূর্ণিফল খেলাও ছিল মজার।
রামধনি আবার ওধার থেকে ডাকতো-এ দাদাবাবু, দাদাবাবু দুধ খেয়ে যাও–
শেষকালে যখন কিছুতেই খাবে না রাখাল, তখন রামধনি অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টারকে গিয়ে বলতো। অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টার ছিলেন রামরতনবাবু। ভারি কড়া লোক। বগলের তলা দিয়ে চাদরটাকে ঘুরিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখতেন। রামধনির কথা শুনে দৌড়ে আসতেন। এসেই ঘঁক দিতেন–এই ইস্টুপিড–
রাখাল মুখ কাচুমাচু করে খেলা ছেড়ে এসে দাঁড়াতো।
রামরতনবাবু বলতেন–দুধ খাচ্ছো না কেন, দুধ খাও–
রাখাল আস্তে আস্তে রামধনির হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে টো-টো করে সব দুধটা এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলতো। তারপর চারটে রসগোল্লা একটার পর একটা মুখে পুরে দিত। রসগোল্লাগুলো চিবোতে চিবোতে যেন দম আটকে আসতে রাখালের। দীপঙ্কর, কিরণ, ফটিক, বিমান, লক্ষ্মণ সরকার সবাই চেয়ে চেয়ে সেই রসগোল্লা খাওয়া দেখতো তার। রাখালের রসগোল্লা চিবানো দেখে মনে হতো সে যেন একমুখ নিমপাতা খাচ্ছে।
সবটা খাওয়া হয়ে গেলে রামরতনবাবু বলতেন–আর যেন কখনো তোমার নামে কমপ্লেন না শুনতে হয় আমায়-বুঝলে?
রাখাল মুখ নিচু করে ঘাড় নাড়তো।
রামরতনবাবু আবার বলতেন–দুধ খেতে এত গোলমাল কর যেন বুঝতে পারি না, জানো দুধ কত পুষ্টিকর খাবার, দুধ খেলে শরীর ভালো হয়, আর শরীর ভালো হলে ব্রেনও ভালো থাকে, ব্রেন ভালো হলে তবে তো লেখাপড়া করতে পারবে–যাও–
বলে রামরতনবাবু চলে যেতেন।
তখন রাখাল নিজমূর্তি ধরতো। রামধনিকে বলতো–দাঁড়া, তোকে আজকে আমি কী করি। তুই যখন ঘুমোবি তখন তোর টিকি কেটে দেব–
কথাটা বলতেই দীপঙ্কর, ফটিক, কিরণ, বিমান সবাই হো-হো করে হেসে উঠতো। তখন রাখাল একটা ছড়া কাটতে–
রামধনি পাঁড়ে–
দই নেই ভাঁড়ে–
পাড়ের মাথায় লম্বা টিকি
টিকি নিয়ে খরচ লিখি–
টিকি কাটবো কচকচিয়ে–
পাঁড়ে মরবে ছট ফটিয়ে।
এ সেই রাখাল। এক-একদিন রাখাল কিছুতেই আর রসগোল্লা খেতে পারতো না। দীপুকে বলতো–এই দীপু, খাবি?
রামধনি দীপঙ্করের দিকে কটমট করে তাকিয়ে দেখতো।
দীপঙ্কর বলতো–না ভাই, আমার পেট ভর্তি আছে–
কিরণ সেই রাখালকেও মেম্বার করেছিল লাইব্রেরীর। এক আনা করে চাঁদা। মাসে মাসে দিতে হবে। বেশি দিলে তি নেই। সেই পয়সায় বই কিনে বিরাট লাইব্রেরী হবে। তারপর যখন আরো পয়সা হবে লাইব্রেরীর, তখন একটা ঘর তৈরি করা হবে। তখন সবাই আসবে লাইব্রেরী দেখতে। মহাত্মা গান্ধী এলে তাকে ডেকে দেখানো হবে। জে এম সেনগুপ্ত আসবেন। ভালো ভালো বই সব থাকবে লাইব্রেরীতে।
রাখাল বললে–আমি তোদের অনেক বই দেব–আমাদের বাড়িতে অনেক বই আছে–
সত্যিই কিরণ গিয়ে বই নিয়ে এসেছিল। মোটা মোটা বাঁধানো বই সব। সবই ইংরিজী। তা ইংরিজী বইও থাক। ইংরিজী বইও থাকা দরকার।
রাখাল বললে–কাউকে বলিস নি যেন, র্যাপারের মধ্যে পুরে নিয়ে যা ভাই, দাদু দেখতে পেলে বকবে–
কিরণ র্যাপারের মধ্যে জড়িয়ে বইগুলো এনেছিল। সমস্ত দিন কিরণ সেই লাইব্রেরীর মধ্যেই থাকতো। বইগুলো বার করে সাজিয়ে রাখতো। আলমারি নেই, টেবিল নেই, চেয়ার নেই, কিছু নেই। শুধু একটা মাদুর পাতা মেঝের ওপর। আর দেয়ালের গায়ে বইগুলো ইট পেতে সার সার করে দাঁড় করানো। অনেকদিন দীপঙ্কর গিয়ে দেখেছে কিরণ একলা চুপ করে বসে আছে ঘরের ভেতরে–
দীপঙ্কর বলতো–কীরে, একলা কী করছিস?
কিরণ বলতো–কেউ আসে না, কেউ না এলে আমি একলা কী করে লাইব্রেরী চালাবো বুঝতে পারছি না ভাই–
আশ্চর্য কিরণের ধৈর্য। বই আছে মেম্বার নেই। কেউ আসে না লাইব্রেরীতে। সেই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরের মধ্যে গিয়ে বসতে কারোর তেমন মাথাব্যথা নেই। সবাই তখন ফুটবল খেলতে গেছে পার্কে, কিংবা হরিশ পার্কে গেছে, কিংবা রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। তখন কিরণ একলা-একলা অন্ধকার ঘরে লাইব্রেরী করছে। লাইব্রেরী ঝট দিচ্ছে, বইগুলোর ধুলো ঝাড়ছে, বইতে নম্বর দিচ্ছে, খাতায় নামগুলো লিখে ক্যাটালগ তৈরি করছে। কাজ তো একটা নয়!
কিরণ বললেবোস, তোর সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে–
দীপঙ্কর বললে–কী?
-আমাদের লাইব্রেরীর একটা নাম দিতে হবে ভাই, আমি একটা নাম ভেবেছি, নামটা কী রকম হয়েছে বল তো–দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী–
দীপঙ্কর বললে–খুব ভালো নাম হয়েছে–
কিরণ বললে–একটা সাইনবোর্ড টাঙাতে হবে-একটা টিন দিতে পারিস চৌকোমতন–আমি রং দিয়ে লিখে নেব–
সে টিনও শেষ পর্যন্ত যোগাড় হয়েছিল। অঘোরদাদুর উঠোনে একটা ক্যানেস্তারার টিন পড়েছিল বহুদিন ধরে। সেই টিন পিটিয়ে সোজা করে বাক্স রঙ-করার দোকান থেকে রং এনে ইংরিজীতে সাইনবোর্ড তৈরি হয়েছিল। শুধু সাইনবোর্ডই নয়, রবার স্ট্যাম্পও একটা এনেছিল কিরণ। প্রেসিডেন্ট হয়েছিল দীপঙ্কর আর সেক্রেটারী হয়েছিল কিরণ।
কিরণই ঘুরে ঘুরে চাঁদা আদায় করতো। ক্লাসের সব ছেলের কাছ থেকে আদায় হলো চাদা। তারপর ক্লাসের বাইরে। মধুসূদনের বড়দা দিলে দু আনা। দুনিকাকাও দিলে দু-আনা–
দুনিকাকা বললে–আবার লাইব্রেরী কেন রে বাবা, লাইব্রেরী করে কী হবে? লেখাপড়া করিস মন দিয়ে?
কিরণ বললে–আউট বুক পড়বো, তাই–
-কী আউট বুক পড়বি শুনি? আউট বুক মানে কি আগে বল্ দিকিনি? আউট বুক বানান্ কী বল্ দিকি আগে তোরা–
দীপঙ্কর একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিরণ বললে–বাইরের বই না পড়লে তো নলেজ হয় না–
-আবার নলেজ শিখেছে! নলেজ বানান করতে পারিস ছেঁড়া? নলেজ নিয়ে কি ধুয়ে খাবি সব? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হবি?
ছোনেদা বললে–আহা চাইছে দু আনা পয়সা, দিয়ে দাও না দুনিকাকা–
দুনিকাকা রেগে গেল। বললে–আরে, তুই বুঝিস না, দেখছিস পাড়ায় সি-আই-ডি ঘুরছে, স্বদেশী বই-টই যদি রাখে তো কোনদিন বিপদ হবে এমন। শেষে টেগার্ট সাহেব খবর পেলে মেরে তক্তা বানিয়ে ছেড়ে দেবে সকলকেটেগার্ট সাহেবকে তো চেনেনা না–
যাহোক, শেষ পর্যন্ত দুনিকাকা ফতুয়ার পকেট থেকে একটা দোয়ানি বার করে দিলে।
কিরণ একটা রসিদ দিতে যাচ্ছিল। দুনিকাকা বললে–আর রসিদ দিতে হবে না, শেষকালে নাম দেখে কোনদিন ইলিশিয়াম রো-তে ধরে নিয়ে যাবে, তখন চাকরিটি খতম–টেগার্ট সাহেবকে তো চেনো না।
সেই কিরণ! যখন ইস্কুলের সব ছেলেরা লেখাপড়া গল্প ঝগড়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন কিরণ তার লাইব্রেরী নিয়ে মেতেছে। কিরণের বড় সাধ ছিল, দেশে স্বরাজ আসবে, সি আর দাশ তার দেশের রাজা হবে। বড় সাধ ছিল তার বাবার অসুখ ভালো হয়ে যাবে, তাদের অবস্থা ফিরবে। কিন্তু সি আর দাশ মারা যাবার পর থেকেই কিরণ যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ লাইব্রেরীর ভূত ঢুকলো মাথায়। যখন সবাই নানান কাজে মত্ত, কিরণ তখন লাইব্রেরী নিয়ে দিনরাত মাথা ঘামাচ্ছে। মানুষের সংসারে এমনি অবুঝ লোক বোধহয় দু-একটা থাকে। পৃথিবীতে এমনি বেহিসেবি লোক বোধহয় দু একটা বাস করে। তারা কাজ করে মনে-প্রাণে, নিষ্ঠা নিয়ে কাজের চেষ্টাও করে। তারপর একদিন কোথায় থাকে তাদের কাজ, আর কোথায় থাকে তারা। সবাই যখন কাজের সাফল্যে একেবারে প্রথম সারিতে এগিয়ে এসে পঁড়িয়েছে, তখন আসল মানুষটিকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন সেই বেহিসেবি কাজ-পাগল মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, কেউ আর তার খোঁজও রাখে না। কেউ আর তার সন্ধানও নেয় না।
কিরণের সঙ্গেই আগে একবার নির্মল পালিতের বাড়িতে গিয়েছিল দীপঙ্কর।
চণ্ডীবাবুদের মতো ব্যারিস্টার পালিতও ছিলেন বড়লোক। কিন্তু অন্য ধরনের বড়লোক। চণ্ডীবাবুরা বনেদী। গাড়ি ছিল, সরকার, মুহুরী, গোমস্তা, দারোয়ান, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, দোল-দুর্গোৎসব সবই ছিল। তাদের ছেলে রাখাল খেত দুধ আর রসগোল্লা। কিন্তু ব্যারিস্টার পালিত ছিল নতুন আমদানি। কবে একদিন হাইকোর্ট হয়েছিল কলকাতায়, পঞ্চায়েত উঠে গিয়ে ধর্মাধিকরণের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইংরেজের সাম্রাজ্যে। সেদিন উদ্দেশ্য যত সই থাক, আকাঙ্খ যত বিরাটই থাক, আর একদল মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে। সে-মানুষেরা কালীঘাটে যেত না, দোল-দুর্গোৎসবে যোগদান করতো না, তারা বাঙালী হয়েও থাকতো সায়েব পাড়ায়। তাদের বাড়িতে রান্না করতো বাবুর্চি-খানসামা, ছেলে মানুষ করতো আয়া, বাবাকে বলতো ড্যাডি, আর মাকে বলতো মাম্মি।
নির্মল পালিত ছিল সেই সমাজের। দারোয়ান ইস্কুলে নিয়ে এসে পৌঁছে দিত। আবার ছুটির সময় সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যেত। ভালো করে ভাবও হয়নি নির্মলের সঙ্গে। বড়জোর মাঝে-মাঝে রাস্তায় পথে পার্কে দেখা হয়েছে। দেশবন্ধু যেদিন মারা যান, সেদিন দারোয়ানের সঙ্গে দেখেছে রাস্তায়। দেশবন্ধুও তো ব্যারিস্টার ছিলেন। ব্যারিস্টার পালিতের সম-ব্যবসায়ী। বোধ হয় সেই কারণেই।
মনে আছে দীপঙ্করের কেমন যেন ভয়-ভয় করছিল নির্মল পালিতের বাড়ি যেতে। এক-একটা বাড়ি থাকে, যার সামনে গেলেই ঢুকতে ভয় করে। নির্মল পালিতদের বাড়িটাও ঠিক তেমনি। সামনে একটু ঘেরা বাগান মতোন। সেখানে একটা দারোয়ান বসে থাকে। অনেক সময় একটা কুকুরও বসে থাকে সামনে।
কিরণ বললে–চল্ ভয় কী রে, আমরা তো চোর নই–ভেতরে চ্ল—
আরো অনেক আগের কথা মনে আছে। কিরণদের লাইব্রেরী তখন সবে শুরু হয়েছে। চাঁদার জন্যে তখন যার-তার কাছে হাত পাতছে কিরণ। কিরণ একলা লাইব্রেরী গড়ে তুলবে। তার আর কোন দিকে জ্ঞান নেই। এসব সেই সময়ের কথা।
বাড়ির সামনে গিয়ে সেদিনও দীপঙ্কর থমকে দাঁড়িয়েছিল।
কিরণ অভয় দিয়েছিল। বলেছিল–ভয় কিরে, চল–
দীপঙ্কর বললে–ভয় করছে ভাই, যদি তাড়িয়ে দেয়–
–কে তাড়িয়ে দেবে, আমি তো যাচ্ছি, আমার সঙ্গে চলে আয়–
বলে আগে আগে যেতেই কোথা থেকে এক দারোয়ান এগিয়ে এসে বললে–কোন্ হ্যায়-কেয়া মাতা ইধার?
দীপঙ্কর ভয় পেয়ে পালিয়েই আসছিল। কিরণও প্রথমটা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরেই সামলে নিলে। তারপর দারোয়ানের সামনে মাথা তুলে বললে নির্মলবাবু আছে! নির্মলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি–
-খোকাবাবু?
কিরণ বললে–হ্যাঁ, খোকাবাবু! খোকাবাবুর সঙ্গে এক ইস্কুলে পড়েছি, আমরা, খোকাবাবুর ক্লাসফ্রেন্ড আমরা–
দারোয়ান কিছু বুঝলো না। বললে–তব সাহেবকা পাস্ চলো—
কিরণকে নিয়ে দারোয়ান ঘরের দিকে যাচ্ছিল। কিরণ পেছনে ফিরে বললে—আয় না দীপু, চলে আয়–আমি তো আছি ভয় কী!
কিরণের অভয় পেয়ে দীপঙ্করও পেছন-পেছন গেল। গাড়ি-বারান্দার নিচে কী চমৎকার সাজানো। একটা কুকুর জিভ বার করে চেয়ে দেখছে। টবের ওপর বাহারি ফুলগাছ বসানো রয়েছে। একটা দাঁড়ানো দাঁড়ের ওপর একটা কাকাতুয়া। বসে বসে মাথা ফুলিয়ে সব দেখছে। পাশেই একটা ন্যাংটো পরী। শ্বেত পাথরের তৈরি। পরীটা কাপড় সামলাতেই ব্যস্ত।
দীপঙ্কর আর কিরণ দারোয়ানের পেছনে-পেছনে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল।
দারোয়ান ঘরের দরজাটা খুলতেই কে একজন সাহেবি জামা-কাপড়-পরা লোক যেন চিৎকার করে উঠলো। মনে হয় নির্মলের বাবা, ব্যারিস্টার পালিত।
একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। কিরণ সোজা ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। দীপঙ্করও ভেতরে ঢুকলো। একজন বাঙালীবাবুর মতন লোক একেবারে হাঁ-হা করে সামনে এগিয়ে এসেছে দরজার দিকে।
কিরণের সাহস আছে খুব বলতে হবে। বললে–নির্মল আছে?
