চার
ঘোরতর অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তখন আমার মাথায় ছিল ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। আমার সামনে রুমকি। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বড়ো বড়ো কাyচের টুকরো। সুস্বাদু আচার। মশলার অপূর্ব গন্ধ। অপরাধী এইভাবেই বোধহয় আত্মসমর্পণ করে থানায় গিয়ে।
রুমকি আমাকে কিছুই বললে না। আমার পায়ের কাছে বসে বললে, ‘ইস, আমার জন্যেই কেটে গেল!’
একটু সাহস বাড়ল। বললুম, ‘পাছে পড়ে যাও তাই তোমাকে ধরতে গিয়েছিলুম।’
‘তুমি না ধরলে সত্যিই পড়ে যেতুম। বয়ামটা যে অত ভারী বুঝতেই পারিনি।’
‘কতটা আচার নষ্ট হল।’
‘জীবন আগে না আচার আগে! দাঁড়াও তোমার পা—টা ঠিক করে দি।’
‘তেমন একটা কিছু হয়নি। অল্প একটু কেটে গেছে।’
‘কাচের কাটা তো, বেশ ব্যথা হবে।’
‘আমার কিন্তু খুব ভয় করছে, যদি কেউ এসে পড়ে।’
‘সে ভয় নেই। রাত আটটার আগে কেউ আসবে না।’
আমি আপনাকে এই সব কথা শোনাচ্ছি কেন, আমার মাথায় আসছে না। এসব তো আপনার শোনার কথা নয়। যার বিশ্বাস নেই, বৈরাগ্য নেই, নানা আসক্তিতে যার অন্তর ভরা, সে কোন সাহসে আপনার কৃপা আশা করে। এমন বেসুরো মানুষকে আপনি বলতেন, ও ইখানকার লোক নয়। এখন তো ও—কথা খাটবে না। এখন তো সবাই বেসুরো। এখন তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। আমি আপনাকে গান শোনাব :
ভজন পূজন কিছুই না জানি।
তাই ভাবি কীসে পাব পদে স্থান।।
ভরসা কেবল করুণা তোমার।
তাই এ সন্তান ডাকে বার বার।।
এই কারণে শোনাব, সাধারণ ইন্দ্রিয়াসক্ত মানুষ একেবারে বেহুঁশ নয়। তার একটা আকৃতি থাকেই থাকে, একটা আক্ষেপ, এ আমি কী করেছি, আমাকে তো তাঁর কাছে যেতেই হবে। আমি বারে বারে পিছলে যাচ্ছি। আমাদের পুরনো বাড়ির সেই পিছল উঠোনের উদাহরণ। কলতলায় আমাকে যেতেই হবে, তা না হলে আমি জল পাব না। পিছলে হয়তো বারকতক পড়েই গেলুম। পড়ব উঠব, উঠব পড়ব, এই ভাবে আমি ঠিক পৌঁছে যাবো। বাধা, আপনার বাধা অতিক্রম করার ক্ষমতাও আপনার দান। তা না হলে আপনার ওই কাহিনিটা যে মিথ্যা হয়ে যায় ভগবান। আপনি মণিলাল মল্লিককে একদিন বলেছিলেন, ‘যাদের চৈতন্য হয়েছে, তারা পাপপুণ্যের পার। তারা দেখে ঈশ্বরই সব করছেন। এক জায়গায় এক মঠ ছিল। মঠের সাধুরা রোজ মাধুকরী করতে যায়। একদিন একটি সাধু ভিক্ষা করতে করতে দেখে যে, এক জমিদার একটি লোককে ভারি মারছে। সাধুটি বড়ো দয়ালু; সে মাঝে পড়ে জমিদারকে মারতে বারণ করলে। জমিদার তখন ভারি রেগে রয়েছে, সে সমস্ত কোপটা সাধুটির গায়ে ঝাড়লে, ভারি প্রহার করলে। কেউ গিয়ে মঠে খবর দিলে, তোমাদের একজন সাধুকে জমিদার ভারি মেরেছে। মঠের সাধুরা দৌড়ে এসে দেখে সাধুটি অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। তখন তারা পাঁচজন ধরাধরি করে তাকে মঠের ভিতর নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে শোয়ালে। সাধু অজ্ঞান, চারিদিকে মঠের লোকে ঘিরে বিমর্ষ হয়ে বসে আছে, কেউ কেউ বাতাস কচ্ছে। একজন বললে, মুখে একটু দুধ দিয়ে দেখা যাক। মুখে দুধ দিতে দিতে সাধুর চৈতন্য হল। চোখ মেলে দেখতে লাগল। একজন বললে, ওহে দেখি, জ্ঞান হয়েছে কিনা? লোক চিনতে পারছে কিনা? তখন সে সাধুকে খুব চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে—মহারাজ। তোমাকে কে দুধ খাওয়াচ্ছে? সাধু আস্তে আস্তে বলছে—’ভাই, যিনি আমাকে মেরেছিলেন, তিনিই দুধই খাওয়াচ্ছেন।’
