Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উত্তরঙ্গ (১৯৫১) || Samaresh Basu » Page 24

উত্তরঙ্গ (১৯৫১) || Samaresh Basu

২৪. তেলেনীপাড়ার চটকল

ভোরবেলা।

তেলেনীপাড়ার চটকল। বস্তবড় উঁচু দেওয়ালের একটানা লম্বা ঘর, পেটানো ছাদ। গোল গোল ইটের থাম ও চৌকো। কাঠ দু ফুট, স্কোয়ার, তার উপরে কড়ি। হলের এক অংশে পাট পেঁজা করা ও সুতোর মেশিন বসানো। মাঝে একটা চওড়া ছেদ পড়েছে। তারপর শুরু হয়েছে তাঁতের সারি। হলের কিছুটা পুবে বয়লার ঘর; তার সঙ্গে পাইপ সংযুক্ত স্টিম এঞ্জিনের পাথর বাঁধানো দোতলা ঘর।

ভোর ছটা বেজে গেলেও এখনও মাত্র কয়েকজন মেয়েপুরুষ এসেছে। তারাও এসে কারখানার মধ্যে ঢুকে নিজেদের মধ্যে গালগল্প শুরু করল। অনেকেরই ধারণা হয়তো ছটা বাজেনি এখনও। বাজলে কলের বাঁশি এতক্ষণ বেজে উঠত নিশ্চয়ই।

কারখানার অদূরেই পুব-দক্ষিণ কোণ ঘেঁষে গোরা সাহেবদের কুঠি। রাজপ্রাসাদের মতো দোতলা অট্টালিকা। একতলার পেছনে ও সামনে কত সারি সারি জোড়া জোড়া থাম চলে গেছে। সুপ্রশস্ত ঝকঝকে বারান্দা। দেওয়াল প্রায় দু ফুট চওড়া। দরজার মাথায় কোনও চৌকাঠ নেই, দুর্গের মতো অর্ধগোলাকার দেওয়ালের মাথায় মাথায় দরজাও গোল করে কাটা। কারখানার দিকের দরজা জানলাগুলি বন্ধ, খিলানে কার্নিশে অসংখ্য পায়রার ভিড়। সেই দরজা বন্ধ প্রাসাদ থেকে পিয়ানোর মিষ্টি শব্দ আসছে ভেসে ভেসে। সেই বাজনার শব্দে ও আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া ঢেউ খেলানো আলসে দেখে মনে হয় জগতের সমস্ত ভিড়ের বাইরে যেন একটি সুপ্ত স্বর্গপুরী। সামনে বিস্তৃত জমির উপর দেশি বাগান। কয়েকটি এ দেশিয় লোক নিয়ে এক সাহ্বে বাগানের কাজকর্ম দেখছে। বাঁধাকপির চাষটার দিকেই সাহেবের নজর বেশি। বাগানের গেটে একজন বন্দুকধারী প্রহরী।

কারখানার অদূরের উত্তর কোণে কোম্পানির জায়গাতেই একটা লম্বা ব্যারাকের মতো সুদীর্ঘ চালাঘর। ছোট ছোট আলাদা ঘর করা হয়েছে তার মধ্যে বেড়া দিয়ে। সেখানে থাকে যারা অন্যত্র থেকে এখানে এসেছে। কোম্পানির পয়সার বাঁশ মাটি দড়ি বিচুলি ইত্যাদি কিনে বাসিন্দারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে এ ঘর।

ম্যানেজার রবাসেন আর মিস্তিরি আহের আলী অর্থাৎ রবার্টসন এবং ওয়ালিক আসতেই কিছুটা তাড়া পড়ল কারখানার মধ্যে। কিন্তু আসল যন্ত্রই এখনও চালু হয়নিকাজ সবাই করবে কী?

ওয়ালিক তাড়াতাড়ি স্টিম ঘরের দিকে গেল। সেখানে মেশিনের ধারে খানিক বাঁধানো জায়গায় জনা দুয়েক অপুট মিস্ত্রি শুয়ে আছে। সাহেবকে দেখেই লাফিয়ে উঠে বলল, কেদার এখনও আসেনি সায়েব।

কেদার হল এখানকার সাহেবদের চোখের মণি। শুধু স্টিম বলে কথা নয়, সারা চটকলের সমস্ত মেশিন তার নখদর্পণে।

ওয়ালিক জিজ্ঞেস করল, নারান কাঁহা, নারান?