হঠাৎ ব্যারিস্টার চেঁচিয়ে উঠলেন–Who are these urchins Babu?
বাবুটি নিজেই যেন এক মহা অপরাধ করে ফেলেছে। হন্তদন্ত হয়ে বললেখোকা, তোমরা এখন যাও, তোমরা এখন যাও এখান থেকে-সাহেব রাগ করছেন–
দারোয়ান এতক্ষণে সুবিধে পেয়ে গেল। বললে–চলো, চলো, নিকালো—
কিরণ কিছুতেই দমবার পাত্র নয়। বললে–আমরা নির্মলকে খুঁজতে এসেছি–
হঠাৎ যেন বজ্রপাত হলো! ব্যারিস্টার পালিত চিৎকার করে উঠলেন–Ask them to clear out….
ইংরিজী কি বাঙলা কী ভাষায় যে কথাটা বলা হোল, কিছু বোঝা গেল না। বোঝবার অবকাশও দিলে না কেউ। দারোয়ান ততক্ষণ তাদের দুজনকে বাইরে টেনে নিয়ে এসেছে। তারপর দীপঙ্কর আর কিরণ প্রায় একরকম গলাধাক্কা খেয়েই সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন।
দীপঙ্কর বলেছিল–আর কখনো আসবো না ভাই নির্মলদের বাড়িতে–
কিরণ বলেছিল–আলবত আসবো, লাইব্রেরীর চাঁদা নিতেই হবে নির্মলের কাছ থেকে–
মনে আছে রাস্তায় এসে বাড়িটার দিকে ফিরে চেয়ে দেখেছিল দীপঙ্কর। কোথায় যেন একটা কর্কশ রুক্ষতা, একটা মায়া-মমতাহীন কাঠিন্য মাখানো আছে বাড়িটাতে। এত সাজিয়েছে, এত ফুলের টব, এত কাকাতুয়া, এত ন্যাংটো পরী, তবু যেন কোথায় কী নেই, যেন সব থেকেও সব কিছু হারানো। সব পেয়েও সব কিছু খোয়া যাওয়ার ছাপ লেগে আছে গায়ে। যেন কাকাতুয়া পাখিটার ওই মাথা ফোলানো গম্ভীর চেহারাটার মধ্যেই বাড়িটার আসল কথা লুকিয়ে আছে।
কিরণ সেদিন বলেছিস-ঠিক আছে, দেখবি আমি ঠিক চাঁদা আদায় করবো, চাঁদা না দিয়ে ও যাবে কোথায়–
তা এতদিন পরে কিরণের কাছে নির্মল পালিতের নাম শুনে দীপঙ্কর কেমন যেন অবাক হয়ে গেল।
কিরণ বললে–নির্মলকে মেম্বার করেছি জানিস, মাসে এক টাকা করে চাঁদা দেবে বলেছে আমাকে যেতে বলেছে নির্মল, যাবি আজ?
দীপঙ্কর বললে–যদি ওর বাবা আবার তাড়িয়ে দেয়?
-দূর, ওসব ভয় করলে লাইব্রেরী করা চলে না! ওরকম লোকে কত তাড়িয়ে দেবে, কত গালাগালি দেবে। তাহলে আর কাজ হবে না কিছুই।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তোর বাবা জানে, তুই ফেল করেছিস?
কিরণ বললে–জানলে আর কী করবে, কথা তো বলতে পারে না মোটেই, গলাটা আরো ফুলে গেছে বাবার–
-কিন্তু কী করবি তুই? আবার পড়বি?
কিরণ বললে–এবার পড়লে মাইনে লাগবে। আর ফ্রি তো করবে না, তা ছাড়া পড়েই বা কী হবে! ওই সংস্কৃত ধাতুরূপ আর ওই ইংরিজী ট্রানস্লেশন পড়ে কী-ই বা লাভ! আমি লাইব্রেরীতে বসে বসে অনেক বই পড়ে ফেলেছি–
-কী বই?
কিরণ বললে–এই ম্যাকসুইনী, ম্যাটসিনী, গ্যারিবীর লাইফ-টাইফ সব পড়ে ফেলেছি, বুঝলি, আরো পড়বো। পড়ে পড়ে আমার অনেক জ্ঞান হয়েছে। তোরা সব কলেজে পড়, তোরা চাকরি-টাকরি কর, আমার ওসব হবে না–আমায় তো কেউ চাকরি দেবে না–আমি পড়বো কী জন্যে? কার জন্যে পড়বো? আর একটা সার জেনে গেছি যে, টাকা কোনওকালে হবে না আমার–
-কেন?
কিরণ বললে–দূর ভাই, আমি জেনে গেছি, জোর করে কেড়ে না নিতে পারলে কারো টাকা হয় না, এ দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত! কেড়ে নিতে না পারলে টাকাও হয় না, ও স্বরাজও হয় না–কেউ তোর মুখ দেখে তোকে টাকা দেবে না–পৃথিবীটা অত সোজা নয়–
দীপঙ্কর কিরণের কথা শুনে সেদিন কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল। এই কিরণও একদিন কত স্বপ্ন দেখেছে, কত আশা করেছে, কত ভালোবেসেছে! হঠাৎ যেন তারই মুখে কথাগুলো অন্য রকম শোনালো। কিরণ যেন কেমন বদলে গিয়েছে। কোথায় গেল তার সেই সাধু? সেই খাঁটি হিমালয়ের সাধু? সোনার কার্তিকের ঘাটে বসে যে অনেক আশার কথা শুনিয়েছিল কিরণকে! কিরণের বাবার অসুখ ভালো হয়ে যাবে, কিরণের অবস্থা ভালো হয়ে যাবে, কিরণের দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে! সে সাধুই বা কোথায় গেল, সে কিরণই বা কোথায় গেল। কোথায়ই বা গেল সেই সি আর দাশ! কিরণের দিকে চেয়ে দীপঙ্করের মনে হলো, কিরণের সমস্ত আশা, সমস্ত স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সেই ক’বছরে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে কী করে কেড়ে নিবি?
কিরণ বললে–মিথ্যে কথা বলবো, তোক খুন করবো, যা খুশী তাই করবো, সোজা মিষ্টি কথায় কিছু হবে না–
-তার মানে?
কিরণ বললে–তার মানে ওই সি আর দাশ, গান্ধী ওদের কথায় আর কিছু হবে না–কংগ্রেসের কথায় আর কিছু হবে না-কংগ্রেসের কথায় স্বরাজ হবে, না কলা হবে! ভজুদা আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে–
-কেন?
কিরণ বললে–সায়েবরা এত কষ্ট করে এদেশে এসেছে, এত বড় ব্যবসা-বাণিজ্য কেঁদে বসেছে, সব আমাদের দিয়ে দেবে বলে? ভজুদা বলেছে সংসারে সব জিনিস কেড়ে নিতে হয়, ও বাড়িতেও যা সমাজেও তাই, দেশের বেলাতেও তাই! আয়ার্ল্যান্ড কেড়ে নিতে পেরেছিল তাই স্বাধীন হয়েছিল, অ্যামেরিকা লড়াই করেছিল তাই স্বাধীন হতে পেরেছিল–জানিস, বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা–আমিও কেড়ে নেব সব-এবার থেকে পৈতে বেচবো না আর,–
-তাহলে কী করে চালাবি?
কিরণ বললে–সে আর একদিন বলবো তোকে সব, পয়সা উপায় করার সহজ উপায় আছে–ভজুদা সব শিখিয়ে দিয়েছে আমাকে–
–ভজুদা কে রে?
কিরণ বললে–আমার শুরু, তোকে একদিন আমার গুরুর কাছে নিয়ে যাবো, দেখবি তোর চোখ খুলে যাবে, জানিস, ভজুদা বলেছে আমরা যে গরীব লোক, সে ভগবানের দোষ নয়, মানুষের দোষেই আমরা গরীব। বড়লোকরাই আমাদের গরীব করে রেখেছে। সাহেবরাই তো বড়লোক! সাহেবদের যেমন করে হোক তাড়াতে হবে– তোকে একদিন নিয়ে যাবো ভজুদার কাছে, দেখবি সব প্ল্যান হচ্ছে আমাদের, এখন কিছু বলবো না–
নির্মলদের বাড়িটা এসে গিয়েছিল।
আবার সেই ব্যারিস্টার পালিতের বাড়িটা। সেই সামনে দারোয়ান বসে আছে। সেই সার-সার টবে ফুলগাছ সাজানো। সেই ঝুঁটি-ফোলানো কাকাতুয়াটা দাঁড়ানো দাঁড়ে বসে আছে। সেই ন্যাংটো পরীটা কাপড় সামলাতে ব্যস্ত।
আজ আর কিরণের ভয় নেই। কিরণ যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে এই কদিনের মধ্যে। ম্যাট্রিকে ফেল করে কিরণ যেন সত্যিই অনেক শিখে গেছে। একদিনে যেন হঠাৎ সাবালক হয়ে উঠেছে কিরণ অথচ এই কিরণের সঙ্গেই কতদিন কত রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। কত অন্তরঙ্গ ছিল কিরণ তখন। মনে হতো কিরণ আর দীপঙ্কর যেন এক। এক তাদের সমস্যা, একই তাদের ভাগ্য! কিন্তু ভাগ্যবিধাতা তাকে ম্যাট্রিক ফেল করিয়ে যেন তাকে অনেক বড় করিয়ে দিয়েছে। অনেক জ্ঞানী অনেক গুণী। দীপঙ্কর যেন কিরণের চেয়ে অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে!
কিরণ সোজা হট হটু করে সামনের গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো। আশ্চর্য। এমন বেপরোয়া তো কিরণ ছিল না আগে। এত সাহস কোত্থেকে পেলে কিরণ!
সেদিনকার সেই দারোয়ানই ঠিক তেমনি করে বসে ছিল।
কিরণ গিয়ে বললে–খোকাবাবু হ্যায়?
দারোয়ান উঠে দাঁড়াল। বললে–ঠাহরিয়ে–
বলে সোজা ভেতরে চলে গেল। কিরণ বললে–দেখলি তো! এই বেটাই সেদিন কীরকম তেরিয়া-মেরিয়া করেছিল মনে আছে তো?
সত্যি দীপঙ্করও দারোয়ানের ব্যবহারে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এ কী হলো? এমন তো হবে আশা করেনি সে। খানিক পরেই নির্মল এল। একটা পা-জামা পরা। অনেকদিন পরে নির্মলকে দেখলে দীপঙ্কর। সামান্য-সামান্য গোঁফের রেখা উঠেছে মুখে। গলাটা একটু ভারি হয়েছে। সেই নির্মল পালিত! যেন চেনা যায় না ঠিক। যেন অনেক বদলে গেছে। একটা শার্ট পরেছে। চুলগুলো আলুথালু।
নির্মল হাসলো। বললে–দীপু তুই? কত বড় হয়ে গেছিস রে? চেনাই যায় না তোকে?
দীপঙ্করেরও হঠাৎ যেন মনে হলো তাহলে শুধু নির্মলই নয়, সে-ও বদলে গেছে। নাকি! সে-ও বড় হয়েছে নাকি!
নির্মল বললে–প্রথমটা তোকে চিনতেই পারিনি
দীপঙ্কর বললে–তুই ফার্স্ট হয়েছিস?
নির্মল বললে–আমার তো ছটা মাস্টার ছিল–তোর কী হলো?
দীপঙ্কর বললে–আমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছি কোনরকমে–
কিরণ মাঝখানে বাধা দিয়ে বললে–ওসব কথা থাক্ তোদের, আমার চাদাট্টার কী হলো ব? দিবি না?
দীপঙ্কর ভাবছিল সেই নির্মল পালিত! তাকে চিনতে পেরেছে, তার সঙ্গে কথা বলেছে। তার মতো গরীব ছেলেদের সঙ্গে কথা বলাটাই তো যথেষ্ট। তার আবার এত খাতির! ওদের কি কম টাকা! ওদের কম প্রতিষ্ঠা! এক ডাকে সারা কলকাতার লোক ওর বাবাকে চিনবে। সেই তার ছেলে! সেই ম্যাট্রিকে ফাস্ট হওয়া ছেলে। থাক্ না ছটা মাস্টার! ছটা মাস্টার কে রাখতে পারে? আর ছটা মাস্টার থাকলেই কি সবাই ফার্স্ট হতে পারে! তবু তো দীপঙ্কর লোককে বলতে পারবে যে ফার্স্ট বয় নির্মল পালিত তার বন্ধু! সেদিন ব্যারিস্টার পালিতের কাছে গালাগালি খাওয়ার সমস্ত অপমান যেন এক মুহূর্তে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
কিরণ বললে–বিলেত যাবার আগে আমাকে এক বছরের চাঁদাটা দিয়ে দিস্ আমার পাঁচ শশা বই হয়ে গেছে আর সাত শো বই হলেই লাইব্রেরীটা একজনকে দিয়ে ওপন্ করাবো–
নির্মল বললে–কিন্তু তুই ফেল করলি কেন কিরণ?
কিরণ বললে–পাশ করলেই বা কী হতো? আমি তো আর পড়তে পারতুম না অত টাকা কোথায় পাবো?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তুই বিলেত যাচ্ছিস!
নির্মল বললে–বাবার খুব ইচ্ছে–
নির্মল পালিত ফার্স্ট হয়েছে শুনে তবু কিছুটা আনন্দ হচ্ছিল। দীপঙ্করের। কিন্তু তার বিলেত যাওয়াটা শুনে কমন যেন পর মনে হলো নির্মলকে। মনে হলো নির্মলের সঙ্গে তাদের অনেক তফাত।
দীপঙ্কর বললে–বিলেত যেতে তো অনেক টাকা লাগে, না রে?
নির্মল বললে–সে বাবা জানে, আমার কী!
কিরণ টাকাটা নিয়ে একটা রসিদ লিখে দিলে। এক টাকা চাঁদা। মাসে এক টাকা! ওদের কাছে কিছুই না। অমন কত টাকা কত দিকে খরচ হচ্ছে ওদের। ওটা ওদের গায়ে লাগে না। একটা টাকা ওদের কাছে সত্যিই কিছুই নয়। আশ্চর্য! কেমন অবলীলায় একটা টাকা দিয়ে দিলে।
গাড়ি-বারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। এই বাড়িতেই একদিন আরো ছোটবেলায় ঢোকবার জন্যে দূর থেকে কত লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছে দীপঙ্কর। এই বাড়িতেই একদিন ঢুকে নির্মল পালিতের বাবার কাছে বকুনি খেয়েছে দীপঙ্কর। এতদিন পরে নির্মলের সঙ্গে সেই বাড়ির গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে যেন বড় আনন্দ হোল দীপঙ্করের। যদি চাঁদা নাই-ই দিত, তবু কোনও দুঃখ ছিল না দীপঙ্করের। নির্মল পালিত তো তার সঙ্গে কথা বলেছে। নির্মল পালিত তো তাকে চিনতে পেরেছে। সেইটেই তো যথেষ্ট।
নির্মল হঠাৎ বললে–চা খাবি?
দীপঙ্কর বললে–চা?
নির্মল বললে–আমাদের চা-খাবার টাইম হলো কি না–আজকে দিদির দুজন বন্ধুকে চায়ের নেমন্তন্ন করা হয়েছে আমাদের বাড়িতে–
কিরণ হঠাৎ বললে–দূর, আমরা চা-টা খাবো না, চা হলো কুলীদের রক্ত–
নির্মল’অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। বললে–কুলীদের রক্ত?