ঠাকুর আপনার এই কাহিনির ব্যাখ্যা আমি যে—ভাবে করেছি আপনাকে খোলাখুলি বলি। আমার চৈতন্য হয়নি সে কথা খুবই ঠিক; কিন্তু কৈশোর আর যৌবনের কিছুটা আমার যাঁদের সঙ্গে কেটেছে, তাঁরা আমার একটা সংস্কার তৈরি করে দিয়ে গেছেন। সেই সংস্কার হলেন আপনি। শ্রীরামকৃষ্ণময়ং জগৎ। আমার ইন্দ্রিয় হল ওই জমিদার। সে আমাকে নিয়ত চাবকাচ্ছে। আমি অচৈতন্য হচ্ছি। ঠাকুর আপনি আমাকে চেতনা দিচ্ছেন, আবার অচৈতন্যও করে দিচ্ছেন। দিন যাঁর রাতও তাঁর। এই দিন—রাত্রির পরপারে আপনিই আমাকে নিয়ে যাবেন। বন্ধন যাঁর মুক্তিও তাঁর। সবই তো এই দেহেই ঘটেছে। আর ঘটাচ্ছেন আপনি। এই বিশ্বাস আমার প্রবল। প্রবল বলেই আপনাকে মনের কথা সব খুলে বলছি। ভণ্ডামি করলে করা যায়, তাতে আপনি আমার ত্রিসীমানা ত্যাগ করবেন। আপনি বলে গেছেন, ঈশ্বর মন দেখেন। আপনি আমার ঈশ্বর। আপনি আমার মন দেখুন, তারপর আমার মনে আপনার আঙুল ঠেকান। শোধন করে দিন।
আপনার সেই কাহিনিটাও যে আমার স্মরণ করতে ইচ্ছে করছে। এই কাহিনিতে আমার মুক্তির প্রতিধ্বনি আছে। আপনি জনৈক ভক্তকে এই গল্পটি বলেছিলেন, ‘কোনো এক গ্রামে একটি তাঁতি থাকে। বড়ো ধার্মিক, সকলেই তাকে বিশ্বাস করে আর ভালোবাসে। তাঁতি হাটে গিয়ে কাপড় বিক্রি করে। খরিদ্দার দাম জিজ্ঞাসা করলে বলে—রামের ইচ্ছা সুতোর দাম এক টাকা, রামের ইচ্ছা মেহন্নতের দাম চার আনা, রামের ইচ্ছা মুনাফা দু—আনা। কাপড়ের দাম, রামের ইচ্ছা, এক টাকা ছয় আনা। লোকের এত বিশ্বাস যে তৎক্ষণাৎ দাম ফেলে দিয়ে কাপড় নিত। লোকটি ভারি ভক্ত, রাত্রিতে খাওয়াদাওয়ার পরে অনেকক্ষণ চণ্ডীমণ্ডপে বসে ঈশ্বর—চিন্তা করে, তাঁর নামগুণ কীর্তন করে। একদিন অনেক রাত হয়েছে, লোকটির ঘুম পাচ্ছে না, বসে আছে, এক—একবার তামাক খাচ্ছে। এমন সময় সেই পথ দিয়ে একদল ডাকাত ডাকাতি করতে যাচ্ছে। তাদের মুটের অভাব হওয়াতে ওই তাঁতিকে এসে বললে, আয় আমাদের সঙ্গে—এই বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। তারপর একজন গৃহস্থের বাড়ি গিয়ে ডাকাতি করলে। কতকগুলো জিনিস তাঁতির মাথায় দিলে। এমন সময় পুলিশ এসে পড়ল। ডাকাতেরা পালাল, কেবল তাঁতিটি মাথায় মোটসুদ্ধ ধরা পড়ল। সে রাত্রি তাকে হাজতে রাখা হল। পরদিন ম্যাজিস্টার সাহেবের কাছে বিচার। গ্রামের লোক জানতে পেরে সব উপস্থিত। তাঁরা সকলে বললে, ‘হুজুর! এ লোক কখনো ডাকাতি করতে পারে না।’ সাহেব তখন তাঁতিকে জিজ্ঞেস করলে, ‘কিগো, তোমার কী হয়েছে বল?’ তাঁতি বললে, ‘হুজুর! রামের ইচ্ছা, আমি রাত্রিতে ভাত খেলুম। তারপর রামের ইচ্ছা, আমি চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছি, রামের ইচ্ছা, অনেক রাত হল। আমি, রামের ইচ্ছা, তাঁর চিন্তা করছিলুম আর তাঁর নামগুণ গান করছিলুম। এমন সময়, রামের ইচ্ছা, একদল ডাকাত সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। রামের ইচ্ছা, তারা আমায় ধরে টেনে নিয়ে গেল। রামের ইচ্ছা, তারা এক গৃহস্থের বাড়ি ডাকাতি করল। রামের ইচ্ছা, আমার মাথায় মোট দিলে। এমন সময় রামের ইচ্ছা, পুলিশ এসে পড়ল। রামের ইচ্ছা, আমি ধরা পড়লুম। তখন রামের ইচ্ছা, পুলিশ লোকেরা হাজতে দিল। আজ সকালে, রামের ইচ্ছা, হুজুরের কাছে এনেছে।