মিস্তিরি দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে একজন বলল, সে এখন সগগে আছে, মিস্তিরি সায়েব।

ক্যায়া?

মদ–বুঝলে? দারু খেয়ে ঘর মে পড়ে আছে।

রবার্টসনও সেখানেই এসে হাজির হল। রবার্টসন অপেক্ষাকৃত গম্ভীর এবং অহঙ্কারী। সে কোনওমতে কখনওই তুষ্ট নয়। তার ধারণা এ-দেশের লোকগুলো শুধু নয়, পৃথিবীর সমস্ত কালো মানুষকেই একদিন সাদা হতে হবে। কারণ এদের মনুষ্যজন্ম খুব বেশিদিনের নয়। আর কালোই হচ্ছে মানুষের আদিম রূপ। যে জাতির অগ্রগতির সেদিক থেকে বেশি, সে জাতিই সাদা হয়েছে। সেইজন্যই সে এ দেশিয় কোনও ফরসা মানুষ দেখলেই তার বংশ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। তা ছাড়া, এরা ধর্মান্ধ তো বটেই, এবং এক দুরন্ত ধর্মান্ধর পাল্লায় তাকে একবার পড়তেও হয়েছিল ওপারে গাড়লিয়ার এদেশিয় এক ব্ল্যাক দেবতার মন্দিরে। সে লোকটার কথা সে জীবনে কোনও দিন ভুলবে না। সে চেয়েছিল লোকটাকে খুনি বলে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু আর কেউ ব্যাপারটাকে আমল দিল না বসে সে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছিল। সে বেশ খানিকটা তাজ্জব হয়ে যায়—ওয়ালিক এবং তার অন্যান্য কর্মীরা অনেকেই রীতিমতো ঠাণ্ডা মাথায় এদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।

সে যখন ওয়ালিকের মুখে শুনল, কেদার আসেনি, স্পষ্টই বলল, ওকে পুলিশের হাতে দিয়ে দাও, কারখানার দায়িত্ব সে পালন করেনি।

ওয়ালিক একটু হেসে তাকে নানান কথা বুঝিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। তারপর সে কুঠির আস্তাবলে ঢুকে এক্কার সঙ্গে নিজের হাতেই ঘোড়া জুতে বেরিয়ে গেল মাথার উপর চাবুক ঘুরিয়ে।

যে সব মেয়েপুরুষ বাইরে দাঁড়িয়েছিল রবার্টসন তাদের ধর্মকে ভিতরে পাঠিয়ে দিল। তারপর নিজে সে এগুল চালাঘরটার দিকে। যে সব ঘরের দরজা তখনও ভিতর থেকে বন্ধ, সেগুলো ধাক্কা দিতে লাগল।

একটা ঘরের দরজা খুলে উঁকি দিল মদন কৈবর্তের বউ কাতু। সদ্য ঘমভাঙা। আরক্ত চোখ, বিস্ত বেশবাস, দরজা খুলেই রবাসেনকে দেখে রুষ্ট হয়ে উঠল সে। বলল, আ মলো মুখপোড়া, দরজা ধাক্কাচ্ছ কেন?

রবার্টসন বাংলা দূরের কথা, এখনও হিন্দিই ভাল বলতে পারে না। বলল, হোয়াট?

কাতু বলল, বলছি কেয়া হুয়া?

টুম কাম মে নই গিয়া কেঁও?

তোর বাঁশি বাজেনি তো যাব কী। বলে সে মুখ টিপে হেসে আবার বলল, শ্যামের বাঁশি তো নেহি হুয়া।

রবাসর্টসন বুঝল না কিছু। বলল, নারান কাহাঁ?

কাতু এবার ঝোঁজে উঠল, আ মলো, নারান কি আমার ভাতার যে ওর কথা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করো?