কিরণ বললে–হ্যাঁ, চা-বাগানের সাহেবরা কুলীদের পেটে বুটের লাথি মেরে পিলে ফাটিয়ে চা তৈরি করে। ওই চা খাওয়া আর কুলীদের রক্ত খাওয়া সমান–
নির্মল অনেক বই পড়েছে। কিন্তু এসব কথা কখনও কোনও বইতে পড়েনি। কথাটা শুনে সে একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিরনের দিকে। যেন নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার একটু। তারপর বললে–চা আমরা কিন্তু রোজ খাই যে–
কিরণ বললে–তোরা চা খেগে যা। আমরা খাই না, আমিও খাই না দীপুও খায় না–আর কখনও খাবোও না-দেখিসনি খবরের কাগজে বেরিয়েছে, আসামে একটা সায়েব বুটের লাথি মেরে একটা কুলীর পেটের পিলে ফাটিয়ে দিয়েছে–
নির্মল বললে–আমি এখন যাই ভাই, টি-টাইম হয়ে গেল–দিদিরা বসে আছে-এক্ষুনি দিদির বন্ধুরা এসে পড়বে।
বলে নির্মল চলে গেল। কিরণ দীপুকে নিয়ে বাইরে এল।
দীপঙ্কর বললে–এই চা খেলি না কেন তুই? চা খেয়ে দেখতুম কেমন লাগে খেতে–
কিরণ বললে–দূর, লালচে রং–গরম জলের মতো–আমি খেয়েছি একবার–
নির্মল চলে যেতেই দীপঙ্কর আর কিরণ গেট খুলে বাইরে রাস্তায় আসছিল। হঠাৎ দেখলে একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। গাড়িটাকে দেখেই দারোয়ান কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে লাফিয়ে গেটটা খুলে দিয়ে সসম্ভ্রমে সেলাম করলে। আর গাড়িটা এসে ঢুকলো গাড়ি-বারান্দার তলায়।
নির্মলদেরই গাড়ি। হঠাৎ দীপঙ্করের ভয় হলো। যদি গাড়ির ভেতরে নির্মলের বাবা থাকে। যদি নির্মলের বাবা দেখতে পায় তাদের। দেখতে পেয়ে সেদিনকার মতো বকে আবার।
দীপঙ্কর বললে–পালিয়ে চল্ কিরণ-নির্মলের বাবা আসছে বোধহয়–আবার বকবে হয়তো।
কিন্তু না। দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল দেখে। নির্মল পালিতের বাবা নয়। ভেতর থেকে নামলো লক্ষ্মীদি আর সতী। আর নামতেই দারোয়ানটা সোজা হয়ে আত্মর সেলাম ঠুকলে দুজনকে।
লক্ষ্মীদি প্রথমে দেখতে পায়নি। সতী ছিল পেছনে। সেই আঁকড়া-ঝাকড়া চুলভর্তি মাথা। এক রকমেরই শাড়ি পরেছে আজ দুজনে। লক্ষ্মীদি চুল বেণী করে পিঠে ঝুলিয়ে দিয়েছে। দুজনেই তার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে। তাদের দেখতে পায়নি।
দীপঙ্কর বললে–চল্ কিরণ, এখুনি দেখে ফেলবে—
কিরণ জিজ্ঞেস করলে–কে রে ওরা?
দীপঙ্কর বললে–বাইরে রাস্তায় গিয়ে বলবো–
তাড়াতাড়ি হন্ হন্ করে রাস্তার দিকে যেতেই হঠাৎ পেছন থেকে লক্ষ্মীদির গলার আওয়াজ এল–কে রে? দীপু না? এই দীপু শো–
দীপঙ্কর পেছন ফিরলো। লক্ষ্মীদি আর সতী সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দীপঙ্কর সামনে এগিয়ে গেল।
লক্ষ্মীদি সিঁড়ির দুটো ধাপ নেমে এসে জিজ্ঞেস করলে–দীপু? তুই এখানে কী করতে রে?
দীপঙ্করও যেন সত্যি-সত্যি অবাক হয়ে গেছে।
লক্ষ্মীদি সামনে এসে দীপুর দুটো কাঁধে হাত দিয়ে বললে–পালাচ্ছিলি কেন আমাকে দেখে?
দীপঙ্করের মুখে কথা হারিয়ে গেছে। সে কী বলবে বুঝতে পারলে না। কেনই বা সে লক্ষ্মীদিদের দেখেও পালিয়ে যাচ্ছিল। কেন, কীসের ভয় লক্ষ্মীদিকে! লক্ষ্মীদি তো আর তাকে কোনদিন মারে না। তবে? তবে কি লজ্জা! সতাঁকে দেখে লজ্জা! অথচ সতী তো তাকে চেনেও না। হয়তো মনেও রাখেনি তাকে সতীও তার দিকে চেয়ে ছিল। দিদি কার সঙ্গে কথা বলছে তাই দেখছিল।
দীপঙ্করের মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন থরথর করে কাঁপতে লাগলো, বললে–তোমরা?
লক্ষ্মীদি বললে–আমাদের আজ চায়ের নেমন্তন্ন আছে এখেনেতা তুই আর আসিস না কেন রে?
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগল।
লক্ষ্মীদি সতাঁকে ডেকে বললে–এই এর কথাই বলেছিলুম তোকে–কেবল তোর কথা জিজ্ঞেস করতো, জানিস! তুই কেমন দেখতে, ফরসা না কালো, এই সব–দিনরাত কেবল তোর কথা জিজ্ঞেস করতো–নে এখন মিলিয়ে দেখ, মিলেছে কি না।
তারপর দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–এই তো আমার বোন সতী রে–তুই অত জিজ্ঞেস করতিস সব কথা, সতী বলতে অজ্ঞান, আর সেই সতী এল তুই একবারও দেখতে এলি না?
সতী যেন তখন সামনে ভূত দেখেছে। সিঁড়ির ধাপ দুটো টপকে একেবারে দিদির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
-ওমা, কী সর্বনাশ, এই সেই দীপু! সেই উঁকি মেরে মেরে দেখতো তোমাকে!
লক্ষ্মীদি জিজ্ঞেস করলে–কেন তুই কী ভেবেছিলি?
সতী সে-কথায় কান না দিয়ে হঠাৎ দীপুর হাত দুটো ধরে ফেললে। বললে–তুমি কিছু মনে করো না কিন্তু–
লক্ষ্মীদিও অবাক হয়ে গেল যেন। বললে–ওমা তুই চিনিস নাকি ওকে? তুই ওকে চিনলি কী করে?
সতী বললে–আমি বুঝতেই পারিনি লক্ষ্মীদি, আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি, আমি ভেবেছিলাম…
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমাকে চাকর ভেবেছিলে বলে আমি কিছু মনে করিনি সেদিন–
বলে একটু থামলো দীপঙ্কর।
সতী বললে–সত্যিই আমার বড় অন্যায় হয়ে গিয়েছিল–জানো লক্ষ্মীদি, সেদিন আমি এর মাথায় মোট বইয়ে নিয়ে এসেছিলাম–
দীপঙ্কর বললে–আর চারটে পয়সাও দিয়েছিলে–
সতী এবার হেসে ফেললে। বললে–পয়সা চারটে নিলে না দেখে আমি ভাবলাম কম দিয়েছিলাম বলে বুঝি নিচ্ছে না–সত্যিই আমি কী করে বুঝবো বলো, আমি তো চিনতাম না, কলকাতায় সেদিন প্রথম এসেছি কিনা–
লক্ষ্মীদি বললেওমা তোদের এত কাণ্ড ঘটে গেছে আমি তো কিছু জানতাম না সেই জন্যেই বুঝি তুই আসতিস না আমাদের বাড়িতে, আমি তাই ভাবছিলাম দীপু আসে না কেন–
দীপঙ্কর বললে–না লক্ষ্মীদি,-সেজন্যে নয়, তোমাদের কাজ করতে পেলে আমি তো বেঁচে যাই–
লক্ষ্মীদি বললে–সত্যিই রে সতী, দীপু আমার সব কাজ করে দেয়–ও কিছু মনে করেনি–
সতী সত্যিই খুব লজ্জায় পড়েছিল। বললে–না, না, আমি তোমায় কোনও কাজ করতে দেব না, আর তোমায় আমার কোনও কাজ করতে হবে না তা বলে–
লক্ষ্মীদি বললে–নারে, ওকে কাজ করতে দিস তুই নইলে ও উঁকি মেরে দেখবে—
কথাটা বলে লক্ষ্মীদি হাসলো। দীপঙ্কর লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললে।
সতী বললে–কিন্তু ছি ছি, সত্যিই আমার খুব লজ্জা করছে–
লক্ষ্মীদি বললে–ওর কাছে আবার লজ্জা কীসের রে তোর, ওকে আগে কত মেরেছি, ওর কাছে আমার কোনও লজ্জা-টজ্জার বালাই নেই-তা আসিস্ তুই আমাদের বাড়িতে, আসবি তো? কবে আসবি? কাল? আমার একটা কথা আছে তোর সঙ্গে।
সতী তখনও তার দিকে চেয়ে ছিল। আবার বললেছি ছি, আমার বড় লজ্জা করছে সত্যি। ছিঃ–
লক্ষ্মীদি তার হাত ধরে টানলে। বললে–রাখ তুই, ওকে আর লজ্জা করতে হবে না। তোর চলে আয়-ভারি তো এক ফোঁটা লজ্জার মানুষ–
বলে লক্ষ্মীদি সতাঁকে টেনে নিয়ে ওপরে চলে গেল।
রাস্তায় কিরণ তখনও সেইদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দীপঙ্কর কাছে আসতেই কিরণ বললে–ওরা কে রে? খুব লাগদার চেহারা তো? কে ওরা?
দীপঙ্কর বললে–ওই আমাদের অঘোরদাদুর ভাড়াটেদের বাড়ির মেয়ে–
দীপঙ্কর অন্যমনস্কের মতন কিরণের সঙ্গে হাঁটছিল। কিরণের কথাগুলো ঠিক তার কানে যাচ্ছিল না যেন। তার হাতটা চেপে ধরেছিল সতী। লজ্জায় পড়েছে সত্যিই! চিনতে না পারলে কী করবে! সতীর তো দোষ নয়!
কিরণ আবার বললে–ওদের সঙ্গে বুঝি খুব রগড়া-রগড়ি তোর?
দীপঙ্কর অন্যদিকে চেয়ে বললে–না, সে-সব কিছু নয়–
-তবে? ওরা খুব বড়লোক বুঝি?
দীপঙ্কর বললেবোধহয়–কী করে ওদের বাবা?
দীপঙ্কর তখনও আপন মনে ভাবছিল। সত্যিই সতীর আর দোষ কী? চিনতে পারেনি বলেই তাকে পয়সা দিয়েছিল। চিনতে পারলে তো আর দিত না। সতী লক্ষ্মীদির মতোন নয় একেবারে। কত লজ্জায় পড়েছে যে। বার বার আফসোস করেছে। দীপঙ্করেরই লজ্জা হতে লাগলো! লক্ষ্মীদি কি সব বলে দিয়েছে? সেই উঁকি দিয়ে দেখার কথাও বলে দিয়েছে? হয়তো আরো অনেক কথা বলেছে। কে জানে!
কিরণ বললে–কী রে, কথা বলছি না যে?
-কী বলবো?
-কী করে ওর বাবা?
দীপঙ্কর বললে–শুনেছি নির্মলদের চেয়েও বড়লোক ওরা, বর্মায় কাঠের ব্যবসা ওদের–
কিরণ লাফিয়ে উঠলো। বললে–তাহলে তো খুব ভালোই হয়েছে রে, কেল্লা মেরে দিয়েছি–একটা কাজ কর না–
-কী কাজ?
-তুই করবি কি না বল আগে?
দীপঙ্কর বললে–কী কাজটা বল না–
কিরণ বললে–তোর সঙ্গে অত রগড়া-রগড়ি, আমাদের লাইব্রেরীর মেম্বার করে দে না ওদের, মাসে দুজনে এক টাকা করে চাঁদা দেবে আর বই পড়বে?
দীপঙ্কর সে-কথার কোনও উত্তর দিলে না। নির্মলদের সঙ্গে ওদের আলাপ হলোই বা কী করে! কখনও তো শোনেনি লক্ষ্মীদির মুখে। এমন করে যে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে তাও তো ভাবেনি দীপঙ্কর। যে কদিন সতী এসেছে সে-কদিন কতবার লোভ হয়েছে ওদের বাড়ি যাবার জন্যে! কেবল মনে হয়েছে একবার যদি লক্ষ্মীদি ডাকে! একবার যদি রঘুকে পাঠিয়ে দেয়। নিজে যেচে যেতে কেমন লজ্জা করতো দীপঙ্করের। সকালে বিকেলে আমড়া গাছতলার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে।
মা বলেছে-হারে, ওখানে ঘুরঘুর করছিস্ কেন রে? ওখানে তোর কী?
জানালার পর্দার ফাঁকে একটা মুখ দেখবার জন্যে অনেকবার উঠোনে ঘোরাঘুরি করেছে। কেউ এদিকে দেখে না। এ-বাড়ির দিকে চেয়ে দেখবার গরজ কারো নেই। শব্দ করে কাশলেও কেউ উঁকি দেয় না এদিকে।
মা বলেছিল–ঠাণ্ডা লাগিয়ে আবার সর্দি কাশি করো-জ্বর বাধাও–তখন আমারই জ্বালা–
ম্যাট্রিকের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে তখন। কত ভাবনা তখন মা’র। কোন্ কলেজে পড়বে, কে খরচ যোগাবে, কোথা থেকে বই আসবে, সব ভাবনা মা ভাবছে তখন। কাকে ধরে কার কাছ থেকে ভিক্ষে করে ছেলের পড়ার খরচ চলবে এইসব ভাবনায় মা তখন অস্থির। আর পড়া ছেড়ে একটা চাকরিও যদি কেউ জুটিয়ে দেয় তা-ও মা ভাবছে। কে ই বা চাকরি দেবে! মা তখন দুপুরবেলা ঘরে চাবি দিয়ে বেরোয়। ছেলের ভবিষ্যতের জন্যে এর বাড়ি ওর বাড়ি গিয়ে গিন্নীদের কাছে ধর্না দেয়। যদি কর্তাকে বলে কোনও অফিসে ঢোকানো যায়! আর ওদিকে দীপঙ্কর তখন ঘরের জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। যদি লক্ষ্মীদি ডাকে! যদি একবারটি ডেকে পাঠায়। যদি সতাঁকে আর একবার দেখতে পায়!
তা সেই অত চেষ্টা, অত পরিশ্রমেও যা হয়নি তাই-ই হলো নির্মলদের বাড়িতে চাঁদা চাইতে এসে। ভাগ্যিস কিরণের সঙ্গে এসেছিল সে এখানে-এই নির্মলদের বাড়িতে, নইলে হয়তো দেখা হবার সুযোগই মিলতো না।
কিরণ সঙ্গে যেতে যেতে এক-সময়ে বললে–যাকগে, এক টাকা করে যদি না দিতে চায় তো আট আনা করে দিতে বলিনা হয় আট আনাতেই দুজনকে মেম্বার করে নেওয়া যাবে-কী বল–
তখনকার দিনে কিরণ সত্যিই লাইব্রেরী ছাড়া আর কিছু ভাবতোই না। দীপঙ্কর ফটিক মধুসূদন সবাই কলেজে ঢুকেছে। সকালবেলা খেয়ে দেয়ে তিন-চারজনে দল বেঁধে কলেজে যেত। আর কিরণ, কিরণের সঙ্গে দেখা হলেই লাইব্রেরীর কথা বলতো।
কিরণ বলতো–তোরা লাইব্রেরীতে কেউ না এলে আমি একলা সামলাবো কী করে?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো–কত মেম্বার হলো এ-পর্যন্ত?
মেম্বার অনেকে হয়েছিল অবশ্য। সবাই শুধু চাঁদা দেওয়ার মেম্বার। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কিরণ বার বার তাগাদা দিয়ে চাঁদা আদায় করে আনতো। কেউ দু’ আনা, কেউ এক আনা, আবার কেউ বা খালি এক পয়সা। ছোট ছোট ছেলেরা আধলাও দিয়েছে।
রাস্তায় হয়তো ভিক্ষে করছে কিরণ। ট্রাম রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সুর করে বলছে ভদ্রলোকেরা দয়া করে পৈতে কিনে নিয়ে যাবেন, ভদ্রলোকেরা দয়া করে…
রাস্তার ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন দুজন হয়তো কিনতো পৈতে। সাত আট পয়সার পৈতে বিক্রী হলেই চলে আসতো কিরণ। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে, বেশিক্ষণ ভিক্ষে করতে ভালো লাগতো না। তাছাড়া, দীপঙ্কর ছিল ছোটবেলা থেকে কিরণের সর্বণের সঙ্গী। ক্লাসেরও সঙ্গী, ভিক্ষেরও সঙ্গী। বরাবর এক সঙ্গে লেখাপড়া করেছে, এক সঙ্গে ভিক্ষে করেছে, এক সঙ্গে মিটিং শুনতে গেছে–হঠাৎ দীপঙ্কর পাশ করে যাওয়াতে কিরণ। যেন বড় একলা পড়ে গিয়েছিল। চুপচাপ লাইব্রেরীতে বসে থাকতো। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তো, তখন মাদুরটার ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়তো।
বাড়িতে এসে মা’কে পয়সাগুলো গুনে দিত।
বলতো–আজকে ন’ পয়সার বিক্রি হয়েছে মা-এই নাও—
মা বলতো–তা হারে, আর হলো না?
