ঊর্বশী ও অগস্ত্যের জন্মকথা (পুরাণ কথা,বিজ্ঞান ও বেদ)
ঊর্বশী ও অগস্ত্যের জন্মকথা
ঊর্বশী ও অগস্ত্যের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই বা আছে দুইই বলা যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা তাদের জন্মকথার এক বৈচিত্র্যগত মিল —- এনারা কেউই মাতৃগর্ভ থেকে প্রসবিত হন নি।
না। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে বা কয়েক দশক আগেও “test tube baby ” বা “surrogate mother ” বা কিছুদিন আগেও “sperm bank” , “egg donation centre” বলে অনেকেরই সম্যকভাবে বা ন্যুনতম ধারণাও কিছু ছিল না।
স্মৃতিকথা উদ্ভূত পুরাণের উদ্ধৃত সারবস্তু কখনও উদ্ভট কখনও পরে বিশ্বাস নৈকট্যের যুক্তিমুক্তি।
পুরাণ যুগে নর, যক্ষ, কিন্নর, গন্ধর্ব, নাগেরা ছাড়া আর সকলের মাঝে দেবতা , দানব ও মুনি ঋষিরাই প্রধান ছিলেন বলা যায়। সাধারণত দেবতারা মুনিঋষিদের উপর তেমন রাগ হিংসা প্রদর্শন করতেন না, কিন্ত অহেতুক দানবেরা মুনিঋষিদের মাঝে মাঝেই তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতেন। অতিষ্ঠ হয়ে মুনিঋষিরা উপায় কিছু পাচ্ছিলেন না। এ যেন কিছু দামাল শক্তিশালী দুষ্টুবুদ্ধি শিশুদের কান্ডজ্ঞানহীন কর্ম— দেবরাজ ইন্দ্র ত্রিভুবনের রাজা। তিনি হুকুম দিলেন অগ্নি ও পবন দেবকে দানবদের শায়েস্তা করতে। অগ্নিদেব ছুটে গেলেন, পেছন পেছন পবন দেব, ফলে সব আগুনে পুড়ে ছাড়খার হতে লাগল, অনেক অসুরও মারা গেলেন। ঘর বাড়ি , বন উপবন, সর্ব স্থলধাম ছেড়ে দানবেরা পালাতে শুরু করলেন। শেষে তারক, বিরোচন, কমলাক্ষ প্রভৃতি দানবেরা সমূদ্রে গিয়ে আশ্রয় নিলেন, ও পরে সেই সমূদ্র জলে দুর্গ নির্মাণ করে আবারও প্রতিশোধস্পৃহায় মুনি ঋষিদের উপর উপদ্রবে মেতে উঠলেন। ইন্দ্রও তাতে বিফল হয়ে আরও রেগে অগ্নি ও পবনকে বললেন, “সমুদ্রের জল শুকিয়ে দিয়ে ওদের বিনাশ করো” কিন্ত এতে অগ্নি ও পবন দেবতারা রাজী হলেন না, কারণ জলে আরও নানাবিধ নিরীহ প্রাণী ও উদ্ভিদসকল আছে, তারা তাহলে বাঁচবে না। ইন্দ্রের কথা অমান্য করায়, তিনি অভিশাপ দিলেন,অগ্নি ও পবনকে, মর্তলোকে নির্বাসনে। সেখানে তারা মিত্রাবরুন নাম নিয়ে থাকবে ও তপস্যা করবে, একে অপরের সঙ্গে থাকবে, আলাদা হতেও পারবে না। এ হলো কিন্তু অগস্ত্য জন্মের গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। তবে এই অগস্ত্য জন্মকাহিনীর বলবার আগে ঊর্বশীর জন্মকথা এখন বলে নিতেই হবে। আরও একটু পেছনে যেতে হবে, ধর্মের ঔরসে নারায়ণ ঋষি নামে স্বয়ং বিষ্ণু জন্ম নেন ও গন্ধমাদন পর্বতে কঠোর তপস্যায় রত থাকতেন। ইন্দ্র সর্বদাই ভীত থাকতেন সিংহাসন হারাবার ভয়ে। পাছে নারায়ন ঋষি অতি ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে, দেবলোকের সিংহাসন অধিকার করেন, তাই তাঁর ধ্যান ভগ্ন করার জন্য ইন্দ্র মদন দেবকে তড়িঘড়ি পাঠালেন। এদিকে নারায়ণ ঋষি ধ্যানে সমস্ত অবগত হয়েই, চাতুরী করে নিজ উরু থেকে এক রূপসী কন্যার জন্ম দিলেন। (এখানে এ আজগুবিভাবে এক কন্যার জন্ম কিভাবে হলো,তার কোন ব্যাখ্যা পুরাণে নেই, ভবিষ্যত জানে !!! আসলে রূপসী যুবতী, ঊর্বশী ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির এক রোবট)
সে কন্যা অতীব সুন্দরী, যার নামই একবারে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা অপ্সরা বলে কথিত—- হ্যাঁ, তিনিই ঊর্বশী, যাকে দেখে স্বয়ং মদনদেবেরই মাথা ঘুরে মুর্ছা যাবার অবস্থা হয়েছিল। (না, প্রশ্ন করাও যাবে না, একবারেই কিভাবে পূর্ণাঙ্গ যুবতীর জন্ম হয়?)