রবার্টসন কিছু না বুঝে কাতুর গায়ের উপর দিয়ে জানালাহীন অন্ধকার ঘরটার মধ্যে ঢুকে গেল। গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল দুটো মেয়েমানুষ প্রায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় শুয়ে আছে কাঁচা মেঝের উপর। এবং দুজনেই যে অন্তঃসত্ত্বা তা বুঝতে রবার্টসনের দেরি হল না ওদের গোল এবং উঁচু পেট দেখে।

জিজ্ঞেস করল কাতুকে, ই লোক কৌন্ হ্যায় কল মে কাম কটা হ্যায়?

হ্যাঁ গো সায়েব, কারখানার কামিনদেরও চেনো না?

টুমকো রিলেটিভ হ্যায়?

তোমার মরণ হ্যায়। বলে কাতু ঘরের মধ্যে ঢুকে সাহেবকে বলল, তুমি যাও সাহেব, হাম্‌ যারা হ্যায়।

রবার্টসন বলল, গেট আপ, জলডি চল। মগর নারান কাহাঁ? কাতু বউ দুটোকে ধাক্কা দিয়ে তুলে বলল, চল তাড়াতাড়ি, সায়েব এয়েছেন? বলিহারি ঘুম বাপু তোদের। ছিনাথ কেঠুরে তোদের ঘুম ভাঙাত কী করে?

এ সেই শ্রীনাথের পলাতক জোড়া বউ, চোখ বড় বড় করে হঠাৎ ঘুম ভাঙার চমকানি নিয়ে উঠে বসল। শ্রীনাথের ঔরসে হাজার চেষ্টাতেও সন্তান পেটে ধরতে পারেনি ওরা। আর আজ একটা একটা নয়, দুটো বউয়েরই পেটে সন্তান এসেছে। নিজেদের নারীত্ব সম্পর্কে সন্দেহ ঘুচেছে, তা ছাড়া তারা আজ স্বাধীনভাবে রোজগার করে পেট চালায়। কিন্তু যত দিন ঘনিয়ে আসছে তত ওদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে!

সেই সঙ্গে কাতুরও দুশ্চিন্তা। তা হলে পূর্বের কথা একটু বলে নিতে হয়।

নারান কাতুকে নিয়ে প্রথম রিষড়ের চটকলে গিয়েছিল। কিন্তু রিষড়ে শুধু দূর নয়, চেনাশোনা লোকের মুখ পর্যন্ত একটা দেখতে পেত না সে। আর যে কাতু অধরার ছেলের বউ এবং দুর্দান্ত নারানের তাঁবে একেবারে ভয়ে কুঁকড়ে থাকত, একবার ঘরের বাইরে এসে সে অকস্মাৎ সমস্ত ভয় সঙ্কোচ কাটিয়ে সোজাসুজি নিজের ইচ্ছেয় চলতে লাগল। নারান তাকে মেরেছে, সে মার খেয়েছে। কিন্তু বেশি দিন সে মার সইল না। নরানের বিরুদ্ধে সে অপর পুরুষকে খেপিয়ে দিল। সেই দিন থেকে নারান বুঝেছিল, কাতু আর সে সেনপাড়ার সন্ত্রস্ত মদনের বউটি মাত্র নয়, তার হাতেও আজ অস্ত্র আছে। তখন নারানের একবার ইচ্ছে হয়েছিল বাড়ি ফিরে যাবার। কিন্তু যে মুহূর্তে সবকথা মনে পড়ে গেল, কাঞ্চন-লখাইয়ের কথা, মারামারির কথা এবং কাতুকে নিয়ে চলে আসার কুৎসিত অপবাদের কথা, তখন সে সে-বিষয়ে নিরস্ত হয়ে কাতুর প্রতি ব্যবহার পরিবর্তন করল। কিন্তু কাতু ঘা-খাওয়া মেয়ে। সে সহজে টলল না।