কিরণ বলতো–আর পৈতে কিনলে না কেউ–
-কেন? তুই ভালো করে ধরলেই কেনে, একটু মুখ ফুটে বলবি তো, বলবি তো যে, বাবার অসুখ, আমাদের সংসার চলে না–
-ওকথা শুনে শুনে ওদের কান পচে গেছে, বিশ্বাস করে না আর–
মা বলে–ভালো করে বলতে জানলেই বিশ্বাস করবে, তুই পারিস না ভালো করে বলতে?
কিরণ বলেও বিশ্বাস করলেও আর কেউ পৈতে কিনবে না।
-কেন? পৈতে ছিঁড়ে গেলেই তো কিনবে। বামুনেরা গলায় পৈতে না দিয়ে থাকবে নাকি?
কিরণ বেশি কথা বললে রেগে যেত। বলতো–পৈতে আজকাল কেউ পরে? বামুনরাও পৈতে পরা ছেড়ে দিচ্ছে–তুমি বাড়ির ভেতর থাকো, তুমি কী করে জানবে! বামুন-শুদুর-বেনে সব এক হয়ে গেছে–ও সুতো গলায় ঝুলিয়ে কী হয়?
কিরণের মাকে কখনও জোরে কথা বলতে শোনেনি দীপঙ্কর। কিরণের মা কথাগুলো শুনে কেমন যেন অবাক হয়ে যেত। হতবাক হয়ে যেত। বামুনরা পৈতে গলায়। দেবে না? তাই কখনও হয়? তাহলে চন্দ্র-সূর্য উঠছে কেন? দিন-রাত্রি হচ্ছে কেন? বামুনরাই যদি ধর্ম না মানে তাহলে পৃথিবী রসাতলে যাবে না? ধর্ম-কর্ম লোপ পাবে না? আজ এত বছর ধরে কিরণের মা ওই পৈতে বিক্রীর পয়সায় সংসার চালিয়েছে, স্বামীর অসুখের খরচ চালিয়েছে, ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছে, আর এখন সেই পৈতেই যদি না চলে?
হঠাৎ কিরণের বা পকেটে পয়সার ঝন্ ঝন্ শব্দ হতেই মা যেন চমকে উঠেছে। বললে–ওই যে পয়সার শব্দ হলো, ওই তো পয়সা রয়েছে তোর কাছে–
কিরণ রেগে উঠতো। বলতো–ও কি তোমার পয়সা? ও তো আমার–
-তোর আবার পয়সা কোত্থেকে এল? তুই রোজগার করিস?
-তা রোজগার করি না বলে কি আমার পয়সা থাকতে নেই–ও পয়সায় তুমি হাত দিতে পারবে না–
কিরণের মা তখন কিরণের জামার পকেটে হাত দিতে গেছে।
কিরণ লাফিয়ে উঠলো।
-খবরদার বলছি, ও পয়সায় হাত দিও না।
-তা কোত্থেকে অত পয়সা এল, তা তো বলবি–দেখছি একটা পয়সার জন্যে আমি মাথা খুড়ে মরছি, আর তোর পয়সা থাকতে আমাকে দিবি না? পয়সা নিয়ে কি আমি নিজের পেটে পুরবো, আমার নিজের পেটের জন্যে আমি পয়সা-পয়সা করি! তোর জন্যেই তো পয়সার কথা বলি–পৈতে বেচে কাটা পয়সা পাই দেখতে পাস্ না–
তারপর কিরণের দিকে চেয়ে বলে–কোথায় চললি আবার?
কিরণ সে-কথার জবাব না দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
কিরণের মা ডাকলে–ওরে, তোর পয়সা নিয়ে আমি সগ্যে যাবো না, তোর পয়সা তোরই থাকবে,-চাল বাড়ন্ত আজকে–ভাত করতে পারিনি চালের জন্যে–
কিরণ মুখ ফিরিয়ে বললে–ভাত না হয়ে থাকে খাবো না–আমি সেই রাত্তিরে বাড়ি আসবো–
-তা তোর কাছে পয়সা রয়েছে, দিয়ে যা না, না-হয় চাল কিনে আন এক সের–
কিরণ এতক্ষণে রেগে আগুন হয়ে গেল। বললে–এ কি আমার পয়সা যে চাল কিনে আনবো, তোমার সঙ্গে বাপু আমার কথা বলবার সময় নেই–
–তা তোর যদি পয়সা নয় তো তোর পকেটে রয়েছে কেন? কিরণ বললে–তুমি মেয়েমানুষ, তুমি এ-সব কী বুঝবে বল দিকিনি-লাইব্রেরীর চাঁদা আমার পকেটে থাকবে না তো কার পকেটে থাকবে শুনি? এ-সব গোনা-গুন্তি চাঁদার পয়সা, মেম্বারদের চাঁদার পয়সা, আমার নেবার জো আছে!
এতক্ষণ কিরণের বাবা দাওয়ায় বালিশের ওপর বুক রেখে সব বোধহয় শুনছিল। হঠাৎ যেন উসখুস করতে লাগল। হাত দুটো নেড়ে কী যেন বলতে গেল। কেমন একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোল গলা দিয়ে। আর তারপরেই বুক থেকে বালিশটা গড়িয়ে উঠোনের ধুলোর ওপর পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কিরণের মা দৌড়ে গেছে।
কাছে গিয়ে বললে–একটু জল খাবে? জল দেব একটু গরম করে?
কিরণের বাবা কথা বলতে পারলে না। কেমন একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে লাগলো। আর কিরণ তাড়াতাড়ি সদর দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে সোজা বাইরে বেরিয়ে এল।
দীপঙ্কর এতক্ষণ সব দেখছিল, সব শুনছিল বাড়ির বাইরে থেকে। বাড়ির ভেতরে ঢাকা নিষেধ। কিরণের বাবার থুথু উঠোনময় ছড়ানো থাকে। এতে রোগের বীজাণু থাকে। মা বারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু বাইরে থেকে সব দেখতে দেখতে কেমন যেন হতবাক হয়ে গেল। কোথায় গেল সেই সোনার কার্তিকের ঘাটের সাধু! আর কোথায় গেল সেই সি আর দাশ। কতদিন আগে কিরণ বিশ্বাস করতো তাদের সব দুঃখের একদিন অবসান হবে। সেই ছোটবেলাকার কিরণ তখন আরো বড়ো হয়েছে। দীপঙ্করও বড় হয়েছে আরো। সে-সব কথা আর তখন বলে না সে। তখন বুঝেছে লাইব্রেরীটাই হলো আসল কাজ, লাইব্রেরীটা গড়ে উঠলে সকলের সব দুঃখের অবসান হবে। সবাই, কলকাতার আর বাঙলাদেশের সব লোক যদি দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী’র মেম্বার হয়, তাহলে সোনার কার্তিকের ঘাটের সাধু যা বলেছিল সেই সবই ফলে যাবে। সেই লাইব্রেরী হলেই লোকে সব শিখতে পারবে, সব শিখলেই তখন চোখ খুলবে। আর চোখ খুললেই স্বরাজ। স্বরাজ এলেই সকলের দুঃখ ঘুচবে। আর কী চাই!
বাইরে এসেই কিরণ বললে–কী ঝামেলা দেখেছিস্ দীপু মন দিয়ে যে কাজ করব, বেশ মন দিয়ে যে লাইব্রেরীটা গড়ে তুলবো, তার উপায় নেই। বাড়িতে ঢুকতে ভাল্লাগে না আর–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু ভাত না খেয়ে কী করে কাজ করবি? যদি ক্ষিদে পায়?
কিরণ বললে–ভাত না পেলাম তো বয়েই গেল–ডাব খাবো–
-ডাব?
কিরণ বললে–চল না, পেট ভরে যত ইচ্ছে ডাব খেয়ে নেব, সারাদিন আর ক্ষিদে পাবে না–
জায়গাটা দীপঙ্করও চিনতো না। সত্যিই অজস্র অসংখ্য ডাব। যত ইচ্ছে ডাব খাও। শুধু একটা কাটারি দরকার। কিংবা ছুরি হলেও চলে। কালীঘাটের মন্দিরের পশ্চিমে সোনার কার্তিকের ঘাটে যাবার রাস্তার মোড়ে একটা ডাবের দোকান। ডাবের পাহাড় হয়ে আছে দোকানের সামনে। আগের দিন সংক্রান্তি না কী গেছে। শালপাতার ঠোঙায় সামনের রাস্তাটা ভর্তি। কোত্থেকে একটা কাটারি নিয়ে এল কিরণ।
বললে–দাঁড়া তুই–ভালো ভালো দেখে ডাবগুলো কাটি আগে–
রাস্তার নর্দমা থেকে একটা বড় সাইজের ডাব তুলে নিয়ে কিরণ কাটারি দিয়ে কেটে দু’খানা করে ফেললে। ভেতরে সাদা পুরু শাস। জলটা খেয়ে কোনও খদ্দের ফেলে দিয়েছে ওখানে। সব শাসটা খেয়ে কিরণ বললে–লোকগুলো কী বোকা দেখেছিস তো, আসল জিনিসটাই খায় না–তুই খাবি একটু?
শুধু একটা নয়। আরো অনেকগুলো। ডাব একে একে কেটে শাঁস খেলে কিরণ।
বললে–যেদিন বাড়িতে ভাত হয় না, সেদিন এখানে আয়েস করে ডাব খাই-এ খেলে শরীরের তেজ বাড়ে জানি–
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কেউ কিছু বলে না?
কিরণ বললে–কে আর কী বলবে রে, এ-সব তো ময়লা-ফেলা গাড়িতে করে ধাপায় নিয়ে যায়–শুধু এই কাটারির জন্যে যা একটু অসুবিধে, বেটারা দিতে চায় না কাটারি, বলে–দাঁত পড়ে যাবে-এবার একটা কাটারি কিনলে নির্ভাবনা–
খাওয়ার ব্যাপারটা যেদিন প্রথম দেখেছিল দীপঙ্কর সেদিন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল।
জিজ্ঞেস করেছিল–তুই রোজ খা?
কিরণ বললে–ক্ষিদে পেলেই ডাবের দোকানে চলে আসি, আর মজাসে ডাব খাই-ভাত তো রোজ হয় না আমাদের বাড়িতে–
তারপর খানিক থেমে বললে–খাওয়াটার একটা যা হোক ব্যবস্থা করে ফেলেছি, এবার কাপড়টার একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই নিশ্চিন্তি, তা-ও আর বেশিদিন ভাবতে হবে না–
ততক্ষণে মুখটা মুছে বললে–এবার চল–
বেশ নিশ্চিন্ত নির্বিকার মুখ। পকেটে গোটাকতক পৈতে, আর একটা পকেটে লাইব্রেরীর রসিদ বই, আর হাতে মেম্বারদের নামের খাতা। কোথায় কোথায় কত দূর দূর যেত কিরণ। আগে যেত পৈতে বেচতে, তারপর পৈতে বেচাও ছিল, লাইব্রেরীর মেম্বার যোগাড় করাও ছিল।
কিরণ বলতো–আমার সঙ্গে তোরও যাওয়া উচিত–তুই থাকলে একটু সুবিধে হয়। আসলে তুই হলি প্রেসিডেন্ট আর আমি তো মাত্র সেক্রেটারি-এক-একজন বলে কিনা প্রেসিডেন্ট আসে না কেন?
হাঁটতে হাঁটতে কিরণ অনেক দূরে টেনে নিয়ে যেত এক-একদিন। কোনওদিন খিদিরপুর, কোনওদিন টালিগঞ্জ, কোনওদিন পোড়াবাজার। ক্লাসের সব জানাশোনা ছেলেদের মেম্বার করে ফেলেছিল কিরণ। রাখাল, নির্মল পালিত, বিমান মিত্তির সবাই। দুনিকাকা, পঞ্চাদা, মধুসূদন। শেষে প্রাণমথবাবুকেও মেম্বার করে ফেলেছিল।
শেষে একদিন বললে–এই, তোর অঘোরদাদুকে মেম্বার করা যায় না?
দীপঙ্কর বললে–দূর–
–কেন, দোষ কী?
–না ভাই, শেষকালে লাঠিপেটা করবে–মুখপোড়া বলে গালাগালি দেবে—
কিরণ বললে–তুই অত ভীরু কেন, অত ভয় করলে প্রেসিডেন্ট হওয়া চলে? ওর তো অনেক পয়সা আছে–দু’আনা করে মাসে দিক না–
-না ভাই, আমি বলতে পারবো না।
কিরণ ভাবতো। তাহলে আর কে আছে?
–আচ্ছা চন্নুনীকে মেম্বার করে নিলে হয় না?
শুধু চন্নুনী নয়, পৃথিবীর সমস্ত মানুষকেই কিরণ তার লাইব্রেরীর মেম্বার করবার জন্যে যেন পাগল হয়ে উঠেছিল তখন। কিরণের মনে হতো ভালো কাজের জন্যে মেম্বার হতে কেন আপত্তি হবে। পয়সা তো চুরি করবে না কিরণ। একদিন এই লাইব্রেরীর নাম তো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। তখন? তখন তো সবাই যেচে খোশামোদ করে মেম্বার হতে চাইবে। কিন্তু তার আগে? তার আগে দিন-রাত না খাটলে চলবে কেন! কলেজের সব ছেলেদের মেম্বার করবার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে কিরণ।
বলতো–তোদের কলেজে অত ছেলে, আর তুই একটাকেও মেম্বার করতে পারলি না–ধিক্ তোকে–
শেষে আর নাম খুঁজে পাওয়া যেত না। কিরণ রাস্তার মোড়ে মোড়ে গিয়ে দাঁড়াত। সুর করে বলতো–ভদ্রলোকেরা দয়া করে এক পয়সার পৈতে কিনে নিয়ে যাবেন জ্বলোকেরা দয়া করে….
কিরণের ফর্সা চেহারা, কিরণের খালি পা, ছেঁড়া জামা-কাপড় দেখে এক একজনের দয়া হতো বোধ হয়।
কাছে এসে বলত–দেখি ভাই, কেমন পৈতে দেখি–
পৈতের ফেটি খুলে পাকিয়ে দেখে দু’একজন কিনতো। তারপর পৈতের পয়সা দিয়ে চলে যাবার সময় হঠাৎ কিরণ বলতো–আমাদের লাইব্রেরীর মেম্বার হবেন। স্যার–?
-লাইব্রেরী! ভদ্রলোকেরা অনেকেই চমকে উঠতো।
কিরণ উৎসাহ পেয়ে পকেট থেকে রসিদ বইটা বার করে দেখিয়ে বলতো–এই দেখুন স্যার, অনেকেই মেম্বার হয়েছেন, নতুন করেছি, পাঁচশো বই হয়ে গেছে। দয়া করে যদি মেম্বার হন,-আমিই সেক্রেটারী–আর ওই আমাদের প্রেসিডেন্ট বসে আছে-ওই যে–
দূরে দীপঙ্করকে দেখিয়ে দিত কিরণ। দীপঙ্কর তখন অনেক দূরে একটা গাছতলায় হঁট পেতে তার ওপর বসে আছে।
ভদ্রলোক রেগে যেত। বলতো–এই বয়সেই জোচ্চুরি ব্যবসা ধরেছ, ছোকরা জানো পুলিসে ধরিয়ে দিতে পারি তোমাদের এখুনি–
বলে আর কথা না বাড়িয়ে ভদ্রলোক চলে গেল।
দীপঙ্কর কাছে এল। বললে–কী বলছিল রে লোকটা?