অমন ধার্মিক লোক দেখে সাহেব তাঁতিটাকে ছেড়ে দেবার হুকুম দিলেন। তাঁতি রাস্তায় বন্ধুদের বললে, ‘রামের ইচ্ছা, আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সংসার করা, সন্ন্যাস করা সবই রামের ইচ্ছা।’
ঠাকুর আপনার এই কাহিনির সঙ্গে আমি যে তত্ত্ব পেয়েছি, তাতে আমার এই বেচাল, সেও তো আপনার ইচ্ছা বলে মনে করতে পারি। তা না হলে আমি সেদিন কেন অমন অসংযমী হতে যাব। নিশ্চয় আপনি মনে করেছিলেন ছেলেটার সংসারে ঢোকা উচিত। একটু দেখে নিক সংসার কী বস্তু। রমণী শরীর কী রকম। প্রেম ভালোবাসা কাকে বলে। দেখা না হলে পরে ছোঁক ছোঁক করবে। বেশি বয়সে ফেঁসে যাবে। চরিত্রহীন হবে। সংসার কিছু অপবিত্র জায়গা। গৃহদুর্গে বসে আত্মস্থ হওয়ার চেষ্টা, বনে—জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে হতাশ হওয়ার চেয়ে অনেক ভালো। সংসারে না ঢুকলে সেই শিক্ষাটা হবে কী করে…যেমন আপনি বলেছিলেন—সারবস্তু কিছুই নাই—আমড়া, আঁটি আর চামড়া।
সেদিন রুমকির হাত দুটো ধরে বলেছিলুম, ‘তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে বলেই এমন করে ফেলেছি। বিশ্বাস করো, আমি দুশ্চরিত্র খারাপ ছেলে নই। তোমাকে দেখে আমার ভেতরটা কেমন করে উঠল, তাই আমি অমন করে ফেলেছি। লক্ষ্মীটি, তুমি আমার নামে বদনাম রটিয়ো না। তাহলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।’
আমার কথা শুনে রুমকি খুব খানিক হেসে, আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলেছিল, ‘ভীতু, ভীষণ ভীতু! তুমি কী এমন করেছ! শোনো, তোমাকেও আমার ভীষণ ভালো লাগে। কেমন একা একা আপনমনে থাকো তুমি! হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসছ, মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ছ। কখনো গান গাইছ। কখনো স্তোত্রপাঠ করছ। তুমি বুঝি খুব ধার্মিক!’
খুব জোরগলায় হ্যাঁ বলতে পারলুম না। বলি কী করে? যে ধার্মিক সে কখনো ডাগর একটা মেয়ের কোমর জড়িয়ে ধরতে পারে? মিউমিউ করে বললুম, ‘ধার্মিক হলে কেউ মেয়েদের কাছে আসে?’
‘তা মেয়েরা বুঝি অধর্ম? মা না হলে ছেলে হয়? তোমার মা বুঝি অধর্ম?’
‘না না, তা নয়, মা ছাড়া অন্য মেয়ের কথা বলছি।’
‘সব মেয়েই তো একদিন না একদিন মা হয়ে যাবে।’
‘আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। ধরো যে আমার মা, তিনি তো একজনের স্ত্রী। এই স্ত্রী পর্যন্ত চলে যায়, কিন্তু যে মেয়ে স্ত্রী হয়নি তার সঙ্গে মেলামেশাটা ধার্মিকের কাজ নয়।’
‘তাহলে প্রেমে ধর্ম নেই? শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে কুঞ্জবনে প্রেম করতেন, সেটা তাহলে অধর্ম, পাপ?’
‘দেখ রুমকি, শ্রীকৃষ্ণের ব্যাপারটা বোঝা অত সহজ নয়। ওর ওপর সব বড়ো বড়ো বই আছে। ওটা একটা সাধনা।’
‘তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে, আমার সঙ্গে মেলামেশা করলে তোমার ধর্ম চলে যাবে। ভেবে দেখ, আমার সঙ্গে মিশবে, না চোখ উলটে ধ্যান করবে! আমার ধর্ম আসে না। আমি খিদে পেলে খাই, ঘুম পেলে ঘুমোই, সিনেমা দেখি, একা একা নাচি। বাজে বাজে বই পড়ি। মিশবে না মিশবে না।’
রুমকি আমার এক হাত দূরে শরীর এলিয়ে বসেছিল। মুখ শরীর সব কিছুই বাঈজিদের মতো। কিছুক্ষণ তাকালে মন কেমন করে। বসে আছে এক হাত দূরে। বাড়িতে আর তৃতীয় কেউ নেই। বাইরে চৈত্রের দুপুর খাঁ খাঁ করছে। কাকের ডাকে গভীর তৃষ্ণা।