ইতিমধ্যে তেলেনিপাড়ার চটকল চালু হতে নারান কাতুর আশা ছেড়ে একলাই চলে এল এবং দু-একজন বেশ পরিচিত লোক যে পেল না তা নয়। কিন্তু তার যেন সমস্ত বুকটা খালি হয়ে গেছে, সমস্ত বোধশক্তি শেষ হয়ে গেছে মনের। এখানে এসে সে অন্যান্য সমস্ত কিছু ভুলে কাজে মনোেযোগ দিল খুব। ওয়ালিকের নজর পড়ল তার প্রতি। কেদার মিস্ত্রি তখন সর্বেসর্বা, আজও অবশ্য তাই। কেদারের সম্পর্কে লোকে বলে মরাকে বাঁচাতে পারে সে। অর্থাৎ এত ওস্তাদ মিস্ত্রি যে কাটাকে ভাঙাকে জোড়া লাগাতে পারত সে। ওয়ালিক কেদারের সাকরেদ করে দিল নারানকে। নারানও তা মেনে নিয়ে কেদারকে দাদা বলে সম্মান দিল। কেদারও খুশি হল।

ওয়ালিক এ টমাসডম কোম্পানির একজন সত্যকার কর্মী। সে প্রতিমুহূর্তে ভাবত কী করে এ যন্ত্রবিদ্বেষী ও বিরোধী কালা মানুষগুলোর কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেবে। সে সবসময় এদের সঙ্গে মিশত, কথা বলত। দরকার হলে মদ খাওয়াত, পয়সা দিয়ে ফরাসডাঙার মেয়েমানুষের ঘরে পাঠিয়ে দিত কিন্তু কাজের বেলা চেপে ধরে ঠিক! ফলে এ ওয়ালিক সায়েব আফিমের মতো মিষ্টি ও মধুর ছিল সকলের কাছে।

নারানকে প্রায়ই থম ধরে বসে থাকতে দেখে সে বারবারই বলত, কী হয়েছে আমাকে বলো।

শেষটায় নারান তাকে বলেছিল কাতুর কথা। ওয়ালিক সাহেব সেই দিনই টাকা দিয়ে লোক পাঠিয়ে প্রলোভন দেখিয়ে আনিয়েছিল কাতুকে রিষড়ে থেকে!

কিন্তু আশ্চর্য, নারানের কিছু পরিবর্তন হল না। কাতুকে নিয়েই রইল সে কিন্তু এত নিস্পৃহ ও নির্বিকার যে কাতু পর্যন্ত অবাক মানল। মনের বালাইহীনা কাতু তার চোখের সামনে পরপুরুষের সঙ্গ করে দেখেও কোনও নালিশ জানাল না নারান। উপরন্তু ওয়ালিককে নিরাশ করে কাজের দিকে ঝোঁকও তার কমে এল। প্রায় সব সময়েই তাড়ি মদে ড়ুবে থাকে। কোনও কোনও সময়ে দেখা যায় মত্ত অবস্থায় কামাতুর রক্তচক্ষু নিয়ে কাতুকে টেনে নেয়। একটু আদর সোহাগ করে পরমুহূর্তেই ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পাগলের মতো ঘুরতে থাকে এদিকে-সেদিকে দিগবিদিক ভুলে।

পবন চাঁড়াল যেদিন এল তার বউ তারাকে নিয়ে সেদিন সে কিছুটা সুস্থভাবে তাকিয়েছিল—যেন কতদিন সে মেয়েমানুষ দেখেনি। তারা একটু হেসে তাকে কাতুর কথা জিজ্ঞেস করতেই এক ধমকে পবন তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, কারও কথা জানবার তোর দরকার নেই এখেনে। থাকবি, রাঁধবি, খাবি।

এ-সময় বোধ করি তাদের তিনজনেরই সেই ফেলে আসা গ্রাম, তাদের বাল্যকাল, খেলাধুলো, গানবাজনা মনে পড়েছিল। তাই সেই ধমকে তারা কেঁদে ফেলেছিল, পবন ধমকে উঠেই নারানের দিকে ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আর নারান নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিল শুন্যে।

সেই থেকে নারান আর একদিনও যায়নি পবনের কাছে। পবনও আসেনি তার কাছে। বরং তারাকে দেখা গেছে দূর থেকে দেখে হাসতে নারানকে। নারানের কাছে সে হাসি অর্থহীন। সুখ দুঃখের অতীত ভাঙাচোরা মুখটা তুলে অর্থহীন চোখেই সে তারার দিকে তাকিয়ে থেকেছে।