কিরণ বললে–বলছিল পুলিসে ধরিয়ে দেবে! আমাকে পুলিসের ভয় দেখাচ্ছে! পুলিসের ভয় দেখালে আর লাইব্রেরীর সেক্রেটারি হওয়া যায় না–চল, এবার অন্য মোড়ে গিয়ে দাঁড়াই–এখানকার লোকগুলো বড় বদমাইশ ভাই।–
এক-একদিন এক-এক পাড়ায়। একদিন খিদিরপুরের মোড়ে ওই রকম। তখন বিকেল হয়েছে। কলেজের গেটের সামনেই দাঁড়িয়েছিল কিরণ। বাইরে আসতেই কিরণ বললে–তোর এত দেরি হলো যে?
দীপঙ্কর বললে–হিস্ট্রির ক্লাস ছিল—
কিরণ জিজ্ঞেস করলে-আজকে মেম্বার করেছিস্ কাউকে?
দীপঙ্কর বললে–কেউ মেম্বার হতে চাইছে না ভাই–
-তুই ভালো করে বলতে পারিস না যে, তুই হলি প্রেসিডেন্ট! আর যে না-হতে চাইবে তাকে আমাদের লাইব্রেরীতে ধরে আনবি, দেখবি আমি ঠিক বুঝিয়ে-বাজিয়ে। পটিয়ে নেব-জানিস, তোরা পাশ করলে কী হবে, একটু বুদ্ধি খরচ করতে হয়।
পাশ না-করার জন্যে সত্যিই কিরণের কোনও অনুশোচনা ছিল না। পাশ তো গাধাতেও করে। কিরণের মনে হতো, নিজের তার যা-ই হোক, কিন্তু আরো অনেক ছেলে আছে কলকাতায় যারা শুধু টাকার অভাবে পড়তে পায় না। কলেজের মাইনে, এগৃজামিনের ফি কিছুই দেবার ক্ষমতা নেই। তাদের জন্যেই ছিল তার লাইব্রেরী। তার লাইব্রেরী থেকেই বই নিয়ে একদিন তারা পড়ে পাশ করবে। আর শুধু কি লাইব্রেরী। ছোট লাইব্রেরীই একদিন বড় লাইব্রেরী হবে। লাইব্রেরীর সঙ্গে থাকবে খেলার মাঠ, একসারসাইজের ক্লাব। সেখানে মনের চর্চার সঙ্গে শরীরের চর্চা হবে। শরীরটার কথা না ভাবলে চলবে না। শরীরটা চাই। দরকার হলে পুলিসকে ঠেঙাতে হবে।
তারপর চুপি চুপি বলতো–কাউকে বলিস্ নি, তোকেই শুধু বলছি, দরকার হলে আমাদের ক্লাব থেকে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, জুজুৎসু সব শেখানো হবে, আর রিভলবার পিস্তল…সে সব পরে–
–রিভলবার? পিস্তল? সে-সব কে দেবে?
কিরণ মুচকি হাসতো। বলতো–সে-সব তোর ভাবনা নেই, সব ভজুদা দেবে হিমালয়ের ওপর সব রেডি হচ্ছে–
-ভজুদা? ভজুদা কে রে?
কিরণ বলতো–তোকে ভজুদার কাছে একদিন নিয়ে যাবো, দেখবি কী লার্নেড়, লোক, সব মুখস্থ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, নেপালী, বার্মিজ, সব ভাষা শিখে একেবারে শুলে খেয়েছে ভজুদা-তোরা তো ম্যাট্রিক পাশ, তোদেরও ইংরিজী শেখাতে পারে।
ভজুদার কথা সে-ই প্রথম কিরণের মুখ থেকে শোনে দীপঙ্কর। তখনও ভজুদাকে দেখবার সুযোগ হয়নি। কোথাকার কোন্ ভজুদা, কোথা থেকে এত ভাষা শিখলো তা ও জানতো না। কিন্তু তবু কিরণের মুখ থেকে তার কীর্তি-কাহিনী শুনে কেমন যেন ভয় হতো, রোমাঞ্চ হতো দীপঙ্করের। প্রাণমথবাবু শুধু জেল খাটে, কিন্তু ভজুদা? ভজুদা জার্মান ফ্রেঞ্চ নেপালী বার্মিজ ভাষা জানে। ভজুদা রিভলবার পিস্তল সব দিতে পারে। পুলিস কিছু তার টের পাবে না। হিমালয়ের ওপরে সব রেডি হচ্ছে।
কিরণ বললে–তোকে তাহলে খুলেই বলি দীপু, লাইব্রেরীটা আমাকে ভজুদাই করতে বলেছে–
–তুই ভজুদাকে চিনলি কী করে?
কিরণ বললে–সে-সব এখন তোকে কিছু বলবো না, ভজুদা বলেছে তোকে একদিন নিয়ে যেতে–
–আমাকে চেনে ভজুদা?
কিরণ রহস্যময় হাসি হাসলো একটা। ‘পথের দাবি’ পড়েছিস?
-পথের দাবি?
কিরণ বললে–লজ্জার কথা! তুই হলি দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী’র প্রেসিডেন্ট আর তুই-ই ‘পথের দাবি’র নাম শুনিনি? লজ্জার কথা, লোকে বলবে কী, বল তো?
তারপর হাসি থামিয়ে কিরণ বললে–শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই ‘পথের দাবি’ উপন্যাস–গভর্নমেন্ট প্রেস্ক্রাইব করে দিয়েছে, সেই ‘পথের দাবি তো ভজুদাকে নিয়েই লেখা–
কেমন করুণার দৃষ্টি দিয়ে কিরণ দীপঙ্করের দিকে চেয়ে দেখলে। দীপঙ্কর কিছু জানে না। লেখা-পড়া শিখে ম্যাট্রিক পাশ করলে কী হবে, দীপঙ্কর তো ভজুদাকে চেনে না। দীপঙ্কর তো জানে না, আড়ালে আড়ালে ভজুদারা কত কী কাণ্ড করছে। তোমরা পাশ করে কলেজে পড়ে চাকরি করবে! কিংবা বিয়ে-থা করে সংসারী হবে। আর কিরণরা? তারা আরো মহৎ কাজের জন্যে পৃথিবীতে এসেছে। তিরিশ টাকার চাকরি জুটলে অবশ্য আপাত অভাব মিটবে। দুবেলা ভাত হয়তো জুটবে, বাবার ওষুধ হয়তো জুটবে, মা’র শাড়িও হয়তো জুটবে। কিন্তু তাতেই কি দুঃখ ঘুচবে? তাতেই কি সবাই সুখী হবে? তাতেই কি সকলের ভাত, সকলের কাপড়, সকলের আশ্রয় জুটবে? চাকরি জুটলে আর কত হবে? এখন একবেলা খাচ্ছি, তখন হয়তো দুবেলা খাবো। একটা ছেঁড়া কাপড় পরছি, তখন হয়তো আস্ত কাপড় পরবো। কিন্তু অভাব আমার যা আছে, তাই ই থাকবে–
-তাহলে কীসে অভাব ঘুচবে?
কিরণ বললে–সে ভজুদা তোকে সব বুঝিয়ে দেবে–তাই তো বলছি তার আগে দুই আমাকে কিছু মেম্বার যোগাড় করে দে লাইব্রেরীর–তখন দেখবি ভজুদা কী করে–
রাস্তায় চলতে চলতে অনেকদূর চলে এসেছিল। খিদিরপুরের মোড়ের কাছে আসতেই কিরণ বললে–দাঁড়া তুই, এখানে একটু ভিক্ষে করে নিই–
দীপঙ্কর অনেকদূরে গিয়ে দাঁড়াল। বেশ স্পষ্ট বিকেল হয়ে গেছে তখন। কতকগুলো ট্রাম সোজা খিদিরপুরের দিকে চলে যাচ্ছে। আর কতকগুলো যাচ্ছে কালীঘাটের দিকে। কয়েকটা জুতোর দোকান। মুসলমানদের রুটি মাংসের হোটেল। শিকে-ফোঁটানো গরুর মাংস টাঙানো রয়েছে সার-সার। আর বিরাট একটা উনুনের সামনে মোটা-মোটা রুটি তৈরি করছে হাত দিয়ে। দীপঙ্করের ক্ষিদে পেতে লাগল। অনেকদিন মাংস খায়নি দীপঙ্কর। মাংস খেতে বেশ লাগে। মাংস হলে সেদিন চেয়ে চেয়ে ভাত নেয় দীপঙ্কর। মাংস আর কদিনই বা হয় অঘোরদাদুর বাড়িতে। যেদিন হয়তো অঘোরদাদুর যজমানরা প্রসাদ পাঠিয়ে দেয়, সেইদিনই মাংস হয়। তাছাড়া, মাংস অঘোরদাদুর বাড়িতে হয় না বড় একটা।
এদিকে কিরণ তখন গলাটা করুণ করে বলছে-ভদ্রলোকেরা দয়া করে পৈতে কিনে নিয়ে যাবেন–ভদ্রলোকরা দয়া করে…
হঠাৎ অবাক হয়ে গেল দীপঙ্কর।
-এ কি, কাকাবাবু না? রাস্তার ওপাশে হঠাৎ যেন কাকাবাবুর মতো কাকে দেখা গেল। সঙ্গে আরো কয়েকজন লোক রয়েছে। কিন্তু কাকাবাবুর এ-রকম চেহারা কেন? সেই কোট-প্যান্ট টুপি কোথায় গেল? এ যেন অন্যরকম চেহারা হয়ে গেছে আজ! মাথার চুল উস্কোখুস্কো, পরনে ময়লা ধুতি, গায়ে একটা ছিটের কামিজ! একেবারে চেনাই যায় না। এই খিদিরপুরেই কাকাবাবুর আপিস নাকি? এ রকম পোশাকে তো কখনও দেখেনি কাকাবাবুকে।
-কাকাবাবু?
এ-ফুটপাথ থেকে ও-ফুটপাথে পার হতে গিয়ে পেছন থেকে ডাকলো দীপঙ্কর।
-কাকাবাবু!
কাকাবাবু ফিরলেন। সঙ্গের লোকগুলোও পেছন ফিরে চেয়ে দেখলে তার দিকে।
-কাকাবাবু আপনি এখানে? আমি আপনাকে চিনতেই পারি নি একেবারে–এরকম জামা-কাপড়ে আপনাকে কখনও দেখিনি কিনা আগে, এইদিকেই আপনার আপিস বুঝি?
কী জানি, দীপঙ্করের মনে হলো, কাকাবাবুর মুখখানা যেন অন্যদিনের চেয়ে গম্ভীর গম্ভীর। তার দিকে চেয়ে সে-রকম হাসলেন না আর। যেন প্রথমটায় চিনতেই পারলেন না। দীপঙ্কর কাছে আসতেও যেন অভ্যর্থনার ইঙ্গিত দেখা গেল না দুচোখে। তবে কি কাকাবাবু নয়? তবে কি ভুল করেছে দীপঙ্কর!
-কাকাবাবু, আমি দীপু। অগোরদাদুর বাড়িতে থাকি। এই কলেজ থেকে ফিরছি—
এতক্ষণে যেন চিনতে পেরেছেন!
বললেন–তুমি? দীপুবাবু? তা এখানে কী করতে?
সে-কথার উত্তর না দিয় দীপঙ্কর বললে–আপনাকে আমি চিনতেই পারিনি কাকাবাবু। আপনার এ কীরকম জামা-কাপড়?
কাকাবাবু বললেন–এই এমনি…তা আমি একটু ব্যস্ত আছি দীপুবাবু, তুমি অনেকদিন আসোনি কেন আমাদের বাড়িতে? আসবে, বুঝলে? আসবে–তোমার সঙ্গে কথা আছে। অনেক তাহলে আমি এখন আসি, কেমন–
কাকাবাবুর সঙ্গের লোকগুলোও তার দিকে এতক্ষণ যেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছিল। কাকাবাবুর সঙ্গে তারাও চলে গেল। দীপঙ্কর সেইখানে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলো। দেখলে কাকাবাবু পাশের অন্ধকার একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
দীপঙ্কর হঠাৎ কাকাবাবুর এই ব্যবহারে কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। এখানে ও রকম পোশাকে কাকাবাবু কী করছেন! সঙ্গের ও লোকগুলোই বা কে? অন্ধকার গলির মধ্যে সবাই ঢুকলো কেন? ওখানেই কাকাবাবুর আপিস নাকি? ও কীরকম আপিস, এ কীরকম চাকরি। এই সময়ে তো লোকের ছুটি হয়। এই সময়েই কাকাবাবু আপিসে ঢুকলেন নাকি আবার? কিন্তু দীপঙ্করকে এখানে দেখে তবে অমন গম্ভীর হয়ে গেলেন কেন? যেন ঠিক চিনতে পারেন নি!
ওদিকের ফুটপাথে কিরণ তখনও সুর করে বলছে–ভদ্রলোকরা দয়া করে পৈতে কিনে নিয়ে যাবেন, ভদ্রলোকরা দয়া করে…
দীপঙ্করকে দেখেই কিরণ এগিয়ে এল। বললেকী রে, কোথায় গিয়েছিলি? তোকে খুঁজছিলুম!
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে কত হলো আজকে?
কিরণ বললে–এগারো পয়সা হয়েছে–এতেই হয়ে যাবে কিন্তু লাইব্রেরীর মেম্বার কেউ হতে চায় না–
দীপঙ্কর বললে–খুব কিদে পেয়েছে ভাই-পেট চোঁ চোঁ করছে—
কিরণ বললে–ডাব খাবি? ডাব! আবার সেই ডাব! কিন্তু ডাব খেতেও তো অনেকদূর যেতে হবে!
দীপঙ্কর বললে–ডাব তো সেই মন্দিরের কাছে, কালীঘাটে–সে তো এখনও অনেকদূর এদিকে ডাবের দোকান নেই?
কিরণ বললে–আছে–
-কোথায়?
কিরণ বললে–ডকের ধারে, একটা দোকান আছে, গাদা গাদা ডাব পড়ে থাকে নর্দমায়–
-কিন্তু কাটারি?
কিরণ বললে–একটা দোকানের সঙ্গে ভাব করেছি, একটা পয়সা দিলে কাটারিটা ধার দেয়-পয়সা আছে তোর কাছে?
দীপঙ্কর বললে–না–
-সে কি রে তোরা কলেজে পড়িস, একটা পয়সাও পকেট থাকে না তোদের?
দীপঙ্কর বললে–তোর কাছে তো পয়সা রয়েছে।
কিরণ বললে–পৈতের পয়সার তো হিসেব দিতে হবে মা’কে–
-কিন্তু লাইব্রেরীর চাঁদার পয়সা রয়েছে, তার থেকে একটা পয়সা নিলে কী হয়?
কিরণ বললে–তা হয় না রে, ও তো আমার নয়, মাকেই বলে ও-পয়সা ছুঁতে দিই না। ও পয়সায় হাত দিতে পারবো না ভাই-লাইব্রেরীর পয়সা হচ্ছে পাব্লিকের পয়সা, ও আমি ছুঁতে পারবো না–
-তা হলে?
জীবনে কোথাও যখন কোনও হদিস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, ঠিক তখনি এক-এক সময়ে অকূলে কূল পাওয়া যায়। সেদিন দীপঙ্করের ঠিক তাই হলো। এমন যে হবে ভাবতেও পারা যায়নি। এমনভাবে যে দেখা হয়ে যাবে হঠাৎ তারও কোনও ঠিক-ঠিকানা ছিল না। দীপঙ্করও অবাক হয়ে গিয়েছিল। আর তারপর কিরণও অবাক হয়ে গিয়েছিল কম নয়।
খিদিরপুরের সেই রাস্তার মোড়ের মাথায় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। সেই স্যুটপরা চেহারা। সেই ফিটফাট সাজগোেজ। সেই ফরসা লম্বা-চওড়া গড়ন। হন্ হন্ করে কোথায় চলেছেন। প্রথমে দীপঙ্কর দেখতে পায়নি। কিরণ দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াল। বললে–আমাদের লাইব্রেরীর মেম্বার হবেন স্যার?
–লাইব্রেরী? কোন্ লাইব্রেরী?
–দি কালীঘাট বয়েজ লাইব্রেরী, পাঁচশো বই আছে আমাদের, আরো বই কিনতে হবে অনেক, যদি কিছু সাহায্য করেন-বলে কিরণ ছাপানো রসিদ বইটা সামনে খুলে ধরলো।
বললে–এই দেখুন অনেকে চাঁদা দিয়েছে, চাঁদা কালেক্ট করে আমরা আরো বড় লাইব্রেরী করবো, এই দেখুন এই ভদ্রলোক দিয়েছেন এক টাকা, আর দেখুন এই–
ভদ্রলোক আট আনা–
-কালীঘাট? কালীঘাটে কোথায় তোমাদের লাইব্রেরী?
