২৬. কাঞ্চনের বাপের বাড়ি থেকে
কাঞ্চনের বাপের বাড়ি থেকে আসার দিন সন্ধ্যায় যখন লখাই ফিরল, সে দুরন্ত ক্রোধে ছেলেকে কোলে নিয়ে আড়াল করে রাখল নিজেকে।
তাদের আসার কথা শুনে লখাইয়ের প্রাণটা আকুল হয়ে উঠল। কাঞ্চীবউ এসেছে। এসেছে তার ছেলে। ছেলের কথা মনে হতেই অস্থির হয়ে সে ঘরের মধ্যে ঢুকল। কিন্তু কাঞ্চন তার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তখন সে কালীকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েচে বউঠান?
কালী মুখ ভার করে বলল, জানিনে।
কাঞ্চন ঘর থেকে ছুটে যাওয়ার দোলানি পেয়ে দামাল শিশু ভেবেছে তাকে নিয়ে খেলা হচ্ছে। সে তার কচি গলায় একটা বিচিত্র শব্দ করে হেসে উঠল।
সে শব্দে লখাইয়ের বুকটা যুগপৎ বিস্ময় ও আনন্দে উতলা হয়ে উঠল, সে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে গেল কাঞ্চনের সন্ধানে।
কাঞ্চন ঢেঁকি ঘরের পাশ দিয়ে গোয়ালের পেছন দিয়ে বাগানে পড়ল।
কালী সবই দেখছিল ঘরের দরজা থেকে। সে বলে উঠল, ওলো ছুঁড়ি, ছেলে নে তুই যাচ্ছিস কোথায় এ সন্ঝে বেলাতে?
কথাটা কানে যেতেই জামরুল তলায় কাঞ্চন থমকে দাঁড়াল। তার উপর নীচ দেখে ছেলের বুকে থুতু ছিটিয়ে ফিরে দাঁড়াল বুকে কাপড়ের আড়াল করে।
লখাই এসে ধরে ফেলল তার আঁচল। ডাকল, কাঞ্চীবউ।
কাঞ্চন এক হ্যাঁচকায় কাপড় টেনে নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, লাজ নেই তোমার মিসে! ও মুখ পচে যাবে কাঞ্চীর নাম নিলে পচে যাবে।
ছেলেটা মাঝে মাঝে উল্লাসে নানান শব্দ করে উঠছে। লখাইয়ের প্রাণ আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল। গোয়ালের পেছনে এসে কাঞ্চনকে সাপটে ধরল সে ছেলেসুদ্ধ দুহাতে। বলল, কী হয়েছে তোর কাঞ্চী বউ ছেলেটাকেও দিবিনে একটু আমার কাছে?
কাঞ্চন লখাইকে ধমক দিয়ে ফুঁসে উঠল, মরেছে তোমার কাঞ্চী,? নাম তুমি নিয়ো না। কী বলেছেলে সেদিন মিথুক বেহায়া মিসে? আমার যাতে আনকথানা? ও মুখ পচে যাবে, পচে যাবে। বলে লখাইয়ের মুখের দিকে একবারও না দেখে জোর করতে লাগল বার বার। হিসিয়ে উঠল, ছাড়, আমার ছেলের লাগবে।
ছেলে কি আমার সয়, কাঞ্চীবউ?
কেন, সরি বোষ্টমি দিতে পারেনি ছেলে একটা?…তাই, তাই আমার মন সারাদিন ওই কথা গেয়েছে। পুরুষের ধন্দলাগা কী আমি জানি নে?
কাঞ্চনের মুখটা দুহাতে ধরে বলল লখাই, পান মানেনি আর তুই থাকলে এমন হত না।
অমন পান তোমার–বলতে গিয়ে থমকে গেল কাঞ্চন। লখাইয়ের মুখের দিকে তার চোখ পড়ল। মুহূর্তে নিভে গেল তার চোখের আলো, এ কী মুখ হয়েছে লখাইয়ের সন্ধ্যার,আবছায়াতেও স্পষ্ট দেখতে সে, লখাইয়ের গাল ঝরে গেছে। চোখের কোল বসা। চুল উসকোখুসকে। কপালের সামনে কয়েকগোছা চুলে পাক ধরেছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে লালায়িত চোখে। এ দেখে মেয়েমানুষে কি পারে পান ধরে চুপ করে থাকতে? সে ছেলে লখাইয়ের কোলের উপর তুলে দিয়ে বলল, সে রাক্ষুসী কি পীরিত করে এমন হালই করেছে তোমার?”