কী বিচিত্র আবহাওয়া এখানকার। এখানে সমাজ সংসার সব থেকেও যেন তার কোনও বালাই নেই। মানুষ রাত পোহালে মাঠে যায়, সেখানেও তাদের সুখদুঃখের কথা হয়, নানান চর্চা হয়। এখানকার কারখানাতেও তা হয়। কিন্তু তার রূপ যেন ভিন্ন। কথা হাসি গান সবই যেন পাট পিষ্ট করার মতো বিরাট লৌহচাকাটার মতো কঠিন, পেঁজা পাটের মতো শাসরোধী নরম, স্টিম ইঞ্জিনটার বিচিত্র বহু অংশ ও গায়ের বিঘুটে তেলের গন্ধের মতো। ওই ইঞ্জিনটার জন্যই মানুষের বেঁচে থাকার দরকার। ওই সিলিন্ডার আর পিস্টনের নিছক ওজন, মাপা ও মসৃণ, অবিরত গড়ানো লৌহজীবন।

মাঠের ও যন্ত্রের সমাজের ফারাক আছে। যন্ত্রকে তার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তুষ্ট করলেই দায়িত্ব শেষ, তারপরে তুমি যা খুশি তাই করতে পারো। কোন বাধা নেই। বারোমাসের তেরো পার্বণ বা প্রকৃতির সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ নেই। নাই বা থাকল তোমার কোনও সমাজ-সংসার, না থাক প্রীতি-ভালবাসা-স্নেহ। কিছু আসে যায় না।

যন্ত্রকে চালাতে যন্ত্র-হিসাবেই তোমার দাম। তুমিও যন্ত্র। একথা মানতে মানুষ পারে না। সে ছুটতে চায় তার জীবনের দিগবিদিকে। কিন্তু কী অদ্ভুতভাবে সে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে যন্ত্রের সঙ্গে। সে প্রতিমুহূর্তে অবরোধের প্রাচীর দিয়ে দাঁড়াচ্ছে সামনে।

ওয়ালিক সায়েব বলে, যব তুম মেশিন মে হাত লাগায়েগা, সমঝো তুমভি মেশিন।

পবন মাথা মুড়িয়ে এসে দেখল সেই মাথাই আবার মুড়িয়ে দিতে চাইছে যন্ত্রের অনুশাসন। খির পাড়ার মাটি ও রসে গড়া জীবনের স্বাভাবিকতা একটা বেয়াদপি মাত্র যন্ত্রের কাছে। অতএব সাবধান! একটি সূক্ষ্ম প্যাঁচকাটা বলটুর মতো নিজেকে স্বস্থানে লাগিয়ে রাখো। বিচ্যুত হলে অদরকারি মালের স্তুপে ফেলে দেওয়া হবে।

কিন্তু না, যন্ত্র ততখানি শিকড় এখনও গাড়তে পারেনি এ দেশের মাটিতে। হাড্ডিসার প্রেতিনী তখন সবেমাত্র কাঁচা পয়সার ওড়না ঢেকে মিছে ভাবনাহীন জীবনের ডাক দিয়েছে। তবু একবার তার বক্ষলগ্ন হলে মুক্তি নেই।

পবন কিছু দিন কেবলি ভাবল ফিরে যাব। কিন্তু কোথায়? ভাবতে ভাবতেই এক একটি সপ্তাহ অতিক্রম করে গেল। পেটে দানা পড়তে লাগল। আবার ভাবল, কিন্তু কোথায়? কী আছে? আবার সপ্তাহের বেতনে ঘাড়ে করে চাল নিয়ে এল। একটু মাংসও বা। কিংবা ফরাসডাঙার রকমারি মদের দোকানে কয়েক পাত্র উজাড় করে দিল। লখাইয়ের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে আন্নাচুনুরীর কথা, আদালি বন্ধুর কথা। না, সে যেন কতদিনের কথা, আর অনুরাগ ও বিরাগ এক সঙ্গেই কাতর করে তোলে তাকে। …অসহ্য জ্বালায়, এক বিচিত্র কটু তিক্ততায় তার জন্মো পিরিতের বউ, সব গিয়েও যা এবং যে রয়েছে সেই তারাকেও হঠাৎ মারধোর করে বসে। তারা কাঁদলে তার আরও খারাপ লাগে। যখন সোহাগে আদরে সে হাসে তখন বন বলে, রি, চল কোথাও চলে যাই।