-নেপাল ভট্টাচার্যি লেন। এখন ছোট ঘর আছে, পরে বড় বাড়ি ভাড়া নেব–
-কালীঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন চেনো?
কিরণ এবার সাহস পেয়ে গেল। বললে–ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন? ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনেই তো আমাদের প্রেসিডেন্ট থাকে–ওই তো আমাদের প্রেসিডেন্ট, দীপঙ্কর সেন, উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন–
উনিশের একের বি! নম্বরটা শুনে ভদ্রলোক যেন কেমন বিচলিত হলেন মনে হলো। চেয়ে দেখলেন প্রেসিডেন্টের দিকে। দীপঙ্কর তখন দূর থেকে কিরণের কাণ্ড দেখছিল। সামান্য ঝাপসা-ঝাপসা অন্ধকার হয়ে এসেছে। ভালো করে দূরের মানুষকে চেনা যায় না। ভদ্রলোক তখন একেবারে দীপঙ্করের সামনে এগিয়ে এসেছে। বললেগুড় গুড়, তুমি? দীপু?
ভদ্রলোকের মুখে নিজের নাম শুনে দীপঙ্করও চমকে উঠেছে। ভালো করে চেয়ে দেখল দীপঙ্কর। যেন চেনা-চেনা মনে হলো তার। যেন কোথায় দেখেছে অনেকবার। অনেকবার কথা বলেছে, কাছে এসেছে…
হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
-আপনি? আপনি এখানে?
-আমাকে চিনতে পারছো তুমি? আমি মিস্টার দাতার, অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা–
মিস্টার দাতার! এতদিন নামটাই জানতো না দীপঙ্কর। সেই কুণ্ডুপুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো দীপঙ্কর, আর লক্ষ্মীদির চিঠিটা নিয়ে ভদ্রলোকের হাতে দিত। চিঠিতে কী লেখা আছে, তাও জানতো না, চিঠি যাকে দিত তার নামও জানতো না। শুধু একবার দেখেছিল লক্ষ্মীদি ভদ্রলোকের একখানা ছবি নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। দীপঙ্করকে দেখেই ছবিটা লুকিয়ে ফেলেছিল লক্ষ্মীদি। সেই সি আর দাশ যেদিন মারা যান। তারপর এতদিন নিয়ম করে চিঠি দিয়ে এসেছে। কত বর্ষা বাদল, গ্রীষ্ম কেটে গেছে–দীপঙ্কর ম্যাট্রিক পাস করেছে, মুখে অল্প অল্প গোঁফের রেখা উঠেছে–সে-ও অনেকদিন হয়ে গেল। তারপর একদিন সতী এসে হাজির হয়েছে–
মিস্টার দাতার হঠাৎ বললে–তোমরা চা খাবে?
দীপঙ্কর কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই কিরণ বললে–চা তো আমরা খাই না–
তবে অন্য কিছু? চপ্ কাটলেট কি সিঙ্গাড়া কচুরি?
কিরণ বললে–তা খেতে পারি, আমাদের খুব ক্ষিদে পেয়েছে—
মিস্টার দাতার বললেন–তাহলে চলো, তোমাদের খাওয়াবো আমি–
একটা মিষ্টির দোকানে গিয়ে ঢুকলেন। শ্বেতপাথরের টেবিল, হাত ধোবার জায়গা, কাঁচের গেলাস, সব আছে। মিস্টার দাতার একটা টেবিলের ধারে গিয়ে বসলেন। দীপঙ্করেরাও বসলো। তারপর লুচি এল, সন্দেশ এল, পান্তুয়া এল। কলাপাতায় করে দুজনের সামনে লুচি মিষ্টি দিয়ে গেল।
দীপঙ্কর বললে–আপনি খাবেন না?
দাতার বললেন–আমি এসব খাই না, আমি চা খাবো’খন–
কিরণের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। কিরণ তখন গোগ্রাসে গিলছে সব। এক-একটা লুচির ভেতর এক-একটা পান্তুয়া পুরে টপাটপ মুখে পুরে দিচ্ছে। কোনদিকে খেয়াল নেই তার। নিমেষে সমস্ত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দীপঙ্করের মনে হলো কিরণ যেন বড় নির্লজ্জের মতো খাচ্ছে। বড্ড লজ্জা করতে লাগলো দীপঙ্করের। অচেনা লোক খাওয়াচ্ছে, একটু আস্তে আস্তে অনিচ্ছের সঙ্গে খেলেই তো মানায়। মিস্টার দাতার কী ভাবছে কে জানে!
কিরণের দিকে চেয়ে তার বললেন–আর খাবে?
কিরণ মাথা নাড়লো—হ্যাঁ–
-তুমি?
দীপঙ্কর বললে–না–
-লজ্জা করছে নাকি? লজ্জা কোরো না, পেট ভরে খাও—
কিরণ বললে–আমার লজ্জা নেই, আমাকে যত দেবেন তত খাবো, আমি আজ চারদিন ডাব খেয়ে আছি–
–ডাব?
কিরণ বললো, আজকে সকালে দশটা ডাব খেয়েছি, কালকে খেয়েছিলাম কুড়িটা–
দীপঙ্কর থামিয়ে দিলে। বললে–ওর বাবার অসুখ, খেতে পায় না রোজ, তাই ডাবের শাঁস খায় কিরণ–
মিস্টার দাতার যেন কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। কী করে কিরণ, কী করে দীপঙ্কর। কেমন তাদের অবস্থা। কবে কীভাবে ভিক্ষে করে পড়াশোনা চালিয়েছে। তারপর কেমন করে টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি। কেমন করে প্রাণমথবাবু প্রতি মাসে সাহায্য করেন দীপঙ্করকে। কত টাকা করে সাহায্য করেন, তা-ও জিজ্ঞেস করলেন।
কিরণ বললে–আমার নিজের কিছু সাহায্যের দরকার নেই, আপনি বরং আমাদের লাইব্রেরীর মেম্বার হোনমাসে মাসে এক টাকা করে দিন–আর কিছু চাই না–
মিস্টার দাতার বললেন–মাসে মাসে এক টাকা নয়–
-তাহলে আট আনা? কিন্তু আট আনার কম নিলে আর চলে না!
–না, আট আনা নয় দু টাকা–দু টাকা করে আমি দেব–
কিরণ অবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে তার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। দীপঙ্করও কেমন হতবাক হয়ে গেছে। কতটুকুই বা জানা-শোনা, কতটুকুই বা পরিচয়! সেই লক্ষ্মীদির চিঠি দিতে গিয়েই যা মুখ-চেনা। কখনও নামও জিজ্ঞেস করেনি তাঁর। কখনও অনাবশ্যক কৌতূহলও প্রকাশ করেনি। শুধু এক-একবার মনে হয়েছে। ভদ্রলোক কে? কেন লক্ষ্মীদি তাকে চিঠি লেখে? কেন লক্ষ্মীদির বাড়িতে আসে না লোকটা, কেন এই লুকোচুরি! কেন লক্ষ্মীদি তার চিঠির কথা কাউকে বলতে বারণ করে দিয়েছে? কেউ জানতে পারলে দোষ কী? তবে কি কোনও অন্যায় করেছে! লুকিয়ে লুকিয়ে এই চিঠি দেওয়া অন্যায় বৈকি। বিন্তিদি তো কাউকে চিঠি দেয় না, বিন্তিদিকে তো কেউ দেখতেই পায় না। লক্ষ্মীদি কেন বিন্তিদির মতোন নয়!
মিস্টার দাতার বললেন–আমার আপিসের ঠিকানাটা তুমি রাখো–
বলে একটা কার্ড দিলেন। দীপঙ্কর কার্ডটা নিয়ে দেখলে-লেখা রয়েছে–মিস্টার এস এস দাতার, চব্বিশ-বি বউবাজার স্ট্রীট।
দাতার বললেন–রোজ দুপুরে আমি আপিসে থাকি, আমার আপিসে এসে চাঁদা নিয়ে যেও তোমরা বরং–
তারপর একটু থেমে বললেন–আর তোমাদের অ্যাডমিশন-ফি আমি এখনি দিয়ে দিলাম পাঁচ টাকা–
পাঁচ টাকা! পাঁচ টাকার নোটটার দিকে চেয়ে কিরণ যেন হাত বাড়াতেও ভুলে গেল। মিস্টার দাতার পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরালেন একটা। সেই সিগারেট! সেই হুস-হুঁস করে ধোয়া টানা। অনেকদিন অনেকবার ওই সিগারেট খাওয়া দেখেছে দীপঙ্কর। লক্ষ্মীদির চিঠিটা পড়বার সময় ওই রকম জোরে জোরে সিগারেট টানতো। তারপর বলতো–ভেরি গুড–
আগে লক্ষ্মীদির চিঠি নিয়ে গিয়ে দেবার সময় অনেকদিন রাগ হয়েছিল দীপঙ্করের। অনেকবার মনে হয়েছে সে যেন অন্যায় করছে, সে যেন দোষ করছে। কিন্তু এই আজ প্রথম দীপঙ্করের মনে হলো ভুল করেছিল সে। ভদ্রলোকের সম্বন্ধে অন্যায় ধারণা করা। তার ভুল হয়েছে। সত্যিই মিস্টার দাতার ভালো লোক। লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ্মীদির সঙ্গে করুক ভাব, কাউকে বলবে না সে।
দাতার বলতে লাগলেন-তোমরা হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে, আমার টাকা দেওয়া দেখে, কিন্তু একদিন তোমাদের মতন আমিও ছোট ছিলাম, আমারও অনেক কষ্টের মধ্যে দিন কেটেছে, অনেকদিন না-খেয়েও কেটেছে, অনেকদিন পকেটে একটা পয়সাও থাকতো না, কিন্তু পরে আমার অনেক টাকা, অনেক সম্পত্তি হয়েছিল–একদিন টাকার অভাবে পাগল হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েও গিয়েছিলাম–
কিরণ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলেন?
দাতার বললেন–বর্মায় পালিয়ে গিয়েছিলুম—
বর্মা! লক্ষ্মীদিদের দেশ তো বর্মায়! দীপঙ্কর যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পাবার চেষ্টা করলে। তবে কি বর্মাতেই লক্ষ্মীদির সঙ্গে ভাব হয়েছে মিস্টার দাতারের? খেয়ে দেয়ে টাকা পেয়ে কিরণের তখন মহা ফুর্তি হয়েছে। পকেট থেকে পেন্সিল বার করে একটা রসিদ কেটে দিলে। পাঁচ টাকার রসিদ।
অ্যাডমিশন-ফি। তারপর মাসে মাসে দু টাকা করে চাঁদা।
কিরণ জিজ্ঞেস করলে–আপনার ফুল নামটা কী লিখবো?
দীপঙ্কর রসিদটা এগিয়ে দিলে। তারপর মিস্টার দাতার বলতে লাগলেন তোমাদের হতাশ হবার কোন কারণ don’t be disheartened boys, আমিও একদিন পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি উপোস করে, তুমি ডাব খেয়েছ কুড়িয়ে কুড়িয়ে, আমি তা-ও পাইনি–কিন্তু, হতাশ হইনি, আমি সব পেয়েছি এখন, লোকে যা চায় সব পেয়েছি লোকে যা চায় না, তাও পেয়েছি–
কিরণ বললে–ভজুদাকে আপনি চেনেন?
-ভজুদা? Who is he? তিনি কে?
কিরণ বললে–ভজুদাও অনেক দেশ ঘুরেছে কিনা, সাতটা ভাষা জানে ভজুদা, ভজুদা নেপালী ভাষা জানে, বার্মীজ ভাষা জানে, ফ্রেঞ্চ জানে, ভজুদাও আমাকে বলেছে। কষ্ট চিরকাল থাকে না, কষ্টের একদিন শেষ আছে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, আমাদের স্বরাজ আসবে, ইংরেজরা চলে যাবে, আমাদের দেশের লোকই আবার আমাদের দেশের রাজা হবে। ছোটবেলায় কালীঘাটের সোনার কার্তিকের ঘাটের এক সাধুও তাই বলেছিল আমাকে–
মিস্টার দাতার সব শুনে বললেন–ঠিক ঠিক, বর্মায় মস্ত বড় একজন টিম্বার মার্চেন্ট মিস্টার বি মিত্র বলে একজন আছেন–তারও লাইফ-হিস্ট্রি তাই–এখন তিনি প্রচুর টাকার মালিক, প্রোমে এত বড় বিজনেস কারো নেই–
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে–লক্ষ্মীদির বাবা?
মিস্টার দাতার বললেন—হ্যাঁ–
দীপঙ্কর বললে–লক্ষ্মীদির বোন সতীও এসেছে কলকাতায়—
মিস্টার দাতার বললেন–এসেছে?
বলে কী যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ উঠলেন। বললেন–এবার আমি উঠবো, তোমরা বাড়ি যাও–ঠিক যেও কিন্তু আমার আপিসে–
মিস্টার দাতার উঠে গিয়ে দাম দিয়ে দিলেন খাবারের। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল তার খাওয়াতে।
যাবার সময় হঠাৎ দীপঙ্করকে আড়ালে ডাকলেন। বললেন—শোন—
দীপঙ্কর কাছে গেল।
দাতার বললেন–তোমার সঙ্গে লক্ষ্মীদির দেখা হবে নাকি আজ?
-হ্যাঁ-বলুন না কী বলতে হবে!
তাহলে কাল আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো সেইখানে—
দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। জিজ্ঞেস করলে সেইখানে কোথায়?
–সেইখানে বললেই বুঝতে পারবে তোমার লক্ষ্মীদি-আর কিছু বলতে হবে না। মনে থাকবে তো-কাল! কাল সকালে–
বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন।
কিরণ অনেকদিন পরে পেট ভরে খেয়েছে। পাঁচ টাকা চাঁদা পেয়েছে। এত চাঁদা আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি। চণ্ডীবাবুরা এত বড়লোক, তাদের বাড়ির ছেলে রাখালও দেয়নি। ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে নির্মলও দেয়নি। দুনিকাকা, পঞ্চাদা, মধুসূদনের বড়দা, কেউ-ই দেয়নি। বরং টিটকিরি দিয়েছে।
কিরণ বললে–লোকটা খুব ভালো রে দীপু-খুব ভালো লোক-কত খাওয়ালে আমাদের–এখন চারদিন আমার কিছু না খেলেও চলবে–
দীপঙ্করেরও মনে হলো লোকটা সত্যিই ভালো। কতটুকুই বা আলাপ, কী-ই বা সম্পর্ক! সামান্য কয়েকদিন চিঠি নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছে। তাইতেই এত খাতির, এত আপ্যায়ন।
কিরণ পাঁচ টাকার নোটটা জামার পকেট থেকে বার করলে। বার বার ভালো করে দেখলে–যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তার। পাঁচ টাকার নোট! কাগজটা পকেটে ভাঁজ করে রেখে বললে–পাঁচ টাকার নোটগুলো বেশ দেখতে, না রে?
তারপর বললে–তোর জন্যেই টাকা ক’টা পেলাম দীপু, তুই না থাকলে দিতই না–ও কে রে? তোকে চিনলে কী করে?
দীপঙ্কর তখন হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। টাকটার দিকে চেয়েই মনে হলো একটা কথা। টাকা দিলে বলেই কি লোকটা ভালো? এতদিনের সব ঘৃণা, সব অপবাদ কি ওই পাঁচটা টাকাতেই উবে গেল! টাকার জন্যেই কি কিরণ তবে প্রশংসা করছে দাতারকে? টাকা আর খাওয়ানো! যদি টাকা না দিত, যদি না খাওয়াতো? যদি অন্য লোকের মতো পুলিসে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখাতো! তাহলে? তাহলে অঘোরদাদু তো ঠিক কথাই বলেছে। টাকা দিয়েই তো সব কেনা যায়। সংসারের সব কিছুই তো টাকাতে কেনা যায়। স্নেহ, ভালোবাসা, বিবেক, গয়না, চাল, ডাল, নুন, তেল সব কিছু!