পৌরাণিক নারায়ণ ঋষি তাকে জন্ম দিলেন শুধুমাত্র ইন্দ্রর মন ভোলাবার জন্য, হয়েছিলোও কথাতাই। সকল অপ্শরাদের মধ্যে ইন্দ্র সবচেয়ে ভালবাসতেন ঊর্বশীকেই।
ঊর্বশীর ইন্দ্রর কাছে যাবার পথেই মাঝখানে জন্ম হলো—- অগস্ত্যের। সে এক আচমকা অদ্ভুত প্রেমকাহিনী— পরম সংযমী মিত্রাবরুন দুজনেই পড়লেন প্রেমে ঊর্বশীর — একসাথে, সেই গন্ধমাদন পর্বতে ,বলাবাহুল্য ঊর্বশীও দুই ঋষির প্রেমে পড়লেন। নারায়ন ঋষি ঊর্বশীকে বলেছিলেন যে পুরুষ প্রথম ডাকবে, তার কাছেই আগে যাবে। মিত্র দেব প্রথম প্রেম নিবেদন করেন ঊর্বশীকে, কিন্ত একটু পরেই বরুণও চঞ্চল মনে প্রেম ব্যক্ত করেন, এবং তা এমন উগ্র যে তিনি ঊর্বশীর অঞ্চল ধরে আকর্ষণও করেন। কিন্ত ঊর্বশী বলেন, “মিত্রা প্রথম আমায় ডেকেছেন, তার মনোরঞ্জন করেই তারপর তোমার কাছে আসব।” অথচ বরুণকে এমন কথা দিয়েছে বলে মিত্রাও রেগে অপমান করে ঊর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করেন। ঊর্বশী দুজনকে ছেড়েই চলে গেলেন। কিন্ত তাকে কামনার ফলে ঋষিদের যে শক্তি সঞ্চিত হল তা কখনও নাকি ব্যর্থ হতে পারে না , তাই সেই শক্তি পতিত হলো এক কুম্ভে। সেইখানেই জন্ম হলো কিছুদিন পর আর এক মুনির— তিনিই অগস্ত্য। মাতৃগর্ভে তার জন্ম হয় নি, হয়েছে কুম্ভ থেকে সেজন্য তার নাম “কুম্ভজ” বা “কুম্ভযোনি”। ক্ষমতাবান অগস্ত্য এক নিঃশ্বাসে এক বিশাল পুকুরের জল পান করে ফেলতে পারতেন– সে অন্য আর এক কাহিনী। আমার প্রশ্ন হলো — ধরা গেল মিত্রাবরুন অগস্ত্যের পিতা ( যদিও এখানেও প্রশ্ন উঠে আসে— দু’জন পিতা কি করে এক সন্তানের জন্ম দেন? এও কি বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দেবে ভবিষ্যতে)
আর অগস্ত্য মুনির মাতাই বা কে?
ঊর্বশী কি সত্যিই নর রক্তমাংসের মানুষ???
বর্তমানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ” ডিম্বানু কৃত্রিম– নিষিকি-করণ” বা “কৃত্রিম প্রজনন” এখন প্রতিষ্ঠিত । কিন্ত মাতৃগর্ভ ব্যতীত “প্রাণহীন কৃত্রিম মাতৃগর্ভ ” বা “কৃত্রিম ডিম্বানু” তৈরিও কি সম্ভব ছিল সেই সময় ? বর্তমানেও অনাবিষ্কৃত। না, এসবের শুধু কেন , কোন বৈজ্ঞানিক বিষয়েরই সন্ধান নেই পুরাণে ….. এসব আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের ধারণা বা বৈজ্ঞানিক কল্পনাবিলাস মাত্র, ভবিষ্যত হয়ত এর উত্তর দেবে।
(সংগ্রহ:মৎস্য পুরাণ)