সে কথায় তারা আরও ভয় পায়। পবন তার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। ভরসা করে সে আর প্রাণ খুলতে পারে না তার কাছে। কিন্তু তার বলিষ্ঠ শরীরের মধ্যে উদ্বেলিত চাঁড়াল রক্ত প্রবাহিত। মারের পর পবনের সোহাগ তার কাছে অসহ্য অপমানকর হয়ে উঠল। সে পবনের মুখের উপর বলে দিল, অমন পিরিতে তার দরকার নেই।…কী এত বড় কথা? সাঁড়াশির মতো দুটো হাত দিয়ে গলা টিপতে গিয়েও পবন হঠাৎ থেমে গেল। অবাক বিস্ময়ে নিজের হাত দুটো দেখে দু হাতে তারাকে বুকের কাছে টেনে এনে বলল, আমাকে তুই ঘেন্না করিস, না রে তারি? তারপর একটু থেমে বলল, দাঁড়া কোনও রকমে করে কন্মে কিছু টাকা জমিয়ে গাঁয়ে চলে যাব আবার। ভিটে ছাড়াব, অ্যাঁ?…ফিরে যাব, তখন দেখিস

পবনের বুকে মুখ রেখে প্রাণভরে তারা কাঁদল। হ্যাঁ চলো ফিরে যাই। ধান ভেনে শাকপাতা কুড়িয়ে খাব। পরের জমিতেই না হয় তুমি খাটবে।

নারান কিন্তু দেখল অন্য জিনিস। সে দেখল করসেন সায়েব অর্থাৎ ক্রুকসান ফাঁক পেলেই তারার কাছে গিয়ে আলাপ জমাবার চেষ্টা করছে। নিষ্কর্মার ধাড়ি এ কুরুসেন নাকি এ কোম্পানির মালিকের ভাগিনেয়। লোকে বলে, কোম্পানির ভাগনে। লোকটার বউ নেই এখানে, আছে নাকি তাও কেউ জানে না। সুন্দরী-অসুন্দরী পর্যন্ত বাছে না এক এক সময় এমন ভাবে কামিনদের পেছনে কুরুসেন লেগে থাক। তার এ দুস্কার্যের সহায় এখানে কাতু।

লোকটা ফিটফাট সেজে মুখে একটা পাইপ লাগিয়ে একটা ছড়ি হাতে ঘুরে বেরায়। মেয়েমানুষ দেখলেই ইশারা-ইঙ্গিত করে। কারখানার মধ্যে মেয়েরা যেখানে কাজ করে, সেখানে গিয়ে তাদের। সঙ্গে চেষ্টা করে কুৎসিত আলাপ জমাবার। সুযোগ পেলে ছড়ি দিয়ে কারও শাড়ি তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে, হাত দিয়ে গায়ে থাবলা দিলে অপরিসীম আনন্দে হোহো করে হেসে ওঠে।

এজন্য যে তাকে কোনও বাধা পেতে হয় না, তা নয়। অনেক সময়েই অপমান সইতে হয়। কোন এক মেয়ে তাকে মেরেছিল পর্যন্ত। কিন্তু তার অপমানজ্ঞান যেমন নেই, তেমনি আছে জানোয়ারের মতো ক্রোধ।

শ্রীনাথের বউ দুটো যখন এল কাতুই তাদের আশ্রয় দিয়ে নিজের ঘরে তুলল। কুরুসেন খুব খুশি। কিন্তু নারান সাক্ষাৎ যমদূতের মতো দাঁড়াল তার সামনে। ভিতু কুরুসেন গতিক দেখে সরে, দাঁড়াল। কন্তু নারান নিজেই তার মনের ভাব বোঝে না। উৎফুল্ল হয়ে দুদিন সে বউ দুটো নিয়ে নাড়াচাড়া করল! তার পরে আবার যেমন তেমনি।