কিরণ বললে–কী রে, কথা বলছিস না যে–
পাশ দিয়ে একটা ট্রাম পুলের ওপর থেকে তখন সোঁ সোঁ করে নামছে। দীপঙ্কর অন্যমনস্ক ছিল–একেবারে তার গায়ের পাশ দিয়ে চলে গেল ট্রামটা। দীপঙ্কর এক মুহূর্তে পাশে সরে দাঁড়াল। আর একটু হলেই একেবারে যেন চাপা পড়ে যেত সে।
দীপঙ্করের মা তখন রান্না চাপিয়েছিল। বিকেল বেলাটা একটু ফুরসত থাকে হাতে। তখন দীপু কলেজ থেকে আসে না। এখন বড় হয়েছে ছেলে, কিছু বলেও যায় না। কোথায় কোথায় যায়! সন্ধ্যে হয়ে আসে, তখন এসে হাজির হয়। তারপর হ্যারিকেন জ্বেলে পড়তে বসে।
-ও মেয়ে, মেয়ে—
হঠাৎ এক-একদিন অঘোরদাদু নেমে আসে দোতলা থেকে। চোখে দেখতে পায় না অঘোরদাদু তখন। কিন্তু দেয়াল ধরে ধরে এসে দাঁড়ায় বাইরে।
বলেও মেয়ে, মেয়ে-মুখপোড়া কানেই শোনে না–
-কী বাবা? মা সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে–আপনি এখন কী করতে এলেন বাবা? ভাত ভাবেন?
-মুখপোড়াটা কোথায়? বলি গেল কোথায়, মুখপোড়াটা?
মা বুঝতে পারে না। বলে–কে বাবা? কার কথা বলছেন?
-আবার কার কথা বলবো! মুখপোড়া আবার ক’টা আছে বাড়িতে শুনি?
-ছিটের কথা বলছেন? না ফোঁটা?
অঘোরদাদু রেগে গেল। বললে–আরে, সেগুলো কি মুখপোড়া? সেগুলো তো হারামজাদা–
-তাহলে কার কথা বলছেন? দীপু?
-হ্যাঁ রে মেয়ে, সেই তো আসল মুখপোড়া! মুখপোড়া পাস করেছে আর আমায় পেন্নাম করলো না যে, মুখপোড়া ভেবেছে কি! মুখপোড়া কি সাপের পাঁচ পা দেখেছে? মুখপোড়া কি…….বলতে বলতে অঘোরদাদুর ফোকলা দাঁতের মধ্যে কথাগুলো আটকে গেল।
-ওমা সে কি কথা, ও দীপু—
দীপু পড়তে পড়তে উঠে এল।
মা বললে–তোর দাদুকে প্রণাম করিসনি তুই? সে তো অনেকদিন হলো পাস করেছে বাবা, এখন কলেজে পড়ছে, ওর বই কেনবার জন্যে আপনি টাকা দিলেন, ওর জামা কিনে দিলেন।
দীপঙ্কর অঘোরদাদুর পায়ের কাছে ঢিপ্ করে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে।
অঘোরদাদু লাঠিটা নিয়ে চীৎকার করে উঠেছে।
–বেরে। মুখপোড়া, বেরিয়ে যা–আমি কেউ নই মুখপোড়া, আমি কেউ নই তোর? আমাকে অপগেরাহ্যি?
বলতে বলতে এক-পা পেছিয়ে লাঠিটা বাগিয়ে ধরলে অঘোরদাদু।
মা বললে–আমারই ভুল বাবা, আমি কোথা থেকে পড়াবো, কোথায় টাকা পাবো, এই ভাবনাতেই অস্থির ছিলাম, তাই আপনাকে আর বলতে পারিনি–
অঘোরদাদু তবু শান্ত হয় না। চীৎকার করে বলতে লাগলো–আমাকে অপগেরাহ্যি? আমারই বাড়িতে থেকে, আমারই খেয়ে, আমাকেই কলা দেখাবি মুখপোড়া–গুনে গুনে অতগুলো তুলসী দিলুম ঠাকুরকে, দাঁড়া দেখাচ্ছি তোর পাস করা–দাঁড়া–
বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল অঘোরদাদু।
মা খুব রাগ করতে লাগলো। বললে–আমার না-হয় মনে ছিল না, আমার সাতটা ভাবনা মাথায় ঘুরছে, তোর তো খেয়াল করতে হয়–কী করিস বল তো সারাদিন কেবল খাওয়া আর কলেজ যাওয়া-আর তোর কী কাজ শুনি?
চন্নুনী সকাল বেলা বাজারে যায়। হিসেব করে করে বুঝিয়ে দেয় মা। বলে–এই চার আনার মধ্যে সব আনতে হবে চন্নুনী-বুঝলে বাছা?
চন্নুনী ফোড়ন কাটে। বলে–চার আনায় কেমন করে আনি আমি, আমি তো গুণ জানিনেকো–
-ওর বেশি আমি দিতে পারবো না বাছা। বেশি লাগে তো বাবার কাছে চেয়ে নিয়ে যাও–আমি জানি না–
চন্নুনী জানতো। অঘোরদাদুর কাছে গিয়ে পয়সা চাইবার সাহস নেই তার। গজ গজ করতে করতে ঝুড়ি নিয়ে বাজারে চলে যেত। তারপর অনেক বেলা করে যখন আসতো, তখন উনুনের কয়লা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
-হ্যাঁ গো চন্নুনী, এই এখন বাজার আনলে তুমি? কখন রান্না করবো আর কখন খেতে দেব শুনি?
শুনো পুঁইশাক, চিংড়িমাছ, একফালি কুমড়ো, আধসের আলু, একটা বেগুন এমনি আরো কটা জিনিস এনে ফেলেছে তখন চন্নুনী।
উত্তরে চন্নুনী বলতো আমি আর পারবো নি গো বাজার করতে–
-তা পারবে না তো বাবাকে গিয়ে বলো তুমি আমাকে বলে কি লাভ বাছা? আমি কে?
চন্নুনী বলতো–তা সব কথায় তুমি বাবাকে দেখাও কেন বল তো দিদি! বলি তুমি কেউ নও? বলি তুমিও তো এ-বাড়ির লোক গো–
মা রেগে যেত। তাড়াতাড়ি তরকারিগুলো বঁটিতে কুটতে কুটতে বলতো–না, আমি এ-বাড়ির কেউ নই, কেউ নই, আমি এ-বাড়ির কেউ হতে যাবো কেন শুনি? আমার কপাল পুড়েছে, তাই তোদের বাড়ি এসে ভাত রাঁধছি–আমার ছেলে মানুষ হলে আমি এখানে আর ভাত রাঁধবো ভেবেছিস?
বিন্তি দরজার কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতো। যতক্ষণ মা’র সঙ্গে চন্নুনীর কথা হতো, ততক্ষণ কিছু কথা বলতো না মুখে। যেন মহা অপরাধ করেছে সে এ-বাড়িতে মেয়ে হয়ে জন্মিয়ে। যেন মহা অন্যায় করেছে সে এখানকার সকলের চোখের সামনে বড় হয়ে। যখন ছোট ছিল বিন্তি, তখন এতটা বুঝতে পারেনি। এই কালীঘাটের আরো দশজন ছেলে-মেয়ের মতো খোলা আকাশ আর ভাঙা ছাদের তলায় মানুষ হয়েছে। দেখেছে এক বৃদ্ধ অথর্ব সংসারবিরাগী মাতামহ আর দুটি ভাইকে। ভাই দুটি কখন একে একে বাড়ি ছেড়ে বাইরের জগতে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে। কখন নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে সমস্ত মন, কিছুই তার খেয়াল ছিল না। তারপর একদিন অত্যন্ত নিঃশব্দে টিপি টিপি পায়ে যখন যৌবন এসেছে, তখন ভয়ে ভয়ে আত্মগোপন করেছে একেবারে নিজের অন্তঃস্থলের অন্তঃপুরে। তার সেখানকার সে বন্দিত্বের সংবাদ কেউ রাখেনি, রাখবার প্রয়োজনও অনুভব করেনি। এক জানতে পারতো চন্নুনী। ছোটবেলা থেকে ওই চন্নুনীই ছিল একাধারে সব। রান্না করেছে, খাইয়েছে, বাজার করেছে, আবার উঠোনও ঝাঁট দিয়েছে। ওই চন্নুনীই ছিল তখন মায়ের মতন। কিন্তু চন্নুনীও একদিন বুড়ি হয়ে গেল। চোখে ছানি পড়লো তার। সে-ও বুঝতে পারলে না মেয়েটার কথা। তখন এল দীপুর মা। তখন হঠাৎ যেন একটা আশ্রয় মিললো। হঠাৎ যেন একটা আশ্বাস মিললো তখন।
বলতো—দিদি—
তরকারি কুটতে কুটতে মা বলতো–কি রে? কিছু বলবি মা তুই?
আর কথা শোনা যেত না বিন্তির। বিন্তির মুখে তখন কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
মা আবার বলতো–কী বলছিলি বল্ না মা?
-তুমি চলে যাবে দিদি?
-ওমা, তুই বুঝি ভয় পেয়ে গেছিস ওমনি! দূর, আমি কোথায় যাবো বাছা, আমার সেই চুলোয় ছাড়া আর যাবার জায়গা রেখেছে কী ভগবান! আমার দীপু আবার মানুষ হবে, আমি নাকি আবার তাই দেখবো! তুইও যেমন।
বিন্তির মুখে তখনও কথা নেই।
মা বলতো–তোর কোন ভাবনা নেই মা, তোর একটা হিল্লে করে তবে যাব, দেখিস–
বিন্তি যেন মনে-মনে সান্ত্বনা পেত মার কথা শুনে। কিসের আশ্বাস, কিসের সান্ত্বনা তা জানতো না, তা প্রকাশ করতেও পারতো না। কিন্তু তবু মনে হতো মা’র অভয় পেয়ে বিন্তিদি যেন বড় আশ্বস্ত হয়েছে। তারপর নিজের ঘরের দরজাটার সামনে বসে মা’র রান্না দেখতো।
যখন অনেক রাত হত, মা বিন্তির ঘরে গিয়ে বলতো–দরজা বন্ধ করে শুয়ো বাছা-দরজায় খিল লাগিয়ে দিও-যদি দরকার হয় তো আমাকে ডেকো মা-বুঝলে–
তারপর এক-একদিন ছিটেকে খেতে দিয়ে মা বলতো–হ্যাঁ বাবা, তোমরা উপযুক্ত ভাই থাকতে ছোট বোনটার বিয়ে দেবে না–এ কেমন কথা–
ছিটে-ফোঁটা কেউ-ই বাড়ির ব্যাপারে বড় থাকে না কোনদিন। বাড়ির সঙ্গে কেবল খাওয়ার সম্পর্ক তাদের। তা-ও অঘোরদাদুকে লুকিয়ে। অঘোরদাদু যদি জানতে পারতো যে, ছিটে-ফোঁটা বাড়িতে খেতে আসে তো অনর্থ বাধাতো অনেকদিন আগেই।
খেয়ে নিয়ে আঁচিয়ে আবার বেরিয়ে যেত তারা।
একদিন ফোঁটাকেও ওই কথা বললে মা। বললে–তোমরা উপযুক্ত দাদা রয়েছ, তা বোনটার কথা তোত তোমরা কেউ একবার ভাববে–
বাড়িতে শুধু খাওয়া। খেতেই আসে দু’ভাই। হয়তো খেতে আসবার আগে একেবারে গঙ্গায় স্নান করে বাড়িতে এসে ঢোকে।
খেতে খেতে ফোঁটা বললে–তা আমরা কী করবো দিদি-বুড়োটা বেঁচে থাকতে সে আমরা কী করবো–
-উনি বুড়ো মানুষ, ওঁর কি চোখ আছে, ওঁর কি খাটবার ক্ষমতা আছে–
-ক্ষমতা তো নেই, কিন্তু মুখের তেজ তো আছে ষোল আনা! শালা মুখের তেজের জ্বালায় বাড়িতে পর্যন্ত টিকতে দেয় না–
মা বলতো–বুড়ো হলে মানুষ ওই রকমই হয় বাবা, তা হলে কি রাগ করা চলে, এই যে খেতে পাচেছা দু’বেলা এও তো ওঁরই দৌলতে-উনি রোজগার করে আনছেন বলেই তো দুবেলা মুখে দিতে পাচ্ছো তোমরা।
-মাইরি আর কি! খেতে দেবে না মানে! বুডোর বাপ খেতে দেবে-বুড়োর চোদ্দপুরুষ খেতে দেবে–খেতে না দিলে বুড়োকে দেখে নেব না একচোট-মাথায় থান ইট মারবো না–
এর পর আর বেশি কথা বলা চলে না। বেশি কথার মানুষও নয় ছিটে-ফোঁটা। খেয়ে উঠে আর এক মিনিট দাঁড়ায় না কেউ। উঠোনের কলের চৌবাচ্চায় আঁচিয়ে নিয়ে সোজা বাইরে চলে যায়। তারপর বাইরে গিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে লম্বা করে ধোয়া ছাড়ে। তারপর সারা দিনের মধ্যে আর দেখা পাওয়া যায় না তাদের।
তখন ছোট একটা পেতলের হাঁড়িতে আলোচালের ভাত একেবারে পুড়ে যাবার অবস্থা।
কলতলা থেকে মা ডাকে–ওমা বিন্তি, ওমা-বাবার ভাতটা পুড়ে গেল—নাবালি না–
অঘোরাদাদুর ভাতটা মা আর নামায় না। ওটা নামাবার ভার বিন্তির ওপর।
বিন্তি বলে–তুমি নামালেই পারতে দিদি–
-না বাছা, বামুনের ভাত উচ্ছিষ্ট করে পাতক হবো নাকি?
-তা আমাদের ভাত তুমি নামাও যে?
মা বলে–তোমরা হলে আমার মেয়ের মতন-চন্নুনীর হাতের ছোঁয়া খেয়ে মানুষ হয়েছ তুমি, আর আমার ছোঁয়া খেলে কী আর এমন দোষ!
তা এমনি করেই একদিন দীপুর মা এসে অঘোরদাদুর বাড়ির সমস্ত ভার মাথায় তুলে নিয়েছিল। এমনি করে একদিন এ-বাড়ির ভাত রাঁধা থেকে শুরু করে বাজার করা, হিসেব রাখা, নাতি-নাতনী মানুষ করা, সব কাজের ভার এসে পড়েছিল দীপুর মা’র ওপর। অঘোরদাদু কখনও টাকা দিয়েছে, কখনও দেয়নি। কখনও ঝগড়া করতে হয়েছে মাকে। কখনও তর্ক করতে হয়েছে মাকে। অঘোরদাদুর কাছ থেকে বিন্তির শাড়ি শেমিজ কেনার টাকাও যেমন আদায় করতে হয়েছে জোর করে, অঘোরদাদুর বাড়িঘর সারানোর টাকাও তেমনি আদায় করতে হয়েছে। বুড়ো টাকা খরচ করতে চায় না, অঘোরদাদুর কেবল মনে হয় সংসারে সবাই বুঝি তার টাকার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। অঘোরদাদুর কাছে সংসারে সবাই-ই ছিল যেন অঘোরদাদু।
কিন্তু সেই অঘোরদাদুই বোধ হয় একদিন বুঝতে পেরেছিল সংসারে আর এক ধরনের মানুষও আছে। একদিন রাত্রে হঠাৎ চণ্ডীবাবুর বাড়ি ডাকাতি হয়ে গেল। চণ্ডীবাবুদের রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের গায়ের গয়না চুরি হয়ে গেল সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। রামধনি দরোয়ান গেটের পাশেই শুয়ে থাকতো, সে-ও টের পায়নি কিছু। আগের দিন সন্ধ্যেবেলা কুল-পুরোহিত এসে পুজো করে গিয়েছেন, আরতি হয়েছে, ভোগ হয়েছে, সেবা হয়েছে, ধুপ-ধুনো জ্বলেছে, কাঁসর-ঘণ্টা বেজেছে। যা যা রোজ হয় তাই ই হয়েছে। হঠাৎ পরের দিন ভোরবেলা দেখা গেল-ঠাকুরবাড়ির দরজার তালা ভাঙা। বিগ্রহের গলার পঞ্চাশ ভরি সোনার হার আর মাথার মুকুটের সোনার মণিটা নেই। চণ্ডীবাবুরা বড়লোক। তাঁদের লোকসান গায়ে লাগে না অত–কিন্তু তারপর থেকে অঘোরদাদুর চোখের ঘুম, দিনের বিশ্রাম সব ঘুচে গেল। আশে-পাশে একটা কিছু আওয়াজ হলেই চিৎকার করেন কে? কে রে? কে র্যা মুখপোড়া?
