রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – গজ-কচ্ছপের বৃত্তান্ত ও গরুড়-পবনের যুদ্ধ
শ্রীরাম বলেন, মুনি কহ বিবরণ।
ভাঙ্গিল সুমেরু-শৃঙ্গ কিসের কারণ।।
কি লাগিয়া বিসম্বাদ গরুড়-পবনে।
বিস্তারিয়া কহ মুনি শুনি তব স্থানে।।
মুনি বলে শুন রাম অপূর্ব্ব কথন।
গরুড়-পবনে যুদ্ধ হৈল কি কারণ।।
সন্তাপন নামে বিপ্র ছিল পূর্ব্বকালে।
তিন কোটি ধন রাখি স্বর্গবাসে চলে।।
সন্তাপনের দুই পুত্র পরম সুন্দর।
সুপ্রতাপ বিভাস এ দুই সহোদর।।
জ্যেষ্ঠপুত্র স্থানে ধন থুয়ে গেল বাপে।
কনিষ্ঠ করেন দ্বন্দ্ব ধনের সন্তাপে।।
ধন-শোকে ছোট ভাই হইল দুঃখিত।
জ্যেষ্ঠেরে কহেন ভাগ দেহ সমুচিত।।
জ্যেষ্ঠ বলে পিতা ভাগ না করিল ধন।
মম স্থানে ভাগ চাহ তুমি কি কারণ।।
ধন না পাইয়া কহে বশিষ্ঠের ঠাঁই।
পিতৃধন অংশ নাহি দেয় জ্যেষ্ঠ ভাই।।
কত অংশ পাই আমি বলহ এখন।
সেই দাওয়া করিয়া লইব পিতৃধন।।
বশিষ্ঠ বলেন আছে বেদের বিহিত।
পঞ্চ অংশের দুই অংশ তোমার উচিত।।
কনিষ্ঠ কহিল গিয়া জ্যেষ্ঠ বিদ্যমান।
পঞ্চ অংশের দুই অংশ দেহত এখন।।
আমি গিয়াছিনু ভাই বশিষ্ঠের স্থানে।
বশিষ্ঠ বলিল ভাই নাহি দেয় কেনে।।
জ্যেষ্ঠ বলে কনিষ্ঠ করিলে হেন কেনে।
জাতি-নাশ করিলে কহিয়া অন্য স্থানে।।
হীন জন জ্ঞান বুঝি কৈলা মুনিবর।
ধনের লাগিয়া এত হইলে কাতর।।
বারে বারে নিষেধিনু না শুনিলে কানে।
গজ হয়ে পাপিষ্ঠ প্রবেশ কর বনে।।
কনিষ্ঠ দিলেক শাপ জ্যেষ্ঠের উপরে।
কচ্ছপ হইয়া তুমি থাক সরোবরে।।
দুয়ের শাপেতে জন্তু হয় দুই জন।
কনিষ্ঠ গজের দেহ করিল ধারণ।।
দশ যোজন গজ দেহ কনিষ্ঠ ধরিল।
গজের গর্জ্জনে গিয়া বনে প্রবেশিল।।
কচ্ছপ সলিলে গেল গজ গেল বন।
শুণ্ডের ভিতরে গজ রাখে যত ধন।।
যতন করিয়া ধন যেই জন রাখে।
খাইতে না পায় ধন যায়ত বিপাকে।।
ধন পেয়ে যে জন না করে বিতরণ।
যথাকার ধন তথা যায় অকারণ।।
ধনেতে বিরোধ বাধে শুন মহাশয়।
যত ব্যয় করে, তত পরলোকে হয়।।
বশিষ্ঠের শাপে ধন নাহি পায় রক্ষা।
গজ-কচ্ছপের শুন ধনের পরীক্ষা।।
কহিলাম ধনের বৃত্তান্ত তব স্থানে।
গজ-কচ্ছপের কথা শুন সাবধানে।।
জলেতে কচ্ছপ আছে সেই সরোবরে।
দৈবযোগে গজ গেল জল খাইবারে।।
প্রখর রৌদ্রেতে গজ তৃষ্ণায় বিকল।
সরোবর দেখি গজ খেতে গেল জল।।
গজে দেখি কচ্ছপের পড়ে গেল মনে।
পূর্ব্বশোকে কচ্ছপ সে শুণ্ডে ধরে টানে।।
গজ টানে বনেতে কচ্ছপ টানে জলে।
গজ আর কচ্ছপ উভয়ে তুল্য বলে।।
কেহ কারে নাহি পারে দুজনে সোসর।
দুইজনে টানাটানি একই বৎসর।।
বিনতা-নন্দন গরুড় উড়ে অন্তরীক্ষে।
অন্তরীক্ষে থাকিয়া গরুড় তাহা দেখে।।
এক বর্ষ যুদ্ধ হৈল অতি ভয়ঙ্কর।
কেহ কারে জিনিতে নারে একই বৎসর।।
কাতর হইয়া গজ স্মরে নারায়ণ।
পাপদেহ নারায়ণ কর বিমোচন।।
গজেরে কাতর দেখি গরুড়ে দয়া হৈল।
বাম পায়ের নখ দিয়া দোঁহারে তুলিল।।
গজ-কূর্ম্মে লয়ে পক্ষী উড়িল তখন।
মনে করে কোথা লয়ে করিব ভক্ষণ।।
