রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – মরুত্ত রাজার যজ্ঞ-বৃত্তান্ত
অগস্ত্যের কথা শুনি শ্রীরামের হাস।
কহ কহ বলি রাম করেন প্রকাশ।।
বেদবতী হরিয়া রাবণ কোথা গেল।
কহ শুনি মুনিবর পুরাণ সকল।।
অগস্ত্য বলেন কারে রাবণ না মানে।
শাপ গালি যত দেয় কিছু নাহি শুনে।।
যত যত রাজা আছে পৃথিবীমণ্ডলে।
সবারে জিনিল দশানন বাহুবলে।।
যজ্ঞ করে মরুত্ত ভূপতি মহাধনী।
সমস্ত ব্রাহ্মণ যজ্ঞে করে বেদধ্বনি।।
যজ্ঞভাগ লইতে আইল দেবগণ।
রথে চড়ি সেইখানে চলিল রাবণ।।
ত্রাস পায় দেবগণ রাবণেরে দেখি।
সর্প যেমন মাথা নোঙায় দেখি তার্ক্ষ্য পক্ষী।।
না দেখিয়া উপায় সকল দেবগণ।
পক্ষীরূপ হইয়া হইল অদর্শন।।
ইন্দ্র হন ময়ূর কুবের কাঁকলাস।
যম কাকরূপ হন বরুণ সে হাঁস।।
যজ্ঞ করে মরুত্ত ভূপতি মহাসুখে।
রণ দেহ বলিয়া রাবণ তাঁকে ডাকে।।
মরুত্ত বলেন আমি তোমারে না চিনি।
পরিচয় দেহ মোরে তবে আমি জানি।।
দশানন বলে আমি ভুবনে বিদিত।
রাবণ আমার নাম সংসারে পূজিত।।
কুবের আমার জ্যেষ্ঠ ধন-অধিকারী।
লইলাম তাহার কনক-লঙ্কাপুরী।।
আপন বড়াই করে রাবণ সে স্থলে।
শুনিয়া মরুত্ত রাজা অগ্নি হেন জ্বলে।।
জ্যেষ্ঠের হরিয়া মান কহিছ আপনি।
হেন কথা লোকমুখে কখন না শুনি।।
ধার্ম্মিকের অপমান অধার্ম্মিকে করে।
ধার্ম্মিক তাহার নিন্দা সহিতে না পারে।।
পাইয়া ব্রহ্মার বর কারে নাহি ডর।
মানুষের হাতে আজি যাবি যমঘর।।
অস্ত্র লয়ে রাজা যায় যুঝিবার মনে।
হাত পসারিয়া রাখে সমস্ত ব্রাহ্মণে।।
মহেশের যজ্ঞে রাজা অনুচিত কোপ।
আপনি হইবে দুষ্ট সবংশেতে লোপ।।
যজ্ঞ পূর্ণ না হইলে অতি বড় দোষ।
পরাজয় মান রাজা হউক সন্তোষ।।
ব্রাহ্মণের বাক্যে রাজা কোপ করে দূর।
কহিল পাপিষ্ঠ বেটা বড়ই নিষ্ঠুর।।
পরাজয় মানিল মরুত্ত যজ্ঞস্থানে।
যজ্ঞের ব্রাহ্মণে সব ডাক দিয়া আনে।।
দশ বিশ ব্রাহ্মণেরে সাপটিয়া ধরে।
দুষ্ট দশানন সবাকারে ফেলে দূরে।।
করিয়া সংগ্রাম জয় রাবণ চলিল।
দেবগণ পক্ষী হইতে বাহির হইল।।
পক্ষী হইতে দেবতা পাইল পরিত্রাণ।
পক্ষিগণে দেবগণ করেন কল্যাণ।।
ইন্দ্র বলে ময়ূর তোমারে দিলাম বর।
হউক সহস্র চক্ষু লেজের উপর।।
পূর্ব্বেতে ময়ুর ছিল সামান্য আকার।
ইন্দ্র-বরে সহস্র লোচন হইল তার।।
যখন আকাশে মেঘ করিবে গর্জ্জন।
পেখম ধরিয়া তুমি করিবে নর্ত্তন।।
বর কাঁকলাসেরে দিলেন ধনেশ্বর।
স্বর্ণবর্ণ হউক তোমার কলেবর।।
কুবেরের বরে তার নিজ বর্ণ খণ্ডে।
স্বর্ণবর্ণ হইল মুকুট ধরে মুণ্ডে।।
বরুণ বলেন হংস দিলাম এ বর।
চন্দ্র হেন হউক তোমার কলেবর।।
আমি এক লোকপাল সলিলেন পতি।
তোমার চরিতে জলে হইবে পিরীতি।।
যম বলে কাক আমি দিলাম এ বর।
তোমার নাহিক রবে মরণের ডর।।
রোগ পীড়া তোমার না হইবে সংসারে।
তব মৃত্যু হয় যদি মানুষেতে মারে।।
যেই জন যোগাইবে তোমার আহার।
যমলোকে তৃপ্তি তার হইবে অপার।।
পক্ষীরা আপন স্থানে চলিল যে যার।
বর দিয়া দেবগণ গেল স্বর্গদ্বার।।
মরুত্তের যজ্ঞকথা অতি চমৎকার।
তাহাতে সোণার পাত্র পর্ব্বত-আকার।।
স্বর্ণপাত্রে ভুঞ্জি নিত্য করেন বর্জ্জন।
সেই সোনা ভরিয়াছে ত্রিলক্ষ যোজন।।
কুবেরের ধন জিনি মরুত্তের ধন।
মরুত্ত সমান আর নাহি কোন জন।।
মরুত্ত-রাজার ধন সংসারেতে ঘোষে।
এমন ভূপাল ছিল চন্দ্রমার বংশে।।
মরুত্ত-রাজার যজ্ঞ সংসারে বিদিত।
উত্তরকাণ্ড রচে কৃত্তিবাস সুপণ্ডিত।।