সে কথার কোনও জবাব দিতে পারল না লখাই শিশুকে বুকে পেয়ে।
আলোর সামনে এনে লখাই রাজ্যের বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে শিশুকে দেখতে লাগল। তার চোখ মুখ, তার পা নাড়া, হাত খাওয়া আর শিশুর বিচিত্র গলার স্বরে নিজেও সে হেঁড়ে গলায় কাকলি গাইতে শুরু করল।
কালী হাসতে হাসতে দাওয়ায় গিয়ে শ্যামের গায়ে ঠেলা দিয়ে লখাইকে ইশারায় দেখিয়ে দিল। মধু তখনও বাড়ি ফেরেনি।
কেবল কাঞ্চনেরই হাসি-কান্নায় মুখ অদ্ভুত হয়ে উঠল।
এমনি দেখতে দেখতে লখাই কেমন যেন গম্ভীর এবং উদাস উঠল। কোলে তার নিজের ঔরসজাত ছ মাসের ছেলে খেলা করতে লাগল হাত পা ছুড়ে। তার মন ফিরে গেল বাইশ বছর আগের সেই দিনগুলিতে। বিশেষ মরুভূমির সেই ধূসর প্রান্তর। পাকাচুলভরা মাথা এক বুড়ি, তার মা। আর সোনার টিকলি দোলানো একখানি ঘোমটা চাকা মুখ কঞ্চনপরা হাতে কলসি বেষ্টন করে চলেছে পাতকুয়োর ধারে। কেমন ছিল সে মুখ? ভাবতে গিয়ে একবার কাঞ্চন, আর একবার সারদার মুখই বার বার ভেসে উঠল চোখের উপর। তারপর সেই যুদ্ধক্ষেত্র। কামান গোলা বন্দুক। কবে…কোনদিনের ইতিহাস সে সব। সবই যেন ঝাপসা হয়ে গেছে। কেবল আগ্নেয়গিরির অগ্নিগর্ভ থেকে অনুক্ষণ একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে।–
হঠাৎ সে বলে উঠল, ওর নাম কী? ছেলের নাম রেখেছে?
কালী বলল, তুমিই বলো এট্টা নাম।
বলব? আমি বলি ওর নাম থাক হীরালাল। মনে মনে বলল, যে হতভাগ্য বিদ্রোহী সিপাহি হীরালাল নবজন্মে লক্ষ্মীন্দর হল, তার ছেলে সে নামেই পুরো জীবনটা বহন করুক।
.
কয়েকদিন পরে, রাত্রে লখাই একদিন সারদার কথাই কাঞ্চনকে বলছিল। কেন সে পারেনি তার প্রাণ চাপতে। সে শুধু ধন্য নয়, কাঞ্চন বা সারদা কাউকে ছাড়াই পূর্ণ নয় লখাইয়ের জীবন। কাঞ্চন তার সুখ দুঃখের মিলিত সঙ্গিনী, সারদা শুধুই দুঃখের দিনের জন্য বসে থাকবে।
এমন সময় উঠোনে মানুষ মূর্তি দেখে চমকে উঠল তারা। লখাই তাড়াতাড়ি আলো নিয়ে এসে দেখল জলে ভেজা ক্লান্ত পবন।
পবনকে বসতে দিল সে। শুকনো কাপড় দিল পরতে। তা একটু সুস্থ হতে পবন তার সব কথা বলে বলল, লখাই, তারা ছাড়া আর কেউ ছেল না। তাও হতভাগী মিছে ভয়ে ড়ুবে মল।
লখাই ঘর থেকে একটা ধারালো কাটারি এনে পবনের হাতে দিয়ে বলল, তুই পবন যেভাবে খুশি মরিস, আমার আপত্য সে শশারের বাচ্চা ফিরিঙ্গিকে এক চোপে শেষ করে দে আয়।
কাঞ্চন শঙ্কায় কেঁপে উঠে তার হাত ধরে বলল, এ-সব কী বলছ?
ঠিকই বলছি। তীব্র জ্বালায় ফুঁসে উঠল লখাই, এ রাতেই তুই এ কাটারি নে যা। না পারি কাল যাবি।
পবন খানিকক্ষণ হতভম্বের মো লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তাতে কি লখাই, তারা ফিরে আসবে? আর সায়েবকে কেমন করে…
আচমকা হাত তুলে সজোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল লখাই পবনের গালে। শালা পারবিনে তো, এখানে এসেছিস কেন? মাগের মান রাখতে পারিনি, গলায় দড়ি দিগে যা।
সে রাত্রেই পবন গলায় দড়ি দিয়ে মরল আগুরিপাড়ার তেঁতুল গাছে।