শ্যামবর্ণ বটবৃক্ষ শত যোজন ডাল।
অশীতি যোজন মূল নেমেছে পাতাল।।
চারি গোটা ডাল তার পর্ব্বতের চূড়া।
সত্তর যোজন যুড়ি আছে তার গোড়া।।
গজ-কচ্ছপ লয়ে বৈসে গাছের উপর।
সহিতে না পারে বৃক্ষ তিন জনার ভর।।
ভর নাহি সহে ডাল মড় মড় করে।
ডাল ভাঙ্গি পড়ে যদি মুনিগণ মরে।।
দক্ষিণ পায়ে গরুড় ধরিলেক ডালে।
মুনিগণ এড়াইল থাকি বৃক্ষতলে।।
ফেলিল সে ডালে লয়ে চণ্ডালের দেশে।
ডালের চাপনে মরে স্ত্রী আর পুরুষে।।
বহু পাপে হয়েছিল চণ্ডাল জনম।
গরুড়ের হাতে পাপ হৈল বিমোচন।।
গজ-কূর্ম্মে লয়ে গেল ব্রহ্মার সদন।
কহ ব্রহ্মা কোথা লয়ে করিব ভক্ষণ।।
ব্রহ্মা বলে কোথা সহিবেক এত ভার।
গজ-কচ্ছপ লয়ো যাহ সুমেরু-শিখর।।
তথা গজ-কচ্ছপেরে করহ ভক্ষণ।
ব্রহ্মার বচনে পক্ষী চলে ততক্ষণ।।
পর্ব্বত উপরে বৈসে করিতে ভক্ষণ।
হেনকালে এল তথা দেবতা পবন।।
পবন বলেন পক্ষী তুমি কেন হেথা।
মোর ঠাঁই পড়িলি ছিঁড়িব তোর মাথা।।
যাবৎ তোমার নাহি করি অপমান।
আপনা জানিয়া বেটা যাহ নিজ স্থান।।
গরুড় কহেন তুমি গালি কেন পাড়।
উপযুক্ত শাস্তি দিব অহঙ্কার ছাড়।।
গরুড়ের বচনে পবন ক্রোধে বলে।
ফেলিব পর্ব্বত ঠেলি সমুদ্রের জলে।।
গরুড় বলেন বায়ু বড়াই না কর।
সুমেরু-পর্ব্বত তুমি নাড়িতে কি পার।।
গরুড়ের বচনে পবন ক্রোধে বাড়ে।
পর্ব্বত সমেত চাহে উড়াইতে ঝড়ে।।
প্রলয় হইল যেন পর্ব্বত উপরে।
দুই পাখে গিরি ঢাকে বিনতা কুমারে।।
বাড়াইয়া কৈল পাখা সহস্র যোজন।
পবন দেখিয়া পাখা ভাবে মনে মন।।
গরুড়ের পাখা যেন বজ্রের সোসর।
সাত দিন শিলাবৃষ্টি পাখার উপর।।
মেঘের গর্জ্জন আর পড়িছে ঝঞ্ঝনা।
পর্ব্বতের তবু নাহি এড় এক কোণা।।
প্রলয়কালেতে যেন সৃষ্টি হয় নাশ।
দেখি যত দেবগণে গণিল তরাস।।
ব্রহ্মারে জিজ্ঞাসা করে যত দেবগণ।
আচম্বিতে মহাপ্রলয় হয় কি কারণ।।
দেবতার এই বাক্য শুনি প্রজাপতি।
দেবগণে লয়ে তবে যান শীঘ্রগতি।।
ব্রহ্মা কহিলেন শুন দেবতা পবন।
আচম্বিতে প্রলয় করহ কি কারণ।।
সৃষ্টি সৃজিলাম আমি অতিশয় ক্লেশে।
হেন সৃষ্টি নষ্ট কর যুক্তি না আইসে।।
না শুনে ব্রহ্মার বাক্য কহিছে পবন।
প্রলয় যাহাতে হয় করিব সে রণ।।
পবনের ঠাঁই ব্রহ্মা শুনি সে উত্তর।
বিরস হইয়া ব্রহ্মা চলিলা সত্বর।।
পবনে এড়িয়া যায় গরুড় গোচরে।
বিরিঞ্চি বলেন পক্ষী বলি হে তোমারে।।
আমি সৃষ্টি করিলাম তুমি কর রক্ষা।
এক দিন হৈতে তুমি তুলি লহ পাখা।।
ব্রহ্মার বচনে গরুড়ের হৈল হাস।
তোমার বচনে পাখা করিব প্রকাশ।।
ব্রহ্মা বলে যে যেমন আমি তাহা জানি।
শত যুগে পবন তোমারে নাহি জিনি।।
ব্রহ্মার বচনেতে গরুড়পক্ষী হাসে।
তবেত গরুড় পাখা করিল প্রকাশে।।
গরুড় তুলিতে পাখা গিরিবর নড়ে।
ঝড়েতে সে পর্ব্বতের এক শৃঙ্গ পড়ে।।
চিত্রকূট গিরি ছিল সাগর ভিতরে।
সুমেরুর শৃঙ্গ পড়ে তাহার উপরে।।
লঙ্কানামে পুরী তাহে কৈল বিশ্বকর্ম্ম।
এইরূপে শ্রীরাম শুন লঙ্কার জন্ম।।