রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – লব কুশের সহিত শ্রীরামের যুদ্ধের আয়োজন
মুনিগণ বেষ্টিত শ্রীরাম যজ্ঞস্থানে।
হেনকালে সাত জন গেল সেইখানে।।
সাত জনে দেখিয়া শ্রীরাম চিন্তাবান।
জিজ্ঞাসেন ভরত লক্ষ্মণের কল্যাণ।।
কৃতাঞ্জলি করি সাত করে নিবেদন।
কি কহিব রঘুনাথ দৈবের ঘটন।।
প্রমাদ পড়িল প্রভু ভয়ে নাহি কহি।
সাত জন আইলাম আর কেহ নাহি।।
চারি অক্ষৌহিণী পড়ে ভরত লক্ষ্মণ।
সবে মাত্র এড়াইয়া এনু সাত জন।।
দুই শিশু নর নহে বিষ্ণু-অবতার।
তোমার যতেক সেনা করিল সংহার।।
আপনি যদ্যপি রাম যুঝ তার সনে।
জিনিতে নারিবে প্রভু হেন লয় মনে।।
ত্রৈলোক্যের নাথ তুমি জগৎ-পূজিত।
জিনিতে নারিবে রণ কহিনু উচিত।।
শুনিয়া মূর্চ্ছিত রাম কমললোচন।
চৈতন্য পাইয়া রাম করেন ক্রন্দন।।
কোথাকারে গেলে ভাই ভরত লক্ষ্মণ।
আমারে এড়িয়া কোথা গেলে তিন জন।।
পূর্ব্বেতে আমার প্রতি আছিলে সদয়।
রণস্থলে গিয়া ভাই হইলে নির্দ্দয়।।
শ্রীরামের সর্ব্বাঙ্গ তিতিল নেত্রনীরে।
ভাগীরথী বহে যেন হিমালয়োপরে।।
তিন ভায়ে স্মরণ করিয়া বহুতর।
হায় হায় বিলাপ করেন রঘুবর।।
আমা লাগি লক্ষ্মণ যে রাজ্য পরিহরি।
বনবাসে গেলে যে গাছের ছাল পরি।।
চতুর্দ্দশ বর্ষদুঃখ পাইলে তপোবনে।
ইন্দ্রজিৎ পড়িল তোমার তীক্ষ্ণ বাণে।।
লক্ষ্মণের তুল্য ভাই নাহি ত্রিভুবনে।
হেন ভাই পড়ে মোর ছাওয়ালের রণে।।
ভরতের যত গুণ করিতে না পারি।
আমি বনে গেলে হয়েছিল ব্রহ্মচারী।।
চৌদ্দ বর্ষ দুঃখ পেয়ে পরিল বাকল।
রাজভোগ এড়িয়া খাইল বৃক্ষ-ফল।।
শিশুর বিরোধে ভাই গেলা রসাতল।
এতেক ভাবিয়া রাম হলেন বিকল।।
ভাই মোর শত্রুঘন প্রাণের সোসর।
তব তুল্য বীর নাহি পৃথিবী ভিতর।।
বহুদিন যুদ্ধে আমি মারিলাম রাবণ।
এক দিনের যুদ্ধে তুমি মারিলে লবণ।।
হেন ভাই পড়িল যে শিশুর সংগ্রামে।
যা থাকে কপালে তাহা ঘটে ক্রমে ক্রমে।।
নেত্রনীরে শ্রীরামের তিতিল বসন।
সুগ্রীব প্রভৃতি দেন প্রবোধ বচন।।
আপনি শ্রীরাম তুমি বিচারে পণ্ডিত।
তোমার ক্রন্দন প্রভু নহে ত উচিত।।
ক্রন্দন সম্বর রাম স্থির কর মতি।
দুই শিশু ধরি গিয়া চল শীঘ্রগতি।।
শ্রীরাম বলেন যাই ভায়ের উদ্দেশে।
তিন ভাই গেল যদি আমি আছি কিসে।।
দুই শিশু মারিয়া শুধিব ভায়ের ধার।
অযোধ্যায় তবে সে আসিব পুনর্ব্বার।।
শুনিয়া রামের কথা সুগ্রীব রাজন।
শ্রীরামের প্রতি কহে প্রবোধ বচন।।
রাক্ষস বানর আর আছে যত সেনা।
সাজন করিয়া মারি শিশু দুই জনা।।
সুমন্ত্রের তরে রাম করেন জ্ঞাপন।
বাছিয়া সাজাও রথ অপূর্ব্ব দর্শন।।
পাইয়া রামের আজ্ঞা সুমন্ত্র সারথি।
কনক-রচিত রথ আনে শীঘ্রগতি।।
চড়েন পুষ্পক-রথে শ্রীরাম প্রবীণ।
শুভযাত্রা করি রাম চলেন দক্ষিণ।।
চলিল ছাপ্পান্ন কোটি মুখ্য-সেনাপতি।
তিন কোটি চলে তাহে মদমত্ত হাতী।।
চলিল তিরাশী কোটি শ্রেষ্ঠ তাজি ঘোড়া।
অক্ষৌহিণী সত্তর চলিল ভূমি যোড়া।।
তিন কোটি মহারথী চলিল প্রধান।
সর্ব্বক্ষণ থাকে তারা রাম-বিদ্যমান।।
মহারথী চলিল যতেক রাজধানী।
পাত্র মিত্র সবে চলে করিয়া সাজনি।।
শ্রীরামের সেনা ঠাট কটক অপার।
দেখিলে যমের চিত্তে লাগে চমৎকার।।
সুগ্রীব অঙ্গদ চিলে লয়ে কপিগণ।
গবাক্ষ শরভ গয় সে গন্ধমাদন।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র চলে বানর সম্পাতি।
চলিল ছত্রিশ কোটি মুখ্য-সেনাপতি।।
সত্তর কোটি বীরে চলে পবন-নন্দন।
তিন কোটি রাক্ষসে চলিল বিভীষণ।।
মহাশব্দ করি যায় রাক্ষস কপিগণ।
আর যত সেনা যায় কে করে গণন।।
বিজয় সুমন্ত্র নড়ে কশ্যপ পিঙ্গল।
শত্রাজিৎ মহাবল চলিল সকল।।
রুদ্রমুখ চলে আর সুরক্ত-লোচন।
রক্তবর্ণ মহাকায় ঘোর দরশন।।
রথের উপরে রাম চড়েন সত্বর।
মহাশব্দ করি যায় রাক্ষস বানর।।
কটকের পদভরে কাঁপিছে মেদিনী।
শ্রীরামের বাদ্য বাজে তিন অক্ষৌহিণী।।
কৃত্তিবাস কবি কহে অমৃত-কাহিনী।
দুই বালকের জন্য এতেক সাজনি।।