বউ দুটো পড়ল কুরুসেনের পাল্লায়। কাতু বলেছিল বউ দুটোকে পেট পুরিয়ে ফেলতে, কিন্তু বউ দুটো ঘর ছেড়ে শুধু মুখরা নয়, উদ্দাম হয়ে উঠেছে। বলেছিল, মরে গেলেও পেট পোব না, সে তোমার পেটে সাপই আসুক আর বাঘই আসুক।

জীবনভর আকাঙ্ক্ষার চরম পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হল। পেটে তাদের সন্তান এল। কিন্তু কুরুসেন হল তাদের কাল। সে সবসময় চেষ্টা করছে কী করে এ গর্ভবতী বউ দুটো সরিয়ে দেওয়া যায়। ফলে এখন বউ দুটো সবসময়েই লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়ায়।

নারান একবার ভাবল কুরুসেন সম্পর্কে সে পবনকে সাবধান করে দেয়। আবার ভাবল, তারাকেই সে বুঝিয়ে দেবে।

কিন্তু তা সে পারল না। ভাবল, তারা কি কুরুসেনের মন বোঝে না? সে কী বলে সায়েবের সামনে দাঁড়ায়। আর পবন হয় তো তাকে বিশ্বাসই করবে না। থাক, মানুষ তার পথ নিজেই করে। নারানকে তার জন্য কিছু করতে হবে না।

রবার্টসনের ডাকে শেষ পর্যন্ত নারানকে খুঁজে পাওয়া গেল অন্য একজনের ঘরে। সে চোখ মুছতে মুছতে স্টিম ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

লোকজন আবার সব সামনের মাঠে এসে ভিড় করেছে। কুরুসেন তার ছড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে মেয়েদের আশেপাশেই। কয়েকবার চেষ্টা করেছে শ্রীনাথের বউ দুটোর পেটে ছড়ি দিয়ে

খোঁচা দেওয়ার। বউ দুটোও সেয়ানা। তারা পুরুষের ভিড়ের মাঝখানে চলে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল ওয়ালিকের এক্কা ছুটে আসছে চাবুকের সপাং সপাং শব্দে ধুলো উড়িয়ে।

ওয়ালিকের পাশে বসে আছে কেদার।

লোকজন সব হইহই করে কারখানার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

ওয়ালিক আর কেদার এসে দেখল নারান স্টিম দিয়ে মেশিন প্রায় তাতিয়ে ফেলেছে। টাইট দিচ্ছে সিলিন্ডার।

কেদার বলল, বাঃ সারেদ, চালাও। বেরথা কেন ডেকে নে এলে সায়েব। শুয়োরের বাচ্ছার নড়িটা ধরে আমি ছিঁড়তুম ওভেনে।

ওয়ালিক নারানের পিঠ চাপড়ে, কেদারকে নিয়ে পড়ল। সে পরিষ্কার বাংলায় বলল, টুমার ছেলে শুয়ার কি বাচ্ছা হোবে কেন, টবে শুয়র টুমি হলে কিনা? তারপর হেসে বলল, আমাকে বোলো টুমার ছেলে কেননা এটো ডিগরি কোরে, কামে কেনো আইসে না।

কেদার বলল, সায়েব, সে হারামজাদা এখন মেয়েমানুষ চিনেছে, ওকে বে দিতে হবে।

হাঁ, জরুর ডিটে হোটে। সাডি কেন দিচ্ছে না টুমি?

কেদার চুপ করে রইল।

ওয়ালিক বলল, টাকা চাই? কেটনা বোলো, বলল কিডার। শও টাকা?