দীপঙ্কররা যখন কালীঘাটে এসেছিল, তখন এমন কালীঘাট ছিল না। ছোট ছোট খড়ের চালা আর সরু সরু গলি। গলি দিয়ে দিয়ে এখান থেকে একেবারে ওই মন্দিরে যাওয়া যেত এক মিনিটের মধ্যে। কার বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে, কার বাড়ির উঠোনের মধ্যে দিয়ে একেবারে এক নিমেষে চলে যাওয়া যেত ভবানীপুর পর্যন্ত। অঘোরদাদুর ছাদে উঠলে এদিকে ওদিকে কত গাছ দেখা যেত। রাত্রিবেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে ঘরের জানালা দিয়ে দীপঙ্কর চোখ মেলে দেখতো-আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে অনেকগুলো দৈত্য যেন মাথাভর্তি জটা নিয়ে এদিক-ওদিক করছে। দিনের বেলায় নারকোল গাছগুলোই যে রাত্রিবেলা দৈত্য হয়ে উঠতো তা আর বোধ হয় মনে থাকতো না তখন।
-ও মেয়ে, মেয়ে-মুখপোড়া কানেও শোনে না!
অনেক রাত তখন। অঘোরদাদু খড়ম পায়ে একেবারে দীপুদের ঘরের সামনে এসে ডাকতে শুরু করেছে। দীপঙ্কর তখন ছোট। খুব ছোট। কোথাকার কোন্ হুগলী জেলার ব্যাটারা গ্রাম থেকে সবে এসে উঠেছে অঘোরদাদুর বাড়িতে। না আছে একটা আশ্রয়, নাআছে একটু সম্বল।
অঘোরদাদু বললে–কিসের শব্দ হলো মেয়ে?
-কই কিছু শব্দ শুনিনি তো–কিসের শব্দ?
অঘোরদাদু বললে–শব্দ শোননি–তাহলে আমি শুনলুম যে,–
অঘোরদাদু ছটফট করতে লাগলো কদিন ধরে। রাতেও ঘুম নেই, দিনেও ঘুম নেই। যজমানবাড়িতে পুজো করতে যাওয়া হয় সময়মত। ঘরের তালাটা বার বার টেনে টেনে বন্ধ করে। বাইরে গিয়ে রিকশায় উঠে আবার ফিরে আসে। আবার তালাটা টেনে টেনে দেখে। আবার বাইরে যায়। কোথাও গিয়েও শান্তি নেই মনে। এসেই হাঁফাতে হাঁফাতে তালাটা টেনে দেখে।
তারপর একদিন ডাকাতি হলো গঙ্গার ওপারে। ডাকাতরা ওপারে ডাকাতি করে এপারে কালীঘাটে শা’নগরে এসে সিন্দুক ভেঙে খালি করেছে।
তখন অঘোরদাদু আর ঠিক থাকতে পারলে না। আবার একদিন রাত্রে এল। ডাকলেও মেয়ে, মেয়ে–ও মেয়ে, মেয়ে–
-কী বাবা?
-তুমি এই ঘরে এসে শোও বাছা, আমি আর পারিনে মুখপোড়াদের জ্বালায়-
-কিন্তু আপনি? আপনি কোথায় শোবেন?
তা সেই দিন থেকে তাই-ই ঠিক হলো। দীপঙ্করকে নিয়ে মা শুতে লাগলো অঘোরদাদুর ঘরে। মাকে লোহার সিন্দুকটা পাহারা দিতে হলো সেই দিন থেকে। আর সেই দিন থেকে অঘোরদাদু দোতলার ঘরটায় নিজের শোবার ব্যবস্থা করলে। কিন্তু তবু অঘোরদাদুর ভাবনা কমেনি। প্রথম প্রথম দিনের মধ্যে দশবার অঘোরদাদু এসে দেখে যেত। বলতো–মুখপোড়া তালাটা ঠিক আছে তো!
বলে তালাটা টেনে টেনে দেখতে বার বার—
তারপর বলতো–ছিটে-ফোঁটা তোমার ঘরে কেউ আসে না তো মেয়ে?
মা বলতো–না বাবা–
-এলে মুখপোড়াদের বাড়ি ঢুকতে দেবে না–এই বলে রাখলুম-বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। খ্যাংরা মেরে দূর করে দেবে–
-তা ওরা খাবে কি বাবা? আপনি না খেতে দিলে ওরা খাবে কী? ওরাও তো আপনার নিজের নাতি–
অঘোরদাদু রেগে যেত। নিজের নাতি না কচুপোড়ার নাতি! অমন নাতি আমার দরকার নেই, আমি অমন নাতির মুখ দেখতে চাইনে, মুখপোড়া নাতি-নাতনী আমার সগৈড়বাতি দেবে, বলি আমার পিণ্ডি চটকাবে মুখপোড়ারা—
মা এক-একদিন বলতো–তা আমার দীপুও তো একদিন বড় হবে, তখন? তখন দীপু যদি সিন্দুক ভাঙে বাবা—
অঘোরদাদু বলতো–তা টাকা বড় না ছেলে বড় রে মেয়ে–টাকার চেয়ে ছেলে বড় হলোলা তোর কাছে? খুব সাবধান মেয়ে, ছেলেকে বিশ্বাস করিসনি মেয়ে, মুখপোড়া ছেলে সব পারে, ছেলে তোর গলায় ছুরি বসাতে পারে! ও ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনী জামাই ভাগ্নে মুখপোড়াদের কাউকে বিশ্বাস করিসনি–
-তা হলে বিশ্বাস করবো টাকাকে?
-টাকাই তো সব রে মুখপোড়া! টাকা আছে বলে বেঁচে আছি যে রে মুখপোড়া! টাকা আছে বলে খেতে পাচ্ছি যে রে মুখপোড়া! টাকাই তো ধর্ম, টাকাই তো জপ তপ রে মুখপোড়া, টাকাই তো ঠাকুর রে–
কথাগুলো দীপঙ্কর সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে আসতে অঘোরদাদুর। মা বোধ হয় বিশ্বাসও করতো কথাগুলো, আবার বিশ্বাস করতোও না বোধ হয়। একদিন টাকার জন্যেই তো দেশ ছাড়তে হয়েছে, গ্রাম ছাড়তে হয়েছে, শ্বশুরের ভিটে ছাড়তে হয়েছে মাকে। ওই টাকার জন্যেই তো মা একদিন রাত-দুপুরে ব্যাটরা ছেড়ে দীপুকে কোলে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে। ওই টাকার জন্যেই তো বাবাকে খুন করেছে ডাকাতরা। অনেকদিন দুপুরবেলা অকারণে মার চোখ দিয়ে জল পড়তে দেখেছে দীপঙ্কর। কোথাও কিছু নেই–মা চোখের জলটা আঁচলে হয়তো মুছে ফেলেছে। দীপঙ্কর প্রথম প্রথম কিছু বুঝতে পারতো না।
চন্নুনী বাজার থেকে কলাটা-মুলোটা আনলেই মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দর জিজ্ঞেস করতো। দর শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতো বুক চিরে। বলতো–এই শুকনো একটা আমের কষি, তা-ও আবার পয়সা দিয়ে কিনতে হচ্ছে মেয়ে–
বলতো–এই দীপুদের বাগানে একবার ঘুরে এলে এক চুবড়ি আম-কেউ খাবার। লোক নেই–
দীপু জিজ্ঞেস করতো–সেখানে চলো না মা–
মা থেমে যেত। বলতো–ভগবান যদি দিন দেন তো যাস্, তুই, আমি আর দেখতে পাবো না সে-সব–
সে মর্মান্তিক গল্প শুনেছে একদিন মার কাছে। সকাল বেলা বাবা গিয়েছে কাছারিতে। জমি নিয়ে জ্যাঠতুতো ভাইয়ের সঙ্গে মামলা। মামলা চলছে দু বছর ধরে। মামলা নিয়ে উকিল-মুহুরি করতে হচ্ছে। কেবল সদর আর ঘর।
মা বলতো–জমি নিয়ে তোমার এত হেনস্থার দরকার কী! তুমি জমি ছেড়ে দাও ওদেরও বড় নচ্ছার জিনিস–
বাবা বলতো–আমার জমি তা বলে ছেড়ে দেব? নইলে দীপু বড় হয়ে আমাকে দুষবে না!
হায় রে! সেই দীপুই আবার বড় হবে একদিন, সেকথা কি মা ভেবেছিল! সেই দীপুর ভবিষ্যতের জন্যেই মামলা, অথচ কোথায় রইল দীপু, আর কোথায় রইল সে জমি! আর কোথায়ই-বা রইল সেই মানুষটা। সন্ধ্যে হয়ে গেল তখনও আসে না। রাত নিম্নতি হয়ে গেল, তখনও আসে না। একবার মার সন্দেহ হল। দীপু তখন ঘুমোচ্ছে, আস্তে আস্তে মা দরজাটা খুলে একবার বাইরেটা দেখলে। সামনে একটা চালতা গাছ ছিল। সেই চালতা গাছের তলা দিয়ে কাছারি যাবার রাস্তা। মা একবার হাঁক দিলে। বউমানুষ, তবু যেন কোথা থেকে সাহস ফিরে এল বুকের মধ্যে।
ডাকলেও গোলাম, গোলাম মোল্লা।
গোলাম মোল্লা ছিল দীপুর বাবুর ছিট প্রজা। চাকরান জমি দিয়ে তাকে রেখেছিল দীপুর বাবা। কাঠ কেটে দিত, বাগানের আম-কাঁঠাল পেড়ে দিত। বাঁশ কেটে দিত। ফাই-ফরমাজ সবই সারতো গোলাম মোল্লা। বিপদের দিনে সেই গোলাম মোল্লাকেই ডাকলাম প্রাণপণে।
গল্প শুনতে শুনতে দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তারপর?
সে এক দিন গেছে দিপুর মা’র জীবনে। মানুষটা সকালে খেয়ে দেয়ে কাছারি গেছে, তখনও এল না। এমন তো হয় না। তারপর পুবের বাঁশঝাড়ে একটা চাঁদ উঠলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও গোলাম মোল্লার সাড়াশব্দ নেই।
মা আবার ডাকলেও গোলাম, গোলাম মোল্লা-গোলাম মোল্লা বাড়ি আছো?
মা জানতো গোলাম এলে আর ভাবনা নেই। যেমন করে হোক মানুষটার একটা খবর আনবেই আনবে। রাতবিরেতে একমাত্র গোলামই অসম সাহসের কাজ করতে পারে। তার প্রাণে ভয়-ডর বলে কিছু নেই। কিন্তু হঠাৎ মনে হল গোলাম মোল্লার ঘরটার দিক থেকেই কে যেন ছুটে বেরিয়ে এল। আর হাতে তার যেন কী একটা চক্ করে উঠলো। চাঁদের আলোয় দীপুর মা দেখলে গোলাম মোল্লা একটা ধারালো কাটারি নিয়ে তার দিকেই ছুটে আসছে।
মা চীৎকার করে উঠলো–ও গোলাম, গোলাম নাকি? কে গো তুমি?
এক মুহূর্তের ব্যাপার। এক মুহূর্তের জন্যেই ভগবান বাঁচিয়ে দিলেন সেদিন। হয়তো দীপুর ভবিষ্যতের জন্যেই মা বেঁচে গেল। নইলে ছিট-প্রজা গোলাম মোল্লাই যে টাকা খেয়ে মা’কে খুন করতে আসবে, কে ভাবতে পেরেছিল তখন? আর শুধু কি দীপুর মা, দীপুকেও হয়তো খুন করে ফেলতো সেদিন। টাকার এমনই খেলা। টাকায় সবাই বশ হয়। টাকার মতন নচ্ছার জিনিস আর সংসারে আছে কী?
গল্প শুনতে শুনতে দীপঙ্কর আবার জিজ্ঞেস করতো–মা, তারপর?
-তারপর কি আমার আর জ্ঞান আছে! দরজায় হুড়কো লাগিয়ে তোকে কোলে করে ভগবানকে ডাকতে লাগলুম। রাতটা পোয়ালো, সকাল হল, মানদা এল। গুপি পেয়াদা এল-আর, তারপর–
বলতে বলতে মা কান্নায় ভেঙে পড়তো। বলতো–শেষকালে আর চেনা যায়নি রে, সারা শরীর এমন খণ্ড খণ্ড করে ফেলেছে। তোর বাবার হাতে চারটে আংটি ছিল, সেগুলো দেখেই চিনতে পারলে সবাই–
তা দুদিন দু-রাতও কাটলো না। পুলিস-পেয়াদারা গা ছেড়ে চলে যেতেই আবার শুরু হলো। দিনরাত দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে পড়ে থাকি আর ভগবানকে ডাকি। তা শেষকালে তা-ও ভয় করতে লাগলো, সারা গায়ে আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। মনে হয় সবাই গা-সুদ্ধ লোক যেন টাকা খেয়েছে জাঠ-শ্বশুরের। টাকা এমনই জিনিস রে দীপু, সম্পত্তি এমনই জিনিস। ওই জমি-জমা না থাকলে কিছুই হতো না। মানুষটাও অমন করে খুন হতো না, আমাকেও হাত পুড়িয়ে পরের বাড়ি এসে এই এমন করে রাঁধতে হতো না।
এসব অনেক দিনের কথা। অনেক দিন আগেই এসব গল্প শুনেছে দীপঙ্কর। ওই কিরণ, ওই প্রাণমথবাবু, ওই অঘোরদাদু, ওই চন্নুনী, বিন্তিদি, ওই ছিটে-ফোঁটার কাহিনীও দীপঙ্করের অন্তরাত্মার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। নিজের জন্মের সঙ্গে যে দুর্ভাগ্য তার সঙ্গী হয়ে আছে, তার থেকে মুক্তি পাবার স্বপ্ন দেখতো দীপঙ্কর, কিন্তু কিরণের মতো অতটা বিশ্বাস করতে বুঝি তার ভয় হতো। বড় ভীতু দীপঙ্কর। কাউকে আঘাত দিতেও ভয় পেত, কাউকে ভালোবাসতেও তার ভয় হতো। মনে হতো কোনও কিছুকে খুঁচিয়ে তোলবার দরকার নেই, কাউকে ঘাঁটিয়েও লাভ নেই। যে-যেমন আছে, সবাই তেমনি থাকুক। কারোর যেন কোনও ক্ষতি না হয়, কোথাও যেন কিছুর ব্যতিক্রম না হয়। অঘোরদাদ হোক কৃপণ, তার বিশ্বাসের যেমন কোনও দিন অমর্যাদা না করে দীপঙ্কর, অবিশ্বাসেরও তেমনি যথাযথ মূল্য যেন সে দেয়। লক্ষ্মণ সরকার তাকে চাটি মেরে যদি তৃপ্তি পায় তো পাক, তাতে তার কী এমন ক্ষতি। একটু না-হয় সহ্যই করবে, একটু না-হয় মুখ বুজে থাকবে, তাতে কালীঘাটের নিয়মিত জীবনযাত্রার ধারায় কোনও ব্যাঘাত না ঘটলেই হলো। অঘোরদাদু যেমন যজমানদের ঠকায়, তেমনিই ঠকিয়ে যাবে, মধুসূদনের রোয়াকে দুনিকাকারা যেমন পরনিন্দা করে, তেমনি পরনিন্দাই করবে। প্রাণমথবাবুও জেলে গিয়ে যদি দেশসেবা করতে চান তো করুন, কিরণ যদি মনে করে লাইব্রেরী করেই স্বরাজ আসবে তো মনে করুক। অথচ যা হবার তা হবেই। দীপঙ্কর ভেবে দেখেছে, কারোর ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া করে পৃথিবী তার নিজের পথ এতটুকু ছাড়বে না। সে চলবেই। বরাবর যেমনকরে চলে এসেছে, তেমনি করেই চলবে। আমড়া গাছে যে-কাকটা দিনের পর দিন চুপ করে খাবারের আশায় বসে থাকে তেমনি করেই বসে থাকবে। যতদিন বাঁচবে ততদিন। আর তার সঙ্গে দীপঙ্করও দিনের পর দিন নিজের পায়ে দাঁড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে!
এমনই সব চলছিল, হঠাৎ লক্ষ্মীদিরা আসবার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন আবার আশা করতে ভালো লাগলো দীপঙ্করের।