কেদার হতভম্ব হয়ে সায়েবের দিকে তাকিয়ে রইল।

ওয়ালিক তার পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, দেড়শো টাকা ডিবে হামি, ছেলের সাডি ডেও টুমি, হাঁ উকো টুমার কাম শিখাও, অওর দু-চারটে ছোক্রাকে কাম বুঝাও।

কেদার আবেগে ওয়ালিকের হাত ধরে বলল, ভগমান তোমাকে রাজা করবে সায়েব। একটা ঘর তুলতে পারলে আমার ছেলের বে আটকাবে না।

হঠাৎ ভীমগর্জনে একটা শব্দ করে মেশিন চলতে আরম্ভ করল। ওয়ালিক ও কেদার বিস্মিত আনন্দে নারানকে জড়িয়ে ধরল।

নারান এই প্রথম নিজের হাতে মেশিন চালাল।

ওয়ালিক বলল কেদারকে, টুমার সাকরে আছে।

কিন্তু নারান কপাল থেকে ঘাম ঝেরে ফেলে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

কেদার বলল, চললি যে?

নারান বলল, ভাল লাগে না। গাঁয়ের চটকল হলে সেখেনে কাজ করব। এখেনে আর থাকব না।

ওয়ালিক বলল, কেনো কী তখলি আছে আমাকে বোলো।

নারান একবার সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে চলে গেল। ওয়ালিক আর কেদার পরস্পরের দিকে বিস্মিত-চোখে তাকিয়ে রইল।

নারান বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল অধরার ছেলে মদন মাঠের উপর দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই মদন কাছে ছুটে এল।

নারান বলল, কী রে মদ্‌না?

মদন নারানের হাত দুটো ধরে বলল, নারান, ভাই, কাতু কোথা? আমি সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি। আমি এখেনেই থাকব, কাতুর কাছে। আর সেখেনে যাব না।

নারান তার কাছে তাদের বাড়ি ও গ্রামের সব কথা খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে তারপরে বলল, কাতুর কাছে থাকবি?

মদন বলল, হ্যাঁ। মা আমাকে আর এট্টা বে দিইচে। সে বউকে আমার ভাল লাগে না।

এ বউকে ভাল লাগবে? বলে বিচিত্র হেসে নারান তাকে কারখানার দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে কাতুর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

এমন সময় রবার্টস বাইরে এসে মদনকে দেখে বলল, কেয়া, কাম মাংটা?

মদন বলল, না, কাতু কোথায় সায়েব, কাতুমণি?

কাতুমণি? অন্ডর দেখো। বলে রবার্টসন কুঠির দিকে চলে গেল। মদন এক পা এক পা করে ভিতরে গিয়ে মেশিন চলা দেখে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ এমন দাঁড়িয়ে থাকত বলা যায় না। হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে তার সম্বিত ফিরল। দেখল কাতু দাঁড়িয়ে তার সামনে।

কাতু বলল, মরণ! এখানে কী করতে এসেছ?

মদন আবেগে আনন্দে বলে উঠল, তোর কাছে। আমি তোর কাছে থাকব, মাকে ছেড়ে এসেছি আমি।

কেন, আর একটা বউ রয়েছে যে?

থাকুক, সে আমার কেউ নয়।

আশ্চর্যরকম গম্ভীর হয়ে কাতু বলল, মিসে জানো না, আমি খারাপ মেয়েমানুষ?

মদন বলল, সে তো মায়ের দোষে।

সেদিন বোঝোনি সে কথা?

করুণ মুখে মদন বলল, মাকে তো তুই চিনিস্‌।

কাতু বলল, কিন্তু আজ আর মায়ের দোষে নয়, আমি খারাপ হয়ে গেছি একেবারে।

উদ্বেগে আবেগে অস্থির গলায় মদন বলল, খারাপ হলেও মদন তো তোর পর নয় কাতু। তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।

কাতু বাবুলোকের প্রেম-পিরিতের কথা শুনেছে কিন্তু তার রীতি দেখে ওই বস্তুটির তার কাছে ঘৃণিত ও ক্লেদাক্তই মনে হয়েছে। কিন্তু মদনের এ পিরিত যেন সৃষ্টিছাড়া। এও কি তবে পিরিত! চোখ ফেটে জল আসতে চাইল তার। ভাবল, এ মুখপুড়ীর জন্য ও আবার কোন মানুষের প্রাণ পোড়ে?বলল, তোমার পান চাইলে কেন থাকবে না? তুমি রাখতে পারোনি আমাকে এবার আমিই তোমাকে রাখব।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress